সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যে প্রগতিশীল চেতনার, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের, মার্ক্সবাদী ভাবধারার কবি, যার মৃত্যুর ৭৫ তম বছর এই বছর। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা কিশোর কবি প্রয়াত হন ১৯৪৭-এর ১৩ মে, টিবি রোগের শিকার হয়ে। অসুস্থ হয়েছিলেন আরও কয়েক বছর আগেই। বার বার তাঁকে যেতে হতো ১০ রডন স্ট্রিটে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ‘রেড এইড কিওর হোম’ বা যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে। এই হাসপাতালের লেডি মেরি হার্বার্ট ব্লকের এক নম্বর বেডে শুয়েই দুরারোগ্য ক্ষয়রোগের করাল গ্রাসে শেষবার ধরা দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর জন্য বাংলার কৃষকের ঘরের প্রায় সব ফসল দখল করে নেওয়ায় ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ইতিহাস সবারই জানা। দুর্ভিক্ষ সুকান্তকে উদ্বেলিত করেছিল মানুষের আরও কাছে ছুটে যেতে। কমিউনিস্ট পার্টির ত্রাণ শিবিরগুলিতে শেষ দানাটুকু পর্যন্ত যাতে কোনও আর্ত পান, সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। অথচ নিজে থেকে যেতেন অভুক্ত। পার্টি ও সংগঠনের কাজে এমন অস্বাভাবিক পরিশ্রমের ফলে তাঁর শরীর ক্রমেই জবাব দিচ্ছিল। সুকান্ত অদম্য, তাঁর কবিতার চেয়েও কিছু বেশি।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় ‘ছাত্র সংগ্রাম’ পত্রিকায় সেদিনের ছাত্র আন্দোলনের কথা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, পূর্ব বঙ্গে নোয়াখালীতে সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশন (এ. আই. এস. এফ.) সম্মেলন থেকে সুকান্তর ফিরে আসার কথা। সেই সম্মেলনে স্কুল ছাত্রদের সংগঠন কিশোর বাহিনীর জন্য চাঁদা তোলা হয়েছে। সেই চাঁদা বাবদ সংগৃহীত অর্থ নিয়ে সুকান্ত ফিরছেন। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে উঠেছেন। পেটে খিদে। পকেটে নিজের পয়সা সামান্যই বেঁচে আছে। খিদের তাড়নায় চায়ের কাপে পাউরুটি ডুবিয়ে খেয়েছেন, তবু কিশোর বাহিনীর জন্য সংগৃহীত অর্থে হাত দেননি। অনায়াসে সেখান থেকে কিছুটা খরচ করে ফিরে এসে সেই টাকা পূরণ করতে পারতেন। কিন্তু সংগঠনের অর্থ নিজের জন্য খরচ করা সুকান্তের পক্ষে অসম্ভব।
সততা, কৃচ্ছতা সাধন এবং বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে দেশ স্বাধীন করার ব্রতে ব্রতী সুকান্তকে গলা দিয়ে রক্ত তুলে মরতে হয়েছে। সুকান্তর অসুস্থতা তখনকার বাংলার সাহিত্যিক মহলকে, বিশেষত সমমনোভাবাপন্ন লেখকদের, আকুল করেছে। তার উদাহরণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা। সুকান্ত তখন শেষবারের মতো ভর্তি হয়েছেন যাদবপুরের হাসপাতালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাটি লিখলেন ১৭ এপ্রিল ১৯৪৭। দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকা, যে পত্রিকার কিশোর বিভাগের দায়িত্ব ছিল সুকান্তর উপর, তার ৪ মে, ১৯৪৭ সংখ্যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাটি প্রকাশিত হল —
“চৈত্রের পরিচয়ে তুমি সূর্য হতে চেয়েছ।
তোমার যক্ষা হয়েছে?
তোমার তরুণ রশ্মি দেখে ভেবেছিলাম,
বাঁচা গেল, কবিও পেয়ে গেছে নতুন যুগ।
তোমার যক্ষা হয়েছে?
এও বুঝি ষড়যন্ত্র রাত্রিজ মেঘের,
ঊষার যারা আজ দুর্যোগ ঘটালো।
… …
কবি ছাড়া আমাদের জয় বৃথা।
বুলেটের রক্তিম পঞ্চমে কে চিরবে
ঘাতকের মিথ্যা আকাশ?
কে গাইবে জয়গান?
বসন্তে কোকিল কেসে কেসে রক্ত তুলবে
সে কিসের বসন্ত!”
কালীঘাটের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের মামাবাড়িতে বাংলা বাংলা ১৩৩৩ এর ৩০ শ্রাবণ বা ১৯২৬-এর ১৫ আগস্ট, রবিবার, ষষ্ঠীর দিন জন্ম নেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। ফরিদপুর জেলার (অধুনা গোপালগঞ্জ) কোটালিপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামের ছেলে নিবারণ ভট্টাচার্য তাঁর বাবা, মা সুনীতি দেবী। এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবার। নিবারণ বাবুর দাদা ছিলেন পুরোহিত দর্পণ গ্রন্থের প্রণেতা। বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের ছিল বই প্রকাশনার ছোট্ট ব্যবসা। ‘সারস্বত লাইব্রেরি’। ছয় সন্তানের বাকি ভাইরা হলেন সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক এবং অমিয়। তাঁরা তখন থাকতেন বাগবাজার নিবেদিতা লেনের এক বাড়িতে। ছাত্র ছিলেন কমলা বিদ্যামন্দিরের। এই স্কুলেরই ছাত্রদের ম্যাগাজিন ‘সঞ্চয়’-এ তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। সেটি নিবন্ধ। তারপর আরেকটি লেখা লেখেন, ‘বিবেকানন্দর জীবনী’, যেটি ‘শিখা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য।
বাগবাজারের বাসা ছেড়ে বাবা চলে আসেন শ্যামবাজারের কাছে ১১ ডি রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে। সুকান্ত ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাই স্কুলে। শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেছেন। তারপর ঘটল তাঁর মহানিষ্ক্রমণ। ১৯৪২-এ গান্ধীজির ডাকে শুরু হল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। রাশিয়ায় হানা দিয়েছে জার্মানি। কমিউনিস্ট পার্টি ডাক দিল জনযুদ্ধের। দেশে তুমুল গণ আন্দোলন শুরু হয়েছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।
অল্প বয়সেই দিদি রাণী এবং মাকে হারিয়ে সুকান্তর ঘরের প্রতি টান কমে গিয়েছিল। একমাত্র জ্যাঠতুতো মেজো দাদা রাখাল ভট্টাচার্যের স্ত্রী মেজো বৌদি রেণু দেবীর একান্ত অনুগত ছিলেন সুকান্ত। রাখাল ভট্টাচার্য ছিলেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক এবং কলকাতা প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশ আমলে তিনিই একমাত্র বাঙালি, যিনি দ্য স্টেটসম্যান এর সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলেন। রাখাল ভট্টাচার্যর কন্যা মালবিকা চট্টোপাধ্যায় ও জামাতা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় দুজনই অধ্যাপক। মালবিকা চট্টোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক মহিলা ফেডারেশন (ডব্লিউ. আই. ডি. ডব্লিউ.)-এর প্রাক্তন সভানেত্রী ও জামাতা (এখন প্রয়াত) জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের অধ্যাপক আন্দোলন ওয়েয়কুটার সভাপতি ছিলেন। মালবিকা চট্টোপাধ্যায়ের ভাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
চল্লিশের দশকে বাংলার অনন্যসাধারণ ছাত্রনেতা ছিলেন অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য। সেই সময় মাত্র ১৬ বছরের কিশোর সুকান্ত তাঁর ঘনিষ্ঠ হন। অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য তখন এ. আই. এস. এফ.-এর রাজ্য শাখা বি. পি. এস. এফ.-এর সম্পাদক। সুকান্তর মতোই তিনিও এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্যের গড়ে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সুকান্তর গড়ে বেড়ে ওঠার অনেক মিল ছিল। অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রক্ষণশীল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করা সুকান্ত বিপ্লবী আন্দোলনে মানসিক সংহতি খুঁজে পান। আমারও প্রায় একই কাহিনি ছিল বলে দ্রুত আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই।”
অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্যই তাঁকে নিয়ে আসেন এআইএসএফে। এই সময় থেকেই তাঁর কবিতা লেখা শুরু। কবিতায় বা ছোট ছোট গদ্য সাহিত্যে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ অন্য মাত্রায় স্থান পেতে থাকে। উচ্চারিত হতে থাকে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণী-সহ শোষণহীন নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য দায়িত্ব দেন কিশোর বাহিনী গড়ে তোলার। সে কাজে তাকে তিনি সহায়তা পেয়েছেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু অরুণাচল বসু এবং পরবর্তীকালে বিশিষ্ট শিল্পী বেলেঘাটার দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। কলেজ স্ট্রিটের গায়ে ৮/২ ভবানী দত্ত লেনে ছিল কিশোর বাহিনীর দফতর। অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসুকেই মাতৃহারা সুকান্ত পরবর্তীকালে ‘মা’ ডেকেছেন, সেই সম্মানই দিয়েছেন আমৃত্যু।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “কিশোর বাহিনীর আন্দোলনে সুকান্তকে টেনে এনেছিলেন তখনকার ছাত্রনেতা এবং আমাদের বন্ধু অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য। রাজনীতিতে শুকনো ভাব তখন অনেকখানি কেটে গিয়ে নাচ গান নাটক আবৃত্তির ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা রসকষ এসেছে। কবিতাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের যেমন আসরে ঢুকতে হয়েছিল, সুকান্তর বেলায় তা হয়নি। সুকান্তর সাহিত্যিক গুণগুলোকে আন্দোলনের কাজে লাগানোর ব্যাপারে অন্নদারও যথেষ্ট হাতযশ ছিল।”
পূর্ববঙ্গে ১৯৪৩-এ ছাত্র সম্মেলন থেকে ফেরার পর ১৯৪৪-এ সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেলেন। তখন কলকাতায় জোরদার হচ্ছে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন। তাঁর আগেই বিশ্বের প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের প্যারিস সম্মেলন থেকে নানা দেশে গড়ে উঠছে অনুরূপ সংগঠন। ভারতে জন্ম নিয়েছে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। কলকাতায় তৈরি হয়েছে ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ, যাতে আছে হীরেন মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, চিন্মোহন সেহানবীশ, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, হারীণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা। ১৯৪১ সালে সত্যেন মজুমদারের সম্পাদিত ‘অরণি’ নামে ফ্যাসিবিরোধী পত্রিকা বার হল ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের’ মুখপত্র হিসেবে। এই পত্রিকাতেই ১৯৪৩-এর ২ এপ্রিল সুকান্তর ‘ক্ষুধা’ গল্প, ২৮ মে চিত্র-গল্প ‘দুর্বোধ্য’ এবং ১৯৪৪-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভদ্রলোক’ গল্প প্রকাশিত হয়। তার আগে, ১৯৪২-এ ঢাকায় খুন হয়ে গেলেন ফ্যাসিবিরোধী লেখক আন্দোলনের অগ্রণী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ।
সুকান্তর কথা লিখতে গেলে সেই সময়টাকে ভীষণ জরুরি। কারণ, সুকান্তর প্রতিভা তো ছিলই, কিন্তু তাঁকে নির্দিষ্ট একটি দিকে চালিত করে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছে সেই সময়কাল ও সেই সময়ের মানুষেরা, যাদের অনেকেই সাহিত্যিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সুকান্ত তখন তাঁর অসাধারণ শব্দচয়নে প্রচণ্ড গতির সঙ্গে ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলীর স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত ব্যবহারে বিরাট জায়গা দখল করে নিয়েছেন। সেই বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের থেকে ‘আকাল’ নামক একটি কাব্য সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্কলনের সমগ্র সম্পাদনার ভার এসে পড়ে সুকান্তর উপর।
এসব করতে গিয়ে সুকান্তর আর ঠিক মতো লেখাপড়াটাই হল না। বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাই স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু অকৃতকার্য হলেন। নৈর্ব্যক্তিক ভাবে একথা বলাই যায়, সেই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে গেল।
সেই সময়েই তরুণদের মধ্যে সুকান্তর জনপ্রিয়তা অসাধারণ, কিন্তু সেসব কবিতা বা লেখা প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা, অরণি বা অন্যান্য পত্রপত্রিকায়। তার কোনও কবিতার বই সুকান্তর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রথম বই ‘ছাড়পত্র’ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অগ্রজ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই বই ছেপে প্রকাশ হওয়ার আগেই সুকান্ত চলে গিয়েছেন এই পৃথিবী ছেড়ে না-ফেরার দেশে। সুকান্তর সৃজিত সাহিত্য সম্ভার হল — ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫)।
সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সুকান্ত সমগ্র, যেটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল সুকান্তর মৃত্যুর ২০ বছর পর, বাংলা ১৩৭৪-এর ৩১ শ্রাবণ, সুকান্তর ৪১ তম জন্মদিনের পরের দিন। যে কবির একটি বইও বেঁচে থাকতে আলোর মুখ দেখেনি, সেই কবির ‘সমগ্র’ বিক্রি হয়েছে ঝড়ের বেগে। পরের বছরই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তার পরের ২৮ বছরে ৩২ বার বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়। তৃতীয় সংস্করণ (২০০০) প্রকাশের পর অল্পদিনেই সেটিও নিঃশেষিত হয়।
অথচ, তাঁর জীবদ্দশায় অনেকেই তাঁর কবিতার সমালোচক ছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজেও ছিলেন সমালোচক। লিখেছেন, “সুকান্ত বেঁচে থাকতে তাঁর অনুরাগী পাঠকদের মধ্যে আমার চেয়ে কড়া সমালোচক আর কেউ ছিল কিনা সন্দেহ। … সামনাসামনি তাঁকে কখনো আমি বাহবা দিইনি। তাঁর লেখার সামান্য ত্রুটিও আমি ক্ষমা করিনি।… খুঁত ধরব জেনে নতুন কিছু লিখলেই সুকান্ত আমাকে একবার না শুনিয়ে ছাড়ত না”।
সুকান্তর জ্যেঠতুতো দাদা মনোজ একদিন সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তাঁর ১৪ বছর বয়সী ভাই সুকান্তর কবিতা এনে পড়ালে তিনি সেটা বিশ্বাস করেননি। ততদিনে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত ও সমাদৃত। কবি বুদ্ধদেব বসুও সুকান্তর কবিতা পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা তখন কলেজের ক্লাস পালিয়ে বিডন স্ট্রিটের এক চা দোকানে আড্ডা দিতেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “সন্দেহভঞ্জন করার জন্যেই বোধহয় মনোজ একদিন কিশোর সুকান্তকে সেই চায়ের দোকানে এনে হাজির করেছিল। সুকান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর কবিত্বশক্তি সম্বন্ধে কেন আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম, সে বিষয়ে কেউ যদি আমাকে জেরা করে আমি সদুত্তর দিতে পারব না।”
পরে পূর্বাভাস’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিস্ময়ের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় – “কারণ, বাংলা কবিতার ধারা তারপর অনেকখানি বয়ে এসেছে। কোনো কিশোরের পক্ষে ঐ বয়সে ছন্দে অমন আশ্চর্য দখল, শব্দের অমন লাগসই ব্যবহার সেদিন ছিল অভাবিত।” রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারা যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এমন রচনা প্রকৃতই বিস্ময়কর ও অসাধারণ। এমনিতে বাংলার সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সঙ্গে একসঙ্গে সুকান্তর নামটি উচ্চারিত হয়। অথচ, সুকান্ত কবিতা লিখেছেন বড় জোর তিন বছর, তাও জীবনের উপান্তে।
সুকান্তর কাছে বাকি সকলের নয়, পার্টি কর্মীদের ভাল লাগাটাই ছিল প্রধান। কারণ, কবিতাকে তিনি তৈরি করতেন সমাজ বদলের অস্ত্র হিসেবে। সমাজ বদলের কারিগরদের কাছে তার মূল্যটাই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “অসুখে পড়বার অল্প কিছুদিন আগে একদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এক মিটিঙে যাবার পথে আমার এক সংশয়ের জবাবে সুকান্ত বলেছিল : আমার কবিতা পড়ে পার্টির কর্মীরা যদি খুশি হয় তাহলেই আমি খুশি — কেননা এই দলবলই তো বাড়তে বাড়তে একদিন এ দেশের অধিকাংশ হবে।”
রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মদিনে ১০’ (বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি) কবিতায় লিখেছিলেন, —
“আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।”
এই কবিতা উদ্ধৃত করে সুকান্তর মৃত্যুর পর বিশিষ্ট কবি তথা বঙ্গবাসী কলেজ অফ কমার্স-এর অধ্যক্ষ জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “যে কবির বাণী শোনার জন্য কবিগুরু কান পেতেছিলেন, সুকান্ত সেই কবি। শৌখিন মজদুরি নয়, কৃষাণের জীবনের সে ছিল সত্যকার শরিক, কর্মে ও কথায় তাদেরই সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর, মাটির রসে ঋদ্ধ ও পুষ্ট তাঁর দেহমন। মাটির বুক থেকে সে উঠে এসেছিল।”
শেষদিকে নানা কারণে সুকান্ত মানসিক অবসাদে ভুগেছেন, তবে শারীরিক অবস্থার জন্য নয়। অরুণাচল বসুর মা সরলা দেবীকে, যাকে তিনি মা ডাকতেন, তাঁকে লিখেছিলেন, “আমি কোথাও চলে যেতে চাই… কোনো গহন অরণ্যে কিংবা যে কোন নিভৃততম প্রদেশে; যেখানে কোনো মানুষ নেই, আছে কেবল সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট-মনা হিংস্র আর নিরীহ জীবেরা, আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। … সমস্ত জগতের সঙ্গে আনার নিবিড় অসহযোগ চলছে। এই পার্থিব কৌটিল্য আমার মনে বিস্বাদনা এনে দিয়েছে, যাতে আমার প্রলোভন নেই জীবনের ওপর।… এক অননুভূত অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করেছে। সমস্ত পৃথিবীর ওপর রুক্ষতায় ভরা বৈরাগ্য এসেছে বটে, কিন্তু ধর্মভাব জাগেনি। আমার রচনাশক্তি পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে আসছে মনের এই শোচনীয় দুরাবস্থায়”।
সূত্র
১) প্রিয়ঙ্কা চৌধুরী , দ্য ডেইলি স্টার, ঢাকা, ১৩ মে, ২০২০
২) স্বাধীনতা পত্রিকা, ৪ মে, ১৯৪৭
৩) ছাত্র সংগ্রাম, ১৯৭৬
৪) www.poemhunter.com/sukanta-bhattacharya/biography
৫) Rhyming Revolution: Marxism and Culture in Colonial Bengal by Prof. Rajarshi Dsagupta
৬) কবিকিশোর, জগদীশ ভট্টাচার্য, পরিচয়, শারদীয়, ১৩৫৪
অপূর্ব লেখা। এত সুন্দর বাঁধন যে মনে হয় বারবার পড়ি। অনেক অজানা তথ্য যা জেনে পাঠক ঋদ্ধ হবে সুনিশ্চিত।
মন দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ
খুব ভাল লেখা। ধন্যবাদ।
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই
চন্দ্রশেখর দাদার লেখা বরাবরই তথ্যবহুল। পড়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলাম। আরো লিখুন আপনার কলমের দিকে তাকিয়ে রইলাম।