সম্পাদকীয়
পৃথিবী তবুও ঘুরছে, ঘুরবেও–
কোনো গর্ভবতী মহিলা যদি পুত্রসন্তান লাভ করতে চান, তবে বটপাতার রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে ডানদিকের নাক দিয়ে টানলেই তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হবে।
—না, এটা কোনো ওঝা বা গুনিনের নিদান বা অর্থহীন পাগলের প্রলাপ নয়। ভারতবর্ষের তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্বয়ং এই নিদান দিয়েছিলেন। তাও কোনো হেলাফেলার সমাবেশে নয়, ১১ মে ২০০১ প্রযুক্তি দিবসে নয়াদিল্লিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক আয়োজিত এক প্রদর্শনী উদ্বোধনের সময় মন্ত্রী মহোদয় এই মূল্যবান পরামর্শটি কোটি কোটি দেশবাসীকে বিতরণ করেছিলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ১২ মে ২০০১ তারিখে ‘পুত্রলাভে যোশীর সূত্র’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়।
কোনো মহিলা গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে যায়। একবার গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার পর নাক দিয়ে বটের রস আর দুধের ককটেল হোক বা অন্য কোনো দাওয়াই ব্যবহার করেই হোক, গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটি এখন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও জানে। মাননীয় মন্ত্রী কোনো নিরক্ষর বা অশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি পদার্থবিদ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তবু তিনি বিজ্ঞানের সমস্ত তথ্য, প্রমাণ ও পদ্ধতিকে নস্যাৎ করে পরিপূর্ণ অবিজ্ঞানের কথা বলেছেন, সামান্যতম দ্বিধা বা সঙ্কোচের কোনো লক্ষণই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। এই অবিজ্ঞান-অপবিজ্ঞানের কথার আরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে জ্যোতিষ বিদ্যার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু করার বিষয়ে ওই মন্ত্রীর একান্ত উদ্যাগের মধ্য দিয়ে।
বছর ছয়েক আগে (২০১৭ – ২০১৮) মুম্বাইতে সর্বভারতীয় বৈদিক সম্মেলনে তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন ডারউইনের বিবর্তবাদের নাকি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। স্কুল-কলেজের পাঠক্রম থেকে এই তত্ত্ব বাদ দেওয়া যায়। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনোই বানর থেকে মানুষে রূপান্তরিত হননি, ডারউইন নিজেও জঙ্গলে গিয়ে বানরকে মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেননি ইত্যাদি, ইত্যাদি। ২০১৯ সালে ১০৬তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সময় অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাগেশ্বর রাও গোল্লাপল্লি দাবি করেছিলেন, হিন্দুদের দশাবতার তত্ত্ব ডারউইনের চেয়ে বিবর্তনের ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছে। আর দশাবতারের তত্ত্বটি যেহেতু হিন্দুদের রক্তপ্রবাহের মধ্যে রয়েছে তাই ভারতবর্ষের প্রতিটি স্কুলে এইটি পড়ান উচিত। সুরেন্দ্র জৈন, একটি মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মকর্তা, আরও এক পা বাড়িয়ে বলেছেন, ডারউইনের তত্ত্ব ধর্মের পরিধিকে সীমিত করেছে, এটা নাকি কল্পনাপ্রসূত, আর তাঁরা দশাবতারের প্রমাণও পেয়েছেন। কাজেই এই দশাবতার তত্ত্ব শুধু হিন্দু ছাত্রদের নয়, ভারতের সমস্ত ছাত্রকে শেখান উচিত—এটা শুধু পৌরাণিক কাহিনী নয়, ইতিহাসও বটে।
এ বিষয়ে আরও অগ্রগতি ঘটেছে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং’ (এন সি ই আর টি)-এর হাত ধরে। এরা দশম শ্রেণীর পাঠক্রম থেকে বিবর্তন বিষয়ক অধ্যায়টি বাদ দিয়েছে। শুধুমাত্র যারা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে জীব বিজ্ঞান পড়বে, তাদের জন্য পাঠক্রমে বিবর্তন অধ্যায়টি থাকবে। এর ফলে দশম শ্রেণীর শেষে এসেও অর্থাৎ ১৬ বছর বয়সে ছাত্রছাত্রীরা বিবর্তন বিষয়ে কিছুই জানবে না। ছাত্রছাত্রীদের মনেকৈশোরপ্রাপ্তির পরে যুক্তিনিষ্ঠ প্রশ্নের জন্ম হয়, তারা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহী হয়। যে বিষয় ছাত্রছাত্রীদের বৈজ্ঞানিক মেজাজ এবং যুক্তিপূর্ণ চেতনা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়েই সিলেবাস থেকে বিবর্তন বিষয়টি ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস’ অনুষ্ঠিত হত। দেশের বিজ্ঞানীরা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতেন। এই অনুষ্ঠানে দেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী বক্তৃতা দিতেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশ কোন পথে চালিত হচ্ছে এবং আগামী দিনে কীভাবে চালিত হবে তার একটা রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ব্যক্ত করতেন। এখানে বিগত প্রায় এক দশক ধরে দেখেছি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে ‘ও নতুন কিছু নয়’ এমন একটা ধারণা দেবার চেষ্টা চলেছে। এইসব অবৈজ্ঞানিক ধারণা সাধারণ মানুষকে যে শুধু বিভ্রান্ত করে তাই নয়, অপবিজ্ঞান প্রচারে দেশের সম্মান লঘু হয়। আমাদের সংবিধানে দেশের মানুষের সাইন্টিফিক টেম্পার বা বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির যে কথা বলা হয়েছিল, আজ সেটা তলানিতে ঠেকেছে। ১০৯ বছর ধরে চলা বিজ্ঞান কংগ্রেস গত বছর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি উৎসাহের অভাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অন্তর্গত সংস্থা, ‘বিজ্ঞান প্রসার’, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে—এরা দেশের মানুষের কাছে বিজ্ঞানের কথা পোঁছে দেওয়ার কাজ করত। দেশের শাসক হিন্দুদের নানা পৌরাণিক চিন্তাভাবনাকে বিজ্ঞানের মোড়কে, ইতিহাসের মোড়কে মুড়ে দিতে তৎপর হয়েছে।
ভারতবর্ষে বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। চার্বাক দর্শন এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা চর্চার ক্ষেত্রে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, রামমোহন রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, সেই আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেছেন অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা প্রমুখরা। পরবর্তীকালে সেই ধারাই নিয়ে চলেছেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যরা। ভারতীয় ঐতিহ্যে অনিশ্বরবাদী, সংশয়বাদী, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী চিন্তাধারার কোনো অভাব নেই বরং সেইটি অন্যান্য পুরানো সভ্যতা থেকে অনেক বেশি আছে৷ কিন্তু শাসক দেশের বহুত্ববাদের এই ধারণাটাকে যেন নস্যাৎ করে দিতে চাইছে।
বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রের সরকার ঘোষণা করলেন ‘পঞ্চভূত’ রক্ষায় তারা দেশ জুড়ে আলোচনা, মিছিলের আয়োজন করবেন। এজন্য দেশের, মূলত কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, তারা ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিলেন। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক, ডিপার্টমেন্ট অফ স্পেস সাইন্সেস এবং প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসার-এর মাধ্যমে এই ‘পঞ্চভূত’ চর্চার আয়োজন করা হয়েছিল। ‘সুমঙ্গলম’ নামে ‘পঞ্চমহাভূত’ বক্তৃতামালার উদ্দেশ্য হিসেবে তাদের যুক্তি ছিল—সৃষ্টির আদি পদার্থ হচ্ছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম। এই পাঁচ পদার্থকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই আলোচনা। দেশের বিজ্ঞানমনষ্ক বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা জানি মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১০০-র বেশি।
বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ প্রকৃতি ও পৃথিবীকে রক্ষা করার বার্তাকে বিরোধিতা করে না। প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্যকেও তারা অস্বীকার করেন না। তবে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নাম করে মিথকে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞানের তকমা দিতে চাইছেন—সেটা আশঙ্কার বিষয়।
অতীতে দেশের প্রধানমন্ত্রী গণেশের মাথায় হাতির মাথা বসানোকে প্লাস্টিক সার্জারির সঙ্গে তুলনা করেন। আই আই টি, খড়গপুর-এর অধিকর্তা যখন রাবণের পুষ্পক রথকে পৃথিবীর প্রথম বিমান বলে আখ্যা দেন, তখন আমরা এইসব ‘কাল্পনিক বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যায় শঙ্কিত হই। এইসব উদ্দেশ্যমূলক ‘পৌরাণিক বিজ্ঞানচর্চা’ আসলে আমাদের পিছনের দিকেই ঠেলে দেয়। ইতিহাস ও বিজ্ঞানের চর্চাকে গুরুত্বহীন করে তোলে। এইভাবে পিছিয়ে যেতে যেতে একদিন কিন্তু সমাজ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে পিছিয়ে পড়বে।
বিজ্ঞানকে দমিয়ে রাখা যায় না, একথা ইউরোপ জেনে গেছে কয়েক শত বছর আগে—
‘চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও লিখে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না।
পৃথিবী তবুও ঘুরছে, ঘুরবেও যতই চোখ রাঙাও না।’
আমরাও হয়তো জানব, তার জন্য মূল্য ধরে দিতে হবে কি?