সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আধুনিক বাংলা গানে গণসংগীতের ধারা (১৯৪০–৪৫)

আধুনিক বাংলা গানে গণসংগীতের ধারা (১৯৪০–৪৫)

ডালিয়া রায় চৌধুরী

জানুয়ারি ১৯, ২০২২ ১৭৬৮ 0

বিংশ শতাব্দীর একটি প্রতিবাদী ও সংস্কারবাদী শিল্পধারা হলো গণসংগীত। চল্লিশের দশকে বাংলায় গণসংগীত আন্দোলন ছিল একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ। শুধু গানে নয়, শিল্প-সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রেই চল্লিশের দশকে বেশ একটু লক্ষণীয় বিকাশ ঘটেছিল, যাকে সাধারণত বলা হয় বামপন্থী বা মার্কসবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে শ্রমমুখী ও মননশীল এই দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। ভারতীয় সংগীতচর্চার ইতিহাস সভ্যতার নিদর্শন অনুযায়ী পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন।

১৯৪০-এর গোড়ার দিকে ‘গণসংগীত’ নামটির সূত্রপাত হলেও যে শ্রেণির গানকে ‘গণসংগীত’ বা ‘গণগীতি’ নামে বিবেচনা করা হয়েছে, তাতে অনেকটা স্বতন্ত্র চরিত্র ও বোধের ব্যাপ্তি বোঝানো হয়েছে, যাকে পূর্বোক্ত জাতীয় সংগীত বা স্বদেশী সংগীত থেকে আলাদা করা যায়। স্বদেশী সংগীত বা দেশাত্মবোধক গান বলতে আমরা যা বুঝি, তার সঙ্গে ভাবে ও ভঙ্গিতে একটা পার্থক্য বোঝানোর জন্যই ‘গণগীতি’ বা ‘গণসংগীত’ শব্দের উৎপত্তি। 

‘গণসংগীত’ বাংলা গানের এমন একটি ধারা যা শিল্পীর সৃজনশীলতা ও মননের পরীক্ষানিরীক্ষামূলক একটি ফসল বলে মূল্যায়ন করার থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল সময়, সমাজ ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে শোষিত মানুষের অধিকার, বিদ্রোহ এবং মতাদর্শ নিয়ে তাঁদের জাগ্রত করার। সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করতে গেলে দেখা যাচ্ছে সেখানে স্বরূপ ও বিষয় নিয়ে বেশকিছু মতভেদ রয়েছে। গণসংগীতের রূপকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, ‘স্বদেশচেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশলো সেই মোহনাতেই গণসংগীতের জন্ম।‘ তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম।‘

সংগীতকার সলিল চৌধুরীর ভাষায়, শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাঙ্খা সংগ্রামের সাংগীতিক ইতিহাসই হলো গণসংগীত। গবেষক শম্ভুনাথ ঘোষের বিচার্যে, ‘যে সংগীত জণগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তাকেই বলে স্বদেশাত্মক বা রাষ্ট্রীয় গীতি বা গণসংগীত।

জার্মানির প্রখ্যাত মিউজিক কম্পোজার হানস এইসলার বলেছেন—’Mass song is the fighting song of the modern working class and to a certain degree folksong at a higher stage than before, because it is international.’ 

উপরোক্ত সংজ্ঞার্থের বিভিন্ন মন্তব্যে সূক্ষ্ম কিছু গরমিল রয়েছে কারণ, গণসংগীতকে সাধারণ অর্থ ও বিশেষ অর্থ দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা হয়েছে।

পাশ্চাত্যে আধুনিকতার বিচারে প্রথম শ্রমিক আন্দোলন ১৮২০ সালে হয় ইংল্যান্ডে—যাকে মেশিন ভাঙা আন্দোলন বা ল্যাডাউড মুভমেন্ট’ বলে। ১৮৪৪ সালে সাইলেসিয়ার শ্রমিকদের আন্দোলনে জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের (১৭৯৭-১৮৫৬) লেখা ‘Song of the silessian weavers’— ‘In gloomy eyes there wells no tear grinding there teath, they are sitting here germany, your shround’s on our Loom; And in it we weave the threefold dom….we weave, we weave.’

অতঃপর ১৮৪৮ সালে ইংল্যান্ডে চার্চিস্ট আন্দোলন, ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের শ্রমিক রাষ্ট্র, কমিউন যোদ্ধা ইউজিন পোতিয়ের-এর (১৮১৬-১৮৮৭) লেখা ফরাসি ভাষায় ‘লা ইন্টারন্যাশনালে’ সংগীতের বঙ্গানুবাদ তিনজন করেন—শিবনাথ শাস্ত্রী, কাজী নজরুল, মোহিত মৈত্র —

Debout, les damnes de La terre

Debout, Les for cats de La faim

La raison tonne en son cratere

c’est l’eruption de La fin’,

জাগো অনশন বন্দী ওঠে ৱে যত….গান— 

ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিট্যুট’ (Y.C.I) -এর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে, কিন্তু ব্যাপকতা ও প্রসারের দিক থেকে এই আন্দোলন ছিল খুবই সীমাবদ্ধ এবং মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক। তাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গতিময়তায় Y.C.I কিছুটা তরঙ্গ তুললেও, প্রকৃতপর্বে বাংলা তথা ভারতের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (১৯৪৩)। তবে ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিট্যুট’ (Y.C.I) ছিল গণনাট্য সংঘের সূতিকাগৃহ। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ ফ্যাসিস্ত বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-র শাখা রূপেই মূলত ফ্যাসিবাদ- বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দেলন পরিচালনা করেছিল।১০

শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি মানুষের চেতনা যখন প্রতিবাদী মানসিকতায় নিষিক্ত হয়ে আন্তর্জাতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ হল, তখন সঠিক অর্থে গণসংগীত তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা নিয়ে হাজির হল। গণসংগীতে মূলত শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি জনগণের জীবনের কথা, সংগ্রামী চেতনা ও শোষণমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। ১৯১৭-তে যখন শ্রমিক বিপ্লব সংগঠিত হয়, বাংলায় প্রথম গণসংগীতরূপে চিহ্নিত করা হল শিবনাথ শাস্ত্রী রচিত ‘উঠো জাগো শ্রমজীবী জনতা’। ১৯২০ সালের পর সদ্যগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে নজরুল রচনা করলেন দুটি গান (১) কৃষকের গান (২) শ্রমিকের গান (১৯২৫) শ্রমিক বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে তিনি লেখেন— ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগীতের ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠোরে যত’ বাংলায় অনুবাদ করেন।

গণনাট্য সংঘের জন্ম হয়েছিল ফ্যাসিস্ত-বিরোধী আন্দোলনের উত্তর পর্বে, তবে তা আরো প্রসারিতরূপ লাভ করেছিল নানাবিধ সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে। গণনাট্য সংঘর মুখপত্র ‘লোকনাট্য’-র এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল —

| “ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিস্ট-দস্যু হিটলারের তাণ্ডবলীলা চলেছে। এশিয়ায় তার সাকরেদ তোজোর দল স্ত্রী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের রক্তে স্নান করে, একটার পর একটা দেশ গ্রাস করে বাংলার দুয়ারে উপস্থিত।… সেই দারুণ বিভ্রান্তির মাঝে পথ দেখালো এক অভিনব বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক অভিযান। মাঠের চাষী, কলের মজুর আর বিপ্লবী ছাত্রের কণ্ঠে গর্জে উঠলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের গান। সে গানের সুর ও কথা লক্ষ লক্ষ নিচের তলার মানুষের একান্ত আপনার। তাই লক্ষ কণ্ঠে সে গান ছড়িয়ে গেল কারখানা থেকে বস্তিতে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, হাটে মাঠে বাজারে, স্কুল কলেজে। গানের পাশে এসে জমলো যাত্রা, পাঁচালী, নাটক, লোকনৃত্য আরো কত বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপ। শ্রমিক, কৃষক, কবি ও শিল্পী রূপ দিলেন তাদের দৈনন্দিন জীবনকে, তাদের আশা আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে। বিভ্রান্ত দেশকে তাঁরাই দেখালেন পথ, তাঁরাই দিলেন নতুন সংস্কৃতি, যাঁরা যুগ যুগ ধরে পদানত, যাঁদের শিল্পজ্ঞান সম্বন্ধে অবজ্ঞা মিশ্রিত করুণা ও অবিশ্বাসই তথাকথিত সার্থক শিল্পী ও সাহিত্যিক মহল পোষণ করে থাকেন। সংস্কৃতিকে নিপীড়িত মানুষের জীবন সংগ্রাম ও মানব মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী হাতিয়ারে রূপান্তরিত করে জন্ম নিল ‘গণনাট্য সংঘ’।১১

এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুধুমাত্র লেখক ও শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক তথা বিভিন্ন অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাও এই আন্দোলনে যোগ দেন। ফ্যাসিজমের তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতেই কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্ট নীতি অনুসরণ করেছিল। মধ্য তিরিশের দশক থেকেই হিটলার, মুসোলিনির তাণ্ডবে গোটা বিশ্ব আক্রান্ত হয়েছিল। চল্লিশের দশকের গণসংস্কৃতি আন্দোলন-এর সূচনা ঘটেছিল বিশ্বযুদ্ধকালীন (দ্বিতীয়) বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে। ফ্যাসিস্ট-বিরোধিতার মূল মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন গণ আন্দোলন পরিচালনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন হল এরকমই একটি প্রচেষ্টা, তবে এই আন্দোলনের উপর বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাব অপেক্ষা সমসাময়িক ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ফ্যাসিবাদের চক্রান্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি, ভারতের পূর্ব সীমান্তে জাপানি আক্রমণ, ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৪৩-৪৪-এ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধের পরিসমাপ্তি, যুদ্ধোত্তর দিনগুলিতে অসংখ্য গণঅভ্যুত্থান, অবশেষে স্বাধীনতা ও দেশভাগ প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল সাধারণ মানুষকে, সুতরাং শিল্পীসাহিত্যিকদেরও।

বাংলায় গণসংগীতের উদ্ভব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বামপন্থীদের ভূমিকা, গণ আন্দোলনকারী উপাদান হিসাবে গণসংগীতের গুরুত্ব এবং পরবর্তীকালে গণসংগীত আন্দোলনের সঙ্কটকালীন অবক্ষয় এসব কিছুই আসবে আমার আলোচনায়।

বাংলা গণসংগীত সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে স্বদেশী সংগীতের ভূমিকা বা সৃজনাত্মক তত্ত্ব নিয়ে বিশ্লেষণের বিস্তারের একটা সাধারণ সূত্র বিদ্যমান। প্রাথমিকভাবে অনুমেয় যে, স্বদেশী গানই যেন গণ সংগীতের আগের ধাপ। কথাটা কোনো অর্থেই সঠিক নয়। অবশ্য একথা সত্য যে, চল্লিশের দশকের আগে-পিছে যারা এদেশে মার্ক্সবাদী তথা ব্যাপকার্থে কমিউনিস্ট ভাবনায় দীক্ষিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লববাদী দল-উপদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণসংগীত রচনা বা গাইবার অব্যবহিত আগে চল্লিশের অনেক গণশিল্পী গাইতেন স্বদেশী সংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত, তাদের স্মৃতিচারণ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ আর তিরিশের দশকে রচিত নজরুলের কিছু গান ব্যতীত বাংলা স্বদেশী গানে শ্রেণি সংগ্রাম তথা রক্তাক্ত বিপ্লবের কথা তেমন আসেনি। আসেনি মজুতদার বা মুনাফাবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথাও, তাতে নির্লিপ্তভাবে অনুপস্থিত ছিল আন্তর্জাতিক বিশ্বের উঁকিঝুঁকি। ঐতিহাসিক কালগত কারণেই তা আসেনি।

তবুও গণসংগীতকে আজও মেনে নেওয়া হয়ে থাকে স্বদেশী গানের উত্তরসূরীরূপে। একদা স্বদেশী গানের মাধ্যমে ব্রিটিশের অধীনতার ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও ক্রমে নতুন একটা সমাজবোধ যুক্ত হল স্বাদেশিকতার সঙ্গে। জাতি গর্ব এবং হিন্দুত্বের অভিমান ক্রমে এ গান থেকে বাদ পড়ল। তথাপি এই সংগীতে ফুটে ওঠে একটি দেশ ও জাতির ঐতিহ্য এবং বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যমূল্য, সুর ও ছন্দে নিবন্ধ হওয়ায় এই সংগীত মানুষের মনে স্বভাবতই ভাব ও গতির সঞ্চার করেছিল সরাসরিভাবে।। বীররসের নিহিতকরণ—এটি ছিল এর আরেক বিশেষত্ব।

সমকালীন নানা রাজনৈতিক ঘটনা ও সামাজিক ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালি সংগীতস্রষ্টা ও কবিরা বাংলা স্বদেশী সংগীত ও কবিতা রচনা করেছেন। আবার, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও নজরুলের দেশাত্মবোধক সংগীতে উপযুক্ত শর্ত ও লালিত্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক লালসা, জাত-পাত, সমাজজীবনের সকল সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম ঘটনাও ধরা দিতে থাকে সাহিত্য ও সংগীত রচনার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক (১৮৬০) এবং তার দু-একটি গান স্মরণীয়। নীল আন্দোলনে অত্যাচারিত এবং লাঞ্ছিত গরিব চাষিদের দুঃখে কবি গাইলেন –

‘হে নিরদয় নীলকরগণ                                                                                     আর সহেনা প্রাণে এ নীল দাহন।

হিন্দুমেলাকে (১৮৬৭) কেন্দ্র করে লেখা হল—

‘মিলে সবে ভারত সন্তান।‘

এরপর ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে (১৮৮৬) রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন— ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।‘

ক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে একমাত্র নজরুল ব্যতীত আর কোনো গীতিকারের কণ্ঠে তেমন কোনো নতুন ভাবনার গান জাগেনি। অবশেষে ১৯৪০-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছুঁয়ে উঠে আসে বাংলার গণসংগীত।

১৯৩৬ সালে সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠন এবং ১৯৪০ সালে কলকাতা বিবিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা গঠিত ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিটুট ছিল প্রকৃতপক্ষে এদেশে গণসংগীতের সূতিকাগার। অগ্রণী’ ও ‘পরিচয়’ এ দুটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মার্ক্সবাদী ভাবনাচিন্তার বুদ্ধিবাদীদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে বাংলা গণসংগীতের আভাস জেগে ওঠে ‘youth cultural Institute (Y.C.I) 1940 (১৯৪০) সালে প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। প্রধানত উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আলাপ-আলোচনা প্রচার, অভিনয়, পোস্টার, প্রদর্শনী, বিতর্কের আসর ও গানের মাধ্যমে তাঁদের কার্যকলাপ চালাতেন। তবে এঁদের সঙ্গে গ্রামীণ নিম্নবর্গের তেমন যোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এবং বিপ্লবাত্মক গান গাইতে গাইতে ক্রমে তাঁরা নিজেরাও গান লিখলেন। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, বিভিন্ন সামাজিকঅর্থনৈতিক সংকট, স্বাধীনতা সংগ্রাম— ইত্যাদিতে আলোড়িত সময়ে যখন বাংলা সংগীত জগৎ প্রায় ম্রিয়মান হয়েছিল, অথবা দুঃখের মায়াজগতে বিচরণ করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই মায়াভেদী ভূমিকায় হাজির হল গণসংগীত। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশক ছিল এর রাজত্ব। তারপর ক্রমপতনের রেখা স্পষ্ট হতে থাকে।

চিন্মোহন সেহানবীশের স্মৃতি-অনুসারে বাংলাদেশে নতুন ধারার গানের আন্দোলনের সূত্রপাত ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিটিউটের আমল থেকে। সেহানবীশের ভাষায়, সে আন্দোলন ছিল একান্তভাবে কলকাতার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মজুর কিষাণের সংগ্রামের সঙ্গে সে আন্দোলনের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না, এই সময়কার কিছু গান নিয়ে কমরেড বিনয় রায় শুরু করলেন তার আন্দোলন। গোড়া থেকে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো। বিটা কিষাণ সম্মেলন থেকে তিনি কিছু হিন্দি গানের প্রচলন করেন। ভারতভূষণ অগ্রবালের ‘বড়ে চলো’ গানটিও ওই সময়ের। এরই সাহায্যে ‘সোভিয়েত সুহৃদ সংঘ’-র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত-জার্মান যুদ্ধারম্ভের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে তিনি মাতিয়ে তুললেন সমস্ত জনসভাকে। এরপর ডোমার কিষাণ সম্মেলনে তাঁর উত্তরবঙ্গের ভাষায় লেখা গেরিলা গান—

‘হোই হোই হোই – জাপান আসে ঐ’ চাষিদের মধ্যে বিপুল উত্তেজনা সৃষ্টি করল। মফঃস্বল থেকে হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা হিন্দি গানও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গানের আন্দোলন যে ক্রমেই মধ্যবিত্তদের গণ্ডি পেরিয়ে আম জনসাধারণের দিকে এগোচ্ছিল তার এক প্রমাণ বিভিন্ন জেলায় প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় গান রচনা। ময়মনসিংহের ‘হাজং’ নামে আদিম জাতির মধ্যেও জনযুদ্ধের গান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিশনারিদের প্রভাবাধীন গারোদের মধ্যেও এই সুরের ছোঁয়া লেগেছিল।১২

জনযুদ্ধের গান’ সংকলনে সংকলিত গানগুলিই ছিল বাংলায় ফ্যাসিস্ত-বিরোধী গানের আন্দোলনের প্রধান অবলম্বন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গানের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হল—

(১)

‘স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় আর একলার

দেশে দেশে জণগণ ধরো আজ হাতিয়ার

কমরেড, ধরো আজ হাতিয়ার।

বিপ্লবী সোভিয়েট, বীর চীন

সাথী আজ ইংরাজ, মার্কিন

করো পণ, আছে প্রাণ যতদিন— ভারতকে, বিশ্বকে বাঁচাবার গুরুভার

নিতে আছি প্রস্তুত, মরতেও তৈয়ার।’..

(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

(২)

‘বজ্রকণ্ঠে তোলো আওয়াজ

রুখবো দস্যুদলকে আজ। দেবে না জাপানি উড়োজাহাজ

ভারতে ছুঁড়ে স্বরাজ।…

(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

(৩)

‘হোই হোই হোই

জাপান ঐ আস্যে বুঝি

হামার টারীত, ব্যারাও গাঁওয়ের

গেরিল্লা জুয়ান’…

(বিনয় রায়)

(৪)

‘জাপানকে ভয় করবো না গো।

ঘরের কাছে শত্রু এল। ও দেশবাসী এবার জাগো’…

(রামপ্রসাদী)

(৫)

‘রইবো না আর ঘরের কোনে ওরে ও চাষি ভাই,

আয়রে ছুটে আজ লড়ায়ে যাই।

জাপানিরা বিষম ডাকাত, তুলনা তার কোথাও নাই,..

(ভাটিয়ালি)

(৬)

এক হয়ে আজ দাঁড়াও দেখি মজুর কিষাণ— এক নিমেষে আসবে স্বরাজ পালাবে জাপান রে

কাস্তোটারে দিও জোরে শান।

(হেমাঙ্গ বিশ্বাস)

(৭)।

দস্যু রুখবার তরে

দস্যু রুখবার তরে, ঘরে ঘরে কৃষক সন্তান

ঐক্যবদ্ধ হইতেছিল রুখিতে জাপান।

(জনযুদ্ধের ডাক, নিবারণ পণ্ডিত)

(৮)

‘অব কোমর বনধ তৈয়ার হো

লাখ কোটি ভাইয়োঁ

হাম ভুখসে মরণেবালে, কেয়া মতসে ডরনেবালে

আজাদীকা ডঙ্কা বাজাও

উধাও অগ্নিধ্বজা’

(বিখ্যাত ফরাসি লা মার্সাই’ গানটির হিন্দিভাষান্তর হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)

‘জনযুদ্ধের গান’ -এর তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় বিনয় রায় লিখেছিলেন ‘..বাংলায় সংস্কৃতিক্ষেত্রে প্রগতি আনবার চেষ্টা চলছিল গত এক যুগ ধরে। কিন্তু সেই আন্দোলনের সঙ্গে গণজীবনের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না, ফলে, প্রচেষ্টা ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। আজকের গানের আন্দোলন সংস্কৃতিকে সেই ব্যর্থতা থেকে মুক্ত করে জনসাধারণের সঙ্গে সংযুক্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে এবং অনেকাংশে সমর্থ হয়েছে। মানতেই হবে ভাষা ও সুরের ক্ষেত্রে এ গানগুলোর অধিকাংশই ওস্তাদের আসরে স্থান পাবে না, কিন্তু সংস্কৃতিতে প্রগতি অর্থে যদি জনসাধারণের সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও ধারণা বৃদ্ধি বোঝায় তবে জনযুদ্ধের গান নিঃসন্দেহে সে কাজে অনেক সাহায্য করেছে ও করছে।… কিন্তু এ শুধু স্বদেশী আমলের স্বাদেশিকতার পুনরুজ্জীবন নয়। বলিষ্ঠ দেশপ্রেমের সঙ্গে এই গানের মধ্যে এসে মিলেছে ফ্যাসিজমকে রুখবার দুর্জয় সংকল্প, ব্যাপক আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আর মজুর-কিষাণের জীবন ও সংগ্রামের কথা।.. তাই এই গানের সহজ ও ধারালো কথার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে  ভারী সংস্কৃতির ইঙ্গিত।১৩

‘গণনাট্য সংঘ’ পরিবেশিত সংগীতের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ :

১) এই গানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধের সঙ্গে একইসঙ্গে দেশীয় জোতদার ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ স্পষ্ট।

২) বাংলার বিভিন্ন লোকগোষ্ঠী, বিচিত্র ভূখণ্ডে ছড়ানো ও বিবিধ সঙ্গীতিক আঙ্গিকে সক্রিয় এবং কৃষকশ্রেণির গভীরে প্রোথিত দেশীয় চেতনার প্রতিবাদী শিল্পরূপ। এক্ষেত্রে কয়েকটি গানের কথা উঠে আসে। যেমন লৌকিক সুরে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই গানটি ?

‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষাণ ভাইরে

কাস্তেটারে দিও জোরে শান। ফসল কাটার সময় এলে কাটবে সোনার ধান।

দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান্ রে

কাস্তেটারে দিও জোরে শান।

জনযুদ্ধের গান ও অন্যান্য ফ্যাসিস্ত-বিরোধী প্রতিবাদী গানের সংগীত পরিচালক ছিলেন বিনয় রায়। তাঁরই উদ্যোগে জনযুদ্ধের সময়ে নতুন আঙ্গিকে সংগীত আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। দেবেশ রায়ের কথায় :

গানের ক্ষেত্রে এই নেতৃত্ব দেন বিনয় রায়। তিনি প্রচলিত অর্থে গায়ক ছিলেন না, কিন্তু গান গাইবার একটা স্বাভাবিক শক্তি তাঁর ছিল, আর ছিল অসামান্য কণ্ঠসম্পদ। চল্লিশের দশকের গোড়ায় তিনি ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। শ্রমিক সভায় গানও গাইতেন। নতুন সংস্কৃতি আন্দোলনে বিনয় রায়ের ডাক পড়ল। তাঁকে নিয়ে তখনকার দিনের ট্রেড ইউনিয়ন এবং লেখক ও শিল্পী সংঘের ভেতর বেশ কিছুদিন টানাটানি হয়, শেষে পাকাপাকি তিনি সংঘে যোগ দেন।  

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রধানত বিনয় রায়ের নেতৃত্বদানেই সংঘের গানের দল স্বাতন্ত্র্য পেয়ে বেড়ে উঠতে থাকে, সংঘের ভেতরই এই গানের দল ও নাটকের দলের স্বাধীন বিকাশ ঘটতে থাকে। বিনয় রায়ের টানে আর ফ্যাসিস্ত-বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে বাদল খাঁ ভীষ্মদেবের ঘরানা এবং ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর সংগীতাসর থেকে সংঘে এসে পৌঁছে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র, কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। আর সংঘে এসে তিনি হয়ে উঠলেন প্রধান গীতিকার, প্রধান সুরকার, প্রধান গায়ক। নবজীবনের গান রচনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। এলেন শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। শুধুমাত্র নতুন নতুন গণসংগীতই নয়, রবীন্দ্রসংগীতেরও নতুন গায়ন আবিষ্কার করলেন এই শিল্পী। বহু সংখ্যক গায়কের উদাত্ত কোরাসে কোথায় উবে গেল শান্তিনিকেতন আর ব্রাহ্মসমাজের অচলায়তনের নিরুত্তর রবীন্দ্রনাথ, মিছিলে মিটিঙে গঞ্জে ময়দানে জন্ম নিলেন লড়াইয়ের, বিদ্রোহের, ভাঙনের রবীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্রনাথের গান নতুন গীতিকারদের গানের সঙ্গে ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের গানের সঙ্গে মিশে এক নতুন আয়তন পেয়ে গেল।

সিলেট থেকে গান আর সুরের ঝাঁপি নিয়ে এলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বাংলার গণসংগীত আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁর অবদানও অবিস্মরণীয়। শচীন দেববর্মন, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পঙ্কজকুমার মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ এসে সংঘের কেন্দ্র ৪৬নং ধর্মতলার সতরঞ্চিতে বিনয় রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিধাস, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুজাতা ও সুপ্রিয়া মুখোপাধ্যায়, প্রীতি সরকার, সাধনা রায়চৌধুরী, ভূপতি ও সুরপতি নন্দী, দিলীপ রায় প্রমুখের পাশে বসলেন। আর শ্ৰদ্ধানন্দ পার্ক ও মহম্মদ আলি পার্কে এসে পৌঁছলেন নানা আঞ্চলিক স্কোয়াড এবং টগর অধিকারী, রমেশ শীল ও শেখ গোমানি প্রমুখ।

‘বাঙলা গানের ঐতিহ্য, নতুন রচিত গান ও গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত লোক-সংগীত—বাংলাদেশের আন্দোলনের গানের এই তিনটি হছে প্রধান উপাদান। এই গান গাইবার ও শোনার আসরেও এক গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। গান কোনো স্বতন্ত্র অবসরের বিষয় নয়—গান রোজকার জীবনের অঙ্গ। গান কোনো অবসরভোগী শ্রেণীর উপভোগের বিষয় নয়—যারা খাটে, গড়ে, বানায় তাদের শ্রমের স্ফূর্তি, তাদের লড়াইয়ের আবেগ ও হাতিয়ার।১৪

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেত্রী কনক মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :

‘চল্লিশের দশকে লোকসংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড বিনয় রায়ের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সহজ সুরে গাওয়া অতি সাধারণ কথার গানগুলিও খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠত। আর পার্টি ও গণ-সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের নাচগানের আসরে তিনি বেশ নামাতেও পারতেন। এই সময় নানা আন্দোলন উপলক্ষে আমি বেশ কয়েকটা ছড়া গান লিখে তাকে দিয়েছিলাম ‘দেশরক্ষার ডাক’ নামে ১৯৪৩ সালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তার প্রকাশ করে। দাম দশ পয়সা। ভূমিকা লিখেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন ও বিনয় রায়।—লেখক)। একবার মনে পড়ে করপোরেশনের ধাঙ্গড়দের (বোধহয় ধর্মঘট উপলক্ষে) কলকাতা টাউন হলে একটা মিটিং হয়। সেই মিটিং-এর জন্যও গান বেঁধে দিতে হল। বিনয় রায়ের নেতৃত্বে করপোরেশনের কাউন্সিলর কমরেড ধীরেন ধর ও কলকাতা জেলার অন্যান্য নেতা ও কর্মীরা ধাঙ্গড়দের একটা ময়লা ঠেলার গাড়ী স্টেজের উপর ঠেলে নিয়ে সকলে গোল হয়ে নেচে গান করেছিলেন।… মহিলা সমিতির জন্য তো অনেকেই অনেক গান নাটক তৈরী করেছিলাম আমরা। রিলিফের কাজের জন্য ও ফ্যাসিস্তবিরোধী প্রচার আন্দোলনের জন্য মহিলা সমিতির কর্মীরা ‘ফুডকিউ’ ‘আত্মার ডাক’ প্রভৃতি নাটিকা অভিনয় করতেন। গ্রামে গ্রামে কৃষক মেয়েদের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে আনবার জন্য নাচ গানের অনুষ্ঠান হত। যেমন সমিতির নেত্রী ও কর্মীরা গোল হয়ে নেচে নেচে ভাটিয়ালি সুরে গান করতেন

‘ওরে ও বীরের মায়ের দল।

তোর সোনার ধানে বর্গি এল দেখরে চাহিয়া

আর কতকাল রইবি ঘুমে ওঠরে জাগিয়া—

(দেশরক্ষার ডাক)

‘১৯৪৩ সালে জুট ক্যাম্পেনের সময় চটকলের নারী শ্রমিকদের মধ্যে গিয়ে আমাদের মেয়েরা গান করত :

‘আগে বাড়ী জা মাইজী আগে বাড়ী জা

কারখানামে মজদুর নীতু, ঘরমে তু হ্যায় মা,

এক হাতমে কারখানামে ফয়দা বাড়ানো,

দুসরে হাতসে মাইজী তুমহার ঘরকো সমহলনা।

(দেশরক্ষার ডাক)

মহিলাদের মধ্যে এরকম নাচগানের জোয়ারের নেতৃত্বে ছিলেন রেবা রায় (রায়চৌধুরী, বিনয় রায়ের ছোট বোন) উষা দত্ত, সাধনা সেন, প্রীতি ব্যানার্জি প্রমুখ। আর বিনয় রায় ছিলেন সবারই শিক্ষক।১৫

বিনয় রায় ছাড়াও ৪৬নং-এর অপর আরেকজন সংগীত প্রতিভা ছিলেন ‘নবজীবনের গান’ (এগুলিও জনপ্রিয়তম ফ্যাসিস্ত-বিরোধী গীতিমালা, যদিও তা সংকলনরূপে প্রকাশিত হয় ১৯৪৫এর সেপ্টেম্বরে)-এর স্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। প্রাক-জনযুদ্ধ যুগে তাঁর সংগীত সাধনা ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ও রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যেই সীমিত। ১৯৪২ সালে হঠাৎ তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো বিনয় রায়ের। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর সংগীতের ধারাটাই এরপর আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেল। এ ব্যাপারে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র লেখায় :

‘..আমার বাড়িতেই বিনয়ের আড্ডা হল। বিনয় আমাকে বলত, আপনি তো প্রসিদ্ধ কবি সুরকার। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের নামে এই যে একটা এলানো, আমায় ধরো ধরো গোছের ব্যাপার চলছে—মানে রবীন্দ্রনাথকে বিকৃত করা, অংশকেই সমগ্র বলে দেখানো—একে ঠেকানো যায় না? আসুন, কিছু শক্ত শক্ত জোরদার রবীন্দ্রসংগীত বাছি এবং তাকে পপুলার করি। গীতবিতান’ দেখে অর্গান বাজিয়ে শুরু হল সেই চেষ্টা, কয়েকটা গানের কথা বড্ড মনে পড়ে ।

‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।

‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।

বাঁধ ভেঙে দাও।

‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি।

…তখন এইসব গান আমরা খুব গাইতাম। পার্টি মিটিং-এও গাইতাম। একদা বঙ্গভঙ্গের সময়, বাংলাদেশের মাঠেঘাটে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের মাটিতে যখন জাপানী বোমা পড়ছে, কোহিমায় আসামে যখন জাপানী উড়োজাহাজের হামলা শুরু হয়েছে—সেই অসম্ভব দিনগুলোয় রবীন্দ্রনাথের গান আবার এদেশের মাঠেঘাটে গাওয়া হয়েছিল। অন্যান্য গীতিকারদের প্রায় বিস্মৃত বা অল্প পরিচিত কিছু গানও আমরা এই সময় গাইতাম। স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে…’ গানটিতে আমি সুর দিয়েছিলাম।

‘হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম এইসময় খুব শুনতাম, বিনয়ের মুখেই বেশি শুনতাম। সাক্ষাৎ আলাপের আগেই হেমাঙ্গের অনেক কটা গান আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তার একটা ঐ ‘ওরে ও চাষী ভাই তোমার কাস্তেটারে জোরে দিও শান’..  ‘একদিন বিনয় বলল—আমাদের আড্ডা আছে বৌবাজারে আর ছেচল্লিশ ধর্মতলায়। চলো না। সেই যাতায়াত শুরু। ছেচল্লিশ নম্বরের চারতলায় তখন ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের জমজমাট ব্যাপার। গিয়ে দেখলাম এক মহাসঙ্গমে গিয়ে হাজির হয়েছি।….ছেচল্লিশ নম্বর তখন প্রকৃত অর্থেই কমিটমেন্টে বিশ্বাসী শিল্প সাহিত্যের মহাযজ্ঞ ও কর্মশালা।

‘গানে ছিল বিনয়, হেমাঙ্গ, জর্জ (দেবব্রত বিশ্বাস), হেমন্ত, সুজাতা-সুপ্রিয়া—সুচিত্রার দুই দিদি। তৃপ্তি আর সাধনাও তখন গান গাইত। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন এবং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ আসতেন।..

‘আমাদের কাজকর্মে আকৃষ্ট হয়ে হরীন্দ্রনাথ (চট্টোপাধ্যায়) মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন, ছেচল্লিশের আড্ডায় বসে সকলকে গান শেখাতেন।

‘সূরিয় অস্ত হো গয়া।

গগন মস্ত হো গায়া…

অব নভমে পতাকা

নাচত হ্যায় নাচত হ্যায়…’

এসব গান তাঁরই কাছে শিখেছি। জর্জ আর হেমন্তর দৌলতে একসময় মানুষ তো সূরিয় অস্ত্র হো গয়া’ গানটি পথেঘাটে গেয়ে বেড়াত।…

‘আর ছিল ইন্টারন্যাশনাল। মোহিত ব্যানার্জির বাংলা তরজমা—‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা’ হরীনদার হিন্দী অনুবাদ ‘উঠো জাগো ভুখে বন্দী অব খেচো লাল তলওয়ার’, উর্দুতে ‘কেয়া খাক হ্যায় তেরি জিন্দেগানী উঠ এয় গরিব বেনোয়া’… হরীনদার কাছে শেখা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের এই অনুবাদগুলি আমরা গাইতাম সভায়, স্ট্রীট কর্ণারে, এমনকি দল বেঁধে উঠলে ট্রামে বাসে ট্রেনে। গাইতাম ছেচল্লিশ নম্বরে।… ‘জাপান কোহিমা আক্রমণ করলে আমি একটা কাব্য ও গান লিখি, যার ধুয়াটা ছিল—

‘আর দেবো না আর দেবো না সোনার মণিপুর।

গানটি ধামাইলের সুরে সাধনা গাইছে আর হেমাঙ্গ, আমি, রোগা ডিগডিগে নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং ভূপতি কি সুরপতি খালি গায়ে কোমরে গামছা বেঁধে নেচে নেচে সাধনার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছি…

‘আমার গানের কতকগুলো সৃষ্টিভূমি ছিলো। প্রথমেই মনে পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের কথা। আমাদের গ্রেট সত্যেনদা। তার বাড়ির তেতলা। সেখানে তখন অরুণ মিত্রও থাকত।…।

‘আর ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের ঘরের একতলা। তার হারমোনিয়াম এবং তার সাহচর্য ‘নবজীবনের গান’কে পূর্ণ রূপ দিতে অনেক সাহায্য করেছে। জর্জকে সহযোগী হিসেবে পেয়ে নিজেকে বহু সময়ই ধন্য মনে হয়েছে। তাছাড়া, ছেচল্লিশ নম্বরকে প্রায় ল্যাবরেটরির মতো ব্যবহার করা হত।…

‘রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গান মনে আসত। এক-একদিন দুটো-তিনটে গানও আসত। যার বাড়ি হােক গিয়ে শোনাতাম, হারমােনিয়াম বাজিয়ে ঠিকমতো তুলে নিতাম। আবার মাঝে মাঝে দীর্ঘ ছেদ পড়ত। প্রকৃতপক্ষে, গোটা তেরশো পঞ্চাশ সাল জুড়েই ‘নবজীবনের গান’ সৃষ্টির পালা চলেছিল।…

‘বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা জন নবজীবনের গান গেয়েছিল। আমরা তো ছিলামই—হেমাঙ্গ, জর্জ, সুচিত্রা, হেমন্ত প্রমুখও নানা সময়ে এ গান গেয়েছে। নবজীবনের গান’ গ্রন্থে প্রকাশকের ভূমিকায় বলা হয়েছিল :

‘এই প্রসঙ্গে শ্ৰীযুক্ত (জ্ঞানপ্রকাশ) ঘোষকে অশেষ ধন্যবাদ গণনাট্য সংঘের পক্ষ থেকে জানাই। তার মত গুণীব্যক্তি যেরকম ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে একাজ অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন করেছেন তাতে আমাদের আন্দোলনের প্রতি তার অপরিসীম স্নেহ প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া শ্ৰীযুক্ত পঙ্কজকুমার মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত, হেমন্ত মুখার্জি ও দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি।‘১৬

এরপর দেখা দিল ১৯৪৩-এর ভয়াবহ মর্মান্তিক মন্বন্তর। সবেমাত্র জাপানী আক্রমণের ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই মন্বন্তর তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হল। মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তর ছিল যুদ্ধেরই অনিবার্য পরিণতি। কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সব সংগঠন তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করতে। এই সময়ে সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিয়ে এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পার্টি গঠন করেছিল একটি প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক ইউনিট। এতে ছিলেন বিনয় রায়, চিন্মোহন সেহানবীশ, সুধী প্রধান, অনিল কাঞ্জিলাল ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়।১৭ পরবর্তীকালে ১৯৪৩ সালে পার্টির সাংস্কৃতিক সেলে ষোল-সতের জন সদস্য ছিলেন। পূর্বোক্তরা ছাড়াও ছিলেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, রবীন্দ্র মজুমদার, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মণি রায়, অনিল সিংহ প্রমুখ।১৮ মন্বন্তরের মুখোমুখি দুর্ভিক্ষ পীড়িত, ক্ষুধার্ত বাংলাকে বাঁচানোর জন্য সেদিন গণসংগঠনগুলির মতো সাংস্কৃতিক সেলের কর্মীরাও যোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। নবজীবনের গান’-এর মতো সংগীত, ‘নবান্ন’-র মতো নাটক, ভুখা হ্যায় বঙ্গাল’ বা ‘স্পিরিট অফ ইন্ডিয়া’-র মতো ব্যালে নৃত্যের অবিস্মরণীয় উৎস ছিল এই মন্বন্তরের যন্ত্রণা। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এ প্রসঙ্গে বলেছেন :

..তারপর এল ১৯৪৩ সাল, বাঙলায় ১৩৫০। গোটা বাঙলাদেশ জুড়ে, বিশেষ করে কলকাতায়, মন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিল। আর ঘরে থাকা যাচ্ছিল না। জমাট সাহিত্যিক আড্ডা ও রিহার্সাল ছেড়ে আমরা সবাই রাস্তায় নেমে পড়লাম। চরম বিপর্যয় ও বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। চৌরঙ্গী, কালিঘাট, লেক মার্কেটের মোড়, বালিগঞ্জ…ওদিকে শেয়ালদা, শ্যামবাজারের মোড়। সর্বত্র এক দৃশ্য— শত সহস্র কঙ্কাল ফ্যান দাও, ফ্যান দাও বলে চিৎকার করছে। পেটের জ্বালায় গ্রাম উৎখাত করে শহরে এসে অন্নদাতা কৃষক ও জগদ্ধাত্রী কৃষাণী দু-মুঠো অন্ন ভিক্ষা চাইতেও সাহস পায় না—বলে ফ্যান দাও। | “মনুষ্যত্বের কী অবমাননা! গোরু ছাগলের খাদ্য নিয়ে মানুষে মানুষে কাড়াকাড়ি। ডাস্টবিনের পচা এঁটোকাটা নিয়ে কুকুরে মানুষে মারামারি। আর দেখলাম মৃত্যু—অমৃতের সন্তানরা মরছে যেন পোকামাকড়। একদিন দেখলাম মা মরে পড়ে আছে, তার স্তন ধরে অবোধ ক্ষুধার্ত শিশু টানাটানি করছে আর হেঁচকি তুলে কাঁদছে।

এর প্রচণ্ড অভিঘাত আমার গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম— -না-না। অস্থির পায়ে দৌড়তে দৌড়তে হেঁটে চলেছি আর মনে মনে বলছি We won’t allow people to die,

মানুষের তৈরি এই দুর্ভিক্ষ মানবো না, প্রতিরোধ করব, উত্তীর্ণ হব।…  

‘এই হল শুরু… সুর আর কথা মনের বেদনা ও যন্ত্রণার রুদ্ধ উৎসমুখ থেকে ঝর্ণার মতো বেরিয়ে এল। শুরু হল ‘নবজীবনের গান’

না না না।

মানবো না মানবো না

কোটি মৃত্যুরে কিনে নেবো প্রাণপণে

ভয়ের রাজ্যে থাকবো না।’…

এই সময়কালেই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র বিখ্যাত কবিতা ‘মধুবংশীর গলি’ শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে বারবার জেগে উঠত শত শত সভা সমাবেশ, হাটে-বাজারে, সর্বত্র।

‘স্বপ্ন জেগে উঠছে, উঠছে।

স্টালিনগ্রাদে, মস্কোভায়

টিউনিসিয়ায়, মহাচীনে, মহা আশ্বাসের প্রবল

দুর্দমণীয় ঝড় উঠেছে সৃষ্টির ঈশান কোণে, নিঃশ্বাসে

—এই সব পংক্তি আজ ইতিহাস। ১৯৪৩-৪৪ সালে মন্বন্তরবিরোধী কর্মোদ্যোগ ও ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন এবং সংগ্রাম গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মীরা একযোগে পরিচালনা করতে শুরু করে। একদিকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য সাহায্য সংগ্রহ, অন্যদিকে মন্বন্তর সৃষ্টিকারী জোতদার জমিদার ও ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের, তখন বলা হত ‘ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র’, অশুভ আঁতাতের মুখোশ উন্মোচন, এ উভয়বিধ উদ্দেশ্য সাধনার্থে সাংস্কৃতিক কর্মীরা গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য শিল্পানুষ্ঠান পরিচালনা করেন। হরিপদ কুমরির একটি গান মন্বন্তরকালে খুবই জনপ্রিয় হয়, ‘মরণ শিয়রে দলাদলি করে কেমনে। বাঁচবি বল সোনার বাংলা হল শ্মশান একসাথে সব চল’…।২০ এক্ষেত্রে বাউল সুরে সত্যেন সেনের একটি দুর্ভিক্ষের গান উল্লেখযোগ্য—কী করি উপায় রে কী করি উপায় /পঞ্চাশে বাঁচল হইল দায়। চাউলের দর ত্রিশ টাকা মন/ কেরোসিন তেল নাই / কাপড়ের দর দশ টাকা জোড়া ওষুধপত্র নাই

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নিজের অনেকগুলি দুর্ভিক্ষের উপর গান ছাড়াও, এসময়ে সুরথ পালচৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের যুগ্ম রচনা ‘বেদের গান’, বিনয় রায়ের ক্যানটিনের গান, কনক মুখোপাধ্যায়ের মুষ্টিভিক্ষার গান’, সাধন দাশগুপ্ত, জিতেন সেন, কুষ্টিয়ার (নদীয়া) আদম আলি শেখ ইত্যাদির অনেক গান সেসময় জনপ্রিয় হয়েছিল।২১

বিশেষ কোনো ঘটনার বিষয়ও গণসংগীতে প্রতিফলিত হত। যেমন—মালাকার কিযাণ সভায় চারজন কর্মী চারজনই কায়ুর গ্রামের অধিবাসী, ব্রিটিশের আদালতে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিনয় রায়ের গান ‘ফিরাইয়া দে দে দে মোদের কাইয়ুর বন্ধুরে।.. আবার তরুণ সম্ভাবনাময় কমিউনিস্ট লেখক সোমেন চন্দ ঘাতকের হাতে প্রাণ দিলে (৮ই মার্চ, ১৯৪২) সাধন দাশগুপ্ত লেখেন,

(আহা) তোমার বুকের খুনে পথ কে ভাসায় বন্ধু

একবার বল না।২২

যাই হোক, একথা বলা বাঞ্ছনীয় যে, মন্বন্তর কালে এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের সকল কর্মী।

তথ্য ও সূত্র নির্দেশিকা

১. সুকুমার রায়, ভারতীয় সংগীত ইতিহাস ও পদ্ধতি, ফার্মা. কে. এল. এম প্রা. লি., কলকাতা, সেপ্টেম্বর ১৯৮৮, পৃ. ১৮।

২. দিলীপ সেনগুপ্ত, প্রবন্ধ ‘গণনাট্য আন্দোলন ও বাংলা গানের ধারা—একটি সমীক্ষা, পৃ. ১৮৭।

৩. হেমাঙ্গ বিশ্বাস, গানের বাহিরানা, মৈনাক বিশ্বাস সম্পাদিত, প্যাপিরাস, কলকাতা ১৯৯৮, পৃ. ১৫১।

৪. দিলীপ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, গণনাট্য সংঘের গান, গণমন প্রকাশন, কলকাতা, ডিসেম্বর ২০০২, পৃ.৬।

৫. সুব্রত (দ্র, গণসংগীত সংগ্রহ, নাথ ব্রাদার্স, কলকাতা, নভেম্বর ১৯৯০, পৃ. ৫।

৬. দিলীপ মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ.৬।

৭. প্রাগুক্ত, পৃ.৬।

৮. দিলীপ মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ.৫।

৯. সাইম রানা, বাংলাদেশের গণসংগীত বিষয় ও সুরবৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমী প্রেস, ঢাকা, ১৪১৬৷৷ ২০০৯,

পৃ.৮।

১০. সুস্নাত দাশ, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাঙলা, প্রাইমা পাবিলিকেশন, ৮৯, মহাত্মা গান্ধী রোড,

কলিকাতা-৭, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল, ১৯৯৮।

১১. সুস্নাত দাশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।

১২. চিন্মোহন সেহানবিশ, ৪৬নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে কলকাতা, ১৯৮৪।

১৩. সুস্নাত দাশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১।

১৪. সুস্নাত দাশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮২।

১৫. কণক মুখোপাধ্যায়, জনযুদ্ধের যুগে : স্মৃতিচারণা, ঐক্যতান, স্মারক সংকলন, ১৯৮৬।

১৬. জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, আমাদের নবজীবনের গান ও কমিউনিস্ট পার্টির অর্ধশতক পূর্তি স্মারকপত্র, ১৯৭৬, প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৮১ সালে ‘কালান্তর পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়।

১৭. ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত, মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্ক, ১ম খণ্ড পৃ. ৩৫।

১৮. জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কমিউনিস্ট পার্টির অর্ধশতক পূর্তি স্মারক পত্র, ১৯৭৬।

১৯. তদেব।

২০. অনুরাধা রায়, চল্লিশের দশকের বাংলায় গণসংগীত আন্দোলন, প্যাপিরাস কল-৪( প্রকাশক-জৈষ্ঠ্য ১৩৯৯, জুন ৯৯২।

২১. তদেব।

২২. তদেব।

পিএইচডি গবেষক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়; ইতিহাস বিভাগ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।