ভারতীয় আদিবাসী বিষয়ে কিছু কথা
আদিবাসী অর্থাৎ ইংরেজি ট্রাইব শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ট্রাইবাস থেকে। এই শব্দটি রোমানরা ব্যবহার করতো প্রযুক্তিগত ভাবে অনুন্নত গোষ্ঠী বা জনজাতি বোঝাতে। ব্রিটিশ ভারতে (ইম্পিরিয়াল গেজেট অনুসারে) আদিবাসী বলে চিহ্নিত করা হতো সাধারণ নাম বিশিষ্ট কতকগুলি পরিবারের সমষ্টিকে যারা একই ভাষায় কথা বলে, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বাস করে এবং মূলগতভাবে এক হলেও সাধারণত অন্তর্বিবাহকারী নয়।
ডবলু এইচ রিভার্সের মতে আদিবাসী হলো একটি গোষ্ঠী যার সদস্যরা একই ভাষায় কথা বলে, যাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে কোন এক দায়বদ্ধতা আছে এবং জীবনসংগ্রাম বা যুদ্ধে একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করে।
ডি এন মজুমদারের মতে, আদিবাসী হলো কিছু পরিবার বা পরিবারগোষ্ঠীর সমষ্টি যারা একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলে, একটি সাধারণ অঞ্চলে বসবাস করে, বিবাহ, জীবিকা ও অন্যান্য সামাজিক- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ (Taboo) মেনে চলে এবং কাজ করবার জন্য বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে।
ব্রিটিশ তাত্ত্বিকরা আদিবাসীরূপে চিহ্নিত করেছিলেন সেইসব জনগোষ্ঠীকে যারা ভারতে প্রচলিত ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথার অন্তর্গত নয় এবং যারা সাধারণত লোকালয় হতে দূরে কোনো বিচ্ছিন্ন, দুর্গম অঞ্চল যথা পার্বত্য বা অরণ্যভূমিতে বাস করে। এই ধারা মেনেই এইচ এইচ রিজলে, ভেরিয়ার এলুইন, এ ভি ঠক্কর প্রমুখ নৃতাত্ত্বিক আদিবাসীদের ভারতের আদিম অধিবাসী বা আদিম বলে অভিহিত করেছেন এবং আদিবাসী সমাজগুলিকে ‘আদিম সমাজ’, ‘সরল সমাজ’, ‘সাক্ষরতাহীন সমাজ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জি এস ঘুরে এদের পশ্চাদপদ হিন্দু বলেছেন। গ্রীগসনের মতে এরা ‘পার্বত্য উপজাতি’।
এইসব পরস্পরবিরোধী সংজ্ঞা বা ভিন্ন ভিন্ন মত থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে একটি সাধারণ সংজ্ঞার মতো কোন স্থির দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে আদিবাসী জীবন ও সমাজের মতো একটি বর্ণময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ক্রমপরিবর্তনশীল বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। একারণেই আদিবাসী বিষয়ে আলোচনাকালে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা এদের কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্টের বিষয়ে একমত হয়েছেন। এগুলি হলো,
নির্দিষ্ট সাধারণ বাসস্থান : আদিবাসীরা একটি নির্দিষ্ট সাধারণ অঞ্চলে বাস করে। কিছু আদিবাসী যাযাবরবৃত্তি অবলম্বন করলেও তাদের গতিবিধি বা ভ্রমণক্ষেত্র একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সাধারণ নাম : আদিবাসী গোষ্ঠী একটি সাধারণ নাম দ্বারা পরিচিত হয়।
সাধারণ ভাষা : কোনো এক বিশেষ আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত মানুষরা সবাই একই ভাষায় কথা বলে।
ঐক্যভাব : আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের মধ্যে বিশেষ ঐক্যভাব দেখা যায়।
রক্তসম্পর্কিত বন্ধন : আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত মানুষরা বিশ্বাস করে যে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে রক্তসম্পর্ক বিদ্যমান। তাঁরা প্রত্যেকে বিশেষ একজন পূর্বপুরুষের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশ্বাসই তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যভাব রাখে।
বিশিষ্ট সংস্কৃতি : প্রতিটি আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থাকে।
অন্তর্বিবাহ : প্রত্যেক আদিবাসী গোষ্ঠী কেবলমাত্র নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহে করে।
ভারতীয় আদিবাসীদের বর্গীকরণ বা বিভাজন :-
ভারতীয় আদিবাসীদের চারটি ভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হলো,
১) ভৌগোলিক বা Geographical
২) অর্থনৈতিক বা Economical
৩) ভাষাগত বা Linguistic
৪) জাতিগত বা Racial
এগুলির মধ্যে শেষ বিষয়টি অর্থাৎ জাতিগত বিভাজনে এখন আর অনেক গবেষকই আস্থাশীল নন। জিনতত্ত্বের গবেষণার অগ্রগতির ফলে জাতি বা Race এর ধারণা এখন নৃতত্ত্ব থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে বলা যায়। তবে ভারতে এখনো আদিবাসী সমাজের উপর জিনভিত্তিক গবেষণা খুব কমই হয়েছে। কিছু গবেষক জিন গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ভাষাগত বা ভৌগোলিক বিভাজনের সঙ্গে মেলানোর বা সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেছেন তবে এ বিষয়ে এখনো অনেকদূর এগোনো বাকি বলেই আমার ধারণা। এখানে জাতিগত বিভাজন বিষয়টি আমরা উল্লেখ ও বিবরণ প্রদান করছি শুধু ঐতিহাসিক কারণে।
ভারতের আদিবাসী
১) ভৌগোলিক বর্গীকরণ: আদিবাসীদের বসতিস্থান অনুসারে সারা ভারতে বসবাসকারী আদিবাসীদের চারটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, এগুলি হলো –
ক) হিমালয় ও উত্তর- পূর্বের পার্বত্য অঞ্চল – এই অঞ্চলের মধ্যে আছে জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চল, আসাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা। এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে প্রধান হলো, জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের গাদ্দি, গুজারা, ভোট, উত্তরাখণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চলের থারু, পশ্চিমবঙ্গের টোটো, লেপচা, আসামের কুকি, মিজো, কাছারি, মেঘালয়ের গারো, খাসি, মণিপুরের থাডো, টাংখুল, ত্রিপুরার ত্রিপুরি ও রিয়াং, নাগাল্যাণ্ডের নাগা সম্প্রদায়। ভারতের প্রায় ১১ শতাংশ আদিবাসীর বাস এই অঞ্চলে।
খ) মধ্যভারত অঞ্চল – এই অঞ্চলের মধ্যে যে রাজ্যগুলির অংশ আছে সেগুলি হলো, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, ছত্রিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ। এখানে বসবাসকারী প্রধান আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি হলো, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, হো, পশ্চিমবঙ্গের ভূমিজ ও লোধা, উড়িষ্যার খন্দ, গন্দ, শবর, ছত্রিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের গন্দ, কামার, বৈগা, ভূমিয়া, করকু ইত্যাদি। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জনঘনত্ব এই অঞ্চলেই দেখা যায়। ভারতের ৫৭% আদিবাসী এখানেই বাস করে।
গ) পশ্চিম ভারত অঞ্চল – রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। রাজস্থানের মিনা এবং ভীল, গুজরাটের ভীল, দুবলা, ধোদিয়া, গামিত, মহারাষ্ট্রের কোলী, মহাদেও ও কোকনা এই অঞ্চলে বাসকারী প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠী। সারা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে ভারতের ২৭% আদিবাসীর বাস।
ঘ) দক্ষিণ ভারত ও দ্বীপ অঞ্চল – অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা, পুদুচেরি, লাক্ষাদ্বীপ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের চেঞ্চু, গন্দ, কৈয়া, কোন্দাকোরা, কর্ণাটকের নাইকাড়া, মারাতি, ইয়েরাভা, তামিলনাড়ুর ইরুলা, টোডা, মালাকুরাভান, কেরালার পুলাইয়ান, পানিয়ান ও কাদার, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে, জারোয়া, সেন্টিনেলিজ হলো এখানকার প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠী।
রাজ্যভিত্তিক উপজাতি, ২০১১ আদমশুমারি অনুসারে
২) অর্থনৈতিক বর্গীকরণ: ভারতীয় আদিবাসীরা নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। যদিও একই আদিবাসী গোষ্ঠী একাধিক জীবিকা বা পেশা অবলম্বন করতেই পারে এবং অনেকসময় করেও তবু অর্থনৈতিক বর্গীকরনের সময় কেবলমাত্র তাদের প্রধান পেশাকে গুরুত্ব দিয়ে তার ভিত্তিতে ভারতীয় আদিবাসীদের মোটামুটি ছয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ক) শিকারী ও সংগ্রাহক – আদিমতম জীবিকা বা পেশা, অরণ্যে জন্তু শিকার করে বা ফলমূল সংগ্রহ করে এখনো জীবিকা নির্বাহ করে ওঙ্গে, জারোয়া, বিরহোড়, চেঞ্চু প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী।
খ) পশুপালক –নীলগিরি পাহাড়ের টোডা সম্প্রদায় (মহিষ পালন), উত্তরাখণ্ডের ভোট (ভেড়া পালন) এরকম কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী যারা শিকারেও দক্ষ নয় আবার কৃষিকাজও তেমন জানেনা।
গ) স্থানান্তর কৃষিগোষ্ঠী – সাধারণভাবে অরণ্যবাসী গোষ্ঠী যারা জঙ্গলের কিছু এলাকা পরিষ্কার করে কয়েকবছর চাষ করে তারপর ঐ জমি পুনরায় অরণ্য অধ্যুষিত হতে দিয়ে অন্য কোনো জমিতে চাষ করে। নাগা ও কুকিদের ভাষায় এ হলো ঝুম, মারিয়া গন্দদের কাছে পেন্ডা, খন্দদের ভাষায় পদু, ভুঁইয়াদের ডাহি আর সাঁওতাল পরগণার পাহাড়িয়াদের ভাষায় এর নাম খাল্লু।
ঘ) স্থায়ী কৃষিগোষ্ঠী – সমতলভূমি বা অরণ্যপ্রান্তে বাসকারী আদিবাসী গোষ্ঠী অনেকেই স্থায়ী কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবনধারণ করে। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ (ধাপ চাষ) করে লেপচা বা ভোটরা, আবার হো, ভীল ওঁরাওরা সমতলভূমিতে সাধারণভাবেই চাষ করে তবে এদের কৃষির পদ্ধতি বা হাতিয়ার তেমন উন্নত নয়।
ঙ) হস্তশিল্পী – বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবিকা হস্তশিল্প যার মধ্যে আছে ঝুড়ি বোনা থেকে শুরু করে বস্ত্রবয়ন, ধাতুর কাজকর্ম সবই। বিরহোড়রা গাছের ছাল থেকে দড়ি বোনে, মাহালীরা ঝুড়ি বোনে, নাগা ও খাসিরা বয়নশিল্পে পারদর্শী, আগারিয়া বা অসুররা লোহার যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার বানাতে দক্ষ, বাস্তারের মারিয়া গন্দরা মদ চলাই করে। তবে আজকাল প্রায় কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীই সম্পূর্ণরূপে হস্তশিল্পের ওপর নির্ভরশীল নয়।
কেরালার একটি প্রাচীন উপজাতি কাট্টুনায়কানের সদস্যরা বছরের পর বছর ধরে বন্য মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করে
চ) মজুর শ্রেণী – ভারতীয় আদিবাসীদের এক বিরাট অংশ কৃষি ও শিল্প এই দুই ক্ষেত্রেই মজুররূপে কাজ করে। কৃষির মরশুমে সাঁওতাল, হো, ওঁরাও, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা দলে দলে সমতলের কৃষিক্ষেত্রগুলিতে মজুর হিসাবে কাজ করে। এছাড়াও চা-শিল্পে, পুর্ব ও মধ্য ভারতের খনি শিল্পে, টাটানগর, ভিলাই ইত্যাদি লৌহ-ইস্পাত শিল্পে আদিবাসী শ্রমিক প্রায় অপরিহার্য।
এসব ছাড়াও কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী লোকনৃত্য, লোকগীতি, (উত্তরপ্রদেশের নাট, তামিলনাড়ুর কোটা), সাপের খেলা (মধ্যভারতের সপেরা, তামিলনাড়ুর ইরুলা) জাদুবিদ্যা বা হাতসাফাই (দক্ষিণ ভারতের গারাদি) ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে। তবে বর্তমানে এইসব পেশার অনিশ্চয়তার কারণে আদিবাসীরা ধীরে ধীরে এসব পেশা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন এবং এক বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক সম্পদ আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হচ্ছে।
৩) ভাষাগত বর্গীকরণ : ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে ভারতের আদিবাসীরা প্রায় সবক’টি প্রধান ভারতীয় ভাষাই ব্যবহার করে। তবে এদের মধ্যে তিনটি ভাষাগোষ্ঠী প্রধান।
ক) অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠী – এই ভাষাগোষ্ঠীর প্রচলন মূলত ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যের আদিবাসীসমূহ ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের মধ্যে দেখা যায়। বোঝাই যাচ্ছে যে এ ভাষায় কথোপকথনকারী আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো হলো, গাদবা, খারিয়া, হো, কোল, মুণ্ডা।
খ) সিন-টিবেটান ভাষাগোষ্ঠী –মূলত হিমালয়ের পার্বত্য উপত্যকা ও পর্বত সংলগ্ন ভূমিতে বসবাসকারী আদিবাসী যথা চাম্বা, ভুটিয়া, লেপচা, টোটো, নাগা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষদের ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
গ) দ্রাবিড়িয়ান ভাষাগোষ্ঠী – প্রধানত দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে এই ভাষাগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ ভাষায় কথা বলে উরুকেলা, গন্দ, বাদাগা, খাদার, চেঞ্চু ইত্যাদি আদিবাসীরা।
সাউথ এশিয়ার ভাষাপরিবার, ছবি:এ হিস্টোরিক্যাল অ্যাটলাস অফ সাউথ এশিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে যে আদিবাসীদের নিজস্ব কোন ভাষা নেই কেবল বিশিষ্ট বাচনভঙ্গী (Dialect) বা ‘বুলি’ আছে, কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। ভাষাতাত্ত্বিকরা আদিবাসী ভাষাসমূহ পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন যে এগুলিও অন্যান্য ভাষার মতোই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বতন্ত্র ভাষা। তবে এগুলির কোনো লিখিত ঐতিহ্য নেই কেবল মৌখিক পরম্পরায় অস্তিত্ব রয়েছে। উড়িষ্যার সাঁওতালদের লিপি ‘অলচিকি’ এ বিষয়ে একমাত্র ব্যতিক্রম। তবে অধুনা ককবরক ভাষাতে কিছু অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
৪) জাতিগত বর্গীকরণ : বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন সময়ে ভারতে বিভিন্ন জাতির মানুষের উপস্থিতি নিয়ে এবং পরবর্তীকালে এই সূত্রে অনেকে জিনগত বৈচিত্র্য নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই আলোচনা এবং গবেষণা এখনো চলছে। বর্তমানে জাতির ধারণার বদলে জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষকরা উৎসাহী। তবে জিনগত বৈশিষ্টের ভিত্তিতে কোনো বর্গীকরণ এখনো করা হয়নি। যদিও ভাষাগতবৈশিষ্টের সঙ্গে জিনগত বৈশিষ্ট্য মেলানো বিষয়ে কিছু কাজ হয়েছে। (উৎসাহীরা দেখতে পারেন, Genomic structures and population histories of linguistically distinct tribal groups of India by Partha P. Majumder et. Al.)
যদিও হাটন, রিজলে, বিএসগুহ, এম এস সরকার প্রভৃতি অনেকেই ভারতের আদিবাসীদের জাতিগত ভিত্তিতে বর্গীকরণ করেছেন কিন্তু ১৯৫২ সালে বি এস গুহকৃত বর্গীকরণটিই সর্বাপেক্ষা সমাদৃত। এখানে সেটিই দেওয়া হলো।
এই বর্গীকরণ অনুসারে ভারতের আদিবাসীদের পাঁচটি প্রধান জাতিতে ভাগ করা যায়।
ক) নেগ্রিটো – দক্ষিণভারতের কাদার, ইরুলা, পানিয়ান, আন্দামান- নিকোবরের ওঙ্গে জারোয়া এই জাতির মানুষের উদাহরণ। এদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো, ছোট মাথা, চ্যাপ্টা বড় নাক, কম দেহদৈর্ঘ্য ও গাঢ় বাদামী গাত্রবর্ণ।
খ) প্রোটো-অস্ট্রালয়েড – এ জাতির মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, লম্বা মাথা, চওড়া ও চ্যাপ্টা নাক (Platyrrhine), কম দেহ দৈর্ঘ্য ও গাঢ় বাদামী গাত্রবর্ণ। মুণ্ডা, ওঁরাও, হো, বৈগা প্রভৃতি প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতির আদিবাসী।
গ) মঙ্গোলয়েড – এ জাতির মানুষের সাধারণ লক্ষণ হলো, উদগত গণ্ডাস্থি, মধ্যম উচ্চতা, চ্যাপ্টা মুখমণ্ডল, হাল্কা বাদামী গাত্রবর্ণ। নাগা, লেপচা, টোটো, ভোট ইত্যাদি মঙ্গোলয়েডজাতির আদিবাসী।
এছাড়াও বি এস গুহ অনুসারে ভারতে আছে ভূমধ্যসাগরীয় এবং পশ্চিমী চওড়া মাথার জাতি কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এদের কোনো প্রতিনিধি নেই।
অবশ্য আজকাল জাতি না বলে ভাষাপরিবার ধরে ভাগ করা হয়।
স্বাধীন ভারতে আদিবাসীদের যে ক’টি প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তার মধ্যে প্রধান হলো জমি হস্তান্তরণ অর্থাৎ আদিবাসীদের জমি গোষ্ঠীর বাইরের লোক বা আদিবাসী নয় এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে চলে যাওয়া বা জমির মালিকানা বদল।
ভারতে আদিবাসীরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত এই দু’ধরনের সম্পত্তি বা জমির মালিকানা ভোগ করেন। চাষের জমি সাধারণত ব্যক্তিগত এবং চারণভূমি গোষ্ঠীগত মালিকানাধীন। এইসব জমির ওপরে আদিবাসীদের মালিকানা সরকার স্বীকৃত এবং এটি বংশগত। তবুও এসব জমি ধীরে ধীরে জমি খাদক মহাজন বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে।
উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে, দ্রুত প্রসারিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে আদিবাসী এলাকায় বাইরের তথাকথিত সভ্য মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উপস্থিতি বেড়েছে । আদিবাসী সমাজ নিজেদের অজান্তেই এই প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ হয়ে পড়েছে। আর এই অর্থনৈতিক কাঠামোয় অর্থ অতি গুরুত্বপূর্ণ। অনুৎপাদক বা কম উৎপাদক জমি, প্রাচীন কৃষি-পদ্ধতি, অন্যান্য জীবিকার অভাব ইত্যাদি কারণে আদিবাসীরা সর্বদাই অভাবগ্রস্ত (অর্থের অভাব) থাকেন, এদিকে বিবাহ, মেলা, উৎসব প্রভৃতি সামাজিক দায়বদ্ধতা বা পোষাক, মদ এমনকি খাদ্যের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্যও তাঁদের ধারাবাহিক অর্থের প্রয়োজন হয়। এইসব অভাব মেটানোর জন্য এঁদের বহিরাগত মহাজন বা ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতেই হয়। এই সুযোগে মহাজনরা এঁদের দিয়ে সাদা কাগজে বা স্ট্যাম্প পেপারে টিপছাপ দিতে বাধ্য করে এবং আদিবাসীরা নিজেদের বংশানুক্রমিক জমি হারান।
মধ্যপ্রদেশের কোরবা, উড়িষ্যার সাওরা ও কোয়া, উত্তরপ্রদেশের থারু প্রভৃতি আদিবাসীরা এভাবেই নিজেদের জমি হারিয়েছেন এবং নিজেদের জমিতেই মজুর হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে যে কারণে এইসব এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে এবং আদিবাসী এলাকাগুলি বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।
হ্যাঁ, আদিবাসী স্বার্থরক্ষাকারী আইন অবশ্যই আছে কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আইন যথাযথরূপে প্রয়োগ হয় না। আইনের প্রয়োগকর্তাদের মধ্যেও আদিবাসী স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন প্রতিনিধির অভাব আছে। আধিকারিকদের একাংশের দুর্নীতি এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে অশুভ আঁতাতের কারণে আইন প্রণয়নের আসল উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হয় না। (এখানে উল্লেখ করা উচিৎ এ ধরনের দুর্নীতি এবং আঁতাত বিষয়ে বর্তমান লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে)।
বর্তমান ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার সবচেয়ে পশ্চাদপদ গোষ্ঠী এই আদিবাসীরা যে ধরনের দুর্ভাগ্যের শিকার তার আশু সমাধান প্রয়োজন কিন্তু সরকারি সদর্থক উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের সদিচ্ছা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান নেই।
তথ্য সংগ্রহ ও সুত্র :
- Tribal India – Nadeem Hasnain; Palaka Publication
- Invitation to Socia & Cultural Anthropology – K. N. Dash; Atlantic Publishers
- An Introduction to Social Anthropology – D.N. Majumdar, T.N. Madan; Mayur Books.
- সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান – ডঃ আর এম সরকার; সহযাত্রী প্রকাশন।