খাইবার কথা
না, ব্যাপারটার সাথে খাওয়াদাওয়া বা নামী কোনও রেস্তোরাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। ‘খাইবার’ একটা জাহাজের নাম। ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীর এক যোদ্ধা ক্রুজার এইচ.এম.আই.এস খাইবার। প্রখ্যাত নাট্যকার উৎপল দত্ত “কল্লোল” নামে একটা নাটক লিখেছিলেন। সেই নাটক মঞ্চেও আলোড়ন ফেলেছিল প্রবলভাবে। ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহের উপর লেখা এই নাটক প্রবল বিতর্ক তোলে। প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় জাতীয় নেতাদের ভূমিকাকে। ষাটের দশকের গণ আন্দোলনে উত্তপ্ত বাংলায় এই নাটক হয়ে দাঁড়ায় সরকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অস্ত্র। ভারতের স্বাধীনতা ঝুটা না সত্যি এই প্রশ্ন তোলার সাথে সাথে ‘কল্লোল’ প্রশ্ন তোলে ভারতের রাষ্ট্রচরিত্র নিয়েও। এই নাটক রচনা ও পরিচালনার কারণে উৎপল দত্তকে রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়তে হয়। জেল খাটতে হয় স্বাধীন ভারতবর্ষে।
সেই ‘কল্লোল’ নাটকের নায়ক এই খাইবার জাহাজ। এই জাহাজকে নাট্যকার আত্মসমর্পণ না করতে চাওয়া আপোষহীন বিপ্লবের প্রতিরূপ হিসাবে দেখিয়েছেন। যখন ‘তলোয়ার’-এর নেতৃত্বে সমস্ত জাহাজ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের আশ্বাসে, তখন রুখে দাঁড়িয়েছিল খাইবার। নৌসেনাদের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন খাইবার জাহাজের লড়াকু নাবিকেরা।
‘কল্লোল’ নাটকের নায়ক এই জাহাজটার কি ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিল? তা ছিল বৈকি!
জাহাজটা ছিল ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের পৈত্রিক সম্পত্তি। নির্মাতা উইলিয়াম হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য এইচ.এম.আই.এস হারউইচ তৈরি হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। পরে সেটা ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবহরকে হস্তান্তর করা হলে নাম হয় এইচ.এম.আই.এস খাইবার। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে জাহাজটা বাতিল করা হয় ১৯৪৯ সালে। মানে খাইবারের জীবনকাল মাত্র ১০ বছর।১
আর হ্যাঁ বিদ্রোহের ইতিহাসও এ জাহাজের নতুন নয়। একটা বিদ্রোহের খবর পাওয়া যাচ্ছে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরের। জাহাজের ইঞ্জিন ঘরের কিছু কর্মী বার্তাবাহকের কাজ করতে অস্বীকার করেন। বার্তাবাহকের কাজটা নাকি তাঁদের জাতভিত্তিক নির্ধারিত পেশার সঙ্গে খাপ খায় না। জাতিচ্যুত হওয়ার ভয় থেকে তাই এই অস্বীকৃতি। একই ভয় থেকে অনেকে দাবী করলেন তাঁরা সেন্ট্রি বা প্রহরার কাজ করতে পারবেন না, অনেকে আবার বললেন তাঁরা জাহাজ রঙ করার কাজ করতে অপারগ। নৌ বাহিনীর নিয়মে সংগঠিত ভাবে এই ধরণের দাবী তোলা হল বিদ্রোহ ঘোষণার সমার্থক। তারপর এনকোয়ারি কমিটি বসল। তাঁরা অনেকের কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করে দিলেন, বিদ্রোহীদের কর্ম বিরতিতে পাঠালেন আর দেশে ফেরার পর ছাঁটাই করলেন অনেককে। কর্তৃপক্ষ বুঝলেন, ভারতীয় নাবিকদের এই জাতের সমস্যায় বেশি হাত না দেওয়াই ভালো। কিন্তু নৌ বাহিনীর শৃঙ্খলা রাখতে গেলে তো আর এভাবে চলা যায় না, সুতরাং সিদ্ধান্ত হল নাবিক নিয়োগের সময় জাতপাতের প্রশ্ন আরও সতর্ক ভাবে বিচার করবার। কোপ পড়ল বেশি করে চট্টগ্রামীদের উপর। ৪২ সালে খাইবারের এই বিদ্রোহে চট্টগ্রামীদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি।২
ব্রিটিশ মিলিটারি ইতিহাস Eastern Fleet War Diary ১৯৪৩, ১৯৪৪, ১৯৪৫, বলছে খাইবার এই তিন বছর ছিল Eastern Fleet-এর অংশ। আর আফ্রিকা, ব্রিটিশ ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বহু নৌ সামরিক কনভয়ের এসকর্ট হিসাবে কাজ করেছে।৩ কিন্তু উৎপল দত্তর “কল্লোল” শুরু হয়েছে খাইবারের হারিয়ে যাওয়া থেকে ফিরে আসার কাহিনী শুনিয়ে। সে ফিরে এসেছে নৌবিদ্রোহের চরম মুহূর্তে উপকথার মহানায়কের মতন।
নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী সৈনিক ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা কিন্তু খাইবারের হারিয়ে যাওয়ার এই বক্তব্যকে সমর্থন করছে। একবার ভূমধ্যসাগর যাত্রায় খাইবার একটা কনভয়-এর সামনে ছিল। কনভয়ের বাকি তিনটি জাহাজ হল, নরফোক্, গ্লোরি আর গ্লস্টার। বাকি জাহাজগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর, একমাত্র খাইবার ব্রিটিশ ভারতীয়। তাই ওকেই সামনে রেখে এগোনো। শত্রু গুলি চালালে মরবে ভারতীয় নাবিক, সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে বাকিরা। এই কনভয়-গুলো প্রধানত যুদ্ধকালীন সরবরাহ জাতীয় কাজকর্ম করত। তো ১৯৪৩ সালের ১৬ আগস্ট কনভয় আক্রান্ত হল। এক ইতালিয় ডেস্ট্রিয়ারের গোলার আঘাতে আগুন লেগে গেল খাইবারে। খাইবার হারিয়ে গেল। জানা যায় বাকি জাহাজগুলো অক্ষত ছিল। একা খাইবার লড়াই করে না পালিয়ে, শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছিল। নিখোঁজ খাইবারের নাবিকদের ঘরের লোকেরা মুম্বাই ওয়াটার ফ্রন্ট বস্তিতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। ধরে নেওয়া হয়েছিল হয়তো কোন জার্মান ডুবোজাহাজের আক্রমণে মাঝ সমুদ্রে ডুবে গেছে খাইবার। কিন্তু খাইবারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এক বিন্দুও না। যেন সে উবে গিয়েছিল ইতিহাসের পাতা থেকে।৪
আর খাইবারের ফিরে আসবার খবরও দিচ্ছেন ফণিভূষণ। সরকারী ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ থামলেও খাইবার ফিরে আসেনি। সে ফিরে এসেছে ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ সকালে। নৌসেনাদের বিদ্রোহের সময়েই তার প্রত্যাবর্তন। সে ফিরে এসে নোঙ্গর ফেলেছে বোম্বেতে। হারিয়ে যাবার ব্যাপারটা হল যে, জার্মান টর্পেডোতে আঘাতপ্রাপ্ত খাইবার আশ্রয় নেয় ফরাসী পোতাশ্রয়ে। সেখানে নাবিকদের বন্দী করে নাৎসিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মুক্তি পেয়ে নাবিকরা ফিরে এসেছেন খাইবারে চেপে বোম্বেতে।৫
উৎপল দত্তর নাটকের সঙ্গে ফণীভূষণ ভট্টাচার্যের বর্ণনার হুবহু মিল থাকলেও, নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী আরও দুই সৈনিক বিশ্বনাথ বসু এবং বলাই চন্দ্র দত্তর বর্ণনায় এই ধরণের ঘটনার কোনও উল্লেখ নেই। সরকারি বা বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমেও নেই। বস্তুত খাইবারের এই হারিয়ে যাওয়া এবং নাটকীয়ভাবে ফিরে আসার বিষয়ের স্বপক্ষে আর তেমন কোনও তথ্যই নেই।
এই প্রত্যাবর্তন যেন রূপকথাকেও হার মানায়। তবে এখানেই শেষ নয়। বিদ্রোহের চরম মুহূর্তে পৌঁছে এসে খাইবার চুপ করে বসে থাকেনি। উৎপল দত্তের নাটকের গতিধারা অনুযায়ী তো বটেই নৌবিদ্রোহের সিপাহী ফণীভূষণ ভট্টাচার্যের ভাষ্য অনুসারেও খাইবার যেন শর্তহীন বিদ্রোহের, আত্মসমর্পণহীন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। আর তাই ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬, ক্যাসেল ব্যারাক ব্রিটিশ বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে খাইবার এগিয়ে গিয়ে গোলা ছুঁড়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। “কল্লোল” নাটকে উৎপল দত্ত দেখাচ্ছেন, খাইবার এহেন ভূমিকা নেয় নৌবিদ্রোহের নেতৃত্বকারী সংস্থা তথা “তলোয়ার” জাহাজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। এমন কোনও মতবিরোধের ঘটনার উল্লেখে যদিও ফণীভূষণ ভট্টাচার্য করেননি, কিন্তু নৌসেনাদের আত্মীয়দের বাসস্থান ওয়াটার ফ্রন্ট বস্তি এবং ক্যাসেল ব্যারাকের সঙ্গী নৌসেনাদের রক্ষা করতে খাইবার এগিয়ে গিয়ে যেভাবে গোলাবর্ষণ করে, সেই বর্ণনা সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যায় “কল্লোল” নাটকের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে। হুবহু মিল পাওয়া যায় আরও এক জায়গায়। “কল্লোল” নাটকে বোম্বাই প্রদেশের কংগ্রেস নেতা মগনলালের ভাষণের সাথে ফণীভূষণ ভট্টাচার্যের উদ্ধৃত করা কংগ্রেস নেতার ভাষণে। দু’জনেই বলছেন হুবহু একই কথা, দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সহ।
“বন্ধুগণ, বোম্বাইয়ের নাগরিকবৃন্দ, নৌ-বহরের বীর জাহাজী ভাইরা, আমাদের অতি প্রিয় বোম্বাই শহরে আজ এক নিদারুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৮ই তারিখ থেকে দেশপ্রেমিক জাহাজীরা এক অভূতপূর্ব হরতাল আরম্ভ করেছেন। খাদ্য-বস্ত্র-ন্যায়বিচারর জন্য তাদের এই বীরত্বপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তাঁদের আশু দাবি-দাওয়ার প্রতি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ, সক্রিয় ও সর্তহীন সমর্থন জানাচ্ছে এবং এ আশ্বাস আমি প্রতিটি জাহাজী ভাইকে দিচ্ছি যে, তাঁদের দাবী পূরণ না করে অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের কোন উপায় নেই। কিন্তু কংগ্রেস গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, জাহাজীদের মধ্যে কেউ কেউ এই সংগ্রামকে এমন একটা জঘন্য সহিংস রক্তারক্তির রূপ দিতে চেষ্টা করছে যে তাতে জাহাজীদের দাবী আদায়ের পথই রুদ্ধ হতে বসেছে। যেমন নাকি আজ ভোরবেলায় “খাইবার” নামক জাহাজের অতর্কিত অবিমৃষ্য্যকারিতায় বহু নিরীহ সৈনিক প্রাণ হারিয়েছে কাসল ব্যারাকস্ এলাকায়। জাহাজী ভাইদের কাছে কংগ্রেসের আবেদন, অহিংস প্রতিরোধের পথ ত্যাগ করে সর্বনাশ ডাকবেন না।…”৬
এমনকি ‘সর্ত’ বানানটাও দুই ক্ষেত্রে অবিকল এক। অর্থাৎ দু’জনেই একই সূত্র থেকে বক্তব্যটি সংগ্রহ করেছেন অথবা কেউ একজন অন্যজনের থেকে উক্ত বক্তব্যটি সংগ্রহ করেছেন।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ ক্যাসেল ব্যারাক আক্রান্ত হওয়ার খবরে ফণিভূষণ ভট্টাচার্য যেখানে খাইবার এবং নর্বদার এগিয়ে গিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গোলা ছোঁড়ার কথা বলছেন, তেমন কোনও ঘটনার কথা নৌবিদ্রোহের অন্যতম নেতা এবং কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটির সদস্য বলাই চন্দ্র দত্তর বিবরণে নেই। তিনি বলছেন, ক্যাসেল ব্যারাকে গুলি চালনার খবরে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটির প্রেসিডেন্ট এম.এস. খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটির দফতর তলোয়ার থেকে এইচ.এম.আই.এস নর্বদায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর নর্বদা থেকে বাকি সমস্ত নৌ ঘাঁটি এবং জাহাজগুলিকে সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটির পক্ষ থেকে সিগন্যাল পাঠানো হয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে এবং বোম্বে শহরকে ঘিরে সামরিক অবস্থান নিতে। প্রসঙ্গত এই সিগন্যালটি তাড়াহুড়ায় কোডে না পাঠিয়ে ইংরাজিতে পাঠানোয় ব্রিটিশরা সহজেই ধরে ফেলে। পরবর্তীতে নৌসেনাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য এই সিগন্যালটির বক্তব্যকে বিকৃত ভাবে ব্যবহার করা হয়। বলা হয়, বিদ্রোহী নৌসেনারা নাকি সমগ্র বোম্বে শহরটাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই অপপ্রচারে কিছু জাতীয় নেতাও অংশ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন বলাই চন্দ্র দত্ত। কিন্তু সেইদিন কোনও জাহাজ থেকে গুলি চালানোর কথা ওনার বিবরণে নেই।৭
২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টায় ব্রিটিশ সরকারের সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তি জানাচ্ছে—
“…At 1050 hours, military reinforcement had to be called in for assistance in Castle Barracks. At the same time, a signal was intercepted from H.M.I.S. NARBADA stating that any shots were fired by the military, all ships would open fire. She is also reported to have invited other ships on loud hailer inciting them by saying: “All guns loaded. Do the same, and if any shots are fired from ashore, open fire.” Men from Barracks are also reported to have gone H.M.I.S. JAMNA which has been told to open fire on Barracks as soon as the latter is clear of mutineers.
A message was sent by the mutineers to ships in stream, directing all British officers to quit the ships and asking any Indian officers who wished to join the mutineers to do so. At 1130 the ships were reported to be firing with small arms at Dockyard.”৮
অর্থাৎ সরকারী বিবৃতিতেও খাইবার কিংবা নর্বদার এগিয়ে গিয়ে আক্রমণের কোনও উল্লেখ নেই। যদিও আক্রমণের প্রস্তুতি ছিল এবং ডকইয়ার্ডে ছোট অস্ত্র থেকে কিছু গুলি ছোঁড়ার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
নৌবিদ্রোহের আর এক সৈনিক বিশ্বনাথ বোস-এর বিবরণে মিঃ এম. এস. খানের ডাকে নৌবাহিনীর বিভিন্ন জাহাজের সামরিক প্রস্তুতির বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি ক্যাসেল ব্যারাক আক্রান্ত হওয়ার পর। ওনার বিবরণে আমরা পাচ্ছি খাইবারের কথা।
“The Clive, Khyber and Lawrence were near the Gateway of India and could resist any offensive from that end. The Narbada, Jumna, Kumaon and others near the dockyards could cover the Ballard Estate area.”৯
তাঁর বিবরণেও জাহাজ থেকে আক্রমণের কোনও ঘটনার কথা জানা যায় না।
The Times (London)-এর ২২ ফেব্রুয়ারির চতুর্থ পাতার রিপোর্ট থেকে জানা যায় ছোট অস্ত্র থেকে কিছু জাহাজ ডকইয়ার্ডের দিকে গুলি চালিয়েছিল।১০ যদিও খাইবারের কোনও বিশেষ ভূমিকার উল্লেখ নেই এখানেও।
বোম্বের চিফ ইন্টেলিজেন্স অফিসার, সরকারের হোম ডিপার্টমেন্টের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-কে সেরাফোন মেসেজে জানাচ্ছেন যে সম্ভবত যমুনা জাহাজটি ক্যাসেল ব্যারাকের খুব কাছাকাছি চলে আসে, ক্যাসেল ব্যারাকের বিদ্রোহী নৌসেনাদের সাথে ব্রিটিশ ফৌজের সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে।১১ তাঁর বয়ানে কোথাও বিদ্রোহী নৌবাহিনীর কোনও জাহাজের গুলি চালানোর কথা নেই। খাইবার সম্পর্কেও কোনও বক্তব্য নেই।
আর ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে বোম্বাই প্রদেশের কংগ্রেস নেতার ভাষণে খাইবারের উল্লেখ অন্য কোনও ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে পাওয়া যায়নি। যদিও কংগ্রেস নেতারা নৌসেনাদের রণংদেহী মনোভাবের নিন্দা করেছেন। বোম্বাই শহর উড়িয়ে দিতে চায় বিদ্রোহী সেনারা, সেই ব্রিটিশ অপপ্রচারেও অংশ নিয়েছেন অনেকে। কিন্তু কোথাও খাইবার প্রসঙ্গ নেই। তাই প্রশ্নটা আবারও একই জায়গায় ফিরে আসে, উৎপল দত্ত আর ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের মধ্যে এই বিষয়টি কার থেকে কে সংগ্রহ করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে পরে বিষদে আলোচনা করা যাবে, আপাতত যেটা বিবেচ্য বিষয় সেটা হল, খাইবার জাহাজের যে ঘটনাবলী উৎপল দত্ত “কল্লোল” নাটকে তুলে ধরেছেন সেটা ফণীভূষণ ভট্টাচার্যের লিখিত বিবরণের দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে। যদিও বেশ কিছু অমিলের জায়গাও রয়েছে। উৎপল দত্তের নাটকে যা নেই, খাইবারের তেমন আরও এক বীরোচিত ঘটনার কথা বিবৃত করেছেন ফণীভূষণ।
১৯৪৬-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী সমস্ত জাহাজ ও ঘাঁটিগুলি শান্তির পতাকা উড়িয়ে দিয়ে ধর্মঘটের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে। সেইদিন বিকেলে সাড়ে চারটে নাগাদ বিদ্রোহী জাহাজগুলোর দিকে শান্তির নিশান উড়িয়ে এগোতে থাকে ছোট ছোট ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ। তারপর চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে অকস্মাৎ শুরু করে নির্বিচার গোলা বর্ষণ। যার পরিণতিতে অসহায় নাবিকরা নির্বিচারে মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকেন। তারপর…
“…ইতিমধ্যেই হঠাৎ আক্রমণে বিদ্রোহীদের দেড়শ’ জন মারা গেলেন। মিঃ মদন সিং ঝড়ের বেগে ‘খাইবার জাহাজের বেতার যন্ত্রর কাছে ছুটে গিয়ে সর্বত্র বেতার-সঙ্কেতে আবার যুদ্ধের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, “পেছন দিয়ে অতর্কিতে কাপুরুষ ব্রিটিশরা আমাদের আক্রমণ করেছে। ওদের ক্ষমা নেই। শান্তির পতাকা এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রতিটি গোরা সৈন্যকে খতম করার সঙ্কল্প নাও। ডু অর ডাই!”১২
প্রসঙ্গত মদন সিং ছিলেন নৌবিদ্রোহের কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটির সহ সভাপতি। ফণীভূষণের বর্ণনা অনুসারে এরপর মদন সিং খোদ নিজে হাতে খাইবারের কামান দাগতে শুরু করেন। মাইক্রফোনে আবেদন রাখেন—“Oh my beloved countrymen! See our national leaders. They are nothing but the traitors of our motherland; see them—see them—see them.”১৩
দুঃসাহসী খাইবার জাহাজের বেতার বার্তা পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে তীরের দিকে এগিয়ে এলো কাথিয়াওয়াড় জাহাজ। ছোট্ট জাহাজ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ক্রুজার গ্লাসগোর সামনে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। যে কারণে গ্লাসগো সম্মান দেখিয়ে ছোট্ট জাহাজটির উপর গুলি চালায় না। লেখকের মতে সামান্য শক্তি নিয়ে অনেক সংগ্রাম করে প্রায় দেড় হাজার মতন গোরা সৈন্যকে নিকেশ করে অবশেষে খাইবার ও কাথিয়াওয়াড় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।১৪
আত্মসমর্পণ পরবর্তী সংগ্রামে খাইবারের বিষয়ে কোনও উল্লেখ না থাকলেও বলাই চন্দ্র দত্ত কিন্তু ছোট্ট করভিট জাহাজ কাথিয়াওড়ের কথা লিখেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি করাচী বন্দরে বিদ্রোহী জাহাজ হিন্দুস্তানের উপর ব্রিটিশরা আক্রমণ চালাবে খবর পেয়ে, জাহাজের রেটিং-রা ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন সহ অফিসারদের বন্দী করে করাচীর দিকে জাহাজ চালিয়ে দেন। কিন্তু পথিমধ্যে তারা বুঝতে পারেন যে হিন্দুস্তানের কাছে পৌঁছতে তাঁদের অনেক দেরী হয়ে যাবে। তাই দিক বদল করে কাথিয়াওয়াড় ছুটে আসে বোম্বাইয়ের দিকে। কাথিয়াওয়াড় ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টায় বোম্বে বন্দরের লাইট হাউসের কাছে পৌঁছোয়। রেটিং-রা জানতেন না যে ইতিমধ্যে বোম্বাইয়ের বিদ্রোহী নৌসেনারা আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন। সিগনালে আসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশমূলক বার্তা, জাহাজকে ওখানেই থামানোর নির্দেশ। কাথিয়াওয়াড় সেই নির্দেশের তোয়াক্কা না করে এগোতে থাকে বন্দরের দিকে। লক্ষ্য একটাই, বিদ্রোহে যোগ দান করা। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ রয়াল নেভির ক্রুজার গ্লাসগো কাথিয়াওয়াড়ের পথ আটকে দাঁড়ালে, ছোট্ট জাহাজের একমাত্র সম্বল একটি বারো ইঞ্চির কামান গ্লাসগোর দিকে তাক করে কাথিয়াওয়াড় পেরিয়ে যায় গ্লাসগোকে। বহু যুদ্ধের বিজয়ী গ্লাসগোর বিধ্বংসী কামান নীরব থাকে ছোট্ট জাহাজের বীরত্বকে সম্মান দেখিয়ে।১৫ কাথিয়াওয়াড়ের এই সংগ্রামের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় দীপক কুমার দাসের REVISITING TALWAR : A STUDY IN THE ROYAL INDIAN NAVY UPRISING OF FEBRUARY 1946 বইতে। বলাই চন্দ্র দত্তর মতই সমর্থিত হয় এই বিবরণের মধ্যে দিয়ে।১৬
না, বলাই চন্দ্র দত্তর বিবরণ অনুসারে কাথিয়াওয়াড় কিন্তু খাইবারের ডাক শুনে ছুটে আসেনি। আর বিকেলে নয়, ২৩ তারিখ ভোরবেলাই সে ছুটে এসেছিল যোদ্ধার বেশে।
লেখক ফণীভূষণ আরও জানিয়েছেন নৌবিদ্রোহের কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটির প্রধান দুই নেতা মিঃ এম.এস. খান (কমিটির সভাপতি) এবং মদন সিং-এর পরিণতির কথা। মিঃ খানকে পায়ে এক মণ ওজনের দুটো পাথর পায়ে বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় আরব সাগরের মাঝে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। আর মদন সিংকে গুলি করে হত্যা করা হয়।১৭ এদিকে বিশ্বনাথ বোস বলছেন নৌবিদ্রোহের সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবার পর যাঁদের গ্রেফতার করা হয়, তার মধ্যে লেখক নিজে ছিলেন। তিনি গ্রেফতার হন এইচ.এম.আই.এস. আসাম থেকে। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মহারাষ্ট্রের মুলুন্দ বন্দীশিবিরে। বাকি বন্দী নৌসেনাদেরও সেখানেই রাখা হয়েছিল। আর সেখানে এম.এস. খানও বন্দী ছিলেন। নৌবিদ্রোহ সংক্রান্ত সরকারী তদন্ত কমিটির বিচার প্রক্রিয়ার সময় লেখকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখন বিপর্যস্ত। লেখক জানাচ্ছেন পরবর্তীকালে দেশভাগের পর এম.এস. খান পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে কমিশনড অফিসার হিসাবে যোগ দেন।১৮ আর গ্রেফতারির পর মদন সিং-এর সঙ্গে এম.এস. খানের মতের অমিলের কথা জানতে পারেন লেখক। মদন সিং আত্মসমর্পণের বিপক্ষে ছিলেন। বিচার শেষে নৌবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর তিনি বলাই চন্দ্র দত্তের মতনই ‘ফ্রি প্রেস জার্নাল’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে যোগ দেন।১৯
আত্মসমর্পণ পরবর্তী সরকারী দমন প্রসঙ্গে অবশ্য সকলেই সরব হয়েছেন। বলাই চন্দ্র দত্ত জানিয়েছেন আত্মসমর্পণের দশ ঘণ্টার মধ্যে চার’শ-এর বেশি নৌসেনাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। নৌসেনাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের বার্তায় ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘No Victimisation, No Vindictiveness’-এর প্রতিশ্রুতির উল্লেখ থাকলেও কার্যক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক আচরণ শুরু হয়ে যায় আত্মসমর্পণের পর থেকেই।২০ ফণীভূষণ ২৩ ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহী সেনাদের আত্মসমর্পণের পর বিকেলে ব্রিটিশদের আক্রমণ এবং খাইবারের প্রতিরোধের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার কোনও উল্লেখ নেই বলাই চন্দ্র দত্তর লেখায়। বিশ্বনাথ বোসের গ্রন্থেও এমন কোনও ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমন কোনও ঘটনার উল্লেখ সরকারী কোনও দস্তাবেজ এবং তৎকালীন গোয়েন্দা রিপোর্টেও দেখতে পাওয়া যায় না।
ঠিক এই পর্যায়ে এসে একটা ধন্দ তৈরি হয় মনে। খাইবার জাহাজের কথা ফণীভূষণ ভট্টাচার্য ছাড়া আর কারও বর্ণনায় কিংবা স্মৃতিচারণায় তেমনভাবে আসেনি কেন? এমন নয় যে খাইবার জাহাজের উল্লেখ অন্য কারও বর্ণনায় নেই। বিদ্রোহে অংশ নেওয়া জাহাজগুলির তালিকা দিয়েছেন বিশ্বনাথ বোস, সেখানে অবশ্যই খাইবারের নাম রয়েছে। খাইবার তখন সমুদ্রে ছিল এবং সেখান থেকেই বিদ্রোহে যোগ দেয়। দেশভাগের পর পাকিস্তান নৌবাহিনীর হাতে চলে যায় খাইবার। ১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধে খাইবার ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উইকিপিডিয়ায় দেওয়া ১৯৪৯ সালে খাইবারের বাতিল হয়ে যাওয়ার তত্ত্বের সঙ্গে না মিললেও উৎপল দত্তের নাটক ‘কল্লোল’ যে এই খাইবারকে কেন্দ্র করেই সেই তথ্য জানাতে ভোলেননি বিশ্বনাথ বোস।২১
কিন্তু কারও বর্ণনাই উৎপল দত্তর নাটক ‘কল্লোল’-এর সঙ্গে হুবহু মেলেনি একমাত্র ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের বর্ণনা ছাড়া। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে উৎপল দত্ত ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের গ্রন্থ থেকেই ‘কল্লোল’ নাটকের মালমশলা আহরণ করেছেন। প্রসঙ্গত জানাই, ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের দুটি বই রয়েছে নৌবিদ্রোহের উপর, একটি ‘নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস’ অপরটি ‘নৌ-বিদ্রোহের ইতিকথা’। বিপদ হল এই দুটি বইয়ের প্রকাশ কাল নিয়ে। ‘নৌ-বিদ্রোহের ইতিকথা’ বইটির প্রথম প্রকাশ লেখা রয়েছে অক্টোবর ১৯৭৩ আর ‘নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস’ বইটির প্রথম প্রকাশ ছাপানো রয়েছে বৈশাখ ১৩৬১ অর্থাৎ ইংরাজি ক্যালেন্ডারে এপ্রিল-মে ১৯৫৪। কিন্তু ‘নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস’ বইটির ভূমিকায় বিপ্লবী গণেশ ঘোষ লিখছেন— “৩৫/৩৬ বৎসর পূর্বেকার অনেক ঘটনাই স্মরণের অতীতে চলে যায়। তা সত্ত্বেও ফণীবাবু যে সেই সব হারিয়ে যাওয়া অমূল্য সম্পদসমূহ খুব কষ্ট খুঁজে বের করে দেশের মানুষের কাছে পরিবেশন করেছেন, তার জন্য তিনি সমগ্র জাতির ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।”২২ ১৯৪৬-এর ৩৫/৩৬ বছর পর অর্থাৎ ১৯৮১/৮২ সাল। প্রসঙ্গত সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘নৌবিদ্রোহ ঝলসে-ওঠা তলোয়ার’ বইটিতে তথ্যসূত্রে লেখক ‘নৌবিদ্রোহের’ ইতিহাস বইটির প্রকাশকাল বলেছেন ১৯৭৯। দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৮১।২৩ সেটাই সঠিক বলে মনে হয়।
সুতরাং মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ‘নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস’ এবং ‘নৌ-বিদ্রোহের ইতিকথা’ বই দুটি কোনও অবস্থাতেই ১৯৭০ সালের আগে প্রকাশিত নয়। এদিকে ‘কল্লোল’ নাটকটি প্রথম মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ২৮ মার্চ ১৯৬৫। অর্থাৎ উৎপল দত্ত ১৯৭০-এর আগেই নাটকটি রচনা করেছেন। সুতরাং কোনও ভাবেই উৎপল দত্তের পক্ষে ফণিভূষণ ভট্টাচার্যর বই থেকে খাইবার সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ‘কল্লোল’ নাটক পরিচালনায় উৎপল দত্তর নৌবহর সংক্রান্ত উপদেষ্টা ছিলেন খাইবার জাহাজের প্রাক্তন রেটিং দীপক বসু।২৪ খাইবার সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জানবার সুযোগ ছিল উৎপল দত্তর। কিন্তু এমন হুবহু ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের বর্ণনার সঙ্গে মিলছে কিভাবে? তাহলে ফণিভূষণ ভট্টাচার্য কি উৎপল দত্তর নাটক থেকে হুবহু এই সমস্ত জায়গাগুলি নিয়েছিলেন?
লেখক ফণিভূষণকে নিয়ে এই জাতীয় অভিযোগ তোলা দুঃসাহসের বিষয় তো বটেই এবং লজ্জাজনকও একই সাথে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে লেখকের এবং তাঁর গোটা পরিবারের অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র’ মামলায় লেখকের গোটা পরিবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেই মামলার মূল আসামী ছিলেন লেখকের নিজের বড়দা কালীপদ ভট্টাচার্য।২৫ অনুশীলন সমিতির সদস্য হিসাবে লেখক ক্যুরিয়ারের কাজ করেছেন।২৬ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে লেখক কারাবাস পর্যন্ত করেছেন।২৭ ১৯৪৪ সালের নৌবিদ্রোহের সময় নৌবাহিনীর অন্যতম নেতৃত্বকারী সদস্য ছিলেন লেখক স্বয়ং। ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহেও বাহিনীর বাইরে থেকে অংশ নিয়েছেন। এমন একজন আজীবন সংগ্রামী—দেশপ্রেমী মানুষ একটা নাটক থেকে হুবহু টুকে দিয়ে ঐতিহাসিক তথ্যের ঘাটতি মেটাচ্ছেন সেই অভিযোগ তোলা তাই যেমন দুঃসাহসের তেমনই লজ্জাজনক।
কিন্তু তাহলে? তাহলে তৃতীয় একটা সম্ভাবনার দরজা খোলা থাকে। ব্রিটিশ আমলে নিষিদ্ধ হয়ে যায় ‘নৌবিদ্রোহ’ নামে একটি বই। লেখক শাহাদৎ আলি। উৎপল দত্তর নাটকের প্রেরণা নাকি এই বইটি। সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ওয়েব মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি লালবাজারে পুলিশের কেন্দ্রীয় সংগ্রহশালা থেকে নাকি বইটি উৎপল দত্তর হাতে আসে।২৮ ‘নৌ-বিদ্রোহের ইতিকথা’ বইটির ভূমিকায় শ্রীপঞ্চানন চক্রবর্তী লিখছেন— “নৌ-বিদ্রোহের কাহিনী আমাদের অনেকের কাছে বেশ কিছুটা অপরিচিত। যখন আরব সাগরের কূলে এই সংগ্রাম ঘটেছিল, তার অনেক দিন পরে সামান্য কিছু সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। পরে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত শেখ শাহাদাত আলির ‘নৌ-বিদ্রোহ’ গ্রন্থটি আমাদের কাছে এসেছিল। এতদিন পরে আবার শ্রীযুক্ত ফণিভূষণ ভট্টাচার্য্যের এই গ্রন্থটি পেয়ে, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি অমূল্য উপাদান বোধে আনন্দিত হয়েছি।”২৯
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহের কাহিনী ফণিভূষণ ভট্টাচার্য লিখেছেন মূলত বলাই চন্দ্র দত্তর বইটি অবলম্বন করে। কারণ তিনি এই বিদ্রোহের সময় ‘তলোয়ার’-এ উপস্থিত থাকলেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার জন্য। তবে তাঁর লেখায় ‘খাইবার’ জাহাজের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।৩০
আমার বক্তব্য ফণিভূষণ ভট্টাচার্য শুধুমাত্র বলাই চন্দ্র দত্তর গ্রন্থ নয়, তার সাথে শেখ শাহাদাত আলির বইটিও অবলম্বন করেছিলেন। সেখান থেকেই হয়তো তুলে এনেছিলেন খাইবার জাহাজের কথা। আর সেই একই সূত্র থেকে নাটকের অনুপ্রেরণাও খুঁজে পেয়েছিলেন উৎপল দত্ত। পেয়েছিলেন তথ্যভাণ্ডার। তাই খাইবার প্রসঙ্গে এতটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় ফণিভূষণ ভট্টাচার্যের বর্ণনার সাথে উৎপল দত্তর নাটকের।
প্রসঙ্গত ৪৪ সালের নৌবিদ্রোহের বর্ণনায় ফণিভূষণ ভট্টাচার্য একজন নেতৃত্ব স্থানীয় বিদ্রোহী শেখ শাহাদাত আলির উল্লেখ করেছেন।৩১ যাঁদের নেতৃত্বে ৪৪-এর বিদ্রোহ পরিচালিত হয়, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেই শেখ শাহাদাত আলি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পরও ধরা পড়েননি তা লেখক জানতেন।৩২ ইনিই ‘নৌ-বিদ্রোহ’ বইটির লেখক শেখ শাহাদাত আলি কিনা সেটা অবশ্য জানতে পারিনি। পাইনি সেই বইটিরও কোনও সন্ধান।
সুতরাং উৎপল দত্তর “কল্লোল” নাটকের নায়ক খাইবার জাহাজের ঐতিহাসিক ভিত্তি যে রয়েছে তা নিঃসন্দেহ হয়ে বলা চলে। বাস্তব ঘটনাবলির সাথে নাটকের কিংবা খাইবার জাহাজের ভূমিকার কতটা মিল আছে সে বিতর্কে না গিয়েও কয়েকটা বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।
‘কল্লোল’ নাটকের খাইবার জাহাজের রেটিং-দের মতই আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তে বহুসংখ্যক রেটিং-এর ক্ষোভের কথা জানা যাচ্ছে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬-এর ‘ফ্রি প্রেস জার্নাল’ পত্রিকার রিপোর্ট থেকে—
“Bombay, Saturday (3 a.m.). Considerable opposition prevails against some of the members of the Central Strike Committee who have almost come to an agreement with Sardar Patel to resume work. The representatives of twenty ships in the harbor who are not represented on the Committee feel that the leaders of the Central Committee sold the pass. They say in no circumstances could they agree to unconditional surrender. They are prepared to surrender provided Sardar Patel gives a guarantee that their demands would be met. The Admiralty at 1 a.m. this morning permitted the Central Committee leaders to invite representatives of the ship[s] to a conference on board HMIS “Talwar”. It is learned that the representatives landed at the Dockyard at 2:30 a.m. and at the time of going to press are in conference considering whether to give up or continue the strike.”
আর ঠিক খাইবারের মতন না হলেও জানা যাচ্ছে অন্য এক অবাধ্যতার গল্প। না কোনও জাহাজ নয়। আত্মসমর্পণ করতে না চাওয়া একটি নৌঘাঁটি এইচ.এম.আই.এস. আকবরের কথা। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটি আত্মসমর্পণের ঘোষণা করলেও যারা আত্মসমর্পণ করেনি। একমাত্র যারা জারী রেখেছিলেন ধর্মঘট, অব্যাহত রেখেছিল সংগ্রাম। হ্যাঁ একলাই। বিশ্বনাথ বসু বলছেন—
“One Naval Establishment had refused to surrender. It was HMIS Akbar at Thana. Its representative had not been able to attend the last meeting of the NCSC and they could not believe the report that the battle was over. They had fought a lone battle throughout and were not prepared to surrender…”৩৩
কোলসেট-এর এই ঘাঁটির সৈন্যদের তাঁদের কমান্ডিং অফিসার জানান যে নৌবাহিনীর কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটি আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেছেন ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা, সুতরাং আকবর-এর নৌসেনাদেরও ধর্মঘট প্রত্যাহার করে এবার আত্মসমর্পণ করা উচিৎ। এই প্রস্তাবে বেঁকে বসেন এইচ.এম.আই.এস. আকবরের বিদ্রোহী সেনারা। তাঁদের স্পষ্ট দাবী, যতক্ষণ না নৌবাহিনীর কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটির কোনও নেতা, সম্ভব হলে প্রেসিডেন্ট, সেখানে এসে জানাচ্ছেন যে ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে, ততক্ষণ তাঁরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। তেমন কাউকে আনা সম্ভব হয়নি। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জামিল তখন রেটিং-দের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে বাকি সবাই আত্মসমর্পণ করার পর শুধু একা আকবর বিদ্রোহ জারী রেখে কিছু করতে পারবে না। তাঁর কথা থামিয়ে দিয়ে জনৈক রেটিং বলে ওঠেন, “গান্ধীজী এবং জিন্নার নির্দেশ হল, যতক্ষণ না দাবী মিটবে আমরা যেন ধর্মঘট চালিয়ে যাই”।৩৪ এইভাবে তারপরের পরের দিন অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যান রেটিং-রা। জাতীয় নেতারা যে ভূমিকাই নিয়ে থাকুন না কেন, রেটিং-রা সংগ্রামের প্রয়োজনে নেতাদের ভূমিকাকে নিজেদের কল্পনার রং-এ রাঙিয়ে নিজেদের সংগ্রামকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হ্যাঁ হয়তো ‘কল্লোল’ নাটকের খাইবারের মতন করে নয়, কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে না চাইবার এই দৃঢ়তা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় উৎপল দত্তর খাইবারের নাবিকদের আপোষহীন সংগ্রামী চেতনাকে।
এবার লেখাটি শেষ করবার পালা। কিন্তু ‘কল্লোল’-এর খাইবার যেমন শেষ কথা বলে যেতে দেয়নি কাউকে, সে জারী রেখেছিল আত্মসমর্পণহীন এক সংগ্রাম। ব্যর্থতার মধ্যেও প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল বারবার, আগামী প্রজন্মের জন্য রেখেছিল সমুদ্রের ঢেউ ভাঙবার দৃঢ়তা। সেই খাইবারের কথা কি শেষ হতে পারে এতো তাড়াতাড়ি? বরং নৌবিদ্রোহের পঁচাত্তরতম বছরে ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন তথা আজকের বাস্তব সংগ্রামের প্রতীক হয়ে সে কি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেই? নাকি ‘পোস্ট ট্রুথ’ সময়ের দৌলতে দেখবার চোখটাই হারিয়ে গেছে আমাদের! জবাব চাইবে ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ
১. “HMIS Khyber (J190),” Wikipedia, accessed November 11, 2020, https://en.wikipedia.org/wiki/HMIS_Khyber_(J190).
২. Dipak Kumar Das, Revisiting Talwar: A Study in the Royal Indian Navy Uprising of February 1946 (Delhi: Ajanta Publications, 1993), 51-52.
৩. “HMIS Khyber (J190).”
৪. ফণিভূষণ ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা (কোলকাতা: রবীন্দ্র লাইব্রেরী, ১৯৭৩), ৫২।
৫. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১১৫।
৬. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১২৫-১২৬ এবং উৎপল দত্ত, উৎপল দত্ত’র নির্বাচিত নাট্য-সংগ্রহ, ৪র্থ খণ্ড (কোলকাতা: জাতীয় সাহিত্য পরিষদ), ২৪৬-২৪৭।
৭. Balai Chandra Dutt, Mutiny of the Innocents (Bombay: Sindhu Publications Pvt. Ltd., 1971), 149.
৮. Dutt, Mutiny of the Innocents, 150-151.
৯. Biswanath Bose, RIN Mutiny : 1946 (New Delhi: Northern Book Centre, 1988), 88.
১০. Bose, RIN Mutiny : 1946, 156.
১১. Sumit Sarkar, ed., Towards Freedom: Documents on the Movement for Independence in India 1946, Part 1 (New Delhi: Oxford U.P., 2007), 74.
১২. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১৪৬।
১৩. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১৪৭।
১৪. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১৪৭-১৪৮।
১৫. Dutt, Mutiny of the Innocents 191-192.
১৬. Das, Revisiting Talwar, 179-183.
১৭. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১৪৮।
১৮. Bose, RIN Mutiny : 1946, 172.
১৯. Bose, RIN Mutiny : 1946, 172.
২০. Dutt, Mutiny of the Innocents, 186.
২১. Bose, RIN Mutiny : 1946, 24.
২২. ফণিভূষণ ভট্টাচার্য, নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস (কোলকাতা: বুক্স অ্যান্ড পিরিয়ডিক্যাল্স), ৪।
২৩. সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৌবিদ্রোহ ঝলসে-ওঠা তলোয়ার (কোলকাতা: রাডিক্যাল ইম্প্রেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৮), ৭৯।
২৪. উৎপল দত্ত, নির্বাচিত নাট্য-সংগ্রহ, ১৯৯।
২৫. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ১৯।
২৬. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ২১।
২৭. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ৮।
২৮. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, “নৌ-বিদ্রোহে কংগ্রেসের ‘বেইমানি’ নাটকে তুলে ধরেছিলেন উৎপল দত্ত,” accessed November 11, 2020, https://www.kolkata24x7.com/utpal-duttas-play-kallol-said-congress-traitor/.
২৯. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ভূমিকা।
৩০. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ৫১।
৩১. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ৬৬-৬৭।
৩২. ভট্টাচার্য্য, নৌবিদ্রোহের ইতিকথা, ৮৭।
৩৩. Bose, RIN Mutiny : 1946, 89.
৩৪. Das, Revisiting Talwar, 223.
গ্রন্থতালিকাঃ
- Wikipedia. “HMIS Khyber (J190).” Accessed November 11, 2020. https://en.wikipedia.org/wiki/HMIS_Khyber_(J190).
- Das, Dipak Kumar. Revisiting Talwar: A Study in the Royal Indian Navy Uprising of February 1946. Delhi: Ajanta Publications, 1993.
- ভট্টাচার্য্য, ফণিভূষণ। নৌবিদ্রোহের ইতিকথা। কোলকাতা: রবীন্দ্র লাইব্রেরী, ১৯৭৩।
- দত্ত, উৎপল। উৎপল দত্ত’র নির্বাচিত নাট্য-সংগ্রহ, ৪র্থ খণ্ড। কোলকাতা: জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৯৫৪(?)।
- Dutt, Balai Chandra. Mutiny of the Innocents. Bombay: Sindhu Publications Pvt. Ltd., 1971.
- Biswanath, Bose. RIN Mutiny : 1946. New Delhi: Northern Book Centre, 1988.
- Sarkar, Sumit, ed. Towards Freedom: Documents on the Movement for Independence in India 1946, Part 1. New Delhi: Oxford U.P., 2007.
- ভট্টাচার্য, ফণিভূষণ। নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস। কোলকাতা: বুক্স অ্যান্ড পিরিয়ডিক্যাল্স, ১৯৫৪(?)।
- বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপ। নৌবিদ্রোহ ঝলসে-ওঠা তলোয়ার। কোলকাতা: রাডিক্যাল ইম্প্রেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৮।
- মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ। “নৌ-বিদ্রোহে কংগ্রেসের ‘বেইমানি’ নাটকে তুলে ধরেছিলেন উৎপল দত্ত।” Accessed November 11, 2020.
- https://www.kolkata24x7.com/utpal-duttas-play-kallol-said-congress-traitor/.
Well written in historical perspective
পড়ে খুব ভালো লাগলো| আনেক কিছু জানলাম|
খুব ভালো লাগলো।অনেক কিছু জানতে পারলাম।
অনবদ্য
আমি বাংলা থেকে ইংরেজি আর হিন্দিতে এই লেখটার আনুবাদ কারতে চআই , আনুমাতি চআই,