চিনি: একটি তিক্ত ইতিহাস
“কফি ও চিনি ইউরোপের আনন্দের জন্য অত্যাবশ্যক কিনা তা জানি না, কিন্তু এটা খুব ভালো করে জানি যে এই পণ্য দুটি বিশ্বের বিশাল অঞ্চলে দুঃখ ডেকে এনেছে। এগুলি চাষ করার জন্য আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে জনশূন্য করা হয়েছে। আর এগুলি চাষের জন্য মানুষ পেতে আফ্রিকাকে জনহীন করা হয়েছে।” (যে এইচ বার্নার্ডিন, ১৭৭৩)
আমরা সবাই মিষ্টি ভালবাসি। মিষ্টি বলতে শুধু রসগোল্লা সন্দেশের মতো মিষ্টান্ন নয়, চা-কফিতে চিনি, মিষ্টি ফল, মধু, সরবত, আইসক্রিম, চকোলেট, গুড় – কত কী। ফল বা মধু বাদ দিলে এগুলোর প্রায় সবেরই পেছনে আছে চিনি। আজ থেকে পাচশো বছর আগেও কিন্তু মানবজাতি চিনি কাকে বলে জানত না। এশিয়ায় আখ থেকে গুড় তৈরি হত, কিনতু চিনি নয়। ইউরোপে তো মিষ্টি বলতে ছিল একমাত্র মধু। মাত্র পাঁচশ বছরে চিনি আমাদের খাদ্যের প্রায় অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, মিষ্টি স্বাদের এই পণ্যটি ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। ডেকে এনেছে দাসপ্রথার মত জঘন্য প্রথা। এক একটা দেশকে, দেশের মানুষকে নিংড়ে শেষ করে দিয়েছে, অন্যদিকে কিছু মানুষের হাতে জমা করেছে অসম্ভব পরিমাণ সম্পদ।
আমার বালিকা বেলায় পড়েছিলাম সৌরীন সেনে ‘আখের স্বাদ নোনতা’। কিউবা বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এই বইয়ে স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল আখ ও চিনির কথা। কারণ ইউরোপীয় দখলদাররা আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের পূর্বে অবস্থিত কিউবা সহ দ্বীপগুলি ব্যবহার করেছে মূলত বাগিচা চাষের জন্য – আর তার এক নম্বরে থেকেছে আফ্রিকা থেকে আনা মানুষদের দাস হিসেবে ব্যবহার করে আখ চাষ। এই দাস-শ্রমিকদের কান্না-ঘামের স্বাদ নোনতা। তা থেকেই সেই বইয়ের নাম।
চিনির স্বাদ মিষ্টি হলেও মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়নের, দাস বানানোর, আক্ষরিক অর্থে খাটিয়ে মারার এই ইতিহাস এক অতি তিক্ত। সেই ট্রাডিশন এখনও চলেছে।
চিনি আবিষ্কারঃ ভারত
মিষ্টির প্রতি মানুষের টান সহজাত। চিনি আবিষ্কারের আগে মিষ্টত্বের প্রধান উৎস ছিল সুপক্ক ফল আর মধু। আমরা জানি, মানব জাতি অতি প্রাচীন কাল থেকে মধু খেয়ে আসছে। অন্যদিকে মিষ্টি ফল মানে সুপক্ক ফল। তা সুপাচ্য, তাতে খাদ্যগুণও বেশি। ফলে মিষ্টি খাদ্য মানে সুখাদ্য, তাই মিষ্টির প্রতি মানুষের টানও সহজাত। মনে রাখতে হবে নবজাত মানব শিশু যে মাতৃদুগ্ধ খায় তার স্বাদও মিষ্টি।
প্রদীপ জ্বালার আগে থাকে সলতে পাকানোর কাজ। চিনির আগে আসে আখ চাষ। একটা মত অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে আখ চাষ প্রথম শুরু হয় নিউ গিনিতে। সে দশ হাজার বছরের বেশি আগের কথা। আট হাজার বছর আগে আখ সেখান থেকে ফিলিপিন্স, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় আসে। অনেকে মতে শুধু নিউ গিনি নয়, ইন্দোনেশিয়াতেও জংলি গাছ থেকে আখ চাষ শুরু হয়েছেল। সে যাই হোক, চিনি প্রথম তৈরি হয়েছে ভারতেই। (১, ৫২)
আজ বেশির ভাগ খাদের মিষ্ট স্বাদের মূলে থাকে চিনি। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর আগে চিনি বস্তুটার অস্তিত্বই বেশির ভাগ মানুষ জানত না। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন কাল থেকেই আখের ব্যবহার জানা ছিল।* পতঞ্জলির মহাভাষ্যে (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০-৩৫০) খাদ্যে চিনি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তার আগে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের একটি চীনা বইয়ে আখের উদ্ভব যে ভারতে, এ কথা লেখা আছে। এরপর, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে, গুপ্ত যুগে এদেশের মানুষ আখের রস থেকে কেলাসিত চিনি/মিছরি (খণ্ড) তৈরি করতে শেখে। মজার ব্যাপার, এই খণ্ড শব্দটি থেকেই ইংরাজি শব্দ ক্যান্ডি এসেছে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসিরা এই শিক্ষা নিয়ে যায় চীনে। সপ্তম শতকে হর্ষের সময় ভারত থেকে আখ চাষ চীনে যায়। চিনি শব্দটা চীন দেশ থেকে আগত হলেও (এদেশে সংস্কৃত নাম ছিল শর্করা), চীনকে আখ চাষ ও চিনি তৈরি শিখিয়েছে ভারত। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বুদ্ধঘোষ-এর গ্রন্থে আখের রস থেকে গুড় ও চিনি তৈরির প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু চীন কেন, ভারতীয় বণিক ও মাঝি মাল্লারা নিজেদের খাবার জন্য এটি দেশ বিদেশে নিয়ে গেছে। তাদের থেকে অন্য দেশের মানুষও এই মিষ্ট দ্রব্যের কথা জানতে পেরেছে। ভারত, চীন ও মধ্য এশিয়ার মানুষ চিনি দিয়ে নানান মিষ্টান্ন তৈরি করতে থাকে। এটা তাদের খাদ্যাভ্যাসের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
পরে, মূলত ইসলাম ও তাদের সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে চিনিও ছড়িয়ে পড়ে মধ্য প্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে।
চিনি উৎপাদন
আখ থেকে চিনি উৎপাদন আসলে চিনিকে জল থেকে আলাদা করার একটা প্রক্রিয়া, কারণ আখের রস আসলে জলে চিনির দ্রবণ। প্রথমে আখ কেটে মড়াই করে আখের রস বের করা হয়। চিনির রসকে জ্বাল দিলে আমরা পাই ঘন চিনির রস। ঘন চিনির রসকে আরও ঘন (supersaturate) করে ঠাণ্ডা করলে থাকলে চিনির কেলাস তৈরি হয়। বাকি ঘন রস গুড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় দুটি জিনিস পাওয়া গেল – ঘন সোনালি দ্রবণ বা গুড়, আর সাদা কেলাসিত প্রায় ৯৯ শতাংশ চিনি।
ইউরোপে চিনি
ইউরোপের পণ্ডিতরা চিনির কথা জানলেও সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু চিনি প্রায় অজানা ছিল। ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক ইউরোপীয় পণ্ডিত, নিয়ারকাস, চিনির কথা লিখে গেছেন। তিনি আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সঙ্গী ছিলেন। তিনি লিখেছেন এক অদ্ভূত মিষ্টির কথাঃ
“ভারতের একটা বেত জাতীয় (রীড) গাছে মৌমাছি ছাড়াই মধু জন্মায়… সে গাছে কোনও ফল হয় না।”
প্লিনি (দ্য এল্ডার) খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে চিনি নিয়ে লিখেছেনঃ
“চিনি আরবেও তৈরি হয় বটে, তবে ভারতের চিনি বেশি ভালো। এটা হলো এক ধরনের বেতের মধ্য থেকে এক রকম মধু, দেখতে সাদা আর চিবোলে মুড় মুড় করে ভেঙে যায়। হেজেলনাটের আকারের একরকম মণ্ড। এটি শুধুমাত্র চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়।”
গ্রিক পণ্ডিত ডায়স্কোরাইডস লিখেছেন,
“ভারত ও আরবে বেতের মতো এক ধরনের গাছে (রীড) এক ধরনের শক্ত মধু পাওয়া যায়, অনেকটা নুনের মত, আর নুনের মতোই দাঁত দিয়ে কামড়ালে ভেঙে যায়। জলে গুলে খেলে এটা পেটের জন্য ভালো, ব্লাডারে ব্যথা হলে কাজ দেয়।”
ক্রুসেডাররা এশিয়ায় এসে চিনির দেখা পায়। তারা এর নাম দিয়েছিল “মিষ্ট লবণ”। একাদশ শতকে প্রথম চিনি ইংল্যান্ডে আসে।(১)(পৃ ৩০) দ্বাদশ শতকে ভেনিসের কিছু বণিক মধ্য এশিয়ায় প্রস্তুত চিনি ইউরোপে রপ্তানি করতে শুরু করে। পঞ্চদশ শতকেও ইউরোপে ভেনিসই ছিল চিনি শোধন ও বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। ইউরোপের অনেক বন্দরেই চিনি শোধনের ব্যবস্থা দেখা দিতে লাগল। ইউরোপে তখনও চিনি অভিজাত ও ধনীদের একটি বিলাস দ্রব্য, তবে তার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
শুধু শোধন আর বাণিজ্যই নয়, ইউরোপের আশপাশে চিনি উৎপাদনও শুরু হয়, তবে তার পরিমাণ বলার মতো কিছু নয়। আরবদের হাত ধরে ভূমধ্যসাগরের কিছু দ্বীপে আখচাষ ও চিনি উৎপাদন শুরু হয়। মুসলিম শাসন কালে স্পেন (দশম থেকে পঞ্চদশ শতকের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ স্পেনের কিছু অংশ মুসলিম শাসনাধীন ছিল) ও সিসিলিতে আখের চাষ ও চিনি উৎপাদন শুরু হয়। পর্তুগিজ শাসক হেনরি দ্য নেভিগেটর তা নিয়ে আসেন ভূমধ্যসাগরের ক্রীট দ্বীপে। সেটা পঞ্চদশ শতকের কথা। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আখ চাষে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হত। তবে, আখ ফলনকারীরা সবাই ক্রীতদাস ছিল না।
এখানে যোগ করা দরকার, ইতালীয় ও স্পেনীয় বণিকদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আখ চাষ ও চিনি উৎপাদন, শোধন ও বাণিজ্যের কেন্দ্রে।
পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের কিছু শক্তি, বিশেষ করে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশরা নৌবাণিজ্যে অগ্রসর হয় এবং ভূমধ্যসাগর ছেড়ে তারা অতলান্তিকের দিকে নজর দেয়। তারা আফ্রিকার পশ্চিম উপকেলের দ্বীপ সাও তোমে, মাদেরা ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ দখল করে। নিরক্ষীয় এই দ্বীপগুলিতে তারা আখ চাষ শুরু করে। এবার ইউরোপ ভালো করে চিনির স্বাদ পায়। বলা হয়, বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে নাকি মানুষ খাওয়া থেকে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না। ইউরোপেরও হল তাই। চিনির স্বাদ পেয়ে ইউরোপীয়রা চিনির এত ভক্ত হয়ে উঠল যে চিনি তাদের চাই-ই চাই।
১৪৯২ সালে, কলমাস যে বছর আমেরিকা পৌছলেন, সে বছরে শুধু মাদেরাতেই তৈরি ১৪০০ টন চিনি তৈরি হয়। চিনি শুধু খেতেই মিষ্টি নয়, তার নাকি আরও অনেক গুণ। “পেটের পক্ষে ভালো, ঠাণ্ডা লাগা সারায়, ফুসফুসের সমস্যা নিবারণ করে”!
ইউরোপের উপনিবেশ ও চিনি উৎপাদন
পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধেই ইউরোপীয়রা, মূলত পর্তুগিজরা, ভূমধ্যসাগর ছেড়া অতলান্তিকের দিকে তাকাতে শুরু করল। অবশ্য তখনও খোলা সমুদ্রে অভিযান করার ক্ষমতা হয়নি তাদের। কিন্তু দক্ষিণে মাত্র ১৪.৩ কিলোমিটার বহরের জিব্রাল্টার প্রণালী (স্পেন ও মরক্কোর মাঝখানে) অতিক্রম করলেই আফ্রিকা শুরু। আফ্রিকার উপকূল ধরে দক্ষিণে যেতে ও যাত্রাপথে দু-চেরটে দ্বীপ অধিকার করতে অসুবিধা কী? না, বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আফ্রিকার ঐ উপকূলে কোনও বড়ো সাম্রাজ্য নেই, যারা বাধা দেবে। অচিরেই ইউরোপীয় স্পেনীয় ও পর্তুগিজরা আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলের মাদেরা দ্বীপপুঞ্জ (মরক্কো থেকে ৫২০ কিলোমিটার পশ্চিমে; পর্তুগাল থেকে ১ হাজার কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপপুঞ্জ এখন পর্তুগালের অধীন স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল) ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ (আফ্রিকা, মরক্কো উপকূল থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে; স্পেন থেকে ২ হাজার কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপপুঞ্জ এখন স্পেনের অধীনে, স্বায়ত্তশাসিত) দখল করল।
উপনিবেশ প্রসঙ্গে একটা কথা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। ভারত ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল, আর ক্যানারি মাদেরা পর্তুগিজদের উপনিবেশ ছিল- এ দুটো উপনিবেশ কিন্তু এক নয়। ভারত ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল- এর অর্থ ব্রিটিশরা ভারতের শাসন করেছে, ভারতীয়দের শোষণ করেছে, কিন্তু এখানকার জমির মালিক থেকেছে ভারতীয়রাই, তাদের জমি-বাড়ি থেকে হটিয়ে সেটা দখল করে নেওয়া হয়নি (রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সমরাস্ত্রে বলীয়ান ভারতবর্ষে অবশ্য সেটা সম্ভবও ছিল না)। কিন্তু মাদেরাতে পর্তুগিজরা বা ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে স্পেনীয়রা দ্বীপের সমগ্র ভূমির দখল নেয়। একে বলে সেটলার কলোনি।
মাদেরা অবশ্য তখন জনশূন্য ছিল। ফলে দখল নিতে কোনও অসুবিধা ছিল না। ক্যানারি দ্বীপে কিন্তু মানুষের বসবাস ছিল। ‘গুয়াঞ্চে’ বলে পরিচিত সেই সেই মানুষদের নিকেশ করে (পাশাপাশি কিছু নারীদের যৌনদাসী বানিয়ে) তাদের জমি দখল করা হয়। গুয়াঞ্চেদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে অবশ্য বেশ কয়েক দশক সময় লেগে গিয়েছিল। পরে আমেরিকা দখলের সময় এই অভিজ্ঞতা, বলা বাহুল্য, স্পেনীয়দের খুব কাজে লেগেছিল।
তার আগে ফিরে যেতে হবে পর্তুগিজদের দখল করা মাদেরা দ্বীপে। ১৪২৫ সালে পর্তুগালের শাসক হেনরি ‘দ্য নেভিগেটর’-এর উৎসাহে সিসিলি থেকে আখের চারা নিয়ে গিয়ে মাদেরা দ্বীপে রোপণ করা হয়। (পৃ ৪১) স্পেনীয়রাও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের দখল করা জমিতে আখ চাষ শুরু করল। এর পর ইউরোপীয়রা অতলান্তিকের আরও দ্বীপ দখল করে সেখানে আখ চাষ শুরু করে। এগুলির নাম আজোরেস, কেপ ভার্দে, সাও তোমেও প্রিন্সিপে*।
মাদেরাতে আখ চাষ দারুন লাভজনক হয়ে উঠল। পঞ্চদশ শতকের শেষে মাদেরা হয়ে উঠল পশ্চিমের প্রধান চিনি উৎপাদক। চিনি উৎপাদন দ্রুত পাড়তে থেকে সেখানে। ১৪৭০ সালে ২৩০ মেট্রিক টন, ষোড়শ শতকের গোড়ায় (১৫০০-১৫১০) ২৬৪৫ মেট্রিক টন। পর্তুগিজরা দখলদার হলেও চিনি উৎপাদন ও বাণিজ্যের পেছনে ছিল ইতালীয় (জেনোয়া) ও ইহুদি আর্থিক শক্তি। আফ্রিকা থেকে আনা ক্রীতদাসদের শ্রম দিয়ে উৎপাদিত আখ থেকে চিনি তৈরি করার জন্য তৈরি হয়েছিল অনেকে আখ মাড়াই কল, চিনি কল। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে স্পেনীয়দের হাতে একই ভাবে চিনি উৎপাদন চলেছে। এই দ্বীপগুলো তো আফ্রিকার পাশেই। তাই ঢালাও ক্রীতদাস আমদানি করে আখ চাষ ও চিনি তৈরি ও রপ্তানি চলতে লাগল।
*আজোরেস দ্বীপপুঞ্জ (পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে পর্তুগিজরা দখল করে, পর্তুগাল থেকে ১৪০০ কিলোমিটার পশ্চিমে; এখন পর্তুগালের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল), কেপ ভার্দে (পঞ্চদশ শতকে পর্তুগিজরা দখল করে; আফ্রিকার সেনেগালের পশ্চিমে একটি দ্বীপপুঞ্জ, পর্তুগাল থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপপুঞ্জ এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র) সাও তোমে ও প্রিন্সিপে (আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে, নিরক্ষরেখার কাছাকাছি; সাও তোমে ও প্রিন্সিপে এখন আফ্রিকার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র; তখন জনশূন্য এই দ্বীপদুটি পর্তুগিজরা পঞ্চদশ শতকে দখল করে)
আমেরিকা অভিযান
১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকায় পৌঁছান, আর তার পর থেকে আমেরিকার ইতিহাস বদলে যায়। পাশাপাশি বদলে যায় চিনি উৎপাদনের ভূপোল, উৎপাদনে জোয়ার নয়, সুনামি আসে।
আমেরিকায় দ্বিতীয়বারের যাত্রার সময়েই কলম্বাস ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে আখ নিয়ে এসেছিলেন, আর আমেরিকায় পৌঁছে তা বপন করেন। কলম্বাসের সময় আমেরিকা বলতে অবশ্য ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলি। কারণ কলম্বাস আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে পা রাখেননি। যাই হোক, কলম্বাসের আনা সেই আখের কাটিং সফলভাবে বপন করা হয়, এবং ১৫০১ সালেই হিস্পানিওয়ালা্ দ্বীপে (এখন যেখানে হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক) আখের ফলন শুরু হয়।
সেই শুরু। তার পর থেকে ইউরোপীয়দের হাতে ক্যারিবিয়ানের সব দ্বীপগুলি হয়ে ওঠে চিনি-দ্বীপ। সাহেবদের কাছে আখ চাষ ও চিনি উৎপাদন, চিনি বাণিজ্য থেকে পাওয়া প্রচুর অর্থ — চিনির মতই মিষ্টি ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু যে মানুষদের প্রাণ জল করা শ্রম আখ চাষে ব্যবহার করা হত, তাদের কাছে ব্যাপারটা মোটেই মিষ্টি ছিল না।
একটু খুলে বলা যাক। কলম্বাস ও তার পরে যে ইউরোপীয়রা আমেরিকায় আসেন, তারা ছলে বলে কৌশলে আমেরিকার মাটির দখল নিতে থাকেন। সেখানে বসবাসকারী মানুষদের জমি দখল করে, তাদের বাস্তুচ্যুত করে দখল করা জমিতে তাদের খাটিয়ে কৃষিকাজ করতে চেয়েছিল ইউরোপীয়রা। কিন্তু সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। আমেরিকার ভূমিপুত্ররা বশ্যতা শিকার করেনি। বারবার প্রতিরোধ, যুদ্ধবিগ্রহ, ইউরোপীয়দের আনা রোগের মহামারিতে আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের মৃত্যু — এসবের ফলে জমিতে চাষ করার লোকের অভাব ঘটে। জমিতে নিজেরা চাষ করলে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয় বটে, কিন্তু বড়োলোক হওয়া যায় না। তাই কলম্বাস আমেরিকায় প্রথম পা রাখার পর বেশি দিন কাটেনি, এক দশকের মধ্যেই ক্যারিবিয়ানে আফ্রিকা থেকে থেকে আনা ক্রীতদাস নিয়ে আসা হয়। তাদের ক্রীতদাস হিসেবে জমিতে খাটিয়ে পণ্য উৎপাদনের কাজ করা হতে থাকল। এই সব পণ্যের একেবারে প্রথমে আছে আখচাষ ও তা থেকে উৎপাদিত চিনি। ইউরোপে, আমেরিকার ইউরোপীয় মহলে চিনির চাহিদা বাড়তেই থাকে, আখচাষের জমিও বাড়ানো হতে থাকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিউবা, হিস্পানিওলা সহ ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলি, ব্রাজিল ও আমেরিকায় মূল ভূখণ্ডে ইংরেজদের কলোনিগুলোতে শুরু হল আখ চাষ। দখল করা বিরাট বিরাট ভূখণ্ডে আখ চাষ। যাকে বলে বাগিচা চাষ (plantation)।
বাগিচা চাষ ও দাসপ্রথা
আখ চাষ বাড়তে লাগল। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস আমদানি। এর আগে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস রপ্তানি হয়েছিল আশপাশের জায়গায়। এবার শুরু হল অতলান্তিক পেরিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে ক্রীতদাস রপ্তানি। কিন্তু আগেই বলেছি, ইউরোপ তখন চিনির স্বাদ পেয়েছে। সেখানে চিনির চাহিদা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে, আমেরিকা দখল ও সেখানকার সোনা রূপো লুঠ ও এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সমুদ্র বাণিজ্য শুরু হয়েছে – অর্থাৎ, ইউরোপের সুদিন শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপের বাজার বাড়ছে। বাজার বাড়ছে আমেরিকায়ও – সেখানেকার প্রবাসী ধনী ইউরোপীয়দের বাজার। চিনির চাহিদা বাড়ছে এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আর এদিকে আমেরিকার অফুরান জমি দখল শুরু করেছে ইউরোপীয়রা।
আফ্রিকায় যত মানুষ দাস-জাহাজে উঠত তার একটা বড়ো অংশ (এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত) যাত্রাকালীন মারা যেত। থাকা-খাওয়ার অসম্ভব খারাপ ব্যবস্থা, স্বাধীনতাহীন, গৃহহারা আত্মীয়-পরিজনহীন এই মানুষদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকতেন তারা গিয়ে পরতেন এমন এক বিদেশে যেখানকার সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না, তাঁর ভাষা কেউ বোঝে না। এই বিদেশের মাটিতে তাদের আবার বিক্রি করা হত। তাদের নতুন ‘মালিক’ তাদের কিনে নিয়ে যেত বাগিচায় – অনেকেই গিয়ে পড়তেন আখ-বাগিচায়।
আখ বাগিচায় ‘ক্রীতদাস’দের হাড় ভাঙা খাটনি চলত ভোর থেকে সন্ধ্যা, কখনো কখনো রাত পর্যন্ত। পান থেকে চুন খসলে, অনেক সময় না খসলেও, নেমে আসত চাবুকের আঘাত। অজানা অচেনা খাদ্য যেটুকু পাওয়া যায় তাতে ভালো করে পেট ভরে না, পুষ্টি তো দূরের কথা। তার ওপর আছে অজানা দেশের জানা-অজানা অসুখ। পালানোর জায়গা নেই। তাও পালাতে গিয়ে ধরা পরে অত্যাচারে প্রাণ গেছে অনেকের। তবে বেশি প্রাণ গেছে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে, বিশ্রামের অভাবে, অসুখে চিকিৎসা ও পথ্যের সম্পূর্ণ অভাবে।
আগেই বলেছি, আফ্রিকা থেকে যত মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজে তোলা হতো তার একটা বড়ো অংশ মারা যেতেন জাহাজেই। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যে ১.২৫ কোটি মানুষকে আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে আমেরিকায় চালান দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আমেরিকায় পৌছেছেন ১.০৭ কোটি – জাহাজে মৃত্যু ঘটেছে ১৮ লক্ষ মানুষের। এই মানুষরা ছিলেন মূলত আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের জোয়ান নরনারী। তাছাড়া আরও মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন আফ্রিকায় জাহাজ পর্যন্ত যাত্রাপথে, এবং মানুষ ধরার প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়ার বড়ো অংশ ছিল যুদ্ধ। এসবের ফলে আফ্রিকার এই অঞ্চলে কাজ করার মতো জোয়ান নারীপুরুষের ঘাটতি দেখা দেয়। অঞ্চলটি দিন দিন দরিদ্র হয়ে পড়ে।
ক্রীতদাস হয়ে আমেরিকায় পৌঁছতেন যারা তাদের প্রায় অর্ধেক, ৫০ লাখের মতো মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলিতে। ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলি তখন স্পেন, ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের উপনিবেশ। সেখানে দাস শ্রম দিয়ে আখের বাগিচা চাষ ও চিনি উৎপাদনে দারুণ মুনাফা। আফ্রিকার আরও ৫০ লক্ষ মানুষ পৌছান ব্রাজিলে। (তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে পৌঁছেছেন অনেক কম ক্রীতদাস – মাত্র ৪ লক্ষের মতো। সেখানে, বিশেষ করে ভার্জিনিয়া ও উত্তর ক্যারোলিনায়, ক্রীতদাসদের সন্তান উৎপাদন করে তাদের ক্রীতদাস হিসেবে নতুন নতুন অঞ্চলে চালান করা হয়।)
আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস হিসেবে যারা আমেরিকার আখ ও অন্য বাগিচায় পৌঁছতেন, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। এমনিতে, ক্রীতদাস-নারীর সন্তানরাও ক্রীতদাস হত, তাতে দিনে দিনে ক্রীতদাসদের সংখ্যা বাড়ার কথা। কিন্তু আখ বাগিচাগুলিতে ক্রীতদাসদের মৃত্যু হার এত বেশি ছিল যে ক্রীতদাসদের সংখ্যা বাড়ার বদলে দিন দিন কমতে থাকে। বিশেষ করে ব্রাজিল ও ক্যারিবিয়ানে। চাষের জন্য বছর বছর আফ্রিকা থেকে নতুন ক্রীতদাস আনা হতে থাকে।
১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকায় পৌছনোর এক দশক পর থেকেই আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস আনা শুরু হয়। আর সেই প্রথা টিকে ছিল ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত। ১৮৮৮ সালে ব্রাজিলে দাসপ্রথার অবসান ঘটে। তার প্রায় এক শতাব্দী আগে হাইতির ক্রীতদাসরা বিদ্রোহের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীন করেছে (১৭৮১)। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ (১৮৩৪) ও ফরাসিরা (১৮৪৮) তাদের উপনিবেশগুলিতে দাসপ্রথার অবসান ঘটায় (১৮৩৪)। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দাসপ্রথার অবসান ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (১৮৬৫)।
আফ্রিকা থেকে মানুষ কিনে বাগিচা চাষ আমেরিকায় শুরু হয়েছিল কলম্বাসের সময়েই, ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলিতে। এর উদ্যোগ ছিল, বলা বাহুল্য, স্পেনীয়দের। তবে ইউরোপের অন্য শক্তিগুলোও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেনি। যারা যখন আমেরিকার মাটিতে পা রাখতে পেরেছে, একই কাজ করেছে। ১৫০০ সালে পর্তুগিজরা ব্রাজিলের মাটিতে প্রথম পা রাখে ও পর্তুগিজ সম্রাটের নামে সেখানকার দখল নেয়। ষোড়শ শতক থেকেই পর্তুগিজরা ব্রাজিলে আখ চাষ ও চিনি উৎপাদন শুরু করে। আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে কাজে লাগিয়ে।
ক্যারিবিয়ানে স্পেনীয় ছাড়াও ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচরাও একইভাবে দ্বীপ দখল ও দাস দিয়ে আখ চাষ শুরু করে।
১৬০৭ সালে প্রথম সরকারিভাবে প্লাইমাউথে ব্রিটিশ কলোনি প্রতিষ্ঠা হয় – যে কলোনিগুলি প্রায় দুশো বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবে। ১৭৫১ সালে নিউ অরলিয়ান্সে প্রথম আখ চাষ শুরু হয়। আর ব্রিটিশরা লুইসিয়ানায় চিনির শোধনাগার প্রতিষ্ঠা করে ১৭৯১ সালে।
মোট কথা, আমেরিকায় বিশাল আকারে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। এক এক সময়ে এক এক জায়গা এই উৎপাদনে এগিয়ে থেকেছে। তার সবটাই দাস-শ্রম দিয়ে।
সাদা চিনি, কালো ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ
- Sweetness and Power: The Place of Sugar in Modern History; Sidney W. Mintz, 1985
- Sugar: The World Corrupted: From Slavery to Obesity; James Walvin, 2017
- Sugar: A Global History; Andrew F. Smith, 2015
- American Sugar Kingdom: The Plantation Economy of the Spanish Caribbean 1898-1934; Cesor J. Ayala, 1999
দারুণ লেখা। চিনির স্বাদ যে তেতো বা নোনতাও হতে পারে তা এই লেখাটি পড়লে বোঝা যায়। মুশকিল হলো আখের ক্ষেতে এখনো দরিদ্র অসহায় মানুষের ঘাম ও রক্ত ঝরে। অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর “এক কাঁইতি কম” গ্রন্থে এর এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। যাইহোক সেজন্য অবশ্যই আমরা চিনি খাওয়া বন্ধ করে দেবো না।
ভারতে আখ ও চিনি উৎপাদন প্রসঙ্গে মনে পড়লো, কোথাও পড়েছিলাম যে মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমিতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচুর আখ চাষ হতো তাই এই অঞ্চলের শাসক সূর্যবংশের যে শাখা তাকে বলা হতো ইক্ষ্বাকু বংশ।