সিতোল
এই লেখায় যে বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে আলোচনা হবে, তা হয়তো পৃথিবীর অন্যতম বিতর্কিত বাদ্যযন্ত্রের একটি। বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস-প্রিয় আজকের মানুষের মূল দৃষ্টি থাকে সাধারণত মধ্য এশিয়ার দিকে। কারণ এই অঞ্চলকেই আধুনিক যন্ত্রের আঁতুড়ঘর মনে করা হয়। সেই তুলনায় বর্তমানের ইউরোপীয় যন্ত্রগুলি আধুনিক ও তার ইতিহাস স্পষ্ট। তবে ইউরোপের এই যন্ত্রটিকে আলাদা করে উল্লেখ করার একান্ত প্রয়োজন।
বাকি অংশ পড়া শুরুর আগে অনুরোধ করবো, যন্ত্রটির ছবি একবার ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে নিন। তারপর বলুন তো, আপনার দেখা কোন যন্ত্রের সঙ্গে অনেকটা মিল পাচ্ছেন? জানি অধিকাংশের উত্তর হবে, ‘বেহালা’। উত্তরটি ঠিক ও ভুল। এমন কেন বললাম? তা জানতে হলে আপনাদের এই লেখার বাকি অংশটা পড়তে হবে। ছবির যন্ত্রটার বর্তমানে আগে আসি। এটা এখন রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। কিউরেটররা এর তৈরির যে সময় উল্লেখ করেছেন তা ১৩০০ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যবর্তী। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, প্রথম বেহালা তৈরির প্রায় ৩০০ বছর আগে এর জন্ম। পাওয়া গিয়েছিল কোথায়? একেবারে বলা যায় রানির হাত থেকে। প্রথম এলিজাবেথ এটা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন ওয়ারুইক কাসেলে, সেখান থেকেই এটি সংগৃহিত। আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে লেখা Old English instruments of Music গ্রন্থে (১৯১০ সালে) এই যন্ত্রটির উল্লেখ করেছেন লেখক উইলিয়াম গালপিন, বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে। সেখানে তিনি বলছেন ‘We are not left in any doubt as to this peculiarity, for there is still an English Cittern of the early fourteenth century in existence. It is preserved at Warwick Castle, and has been persistently described as a Violin. Tradition says that it was given by Queen Elizabeth to her favourite the Earl of Leicester, and by the kind permission of the Earl and Countess of Warwick we are able to reproduce a photograph of this interesting and valuable relic. এখানে গালপিনের লেখা peculiarity শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনিও মনে হয় এই আজব যন্ত্রের জন্মলগ্নের হিসাব মেলাতে পারছিলেন না।
তাঁর গ্রন্থের ২২ পৃষ্ঠার পাশে সাত নং প্লেটে এই যন্ত্রের একটা ছবি দেওয়া হয়, এবং নিচে নাম হিসেবে লেখা হয় Gittern. এখানে খুব সহজভাবে একটা তথ্য দেওয়া যায় যে, ইউরোপের প্রাচীন বাদ্য গিটার্ন থেকেই আধুনিক গিটারের উৎপত্তি। এখানেই বাধলো গোল! তাহলে আমরা এটা মনে করতে পারি কি যে, এই যন্ত্রটিই গিটারের আদিপুরুষ? এবারের উত্তরেও আপনি একইসাথে ঠিক ও ভুল! কি, গুলিয়ে যাচ্ছে তো? তাহলে গোড়া থেকেই শুরু করি।
ইউরোপের নবজাগরণের আগে যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য বাদ্যযন্ত্র, তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার ছিল একধরনের চারণ কবিদের প্রয়োজনে। সারা ইউরোপেই এমন কবিদের দেখা যায়, যারা নাইটদের বীরত্ব এবং আঞ্চলিক শাসকদের নিয়ে গান বানাতেন। আর তাকে আকর্ষণীয় করতে নতুন বাদ্য যুক্ত করতেন। হয়তো এমন উদাহরণ হিসেবে হীরক রাজার দেশে’তে ‘চরণদাস’ চরিত্রটিকে মনে করতে পারবেন। জার্মানিতে এদের বলা হত মিনেসিঙ্গার, আর পর্তুগালে ত্রুভাদুরিসমো, উত্তর ফ্রান্সে ট্রভৌর ইত্যাদি। এদের সময়কাল মোটামুটি ভাবে ১১০০ থেকে ১৩৫০ এর মধ্যে। এরপর ইউরোপে আসে একের পর এক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টাতে শুরু করে, সামন্ত ব্যবস্থা ভেঙে শক্তিশালী রাজার পুনরুত্থান হয়, বারুদের ব্যবহার শুরু হওয়ায় ক্যাসেলগুলোর আর সেই অভেদ্যতার ক্ষমতা রইল না, প্লেগের মারীতে পশ্চিম ইউরোপ হল ছারখার।
এত কিছুর মধ্যে আসলে যেটা হল, দ্বাদশ শতকে বা তারও আগে (মূলত ক্যারোলিঞ্জিয় র্যেনেশাঁসের সময়ের) যে বাদ্যযন্ত্রগুলি বহুল প্রচলিত ছিল, তার অধিকাংশই ক্রমশ মুছে যেতে লাগল। সেই জায়গায় বাইরে থেকে নতুন বাদ্যযন্ত্র এল, ক্রুসেডের ফলে বহু মানুষ নতুন দেশে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেই দেশের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এলেন আর ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যের প্রসারের কারণে সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিতে নতুন যন্ত্রের আবির্ভাব হল। তাই আগের বাজনার চল গেল থেমে। তাহলে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ শতকে প্রচলিত ও অধুনা লুপ্ত ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে কি করে জানবো? উপায় দুটো, প্রথমটা হল, সেই সময়ের সাহিত্যে তাদের বর্ণনা ও হাতে লেখা বইয়ের ছবি থেকে। এই প্রসঙ্গে সেইরকম একটি কবিতার অংশকে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় –
The moone at night ful clear and brighte schoon
And Absolon his Giterne hath i-take.
এতো হল কবিতার কথা। সেই সময়ের গদ্যের একটা উদাহরণ এক্ষেত্রে বেশ আগ্রহ জাগাতে পারে। Lover’s Melancholy এর দ্বিতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যে এক ভয়ের মুহূর্তে বলা হচ্ছে ‘Barbers shall wear thee on their Citterns.’ এই ধরণের উদাহরণগুলি বাদ্যের প্রচলন সম্বন্ধে জানালেও তার আকার সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট করে না। তাই এর জন্য নির্ভর করতে হবে সেই সময়ের ভাস্কর্যের উপর।
বাদনরতদের মূর্তি থেকে আমরা যন্ত্রের আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করতে পারি। আর সেখানেই বাধলো সমস্যা। এমন হুবহু দেখতে তো কোন বাদ্যযন্ত্র ইউরোপে নেই! বা এর কাছাকাছি থাকলেও তা বাজানো হচ্ছে ধাতব বড় প্লেকটার্ম দিয়ে, সহজ কথায় ধাতুর কাঠি দিয়ে। এবার ধরুন যে বাদ্যে বেহালার মত ছড় টেনে বাজাতে হবে সেটাতে যদি ঢাকের কাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করেন, কি অবস্থা হবে বুঝতেই পারছেন! আকারগত পার্থক্যের খুব স্পষ্ট কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি। যেমন, যন্ত্রটির উপরের তল সমতল নয়। এমনকি f হোল রয়েছে। কিন্তু প্রাচীন জিটার্ন সমতল, তার ঠিক মাঝখানে, ফ্রেডবোর্ড শুরু হবার আগে সাধারণত একটা গোল ছিদ্র থাকে। কখনও কখনও তলার দিকেও দুটো ছোট ছিদ্র থাকে কম্পনরত বাতাসকে বাইরে আনার জন্য, বা সহজ কথায় আওয়াজকে নিপুণ করার জন্য। আজকের অ্যাকুইস্টিক গিটার যেমন হয় আর কি। এছাড়া এই যন্ত্রটিতে যে ব্রিজের ব্যবহার করা হয়েছে তাও কেবল বেহালার মত ছড়ে টানা যন্ত্রের ক্ষেত্রেই চলে, প্লাগড ইনস্ট্রুমেন্টে তো মধুর আওয়াজ আনা সম্ভব নয় (অবশ্য সেযুগে রদ্দুর রায় মহাশয় ছিলেন না বলেই মনে করি!)। এমনকি সিতোল নামে যে ধরণের যন্ত্র ছবি বা ভাস্কর্যে দেখতে পাই, তার দেহ ভিন্ন আকারের। এটা যে আকৃতির তাকে বাদ্য গবেষকরা ‘ভাস সেপ’ বলে উল্লেখ করেন। যদি লক্ষ্য করেন, বেহালার আকৃতিও কিন্তু যথার্থ ভাস সেপ নয়। গালপিন এই গন্ডগোলের কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান দিতে পারেননি, কিন্তু ‘peculiarity’ বুঝতে পেরেছিলেন। (এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানাই, গালপিন সাহেবের সংগ্রহে প্রায় ৫০০-এর বেশি দুর্লভ বাদ্যযন্ত্র ছিল)
তবে সমাধান তো একটা চাই। হয় এটার সাথে হাল আমলের একটি ছড়ি ধরিয়ে দিয়ে এর বয়স ৩০০ বছর কমিয়ে দিয়ে বলতে হবে এটা একদম নতুন যন্ত্র অথবা…। এই দ্বিতীয় সম্ভাবনা ভাবতে লেগে গিয়েছিল প্রায় আরো ৬৭ বছর। বিখ্যাত সুরকার লরেন্স রাইট জানালেন এই যন্ত্রকে কিছুতেই গিটার্ন বলা যায় না। কারণ এর যে পেছনের শক্ত কাঠ, তা কোনভাবেই গিটার এমনকি বেহালা পরিবারের কারোই থাকতে পারে না। কথাটা শুনে টনক নড়লো যাদুঘর কর্তৃপক্ষের। প্রাথমিক অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দিলেন মারি রেমনান্ট ও রিচার্ড মার্ক্সকে। শেষে ১৯৮০ সালে তারা জানালেন এর আসল রহস্য। যন্ত্রটির শরীর ১৩০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। কিন্তু ১৬০০ সাল নাগাদ একে সিতোল থেকে বেহালার রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়। তাই কাঠামো এক আর উপরের নাক, মুখ, চোখ আরেক! বোঝ কান্ড! এ যে ‘বকচ্ছপ’ বাদ্য!
তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন হল, এমনটা করা কেন? সপ্তদশ শতকে যখন এটা সারাই করা হয়, তখন সিটোল বাদক তেমন আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু যন্ত্রটির মধ্যে অসম্ভব সুন্দর খোদাইয়ের কাজের কারণে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। তাই একে যুগোপযোগী করার জন্য এই প্রয়াস হয়ে থাকবে। যাদুঘর কর্তৃপক্ষ কিন্তু এতো সহজে এই ধারণা মেনে নেওয়ার বান্দা নন। তারা ২০০৩ সালে লন্ডনের মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করলেন। সেখানে অনেক গণ্যমান্য বাদ্য বিশেষজ্ঞদের ডাকা হল। কয়েক পিপে নস্যি শেষ করে, অনেক তর্কাতর্কির পর সবাই এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, সেদিন থেকে এই যন্ত্রের পুরোনো ‘জিটার্ন’ নাম সরিয়ে ‘সিতোল’ নামে ডাকা হোক, এবং স্থানান্তরিত করা হোক মিউজিয়ামের মধ্যযুগের কক্ষে।
এই ‘বকচ্ছপ’ যন্ত্রটি শেষে পেল এক নতুন কাচাগার। প্রমাণিত হল, ইতালির ভায়োলা বাদ্যের পরিবারের ‘রক্তে’ ইংল্যান্ডের কোন পূর্বসূরি নেই অর্থাৎ বেহালা ও তার ভাইবোনরা বদনামের হাত থেক রক্ষা পেল! সেই সঙ্গে সাহেবদের কলহ ও জিজ্ঞাসার অবসান হল।
তথ্যসূত্র:
১) Francis William Galpin, Old English Instruments of Music: Their History and Character, Methuen, 1911, page 20 – 36
২) Matthew Spring, The Lute in Britain: A History of the Instrument and Its Music, Oxford University Press, 2001, page-5
৩) https://www.medievalists.net/…/a-musical-instrument…/