ইতিহাস কাকে বলে
(গ্রন্থ নাম: ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি?’; লেখক: ই.এইচ. কার; প্রকাশক: পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিক, পেপারব্যাক – ২৪ জুলাই ২০১৮)
কাকে বলে ইতিহাস? প্রশ্ন অতি সহজ এবং প্রাথমিক। কিন্তু উত্তর? না, এর উত্তর প্রদান করা সহজ নয় মোটেই। যুগে যুগে দেবী ক্লিও-এর সেবকরা প্রচেষ্টা করেছেন এই মোক্ষম প্রশ্নের একটি সর্বজনগ্রাহ্য সরল উত্তর খোঁজা। যে বিষয়ের জন্য তাঁরা পুরো জীবন উৎসর্গ করছেন, তার মূলগত চরিত্র কী, সন্ধান করেছেন বহু ঐতিহাসিক। বোঝার প্রচেষ্টা করেছেন তার বৃহত্তর উদ্দেশ্য। নির্ণয় করতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা কি ব্যক্তির কাহিনী বলে, না সমাজের? তাতে নৈতিক বিচারের স্থান আছে না নেই? তার কি কোনো বৃহত্তর অর্থ আর ছন্দ আছে না তা একেবারেই খামখেয়ালী এক প্রবাহ যার ‘নাইকো মানে নাইকো সুর’? গত শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক ই.এইচ. কার-এর ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি?’ (‘What is History?’) ছিল এইপ্রকারই এক উত্তর সন্ধানের প্রচেষ্টা।
মজার বিষয় হল, ইতিহাস কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যাঁর বই ভারতের ইতিহাসের ছাত্ররা প্রায় বিগত পাঁচ দশক ধরে পড়ে চলেছে, সেই ই.এইচ. কার (১৮৯২-১৯৮২ অব্দ) কোনো পেশাদার প্রশিক্ষিত ঐতিহাসিক ছিলেন না। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরের সময় বিভিন্ন শক্তির মধ্যে দড়ি টানাটানি এবং রুশ বিপ্লবের পর নবগঠিত সোভিয়েত সরকার-এর সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার-এর বোঝাপড়া ও টানাপোড়েন তিনি এই সূত্রে খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ এই ঐতিহাসিক সময়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করার সুবাদেই নির্মিত হয়েছিল।
১৯৩৬ অব্দে এই দপ্তর ত্যাগ করে কার বিদ্যায়তনিক জগতে পা রাখলেন। তবে ইতিহাস নয়, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ ওয়েলস-এ আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক হিসেবেই শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কাজ করেছিলেন প্রখ্যাত ‘দ্য টাইমস’ সংবাদপত্রের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে। যুদ্ধের পর তিনি প্রথমে অক্সফোর্ডের ব্যালিওল এবং পরে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ফেলো হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। এই সময় ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রধান ঐতিহাসিক কাজ, ‘আ হিস্ট্রি অফ সোভিয়েত রাশিয়া’ (‘A History of Soviet Russia’) ১৯৫০ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে চোদ্দ খন্ডে প্রকাশিত হয়। পূর্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একজন গভীর পর্যবেক্ষক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি ছিল, কিন্তু এই সময়ে একজন মৌলিক ইতিহাস চিন্তক হিসেবেও তিনি ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মহলে খ্যাতি অর্জন করেন।
এই প্রেক্ষিতেই ১৯৬১ অব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ট্রেভেলিয়ান বক্তৃতা প্রদান করার জন্য আমন্ত্রিত হন। কর্তৃপক্ষর তরফ থেকে অনুরোধ করা হয় সোভিয়েত ইতিহাস নিয়ে কিছু বলার জন্য, কিন্তু কার-এর ইচ্ছা ছিল অন্য। তিনি জানুয়ারি থেকে মার্চ অবধি চলা এই ট্রেভেলিয়ান বক্তৃতামালায় আলোচনা করলেন কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা অথবা কোনও বিশেষ দেশের ইতিহাস নিয়ে নয়, সামগ্রিক ভাবে ইতিহাস বলতে আমরা কী বুঝি, তা নিয়েই। বিষয়টি যদি ওই অবধিই থাকত, তাহলে কার-এর এই বক্তৃতাবলী হয়তো এতটা জনপ্রিয় হত না। অ্যাকাডেমিক ইতিহাস চর্চার পরিসরের বাইরে কার-এর এই বক্তৃতামালা সাধারণ জনমানসে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করে যখন বিবিসি রেডিও-তে তা পাঠ করা হয়। এরপর বিবিসি-এরই সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য লিসনার’-এ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বক্তৃতাগুলি পৌঁছে যায় আরও লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের কাছে।
ওই বছরেই গ্রন্থাকারে কার-এর ট্রেভেলিয়ান বক্তৃতামালা ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি?’ (‘What is History ?’) নামে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী দুই দশক ধরে বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরেও সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁর গ্রন্থের এই বিপুল জনপ্রিয়তা বজায় ছিল। এই জনপ্রিয়তার কারণ কী? কারণ কার জটিল বিদ্যায়তনিক ভাষা ব্যবহার করেননি। ইতিহাসচর্চার বিতর্কগুলি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন, এমন মানুষকেও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল কার-এ বক্তৃতাবলির অত্যন্ত সহজ সরল ভাষা। সাধারণ মানুষের কাছে উপভোগ্য ছিল বোধগম্য বাস্তব উদাহরণ সহযোগে জটিল তত্ত্বের সহজ বিশ্লেষণ এবং গাম্ভীর্য পরিহার করে হাস্যরসের সঙ্গে মজলিশি আড্ডার কায়দায় আলোচনা। এই অসাধারণ উপস্থাপন দক্ষতার একটি কারণ ছিল কার-র ‘দ্য টাইমস’-এর সহসম্পাদক হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতা, জটিল বিষয়বস্তু কী কৌশলে সহজ ভাবে উপস্থাপন করতে হয় তা তিনি এখানেই শিখেছিলেন। এই কারণেই ঐতিহাসিক রিচার্ড জে. ইভানস সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেছিলেন, এর পূর্বে বা এর পরবর্তী সময়ে আর কোনও ট্রেভেলিয়ান বক্তৃতা এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।
বক্তৃতাগুলির সময়ের সঙ্গে সঙ্গেও এতটাই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল যে ১৯৮২ সাধারণাব্দে কার এর একটি নতুন পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করার কথা চিন্তা করছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই নতুন সংস্করণের শুধু ভূমিকাটুকুই তিনি লিখে যেতে পেরেছিলেন। এই ভূমিকা রচনার কয়েক মাসের মধ্যেই ৯০ বছর বয়সে ই.এইচ. কার প্রয়াত হন।
অধ্যাপক কার-এর নিজের জবানবন্দীতেই তাঁর জন্ম ভিক্টোরিয়ান আশাবাদী মানসিকতার আবহে, যে আবহে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ অনন্ত প্রগতির প্রতি আস্থা রাখা সহজ ছিল। বিংশ শতকের দুই বিশ্বযুদ্ধ, ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির স্বাধীনতালাভ, ডান দিক থেকে ফ্যাসিবাদ ও বামদিক থেকে সমাজতন্ত্রের উদারপন্থাকে চ্যালেঞ্জ – ভিক্টোরিয়ান যুগের ইউরোপীয় উদারপন্থীদের এই অনন্ত প্রগতির আদর্শে আঘাত দেয়। তাই কার যখন এই বক্তৃতা দিচ্ছেন, মধ্য বিংশ শতকে অনেক ঐতিহাসিকই সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। কার-এর মতে, এই ভাবনা একেবারেই ইউরোপকেন্দ্রিক, যার সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে ইউরোপের আর মধ্যমণি না থাকার হতাশা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সদ্য স্বাধীন হওয়া উপনিবেশ, বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া দেশগুলির, যার মধ্যে রয়েছে ভারত বা চিনের মতো দেশ – যেখানে পৃথিবীর মানবজাতির একটি বড়ো অংশের বাস, হতাশার কোনও কারণ ঘটেনি। বরং এই কালপর্বে তাদের সামনে নতুন আশার প্রশস্ত রাজপথ উন্মুক্ত হয়েছে। এই দিক দিয়ে কার নিজেকে ইংল্যান্ডের বৌদ্ধিক জগতে নিজেকে একজন বৌদ্ধিক বিসংবাদী হিসেবে তুলে ধরেছেন। কার-এর গ্রন্থে মূল ধারার ইতিহাসচর্চার সঙ্গে এই বিসংবাদের ছাপ আমরা পাই ছত্রে ছত্রে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা সম্পর্কে এই সাধারণ ধারণাটি মাথায় রেখে আমরা এবার প্রবেশ করতে পারি মূল গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনায়।
অধ্যাপক কার প্রদত্ত ছয়টি বক্তৃতা ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি’ গ্রন্থের একেকটি অধ্যায়। প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে।
শুরু করা যাক প্রথম অধ্যায় দিয়ে। ‘দ্য হিস্টোরিয়ান অ্যান্ড হিজ ফ্যাক্টস’ (The Historian and His Facts) শিরোনামের এই অধ্যায় কা শুরু করেছেন পুস্তকের শিরোনামের প্রশ্নটি দিয়ে। ইতিহাস বলতে আদতে আমরা কি বুঝি? জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র্যাঙ্কের সময় থেকে ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চার মূল কথা ছিল ইতিহাস হল আদতে যা ঘটেছিল তারই উপস্থাপন, তার বেশিও না, কমও না। মতামত যে যা খুশি দিতে পারে, কিন্তু তথ্য হল পবিত্র বেদবাক্য যাকে লঙ্ঘন করা যায় না – এই ছিল ঐতিহাসিকদের আপ্তবাক্য। কার কিন্তু এই মতের সঙ্গে সহমত হননি। তিনি দুটি আপত্তি তুলেছেন। প্রথম, শুধু শুষ্ক তথ্য ইতিহাস নয়। ইতিহাস মাত্রই তথ্যের ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা ছাড়া তথ্য হয় এ এক ডাহা মিথ্যা কথা। কাদামাটির তাল দিয়ে মৃৎশিল্পী যেমন প্রতিমা গড়েন, ঐতিহাসিক তথ্যের ব্যাখ্যার মাধ্যমে রূপ দেন ইতিহাসকে।
এই সূত্র ধরেই তাঁর দ্বিতীয় আপত্তি। তথ্যের ব্যাখ্যার মধ্যে কোনও কালনিরপেক্ষ স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় নেই। কোনও তথ্যই নিজে থেকে কথা বলে না, তাকে ঐতিহাসিক কথা বলান। ঐতিহাসিকই বেছে নেন কোন তথ্য তিনি ব্যবহার করবেন, কোন তথ্য তিনি অগ্রাহ্য করবেন। এই তথ্য নির্বাচনের ভিত্তিতেই একই বিষয় দুইজন ঐতিহাসিক দুই ধরনের তথ্যরাশি নিজেদের মতো বাছাই করে জড়ো করে দুইপ্রকার ইতিহাস লিখতে পারেন। তিনি এই কারণেই র্যাঙ্কিয়ান ইতিহাসচর্চার ‘কাল্ট অফ ফ্যাক্ট’-এর প্রতি খড়গহস্ত। অধ্যাপক কার-এর মতে ঐতিহাসিকের কাজ দরকারি-অদরকারী সব তথ্য একজায়গায় জড়ো করে করে আবর্জনার একটা ঢিবি বানিয়ে তাকে ইতিহাসচর্চা বলে চালিয়ে দেওয়া নয়। ঐতিহাসিকের আসল কাজ রয়েছে তথ্য সংগ্রহে নয়, তার ব্যাখ্যায়।
এই যে কার র্যাঙ্কের ইতিহাসচর্চার কালনিরপেক্ষ তথ্যের ধারণা নাকচ করে দিলেন, তাতে কিন্তু বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ল। তাহলে কি নিরপেক্ষ ইতিহাস বলে কিছুই নেই? ডিলথে আর ক্রোচে কবেই বলে দিয়েছেন সকল ইতিহাস হল সমসাময়িক ইতিহাস। একটি নির্দিষ্ট কালে দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তি বা ঐতিহাসিক অতীতকে বর্তমানের লেন্সের মধ্যে দিয়ে যেভাবে দেখে সেটাই আদতে ইতিহাস। পাল্টে যাওয়া বর্তমান সঙ্গে সঙ্গে বদলায় ঐতিহাসিকের এই লেন্স আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলায় অতীতের পাঠ। ঐতিহাসিক কলিংউড আরেকধাপ এগিয়ে বলেছেন সব ইতিহাসের বাসাই হচ্ছে আসলে মানুষের মনে। মানুষ যে চিন্তার ছাকনি দিয়ে শুষ্ক তথ্যের মধ্যে থেকে ইতিহাসের সারকে ছেঁকে নেয়, তা পরিবর্তনশীল – তাই ইতিহাসও পরিবর্তনশীল। সব ইতিহাসই তাই চিন্তার ইতিহাস। বিশুদ্ধ ইতিহাস বলে কিছু হয় না। ইতিহাস তাই-ই, যা কোনও বিশেষ সময়ের ঐতিহাসিকের ভাবনায় ধরা দেয়। অধ্যাপক কার কি তাহলে এই মত সমর্থন করেন?
পররাষ্ট্র দপ্তরের দুঁদে কূটনৈতিক আমলার মতো কার ইতিহাসের এই ভার্সাই-এ যুযুধান এই দুইপক্ষের মধ্যে একটা সন্ধি করার চেষ্টা করলেন। তিনি একদিকে বললেন, একথা অবশ্যই ঠিক ঐতিহাসিক ইতিহাসের বাইরে নন। একথাও ভুল নয় ঐতিহাসিক বর্তমানের লেন্সে অতীতকে দেখেন। তাঁর সমাজ, সময়, সংস্কৃতি, শ্রেণী সবই তাঁর লেন্সকে বিশেষ রং দেয়। তিনি সমাজ নিরপেক্ষ হয়ে আকাশে উড়তে থাকা বাজপাখির মতো নিচে বিস্তৃত কোনও ইতিহাসের ঘটনাক্রমের সর্পিল মিছিলকে দেখেন না। তিনি নিজেও সেই মিছিলেরই অংশ। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে সীমিত দৃষ্টিতে মিছিলের যেটুকু তাঁর কাছে ধরা পড়ে সেই মুহূর্তে, তা থেকেই তিনি অতীতকে বোঝার চেষ্টা করেন। আবার একই সঙ্গে তিনি একথা স্বীকার করতে রাজি হলেন না, যে ইতিহাস তাই-ই, যা ঐতিহাসিকের ভাবনায় ধরা দেয়। ইতিহাস তাহলে কি ? কার উত্তর দিলেন, ইতিহাস হলো ঐতিহাসিক ও তাঁর তথ্যের মধ্যে আদানপ্রদান, অতীত ও বর্তমানের মধ্যে নিরন্তর কথোপকথন। অতীতের একটি সত্য আছে, সেই সত্য হিমালয়ের মতোই অনড়। ঐতিহাসিক শত ভাবনাতেও হিমালয়কে পাল্টাতে পারবেন না। কিন্তু ঠিক যেমন একেক স্থান থেকে আমাদের দৃষ্টিতে হিমালয়ের একেক রূপ দেখা দেয়, ভেসে ওঠে একেক শৃঙ্গ, কোনোটা রোদে উজ্জ্বল কোনোটা মেঘে ঢাকা, ইতিহাস হল কালের এক বিশেষ স্থানে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিকের হিমালয়সম অতীত দর্শন। কাল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিকের স্থান পাল্টায়, একই হিমালয় রোদ-ছায়া মেখে নতুন দৃষ্টিকোন থেকে তাঁর কাছে ধরা দেয় সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘সোসাইটি অ্যান্ড দ্য ইন্ডিভিজুয়াল’ (Society and the Individual)-এ কার আলোচনা শুরু করেছেন ইতিহাসের আরেক বহু পুরনো বিতর্ক নিয়ে। সমাজ না ব্যক্তি? আগে ডিম না মুর্গি? কার বলছেন এ অবান্তর বিতর্ক। ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর মধ্যে আদৌ কোনও বিরোধ নেই। ইতিহাসে ব্যক্তির স্থান আছে, কিন্তু ব্যক্তি তো বিচ্ছিন নয়। সে তো নিরালম্ব বায়ুভূত হয়ে ঝুলে নেই। তার অবস্থান আদতে বৃহত্তর সমাজেরই মধ্যে। এখানেও কার মধ্যপন্থা অবলম্বন করছেন। ইতিহাসে ব্যক্তির কোনই স্থান নেই। শুধু সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারাই ইতিহাসের গতি পরিচালিত হয় এই মত তিনি মানছেন না। আবার শুধু মহান ব্যক্তিরাই ইতিহাস পরিচালনা করেন, সেই কার্লাইলের মহামানব তত্ত্বও তাঁর অপছন্দ। তাঁর মতের সঙ্গে স্পষ্টতই ‘লুই নেপোলিয়ানের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’-এ ইতিহাসে ব্যক্তির স্থান সম্পর্কে মার্কসের পর্যবেক্ষণের প্রভাব আছে। মানুষই ইতিহাস লেখে, কিন্তু এই ইতিহাস লেখার জন্য কেউ কোনও সাদা খাতা পায়না। যে সমাজ, যে কালপর্ব, যে আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে জন্মগ্রহণ করেছে তা তার নয়া ইতিহাস লেখার পরিসরকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। কিন্তু তার হাত পা একেবারেই বাঁধা, সে সম্পূর্ণ বৃহত্তর পরিস্থিতির দাস একথাও কার-এর মতে ভুল। সমাজের খুঁটিতে ব্যক্তির দড়ি বাঁধা আছে, কিন্তু সেই দড়ি খুব ছোট না, বাঁধা থাকা অবস্থাতেই তার নিজের প্রচেষ্টার যথেষ্ট পরিসর রয়েছে, সে একেবারে নিয়তির দাস না।
এই সূত্র ধরেই কার এখানে আরেকবার সতর্ক করে দিচ্ছেন ইতিহাস পাঠের সময় ঐতিহাসিক সম্পর্কে। মনে করিয়ে দিচ্ছেন ঐতিহাসিকও সমাজের অংশ। কার-এর মতে কোনও ঐতিহাসিক তাঁর নিজের কালপর্ব ও সামাজিক অবস্থানের ফলস্বরূপ নিজস্ব দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যত সচেতন, সেই ঐতিহাসিক ইতিহাস লেখার সময় তত সতর্ক হবেন। এই সতর্কতা সহায়ক হবে ঐতিহাসিকের নিজের সীমাবদ্ধতার আলো-ছায়া ভেদ করে ইতিহাসের হিমালয় সম সত্যের রূপ আরও স্পষ্ট ভাবে দর্শন করার।
তৃতীয় অধ্যায়, ‘হিস্ট্রি, সাইন্স অ্যান্ড মোরালিটি’ (History, Science and Morality)-তে কার প্রথমে উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা করেছেন ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলা চলে কিনা এই প্রশ্নের। তাঁর নিজের অভিমত হলো, ধ্রুপদী ভাবে যাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা হয়, তার নিরিখে বিচার করলে ইতিহাস বিজ্ঞান নয়। কারণ বিজ্ঞান খোঁজে কাল নিরপেক্ষ তথ্য। আর কার শুরুতেই দেখিয়েছেন ইতিহাসে তথ্য কাল এবং ঐতিহাসিক ভেদে তার রূপ পাল্টায়। কার নিজেই বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঁচটি মূল সংঘাতের স্থান চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তিনি এর পাশাপাশি এও লক্ষ্য করেছেন, তাঁর সময়কালে বিজ্ঞানের সংজ্ঞারও কিছু বদল আসছে। দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান আর ফ্যাক্ট বা তথ্য না, আগ্রহী হয়ে উঠছে ইভেন্ট বা ঘটনা নিয়ে। রাদারফোর্ড বলছেন বিজ্ঞানের কাজ হল সবজায়গায় প্রযোজ্য এমন আইনের সন্ধান নয়, বরং কীভাবে বিভিন্ন ঘটনা বা ইভেন্ট কাজ করে তা বোঝার চেষ্টা করা। কার-এর মতে, রাদারফোর্ড বিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন, সেই অর্থে ধরলে ইতিহাসের উদ্দেশ্য অবশ্যই বৈজ্ঞানিক। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তাঁর মত হল ঐতিহাসিকের কোনও দায়িত্ব নেই নিজের বিষয়কে বিজ্ঞান বলে প্রতিপন্ন করা। বৈজ্ঞানিকরাই বরং ঠিক করুন বদলাতে থাকা বিজ্ঞান-এর সংজ্ঞার নিরিখে ইতিহাসকে বিজ্ঞান সম্মত বিষয় বলা চলে কিনা।
এই অধ্যায়েই কার আলোচনা করছেন ঐতিহাসিকদের আদৌ নৈতিক বিচার করার অধিকার আছে কিনা তা নিয়ে। তাঁর অভিমত করছেন ব্যক্তির সমালোচনা ঐতিহাসিকের কাজ না। তাঁর কর্তব্য হল প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিচার। টমাস জেফারসন দাসমালিক ছিলেন বলে তাঁকে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নৈতিক ভাবে বিচার করা অনুচিত। বরং কিছু যদি নৈতিক সমালোচনা করতেই হয়, তাহলে ঐতিহাসিক সমালোচনা করবেন অ্যাটলান্টিক দাস ব্যবসার, অর্থাৎ দাস প্রথার প্রতিষ্ঠানের।
চতুর্থ অধ্যায়, ‘কজেশন অফ হিস্ট্রি’ (Causation of History)-তে কার এই অভিমত পোষণ করেছেন যে ইতিহাসের অন্যতম ভিত্তি হল ঘটনাবলির কারণের সন্ধান। কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা কোনও একটি কারণের জন্য হয় না, তার পেছনে ছোট বড়ো একাধিক কারণ থাকে। ঐতিহাসিকের দায়িত্ব হল এই কারণগুলিকে এক জায়গায় আনা এবং সেগুলিকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো। সর্বাপেক্ষা জোরালো কারণের উপর ঐতিহাসিক সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেবেন এবং সর্বাপেক্ষা গৌণ কারণকে রাখবেন সবার শেষে। এই অধ্যায়ে তিনি আরও বলেছেন, কী হতে পারত, এই নিয়ে আলোচনা করা ঐতিহাসিকের কাজ নয়। সেই কল্পনার জাল সাহিত্যিকরা বুনবেন। ঐতিহাসিকরা কাজ করবেন বাস্তবের মাটিতে, তাঁদের কাজ কী হয়েছে তাই নিয়ে। তিনি ইতিহাসের দুর্ঘটনার ধারণার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে দুর্ঘটনা (আকস্মিক কোনও রাজার যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু, কোনও সমুদ্রযাত্রীর আকস্মিক নতুন সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন) ইতিহাসে খুব গভীর কোনও গুরুত্ব রাখে না। গ্যাভ্রিলো প্রিন্সেপ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে দুর্ভাগ্যজনক কিছু সমাপতনের ফলে পিস্তলের পাল্লায় পেয়েছিল এবং সেই দুর্ঘটনাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী এই জাতীয় ইতিহাস ব্যাখ্যা তাঁর কাছে হাস্যকর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হতোই। তার মুখ্য কারণ গ্যাভ্রিলোর ট্রিগারের টান নয়, উপনিবেশ নিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সংঘাত। দীর্ঘমেয়াদী মুখ্য কারণে ইউরোপে যা বারুদের স্তুপ জমে উঠেছিল, প্রিন্সেপের পিস্তলের ট্রিগারে টান তাতে স্ফুলিঙ্গ ছিল মাত্র। তাই কার-এর মতে ঐতিহাসিক জনমোহিনী ইতিহাসচর্চায় গা না ভাসিয়ে সব সময় চেষ্টা করবেন গভীর ভাবে কোনও ঘটনার মুখ্য কারণগুলিকে বোঝার।
পঞ্চম অধ্যায়, ‘হিস্ট্রি অ্যাজ প্রোগ্রেস’ (History as Progress)-এ কার ইতিহাসের মিস্টিক ও সিনিক দুই দৃষ্টিভঙ্গিকেই পরিহার করেছেন। অর্থাৎ ইতিহাসের কোনই অর্থ নেই আর ইতিহাসের অসংখ্য অর্থ আছে, দুই মতেরই তিনি বিরোধী। এখানেই তাঁর ভিক্টোরিয়ান আশাবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। অধ্যাপক কার দিনের শেষে আস্থা রেখেছেন প্রগতির প্রতি। তাঁর মতে মাঝে মাঝে কিছু পশ্চাদগমনের কথা মাথায় রাখলেও, সামগ্রিক ভাবে ইতিহাসের যাত্রাপথ প্রগতির দিকেই। যদিও তিনি একথাও তার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসের গতি প্রগতির দিকে হলেও তা প্রগতির নিশ্চয়তা প্রদান করে না। ইতিহাসের একমাত্র নিশ্চয়তা বদল। এই বদলের সামগ্রিক ঝোঁক যদিও প্রগতির দিকে, এমন কখনই বলা যায় না যে সব বদলই প্রগতিশীল হবে।
ষষ্ঠ অধ্যায়, ‘দ্য ওয়াইডেনিং হরাইজন’ (The Widening Horizon)-এ অধ্যাপক কার মূল যে বক্তব্য রাখছেন তা হল অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ যে অনন্ত শিকলে বাঁধা রয়েছে সেই ইতিহাসকে বুঝতে হলে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ছাত্রদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত করতে হবে। ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে, যেমন দর্শনে, তাঁদের দখল বাড়াতে হবে। পড়তে হবে নিজেদের দেশ আর ইউরোপের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা আর আমেরিকার ইতিহাসও। ছাত্রদের তিনি উপদেশ দিয়েছেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের ইতিহাসচর্চার অন্তর্নিহিত রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করার। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ইতিহাস হল একটি জীবন্ত বিষয়। পরিশেষে অধ্যাপক কার বলেছেন, পৃথিবী স্থির, চার্চের এই গোঁড়া মতের মতোই রক্ষণশীল ঐতিহাসিকরা পড়ান ইতিহাস স্থির, তাই আজকের ইতিহাসের ছাত্রদের দায়িত্ব গ্যালিলিওর অনুকরণে বলা – ‘Yet it moves’।
অধ্যাপক কার-এর এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর যিনি তার সমালোচনায় সর্বাপেক্ষা সোচ্চার ছিলেন, তিনি হলেন কার-এর সুহৃদ এবং একই সঙ্গে কার-এর ইতিহাসচিন্তার তীব্র বিরোধী অধ্যাপক আইজেহা বার্লিন। তাঁর সমালোচনা ছিল মূলতঃ দুটি বিষয়কে নিয়ে।
প্রথম, বার্লিন বলেন দীর্ঘকাল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে আমলা পদে কাজ করার ফলে অধ্যাপক কার ইতিহাসকে দেখেছেন মূলতঃ রাষ্ট্রের ও সমাজের ইতিহাস হিসেবে। তিনি ব্যক্তিকে ইতিহাস রচনায় যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছেন, তা দিয়েছেন সমাজের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে। বার্লিনের মতে, এর ফল হয়েছে, ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বিচারের প্রশ্নে কার হাত ঝেড়ে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের নৈতিক বিচার নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। বার্লিনের মতে এই প্রবণতা যুগে যুগে স্বৈরশাসকদের বলি হয়েছেন যাঁরা তাঁদের প্রতি অনাচার করে। স্বৈরশাসকদের নিছক সময় ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ফসল বলে বেকসুর খালাস দেয়।
বার্লিনের দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল, আমলা হিসেবে নথির উপর গুরুত্ব দিতে অভ্যস্থ কার ভুলে গেছেন সরকারী নথি দেখে ইতিহাস লিখলে আদতে শাসকগোষ্ঠীরই ইতিহাস লেখা হবে। সরকারী মহাফেজখানাকে কোনও বিশ্লেষণ না করে বিনাবিচারে তাকে তথ্যের ভান্ডার হিসেবে গ্রহণ করলে সেই ইতিহাসে শাসিতদের কথা পাওয়া যাবে না। কার, বার্লিনের মতে, সচেতন ভাবেই যারা বিজয়ী তাদের পক্ষে। তাঁর ইতিহাস পরাজিত, লাঞ্ছিতদের ইতিহাস নয়, হতেই পারে না। অধ্যাপক ট্রেভর-রোপারও এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত হয়ে বলেছেন কার-এর ইতিহাস চর্চা আদতে শাসকদের সাফল্য উদযাপনের নামান্তর। তিনি সবসময় ইতিহাসের সেনাবাহিনীতে ‘বিগ ব্যাটেলিয়ান’-এর পক্ষে। একই সঙ্গে তাঁরা কার-এর প্রগতি হিসেবে ইতিহাসের ধারণারও সমালোচনা করেছেন। বার্লিন দাবী করেছেন কার-এর কাছে যা প্রগতিশীল তাই বস্তুনিষ্ঠ। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস কখনই ঐ ছকে চলে না।
কার-বার্লিন বিতর্ক দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে এবং কখনও কখনও তা ব্যক্তি আক্রমণের জায়গাতেও গেছে। দুই বন্ধুর মধ্যে এই বিতর্ক জন্ম দিয়েছে তিক্ততারও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলা যেতে পারে, যে এই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে দুজনেই নিজ নিজ মতের কিছু সংশোধন করেছিলেন। কার কিছুটা বার্লিনের দিকে এসেছিলেন, বার্লিন কিছুটা কার-এর দিকে। পরিকল্পনা মতো অধ্যাপক কার যদি তাঁর গ্রন্থের পরিবর্ধিত সংস্করণটি প্রকাশ করতে সক্ষম হতেন, নিঃসন্দেহে তাতে অধ্যাপক বার্লিনের সঙ্গে সংঘটিত এই বিতর্কের একটি গভীর প্রভাব থাকত। সকল ইতিহাসের ছাত্রের দুর্ভাগ্য অধ্যাপক কার এই গ্রন্থ লিখে যেতে পারেননি। ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি ?’ (‘What is History ?’) -এর পুরনো সংস্করণটি অত্যন্ত মূল্যবান হলেও স্বাভাবিক ভাবেই এই গ্রন্থে ষাটের দশকের পর এই বিষয় নিয়ে চলতে থাকা বিতর্ক ও তা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন ভাবনা অনুপস্থিত। বিংশ শতকের শেষ দশক থেকেই এমন কিছু প্রশ্ন ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে উঠে এসেছে যার উত্তর অধ্যাপক কার-এর গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। তবুও সাধারণ ইতিহাসের ছাত্রের ইতিহাসচর্চার পেছনে যে নীতি এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা যে বিভিন্ন বিতর্ক, তার একটি প্রকৃষ্ট ধারণা পাওয়ার প্রথম সোপান হলো অধ্যাপক ই.এইচ. কার-এর এই গ্রন্থটি। সেই দিক থেকে ইতিহাসচর্চার ইতিহাসে ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি ?’ (‘What is History ?’)-এর স্থান নিঃসন্দেহে পাকা হয়ে আছে।
খুব ভালো লেখা
খুবই মনোগ্রাহী আলোচনা।
পোস্ট মডার্নিজম ও লিংগুয়িস্টিকসেক ধাক্কা ই এইচ কারের অনুসারীরা কিভাবে সামলেছেন জানার আগ্রহ রইল।
১৮৯২ থেকে ১৯৮২। তাঁর সুদীর্ঘ জীবন বাহিত নিরন্তর কর্মপ্রবাহে। তাঁর বেঁচে থাকার সময়টা ছিলো পৃথিবী পাল্টানোর ক্রান্তিকাল। দেখেছেন নিজের চোখে ইতিহাসের ভাঙা গড়াকে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজের সুবাদে ই এইচ কার প্রত্যক্ষ করেছেন রাশিয়ায় রাজতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে পরিবর্তনের বিপ্লবকে। এমন একজন মানুষ শুধু ঘটনা কেন্দ্রিক ইতিহাস নয়, অনুসন্ধানে আগ্রহী হবেন তার সংজ্ঞা নির্ণয়েও। তিনি ছিলেন অনন্য, ইতিহাসে প্রশিক্ষিত না হয়েও তিনি নিজেই ইতিবৃত্ত, যে বয়সে মানুষের অখণ্ড অবসর, সেই ৬৯এই দিলেন ট্রেভোলিয়ান বক্তৃতামালা, আকৃষ্ট হলো সাধারণ জনমন। ইতিহাস বাঁচে তথ্যের আবিস্কারে। অদূর অতীত স্বচ্ছতর, কিন্তু কেমনে তৈরি হবে সুদূর থেকে সুদূরের ইতিকথা? হয় তো পাওয়া গেলো কোনো মূর্তি অথবা কোনো পাথুরে শিলালিপি। তা কি তথ্য হয়, না কি হতে পারে? তাই চাই ব্যাখ্যা নিশ্ছিদ্র যুক্তির অবতারণায়। তথ্যের স্তূপ রচনা ইতিহাস চর্চা নয়, ঐতিহাসিক তাই তাঁর ইচ্ছানুসারে বাছাই করতে পারবেন তাঁর উপাত্তসমূহ। এমনও তো হতে পারে, দুই বিপরীত মতের ইতিহাসবিদ একই বিষয়ের ওপর দুটি পরস্পরের বিপরীতমুখী ইতিহাস রচনা করলেন। এতে কি পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না? সমাজ পাল্টায়, পাল্টায় মানুষ, দৃষ্টিভঙ্গিও, সর্বোপরি প্রযুক্তি। এমনকি বৈজ্ঞানিক আবিস্কারও কালনিরপেক্ষ নয়। আজ যা অভ্রান্ত, আগামীকালের বিচারে তা ভুল প্রমাণিত। কিন্তু ইতিহাস তাই-ই, যা ঘটে চলে অথচ বদলানো যায় না। যা পাল্টায়, তা হলো দৃষ্টিকোণ। অধ্যাপক কার ছিলেন ডক্টর বার্লিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু। যুক্তি দিয়ে কারের বক্তব্যের সবটাই মেনে নিতে পারেন নি। শেষে বন্ধুত্বে ফাটল, তা থেকে তিক্ততা। আসলে পৃথিবীর ইতিহাস জয়ের ইতিহাস। জয়ীরাই লেখে তাদের গরিমাময় ইতিবৃত্ত। পরাজিত সেখানে ভাষাহীন। তাদের বলার কিছু থাকতে পারে না। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে কার তাঁর বক্তৃতার ত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সময় আর ছিলো না।
ami pouro books are pdf chai
history books of histography
internal and external criticism eh kar books