লোহা থেকে ইস্পাত – বিপ্লবী সুবোধ রায়ের রাজনৈতিক জীবনের বিবর্তন
২০২১ সালে মহা ধুমধাম সহযোগে পালিত হল আমাদের দেশ ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি, তাকে আমরা লাভ করেছি লক্ষ লক্ষ মানুষের শোণিতের বিনিময়ে। বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের আত্মত্যাগের এই অর্জন। আমাদের দুর্ভাগ্য এই অসংখ্য মানুষের অধিকাংশই দেশবাসী কর্তৃক বিস্মৃত। তাঁদের জীবন, তাঁদের সংগ্রাম আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। এমনই এক মানুষ, চট্টগ্রামের সুবোধ রায়, প্রখ্যাত বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সুযোগ্য শিষ্য। তাঁর স্বাধীনতা পূর্ব জীবন ও সংগ্রামে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের অবতারণা। বিপ্লবী সুবোধ রায়ের স্বাধীনতা পরবর্তী জীবনের আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে সম্ভবপর না। এই কারণে এই বিশ্লেষণ তাঁর স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সুবোধ রায় জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া জেলায় এক বিত্তশালী পরিবারে। তাঁর ছোটবেলা কাটে এক অত্যন্ত বৈভবশালী পরিবেশের মধ্যে। তাঁর পিতা চট্টগ্রামের জেলা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। তাঁদের আদি বাড়ি গ্রামের দিকে হলেও, তাঁরা চট্টগ্রাম মূল শহরের মধ্যে এক বাড়িতেই থাকতেন। প্রাথমিক ভাবে সুবোধের রাজনীতির দিকে কোন ঝোঁক ছিল না। তিনি নিজে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এমনকি ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, যা চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের অনেকেরই রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা করে, তাও তাঁর মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি। তিনি অনন্ত সিংহের মতো বেপরোয়া ও দুঃসাহসীও ছিলেন না, গণেশ ঘোষের মতো আপাত বাধ্য ছেলের মখমলের আড়ালে তাঁর কোন বিপ্লবী ইস্পাতও ছিল না। তিনি সত্যিই ছিলেন একজন আদর্শ, সাতে পাঁচে না থাকা ভালো ছেলে। পড়াশোনা তিনি আনন্দ করেই করতেন, এই নিয়ে তাঁর পরিবারকে কোনদিন মাথা ঘামাতে হয় নি। তাঁর পিতা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ভালো ফল করলে বিদেশে যাওয়ার পথ তাঁর জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। সুবোধও তাঁর জীবন এই বাঁধা ছকের বাইরে অন্য কোন খাতে প্রবাহিত হতে পারে, এমন ভাবেননি।
এই অবস্থার পরিবর্তন হল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। সুবোধ রায় তখন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত। পড়া বোঝার জন্য জনৈক বন্ধুর বাড়িতে তিনি মাঝে মাঝেই যেতেন। এই বন্ধুর অগ্রজ ছিলেন বিপ্লবী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি সুবোধকে বারবার বোঝান দেশের জন্য তাঁর মত মেধাবী ছাত্রের কাজ করা কত জরুরি। সুবোধের কাজ করতে আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল কাজের পন্থায়। ভালো পড়াশোনা করবেন, চাকরি করবেন ও শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের জন্য অবদান রাখবেন – এই ছিল তাঁর উচ্চাশা। কোনও বোমা বন্দুকের রাজনীতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল না। তাঁর বন্ধুর সেই অগ্রজ যতই তাঁকে বোঝান, যে দেশ স্বাধীন না হলে তাঁর এই উচ্চাশার কোন মূল্য নেই, ততই তিনি বেঁকে বসেন। অবশেষে খুব ধীরে হলেও বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি সুবোধ রায়ের আকর্ষণ বাড়তে লাগল। তাঁর রাজনৈতিক চেতনারও ক্রমে উন্মেষ হল। এর পেছনে একপ্রকার যে কিশোর সুলভ রোম্যান্টিকতা কাজ করেছিল, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তা হলেও, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ তাঁর সামনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী কর্মকান্ডের গুপ্ত দুনিয়ায় প্রবেশের রাস্তা ক্রমে উন্মুক্ত করে দিল।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববর্তী বহু ব্যর্থতার পর, চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ভিন্ন ভাবে সংগঠিত হওয়ার একটি প্রচেষ্টা করছিলেন। একদিকে ছিল কংগ্রেসের মধ্যে তাঁদের কার্যকলাপ, যেখানে কংগ্রেসের বিভিন্ন পদ অধিকার করে বিপ্লবীরা কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ব্রিটিশ শাসকদের চোখে যে মান্যতা আছে তাকে ব্যবহার করতে চাইছিলেন। আর অপরদিকে ছিল এই প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডকে ঢাল করে তার ছায়ায় গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের কার্যকলাপ। এই সময় মাস্টারদা সূর্য সেন স্বয়ং ছিলেন কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সম্পাদক। তাঁর এই পদকে ব্যবহার করে তিনি কংগ্রেসের আড়ালে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন শক্তিশালী করছিলেন, কংগ্রেসের মধ্যে বিপ্লবীমনস্ক তরুণদের সামিল করছিলেন তাঁর কর্মকাণ্ডে। এই সূত্রেই ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সুবোধ রায় যখন কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির এক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করলেন, তিনি নজরে পড়ে গেলেন অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী ও সর্বোপরি সূর্য সেনের।
সুবোধ রায়ের বয়স স্বল্প হলেও তাঁর গুণাবলি বিপ্লবী নেতাদের নজর এড়ায় নি। কিন্তু কংগ্রেস থেকে হোক বা বিভিন্ন ব্যায়ামের আখড়া থেকে হোক, নতুন সদস্যদের না পরখ করে তাঁদের দলে নেওয়া হত না। তাঁদের প্রথমে ছোট ছোট কাজ দিয়ে দায়বদ্ধতা পরখ করা হত। তারপর একটু কঠিন কাজ, অস্ত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, অস্ত্র লুকিয়ে রাখার উপযুক্ত গুপ্তস্থান খুঁজে তা লুকিয়ে রাখা। এরপর গভীর রাতে নির্দিষ্ট সময়ে শ্মশানে বা ওই প্রকার কোন ভীতিপ্রদ স্থানে আসতে বলা হত। এর মাধ্যমে সম্ভাব্য সদস্যের সাহস ও তার সময়ানুবর্তিতা দুইই পরীক্ষা করা হত। এই কঠিন পরীক্ষাগুলি সুবোধ সসম্মানেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
বিপ্লবী দলের অঙ্গ হলেও সুবোধ রায়ের চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিপ্লবী নেতৃত্ব দ্বিধান্বিত ছিলেন। এর কারণ ছিল মূলত তাঁর বয়স। তিনি বিপ্লবীদলের কনিষ্ঠতম সদস্যদের একজন ছিলেন। কিন্তু সুবোধ নেতৃত্বকে বোঝানোর প্রচেষ্টা করেন যেহেতু তাঁর বাড়িতে লাইসেন্সড বন্দুক আছে ও তিনি গোপনে সেই বন্দুক আনতে সক্ষম, তাই তাঁর এই বিদ্রোহে থাকা উচিৎ। এমনিতেই বিদ্রোহীদের আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব ছিল। এক ডজন রাইফেল আর পিস্তলের অধিক কিছু ছিল না। তাই সুবোধের বয়স নিয়ে আপত্তি থাকলেও আরেকটা আগ্নেয়াস্ত্রর জন্যই তাঁরা শেষ অবধি রাজি হলেন। অবশেষে এগিয়ে এল সেই ঐতিহাসিক দিন – ১৮ই-এপ্রিল, ১৯৩০। সুবোধ লিখেছেন – ‘Thus, a new life dawned for me, where sacrifice and suffering travelled side by side, and where heroes and cowards can be differentiated. Emotions and determination won over vacillation. I jumped into fray without once caring for consequences.’, ১৮ই এপ্রিলের প্রভাত সুবোধ রায়ের জন্য নিয়ে এল জীবনের এক নতুন পর্যায়।
অনন্ত সিংহ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের বিদেশী নেতাদের মধ্যে মূল প্রেরণা ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন, গ্যারিবল্ডি, ইমন ডি ভ্যালেরা, জেমস লার্কিন প্রমুখ। একই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত ছিলেন বলে বিশেষ করে আইরিশ বিপ্লবীদের দ্বারা চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল, গুড ফ্রাইডের দিনটি চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এই অনুপ্রেরণাই। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের এই গুড ফ্রাইডের দিনেই আইরিশ বিপ্লবীরা ডাবলিনে বিখ্যাত ‘ইস্টার অভ্যুত্থান’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে প্রচেষ্টা করেন। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলেও তা আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও সুতীব্র করেছিল। চট্টগ্রামে ওই একই দিনে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লবীরাও তাঁদের দেশের স্বাধীনতার লড়াইকে সুতীব্র করার ক্যাটালিস্ট হতে চাইছিলেন। তাঁরা আশা করছিলেন, ইস্টার অভ্যুত্থান-এর মতোই তাঁদের এই অভ্যুত্থান স্ফুলিঙ্গের কাজ করবে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আইরিশ বিপ্লবীদের কতটা সচেতনভাবে অনুসরণ করছিলেন, তার আরেকটি উদাহরণ হল সংগঠনের নামকরণ। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি-এর (আই.আর.এ.) অনুকরণে বিপ্লবীরা তাঁদের সংগঠনের নাম রাখেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (আই.আর.এ.)। এই সচেতন অনুকরণ সুবোধ রায়েরও দৃষ্টি এড়ায়নি, তাঁর বয়স স্বল্প হলেও। তিনি লিখেছেন – ‘We thought, “Our people can also be aroused if we follow the Irish revolutionaries’’ path and lay down our lives in the unequal battle with the enemy forces.’ এবং এর পাশাপাশি উৎসবের দিনে শত্রুর অসতর্কতার যে একটা সুযোগ নেওয়া যাবে সেই সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নেওয়া খুব সহজ ছিল না। স্বদেশী ডাকাতি করে অর্থ জোগাড় করলে পুলিশি নজর তাঁদের উপর পড়তে পারে, এই ভেবে বিপ্লবীরা সেই পন্থা গ্রহণ করেননি। এর পরিবর্তে তাঁরা বাড়ি থেকেই অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এতে মোট আঠারো হাজার টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। দলের মধ্যে পুলিশের গুপ্তচরদের চিহ্নিত করে তাদের সামনে ভুল তথ্য আলোচনা করা হয়। ফলে তারাও পুলিশকে ভুল খবর সরবরাহ করে। পুলিশের ধারণা হয় ২১শে এপ্রিল চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেস কমিটি চট্টগ্রামে একটা জনসভা করবে ও সেখান থেকে নিষিদ্ধ পুস্তক পাঠ করে সিডিশন আইন ভঙ্গ করবে। তারা ধরেই নেয় সূর্য সেনের দলের কাজকর্মের গোপনীয়তা রক্ষার যে প্রচেষ্টা তার কারণ এটাই। অস্ত্র সংগ্রহ করা ছিল আরও কঠিন কাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও কিছু সংগ্রহ করা হয়। দ্রুত একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানার জন্য গাড়ির দরকার ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ড্রাইভারদের ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে দুটি ট্যাক্সি অভ্যুত্থানের কাজে ব্যবহার করা হবে। আক্রমণের সময় বা কোথায় আঘাত হানা হবে তা একমাত্র নেতৃত্বে থাকা বিপ্লবীরা জানতেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুবোধ রায় স্বয়ং এই বিষয়ে ছিলেন অন্ধকারে। তবে এই গোপনীয়তা, তাঁর মতে, ছিল প্রয়োজনীয় সতর্কতার অংশ।
অবশেষে এল সেই ১৮ই এপ্রিল। আকাঙ্ক্ষিত অভ্যুত্থানের সময়। সেইদিন দুপুরে স্কুল কামাই করে সুবোধ বাড়িতেই ছিলেন। লুকিয়ে বাবার আলমারি থেকে পিস্তল সরিয়ে গণেশ ঘোষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতি মতো। নির্দেশ অনুসারে তিনি সন্ধ্যের সময় জেলা কংগ্রেস অফিসে এসে হাজির হলেন তিনি। তাঁর অ্যাকশন গ্রুপের সাতজন সহবিপ্লবী অপেক্ষা করছিলেন সেখানেই। কংগ্রেস অফিসেই তাঁরা পরবর্তী নির্দেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সংকেত না আসায় তাঁরা বিচলিত হয়ে পড়েন। অনন্ত সিংহের স্মৃতিচারণায় আমরা পাই, ট্যাক্সি জোগাড় করার সমস্যা থেকেই এই বিলম্ব হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটার নির্দিষ্ট সময় পার করে দেওয়া বিপ্লবীদের মধ্যে যথেষ্ট স্নায়ুর চাপ সৃষ্টি করলেও তাঁরা খুব বিচলিত হননি। এক ঘন্টা দেরিতে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সংকেত এল। ধুতি, হাফ হাতা শার্ট আর রবার সোলের জুতো পরিহিত স্কুলছাত্র সুবোধ কংগ্রেস অফিস থেকে বেরিয়ে তাঁর দলের সঙ্গে পা বাড়ালেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারের দিকে, জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের উদ্দেশ্যে।
খাকি পোশাক পরিহিত গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও হরিপদ মহাজন ট্যাক্সি করে যখন প্রথম অস্ত্রাগারের দিকে অগ্রসর হন, পুলিশ তাঁদের অফিসার বলে ভুল করে। কয়েকজন সসম্ভ্রমে স্যালুটও ঠুকে দেন। বন্দুকের গর্জনে তাঁদের ভুল ভাঙতে বিলম্ব হয় নি। গার্ড ডিউটিতে থাকা পুলিশ ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিপ্লবীরা জানতেন অন্তত ৬০০ জন পুলিশ অস্ত্রাগারের খুব নিকটে অবস্থিত ব্যারাকে আছে। আকস্মিক ভাবে আক্রান্ত হয়ে তাঁদের মধ্যে যে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তার পূর্ণ সুযোগ যদি না নেওয়া যায়, তাহলে অস্ত্রাগারের দখল নেওয়া যাবে না। তাই তাঁরা বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে অস্ত্রাগারের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। ‘ভাগ জাও, আব গান্ধি রাজা হো গয়া’ আহত পুলিশের কন্ঠে এই চিৎকারে তার সঙ্গীরা আরও জোরে দৌড় লাগাল। এত সহজে অস্ত্রাগার দখলে এসে যাবে, কেউ কল্পনাই করতে পারেননি। দ্রুত বন্দুক ও কার্তুজ লুঠ করা হল। সেই স্থানেই সুবোধের মতো অল্প বয়সিদের দেখিয়ে দেওয়া হল কীভাবে বন্দুক চালাতে হয়। সূর্য সেনের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবী দল ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তার জায়গায় জাতীয় পতাকা তুলে দিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হল এবং ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সূর্য সেন চট্টগ্রামকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন।
বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের সঙ্গে বাইরের সকল টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তাই বাইরে খবর সহজে পাঠানোর কোন উপায় ছিল না। চট্টগ্রামের জেলা শাসকের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দরের একটি জাহাজের বেতার মারফত বাইরে খবর পাঠানো হয়, এর পাশাপাশি একটি মেশিন গানের বন্দোবস্ত করা হয় বিপ্লবীদের পরাজিত করতে। বিপ্লবীরাও বসে ছিলেন না। তাঁরা বন্দুক প্রচুর পরিমাণে পেলেও আধুনিক রাইফেল আর মেশিন গানের কার্তুজ খুঁজে পাননি। এগুলি যাতে শত্রুপক্ষের হাতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে রাইফেল জড়ো করে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনাও বাতিল করে দেওয়া হয় তখনকার মতো। ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ানরা মেশিন গান ফায়ারিং শুরু করলে বিপ্লবীরা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে প্রতি আক্রমণ করতে শুরু করেন মাস্কেট ফায়ারিং-এর মাধ্যমে। কাউন্টার ফায়ারিং-এ মেশিন গান স্তব্ধ করে দেওয়া গেলেও সূর্য সেন উপলব্ধি করেন শহরে থাকা এই মুহূর্তে আর নিরাপদ নয়। অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ সহ কয়েকজন বিপ্লবী আহত হিমাংশু সেনকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। তাঁদের রেখেই সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে শহর ছেড়ে পাহাড়ের দিকে যাত্রা করেন।
সুবোধ রায় ছিলেন এই দ্বিতীয় দলের সঙ্গেই। একে তিনি উত্তেজনায় ১৮ তারিখ কিছু খাননি, তার উপর বন্দুক ও ভারি গুলি ভরা ব্যাগ সহ দুর্গম পথে চলতে হচ্ছে। অসম্ভব কষ্ট সহ্য করেই তিনি বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পথ চলতে লাগলেন। সারা রাত গরমের মধ্যে দুর্গম পথ অতিক্রম করে শ্রান্ত ক্লান্ত বিপ্লবীরা ১৯ তারিখ ভোরবেলা একটি ছোট টিলার নিচে আশ্রয় নিলেন। অম্বিকা চক্রবর্তী স্থানীয় লোকদের সহায়তার খিচুড়ি আর পানীয় জলের ব্যবস্থা করলে বিপ্লবীরা কিছুটা ধাতস্থ হন। সূর্য সেন এই সময়েই সিদ্ধান্ত নেন, যে তাঁরা আর কোনপ্রকার সম্মুখ সমরে যাবেন না। যুদ্ধ চালানো হবে গেরিলা পদ্ধতিতে, জনগণের সহায়তায়। এই প্রসঙ্গে সুবোধ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় চট্টগ্রামের মানুষ, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে, তাঁদের কী প্রকার সহায়তা প্রদান করেছে। সরকারের শত সাম্প্রদায়িক উস্কানি সত্ত্বেও তাঁদের কেউই পশ্চাৎধাবন করা বাহিনীকে বিপ্লবীদলের অবস্থান, সংখ্যা বা অস্ত্র সম্পর্কে কোন তথ্যই প্রদান করেনি। জনতার মধ্যে এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়েই সূর্য সেন গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনই তাঁদের সমর্থন ছিল, স্থানীয় পুলিশের চররা বিপ্লবীদের প্রকৃত পরিচয় ধরে ফেললে সূর্য সেন যখন তাঁদের কাউকে কিছু না বলতে অনুরোধ করেন, তাঁরা সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। ২১ তারিখ বিপ্লবীরা রাতের আশ্রয় নিলেন একটি পাহাড়ের টিলাতে। পাহাড়ের নাম – জালালাবাদ, যেখানে কয়েক ঘন্টা পরেই ইতিহাস রচিত হতে চলেছিল। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও শ্রান্ত বিপ্লবীরা রাতের বেলায় লক্ষ্য না করলেও, ভোরের আলো ফুটতে দেখলেন, তাঁরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন, সেখান থেকে চারিদিকে অনেকদূর অবধি যেমন দেখা যাচ্ছে, তাঁদেরও অনেক দূর থেকে যে কেউ দেখতে পাবে। তাও মাস্টারদা সেখানেই আপাতত বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মাঠ থেকে নিয়ে আসা লেবু ছাড়িয়ে বিপ্লবীরা ভাগ করে খেতে লাগলেন, সুবোধও এক টুকরো পেলেন। মাস্টারদা সহ নেতারা কেউই একটুকরো লেবুও গ্রহণ করলেন না। তাঁদের লেবুর খোসা চিবিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির দৃশ্য বিপ্লবীদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। সুবোধ রায় স্বয়ং সেই দৃশ্য দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হন। নেতাদের এই আত্মত্যাগ দেখে তরুণ বিপ্লবীরা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত হন, শত দুঃখ সহ্য করে মরণপণ লড়াই লড়ার প্রতিজ্ঞা আরও দৃঢ় হয়।
২২ তারিখ সন্ধ্যে পাঁচটা নাগাদ, যখন বিপ্লবীরা জালালাবাদ থেকে নেমে আসার পরিকল্পনা করছেন, তখনই সুবোধের নজরে পড়ে দূরে একটি অপরিচিত লোক পাহাড়ে তাঁদের অবস্থানের দিকে একটা রুমাল বা সাদা কাপড় দিয়ে কি যেন নির্দেশ করছে। তিনি মাস্টারদা আর নির্মলদাকে জানাতেই তাঁরা সঠিক ভাবেই আন্দাজ করেন যে প্রস্তুতি শেষ করে ব্রিটিশ সিংহ তার অপমানের প্রতিশোধ নিতে এসেছে। ক্রমে পুরো ব্রিটিশ বাহিনী যখন বিপ্লবীদের দৃষ্টিগোচর হল, তখন দেখা গেল আধুনিক রাইফেলের পাশাপাশি তারা মেশিন গানও এনেছে। প্রথমে তরুণদের মধ্যে খুবই হইচই পড়ে গেল। অনেকেই পাহাড় থেকে নেমে পালানোর প্রস্তাব রাখলেন। মাস্টারদা দৃঢ় ভাবে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন। তিনি অভিজ্ঞ সেনানায়কের ন্যায় যুক্তি দিলেন প্রতিপক্ষ অস্ত্রবলে ও লোকবলে এগিয়ে থাকলেও, তাঁদের দুটো সুবিধা আছে। প্রথমত, তাঁরা পাহাড়ের মাথায় আছেন, সৈন্যদল আছে সমতলে, তাই উঁচু জায়গা থেকে গুলি বিনিময়ের সময় বিপ্লবীরা অসম্ভব সুবিধা পাবেন আর দ্বিতীয়ত, সূর্য তাঁদের পেছনে রয়েছে এবং সরাসরি তা ব্রিটিশ বাহিনীর চোখে এসে পড়বে, এই পরিস্থিতিতে চোখে রোদ পড়ার ফলস্বরূপ তাদের পক্ষে লক্ষ্য ঠিক রেখে গুলি চালানো কঠিন হবে। মাস্টারদার যুক্তিই গৃহীত হয়। জালালাবাদ থেকে ছোট ছোট কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সুবোধ রায় ছিলেন লোকনাথ বলের দলে। ব্রিটিশ বাহিনী অগ্রসর হতেই লোকনাথ বলের আদেশে তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল কিশোর সুবোধের বন্দুক। জালালাবাদ থেকে আগুনের হলকায় রচিত হল নতুন যুগের ইতিহাস। বালক, কিশোর ও যুবকরা সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের সামনে, এমনকি মেশিনগানের অবিরাম অগ্ন্যুদ্গিরণের মধ্যেও, মাস্টারদার নেতৃত্বে গড়ে তুললেন মহাকাব্যিক প্রতিরোধ। গুলির লড়াই প্রাথমিক ভাবে প্রবল মৃত্যুভয় সুবোধকে আঁকড়ে ধরে। তাঁর মায়ের কথা মনে পড়ে যেতে লাগল বারবার, একবার এমনও মনে হল এই পরিস্থিতিতে কাপুরুষচিত কোনও আচরণ করে ফেলার তুলনায় আত্মহত্যা করাই সঠিক কাজ হবে। কিন্তু ক্রমশ অগ্নিপরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন। প্রাথমিক ভয় কেটে যাওয়ার পর, তিনি নিজেকে বন্দুকের ভলি ফায়ারের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিলেন। ব্রিটিশ বাহিনীর গোর্খা সৈনিক ও ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল-এর সৈনিকদের ‘বাঙালি কুত্তা, গুলি চালাবি নাকি?’, এই প্রশ্নের জবাব সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি দিলেন রাইফেল দিয়েই।
দুই ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর ব্রিটিশ বাহিনী উপলব্ধি করে অস্ত্রবল ও লোকবল অধিক হওয়া সত্ত্বেও সম্মুখ সমরে বিপ্লবীদের পরাজিত করা অসম্ভব। এতক্ষণে তাদের পক্ষে একজন বিপ্লবীকেও আহত করা সম্ভব হয়নি, এদিকে সরকারি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত ও নিহত হয়েছে। তারা কৌশল পরিবর্তন করে, দ্রুত দুটো হালকা মেশিন গান পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে তুলে সেখান থেকে আবার নতুন উদ্যমে বিপ্লবীদের ওপর শুরু হয় গুলি বর্ষণ। ঠিক যে কারণে এতক্ষণ উচ্চতর অবস্থান থেকে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ বাহিনীকে সহজে প্রতিরোধ করতে পারছিলেন, সেই একই কারণে উচ্চতর স্থান থেকে গুলি বর্ষণের পাল্টা প্রতিরোধ তাঁরা করতে অক্ষম হন। এতক্ষণে মাস্টারদার ব্যূহে ফাঁক খুঁজে পেয়ে উৎফুল্ল ব্রিটিশ সিংহ টুঁটি লক্ষ্য করে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু একাধিক সহযোদ্ধার মৃত্যু ও ক্রমশ বুলেট ফুরিয়ে আসা সত্ত্বেও মাস্টারদার ছাত্ররা কেউই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। সৌভাগ্যের বিষয়, যে সময় পশ্চাৎ সম্মুখ দুই দিক দিয়েই আক্রমণ করে রণক্লান্ত বিপ্লবীদের চরম আঘাত দেওয়া সম্ভব হত, ঠিক সেই সময়েই ব্রিটিশ বাহিনী গুলি চালানো বন্ধ করে দেয়। রাত্রির অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা ছিল জালালাবাদেই যদি বিপ্লবীদের এই বাহিনীর সঙ্গে গুলি যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী ব্যস্ত থাকে তাহলে সেই সুযোগে আরেকটি বিপ্লবী বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের দখল নেওয়ার প্রচেষ্টা করতে পারে। সেই কারণে রাতের অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সেনা পুনরায় শহরের নিরাপদ আশ্রয়ে দিরে জায়ল। এদিকে মাস্টারদা এই সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারেই জালালাবাদ ত্যাগ করেন। পরের দিন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী যখন আবার জালালাবাদের দিকে অগ্রসর হয় তখন তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল শুধুই শহীদ বিপ্লবীদের মরদেহ।
জালালাবাদে ইতিহাস সৃষ্টি করার সময় বিপ্লবীরা যখন একত্রিত হলেন, তখন দেখা গেল, তাঁদের মধ্যে ২০ জন বিপ্লবী অনুপস্থিত। এঁদের মধ্যে সকলে যে নিহত হয়েছিলেন এমন না। কিন্তু প্রতিরোধের সময় অনেকেই মূল দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় মাস্টারদা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা যে কজন আছেন, তাঁরাই একত্রে কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবেন। কোথায় আশ্রয় নেওয়া যায়, সেই বিষয়ে সূর্য সেন দলের সকলের নিকট থেকেই পরামর্শ গ্রহণ করেন। যখন সুবোধের পালা আসে, তিনি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে জানান যে তাঁদের গ্রামের দিকে একটি দোতলা বাড়ি আছে, যেখানে একজন দেখাশোনা করার লোক ছাড়া কেউ থাকে না। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই বাড়িতেই বিপ্লবীরা আশ্রয় নেবেন। ২৫শে এপ্রিল পাহাড় থেকে বিপ্লবীরা নেমে আসেন ও গ্রামের দিকে অতি সন্তর্পণে যাত্রা করেন। সুবোধ প্রথমেই সেই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করেন ও তাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলেন। সে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায়। থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলে সূর্য সেন আলাদা করে সুবোধ রায়কে ডেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি যুক্তি দেন এত জন অনভিজ্ঞ বালক সৈনিক নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালনা করা, প্রয়োজন মতো গোপনে আশ্রয় নেওয়া, থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা অতি কঠিন কাজ। যদি বয়সে কম ও স্বল্প পরিচিত বিপ্লবী দলের সদস্যরা বাড়ি ফিরে যায় ও পুলিশের কাছে বয়ান দেয় তাদের অনুপস্থিতির কারণ চট্টগ্রামের নিকটে হওয়া একটি মেলা দেখতে যাওয়া, তাহলে সবদিকই রক্ষা হয়। সুবোধের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না, এমন বয়ান পুলিশ কোনোমতেই মেনে নেবে না। শহরে গেলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, চালানো হবে অত্যাচার। কিন্তু বিপ্লবী দলের বৃহতর স্বার্থে তিনি এই আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি মাস্টারদার আদেশ শিরোধার্য করেন। সূর্য সেন সুবোধ রায়কে আলাদা করে ডেকে অত্যন্ত উষ্ণতা ও স্নেহের সঙ্গে তাঁকে বিদায় দেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পুলিশের অত্যাচারের মুখেও সুবোধ কিছু বলবে না। মাস্টারদার আশীর্বাদ ও জালালাবাদের স্মৃতি মাথায় নিয়ে সুবোধ ফিরে গেলেন তাঁর বাড়িতে।
সুবোধ বাড়ি ফিরলে তাঁর বাবা মা আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন জালালাবাদে সুবোধের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই আনন্দর স্থায়িত্ব অধিক ছিল না। সুবোধকে ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্বয়ং এসে খাওয়ার পাত থেকে উঠিয়ে থানায় নিয়ে যান। প্রথমে তাঁর সঙ্গে ভদ্র আচরণই করা হয়। পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখিয়ে ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করে তাঁর থেকে কথা বের করা। কিন্তু সুবোধ কিছুতেই মুখ খুলছেন না দেখে তাঁর গায়ে শেষে হাত পড়ল। একজন অফিসার হঠাৎ করেই তার নাকে জোরালো ঘুষি বসিয়ে দিলেন, চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলেন সুবোধ। প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চেয়ারে উঠে বসলেন তিনি। এই ঘুষি তাঁর মনের জোর কমানোর বদলে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। যেটুকু ভীতি তখনও তাঁর মনের মধ্যে ছিল, তাও তিরোহিত হল। নরম বা গরম, কোনো জিজ্ঞাসাবাদের সুবোধের থেকে একটি কথাও বের করা গেল না। তাঁকে লক-আপে রাখা হল। সেখানে দুজন ইউরোপিয়ান আই.বি. অফিসার তাঁকে অসম্ভব অত্যাচার করলেন। মুখ বুজে সহ্য করে গেলেন সুবোধ। তাঁরা চলে গেলে, রক্তাক্ত অবস্থায় যখন তিনি শুনলেন, যে কারাগারের ভারতীয় পাহারাদার সিপাই বলছে, ‘তোমরা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছ’, তখন অদ্ভুত গর্ববোধ সঞ্চারিত হল তাঁর হৃদয়ে। সুবোধ লিখেছেন অসম্ভব দুর্দশার মধ্যেও এই চেতনা উষ্ণ ভাবে ঘিরে রেখেছিল তাঁকে।
লক-আপ থেকে সুবোধকে স্থানান্তরিত করা হল চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট জেলে। সেখানে দিনের পর দিন ক্রমশ ধরা পড়ে যাওয়া বিপ্লবীদের আনাগোনা বাড়তেই থাকল। জুভেনাইল ওয়ার্ডে সুবোধ রায় তাঁর সহবিপ্লবীদের সঙ্গে থাকলেও তাঁরা গোপনীয়তা রক্ষা করতেন, কারণ জেলের মধ্যেও সর্বত্র পুলিশের চরের উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন অবগত। তাও এর মধ্যে ক্রমে তাঁরা নিজেদের পক্ষেও বেশ কয়েকজন জেলের কর্মচারীকে নিয়ে এলেন। এমনকি বাইরের বিপ্লবী নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলাও সম্ভবপর হল। এমনকি পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে জেল ভেঙে সুবোধ সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে মুক্ত করার একটি পরিকল্পনাও ছিল প্রায় বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জেলের প্রাচীরের নিচে যে ডিনামাইট রাখা হয়েছিল, ব্রিটিশ পুলিশ তার সন্ধান পেয়ে যায়। এদিকে চট্টগ্রামে মাস্টারদার নাগাল কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। জলের মধ্যে মাছের মতো তিনি ও তার সহকর্মীরা চট্টগ্রামের জনতার মধ্যে মিশে থাকতে পেরেছিলেন। এমনকি সাম্প্রদায়িক উস্কানির পরীক্ষিত কৌশলও কোনো কাজে আসেনি। এর সাক্ষ্য অনন্ত সিংহের রচনায় আমরা পাই। সুবোধ রায় তাঁর স্মৃতিচারণায় একই বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এদিকে ক্রমশ বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছিল। তার সঙ্গে কমছিল কোনও উদ্ধারের সম্ভবনাও। মাস্টারদা জেল ভেঙে যাদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে সুবোধ অন্যতম ছিলেন তার কারণ হল প্রায় সকলেই নিশ্চিত ছিল বিচারে তাঁর ফাঁসি হবেই। এই কারণে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি অবশেষে যখন রায় ঘোষণার দিন এসে গেল এবং বন্দিদের আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে আদালতে প্রবেশের আগে শেষ সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করা হল, তখন সুবোধ ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে এই শেষ দেখা। আত্মীয় পরিজনদের শোকে তাঁর নয়নও শুষ্ক ছিল না। তাও দৃঢ় চিত্তে তিনি আদালতে প্রবেশ করেন এই গর্বে গর্বিত হয়ে যে তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। রাজনৈতিক ভাবে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ফাঁসি দিয়ে শহীদ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বদলে আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর অনেক নিরাপদ। সেই কারণেই অপ্রত্যাশিত ভাবে স্পেশ্যাল ট্রাইবুন্যাল যখন দ্বীপান্তরের শাস্তি ঘোষণা করে, দুঃখিত হয়ে ওঠার পরিবর্তে দশম শ্রেণির কিশোর বিপ্লবী অসম্ভব আনন্দিত হন। সুবোধ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু জীবনকে তিনি ভালোবাসতেন, সার্থক জীবনের মাধ্যমে দেশকে তাঁর তখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে বলে মনে করতেন। সেই পথ এই রায় দানে উন্মুক্ত হয়ে গেল, মাঝে কাঁটা হিসেবে পড়ে রইল শুধু সেলুলার জেলে ২৫ বছরের হাজতবাসের দণ্ড। সূর্য সেনের ছাত্রের কাছে সেই কাঁটা তো পদ্মেরই সমান।
রায় ঘোষণার পর স্টিমারে করে বিপ্লবীদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। গণেশ ঘোষ, ফনী নন্দীর সঙ্গে সুবোধ বন্দি ছিলেন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের জন্য নির্দিষ্ট ‘কন্ডেমড সেল’-এ। অনেক দাগী কয়েদিও এই প্রকার সেলে থাকতে পারতেন না, কান্নাকাটি, ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। ১৬ বছরের সুবোধের কাছে কিন্তু এই কষ্ট কষ্ট বলেই মনে হয়নি। জালালাবাদে যে কিশোর ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে, ‘কন্ডেমড’ সেল আর তার কাছে কীই বা ভীতির বিষয়? ঢাকা জেলে কিছুকাল থাকার পর, ১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে সুবোধ রায়কে স্থানান্তরিত করা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। কলকাতার আউটরাম ঘাটে স্টিমার এসে লাগে। কয়েদি হিসেবেই জীবনে প্রথম কলকাতায় পা দেন সুবোধ। কিন্তু এও অন্তিম গন্তব্য ছিল না। ১৯৩২ সালের ১৫ই আগস্ট এম.ভি. মহারাজা জাহাজে করে আন্দামানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন তাঁরা।
জাহাজে সুবোধ ও তাঁর সহবন্দিদের রাখা হয়েছিল ইঞ্জিন রুমের পাশে। তাদের হাতে পায়ে শিকল দিয়ে বেড়ি পরানো ছিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। কারণ কোনো কারণে জাহাজডুবি হলে বন্দিরা নিজেদের রক্ষা করতেও পারবেন না। কিন্তু তাঁর কথায় রক্ষীরা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। জাহাজে কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক বন্দির সি-সিকনেস দেখা যায়। তাঁদের কোনও প্রকার সহায়তা করা হয় না। এই রকম পরিস্থিতি প্রায় চারদিন সহ্য করার পর অবশেষে সুবোধ ও তাঁর সাথীরা আন্দামানে এসে পৌঁছোন। একদিকে সেলুলার জেলের হাড় ভাঙা খাটুনি, অন্যদিকে ম্যালেরিয়া ও রক্ত আমাশার প্রকোপ কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবীদের অনেককেই কাবু করে ফেলল। কিন্তু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলেও সুবোধকে সেলুলার জেল ভাঙতে পারেনি। ‘বাঘ সিংহও বশ মানে আর বাঙালি সন্ত্রাসবাদীরা বশ মানবে না?’ জনৈক ব্রিটিশ অফিসারের এই বক্তব্যের প্রত্যত্তরে সুবোধের ল্যাকোনিক উত্তর ছিল, ‘না’। নারকেলের দড়ি পাকিয়ে পাকিয়ে হাত রক্তাক্ত হয়ে যেত, কিন্তু তার মধ্যেও জেল লাইব্রেরি থেকে পাঠ্য বই সংগ্রহ করে পড়া থামাননি তিনি। ইতিমধ্যে মেছুয়াবাজার বোমার মামলার সূত্রে সেলুলার জেলে এসে উপস্থিত হন ড. নারায়ণ রায় ও নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। এই সময় সরকার এমন একটি ভুল পদক্ষেপ নেয়, যা পূর্বে রাশিয়ায় জারপন্থী সরকারও নিয়েছিল। উনবিংশ শতকের শেষভাগে রাশিয়ার জার সরকার বিপ্লবীদের মধ্যে মার্কসবাদ প্রসারে উৎসাহ দেয়, তাঁদের ধারণা ছিল, এতে তাত্ত্বিক আলোচনার রেওয়াজ এত বাড়বে যে গুপ্তহত্যা ও বোমার রাজনীতি থেকে রাশিয়ার বিপ্লবীরা সরে আসবে। রাশিয়ায় এর পরিণতি শেষ অবধি কি হয়েছিল, তা জানা থাকা সত্ত্বেও একচক্ষু হরিণের মতো ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন জেলে বন্দি বিপ্লবীদের মধ্যেও মার্কসবাদ প্রচারে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানায়। সেলুলার জেলে এই সুবিধার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন নারায়ণ রায় ও নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। তাঁদের প্রচেষ্টায় আন্দামান হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক বিদ্যালয়। বন্দিত্বর মধ্যেই মানবমুক্তির মন্ত্রে তাঁরা দীক্ষিত হন। সুবোধ রায় কিন্তু প্রথম প্রথম কমিউনিস্টদের এই পাঠচক্র থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল না। তাঁর মনে হয়েছিল সমাজতন্ত্রের মতো মতাদর্শ ভারতের উপযোগী নয়। তিনি কমিউনিস্ট গণ-আন্দোলনের আদর্শ দ্বারাও প্রাথমিক ভাবে প্রভাবিত হয়নি। বরং চট্টগ্রামের ধাঁচের অনেকগুলো অভ্যুত্থান সমান্তরাল ভাবে ভারতে সংগঠিত করতে পারলে আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আসবে এমনই ছিল তাঁর ধারণা। কিন্তু ক্রমশ আলোচনা, বিতর্ক ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে সুবোধ রায় মার্কসবাদী মতাদর্শের দিকে আকর্ষিত হন। তিনি আরও অনেক বন্দি বিপ্লবীর মতো সিদ্ধান্ত নেন কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেবেন।
ইতিমধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সীমিত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। সেই সুযোগ গ্রহণ করে কংগ্রেস একাধিক প্রদেশে সরকার গঠন করে। এই খবর আন্দামানের বন্দিদের কাছে এসে পৌঁছলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার। দুটি দাবিতে তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন – ১) যত দ্রুত সম্ভব সেলুলার জেলের সকল কয়েদিদের মুক্তি দিতে হবে, ২) যতদিন তাঁরা মুক্তি না পাচ্ছেন সকল বন্দিকে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা দিতে হবে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারত সরকার এই দাবি তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেয়। সুবোধ ও তাঁর সহবন্দিরা শুরু করেন ভুখ-হরতাল। তাঁদের সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গান্ধি, এ.কে. ফজলুল হক থেকে মুজফফর আহমেদের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার ব্যক্তিত্ব তাঁদের স্বপক্ষে জনমত সংগঠিত করেন। ব্রিটিশ সরকার জোর করে তাঁদের হরতাল ভঙ্গ করতে সচেষ্ট হলেও সেই প্রচেষ্টা বিফলে যায়। অবশেষে মহাত্মা গান্ধির অনুরোধে এই হরতাল প্রত্যাহার করা হয় এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যে কংগ্রেস সকল প্রকার প্রচেষ্টা করবে তাঁদের দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরতে ও বাস্তবায়িত করতে।
খুব শীঘ্রই তাঁদের এই ভুখ হরতাল সাফল্যের মুখ দেখে। ধীরে ধীরে আন্দামান থেকে কয়েদিদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে মুক্তির জন্য পাঠানো শুরু হয়। ১৯৩৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি ৯৯ জন রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে সুবোধ ফিরে আসেন তাঁর মাতৃভূমিতে। যদিও মুক্তি তখনও অধরা ছিল। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আন্দামানে অর্জিত অধিকারগুলি থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়। তাও দেশের মাটিতে ফেরা সুবোধকে দিয়েছিল আলাদা মনের জোর। এরই মধ্যে কারাগারে দেখা করতে আসেন তাঁর পিতা-মাতা। কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে যে ছেলেকে তাঁরা দেখেছিলেন, সে যৌবনে পা রেখেছে। অতি আবেগপূর্ণ সাক্ষাতের পর গণেশ ঘোষের পরামর্শে সুবোধের পিতা বাংলার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিনের কাছে দরখাস্ত করেন তাঁর ছেলেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। ততদিনে সরকার আন্দামানে সাম্যবাদ প্রচার করার ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। যারা কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাঁদের উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছিল। সুবোধও এর মধ্যে ছিলেন। তাই তৎক্ষণাৎ মুক্তি হল না। কিন্তু দ্রুত বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সরকার অধিক সময় বিপ্লবীদের জেলে বন্দি রাখতেও ভীত ছিল। তাই কয়েক মাস পরে, দীর্ঘ আট বছর কারাবাসের পর অবশেষে মুক্তি লাভ করলেন সুবোধ। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক আঙিনায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। প্রথমেই রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কংগ্রেস পার্টির অফিসে গেলেন তিনি। সেখানে সাদর অভ্যর্থনা পেলেও তাঁর নতুন রাজনৈতিক অভিমুখ অনেকেরই পছন্দ হল না। সুবোধ এরপর গণেশ ঘোষের পরামর্শ অনুসারে গোপাল আচার্য ও বঙ্গেশ্বর রায়ের সহায়তায় দেখা করলেন বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মুজফফর আহমেদের সঙ্গে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ও ইডেন হসপিটাল রোডের ক্রসিং-এ একটি বাড়ির চারতলার ছোট্ট ঘরে কাকাবাবু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন সুবোধকে। শুরু হল তাঁর নতুন রাজনৈতিক জীবন। আট বছর সেলুলার জেলে কারাবাসের পরেও সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গেই সুবোধ রায় পার্টি সদস্যপদ পাননি। তখনকার আমলে সদস্যপদ ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জনের বিষয়। সেই অর্জনের পরীক্ষা দিতেই সুবোধ প্রস্তুত হলেন এইবার। কাকাবাবুর নির্দেশে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করার জন্য তিনি ফিরে গেলেন তাঁর জন্মস্থানে, তাঁর শিকড়ে, চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামে ফিরে আবার পুরোনো সতীর্থদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুললেন সুবোধ। অনেকেই জেল থেকে ফিরে এসেছেন ইতিমধ্যে। তাঁদের অনেকেই উৎসাহের সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দিলেন, আবার অনেকে রাজনৈতিক ভাবে সহমত না হতে পেরে একসময়ের কমরেড-ইন-আর্মসের সঙ্গে তৈরি করে নিলেন শীতল দূরত্ব। কিন্তু সুবোধের উৎসাহে ভাঁটা পরেনি। তিনি কৃষকদের মধ্যে ক্রমশ সংগঠন নির্মাণ করার প্রচেষ্টা করতে থাকেন। কাজটা শুরুতে ছিল খুবই কঠিন। ভদ্রলোক, জমিদারের পুত্র তাঁদের সুখ দুঃখ নিয়ে সত্যিই ভাবিত হতে পারেন এ তাঁদের কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন সুবোধ। আস্থা অর্জন করেন চট্টগ্রাম পাহাড়তলির রেলওয়ে ওয়ার্কশপের মজুরদেরও। তাঁদের নিয়ে পাঠচক্র গড়ে তোলেন সুবোধ। কীভাবে অধিকার বুঝে নিতে হয়, কীভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হয়, সর্বোপরি কীভাবে সমাজ পাল্টাতে হয় তার শিক্ষা সুবোধ ও তাঁর কমরেডরা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই পাঠচক্রগুলির মাধ্যমেই। অক্লান্ত পরিশ্রম, মাইলের পর মাইল পথ হাঁটা সংগঠন নির্মাণে তাঁর জন্য কোনো বাধা হয়েই দাঁড়ায় নি। প্রায় দুই বছর চট্টগ্রামে কাজ করার পর কাকাবাবুর নির্দেশেই কলকাতায় চলে এলেন সুবোধ। একই সঙ্গে চলল পার্টির কাজ ও শর্টহ্যান্ড এবং টাইপরাইটিং শিখে নিয়ে একটা চাকরির সন্ধান। গোপাল আচার্য ও স্নেহাংশু দাসগুপ্ত ইতিমধ্যে ট্রাম শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করছেন। সুবোধ তাঁদের থেকে শহরের ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শিখে নিলেন। সকাল কেটে যেত তাঁর টাইপরাইটিং শেখার পেছনে আর দিনের বাকি সময় ব্যয় করতেন পার্টির কাজে। নারকেলডাঙার রেল শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন সুবোধ, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ও ভাবনী সেন। প্রথম প্রথম শ্রমিকরা তাঁদের পাত্তাই দিতেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা শ্রমিকদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে তাদের আস্থা অর্জনে ও সংগঠন বিস্তারে সফল হন। এর পাশাপাশি সুবোধের উপর দায়িত্ব পড়ে পার্টির মুখপত্র ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বিক্রি করার। প্রত্যেক দিন বারো কপি করে বিক্রি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আট, নয় কপির বেশি বিক্রি করতে পারতেন না তিনি, বাকি কাগজের পয়সা নিজেই দিয়ে দিতেন। এইভাবে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের পুরস্কার স্বরূপ ১৯৩৯ সালে অবশেষে নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ও মুজফফর আহমেদের সুপারিশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন সুবোধ। কাকাবাবুর সংশয় ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা বিপ্লবীরা আদৌ শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে নিজেদের শ্রেণিগত অহংকারকে পাশে সরিয়ে কাজ করতে পারবেন কিনা। কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা আরও বহু বিপ্লবীদের মতো সুবোধ রায় সেই আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক প্রতিপন্ন করেন। এর থেকে মুজফফর আহমেদের থেকে আহ্লাদিত বোধ হয় আর কেউ হননি।
ইতিমধ্যে ঘনিয়ে এসেছে বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই-এর সন্ধির শর্ত দেখে জনৈক ফরাসি সেনাপতি মন্তব্য করেছিলেন – ‘এ সন্ধি নয়, কুড়ি বছরের যুদ্ধ বিরতি মাত্র’। এই ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল নাৎসি জার্মানি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ড আক্রমণ করলে। প্রাথমিক ভাবে কমিউনিস্টদের যুক্তি ছিল, এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধ, এই যুদ্ধে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারতীয়দের জোর করে সামিল করলে তার বিরোধিতা করতে হবে। এই অবস্থান থেকেই সুবোধ রায় চট্টগ্রামে যুদ্ধবিরোধী জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ব্রিটিশদের দমন পীড়ন আরও জোরালো হয়। এর মধ্যেই যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। নাৎসি জার্মানি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে এবং জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। কমিউনিস্ট পার্টি এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। তাঁদের যুক্তি ছিল, প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিজয়ী হলে সামগ্রিক ভাবে বিশ্বের সকল মুক্তি আন্দোলনকে অনেক ধাপ পিছিয়ে দেবে এবং দ্বিতীয়ত, জাপান যুদ্ধে যোগদানের ফলে বিশ্বযুদ্ধ আর সুদূর ইউরোপের বিষয় নয়, ফ্যাসিস্ট শক্তি ভারতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে। এই যুক্তির প্রেক্ষিতে তাঁরা জনযুদ্ধ নীতি ঘোষণা করেন।
পূর্বের যুদ্ধ বিরোধিতার নীতি প্রত্যাহার করার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, তাঁরা আবার প্রকাশ্য সংগঠনের সুযোগ পান। এই সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন সুবোধ। ব্রিটিশ শাসনের উপর তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। তিনি মনে করেছিলেন এই বিশেষ পরিস্থিত অধিক দিনের না, তাই এর মধ্যেই যথাসম্ভব সংগঠন বিস্তারের কাজ করে নিতে হবে। চট্টগ্রাম টাউনে তৈরি হয় নতুন পার্টি অফিস। সেখানে তাঁরা প্রকাশ্যে সমাবেত হয়ে সংগঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে বাংলায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মন্বন্তর। এই পরিস্থিতিতে রিলিফ ওয়ার্কের কাজে কমিউনিস্ট পার্টি সর্বশক্তি নিয়োগ করে। চট্টগ্রামে এর পুরোভাগে ছিলেন সুবোধ রায়। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে আগস্ট আন্দোলন তাঁর কাছে অত্যন্ত হঠকারী মনে হয়েছিল এবং কমিউনিস্ট পার্টির এতে যোগদান না করা তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন। অন্যান্য কমিউনিস্টদের মতোই এই অবস্থানের জন্য পরবর্তীকালে কংগ্রেসের তরফ থেকে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’র তকমা দেওয়া হয়েছিল। অন্য অনেক কটু কথা সহ্য করে নিলেও, এই তকমা যে তাঁকে গভীর ভাবে আঘাত দেয়, তা নিজের স্মৃতিকথায় সুবোধ লিখেছিলেন।
ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ অগ্রসর হওয়া জাপানি ফৌজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংকল্প করে। কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেনি ব্রিটিশ বাহিনী ভারত রক্ষা করতে সক্ষম হবে। পি.সি. জোশী স্বয়ং পূর্ব ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। এই সূত্রে পাঁচজন কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যকে বার্মা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক করা হয় তাঁরা মংদো শহর পর্যন্ত অগ্রসর হবেন এবং স্থানীয় পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবেন। এই পাঁচজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুবোধ রায়। তিনি স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, এই অভিযান তাঁর কাছে ছিল দ্বিতীয় জালালাবাদ। মৃত্যুর সম্ভাবনা চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের থেকে কিছুমাত্র কম ছিল না। জাপানি বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে তাঁরা সকলেই অবহিত ছিলেন ও বার্মায় বাঙালিদের উপর জাপানিরা কি প্রকার অত্যাচার চালাচ্ছে সে খবরও বাঙালি রিফিউজিদের সূত্রে তাঁদের অজানা ছিল না। তা সত্ত্বেও পার্টির নির্দেশ শিরোধার্য করে তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে পাড়ি দিলেন মংদো-র উদ্দেশ্যে। প্রথমে কক্সবাজার হয়ে তাঁরা জঙ্গলের দুর্গম পথ ধরলেন। কয়েক বোতল পানীয় জল, রুটি ও বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার ছিল তাঁদের সম্বল। অসম্ভব কষ্টকে তুচ্ছ করে তাঁরা আরাকানের জঙ্গল অতিক্রম করলেন। লোকালয়ে এসে অনেক খুঁজে রাস্তার ধারের এক চায়ের দোকানে আশ্রয় মিলল। বার্মা থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয় স্বজনকে খুঁজতে এসেছেন, এই পরিচয় দিতেই দোকানি তাঁদের সাদরে আপ্যায়ন করলেন। তাঁর থেকে খবর নিয়েই সুবোধরা পাড়ি দিলেন মংদো-র উদ্দেশ্যে। তাঁরা যত অগ্রসর হতে লাগলেন তত উন্মোচিত হতে লাগল এক ভয়াবহ চিত্র। আরাকানি মগ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাপানি আক্রমনের প্রেক্ষিতে ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা শুরু হয়েছে। আরাকানিরা অনেকেই জাপানের সমর্থক। অপরদিকে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীকে সমর্থন করে। এর উপর রয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও কলেরার মহামারি। মংদো তে ওমরা মিয়া ও জাহির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সমর্থিত একটি শান্তি কমিটির শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কমিটির প্রেসিডেন্ট ওমরা মিয়ার সঙ্গে সুবোধরা সাক্ষাৎ করেন। ওমরা মিয়া তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা করেন ও জানান জাপানি বাহিনী মাত্র কুড়ি মাইল দূরে অবস্থান করছে ও যে কোনো মুহূর্তে অগ্রসর হতে পারে। চতুর্দিকে জাপানি চরের উপস্থিতি রয়েছে। ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাঁরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাও তার মধ্যেই তাঁরা একটি মিলিশিয়া গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এই মিলিশিয়াকে যথাসাধ্য অস্ত্র প্রশিক্ষণও প্রদান করা হচ্ছে। তিন দিন ধরে সুবোধ রায় ও তাঁর কমরেডরা মংদোতে অবস্থান করেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে তাঁরা প্রেসিডেন্ট ওমরা মিয়ার এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন যে তাঁদের গার্ড অফ অনার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এরপর নাফ নদী অতিক্রম করে তাঁরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মাঝপথে স্টিমারে থাকা অবস্থায় একটি জাপানি সাবমেরিনের পেরিস্কোপ দেখে চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলার একটি ঘটনা ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চট্টগ্রামের পার্টি কমিউনে পৌঁছন এবং তাঁদের দুঃসাহসিক অভিযানের সাফল্যের জন্য তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়।
বার্মা অভিযানের অধ্যায়ের পর সুবোধ পুনরায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির রিলিফ ওয়ার্কের মধ্যে ফিরে যান। তাঁরা কালোবাজারী ও মজুতদারির বিরুদ্ধে সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নিজেদের প্রচেষ্টায় লঙ্গর খোলেন, খাদ্য বিতরণের বন্দোবস্ত করেন। এই সময় জাপানিরা চট্টগ্রামের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলে চট্টগ্রাম শহরে বিপুল পরিমাণ সেনা সমাবেশ হয়। সমবেত ব্রিটিশ বাহিনীর একটা বড়ো অংশ পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল না, এঁরা অনেকেই ছিলেন ব্রিটেনের সাধারণ নাগরিক যাঁরা যুদ্ধের সময় সেনাতে যোগদান করেছেন। তাই পেশাদার ব্রিটিশ সেনার মতো তাঁদের ভারতীয়দের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল না। এঁদের মধ্যে অনেকে আবার কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন। মার্চ পাস্ট করার সময় চট্টগ্রামের পার্টি অফিসের লাল পতাকা দেখে তাঁরা গোপনে পার্টির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। এই কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ব্রিটিশ সেনারা সুবোধ ও তাঁর কমরেডদের ভীষণ অনটনের সময় অর্থ ও খাদ্য দিয়ে ভীষণ সাহায্য করেন, যা সুবোধ পরবর্তীকালে কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁর দেখা আন্তর্জাতিকতাবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ে তাঁরা নিজেদেরই দুই বেলা ভালো করে খাদ্যের জোগাড় হচ্ছিল না। এই সহায়তা তাঁদের নিজেদের অভাব অনেকটা মেটায় ও রিলিফের কাজ চালিয়ে যেতেও সাহায্য করে। যদিও তা ছিল বিশাল সমুদ্র ছোট কলসি দিয়ে খালি করার প্রচেষ্টার মতো, তাও এই প্রচেষ্টা কমিউনিস্ট পার্টিকে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এক উচ্চ নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে। এই সেনাবাহিনীর লোকজনের কাছ থেকেই তাঁরা প্রথম সুভাষচন্দ্র বসু ও আই.এন.এ.-এর খবর পান, যদিও এই খবর জাপানের আগ্রাসী বাহিনী সম্পর্কে তাঁদের নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটায় নি। তাঁরা পূর্বের পরিকল্পনার মতোই গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চারশো জন পার্টি সদস্যকে বেছে নেওয়া হয়। এই চারশো জন সদস্যকে বিশেষ গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন সুবোধ রায় স্বয়ং। মাস্টারদা সূর্য সেনের থেকে গেরিলা যুদ্ধের যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন সেই শিক্ষাতেই তিনি কমিউনিস্ট সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে তোলেন। তবে এই গোপন প্রশিক্ষণ চলার মধ্যেই তাঁরা খবর পান যে জাপানি বাহিনী ক্রমশ পশ্চাদপসারণ করছে। এই প্রশিক্ষণকে যে বাস্তবে কাজে লাগাতে হয় নি, তাতে সুবোধ রায়ের থেকে আর অধিক কেউ খুশি হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি পার্টির নির্দেশে কলকাতায় ফিরে যান এবং সেখানেই সংগঠনের কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনি কলকাতাতেই ছিলেন এবং দাঙ্গা প্রতিরোধে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে প্রায় দুই দশকের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে, আসে স্বাধীনতা। সুবোধের কাছে অবশ্য এই স্বাধীনতা সুখকর স্মৃতি ছিল না। দেশভাগের গভীর ক্ষত তাঁকে তাঁর জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল, চট্টগ্রাম ভারত নয়, পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। এই বিপর্যয়ের জন্য সুবোধ মূলত দায়ী করেছিলেন দেশের কংগ্রেস নেতৃত্বকে। স্বাধীনতার পর এই ‘ঝুটা আজাদি’র হোতাদের বিরুদ্ধে তাই তিনি প্রথমে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর সদস্য হিসেবে সংগ্রাম জারি রাখেন। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর রাজ্য কমিটির সদস্যও ছিলেন। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্মৃতি এবং ইতিহাসকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অপ্রকাশিত দলিল সংকলনের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শেষে ২০০৬ সালের ২৬শে আগস্ট তিনি প্রয়াত হন।
সুবোধ রায়ের সশস্ত্র বিপ্লববাদ থেকে মার্কসবাদে বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে কাঁচা লোহার ইস্পাত হয়ে ওঠা। এ কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়, তৎকালীন বহু বিপ্লবীই এই একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিংশ শতকের তিনের দশকে গেছিলেন। এই বিপ্লবীদের মধ্যে চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতৃত্বও ছিলেন যাদের মধ্যে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও কল্পনা দত্ত-র নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। অনন্ত সিংহ এই প্রক্রিয়া ও চিন্তা সূত্রের ধারা তাঁর গ্রন্থে বিশদে ব্যখ্যা করেছেন। মূলত তিরিশের দশকের বিপ্লবী ঢেউ-এর ব্যর্থতার পর কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বিপ্লবীরা অনেকেই চিন্তা করছিলেন তাঁদের নেওয়া রাস্তায় সাফল্য কেন আসল না এবং বিকল্প পথ কি হতে পারে। বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকের বিপ্লবী প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর একই প্রক্রিয়া আমরা দেখেছিলাম, যখন অবনী মুখার্জি, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সোহন সিং ভাকনা বা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো বিপ্লবীরা মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। তিরিশের দশকে বিপ্লবী ঢেউ-এর ব্যর্থতা ও তার ফলস্বরূপ মানসিকতার রূপান্তরের মধ্যেও আমরা একই প্রক্রিয়া দেখতে পাই। এমন না, সবাই এই নতুন পথে হেঁটেছিলেন। অনেকেই এই নতুন মত ও পথ সমর্থন করেননি, অনেকে আবার মার্কসবাদে দীক্ষা নিলেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করে কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। এই সংশয় সুবোধ রায়ের মধ্যেও ছিল। ভারতীয় পরিস্থিতিতে আদৌ সাম্যবাদের কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা, সেই বিষয়েই তাঁর সংশয় ছিল। সেলুলার জেলে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ অধ্যয়ন ও আলোচনার মধ্যে দিয়েই একমাত্র এই সংশয়ের অবসান ঘটে। বিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। নাৎসি জার্মানির কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং কমিউনিস্টদের যে কোনো প্রকার ফ্যাসিবাদী সরকার বিরোধী দৃঢ় অবস্থানের কথা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। এ ব্যতীত সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানব সভ্যতার প্রধান ঢাল বলে মনে করতেন। তাঁর নিজের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণের সঙ্গে কমিউনিস্টদের মিল তাঁর কমিউনিস্ট সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই ছিল জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন। মাস্টারদা যে স্বপ্ন চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবকে দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন কোনোদিনই তাঁরা বিস্মৃত হননি। শুধু মডেল পরিবর্তন করেছিলেন। পূর্বে তাঁরা আইরিশ ও ইতালীয় জাতীয় সংগ্রাম থেকে প্রেরণা লাভ করতেন। মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি, ডি ভ্যালেরা প্রমুখ নেতাদের জীবনী যে মাস্টারদা ছাত্রদের পাঠ করাতেন, একথা অনন্ত সিংহ স্বয়ং লিখেছেন। লেনিনের আলোচনাও হত, কিন্তু সেই সংক্রান্ত বই পত্রের অভাব ছিল বলেই লার্কিন বা মাৎসিনির থেকে তিনি কোথায় ঠিক আলাদা এই বিষয়টা তাঁদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। আইরিশ ইস্টার রাইজিং-এর ধাঁচে সংগঠিত চট্টগ্রামের অভ্যুত্থান যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন দরকার পড়ল বিকল্প মডেলের। কারাবাসের সময় সেই বিকল্প মডেলের সন্ধানই বিপ্লবীরা পেলেন লেনিনের মধ্যে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তাঁর কাছে একটা বিকল্প নীল নকশা ছিল যার মাধ্যমে সমগ্র দেশের মুক্তি সম্ভব। সুবোধ রায়ও স্বদেশ মুক্তির নীল নকশা হিসেবেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে গ্রহণ করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে গণ সমর্থন গড়ে তোলা ও গণ-আন্দোলন সংগঠিত করা তাঁর কাছে নতুন ধরণের রাজনীতি ছিল, কিন্তু এই রাজনীতির মধ্যে দিয়েই সুনিশ্চিত ভাবে মুক্তি আসবে এই ছিল তাঁর ধারণা। এই ধারণাই তিনি সমগ্র জীবন অতি সযত্নে লালন করে গেছেন। স্বাধীনতা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ ঝুটা ছিল না, কিন্তু এই স্বাধীনতা যে অসম্পূর্ণ, তা তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন। সুবোধ রায়ের মতো বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে ভর করে অসম্পূর্ণ এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা তখনই জানানো হবে যখন নিজেদের প্রচেষ্টায় আমরা ভারতবাসীরা তাকে সার্থক ও সম্পূর্ণ করে তুলব।
তথ্যসূত্র:
১. অনন্ত সিংহ, ‘অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম’, কলকাতা: র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১৬।
২. Kalpana Dutta, ‘Chittagong Armoury Raiders Reminiscences’, Bombay: People’s Publishing House, 1973.
৩. Subodh Roy, ‘Chittagong Armory Raid’, New Delhi: LeftWord Books, 2015.
৪. Satyendra Narayan Mazumdar, ‘In Search of A Revolutionary Ideology and A Revolutionary Programme: A Study in the Transition from National Revolutionary Terrorism to Communism’, New Delhi: People’s Publishing House, 1979.
৫. গণেশ ঘোষ, ‘মুক্তিতীর্থ আন্দামান’, কলকাতা: ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, ২০২০।
ভালো লাগলো পড়ে। প্রয়াত অধ্যাপক অমিতাভ চন্দ্রের এই বিষয়ে তথ্যনিষ্ঠ কাজ আছে — দেখলে অর্ক, তুমি এবং তোমার লেখার সূত্র ধরে, যাঁরা পড়বেন, ঋদ্ধ হবেন।
গোপাল আচার্য ও সুধাংশু দাশগুপ্ত ট্রাম কর্মীদের আন্দোলন গড়ে তোলেন। স্নেহাংশু নয়।
১৯৭৮ থেকে সুবোধ রায়ের স্নেহ পেয়ে এসেছি। সেই সুবাদে জানার সুযোগ হয়েছে অনেক পুরোনো দিনের কথা।
কমরেড সুবোধ রায়ের জীবন চরিত আরও বিশদভাবে প্রচার হওয়া দরকার।
গোপাল আচার্য ও সুধাংশু দাশগুপ্ত ট্রাম কর্মীদের আন্দোলন গড়ে তোলেন। স্নেহাংশু নয়।
১৯৭৮ থেকে সুবোধ রায়ের স্নেহ পেয়ে এসেছি। সেই সুবাদে জানার সুযোগ হয়েছে অনেক পুরোনো দিনের কথা।
চট্টগ্রামের হাইকোর্ট ছিলো না, ছিলো চট্টগ্রাম জেলা জজ কোর্ট
অধ্যাপক সুবোধ রঞ্জন রায় কবি অমিত চৌধুরীকে লেখা এক পত্রে উনার বাবা সুবোধ রঞ্জন রায়ের সম্পূর্ণ একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা কি প্রকাশিত হয়েছে!?
অভিজিৎ রায় কী জীবিত আছে, জানেন?
বিরাটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর অভিজিৎ রায় কবি অমিত চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে তাঁর বাবা বিপ্লবী সুবোধ রঞ্জন রায়ের সম্পূর্ণ একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা কি প্রকাশিত হয়েছে?
অভিজিৎ রায় কি জীবিত আাছে, জানেন?
অধ্যাপক সুবোধ রঞ্জন রায় কবি অমিত চৌধুরীকে লেখা এক পত্রে উনার বাবা সুবোধ রঞ্জন রায়ের সম্পূর্ণ একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা কি প্রকাশিত হয়েছে!?
অভিজিৎ রায় কী জীবিত আছে, জানেন?
বিরাটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর অভিজিৎ রায় কবি অমিত চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে তাঁর বাবা বিপ্লবী সুবোধ রঞ্জন রায়ের সম্পূর্ণ একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা কি প্রকাশিত হয়েছে?
অভিজিৎ রায় কি জীবিত আাছে, জানেন?