মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাদের ক্রীতদাস-দাসীরাঃ ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতির খোঁজ
টমাস জেফারসন ও স্যালি হেমিংস
টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)-এর নাম আমরা সবাই শুনেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। সে দেশের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি একজন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা (ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স, 1776) রচয়িতা। এই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করা হয়েছে; সৃষ্টিকর্তা তাদের সবাইকে এমন কিছু অধিকার দিয়েছেন যা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায় না— যার মধ্যে পড়ে জীবন, মুক্তি ও সুখের সন্ধানের অধিকার।
ফরাসি বিপ্লবের চিন্তার আদলে গড়া এই ঘোষণা সে দেশের মানুষকে মুক্তির অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি দিয়েছিল? এই ঘোষণার রচয়িতা কি সত্যিই এই কথাগুলি বিশ্বাস করতেন— নিজের জীবনে কি তিনি এই কথাগুলি প্রয়োগ করেছেন? এ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
মার্কিন দেশের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। ন’ বছর ধরে তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহর ২১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে তাঁর বর্ণবহুল কর্মজীবন নয়, আজ আমরা আলোচনা করব তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে এরকম বড় মাপের একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন শুধু ব্যক্তিগত নয়। বক্তৃতা বা লেখার চেয়েও তাঁর এবং তাঁর সময়ের সমাজচিন্তা ভালোভাবে প্রকাশ পায় ব্যক্তিগত জীবনে।
জেফারসনের বাড়ি ছিল ভার্জিনিয়াতে। টোব্যাকো উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ভার্জিনিয়া। জেফারসন ছিলেন সেই ভার্জিনিয়ার এক প্লান্টেশন মালিক। মার্কিন দেশে সেই সময়ে প্লান্টেশন মালিকরা চাষ করাতেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস-দাসীদের দিয়ে। জেফারসনের প্লান্টেশনটিতেও ছিল এমন বহু দাস-দাসী। সারা জীবনে ৬০০ দাসদাসীর মালিক হয়েছেন তিনি। দাস কেনা-বেচা করেছেন অন্য প্লান্টেশন মালিকদের মতই। না, এদের কাউকে তিনি মুক্তি দেননি। এমনকি মৃত্যুকালে উইলেও তিনি এই দাস-দাসীদের মুক্তি দিয়ে যাননি। তাঁর জীবৎকালে মুক্তি দেননি এমনকি তাঁর নিজের ঔরসজাত সন্তানদের, বা সেই সন্তানদের মাকেও।
একটু পিছনের দিকে ফিরে যাচ্ছি। জেফারসনের বয়স যখন ২৬, তখনই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে মন্টিচেলো প্লান্টেশনটির ৫ হাজার একর জমির মালিকানা লাভ করেন। সঙ্গে পান ৫২ জন ক্রীতদাস-দাসী। এর পর ১৭৭২ সালে টমাস জেফারসনের বিবাহ হয়। স্ত্রীর নাম মার্থা (১৭৪৮-১৭৮২)। পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মার্থার মৃত্যু হয়। এরপর জেফারসন আর বিবাহ করেননি।
জেফারসনের বিয়ের পরের বছরই তাঁর শ্বশুরের মৃত্যু হয়। তখন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে আরো ১১ হাজার একর জমি ও ১৩৫ জন ক্রীতদাস-দাসীর মালিক হন। তিনি হয়ে ওঠেন ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় প্লান্টেশন মালিকদের একজন।
জেফারসনের স্ত্রী মার্থা মারা যান ১৭৮২ সালে। জেফারসনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে তখন অনেক দিন বাকি। এর কিছু পরে জেফারসন যান ফ্রান্সে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হয়ে। ফ্রান্সে বসবাসকালে জেফারসনের সন্তানের সঙ্গী হয়ে ফ্রান্সে আসেন ক্রীতদাসী স্যালি হেমিংস।
টমাস জেফারসনের ক্রীতদাসী স্যালি হেমিংস
কে এই স্যালি? একটু পরিচয় দেওয়া যাক। বিবাহের সময় জেফারসনের শ্বশুরের কাছ থেকে অন্যান্য সম্পদের সাথে বাড়ি থেকে ১৩৫ জন দাসদাসী যৌতুক পেয়েছিলেন জেফারসন। এদের একজন ছিল স্যালি। স্যালি তখন নেহাত শিশু। অন্য ক্রীতদাসদের মত কঠোর শ্রমের কাজ করার জন্য নয়, স্যালি ও তাঁর দাদার স্থান হয়েছিল জেফারসনের বাড়িতে। বাড়ির দাসীর কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ পায়। একটু বড় হলে তাঁর কাজ দাঁড়ায় জেফারসন ও মার্থার সন্তানদের সঙ্গে খেলা করা ও তাদের সঙ্গ দেওয়া।
মার্থার মৃত্যুর পর ১৭৮৪ সালে জেফারসন যান ফ্রান্সে। তাঁর সঙ্গে যায় বড় মেয়ে। অন্য দুই কন্যা থেকে যায় আমেরিকায়। আর একজনও তাঁর সঙ্গে ফ্রান্সে যায়। স্যালির দাদা জেমস। জেফারসনের এই ক্রীতদাসকে শেফ হবার জন্য তালিম দেওয়া হচ্ছিল। তা, শেফ হবার জন্য ফ্রান্সের মত জায়গা আর কোথায় আছে! ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্যালির এই দাদা হয়ে ওঠেন একজন ভালো শেফ। ফ্রান্সে প্রশিক্ষিত প্রথম মার্কিন শেফ।
জেফারসন ফ্রান্সে যাওয়ার পর পরই আমেরিকায় রেখে যাওয়া তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। অবশিষ্ট কন্যা মেরি (পলি)-কে ফ্রান্সে নিয়ে আসতে চান জেফারসন। ১৭৮৭ সালে ন বছরের মেরি রওনা হয় ফ্রান্সের উদ্দেশে। তার দাসী-সঙ্গিনী হয়ে যায় স্যালি। সালির বয়স তখন চোদ্দ।
চোদ্দ বছরের স্যালি পৌঁছে গেলেন ফ্রান্সে— প্যারিসে। সেখানে তিনি থাকলেনও দু বছর। ফ্রান্সে ১৭৮৯-র বিপ্লবে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ হয়। ফ্রান্সে তিনি জেফারসনের কাছ থেকে মাসে ২ ডলার করে বেতনও পাচ্ছিলেন। ফরাসি ভাষাও শিখছিলেন। স্যালি চাইলে ফ্রান্সে থেকে যেতে পারতেন, মুক্ত একজন মানুষ হিসাবে। যেমন থেকে যেতে পারতেন তাঁর দাদা, শেফ জেমস।
কিন্তু তা হয়নি। দু বছর পর, জেফারসনের সঙ্গে ক্রীতদাস হিসাবেই মার্কিন দেশে ফিরে আসেন স্যালি, আর স্যালির দাদা জেমসও। স্যালির বয়স তখন ষোল, তার গর্ভে সন্তান— জেফারসনের সন্তান। ষোল বছরের স্যালি আর ছেচল্লিশ বছরের জেফারসনের সন্তান। সন্তানটি অবশ্য বাঁচেনি। কিন্তু স্যালি আর টমাস জেফারসনের এই সম্পর্ক বজায় ছিল ১৮২৬ সালে জেফারসনের মৃত্যু পর্যন্ত।
স্যালির ছেলে ম্যাডিসন হেমিংস পরে জানিয়েছেন, জেফারসন স্যালিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে স্যালির সন্তানকে তিনি মুক্ত করে দেবেন। এই প্রতিশ্রুতিতে ভর করে আমেরিকায় ফেরে গর্ভবতী ষোল বছরের মেয়ে, ক্রীতদাসী স্যালি।
স্যালির সন্তানরা
স্যালির প্রথম সন্তানটি, আগেই বলেছি, মারা যায়। তার সম্পর্কে এর বেশি জানা যায় না। কিন্তু স্যালি এর পর, ১৭৯৫ থেকে ১৮০৮ সালের মধ্যে, জেফারসনের আরো ছটি সন্তানের জন্ম দেন। তাদের মধ্যে দুজন শিশুকালেই মারা যায়। বাকি চারজন, তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে, বেঁচে থাকে ও বড় হয়। বেভারলি, হ্যারিয়েট, ম্যাডিসন ও এস্টন। জেফারসনের ‘ফার্ম বুক’-এ অন্য ক্রীতদাসীদের সন্তানদের মতো এঁদের জন্মের কথা লিপিবদ্ধ আছে। তবে তফাতও একটা আছে। স্যালির সন্তানদের নামের পাশে বাবার নাম নেই। স্বাভাবিক!
বড় হওয়ার পর কী হয় এই সন্তানদের? একে একে বলছি।
বড় ছেলে, বেভারলি। জন্ম ১৭৯৮ সালে। তার সম্পর্কে ঐতিদাসিকরা বেশি জানাতে পারেননি। তবে তার ভাই ম্যাডিসন জানিয়েছেন যে বেভারলি বড় হয়ে ওয়াশিংটনে চলে যায়, তার সন্তানাদিও হয়।
বেভারলি সম্পর্কে আর কিছু যে জানা যায় না তার কারণ বেভারলি দেখতে ছিল ইউরোপীয়-আমেরিকানদের মত— শ্বেতাঙ্গ। ওয়াশিংটনে গিয়ে সে শ্বেতাঙ্গ সমাজে মিশে যায় তাদের একজন হিসেবে। এই নতুন জীবনে তার কাউকে জানানো সম্ভব ছিল না যে সে এক ক্রীতদাসীর সন্তান।
স্যালির মেয়ে হ্যারিয়েটও (জন্ম ১৮০১) ২১ বছর বয়সে মন্টিচেল্লো ত্যাগ করে অজানা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায়। জানা গেছে, জেফারসনের নির্দেশে তার এক ওভারসিয়ার হ্যারিয়েটের হাতে ৫০ ডলার (আজকের মূল্যমানে প্রায় হাজার ডলার) দিয়ে দেন। খাতায় কলমে সে অবশ্য “পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসী”-ই থেকে যায়। কিন্তু ওয়াশিংটনে গিয়ে তিনিও নিজেকে শ্বেতাঙ্গ নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার চেহারা তাঁকে সেটা করতে সাহায্য করে। স্বাভাবিক ভাবে তাকেও ক্রীতদাসী স্যালির সন্তান পরিচয়টি গোপন করে যেতে হয়, সারা জীবন। কারণ ক্রীতদাসীর সন্তান, দেখতে যতই শ্বেতাঙ্গ হোক, সে ক্রীতদাসী, সে কালো, নিগ্রো, আজকের ভাষায় আফ্রিকান-আমেরিকান।
হ্যারিয়েট অবশ্য খুবই ভাগ্যবতী। কারণ মৃত্যুর আগে টমাস জেফারসন স্যালিকে ক্রীতদাসত্বের বন্ধন থেকে আইনত মুক্তি দেন। একমাত্র তাকেই। স্যালির ভাইদের বা জেফারসনের অন্য কোনও ক্রীতদাসের এই সৌভাগ্য ঘটেনি।
অবশ্য জেফারসন আরো দুজন ক্রীতদাসকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ১৭৮৪ সালে তিনি স্যালির এক ভাই রবার্টকে ডলারের বিনিময়ে মুক্তি কেনার অনুমতি দিয়েছিলেন (অর্থাৎ সে নিজেই অর্থের বিনিময়ে নিজেকে কিনে নিয়েছিল)। ১৭৯৬ সালে তিনি মুক্তি দেন স্যালির আর এক ভাই, ফ্রান্সে প্রশিক্ষিত জেমসকে— তিন বছর থেকে অন্য এক ভাইকে প্রশিক্ষিত করে যাওয়ার শর্তে।
স্যালির দুই সন্তান যে শ্বেতাঙ্গ সমাজে মিশে যেতে পারল তার কারণ শুধু জেফারসনের জেনেটিক উত্তরাধিকারই নয়। স্যালির বাবাও ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, স্যালির মা বেটির ‘মালিক’ ও জেফারসনের শ্বশুরমশাই জন ওয়েলেস। অর্থাৎ স্যালি ছিলেন জেফারসনের স্ত্রী মার্থার বোন। এখানেই শেষ নয়। স্যালির মা বেটিও সম্পূর্ণ ‘আফ্রিকান’ ছিল না। বেটি-র বাবা ছিলেন ক্যাপ্টেন হেমিংস। শ্বেতাঙ্গ ক্যাপ্টেন হেমিংস অবশ্য বেটির মা-র ‘মালিক’ ছিলেন না। জানা যায় যে তিনি নাকি বেটির মা ও তার সন্তানদের কিনে নিয়ে তাদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বেটির মায়ের ‘মালিক’ তাতে রাজি হননি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্যালির সন্তানদের আগের কয়েক প্রজন্মে সবাই শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ শুধু একজন— বেটির দিদিমা। অর্থাৎ স্যালি ছিলেন ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, স্যালির সন্তানরা ৮৭.৫% শ্বেতাঙ্গ। যদিও মার্কিন দেশের আইন অনুসারে তারা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ, সবাই ক্রীতদাস।
ফিরে আসি স্যালির অন্য সন্তানদের প্রসঙ্গে। ১৮০৫ সালে জন্ম নেয় ম্যাডিসন। ১৮৭৩ সালে, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এক সংবাদপত্রে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি জানান যে তিনি নিজে ও স্যালির অন্য সন্তানরা আসলে টমাস জেফারসনের সন্তান।
জেফারসন তার উইলে ম্যাডিসন ও তার ছোট ভাই এস্টনকে মুক্ত করে দিয়ে যান। স্যালিকে অবশ্য তিনি উইলেও মুক্ত করে যাননি। তবে তার কন্যা ও উত্তরাধিকারী মার্থা (স্ত্রী মার্থার সন্তানদের মধ্যে একমাত্র সেই তখন পর্যন্ত জীবিত ছিল) তখন ঠিক মুক্ত না করলেও নিজের মত থাকার অধিকার দেন। শেষ জীবনে স্যালি ও তার দুই ছেলে ক্রীতদাস প্রথাহীন ওহিও রাজ্যে স্বাধীন কালো মানুষ হিসেবে বসবাস করেন। ম্যাডিসন ও এস্টন বিয়ে করেন ‘কালো’ মেয়েদের। তাদের সন্তানাদিও হয়।
এস্টনের বংশধরদের জেনেটিক পরীক্ষাতেই এখন প্রমাণিত যে তারা জেফারসনের বংশধর। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে নেচার পত্রিকায় একটি গবেষণাপত্র১ প্রকাশিত হয়। গবেষকরা জানান যে এস্টনের পুরুষ-ধারার বংশধরদের সঙ্গে জেফারসনের কাকার পুরুষ-ধারায় বংশধরদের ওয়াই-ক্রোমোজোম মিলিয়ে দেখা গেছে যে এস্টনের বংশধররা জেফারসনের বংশের সন্তান।
ওয়াই ক্রোমোজোম দিয়ে কী ভাবে তা প্রমাণ হল? মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে যে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে আর একটি হল ওয়াই ক্রোমোজোম। না, একটু ভুল বলেছি। কারণ সব মানুষের শরীরে ওয়াই ক্রোমোজোম থাকে না, থাকে শুধু পুরুষদের শরীরে। আর এটি তারা পায় বাবার কাছ থেক— মা-র শরীরে তো ওয়াই ক্রোমোজোম নেই-ই। ওয়াই ক্রোমোজোম প্রবাহিত হয় ‘পুরুষানুক্রমে’। বাবার থেকে ছেলে, ছেলের থেকে ছেলের ঘরের নাতি, সেখান থেকে তার ছেলে, তার ছেলে… — এইভাবে। জেফারসনের স্ত্রীর ঔরসে কোনও পুরুষ সন্তান ছিল না। কিন্তু জেফারসনের ওয়াই ক্রোমোজোম তো তার বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া। তাই জেফারসনের কাকার ‘পুরুষানুক্রমে’ বংশধরের সঙ্গে স্যালির ছোট ছেলে এস্টনের ‘পুরুষানুক্রমে’ বংশধরের ওয়াই ক্রোমোজোমের তুলনা করা হয়েছে, এবং দেখা গেছে তাদের ওয়াই ক্রোমোজোম একই গ্রুপের (পরিভাষায় যাকে বলে হ্যাপ্লোটাইপ)। ফলে এটা প্রমাণিত হল যে এস্টনের বাবা জেফারসনের বংশের।
জেফারসনের বংশের, এটা না হয় প্রমাণিত হল। কিন্তু জেফারসনের না হয়ে তার বংশের কোনও আত্মীয়ের সন্তানও তো হতে পারে এস্টন! না, তা নয়। ২০০০ সালে টমাস জেফারসন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এই গবেষণায় প্রাপ্ত আরো সব তথ্য ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে স্যালির সব সন্তানরাই টমাস জেফারসনের সন্তান। এইসব তথ্যের খুঁটিনাটিতে আর যাচ্ছি না।
এবার লেখার জাল গুটিয়ে আনার পালা। এক কথায় বলব যে ভার্জিনিয়ার অন্য প্লান্টেসন মালিকদের মতই জেফারসনের সম্পদ ও সম্পদের উৎস ছিল ক্রীতদাস প্রথা। ক্রীতদাসদের রক্ত-ঘামেই গড়ে ঊঠেছে তার বিখ্যাত মন্টিচেল্লো প্রাসাদ, যা এখন ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট, মার্কিন মুদ্রায় যার ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, দাস মালিক হিসেবে জেফারসন অন্য মালিকদের চেয়ে বিশেষ অন্য রকম ছিলেন না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিনি যে স্বাধীনতায় মানুষের স্বাভাবিক অধিকারের কথা বলেছেন, যৌবনে ওকালতি করার সময় তিনি তাঁর ক্রীতদাস ক্লায়েন্টের হয়ে ঘোষণা করেছেন যে “পৃথিবীতে সবাই আসে তার নিজের ওপর অধিকার নিয়ে”, তাঁর ক্রীতদাসদের তিনি সেই স্বাভাবিক অধিকার দেননি। সেই অধিকার কোনদিন পাননি তাঁর ‘যৌনদাসী’ স্যালি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই অধিকার দেননি তার ঔরসজাত তিন পুত্রসন্তানকেও।
অবশ্য, এ ব্যাপারে টমাস জেফারসন একা নন। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনও ছিলেন ভার্জিনিয়ার প্লান্টেশন মালিক ও দাস-মালিক। ক্রীতদাস-দাসীদের রক্ত-ঘামে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে ধনীদের একজন। ওয়াশিংটন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তখন তার এক ক্রীতদাসী পালিয়ে গেলে অন্য দাস-মালিকদের মতই তাকে ফেরানোর সব রকমের চেষ্টা করেছেন তিনি।
আসলে সক্রেটিসের গ্রীস হোক, বা জেফারসনের মার্কিন দেশ— সাম্য বা গণতন্ত্র সর্বদাই শাসকদের জন্য। তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয় যারা, তাদের জন্য সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র থাকে না। থাকে শুধু শোষণ।
টীকাঃ
১. (Foster, Eugene A.; et al. (November 5, 1998). “Jefferson fathered slave’s last child”. Nature. 396
খুব আগ্ৰহ নিয়ে পড়লাম।
তখমকার পরিস্থিতি মোটামুটি জানা থাকলেও দেশের প্রেসিডেন্টরাও যে (লিংকনের আগের) এই ভাবে জীবন কাটিয়েছেন তা জানা ছিল না। আপনার বর্ণনা ভারী সুন্দর এক নিশ্বাসে পড়া গেল।
It was an interesting research work on Thomas Jefferson. I HV bn enriched. Thanks for sharing such an info.
যতদূর মনে হচ্ছে দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্য বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ওই সময়। এই সব ঘটনার সঙ্গে আদৌ কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা জানতে পারলে খিদে মিটতো। সমৃদ্ধ হলাম। অভিনন্দন।
না, দাস প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন এর অনেক পরে। তবে এর কিছু পরে, জেফারসন যখন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তখন আফ্রিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ক্রীতদাস আনা আইন করে বন্ধ হয়। তাতে অবশ্য ভার্জিনিয়া ক্ষতি হয়নি। কারণ তাদের তখন নতুন করে ক্রীতদাস আনার প্রয়োজন নেই। ক্রীতদাসীদের সন্তানরাই হয় নতুন ক্রীতদাস। বরং কিছুটা লাভই হয়েছিল, কারণ যত ক্রীতদাস জন্ম নিচ্ছিল তত ক্রীতদাস ভার্জিনিয়াতে প্রয়োজন ছিল না– তাদের অন্য রাজ্যে বিক্রি করা দেওয়া হত। আফ্রিকা থেকে নতুন ক্রীতদাস আনা বন্ধ হবার ফলে মার্কিন দেশের বাজারে ক্রীতদাসের দাম বাড়ে। ভার্জিনিয়া লাভবান হয়।
খুব মর্মস্পর্শী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে উপসংহার টুকু যেন লেখার নির্যাস হয়ে বেরিয়ে এসেছে।
এমনিতেই ক্রীতদাস প্রথা তো হৃদয়বিদারক। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা অনেক বেশি সত্যি। শুধু যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, ধর্ষিতা হওয়ার ব্যাপারই নয়, হয়ত তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার এইযে, যৌন সম্পর্ক মানেই সন্তান– যে সন্তান হবে দাস!
ক্রীতদাসপ্রথা এমনিতেই মর্ম বিদারক। মেয়েদের ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি। ধর্ষণ, সম্মতিহীন যৌন সম্পর্ক তো আছেই। কিন্তু বোধহয় তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হল, এইসব যৌন সম্পর্কের ফলে যে সন্তানের জন্ম হবে, জন্ম থেকেই সে হবে দাস।
না, দাস প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন এর অনেক পরে। তবে এর কিছু পরে, জেফারসন যখন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তখন আফ্রিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ক্রীতদাস আনা আইন করে বন্ধ হয়। তাতে অবশ্য ভার্জিনিয়া ক্ষতি হয়নি। কারণ তাদের তখন নতুন করে ক্রীতদাস আনার প্রয়োজন নেই। ক্রীতদাসীদের সন্তানরাই হয় নতুন ক্রীতদাস। বরং কিছুটা লাভই হয়েছিল, কারণ যত ক্রীতদাস জন্ম নিচ্ছিল তত ক্রীতদাস ভার্জিনিয়াতে প্রয়োজন ছিল না– তাদের অন্য রাজ্যে বিক্রি করা দেওয়া হত। আফ্রিকা থেকে নতুন ক্রীতদাস আনা বন্ধ হবার ফলে মার্কিন দেশের বাজারে ক্রীতদাসের দাম বাড়ে। ভার্জিনিয়া লাভবান হয়।
শেষ বাক্যটার জন্যই বুঝি এত আয়োজন। এ বাক্য মাথায় নিয়ে অতীতের থুড়ি জগতের সব জ্ঞান চর্চা করলে ধারণায় ভাবালুতার ঘুম পাবে না।