সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রোমের পতন – ঐতিহাসিক বিতর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

রোমের পতন – ঐতিহাসিক বিতর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

এপ্রিল ৬, ২০২৪ ৫০৮ 2

“No event, or rather series of events, ever made a deeper impact on the mind and imagination of Europe. The ghost of the dead Empire has haunted us ever since. Men refused for long to believe that it was dead, for was not Rome eternal?”

  • J.J. Saunders, The Debate on the Fall of Rome

ইউরোপ, এমনকি মহাসাগরের ওপারে ইউরোপীয় সভ্যতারই সম্প্রসারিত রূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কল্পনা ও মননে রোমের পতনের দীর্ঘ ছায়া আজও বিদ্যমান। আজও ‘পশ্চিম’-এর পতন সংক্রান্ত যে কোনও বিতর্কে হামেশাই রোমের পতনের সঙ্গে তুলনা টেনে আনা হয়। বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন রোমান সাম্রাজ্যের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনও একদিন পতন হবে কিনা, ইউরোপের অতি-দক্ষিণপন্থীরা বর্বর আক্রমণের সঙ্গে তুলনা টানেন অভিবাসনের। মোট কথা, ‘পতন’ বলতেই ইউরোপীয়দের (এবং আমেরিকানদের) মননে প্রথম যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, তা প্রাচীন রোম-সংক্রান্ত। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, রোমের পতন বলতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শেষের দশকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কথা আমরা বলছি। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যা ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি বজায় ছিল, তার সম্পর্কে ইউরোপের ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ধারণা অন্যপ্রকার, সে এই আলোচনার বিষয় নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, আধুনিক ইউরোপের বদলাতে থাকা ঘটনাবলী রোমের পতন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আলোচনাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করা।

রোমের পতনের কারণ নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়েছিল বহুদিন আগেই। প্রাচীন যুগের শেষভাগ, মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের সূচনালগ্নে বহু বিদগ্ধ ধর্মগুরু, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ফিরে ফিরে তাকিয়েছেন রোমের পতনের দিকে। তাকে ব্যাখ্যা করেছেন নানা আঙ্গিকে। কিন্তু রোমের পতন সম্পর্কে আধুনিক অর্থে প্রথম ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করেছিলেন ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন। ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর মহাগ্রন্থ ‘দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্প্যায়র’। অবশ্য এইটি প্রথম বই ছিল না, যেখানে (পশ্চিম) রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক পদ্ধতির ভিত্তিতে এই গ্রন্থেই প্রথম তথ্য ও যুক্তি সাজিয়ে পতনের কারণ নির্ণয়ের প্রচেষ্টা করা হয়। এইদিক থেকে গিবনকেই রোমান সাম্রাজ্যের পতন সংক্রান্ত আধুনিক বিতর্কের জনক হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। 

যাঁরা ই. এইচ. কারের বই পড়েছেন, তাঁরা জানেন কোনও ইতিহাসবিদ-ই নিজের সময়ের বাইরে অবস্থান করেন না। সব ইতিহাসবিদের রচনাতে অতি অবশ্যই তাঁর নিজের সময়ের ছাপ থাকতে বাধ্য। গিবনের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। তিনি ছিলেন আলোকদীপ্তির যুগের যুক্তিবাদী ইউরোপিয়ান। তাঁর কাছে রোমের ‘আলো’-র অস্তের পর ধর্মপ্রধান মধ্যযুগের ‘অন্ধকার’-এর ‘উদয়’ ছিল একটি পারস্পরিক সংযুক্ত বিষয়। পঞ্চম শতকে নেমে আসা সেই আঁধার পেরিয়ে তাঁর প্রজন্মেই আবার ইউরোপীয়রা ‘আলোকদীপ্তি’-র সন্ধান পেয়েছে। তাই তাঁর কাছে রোমের পতনের ইতিহাস ছিল, ধর্ম, বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা সম্পর্কে এক সতর্কবাণী। এই কারণে গিবন তাঁর রোমের পতনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব দেন খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে নাগরিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের উপর। নিঃসন্দেহে বর্বর আক্রমণকে (বর্তমানে ‘বর্বর আক্রমণের তত্ত্ব’ অধিকাংশ ইতিহাসবিদই খারিজ করেন, পরিবর্তে ‘বর্বর অভিপ্রয়াণে’র কথাই বলা হয়ে থাকে) গিবন রোমের পতনের একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু এর পূর্বেও বহুবার বর্বর আক্রমণ হয়েছে। পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের যা অবস্থা ছিল, তার থেকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সেই আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। তাহলে রোমান সাম্রাজ্য পঞ্চম শতকের এই আক্রমণগুলি প্রতিহত করতে সক্ষম হল না কেন? গিবন বলেছেন এর কারণ রোমান সংস্কৃতির অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ের মূলে ছিল অতিরিক্ত আর্থিক বৈভব থেকে সৃষ্ট ধনী ও দরিদ্রের বিভাজন আর তার ফলে নাগরিক ঐক্যবোধের অবসান এবং খ্রিস্ট ধর্মের বিস্তার। এই কারণে ইহকালের উন্নতির থেকে পরকালের দিকে অধিকাংশ মানুষের নজর সরে যায়। এই অবক্ষয়ের ফলেই পঞ্চম শতকের রোমানদের মধ্যে সেই সকল গুণাবলীর একান্ত অভাব দেখা দেয়, যার বলে তাদের পূর্ব পুরুষরা এক সময় ভূমধ্যসাগরীয় পৃথিবী জয় করেছিল। 

গিবনের ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল’ – ১৯৪৬-এর সংস্করণ। খণ্ড-সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে ৭ করা হয়েছিল পাঠকদের সুবিধার্থে। 

গিবন রোমের পতনের যে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নির্মাণ করেন, তা পরবর্তী দেড়শত বছর এই সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আলোচনার ভিত্তি ছিল। জেমস জে. ও’ডনেল-এর মতে এডওয়ার্ড গিবনের সুদীর্ঘ ছায়া রোমের পতন সংক্রান্ত ধারণাকে দীর্ঘকাল নিয়ন্ত্রণ করেছে। গিবনের পথে হেঁটেই ইতিহাসবিদদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভেবেছেন রোমের পতন ছিল বর্বরতা ও ধর্মের বিজয়। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর পর সুদীর্ঘ রোমান শান্তির অবসানের পরেই নাগরিক জীবনে নৈতিক বিকৃতির বিষ দ্রুত প্রবেশ করছিল। এই বিষ রোমের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এরপর থেকে সাম্রাজ্য দাঁড়িয়েছিল কৃত্রিম এক কাঠামোর উপর। কালক্রমে যখন বিপর্যয় এই কাঠামোকে আঘাত করল, তখনই রোমান সাম্রাজ্যের প্রাসাদ ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। গিবন বলেছেন, অভ্যন্তরীণ নৈতিক সমস্যাবলী সাম্রাজ্যের ভেতরকে এত দুর্বল করে দিয়েছিল যে, বাইরের বর্বর জাতির স্রোতের মতো আগমনের চাপ তা সহ্য করতে পারেনি। 

গিবনের ইতিহাস রচনা ছিল রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ধারার। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রশ্নকে তিনি বিচার করেছেন রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তিতে। রোমান সাম্রাজ্যের হয় অস্তিত্ব ছিল, নয়তো ছিল না। এই দ্বৈত সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছু ভাবতে পারেননি। ৪৭৬ সাধারণ অব্দে তাই রম্যুলাস অগাস্টুলাসের সঙ্গে পশ্চিম রোমান রাষ্ট্রের পতন, তাঁর কাছে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন নথি ও প্রাচীন উপাদান ব্যবহার করে এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে তিনি এমনই যুক্তিজাল নির্মাণ করেন।

কিন্তু ইতিহাস সংক্রান্ত কোন দৃষ্টিভঙ্গিই চিরস্থায়ী হয় না। গিবনের পতন তত্ত্ব বা ‘Collapse Theory’ -এর বিরুদ্ধে প্রথম জোরালো প্রতিযুক্তি উঠে আসে বিংশ শতকের সূচনালগ্নে, ঐতিহাসিক অ্যাঁরি পিরেনের ভাষ্যে। বেলজিয়ান এই ঐতিহাসিক তাঁর বিখ্যাত ‘মুহম্মদ অ্যান্ড শার্লেম্যান’ নামক গ্রন্থে গিবনের ‘পতন তত্ত্বের’ একটি বিকল্প ভাষ্য হাজির করেন। পিরেনের মূল বক্তব্য ছিল পঞ্চম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক পতনের মধ্যে দিয়ে রোমান ব্যবস্থার পতন হয়নি। বরং পশ্চিম ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বহুলাংশে সপ্তম শতকের ইসলামের উত্থান ও আরবদের মধ্য প্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিজয়ের পূর্বে একই ছিল। রোমের পতনের পরেও রোমান মুদ্রা ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শাসন কাঠামো – ইত্যাদি বিভিন্ন তথাকথিত ‘বর্বর’ রাজ্যগুলিতে অক্ষুণ্ণ ছিল। জীবন যাত্রার মান ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক চরিত্রও অধিক পরিবর্তিত হয়নি। ‘পতন’ শব্দটির থেকেও পঞ্চম শতকের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির পর পশ্চিম ইউরোপে যে নতুন শক্তি কাঠামোর উত্থান হয়, তার সম্পর্কে ‘বিবর্তন’ শব্দটি অধিক যুক্তিযুক্ত। পিরেনের মতে, আরব দিগ্বিজয় যখন পশ্চিম ইউরোপকে অষ্টম শতকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সমৃদ্ধশালী অঞ্চলগুলির বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল, একমাত্র তখনই বলা যেতে পারে সেই অঞ্চলের শাসনকাঠামো, আর্থিক ব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তনের আগমন হল। সামন্ততন্ত্রের উত্থান শুরু হল, সূচনা হলো মধ্যযুগের। এর ভিত্তিতেই পিরেন বলেন, মহম্মদ না থাকলে শার্লেম্যানের উত্থান হতো না। অর্থাৎ ইসলামের উদয় না হলে, পশ্চিম ইউরোপ রোমান ঐতিহ্য ত্যাগ করে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের দিকে ধাবিত হতো না। 

ঐতিহাসিক অ্যাঁরি পিরেন

পিরেনের তত্ত্বের এমন অনেক দিক আছে, যা পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেননি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, গিবন মহাপ্রলয়-সম পতনের যে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন, যা ইতিহাসবিদদের কল্পনাকে এতকাল অধিকার করেছিল, পিরেনের তত্ত্ব তাতে জোরালো আঘাত হানে। তিনি প্রত্নতত্ত্বের সহায়তায় যে যুক্তিজাল নির্মাণ করেছিলেন, তাঁকে ছিন্ন করা সহজ ছিল না।

ইতিমধ্যে ইউরোপে গণযুগের আগমনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্থান হয়েছে ইতিহাস চর্চার নতুন ধারার। নতুন এই ইতিহাসবিদরা রাষ্ট্রের তুলনায় জনগণ ও সমাজের ইতিহাসে আগ্রহ রাখতেন বেশি। তাঁরা রোমের পতন সংক্রান্ত ইতিহাস আলোচনায় গিবনের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। অভিযোগ উঠল, গিবন ঘরানার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ইতিহাস আলোচনার ধারায় সাধারণ মানুষ একেবারেই অনুপস্থিত। তাই এই ইতিহাসবিদরা নতুন ক’রে রোমের পতনের যে ইতিহাসের অনুসন্ধানে ও লেখনে ব্রতী হলেন, তার কেন্দ্রস্থলে স্থান রইল সমাজ, অর্থনীতি ও সর্বোপরি সাধারণ মানুষ। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেন ফ্রান্সের ‘আনাল’ ঐতিহাসিকরা। পঞ্চম শতকের পতন সংক্রান্ত আলোচনা যত রাষ্ট্র থেকে সমাজের দিকে সরে গেল, ততই গিবন ঘরানার মহাপ্রলয়-সম পতন ও একটি যুগের অবসানের ভাষ্য আক্রমণের মুখে পড়ল। সামাজিক ইতিহাস থেকে ক্রমশ এই ধারণাই উঠে আসতে লাগল, যে রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামোর পতন সাধারণ রোমান নাগরিকের জীবনে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বিকেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামো এবং করের পরিমাণ হ্রাসের কারণে তাঁদের জীবনযাত্রার মানের কিছু উন্নতিই হয়েছিল। এই ব্যতীত সমাজে শিক্ষার ভাষা হিসেবে লাতিন ও ধর্ম হিসেবে রোমান খ্রিস্টান চার্চ তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখে। সাধারণ মানুষের মধ্যে রোমান রীতিনীতি ও আচার সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাহলে ‘রোমের পতন’-এর অর্থ কি? শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের উপরিকাঠামোর পতন? শুধু এই রাজনৈতিক পতনকেই কি ‘রোমের পতন’ বলা চলে? – এই প্রশ্নগুলি ক্রমে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ধারার ইতিহাসবিদদের বিব্রত করে তুলল। তাঁদের পতন তত্ত্ব ক্রমেই নতুন ধারার ঐতিহাসিকতার সামনে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করল। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করল। 

পতন তত্ত্ব-কে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিতে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি হলেন ইতিহাসবিদ পিটার ব্রাউন। অক্সফোর্ডের এই ইতিহাস গবেষক ১৯৭০ সাধারণ অব্দে রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ লেট অ্যান্টিকুইটি’। তিনি বস্তুগত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বললেন যে পঞ্চম শতকে যা ঘটেছিল তা কোনও আকস্মিক মহাপ্রলয় নয়। একটি দীর্ঘ সময় ধরে, তৃতীয় শতকের সংকটের সময় থেকেই পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে স্থানীয় শাসক ও অভিজাত এবং তারপরে নবাগত বিভিন্ন ‘বর্বর’ গোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের ক্ষমতা এবং এই সকল স্থানীয় শক্তির ক্ষমতার দড়ি টানাটানি ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। পঞ্চম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলো এই প্রক্রিয়ার পরিমাণগত পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করার পর গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়ার নিদর্শন মাত্র। এই শতাব্দী-ব্যাপী প্রক্রিয়া আকস্মিকও নয়, মহাপ্রলয়ও নয়। রোমান সাম্রাজ্যের মূল যে কাঠামো, তা হঠাৎ করে রাতারাতি কোথাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। নিছক ভিন্নরূপে পশ্চিম ইউরোপে সাম্রাজ্যের পতনের পর আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে তো সেইটুকু বদলও অনুপস্থিত। সেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তো বটেই, রাজনৈতিক কাঠামোও অক্ষুণ্ণ ছিল। সুতরাং পঞ্চম শতকে রোমের আলো নিভে ইউরোপে মধ্যযুগের আঁধার নেমে এসেছিল, এই ব্যাখ্যা একেবারেই ইতিহাস-সিদ্ধ নয়। 

বিংশ শতকের সাতের দশক থেকে এই শতকের শেষ পর্যন্ত ব্রাউন যে তত্ত্ব সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সেই ‘দ্রবণ তত্ত্ব’ আগের ‘পতন তত্ত্ব’কে একেবারেই কোণঠাসা করে দেয়। এই ভাবনাই ক্রমশ ইতিহাসবিদদের মননে দৃঢ় হতে থাকে যে রোমের আদৌ কোন পতনই হয়নি। যা হয়েছিল, তা হলো জলে যেমন গ্লিসারিন মিশে যায়, তেমনই নতুন ‘বর্বর’ রাজ্যগুলির সঙ্গে ‘রোমান’ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো মিশে গিয়েছিল। এরপর মনে হতে থাকে গিবনের তত্ত্ব চিরকালের মতো ইতিহাসের আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হতে চলেছে। 

কিন্তু নয়ের দশক থেকে আবার পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। প্রায় এক শতাব্দী ব্যাপী বিবর্তন ও দ্রবণ তত্ত্বের জয়যাত্রার পর তার বিরুদ্ধে পতন তত্ত্বের সমর্থকরা শুরু করেন প্রতি-আক্রমণ। এই আক্রমণের সেনাপতিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন ঐতিহাসিক ব্রায়ান ওয়ার্ড-পার্কিন্স। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য ফল অফ রোম অ্যান্ড দ্য এন্ড অফ সিভিলাইজেশন’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে দেখান, রোমান সাম্রাজ্যের পতন প্রকৃত অর্থেই মহাপ্রলয় ছিল। তিনি ব্রিটেনের উদাহরণ দিয়ে দেখান কিভাবে সাম্রাজ্যের পতনের তিন দশকের মধ্যে মুদ্রা ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, অব-নগরায়নের ফলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার পতন হয়েছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রোমান আমলের শহরকেন্দ্রিক মুদ্রাভিত্তিক আন্তর্জাতিক রূপের পরিবর্তে গ্রামকেন্দ্রিক বিনিময়ভিত্তিক স্থানীয় রূপ ধারণ করেছে এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পেয়েছে দ্রুত গতিতে। 

ওয়ার্ড-পার্কিন্স-এর যোগ্য সেনাপতিত্বে ‘পতন’ তাত্ত্বিকরা অবশ্য এই শতকের প্রথম দশকে ‘বিবর্তন’ ও ‘দ্রবণ’ তাত্ত্বিকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও এই বিতর্কের সংগ্রামে অন্তিম বিজয়লাভ করতে পরেননি (আর সেইরকম ‘বিজয়’ বোধহয় ইতিহাসের কোনও বিতর্কেই সম্ভব নয়)। বরং লড়াই চলতে লাগল সমানে সমানে। এই প্রেক্ষিতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন সংক্রান্ত এই বিতর্কে একটি ইতি টানার প্রয়াস করা হয় ইউরোপিয়ান সাইন্স ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে। তাঁরা ঐতিহাসিক পিটার হেদারকে এই দুই যুযুধান তত্ত্বের একটি সমন্বয়ের প্রয়াস করতে আহ্বান জানান।

এই আহ্বানে সাড়া দিলেন পিটার। তাঁর প্রচুর গবেষণার ফসল ছিল ‘ফল অফ রোম’।  পিটার দেখাতে সচেষ্ট হন, পতন তত্ত্ব এবং দ্রবণ তত্ত্ব একে অপরের বিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরেই এমন কতগুলি প্রবণতা ছিল যা তার পতনের কারণ হয়, একথা অনস্বীকার্য। পঞ্চম শতকে এই পতনের যে রাজনৈতিক রূপ ছিল তাকে অবশ্যই আকস্মিক ও মহাপ্রলয়-সম বলা যেতে পারে। কোনোভাবেই এই রাজনৈতিক পরিবর্তন ধীরে বা ধাপে ধাপে হয়নি। এইদিক থেকে ‘পতন’ পন্থীরা সঠিক। আবার অপরদিকে রোমের যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি প্রশাসনিক কাঠামো – তা বহুলাংশে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামোর পতনের পর উত্তরাধিকারী ‘বর্বর’ রাজ্যগুলিতে অক্ষুণ্ণ ছিল। শাসনের ভাষা, শিক্ষার ভাষা লাতিন-ই ছিল, ক্যাথলিক চার্চ ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছিল, প্রশাসনিক কাঠামো ও আইনব্যবস্থা রোমান সাম্রাজ্যের অনুকরণেই ‘বর্বর’ রাজারা শাসন পরিচালনা করতেন। এখানে মহাপ্রলয় ঘটেনি, বরং নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর দ্রাবকে রোমান সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্রাব ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে মিশ্রিত হয়ে প্রাচীন যুগের শেষভাগের (লেট-অ্যান্টিকুইটি) বিবর্তিত পশ্চিম ইউরোপের পরিস্থিতির দ্রবণ প্রস্তুত করেছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বিবর্তন’ ও ‘দ্রবণ’ পন্থীরা সঠিক। 

পিটার হেদারের রোমের পতনের ‘নয়া ইতিহাস’

রোমের পতন নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের এই অতি-সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ বিবরণ পড়ে অনেকেই ভাবতে পারেন যে, যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো। ‘পতন’ আর ‘বিবর্তন ও দ্রবণ’ এই থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের তো শেষ অবধি একটা সিন্থেসিস হয়েই গেলো। বিতর্ক আর রইল কোথায়? আছে মশাই, বিতর্ক এখনও রয়েছে। আজকাল নতুন একটি বক্তব্য উঠে আসছে। যে রোমের পতনের ইতিহাস এতকাল আলোচিত হয়েছে, তা বড্ড বেশি মানবকেন্দ্রিক। এই কাহিনীতে প্রকৃতি কোথায়? কোথায় জলবায়ুর বদল? কোথায় মহামারি? মানব ইতিহাসে এই বিষয়গুলির গুরুত্ব কত, আমাদের সময়ে বাস করে এই কথা আলদাভাবে বলার দরকার পরে না। তাই আবার একদল ঐতিহাসিক বসেছেন নতুন করে রোমের পতনের ইতিহাস লিখতে, যে ইতিহাসে তাঁরা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ুর বদল ও মহামারিকে। এই বিষয়ে এই যাবত অত্যন্ত প্রভাবশালী কতগুলি বই রচিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক কাইল হার্পারের ‘দ্য ফেট অফ রোম : ক্লাইমেট, ডিজি়জ়, অ্যান্ড এন্ড অফ অ্যান এম্পায়ার’।      

নতুন দৃষ্টিকোণে রচিত কাইল হার্পারের রোমের পতনের ইতিকথা

প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ করে প্রকৃতি, জলবায়ু আর মহামারিকে কেন্দ্র ক’রে রোমের ইতিহাস লেখার এত আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কেন? কেন ইতিহাসবিদরা এই বিষয়গুলিকে রোমের পতনের জন্য দায়ী করছেন? ঠিক সেই কারণেই, যে কারণে গিবন একদা ‘আলোকদীপ্তি’-র যুগে চার্চের সঙ্গে মুক্তচিন্তকের সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টধর্মকে রোমের পতনের জন্য দায়ী করেছিলেন। আজ আমাদের সামনে সবথেকে বড়ো সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে জলবায়ুর পরিবর্তন। আর মহামারি কি ভয়াল রূপ নিতে পারে সেই স্মৃতি আমাদের সকলের কাছেই টাটকা। তাই ইতিহাসের বর্তমান রাঙিয়ে দিচ্ছে অতীতের সঙ্গে ইতিহাসবিদের কথোপকথন। গ্লেন বোওয়ারসক্ মন্তব্য করেছেন – ‘অষ্টাদশ শতকের পর থেকে রোমের পতন আমাদের মনকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে, প্রত্যেক অবক্ষয়ের আদিরূপ হিসেবে এই পতন আমাদের দৃষ্টিতে ফিরে এসেছে বারংবার, তাই অবক্ষয়ের ভীতির প্রতীক রূপেই আমাদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে রোমের পতন।’ বিশেষ ক’রে পশ্চিম সভ্যতার দিক থেকে এই পর্যবেক্ষণ সঠিক। তাই পশ্চিমী সভ্যতা থাকবে, আর থাকবে তার অবক্ষয়ের ভীতি, রোমের পতনের কারণ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবসান হবে না। প্রত্যেক ইতিহাসবিদ তাকে ব্যাখ্যা করবেন নিজের মতো করে, নিজের সময়ের ভিত্তিতে। প্রতিবার সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁর দৃষ্টিতে এই পতন ধরা দেবে নতুনভাবে আর তিনি তা থেকে আহরণ করবেন নতুন নতুন শিক্ষা। তাই বলা যেতে পারে, এই বিতর্ক অন্তহীন, ইতিহাসেরই মতো।

তথ্যসূত্র – 

১) Daniel Woolf, A Concise History of History – Global Historiography from Antiquity to the Present, Cambridge University Press, 2019

২) Clifford Ando, Narrating Decline and Fall, Philip Rousseau (Ed.), A Companion to Late Antiquity, Blackwell Publishing, 2009

৩) J. J. Saunders, The Debate on the Fall of Rome, History, vol. 48, no. 162, 1963

৪) Peter Heather, The Fall of the Roman Empire – A New History of Rome and the Barbarians, Oxford University Press, 2007

৫) Bryan Ward-Perkins, The Fall of Rome and the End of Civilization, Oxford University Press, 2005

৬) Kyle Harper, The Fate of Rome: Climate, Disease, and the End of an Empire, Princeton University Press, 2017 

এম.ফিল গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য তালিকা - “রোমের পতন – ঐতিহাসিক বিতর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত”

  1. এত সল্প পরিসরে একটি ঐতিহাসিক মুল্যবান বিশ্লেষণ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
    অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখন ই সম্ভব না।
    আলোচনা সভার মাধ্যমে ই কেবলমাত্র ভাবনার প্রকাশ করা যেতে পারে।
    তবে একটা কথা, আমরা তো আজ ও পশ্চিমি সভ্যতার লেজুড়বৃত্তি করে চলেছি।
    স্বতন্ত্র মূল্যবোধ এর বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ করতে পারব কি যতদিন না এই প্রভাব মুক্ত হতে পারব।

  2. রোমান সাম্রাজ্য পতনের ঘটনাবলীকে ভিত্তি করে কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজাক অ্যাসিমভ রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত পাউন্ডেশন ট্রিলোজী। অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় কল্পবিজ্ঞানের ঠাঁই নেই, তবু ইতিহাসের ঘটনা থেকে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে লাফ দেওয়ার গুরুত্ব খানিক আলাদা। আসিমভ তাঁর কাহিনিতে পতনের কারণ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামননি। তিনি তাঁর লেখায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন রোমান সাম্রাজ্য পতনের পরবর্তী জগৎ কেমন হতে পারে তার কল্পনায়। সেখানে রোমান সাম্রাজ্যকে একটি বহু গ্যালাক্সি জোড়া সাম্রাজ্য ভাবা হযেছিল। এবং একজন সাইকোলজিষ্ট এমন একটি ইকুয়েশন বের করেন যার দ্বারা সাম্রাজ্যের পতনের কাল আগে থেকে বলা সম্ভব। সেই সম্ভাবনার জন্ম মানুষের মনোবিকাশের জগতে। ফলে এই গনক বিজ্ঞানী ভবিষ্তকে সুরক্ষিত করতে সৃষ্টি করলেন দুটো ভিন্ন ও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন প্রান্তে মানব উপনিবেশ। যাদের মনোবৃত্তি হবে আগাপাশতলা ভিন্ন। একটি হবে মুলত চিন্তাবিদদের জগৎ। আরেকটি হবে সম্পূর্ণ বস্তুবাদীদের জগৎ।
    এদের পারস্পরিক দ্বন্দ অথবা সহযোগিতা নির্ণয় করবে মানবজাতির ভবিষ্যত।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।