সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

মার্চ ১, ২০২৫

“মধুর তোমার শেষ যে না পাই”

পৃথিবীর প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ইতিহাস অনুসন্ধান করলে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে একটি বিশিষ্ট খাদ্যাভ্যাসের ধারা লক্ষ করা যাবে। বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে বাংলার অধিবাসীদেরও মধ্যেও এমন এক বিশিষ্ট খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে, যার সঙ্গে উপমহাদেশের বাকি অংশের সঙ্গে মিল থাকলেও অপ্রতিমতাও লক্ষণীয়। পাহাড় থেকে সাগর, নদী আর হাওর দিয়ে ঘেরা বাংলার সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত খাবারের মধ্যে যেমন আছে বহুবিধ মাছ, মাংস, শাক, সব্জির সমারোহ, তেমনই আছে মিষ্টান্নের অভিনবত্ব। বাংলার জনমানসের সৃষ্টিশীলতা প্রতিফলিত হয়েছে বাংলার মিষ্টিতে; শিল্পীর হাতের ছোঁয়া আর বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে বাংলার মিষ্টির নান্দনিকতা ও ঔৎকর্ষ আজ সারা দক্ষিণ এশিয়ায় সমাদৃত, বিশ্বে প্রতিভাত। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার কারিগরদের যে অনলস মেহনত ও বুদ্ধিদীপ্ত আবিষ্কারের ফলে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সেই ইতিহাস নিয়ে বিদ্বৎসমাজে এখনও পর্যন্ত খুব কমই চর্চা হয়েছে। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এই দিকটি নিয়ে এখনও বিশেষ গবেষণার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আদি-মধ্যযুগে রচিত চর্যাপদের সময় থেকেই বাংলার সাহিত্যে এই ভূখণ্ডের মিষ্টান্ন নিয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় রচিত বলে অনুমিত নৈষধচরিতেও এই কালপর্বের মিষ্টান্নের উল্লেখ রয়েছে। অন্ত-মধ্যযুগের বাংলায় রচিত সংস্কৃত স্মৃতিগ্রন্থ, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল বা অন্যান্য মঙ্গলকাব্য এবং চৈতন্যচরিতামৃত থেকে সেই সময়কার বাংলার মিষ্টান্নের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে প্রাগাধুনিক বাংলার মিষ্টান্ন সম্পর্কে লেখা হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলার সবচেয়ে পরিচিত মিষ্টি লাড়ু বা নাড়ু বাংলার প্রবাদ, প্রবচনেও স্থান করে নিয়েছে। নারকেল বা অন্য শস্য ও গুড়ের সহযোগে তৈরি এই মিষ্টি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যত্রও পাওয়া গেলেও বাংলার নাড়ুর স্বাদের স্বকীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলায় দুগ্ধজাত পদার্থ থেকে মিষ্টান্ন নির্মাণের ইতিহাস অনেক দিনের। দুধকে ফাটিয়ে ছানা তৈরির খাদ্য প্রাযুক্তিক ধারণা মধ্যযুগের পূর্ব ভারতে প্রচলিত থাকলেও বাংলায় আগত ইউরোপীয়দের কাছ থেকে আয়ত্ত করা নতুন প্রযুক্তি বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পের এমন এক আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে যে আজ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের কাছে ছানা দিয়ে তৈরি মিষ্টি বাঙালি মিষ্টি নামেই অধিক পরিচিত।

অষ্টাদশ-উনবিংশ শতক থেকে বাংলার মিষ্টি, বিশেষত ছানার মিষ্টির ক্ষেত্রে স্থানিক বিশেষত্বের কারণে কারিগরদের বাসভূমির স্থাননামের সঙ্গে মিষ্টির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নাম যুক্ত হয়ে পরিচিত হতে শুরু করে। নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, জনাইয়ের মনোহরা, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া ও সরভাজা, জয়নগরের মোয়া বা নবদ্বীপের মিষ্টি দই (বা লাল দই) আজও আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত নাম। লেডিকেনি আজও বাংলায় দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। রসগোল্লা আধুনিক যুগের বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতীক, তাই এর সঙ্গে একাধিক স্থাননাম যুক্ত, তবে রসগোল্লার সঙ্গে কলকাতার বাগবাজারের নাম সর্বাধিক জনপ্রিয়। বাংলার ক্ষেতের বিভিন্ন ধরনের শস্য, দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্য, ফল, চিনি বা গুড়, এই সবের সংমিশ্রণে ‘ময়রা’ নামে পরিচিত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের তুখোড় কারিগররা বিগত কয়েক শতক ধরে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ মিষ্টান্ন সৃষ্টি করেছেন তাদের নির্মাণ প্রযুক্তির ইতিহাস নিয়ে এখনও পর্যন্ত খুব কমই চর্চা হয়েছে।   

১৩০৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে বাংলার মিষ্টান্ন রন্ধনশিল্প নিয়ে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় ‘মিষ্টান্ন পাক’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তারপর, বাংলার মিষ্টান্ন নির্মাণ নিয়ে বাংলায় কয়েকটি বই লেখা হলেও কারিগরি বা কারিগরদের আর্থিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশেষ লেখা হয়নি। বাংলার মিষ্টান্ন কারিগরির ইতিহাস নিয়ে যাতে আরও অনেক লেখক বাংলা ভাষায় লেখেন, সে জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। উপমহাদেশের মিষ্টান্ন সংস্কৃতির ইতিহাসের ব্যাপক প্রেক্ষাপটে বাংলার বিশিষ্টতা সম্পর্কেও সচেতনভাবে অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ইতিহাস তথ্য ও তর্ক গোষ্ঠী রন্ধনশিল্পের ইতিহাস চর্চাকে সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে মনে করে। তাই আগামী দিনে বাংলার সংস্কৃতির অনন্যতার বাহক মিষ্টান্নশিল্পের ইতিহাস চর্চার প্রসারের জন্য প্রচেষ্ট হবে।