ভারতীয় রাজনীতির ট্র্যাজিক হিরো সুভাষচন্দ্র বসু
মনীষীদের জন্ম বা মৃত্যু দিনে আজকাল কিছু বলা বা লেখার দস্তুর চালু হয়েছে। সেই দস্তুর মেনেই এই রচনিকা। হয়ত কিছু কথা বিনিময়ের উপলক্ষ তৈরি করা যাবে। তবে এ ঠিক ইতিহাসের সমস্ত ব্যাকরণ মেনে লেখা নয়। এই লেখার সঙ্গে কেউ মন্তব্য-শিল্পের মিল পেলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তথ্য যুক্তি আর আবেগের রসায়নে সুভাষ বসুকে চেনায় এবং চেনানোয় আমাদের অনেক অপরাধ স্খালনের একটা সাবধানি সংক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা হিসাবেই আপাতত কিবোর্ডে হাত রেখেছি।
২৩ জানুয়ারি এলে অনেক ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, সুভাষ বসুকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বাঙালির যুক্তিহীন আবেগের ঘোর। বহু বয়স্ক মানুষ এখনও তাঁকে মৃত বলে মানতে চান না। জন্ম দিনে “নেতাজী ফিরে এস” বলে শ্লোগান দেন—যে ধ্বনি ১৯৭০-এও শুনেছি, ২০২০-তেও শুনলাম। অনেকেই তাঁকে গান্ধীর আপস রাজনীতির বিপরীতে একজন লড়াকু বিদ্রোহী আপসহীন সত্তার প্রতীক এবং সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতিনিধি হিসাবে দেখতে এবং দেখাতে চান। অসংখ্য বাঙালির মনের কোণে আজাদ হিন্দ বাহিনীর গঠন ও লড়াই সম্পর্কে এক মোহময় শিহরণ জেগে আছে। শ্রেণি রাষ্ট্র নির্মিত মূল ধারার গান্ধি-মিথের মতোই সমান্তরালে রয়েছে জনসমাজ সৃষ্ট পার্শ্বধারার সুভাষ-মিথ। দুই-ই আমাদের দেশের জাতীয় অহঙ্কার পোষক মিথ্যা-ভূষণ!
সুভাষ বসু শেষ দফায় বৈধ ইউরোপ ভ্রমণকালে বিয়ে করেছিলেন এবং কলকাতা থেকে পালিয়ে নানা পথ ধরে শেষে জার্মান প্রবাস কালে তাঁর একটি কন্যা সন্তানের ভ্রূণ সঞ্চার হয়—এটা বাঙালির গরিষ্ঠ অংশ মেনে নিতে পারেনি। তাদের কাছে সুভাষচন্দ্র হলেন “সন্ন্যাসীর তরবারি”—নরেন দত্তের সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য এবং আজীবন ব্রহ্মচারী, চিরকুমার! এই কৌমার্য তাদের যাচকাঠিতে এক বিশাল মাপের চারিত্র্যসম্পদ! আসলে এ যে এক প্রকার মধ্যযুগীয় হীনম্মন্যতা এবং নারীজাতির প্রতি এক অনপনেয় অপমান ক্ষেপণ, তা বুঝবার মতো সাবালকত্ব তাদের বোধ হয় চির অনায়ত্ত থেকে গেল!
এখানে বিশদে আলোচনার সুযোগ নেই, কিন্তু দু-এক কথা না বললে অন্যায় হবে। এমিলি শেঙ্কল সুভাষকে কাছে পেয়েছেন মাত্র দু তিন বছর, তাও একটানা নয়, খেপে খেপে; তারপর আটচল্লিশ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে বেঁচে থেকে অনুযোগহীন ভাবে প্রায়-বৈধব্য পালন করেছেন। দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। ভারত সরকারের অনুরোধেও কোনো রকম সুবিধা গ্রহণ করেননি। আর এই বিশাল বড় এবং উদার মনের মানুষটিকে আমরা আমাদের সেই নাবালকি মন থেকে তাঁর প্রাপ্য শ্রদ্ধার এক কণাও দিতে বা দেখাতে পারলাম না। বসু বেঁচে থাকলে এবং এটা দেখলে নিশ্চয়ই তাঁর ভক্ত সমর্থকদের এ হেন বিচারবুদ্ধি দেখে আনন্দে(?) আপ্লুতই হতেন!
এই ধারণা এবং বোধগুলো মিথ্যা হলেও সুভাষের দেশে আরও বহু দিন টিকে থাকবে। কেন না, আমরা বাঙালিরা বা ভারতীয়রা সহজে তথ্য ও যুক্তির ধার ধারি না। আমরা তথ্য এবং যুক্তি দিয়ে ইতিহাস নির্মাণ তো দূরের কথা, পড়ার কথাও ভাবি না, ভাবতে পারি না। “কচকচি” বলে সরে দাঁড়াই। এড়িয়ে যাই।
বলতে দ্বিধা নেই, এই সব দোষ আমারও ছিল। বহুকাল এক সুভাষময় ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোর থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এসে যখন থেকে যুক্তি দিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, দেখলাম, সুভাষচন্দ্র আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধির ছত্রছায়াতে থেকেই রাজনীতি করেছেন। কোনো বিকল্প বা সমান্তরাল ধারার জন্ম দিতে পারেননি। যদিও বৃহত্তর গান্ধিগিরির উদ্যানে তাঁর ছিল কিঞ্চিত ভিন্ন মতিগতি এবং অন্য গতিবিধি। যে দৃঢ় মতভেদ গড়ে উঠলে ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়, অন্য ছাতা খুঁজতে বা গড়ে তুলতে হয়, সেই জোর তাঁর ছিল না অনেক দিন। রাজনীতি যে শুধু সততা দিয়ে হয় না, সঠিক নীতিও লাগে, সঠিক সময়ে নিজের রাস্তা বেছে নিতে হয়, বিপক্ষের সঙ্গে নিছক সৌজন্য দিয়ে নয় মোকাবিলা করতে হয় বক্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া দিয়ে এবং তার পেছনে জন সমর্থন সংগ্রহ করে নিতে হয়—এই সব সাংগঠনিক সারসত্য তিনি বুঝেছেন বড় দেরিতে। যখন বুঝেছেন, তার অনেক আগেই গান্ধি নেহরু শ্রেণিচক্র তাঁদের ঘর গুছিয়ে নিয়েছে। ভারতের উদীয়মান জাতীয় বড় বুর্জোয়ারা তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্রদের ১৯২০-র মধ্যেই বেছে নিয়ে ফেলেছিল। সুভাষ বসু সেই তালিকায় ছিলেন না, বা হয়ত নীচের দিকে ছিলেন। ফলত, ১৯৩৮-৩৯ সালে ঘড়ি ধরে ধরে হরিপুরা-ত্রিপুরী-সীতারামাইয়া-পন্থপ্রস্তাব-পদত্যাগ—ইত্যাদি এক চমৎকার গোছানো ক্রমিক চিত্রনাট্যের প্রায় সফল মঞ্চায়ন বলে ভাবা যেতে পারে।ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ক্ষমতা সন্ধানী বানিয়ারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেও আপামর জনসাধারণের এক বিরাট অংশ যে তাঁকে হৃদয়ের অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল, এ বোধ হয় আর কোনোদিনই তাঁর জানা হল না। মিথ্যা অভিমানেই হয়ত তিনি বিদেশের অজানার উদ্দেশে একদিন পাড়ি জমালেন, তিন চারটে বেনামি পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে।
আজাদ হিন্দ সরকারের মঞ্চ থেকে গান্ধিকে “জাতির পিতা” সম্বোধন করে তিনি শেষবারের মতো তাঁর রাজনৈতিক অপরিপক্কতার নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রবীণতর নেতা হিসাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এক কথা। তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু গান্ধি-মিথ নির্মাণে তাঁর এই সাম্মানিক অবদান এক শক্ত অনড় ভিত গেঁথে দিয়ে গেছে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ নিয়ে আমরা এত কাল যা জেনেছি ও শুনেছি, তা আসল তথ্য থেকে অনেক যোজন দূর। একে তো দূরদর্শী রণনীতি হিসাবে অক্ষশক্তিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রেমিক ভাবা ও সেই অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের কৌশল নির্বাচন সম্পূর্ণ ভ্রান্ত রাস্তা ছিল। স্বাধীনতার শত্রুকে “শত্রুর শত্রু” সমীকরণে ফেলে সমাধানের প্রচেষ্টার প্রথম স্টেপটাই ভুল। এই ভুলটা পরে বোঝা গেছে এমন নয়, তখনই বোঝা উচিত ছিল। বোঝার মতো বুদ্ধি ও রসদ বসুর ছিল। না বুঝতে পারাটা ছিল নেতৃত্বের বিচক্ষণতার দিক থেকে একটা বড় পিছটান। সুভাষ বসুর ১৯৩০-এর দশকে বিশ্ব ভ্রমণ ও সমকালীন ইউরোপীয় রাজনীতি সম্পর্কে স্ব-অভিজ্ঞতার আলোকে এই ঘটনাস্রোত না বোঝার কোনো কারণই ছিল না। একই ভাবে এশিয়ায় জাপানের সম্প্রসারণবাদী ভূমিকা এবং স্বার্থও না বোঝার মতো জটিল কোনো পরিঘটনা ছিল না। তথাপি (অবিভক্ত সিপিআইয়ের ১৯৪০-এর দশকের একাধিক ভ্রান্ত বিশ্লেষণ ও পদক্ষেপ আপাতত অগ্রাহ্য করে) রাসবিহারী বসু ও সুভাষ বসুর দেশপ্রেম ও সদিচ্ছা সম্পর্কে এতটুকু সন্দেহ না করেও বলা যায়, তাঁরা জাপানের এই আজাদ হিন্দ বাহিনী নির্মাণে মদত দেবার প্রকৃত স্বার্থ ও গোপন ইচ্ছা বুঝতে পারেননি।
১৯৪৩-৪৪ সালে জাপানি আর্মি জানত যে তারা বিশ্ব যুদ্ধে পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে অ্যাংলো-আমেরিকান শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে। এখন তাদের দখল করা জমি থেকে দ্রুত ছাউনি তুলেসৈন্যসামন্ত মালপত্র যতটাবাঁচানো যায় নিয়েপিছিয়ে যেতে হবে। এই সময় একটা এমন সমর্থক সামরিক বাহিনী যদি থাকে যারা পেছন দিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, তাহলে সেই অ্যাংলো-আমেরিকান বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন খানিকটা শ্লথ হতে বাধ্য। সেই সুযোগে তারা ডেরা তুলে তুলে উত্তর অভিমুখে অনেকটা নিরাপদে সরে যেতে পারবে। সুভাষচন্দ্র একেবারে শেষ দিকে সম্ভবত খানিকটা আন্দাজ করেছিলেন, জাপান কেন তাঁদের প্রতিশ্রুতিমতো সমরাস্ত্র ও রসদ সাহায্য দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই তার কিছু কারণ আছে! আসলে জাপান ততটুকুই দিয়ে যাচ্ছিল, যতটুকুতে তাদের সীমিত উদ্দেশ্য সাধিত হয়। ভারতের মুক্তি শুধু নয়, আজাদ হিন্দ সেনাদের জীবন ও নিরাপত্তা নিয়েও তার তখন থোড়াই দুশ্চিন্তা!
পরবর্তীকালে যাঁরা আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াই নিয়ে ইতিহাস লিখেছেন, সেই বাহিনীর ভূতপূর্ব সেনাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বহু বৈদ্যায়তনিক গবেষক, তাঁরাও এই বিষয়টি হয় বুঝতে পারেননি, অথবা, বুঝেও উপেক্ষা করেছেন। সুধী প্রধান কিছুটা বুঝেছেন এবং লিখেছেন, কিন্তু তাঁর আবার লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল অবিভক্ত সিপিআইয়ের ১৯৪০-এর দশকের ভ্রান্ত বিশ্লেষণকে ন্যায্যতা প্রদান।বাকি যাঁরা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, ও বিশ্লেষক, তাঁরা অধিকাংশই বুঝুন বা না বুঝুন, সুভাষ ভক্ত সেজে এর নির্বিচার গরিমা কীর্তনকেই দলের সমর্থক বৃদ্ধির সহজ উপায় ঠাওরেছেন!
এখানে একটা টীকা যোগ করছি। ভুল করা মানেই দালালি নয়। সুভাষচন্দ্রের ভুলটাও ভুলই ছিল, দালালি নয়। আবার সিপিআই যে আগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, সুভাষ বসুকে “তোজোর কুকুর” বলে দাগিয়েছিল—তাও ছিল ভুল, ব্রিটিশের দালালি নয়। অনুরূপে গান্ধির অহিংসার পাঁচালিও একটা ভ্রান্ত পন্থা ছিল, ইংরেজদের দালালির মন্ত্রজপ নয়। রাজনীতিতে গণপক্ষের তরফে যে কোনো বড় মাপের ভুল করলেই শত্রুপক্ষের সুবিধা হয়, তবুও কোনটা ভুল আর কোনটা দালালি—তার মধ্যে সীমারেখা টানতে পারা আরও অসংখ্য ভুল থেকে বাঁচার একটা দশ বছরের ওয়ারেন্টি।
সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদেরটা অবশ্যই দালালি ছিল। তারা অনেক বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা আগাগোড়া ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার ধারণাকে বিরোধিতা করেছে। তারা দ্বিজাতিতত্ত্ব দিয়ে হিন্দু ভারতের প্রচার করে দাঙ্গা রাজনীতির চর্চা করে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার চেতনাকে অস্বীকার করেছে। বেশ সোচ্চারে। দেশে থেকে গেলে সুভাষ বসুর জন্যও যে তারা আর একজন নাথুরামকে নিয়োগ করত না—একথা জোর দিয়ে বলা যায় না!
সময় এসেছে, যখন আমাদের সমস্তআবেগ বা সুবিধার আকাশকুসুম ছেড়ে সত্য ও তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে নেতাজীর ব্যাপারে কথা বলতে হবে! বলতে শিখতে হবে।
তবুও আজ সুভাষচন্দ্র বসুকে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানাতে হবে। জানাতেই হবে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। তবে আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর কারণ অন্যত্র নিহিত।
প্রথম ও প্রধান কারণ, তিনি যতটা নগ্নভাবে হিন্দু মহাসভা ও সঙ্ঘের মতাদর্শকে ব্রিটিশের নির্লজ্জ দালালি হিসাবে চিহ্নিত ও নিন্দা করেছিলেন তার তুলনা সে যুগে কেন, এখনও বেশি পাওয়া যায় না। হিন্দু ধর্মের নামে ভোটভিক্ষা, হিন্দু রাষ্ট্রের শ্লোগান, হিন্দু মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস—হিন্দুত্ব লবির সমস্ত ক্রিয়াকলাপকেই তিনি কঠোর ভাষায় নিন্দামন্দ করেছিলেন।
দ্বিতীয় কারণ, সাম্প্রদায়িক সমস্যার নিরসনে তিনিই বোধ হয় একমাত্র কংগ্রেসি নেতা যিনি শ্রেণিগত দাবিদাওয়ার প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এই ব্যাপারে তাঁর কিছু বক্তব্য আছে যা অসম্ভব রকমের সময়োত্তীর্ণ। জামশেদপুরে টাটার ইস্পাত কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘটে তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা আজও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের কাছে শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় উদাহরণ!
তৃতীয় কারণ, তিনি হিন্দু মহাসভার কার্যকলাপ বন্ধে গান্ধিয়ানার বাইরে বেরিয়ে এসে সক্রিয় প্রতিরোধের রাস্তা নিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের একাধিক সভায় সুভাষ বসুর সমর্থকরা ইট পাটকেল ছুঁড়ে সভা পণ্ড করে দিয়েছে এবং শ্যামা মুখুজ্জের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে যখন সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলাই আবশ্যক তখন হিন্দু মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ শাসকের হাত শক্ত করছে, তাদের যে শান্তির এবং সম্প্রীতির বাণী শুনিয়ে কাজ হবে না, শক্ত হাতে সামলাতে হবে—এই বোধ তাঁর হয়েছিল এবং তাঁর দলের সমর্থকদের মধ্যে এটা পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। বলা যেতে পারে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারিগরদের কীভাবে গণ আপ্যায়ন করা উচিত সেই ব্যাপারে তিনি ভাবী কালের কাছে এক সার্থক ও সদর্থক উদাহরণ রেখে গেছেন।
চার নম্বর কারণ, আজাদ হিন্দ বাহিনীতেও ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি গান্ধিয়ানার বাইরে গিয়ে জাতপাত মেনে ধর্মে ধর্মে মিলন নয়, জাতপাত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মিলনের আওয়াজ তুলেছিলেন। জাত ধর্ম যার যাই হোক, সেনাদেরএকই কিচেনের রান্না একই ডাইনিং টেবিলে বসে এক সঙ্গেই খেতে হত। শুধু হিন্দু সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দেবে—সিঙ্গাপুরের এক মন্দির কর্তাদের এরকম প্রতিশ্রুতি শুনেও তিনি জানাতে দ্বিধা বোধ করেননি—হিন্দু মুসলিম শিখ সমস্ত সদস্যদের নিয়ে গেলে যদি চাঁদা দাও নেব, নইলে দিতে হবে না। মন্দিরওয়ালাদের সেই দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। গান্ধির মতো সমস্ত ধর্মীয় আচার বিচার কুপ্রথা কুসংস্কার মেনে নিয়ে ধর্মবিশ্বাসীর নিম্ন রুচিকে সন্তুষ্ট করে নয়, সেই সব কিছুর বিরোধিতা করেতিনি মনুষ্যত্বের আবাহনে মানুষে মানুষে ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন। রাম রাজত্ব আর রামধুনের বদলে তাই তাঁর শ্লোগান হয়েছিল “জয়হিন্দ”! ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালের একমাত্র সেকুলার শ্লোগান। “কদম কদম বঢ়ায়ে জা, খুশি সে গীত গায়ে জা” নগমার কলিতে কলিতে মন্দির নয় মসজিদ নয় আজাদির মঞ্জিলই ছিল একমাত্র উপাস্য। এই রাজনীতিই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীনাথন এবং তাঁর কন্যা সুহাসিনী আলি-র উত্থান সম্ভব করেছিল। যা আজ স্বপ্নের মতো মনে হয়।
প্রসঙ্গত, এই জাতীয় আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, ব্যক্তিজীবনে ধর্মে বিশ্বাসী হলেও, বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট থাকলেও, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ স্কুলের অধুনাতন লব্জশোভিত সনাতন জাতপাত-আকীর্ণ হিন্দুধর্মকে তিনি পেছনে ফেলে এসেছেন।উদ্ভিন্ন কৈশোরে বিবেকানন্দের যেটুকু প্রভাব তাঁর উপর ছিল, তাকে তিনি পরিণত যৌবনে কাটিয়ে উঠেছিলেন। জীবাত্মা-পরমাত্মা-মোক্ষের ধুন-বুলি এবং বিবেকানন্দের রাজনীতি বিমুখতা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি বলেই তিনি ভুল ঠিক যেভাবেই হোক রাজনীতিকেই জীবন যাপনের পদ্ধতি হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন এবং আঁকড়ে ধরেছিলেন। আমাদের জ্ঞাতলোকে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁর বিচিত্র জীবন শঙ্করীপ্রসাদ বসুদের দাবি বা নির্মাণের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না।
পঞ্চমত, মোহন দাস গান্ধিকে বাদ দিলে কংগ্রেসের সমস্ত নেতাই নিজেদের ভবিষ্যত বংশানুক্রমিক ক্যারিয়ার সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। গান্ধিও তাঁর জীবনের প্রথম বিয়াল্লিশ বছর প্রচুর অর্থ কামিয়ে তারপর স্যুটকোট ছেড়ে হাফ ধুতি পরেছিলেন। একশ শতাংশ ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছিলেন মাত্র একজন। সুভাষচন্দ্র বসু। সেদিন থেকে আজ অবধি ব্যতিক্রমহীন ক্যারিয়ার সর্বস্ব লোভী লুটবাজ রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে তাঁর চরিত্র এক উজ্জ্বল চন্দ্রমা।
সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা ভুল জায়গায় শ্রদ্ধা জানিয়ে চলেছি অনেক এবং অনেক দিন। আজ আসুন, মিথ্যার চাষ বন্ধ করে সঠিক জায়গায় তাঁকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি, করতে শিখি।
তথ্যসূত্রঃ
১) ‘Historical Journey of the Indian National Army’, National Archives of Singapore, Retrieved 7 July (2007)
২) Richard J. Aldrich, ‘Intelligence and the War Against Japan: Britain, America and the Politics of Secret Service’, Cambridge University Press, (2000)
৩) Christopher Bayly, Tim Harper, ‘Forgotten Armies: Britain’s Asian Empire and the War with Japan’, Penguin Books (UK), (2005)
৪) Ramesh Sakharam, ‘Benegal Burma to Japan with Azad Hind: A War Memoir 1941–1945’, Lancer Publishers, (2013)
৫) Hugh Toye), ‘The Springing Tiger: A Study of the Indian National Army and of Netaji’, Allied Publishers, (1959)
৬) Peter W. Fay, ‘The Forgotten Army: India’s Armed Struggle for Independence’, 1942–1945, University of Michigan Press, (1993)
৭) Michael Edwards, The Last Years of British India, London Cassell, (1963)
৮) Leonard Moseley, ‘Last Years of the British Raj’; Harcourt, Brace & World, Inc., (1962)
৯) Shah Nawaz Khan, ‘The I. N. A. Heroes: Autobiographies of Maj. Gen. Shahnawaz, Col. Prem K. Sahgal [and] Col. Gurbax Singh Dhillon of the Azad Hind Fauj’, Hero Publications,Stephen Cohen (Winter 1963)
১০) ‘Subhas Chandra Bose and the Indian National Army’, Pacific Affairs. 36 (4): 411–429.
১১) সুধী প্রধান, সুভাষ চন্দ্র, ভারত ও অক্ষশক্তি; পিপ্ল্স বুক সোসাইটি, কলকাতা, (১৯৯৪)
১২) সুভাষচন্দ্র বসুর রচনা – ১) তরুণের স্বপ্ন; ২) নূতনের সন্ধান; ৩) The Indian Struggle I-II; ৪) An Indian Pilgrim (autobiography); ৫) Crossroads; ৬) J. S. Bright (ed), Selected Speeches and Writings of Subhas Chandra Bose.
১৩) পশ্চিমবঙ্গ নেতাজী শতবর্ষ বিশেষ সংখ্যা, ১৯৯৭
ভালো যুক্তিপূর্ণ লেখা। কোন দিক কে ভার হয় নি। ভুল গুলোর ব্যাখ্যা ভালো লেগেছে। তবে আরো বেশী করে জানতে চাই।
হতাশ হলাম। এত একচক্ষু রচনা আশা করি নি।
ইতিহাস লেখনী নির্মোহ হওয়া উচিত। কোনো প্রেজুডিস বা প্রাক ধারণা নিয়ে ইতিহাস কথন পীড়াদায়ক ও ভ্রান্তকর। লেখক সচেতনে যে মতটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তা খানিকটা হলেও পক্ষপাতদুষ্ট। আরো একটু নির্মোহ আলোচনা প্রত্যাশিত ছিল।
খুব ভালো আলোচনা। আমার তো খুবই ভালো লাগলো।
খুব সুন্দর লেখাটা।বেশ নির্মোহ বিশ্লেষণ।
খুব ভালো লাগলো.
লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম, লেখক মহাশয়কে ধন্যবাদ জানাই, পরিশেষে একটা কথা না বলে পারছিনা যে সুভাষ বসু মহাশয়কে আমরা এখনো যথাযথ সম্মান জানাতে পারিনি ।
আলোচনাটা ভালো লেগেছে তবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতি তোজোর সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার দিকটা আরও বেশি করে তুলে ধরলে ভালো হতো!