ঔপনিবেশিক আমলে শ্রমিক আন্দোলন থেকে নারী মুক্তির পথে বর্ধমান জেলা
সূচনা
বৃহত্তর তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে ভারতের নারীরা জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাদের স্বাধিকারের লড়াই শুরু করেন। জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের সূত্র ধরেই বাংলা প্রদেশের অন্যতম জেলা বর্ধমানের নারী সমাজ অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হন। অহিংস আন্দোলনের এই পরিসর ছাড়িয়ে বিপ্লবী আন্দোলনেও বর্ধমানের নারীরা অগ্রসর হন। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার এই আন্দোলন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের গণ্ডি অতিক্রম করে কখনওই নিম্নবিত্ত, গরিব কৃষক রমণী থেকে নারী শ্রমিককে স্পর্শ করেনি। অথচ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সব থেকে শোষিত অংশ রূপে নারীরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম শোচনীয় শিকার। রুশ বিপ্লব সঞ্জাত সমাজতন্ত্রের আদর্শ যে নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দিক নির্দেশ করছিল ও ভবিষ্যতে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিশ্বাস তৈরি করেছিল তার ভিত্তিতে বর্ধমানেও বাম রাজনীতির বিকাশ হয়। এই নতুন রাজনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে সমাজের প্রান্তিক শ্রমিকের আশু সমস্যাকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে বিবিধ প্রকার গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। আলোচ্য নিবন্ধ এই নিচু তলার মানুষের আন্দোলনের অন্যতম অংশ রূপে নারী শ্রমিকের আন্দোলনকে বর্ধমান জেলায় নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নারী, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই প্রেক্ষিতে বর্তমান নিবন্ধে নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকে শ্রমিকের সকল দাবি-দাওয়ার লড়াইয়ের সাথি রূপে দেখে সামগ্রিক সমাজের স্বার্থে বর্ধমান জেলায় নারী মুক্তির আন্দোলনকে অনুসন্ধান করা হয়েছে।
বর্ধমানের পশ্চিমাঞ্চলে খনি ও শিম্পাঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নারী শ্রমিক
বর্ধমানের পশ্চিম দিকে কুমারডুবি, আসানসোল, রানিগঞ্জ, বার্নপুর-কুলটি ছিল সমৃদ্ধ কয়লা খনি এলাকা ও শিল্প কারখানা অঞ্চল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রানিগঞ্জের কয়লাখনি এলাকায় ভারতে প্রথমবার বাণিজ্যিক ভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের সামাজ্যবাদী স্বার্থ সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় ইস্কো ও অন্যান্য সহযোগী কারখানা। আসানসোল, রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চল ও খনিতে কর্মরত এই শ্রমিকেরা অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকে আসা বাগদি, বাউরি প্রমুখ তপশিলি সম্প্রদায়ের ও সাঁওতাল, কোল, কোড়া, মুণ্ডা, নুনিয়া, বেলদার ইত্যাদি আদিবাসী সমাজের প্রান্তিক সমাজের অধিবাসী ছিলেন। এ ছাড়া বিহার, উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও দক্ষিণ ভারত থেকেও দোসাদ, ভুঁইয়া, চামার, গোয়ালা সমেত বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও সম্প্রদায়ের শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে আসতেন। এই শ্রমিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল নারী শ্রমিক। শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের এই অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় প্রাথমিক ভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সব থেকে শোষিত অংশ রূপ মহিলারা পরিবার পুরুষদের আয়কে কিছুটা বাড়ানোর প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। কারণ বৃহত্তর ক্ষেত্রে সারা বিশ্বেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় শিল্পমালিকের স্বার্থে অত্যন্ত স্বল্প মজুরিতে নারীদের নিয়োগ করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজনে তাঁদের ধারাবাহিক যোগানকে সুনিশ্চিত করা হত।১ মনে রাখতে হবে কেবলমাত্র কর্মক্ষেত্রেই এই বিভেদ ছিল না। কারখানায় সব থেকে অদক্ষ, কম মজুরির কাজের সঙ্গে বাড়িতেও তারা সকল ধরণের পরিশ্রমসাধ্য দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।২ আসানসোল-রানিগঞ্জ শিল্প কারখানা ও খনিতে নারী শ্রমিকের মত তপশিলি ও আদিবাসী পুরুষ মজদুররাও একই ভাবে সব থেকে অদক্ষ, সুরক্ষাহীন কাজের সঙ্গে যুক্ত হতেন যা ছিল ভারতের সামগ্রিক শিল্প ক্ষেত্রের একটি প্রতিফলন।৩ প্রধানত অশিক্ষা ও দারিদ্র সমাজের সব থেকে শোষিত এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তার অংশ রূপে নারী মজুরকে কম বেতনের নিম্নমানের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য করেছিল।
মূলত ১৯৩৬ সাল থেকে এই অঞ্চলে জোরালো ভাবে সূচিত নির্বাচন ভিত্তিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের জীবন যাপনের মানের উন্নয়নের স্বার্থে লড়াই শুরু হয়। এই ক্ষেত্রে বিশেষত নারী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত করতে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি অগ্রণী ভূমিকা নেয়। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখা যায় ইংল্যান্ড, জার্মানীর মত শিল্প শহরগুলির সূচনায় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাবেই নারী শ্রমিকরা প্রাথমিকভাবে পুরুষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন দাবি ভিত্তিক রাজনৈতিক লড়াইয়ে অংশ নেন।৪
১৯২১-২২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আসানসোল কুলটি এলাকায় বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস কারখানায় ১১০০০ শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেন ও মালিক পক্ষকে দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করেন।৫ শ্রমিকদের এই লড়াই অর্থনৈতিক দাবিভিত্তিক হলেও জাতীয় আন্দোলনের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে শ্রমিকরাও যে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সচেতন হয়ে ওঠেন তা এর থেকে স্পষ্ট হয়। কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক চেতনার অভাবে ১৯৩০-এর দশকের আগে পর্যন্ত কোনও লড়াই শ্রমিকের অধিকারকে দৃঢ়মূল প্রতিষ্ঠা করতে পারনি। ১৯২৯-৩৪ সাল জুড়ে সারা পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় তার ফলে ভারতেও শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতন হ্রাস ও ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ১৯২৯ সালের মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের গ্রেপ্তার ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিকদের সাথে তাদের মতাদর্শগত লড়াইয়ে শ্রমিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৩৪ সালের পর এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। এই সময় বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে যে মন্দা চলছিল ১৯৩৪ সালের পরে সেই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহাল, বেতন বৃদ্ধি, কাজের সময় হ্রাস, ও ১৯৩৫ সালের এআইটিইউসি (নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) সম্মেলনের প্রস্তাব অনুসারে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় আসানসোল-রানিগঞ্জের পরিস্থিতি এর থেকে কিছু আলাদা ছিলনা।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করে। এই নির্বাচনে শ্রমিকদের আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি হয়েছিল। সেই কারণে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য শ্রমিক কমিটি তৈরি করে। কংগ্রেসের নির্বাচনি ইস্তাহারেও শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার ও নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষিত করার ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এইভাবেই আসানসোলের শ্রমিক আসনে বামপন্থী শ্রমিক নেতা বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়কে কংগ্রেস সমর্থন জানায় ও তিনি জয়লাভ করেন।৬ নির্বাচনে বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের মত র্যাডিকাল প্রার্থীর জয় এই অঞ্চলের শ্রমিকদের মধ্যেকার আধা সচেতন রাজনৈতিক উপলব্ধিকে তুলে ধরেছিল যা শ্রমিকদের শ্রেণিগতভাবে সংঘবদ্ধ হতে পরবর্তীকালে সহায়ক হয়েছিল। প্রদেশগুলিতে জনপ্রিয় সরকার ও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতারা জয় লাভ করায় শ্রমিকদের মধ্যে এই বিশ্বাস ক্রমশ জোরালো রূপ নেয় যে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের দাবিগুলি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। আসানসোলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট ও লেবার পার্টির সাথে কংগ্রেসের ধারাবাহিক প্রচার শ্রমিকদের মনে এই ধারণার সঞ্চারে সাহায্য করে। নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, অনন্ত মুখার্জী, শান্তিরাম মন্ডল প্রমুখ শ্রমিক নেতৃত্বের বক্তব্যের মাধ্যমে শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা হয় যে তাঁরা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান শক্তি। রাজনৈতিক প্রচারের মাধ্যমে তাদের শ্রেণি সচেতন করে দেশের মুক্তি আন্দোলনে তাদের তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থানকে ব্যাখ্যা করা হয়। এই প্রেক্ষিতে আইনসভায় বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের শ্রমিকদের প্রতিনিধি রূপে জয় লাভ এই অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। মূলত ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত আপাত শান্ত আসানসোল-রানিগঞ্জ এরপর থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদে ও ন্যায্য অধিকারের দাবিতে ক্রমশ সোচ্চার হয়ে ওঠে।
১৯৩৭ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি বার্নপুরে শ্রমিকরা প্রথমবার বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার দাবিতে এক ঘন্টার প্রতীকী ধর্মঘট করেন।৭ ১৯৩৭-৩৮ সালে কুলটি ও বার্নপুর অঞ্চলে শ্রমিকদের ওপর জামশেদপুর লেবার ফেডারেশনের নেতা মানেক হোমির একটা প্রভাব ছিল।৮ প্রায় একই সময় ১৯শে জুন থেকে কুলটির মার্টিন-বার্ন কোম্পানিতে ধর্মঘট শুরু হয়। এখানে শ্রমিকেরা ছাঁটাই হয়ে যাওয়া ৩০ জন পাঞ্জাবি শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগ ও মানেক হোমির নেতৃত্বে লেবার ফেডারেশন গঠনের দাবিতে এই ধর্মঘট শামিল হন।৯ এই ধর্মঘট ইউনিয়ন তৈরির দাবিতে করলেও শ্রমিকরা এক্ষেত্রে হোমির সঙ্গে কোন পরামর্শ না করেই অসংগঠিত ভাবেই তাঁদের লড়াই গড়ে তোলেন। এর থেকে বোঝা যায় কীভাবে শ্রমিকদের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ত বিদ্রোহের প্রবণতা ছিল যাকে গ্রামশীয় তত্ত্ব অনুসারে নিম্নবর্গীয় শ্রেণী ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রূপ চিহ্নিত করা যায়।১০ কোম্পানির সাথে হোমির আলোচনার মাধ্যমে স্বল্প বেতনভোগী শ্রমিকদের বেতন সামান্য বৃদ্ধি পায়, রাস্তা ঘাট ও শ্রমিক বসতি নির্মাণের আশ্বাস দেওয়া হয় মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা ও অন্যান্য সুবিধা সামান্য বৃদ্ধি পায়।১১ ছাঁটাই শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। শ্রমিকদের এই লড়াইয়ে মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত দাবি ও তার বাস্তবায়ন শিল্পাঞ্চলে নারী শ্রমিকের গুরুত্বকে চিহ্নিত করে। পরবর্তী সময়ে জুলাই মাসে ইস্কোর শ্রমিকদের বিবিধ অর্থনৈতিক দাবি ও ছাঁটাই বিরোধী আন্দোলনের ভিত্তিতে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিই স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি নারী মজুরদের মাতৃত্বকালীন অবকাশের সময় বৃদ্ধি পায়।১২ বার্ন ও ইস্কোয় নারী শ্রমিকদের স্বার্থ সম্বলিত এই দাবি থেকে ভারি শিল্পে নারী শ্রমিকদের জোরালো উপস্থিতি স্পষ্ট প্রতিভাত হয়।
এই পর্যায়ে রানিগঞ্জ পটারি ওয়ার্কসের শ্রমিকদের পরিচালিত আন্দোলন নারী মজদুরদের এই অবস্থানকে স্পষ্ট করে। মেসার্স বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি পরিচালিত রানিগঞ্জ পটারি ওয়ার্কসের অধীনে সিলিকা ওয়ার্কস বা লালকুঠি ও ওয়ার্কস ১ ও ২ নং নামে দুটি কারখানা ছিল। প্রায় ১৪০০০ শ্রমিক এখানে কাজ করতেন যাঁদের অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে আসতেন। ১৯৩৮ সালের শুরুতে বেতন ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে রানিগঞ্জ পটারি ওয়ার্কস ওয়েলফেয়ার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানি বেতন বৃদ্ধি, অসুস্থতা, প্রসবকালীন সুযোগ সুবিধা, অবসরকালীন সুবিধা ও ছুটির নিয়ম নিয়ে এই ইউনিয়নের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। নারী শ্রমিকের প্রসবকালীন ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও ছুটির দাবির মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের লিঙ্গবিদ্বেষ বিরোধী মানসিকতা প্রকাশিত হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন এক্ষেত্রে শ্রমিকদের যৌথ দাবিতে লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী মনোভাব প্রতিফলিত হলেও ঘটনাপ্রবাহ ও বাস্তব সবক্ষেত্রে সমরৈখিক ছিলনা। সেই কারণ ১৯৩৮ সালেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক দাবি ভিত্তিক আন্দোলনের মধ্যেই নারী শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে একজন নারী মজদুরের প্রতি চারজন পুরুষ শ্রমিকের অশালীন আচরণের বিরুদ্ধ রুখে দাঁড়ান।১৩ সীমিত শক্তি নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই মানসিকতার মধ্যে দিয়ে তাঁদের মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ লক্ষিত হয়। এই নারী মজুররা, যাঁরা প্রাথমিক সচেতনতার নিরিখে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের ভূমিকাকে গ্রামশীয় দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের ইতিহাস চেতনার একটি ওতপ্রোত অংশ রূপে বিশ্লেষণ করা যায়।
এই পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রেণি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব নির্মাণের লড়াইয়ে রানিগঞ্জ বল্লভপুর পেপার মিল আন্দোলন একটি বিশেষ অধ্যায় যেখানে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৩৮ সালে নির্বাচন উত্তর অনুকূল পরিবেশে বেঙ্গল লেবার পার্টি ছেড়ে আসা কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতা নিত্যানন্দ চৌধুরীর উদ্যোগে বার্ণপুরে নরসিংহপুরে কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন ট্রেড ইউনিয়ন কাৰ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।১৪ ১৯৩৮ সালের ১৩ই নভেম্বর মোট ১৬০০ শ্রমিকের মধ্যে ১৩০০ জন শ্রমিক বেতন বৃদ্ধি, সবেতন অসুস্থতাকালীন ছুটি, প্রভিডেন্ড ফান্ড, বোনাস, পেনশন, ফ্যাক্টরি আইন অনুসারে কারখানায় কাজের উন্নত পরিবেশের ব্যবস্থা, নতুন শ্রমিকের একবছরের পর স্থায়ীকরণ ও বেঙ্গল পেপার মিল ওয়ার্কসের ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতির দাবিতে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন।১৫ প্রথম দু’ দিন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলার পর কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাহায্যে মুষ্টিমেয় কিছু অনুগত শ্রমিক দিয়ে কারখানা চালানোর সিদ্ধান্ত নয়। ধর্মঘটীরা কারখানার প্রবেশ পথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪ই নভেম্বর মিল কর্তৃপক্ষের তরফে ম্যানেজার লো এবং সাহেব ইঞ্জিনিয়ার ব্রাউন ধর্মঘট ভাঙার জন্য লরিতে বাইরে থেকে কিছু অনুগত শ্রমিককে কারখানায় ঢোকানোর চেষ্টা করে। শ্রমিকরা বাধা দেন ও সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লরিটিকে আটকানোর জন্য বাম্পার ধরে দাঁড়িয়ে পড়েন। পাঞ্জাবি চালক ইতস্তত করলেও ব্রাউন সাহেব লো সাহেবের আদেশে লরি এগিয়ে নিয়ে গেলে সুকুমার চাপা পড়ে নিহত হন।১৬ তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু সারা বাংলা তথা দেশের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সরকারি তদন্তে এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসাবে দেখানো হয়। এই পরিস্থিতিতে নারী শ্রমিকরা ধর্মঘটে বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। দাসী বাউড়িয়া, ভগবন্তিয়া, যশোবন্তিয়া, প্রমুখের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড় ওঠে। শ্রমিক আন্দোলনের এই চরম মুহূর্তে শ্রমিক পরিবারগুলি যখন এক বিরাট আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখন নারী শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফুর্ত ভূমিকা থেকে বোঝা যায় তাঁরা এই লড়াইয়ে সর্বহারা মহিলা রূপে পুরুষদের সহযোগী রূপে এগিয়ে এসেছিলেন। বৃহত্তর ক্ষেত্রে সর্বত্রই সর্বহারা নারী শ্রমিকরা নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এই বিষয়টি উপলব্ধি করেন।১৭ ধর্মঘট ভাঙতে না পেরে মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাহায্যে ধর্মঘটীদের ওপর আক্রমণ হেনে বিভিন্ন দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়।১৮ ২০শে জানুয়ারি উত্তেজিত অবস্থায় পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সূত্রে ২১শে জানুয়ারি শেখর কোঙার, হরিপদ ব্যানার্জী, বিনয় চৌধুরী, নিত্যানন্দ চৌধুরী এবং দাসী বাউড়িয়া, ভগবন্তিয়া, যশোবন্তিয়া ও আরও দু জন নারী শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়।১৯ নারী শ্রমিকরা যে ভাবে নিজেরা এগিয়ে এসে উদ্যোগ নিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন তা শ্রমিক আন্দোলনে তাদের অগ্রণী তথা সচেতন ভূমিকাকেই চিহ্নিত করে। এই ভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নারীরা পুরুষ শ্রমিকদের সহযোদ্ধা রূপে যেভাবে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন তা বল্লভপুরের নারী মজুরদের নিছক নারীবাদী ভূমিকার বাইরে শ্রেণি রাজনীতির লড়াইয়ের অন্যতম যোদ্ধা রূপে গড়ে তোলে।
চারের দশকে শিল্প ক্ষেত্রে নারী আন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলন
এই প্রেক্ষিতে বর্ধমান খনি এলাকায় নারী শ্রমিকের অবস্থানকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কয়লা শিল্পের প্রথম পর্যায় থেকেই মহিলা ও শিশুরা খনিতে কাজ করতে শুরু করছিলেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কয়লা বোঝাইয়ের কাজ নারী শ্রমিকরা সাহায্য করেন। ১৯১৫ সালে প্রতি পুরুষ পিছু ৫-৬ জন নারী শ্রমিককে নিয়োগ করা হত। এই ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় নারী শ্রমিকের শ্রমমূল্যকে নিছক পুরুষ শ্রমিকের মজুরির অভাব পূরণের মাপকাঠি রূপ প্রতিষ্ঠিত করে খনি মালিকরা শ্রমিকদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বিভেদ তৈরি করে রাখতে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই দেখা যায় পরিবারের সকলেই একই খনিতে কাজ করলেও পুরুষরা প্রতিদিন মজুরি রূপে ৪-৫ আনা পেলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা ছিল মাত্র ১-২ আনা।২০ এছাড়াও নারীরা এককভাবে জল ফেলা, টালোয়ান/ট্রামারের কাজ করতেন।
শুরুর দিকে এই বৈষম্যের প্রতি পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যে কোনও সচেতনতা না থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ১৯৩৬ সাল থেকে বঙ্কিম মুখার্জী, নিত্যানন্দ চৌধুরী প্রমুখ বামপন্থী নেতা, আব্দুর বারির মত কংগ্রেস শ্রমিক নেতা ও রায়পন্থীদের নেতৃত্বে কয়লাখনিগুলিতে শ্রমিকেরা ক্রমশ ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। খনিগুলির প্রধান নিয়ামক ছিলেন ম্যানেজার ও তার নিযুক্ত লোকজন। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নানা কারণে ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া দরিদ্র, ঋণের দায়ে জর্জরিত মানুষদের ভবিষ্যতের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে কোম্পানি নিযুক্ত আড়কাঠি নামে পরিচিত এক দল দালাল খনিতে কাজ করতে নিয়ে আসত। খনিতে এসে ভুল বুঝতে পারলেও ফেরার কোনও উপায় থাকত না। ফলে বিভিন্ন প্ৰদেশ ও ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের নিজস্ব মহল্লা বা ধাওড়া গড়ে তুলতেন। মালিকরাও শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা বজায় রাখতেন। শ্রমিকরা তাঁদের জন্য ধার্য বেতনও সব সময় পেতেন না। কারণ ঠিকাদার ও সর্দারদের তাঁদের বেতন থেকে কমিশন দেওয়া হত। এই বেতনে সারা মাসের খরচ চালানো অসম্ভব হওয়ায় অনেক সময়ই তাঁদের সর্দারদের কাছ থেকে ধার নিতে হত যা কখনও শোধ হত না। জঘন্য পরিবেশ, দেশী মদের দোকান ও বিভিন্ন প্রকার অপসংস্কৃতির মধ্য শ্রমিকদের জড়িয়ে রাখা হত যাতে তাঁদের মধ্যে প্রতিরোধের কোনও ভাবনাই না তৈরি হয়। এই দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে তাঁদের সংগঠিত করার কাজ ছিল যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়েই কমিউনিস্ট, কংগ্রেস ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির উদ্যোগে শ্রমিক সংগঠনের কাজ সূচিত হয়। মালিকদের কাছে শ্রমিকদের মৌলিক পরিচয় ছিল নিম্নবর্গের শ্রেণি রূপে, পৃথিবীর সব দেশের শ্রমিকেরই যা অবস্থান। এই সূত্র থেকেই ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন প্রদেশের হয়েও ধারাবাহিক শোষণের অভিজ্ঞতা থেকে শ্রমিকেরা মালিক শ্রেণীর বিপক্ষে তাঁদের নিজস্ব শ্রেণি অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় শিল্প মালিকেরা যে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে ধর্ম, ভাষা ও জাতি ভিত্তিক বৈষম্যগুলিকে বজায় রাখেন এবং লিঙ্গ বৈষম্যও এর একটি অঙ্গ, ক্রমশ বহু শ্রমিক নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তা উপলব্ধি করেন। কমিউনিস্টদের ধারাবাহিক শ্রমিক স্বার্থবাহী প্রচার সংগঠন শ্রমিকদের ক্রমশ তাঁদের নিজস্ব অবস্থান সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। এর মাধ্যমে তাঁরা ক্রমশ মালিকের ও নিজেদের ভিন্ন শ্রেণি অবস্থান বিষয় সচেতন হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সব বড় শিল্পে মজুরি হ্রাস, ছাঁটাই, কাজের সময় নির্দিষ্ট করাকে কেন্দ্র করে ধর্মঘটের অভিঘাত সৃষ্টি হয়। এই জঙ্গী ধর্মঘট তখনও পর্যন্ত বড় পরিসরে অসংগঠিত কয়লাখনিগুলিকেও প্রভাবিত করে। ১৯৪৬ সালে প্রথমবার কয়লাখনিগুলির শ্রমিকদের মধ্যে সহযোগিতা তৈরি করে কতগুলি সাধারণ সমস্যার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত হয়। সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) এই আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সময় নারী শ্রমিকের অধিকার সংক্রান্ত লড়াই এক বিশেষ মাত্রা লাভ করে। ১৯৪৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে খনির নীচে মেয়েদের কাজ করা বন্ধ হয়। এর ফলে শ্রমিক পরিবারগুলি অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সিপিআই পুরুষ মজুরদের প্রতিদিন ন্যূনতম ১ টাকা মজুরি ও নারীদের পুনরায় কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন বিনা পয়সায় এক সের চাল ও চার আনা ক্ষতিপূরণ ভাতার দাবি করে।২১ এর ফলে নারী শ্রমিকরা বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। মহিলাদের কাজের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বহু বিক্ষিপ্ত ধর্মঘট হয়। শীতলপুর খনিতে সিপিআই-এর নেতৃত্বে সাঁওতাল শ্রমিকরা ৩রা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট করেন এবং ঐ ধর্মঘট ৫ তারিখ পর্যন্ত চলে। খনি মালিক নারী শ্রমিকদের কাজ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে স্বীকৃত হলে ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয়।২২ পৈরী খনিতেও এই ঘটনা ঘটে। তাঁরাও একই প্রতিশ্রুতি পেয়ে কাজে ফেরেন। নারী শ্রমিকের কাজে যোগদানকে কেন্দ্র করে সব শ্রমিকের ধর্মঘট খনি অঞ্চলে কিছুটা হলেও নারী শ্রমিকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। এর পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণকে অস্বীকার না করেও বলা যায় এর মধ্যে দিয়ে শ্রেণিগত লড়াইয়ে লিঙ্গের অধিকার কিছু পরিমাণে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই কমিউনিস্ট আন্দোলনে নারী শ্রমিকদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুরুষ শ্রমিকদের তাঁদের সাথি হিসাবে চিহ্নিত করেন যাঁদের সাথে নারীরা সহস্র অদৃশ্য সুতোয় আবদ্ধ থাকেন।২৩ নারী শ্রমিকদের আন্দোলনে কোলিয়ারিগুলিতে এইসময় এই তত্ত্বেরই স্বার্থক রূপায়ণ লক্ষ্য করা যায়। ফলে বিচ্ছিন্ন নারী আন্দোলনের স্থানে নারীরা শ্রেণি লড়াইয়ের ইতিবাচক দিকের সাথে পরিচিত হন। এইভাবে খনিগুলিতে এই প্রথম সমাজের প্রান্তিক ও উপজাতীয় মানুষদের মধ্যে নিজেদের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে যে লড়াই সূচিত হয় তা তাঁদের মধ্যে সিপিআই-এর পরিচালিত ইউনিয়নকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই আন্দোলনগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়, লিঙ্গ ও ভাষাভাষী সমন্বিত কয়লাখনি শ্রমিকদের কঠোর ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে তাঁদের মধ্যেকার এই সব পার্থক্য ছাপিয়ে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াইয়ে যৌথ সংগ্রামকেই তুলে ধরছিল।
অংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের লড়াই
সংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের লড়াইয়ের পাশাপাশি অসংগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমজীবী নারীরা নিজ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৪৪-৪৫ সাল নাগাদ আসানসোলের পৌরসভার ধাঙড়দের একটি শক্তিশালী ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। এই কাজে বর্ধমানের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্দুমতী দেবী, বরিশালের একজন মহিলা ও বেনারস থেকে আসা মনোরমা দেবী এই ধাঙড়দের ইউনিয়নকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেন।২৪ নারী, পুরুষ নির্বিশেষে ধাঙড়রা মনোরমা দেবীকে দিদি বলে ডাকতেন ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি প্রায় ২৪ ঘন্টাই তাঁদের সঙ্গে থাকতেন ও তাঁদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্দীপিত করে তোলেন। ধাঙড়দের ওপর তাঁর প্রভাব ছিল গভীর। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে পুলিশ মনোরমা দেবীকে গ্রেপ্তার করতে এলে বাসিনী ও অন্য মেয়েরা মাথায় ময়লার বালতি নিয়ে পথ আটকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।২৫ এই ধাঙড়দের নিয়ে মজদুর সঙ্ঘ গড় তুলে তাঁদের মধ্যে বাম রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
উপসংহার
ভারতের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম থেকেই বহুরূপতা ছিল। শিল্পাঞ্চলে কাজ করতে আসা ভূমিহীন চাষী, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা পৃথক জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও ভাষাভাষী সর্বহারা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী শ্রমিকদের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা ছিল। সেই কারণেই ঔপনিবেশিক কালপর্ব থেকেই বর্ধমানের খনি ও শিল্প ক্ষেত্রে নারী মজদুররা গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের আর্থিক সমস্যার সমাধানে পুরুষ শ্রমিকের সহায়তায় অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু পরিবর্তে কর্মক্ষেত্রের অর্থনৈতিক পরিসরে ও কাজের দক্ষতার নিরিখে তাঁরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন। প্রাথমিকভাবে সমাজের প্রান্তিকতম অবস্থানে থাকা নারী সমাজের কাছে এই বিষয়টি কোন প্রশ্ন তৈরি না করলেও ক্রমশ শিল্প ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে নারীরা তাঁদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বর্ধমান জেলার এই আন্দোলন নিছক নারীবাদী আন্দোলনের পরিবর্তে বৃহত্তর শ্রেণি আন্দোলনের অংশ রূপেই গড়ে ওঠে। একদিকে খনি ও শিল্পক্ষেত্রে নারী সহ তপশিলি ও আদিবাসী জনসমাজের প্রান্তিক শ্রমিকদের চরম অসহনীয়, নিম্ন বেতন, অদক্ষ শ্রমের কাজের কারণ রূপে মালিকের বিভেদ বজায় রাখার নীতিকে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। অন্যদিকে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ন্যায্য সুযোগ সুবিধা ও বেতনের ক্ষেত্রে সমতার দাবির লড়াইয়ে পুরুষ শ্রমিককে সাথি রূপে দেখে নিজেদের সামগ্রিকভাবে শোষিত শ্রেণির অংশ রূপে উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই বল্লভপুর আন্দোলনে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক বলদেবের মা শহীদ সুকুমারকে নিজের ছেলে মনে করে তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ স্বাধীনতার পরও নতুন করে আন্দোলন শুরু করার কথা বলেন।২৬ কোম্পানি তাঁকে চাকরি ফিরিয়ে দিতে চাইলেও তিনি কাজ যোগ দিতে অস্বীকার করেন। এই ঘটনা থেকে বল্লভপুরের আন্দোলন শ্রমিকদের মধ্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে শ্রেণি রাজনীতির আদর্শকে কতটা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তা স্পষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিককে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিবর্তে তাঁর অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসা সাথি রূপেই দেখেছে। এইভাবে শিল্প কারখানায় কর্মী ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলারা পুরুষ সহযোগীদের সঙ্গে একযোগে কারখানার নিজস্ব দাবির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে শামিল হন। এর মধ্যে দিয়ে বর্ধমান জেলার গণ-আন্দোলন যেমন পূর্ণতা পায় আবার অন্যদিকে এই গণ-আন্দোলন নারী শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে অণুঘটকের ভূমিকা পালন করে।২৭ এক্ষেত্রে বৃহত্তম প্রেক্ষিতে হবসবমকে অনুসরণ করে বলা যায় যে মেয়েরা যখন তাঁদের অন্দরের গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরের জগতের আন্দোলনে শামিল হন তখন একদিকে তা নারীর ক্ষমতায়নের পথকে উন্মুক্ত করে আবার একই সাথে তাদের রাজনীতিকরণের সুচনা হয়।২৮
পাদটীকা:
১. শমিতা সেন, “উইমেন অ্যান্ড লেবার ইন লেট কলোনিয়াল ইন্ডিয়া: দ্যা বেঙ্গল জুট ইন্ডাস্ট্রি”; কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ইউকে, ১৯৯৯, পৃ. ২২।
২. অমিয় বাগচী, “ক্যাপিটাল অ্যান্ড লেবার রিডিফাইন্ড: ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্যা থার্ড ওয়ার্লড”; তুলিকা বুকস, নিউ দিল্লি, ২০০২, পৃ. xxvi।
৩. ঐ।
৪. এরিক হবসবম, “আনকমন পিপল”; অ্যাবাকাস, লন্ডন, ২০১৩, পৃ. ১৩১।
৫. হোম পলিটিকাল ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্ডিয়া প্রসিডিংস ফাইল অফ এপ্রিল, ১৯২০, পার্ট বি, নং, ১৮৯। সুকোমল সেন, “ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০-২০০০”; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ১২৮।
৬. নির্বাণ বসু, “দ্যা পলিটিকাল পার্টি অ্যান্ড দ্যা লেবার পলিটিক্স ১৯৩৭-৪৭: উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু বেঙ্গল”; মিনার্ভা অ্যাসোশিয়েটস, কলকাতা, ১৯৯২, পৃ. ২৬।
৭. আইবি ফাইল নং ৪৬৫/৩৭ (৪) “লেবার ইউনিয়ন অ্যান্ড অ্যাসোশিয়েশনস ইন বার্ডোয়ান”, পৃ. ৫৫/৭।
৮. ঐ।
৯. হোম পলিটিকাল ফাইল নং, ১০/৩৭, “রিপোর্ট অন দ্যা পলিটিকাল সিচুয়েশন ইন বেঙ্গল ফর দ্যা সেকেন্ড হাফ, মান্থ অফ জুন, ১৯৩৭”, পৃ. ৯।
১০. আন্তোনিও গ্রামশি, “সিলেকশন্স ফ্রম দ্যা প্রিসন নোট বুকস”; ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সোয়ান, নিউ দিল্লি, ২০১০, পৃ. ৬-৮।
১১. হোম পলিটিকাল ফাইল নং, ৬০/৩৭, “স্ট্রাইকস ইন ভেরিয়াস মিলস ইন বার্ডোয়ান”, ১৯৩৭, পৃ. ৪।
১২. ঐ, পৃ. ১৭-২০।
১৩. আইবি ফাইল নং ৪৬৫/৩৭ (৪) “লেবার ইউনিয়ন অ্যান্ড অ্যাসোশিয়েশনস ইন বার্ডোয়ান, হিস্টরি অফ – লেবার ফেডারেশন, ১৯৩৮”, পৃ. ৫১।
১৪. নির্বাণ বসু, “রাণীগঞ্জের শ্রমিক আন্দোলন: একটি বিশিষ্ট অধ্যায় (১৯৩৮-৩৯)”, নির্বাণ বসু সম্পাদিত, “অনুসন্ধানে শ্রমিক ইতিহাস”; সেতু ও পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ২৫০। বিনয় চৌধুরী, “অতীতের কথা কিছু অভিজ্ঞতা” ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫৩। গোপীনাথ দে, “রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়নে বঙ্কিম মুখার্জীর ঐতিহাসিক ভূমিকা”, “বিপ্লবী নায়ক বঙ্কিম মুখার্জী স্মারক সংকলন”; বঙ্কিম মুখার্জী জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, ১৯৯৮, কলকাতা, পৃ. ১১৭।
১৫. হোম পলিটিকাল ফাইল নং, ১০৯/৩৮, “স্ট্রাইক সিচুয়েশন অ্যাট আসানসোল বার্ডোয়ান”।
১৬. আইবি ফাইল নং ৪৬৫/৩৭ (৪) “লেবার ইউনিয়ন অ্যান্ড অ্যাসোশিয়েশনস ইন বার্ডোয়ান, বেঙ্গল পেপার মিল ইউনিয়ন ১৯৩৮”, পৃ. ৪৫। পঞ্চানন সাহা, “হিস্টরি অফ দ্যা ওয়ার্কিং ক্লাস মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল”, পিপলস পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লি, ১৯৭৮, পৃ. ১৭০। বিনয় চৌধুরী, “অতীতের কথা কিছু অভিজ্ঞতা” ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫৩। অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৬/১১/৩৮, পৃ. ১৩। গণশক্তি, ২৪/৬/২০১৩, পৃ. ৪।
১৭. আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই, “সিলেক্টেড রাইটিংস অন উইমেন্স কোয়েশ্চেন” আশিস কুমার দাস সম্পাদিত, সার্চ, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৪।
১৮. আইবি ফাইল নং ৬৬৬/৩৩, “হিস্টরি ফোল্ডার অফ বিনয় কৃষ্ণ চৌধুরী”।
১৯. আইবি ফাইল নং ৬৬৬/৩৩, “হিস্টরি ফোল্ডার অফ বিনয় কৃষ্ণ চৌধুরী”, পৃ. ৯। আইবি ফাইল নং ৪৬৫/৩৭ (৪) “লেবার ইউনিয়ন অ্যান্ড অ্যাসোশিয়েশনস ইন বার্ডোয়ান, বেঙ্গল পেপার মিল ইউনিয়ন ১৯৩৮”, পৃ. ৪৪। পঞ্চানন সাহা, “হিস্টরি অফ দ্যা ওয়ার্কিং ক্লাস মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল”, পিপলস পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লি, ১৯৭৮, পৃ. ১৭২। গোপীনাথ দে, গোপীনাথ দে, “রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়নে বঙ্কিম মুখার্জীর ঐতিহাসিক ভূমিকা”, “বিপ্লবী নায়ক বঙ্কিম মুখার্জী স্মারক সংকলন”; বঙ্কিম মুখার্জী জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, ১৯৯৮, কলকাতা, পৃ. ১১৮।
২০. জে সি কে পিটারসন, “বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, বর্ধমান”; কলকাতা, ১৯১০, পৃ. ১০।
২১. নির্বাণ বসু, “পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোটেস্ট ১৯৩৭-৪৭: আ কমপ্যারেটিভ স্টাডি অফ ফোর মেজর ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বেঙ্গল”, প্রোগ্রেসিভ, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ১১৬। স্বাধীনতা, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬, পৃ. ৪।
২২. নির্বাণ বসু, “পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোটেস্ট ১৯৩৭-৪৭: আ কমপ্যারেটিভ স্টাডি অফ ফোর মেজর ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বেঙ্গল”, প্রোগ্রেসিভ, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ১১৭। স্বাধীনতা, ৮ই, ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬, পৃ. ৫।
২৩. আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই, “দ্যা সোশ্যাল বেসিস অফ দ্যা উইমেন্স কোশ্চেন সেন্ট পিটার্সবার্গ”, ১৯০৯, পৃ. ১-৩৩।
২৪. সুশীল মালখণ্ডী সম্পাদিত, “বর্ধমান জেলার দুই সংগ্রামী নেতা কম বিজয় পাল ও কম রবীন সেন”; পর্যবেক্ষক, আসানসোল, ১৯৯৬, পৃ. ১২৭। বিনয় চৌধুরী, “অতীতের কথা কিছু অভিজ্ঞতা”; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৮৮।
২৫. সুশীল মালখণ্ডী সম্পাদিত, “বর্ধমান জেলার দুই সংগ্রামী নেতা কম বিজয় পাল ও কম রবীন সেন”; পর্যবেক্ষক, আসানসোল, ১৯৯৬, পৃ. ১২৭।
২৬. রবীন সেন, “পাঁচ অধ্যায়”; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১৮৬।
২৭. মালিনী ভট্টাচার্য, “দ্যা ক্লাস ক্যারেকটার অফ সেক্সুয়ালিটি: পেজেন্ট উইমেন ইন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়”, “সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট”, খণ্ড ১৫, সংখ্যা ১৬৪; ১৯৮৭, পৃ. ৫৪।
২৮. এরিক হবসবম, “আনকমন পিপল”; অ্যাবাকাস, লন্ডন, ১৯৯৮, পৃ. ১৪০, ১৪২।
আশ্চর্য লাগলো। বিমল প্রতিভা দেবীর নামটাই নেই।