সম্পাদকীয়

সংকটময় সময় এবং ইতিহাস তথ্য ও তর্ক গ্রুপ
আমরা প্রবেশ করেছি এক নতুন যুগে। বলা যেতে পারে অযৌক্তিক উপায়ে যুক্তিবিরোধিতার যুগ। যুক্তিবাদের পরিবর্তে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে যুক্তিবিরুদ্ধতাকে। যুক্তিবাদের উপর এই আক্রমণ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। মনে পড়ে যায় হিটলারের উত্থানের প্রেক্ষিত নিয়ে লেখা হাঙ্গেরির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক গেওর্গ লুকাচের বিখ্যাত বই ‘ডেস্ট্রাকশন অফ রিজন’।
‘যুক্তির ধ্বংস’ শিরোনামে লেখা এই বইতে লুকাচ দেখিয়েছেন, জার্মান জনগণ, যাঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী দর্শনের উত্তরাধিকারী, তাঁরাও কীভাবে আত্মস্থ করলেন অযৌক্তিক নাৎসি দর্শনকে। তাঁর ব্যাখ্যায়, এটা সম্ভব হয়েছে যুক্তিবাদের ধারাবাহিক বিনাশের মধ্য দিয়ে। আর এভাবেই যুক্তিবাদকে হটিয়ে জায়গা করে নিয়েছে যুক্তিবিরুদ্ধতা। এমন এক মনন তৈরি হয়েছে যা শেষে অবলীলায় মেনে নিয়েছে ফ্যাসীবাদকে। লুকাচ এই লেখা যখন শুরু করেন, হিটলার তখন ক্ষমতায় আর শেষ করেন সেই সময় যখন ঠাণ্ডা যুদ্ধ তুঙ্গে। লুকাচের মৌলিক তত্ত্ব ছিল, ‘যুক্তিবিরুদ্ধতা হল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে একটি যুদ্ধে হারানো গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেই মতাদর্শ ধ্বংস হয়নি। শুকিয়ে যাওয়া শ্যাওলার মতো অপেক্ষা করছিল উপযুক্ত জল সেচের অপেক্ষায়, যাতে আবার সতেজ হয়ে উঠতে পারে। আজকের বিশ্বায়ন তাকে আবার সেই সুযোগ করে দিয়েছে। অভূতপূর্ব অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক শোষণ—ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা অপরিসীম বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি, ধর্মীয় ও জাতিগত অসহিষ্ণুতা, চরম স্বার্থপরতা এবং নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়—এই পরিস্থিতিতে আপামর সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে এক কঠিন পরিস্থিতি। পাশাপাশি যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধের শত্রুদের বিকশিত হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে এক উন্মুক্ত পরিবেশ। যুক্তিবিরুদ্ধতার মতাদর্শের প্রবর্তকরা সুসংগঠিত, অপর্যাপ্ত অর্থ ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন এদের সহায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের জন্য বিপজ্জনক মতাদর্শ সুকৌশলে মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজের প্রত্যন্ত অংশেও। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা সাম্য, যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে অন্যরকম সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় তারা প্রত্যাশিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
আমাদের দেশে শুধু নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও দেশবাসীর মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, সম্প্রীতির সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রচারের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা এই দুষ্ট শক্তির কাছ থেকে কঠোর প্রতিরোধ ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হচ্ছেন।
বিপজ্জনক এই অযৌক্তিক দর্শন থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য প্রতিদিন আরও জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাকার মানুষেরা এই কাজ করে চলেছেন—তবে তাঁরা এই মুহূর্তে সংখ্যায় অল্প।
মনে রাখা দরকার, এই যুদ্ধ আমাদের পরিবারের ভিতরে, এমনকী কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গেও করে যেতে হবে। সংকটময় সময়ে মানুষের মধ্যে যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ দায়বদ্ধ থাকবে।