সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

শিশুপালগড়

শিশুপালগড়

তুষার মুখার্জী

জানুয়ারি ১৪, ২০২১ ১৫১৮ 21

গোড়ার কথা

প্রথমেই আলোচ্য, শিশুপালগড়ের সাথে মহাভারতের শিশুপালের কোনও সম্পর্ক নেই। শিশুপালগড় ভুবনেশ্বর থেকে আট কিলোমিটার দুরের এক পরিত্যক্ত প্রত্নশহর বা দূর্গশহর। এই প্রত্নশহরটির নামাকরণ হয়েছে পাশের একটি ছোট গ্রাম, শিশুপাল গ্রাম তার নামে। এমন নামাকরণের কারণ, এর আসল নাম আজ আর কারও জানা নেই, তবে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। সম্ভবত এর নাম ছিল কলিঙ্গনগর, অথবা তোশালী। আন্দাজের সূত্র, কাছাকাছি এলাকায় পাওয়া দুটি শিলালিপি।

শিশুপালগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতার পরে পরেই। ১৯৪৮ সালে। এটাই স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রত্ন অনুসন্ধান। প্রথম খননকার্যের দায়িত্বে ছিলেন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বি. বি. লাল। হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলো পরিত্যক্ত হওয়ার পরে ভারতে দীর্ঘকাল নতুন কোনও নগর গঠনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মনে হবে, হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী হাজার বছর গোটা ভারতে সংগঠিত নগরজীবনের ধারণাটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এটা যথেষ্ট বিস্ময়ের। এমনটা হওয়ার কথা নয়।

গোটা পৃথিবীতেই সভ্যতাগুলির উত্থান-পতন হয়েছে। মাঝে বেশ খানিক সময় হয়তো সভ্যতার অগ্রগতি স্তব্ধ থেকেছে, তারপরেই আবার ফিরে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ভারতে মনে হবে সবাই নগরসভ্যতাকে বরাবরের মত বাতিল করে গ্রাম্য জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন। ফলে, হরপ্পা সভ্যতার মতোই একটা কাল্পনিক ধারণার জন্ম হতে থাকে যে, ভারতের দ্বিতীয় নগরায়নও হয়তো কোনও বৈদেশিক জাতির অবদান, যেমন শুরুতে ভাবা হয়েছিল, হরপ্পা সভ্যতা কোনও বহিরাগত জাতির অবদান ছিল। হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রে সে ভুল ভেঙেছে। দ্বিতীয় নগরায়নের ক্ষেত্রেও এমন কল্পনাকে খুব বেশি আমল দেওয়া হয়নি।

এমনটা হওয়ার কথা নয়, তবুও যা হওয়ার কথা নয়, দেখা যাচ্ছিল, তাই ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রত্নবিদরা বুঝতে পারছিলেন, সম্ভবত তাঁরা যথাযথ যোগসূত্র খুঁজে পাননি বলেই ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। দরকার একটি যোগসূত্র খুঁজে বার করা, যাতে গোটা পরিস্থিতি সঠিক ভাবে বোধগম্য হয়। যাতে বোঝা যায়, ভারতে গড়ে ওঠা সভ্যতা প্রকৃতই ভারতীয়। নানা জাতি ভারতে এসেছে। তাদের নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতির ছাপও থেকেছে। তবু শেষ অবধি ভিত্তি ছিল এই ভারতেরই জনসমষ্টির নিজস্ব সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা।

হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলি প্রথম দেখার পরে অতীতের কোনও সূত্র না থাকায় ধরে নেওয়া হয়েছিল, বাইরে থেকে কোনও জাতি এসে শহরগুলি গড়েছে, এবং একসময় তাঁরা সব ছেড়ে নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। নিকটতম সমসাময়িক সভ্যতা মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। মেসোপটেমিয়ার কিশ শহরে পাওয়া গেল হরপ্পা সভ্যতার সিল। ফলে প্রাথমিক একটা ধারণার সৃষ্টি হল, মেসোপটেমিয়ার সুমের জাতিই হরপ্পা সভ্যতারও জনক। হরপ্পা সভ্যতার সময়রেখা স্থির হল মেসোপটেমিয়ার সুমের সভ্যতাকে কাল নির্ণায়ক নিদর্শন হিসাবে।

সে ধারনা যে ভ্রান্ত, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ, দুটো সভ্যতার শহর গঠনশৈলী, মৃৎপাত্রের গড়ন, সিল, সিলের উপরে লেখা— সবই ভিন্ন। তখন প্রশ্ন উঠল, তবে কারা বানালো এই শহর?

পাওয়া গেল কট-ডিজি, আমরির মতো প্রায় শহুরে বসতি, যা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর থেকে খানিক নিকৃষ্ট, কিন্তু গঠনশৈলীর নিকটত্ব অভ্রান্ত। দুই রকমের শহরেই অন্য শহরের সাথে সাংস্কৃতিক বহমানতার ছাপ সুস্পষ্ট। ফলে বোঝা গেল, আগে কট-ডিজি, আমরির মত অনুন্নত শহর গড়ে উঠেছে, তারপরে এসেছে উন্নত শহর হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো। একটা দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতা জানা গেল। কোনও সন্দেহ থাকল না যে, স্থানীয় লোকেরাই ধাপে ধাপে গড়ে তুলেছিল উন্নত হরপ্পা সভ্যতা।

তারপরে পাওয়া গেল মেহেরগড়। জানা গেল, একেবারে নব্য প্রস্তরযুগ থেকে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা একটি সভ্যতার ধারাবাহিক রূপরেখা। ক্রমে জানা গেল, হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতি, যা সিন্ধু নদীর উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিস্তৃতি ছিল একদিকে বর্তমান দিল্লির দোরগোড়া অবধি, অন্যদিকে গোটা সৌরাষ্ট্র এলাকা জুড়ে। স্বীকৃত হল, হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল সমসাময়িক অন্য যে কোনও সভ্যতার থেকে অনেক বেশি।

তারপর? তার আর পর নেই। এক হাজার বছর, কোথাও কিছু নেই। তাই কি?

প্রত্ন বিজ্ঞানীরা ভাবতে বসলেন, পরবর্তী কালের শহরগুলির যেগুলিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ন বলা হয়, তার সাথে হরপ্পার সভ্যতার একটা যোগসূত্র পাওয়া খুব দরকার। তবেই আবার ধাপে ধাপে পরিবর্তনের রূপরেখা বোধগম্য হবে। সেটা পেতে গেলে হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রে যেমন ধাপে ধাপে পেছনের সময়টাকে ধরা গিয়েছিল, ধারাবাহিকতা জানা গিয়েছিল; এবারও সেই ভাবেই সম্ভব হবে। তার জন্য সবচেয়ে আদর্শ পরিস্থিতি হতে পারে, দ্বিতীয় নগরায়নের একটি নগরের একদম নিচের কালস্তরে হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক আরেকটি নগর বসতি অথবা হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রত্নসামগ্রী পাওয়া।

তবে তেমন আদর্শ প্রত্নক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই ক্ষীণ। তাই হরপ্পা সভ্যতায় যেমন পাওয়া গিয়েছিল, কিছু দুরে দুরে অথচ ধারাবাহিকতার সুস্পষ্ট চিহ্ন-সহ প্রত্নক্ষেত্র, তেমন পেলেও যোগসূত্র বোঝা সহজ হবে। বোঝা যাবে, কেমন ছিল মাঝখানের হাজার বছর। সেই খোঁজের জন্য আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটি প্রকল্প হাতে নেয়, যার পরিকল্পনা ও রূপায়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মর্টিমার হুইলার। মর্টিমার হুইলারের প্রকল্প শুধু হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে যোগসূত্র খোঁজাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না (যেমনটা এখন আমাদের নজরে আসে। যে কোন প্রত্নক্ষেত্রের সাথে হরপ্পা সভ্যতার একটা যোগসূত্র থাকা যেন অতি আবশ্যিক হয়ে পড়েছে)। মর্টিমার হুইলারের ধারণায় ছিল গোটা ভারতের, প্রত্ন ভারতের, ভারতীয়ত্ব খুঁজে বের করা। ভারতীয় প্রত্নযুগের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া। তার জন্য সবার আগে দরকার, ভারতজুড়ে প্রত্নযুগের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র। প্রাচীন কাল থেকে ইতিহাসের কাল অবধি।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে হরপ্পার পরবর্তী কালের খোঁজে তক্ষশীলা, চারসাদা এইসব এলাকায় খননে পাওয়া গেল, ৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এখানে পাওয়া পারসিক সাম্রাজ্যের আমলের ও পরবর্তী গ্রিক আমলের একাধিক শহরের অস্তিত্ব জানা গেল। সেই এলাকাগুলিতে আরও খননে তার সাথে হরপ্পা সভ্যতা আমলের বহমান সাংস্কৃতিক যোগসূত্র পাওয়া সম্ভব, তেমন আভাস এই প্রত্নক্ষেত্রগুলোতে ছিলই। কিন্তু স্বাধীনতা ও দেশভাগ সেই সুযোগ আর দিল না।

মর্টিমার হুইলারের আরেকটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল দক্ষিণ ভারতের প্রত্ন ইতিহাস অনুসন্ধান করা। কারণ, হরপ্পা সভ্যতা, পারসিক সাম্রাজ্য, গ্রিক আক্রমণ, মৌর্য সাম্রাজ্য উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারতের একটি সামগ্রিক ধারাবাহিক রূপরেখা বুঝতে অনেকটা সাহায্য করেছে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের প্রায় কিছুই জানা ছিল না, জানা ছিল না মধ্যগঙ্গা এলাকার ইতিকথাও। (না, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনও জায়গা মর্টিমারের ধারাবাহিকতার মানসচিত্রে বা পরিকল্পনায় ছিল না।)

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতে প্রত্ন অনুসন্ধানের যে রূপরেখা মর্টিমারের ভাবনায় ছিল, তা লিখিত রূপ পেল আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার Ancient India,( Jan.1949)-তে। সে পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় সংগঠিত। যেমন, তিনি সেই পরিকল্পনায় লিখেছিলেন, প্রত্নবিদদের প্রতি বছর বিগত বছরের কাজের খুঁটিনাটি বিবরণ লিখতেই হবে, বাধ্যতামূলক ভাবে। দরকার হলে কাজ এক বৎসর বন্ধ থাকুক, কিন্তু রিপোর্ট আগে। প্রত্নবিদদের মনে রাখতে হবে, তার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পত্র লেখা ও প্রকাশ করা শুধু কর্তব্য নয়, তার ব্যক্তি জীবনের সাফল্যের খতিয়ান। প্রতিটি প্রকাশিত লেখা প্রত্নবিজ্ঞানকেই সমৃদ্ধতর করবে। গড়ে উঠবে সুসংবদ্ধ প্রত্নভারতের মানচিত্র।

ব্রিটিশ ভারতে পাঁচশোর বেশি দেশিয় রাজ্য ছিল। এরা ছিল নানা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাধীন, তাই সেগুলোতে প্রত্ন অনুসন্ধানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কিছু আইনগত সমস্যাও ছিল। কিছু রাজ্যের প্রগতিশীল রাজারা প্রত্ন অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিলেন, তবে বেশিরভাগ রাজারাই কোনও আগ্রহ দেখাননি। অনেক প্রগতিশীল রাজা নিজেদের উদ্যোগে কিছু কাজও করেছেন, কিন্তু পুরোটাই খাপছাড়া, এলোমেলো। স্বাধীনতার পরে এই সমস্যা নিয়ে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তাতে স্থির হল, সমগ্র ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন এলাকার দায়িত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় সংস্থা আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। শুধু আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন কোনও স্থানীয় বিখ্যাত মনীষা, বা উৎসব, প্রথা, এমন সব, যা স্থানীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সর্বভারতীয় স্তরে গুরুত্ব নেই, সেগুলি রাজ্যস্তরের প্রত্ন বিভাগের অধীনে থাকবে।

মর্টিমারের দক্ষিণ ভারতের প্রত্নকাল খোঁজার পথে প্রথম নজরে আসে ফরাসি শাসনাধীন পণ্ডিচেরীর প্রত্নক্ষেত্র আরিকামেদু-তে পাওয়া কিছু রোমান মুদ্রা। এই মুদ্রা ওই প্রত্নক্ষেত্রের জন্য তার সময়কাল নির্দিষ্ট করতে প্রাথমিক ভাবে সাহায্য করলো। এরপর প্রত্নবিদরা গোটা দক্ষিণ ভারত ঘুরে রোমান মুদ্রা সংগ্রহ করতে লেগে পড়লেন। ফলে, অনেক এলাকার একটা আনুমানিক সময় বোধও তৈরি হল। তবে প্রত্ন সমীক্ষার ধারাবাহিকতার উদ্দিষ্ট কাল নির্ণয়ে তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারলো না।

১৯৪৪ সালে মর্টিমার হুইলার তৎকালীন মাদ্রাজ সংগ্রহালয়ে দেখতে পেলেন একটি ভগ্ন অ্যামফোরা (জলের কুঁজোর মত লম্বা সরু গলা, গলার কাছে দুটো হাতল, পেটমোটা, তলার দিকে ক্রমে সরু)। এটি সাধারণ অব্দের শুরুর দিকের (এখন থেকে ২০০০ বছর আগের) গ্রিক-রোমান মৃৎপাত্রের অভ্রান্ত নমুনা। এটিও পাওয়া গেছে পণ্ডিচেরীর সমুদ্র উপকুলের প্রত্নক্ষেত্র আরকিমেদু-তে। অতএব ওই এলাকার বয়স নির্ধারণে আর কোনও অসুবিধা থাকলো না। আরকিমেদু এখন হয়ে গেল গোটা দক্ষিণ ভারতের প্রত্ন সময়কাল নির্ণয়ের উল্লেখ্য বিন্দু। আরকিমেদুতে পাওয়া গেল আরেক ধরণের গোলাকার পাত্র, যাতে কেন্দ্রাভিমুখী বৃত্তাকার নকশা ছিল। এগুলি ভারতীয় নক্সার নয়। এগুলি ৪৫ সাধারণ অব্দের ইটালির আর্রেটিন মৃৎপাত্র।

এই আর্রেটিন মৃৎপাত্র পাওয়া গেল দক্ষিণ ভারতের ব্রহ্মগিরি, মাস্কি, কোণ্ডাগিরি, চন্দ্রাবলী প্রত্নক্ষেত্রেও। চন্দ্রাবলীতে প্রথম শতাব্দীর রোমান মুদ্রাও পাওয়া গেল। আর্রেটিন মৃৎপাত্র বাদেও লালচে বাদামী রঙের মৃতপাত্র পাওয়া গেল এই সব এলাকায়, এবং তা নিঃসন্দেহে স্থানীয়। এগুলোর সাথে ব্রহ্মগিরিতে সম্রাট অশোকের শিলালিপি পাওয়াতে এবার একত্রে সবকটি প্রত্নক্ষেত্রের কাল নির্ণয় সহজ হয়ে গেল। ব্রহ্মগিরিতে এছাড়াও পাওয়া গেল হলদে রঙ করা মৃৎপাত্র। আর পাওয়া গেল বাদামী-কালো মৃৎপাত্র। সব মিলিয়ে দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির একটা আভাস তৈরি হল।

ব্রহ্মগিরিতে পাওয়া কবরের মেগালিথ ধরে সময় নির্ণয় হল এখন থেকে ২২০০ বৎসর আগের। এর নিচে পাওয়া গেল পাথরের নানা হাতিয়ার-সরঞ্জাম। সাথে পাওয়া গেল তামা আর ব্রোঞ্জের নমুনা। এটা (তখন অবধি) দক্ষিণ ভারতে ব্রোঞ্জ যুগের অস্তিত্বের প্রথম নিদর্শন। প্রস্তর যুগের সরঞ্জাম পাওয়াতে বোঝা গেল, দক্ষিণ ভারতে ২০০ সাধারণ পূর্বাব্দেও প্রস্তরযুগের হাতিয়ারের কদর ছিল। এবার পণ্ডিচেরীর আরিকামেদু থেকে প্রায় সাড়ে ছয়শো কিলোমিটার দক্ষিণের সাথে একটা সাংস্কৃতিক যোগসূত্র পাওয়ে গেল।

এর পরে পূর্বদিকে অন্ধ্রের গুন্টুর জেলার অমরাবতী। এখানেও পাওয়া প্রত্নদ্রব্য প্রমাণ করল– অমরাবতী, আরিকামেদু, ব্রহ্মগিরি সবই এক সংস্কৃতির ধারক। কিন্তু অমরাবতীর সামগ্রীতে অন্ধ্র সংস্কৃতির থেকে কিছু আলাদা নিদর্শনও ছিল। ফলে অনুমান হল, এখান থেকে পূর্বে ক্রমে ভিন্ন সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যেতেও পারে। এই ভিন্নতা হবে আচমকা নয়, ক্রমান্বয়ে। ফলে ভিন্নতার মধ্যেও ধারাবাহিকতা থাকার সম্ভাবনা থাকবে।

এর আরেকটু পূর্বে উড়িষ্যার শিশুপালগড়। শিশুপালগড় উৎখননে ব্রিটিশ মর্টিমার হুইলার অনুপস্থিত। তিনি নিজের দেশে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু মর্টিমার হুইলার কি আশা করেছিলেন, বা কেন নির্বাচন করেছিলেন শিশুপালগড়, খনন কাজ চালানোর জন্য?

মর্টিমার হুইলার নিশ্চিত ছিলেন, সমুদ্রোপকূলের রোমান বাণিজ্যের প্রভাব মুক্ত শিশুপালগড় ভিন্ন সংস্কৃতির বাহক। কতটা ভিন্ন? দক্ষিণের অন্ধ্র সংস্কৃতি অমরাবতীতেই ক্ষীণ ছিল, ফলে অমরাবতী থেকে ৬৪০ কিলোমিটার দুরের শিশুপালগড়ে সে প্রভাব হয়তো থাকবেই না। বরং অমরাবতী আর শিশুপালগড় দুয়ে মিলে এখনও অজানা পূর্বভারতীয় সংস্কৃতির একটা আভাস দিতে পারে।

শিশুপালগড় পশ্চিমের প্রবেশ পথের চিত্র


শিশুপালগড়

ভুবনেশ্বর থেকে আনুমানিক ১০.৬ কিলোমিটার দুরে প্রাচীর ও পরিখা ঘেরা এই ২০,০০০ বাসিন্দার নগরটি ছিল সম্ভবত কোনও রাজধানী শহর। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে তৈরি হয় এক শিব মন্দির। তারপরেই লোক এই শহর ছেড়ে সম্ভবত সেই মন্দিরের কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করেন। অনুমান করা যেতে পারে, শহরের নাগরিকরা শহর ছেড়েছে ধর্মীয় আবেগে। একটু একটু করে শহর জনহীন হয়ে গিয়েছিল।

এই শিশুপালগড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে ধৌলি পাহাড়ে ছিল সম্রাট অশোকের শিলালিপি। সেই শিলালিপিতে উদ্দিষ্ট রাজকীয় কর্মচারীরা হলেন তোশালির মহামাত্রগণ। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, শিশুপালগড়ই তোশালী। অথবা কাছেই তোশালী নামে আরেকটি নগর ছিল। তবে, ধৌলি পাহাড়ের কাছে অন্তত দুটি জনবসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। যদিও খনন করা হয়নি, তবু সম্ভাবনা থাকছে সেগুলি তোশালী হলেও হতে পারে।

হাতিগুম্ফা লিপি

আবার শিশুপালগড় থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে উদয়গিরি খণ্ডগিরি। এখানে আছে একাধিক গুহা। তার মধ্যে একটির নাম হাতিগুম্ফা। এই হাতিগুম্ফায় আছে রাজা খারবেলের শিলালিপি। রাজা খারবেল (আনুমানিক ১৩২ সাধারণ পূর্বাব্দ) সবচেয়ে শক্তিশালী কলিঙ্গরাজ। তাঁর শিলালিপিতে শহর ও পরিখা সংস্কারের জন্য বহু লক্ষ মুদ্রা খরচের কথা বলা আছে। বলা আছে, পরিখাটি বিগত তিনশ বছর সংস্কার হয়নি। এছাড়া লেখা আছে, রাজা নগরীর প্রাচীর সংস্কার করেছেন এবং তার প্রবেশদ্বারও সংস্কার করেছেন। শিশুপালগড়ের খনন কালে বোঝা গেছে, শহরের প্রাচীর সংস্কার হয়েছিল এবং একটি প্রবেশদ্বারও বিশেষভাবে সংস্কার করা হয়েছিল।

যদিও হাতিগুম্ফার শিলালিপিতে বলা কলিঙ্গনগরী কোথায়, কাছে না দুরে, তেমন কোনও কিছুই বোঝা যায় না; তবু এটাও ঠিক যে, হাতিগুম্ফার ধারে কাছে আর কোনও প্রাচীর ঘেরা নগরী নেই। তাছাড়া, ঐ সংস্কার কাজের চিহ্নও বলে এই শহরটিই রাজা খারবেলের কলিঙ্গনগরী হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।

শিশুপালগড়ে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কাজ করেছে ১৯৪৮ আর ১৯৫০ সালে। স্বাধীন ভারতের প্রথম আর্কিওলজির কাজ। নেতৃত্বে ছিলেন বি. বি. লাল। ওনার সঙ্গে ছিলেন, ডক্টর ও. আই. ডি. শর্মা, বি. কে. থাপার, এন. আর. ব্যানার্জী, আর. সি. কর, কে. ভি. সুন্দররাজন ছাড়াও ৪০ জন আর্কিওলজির ছাত্র, আর উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রভাষক। তারপরে আবার ১৯৯১ সালে কাজ হয় কিছুটা। মূলত গাছপালা নিয়ে।

এরপরে ২০০২, ২০০৩, ২০০৫ সালে এম. এল. স্মিথ ও আর. কে. মোহান্তির নেতৃত্বে জরিপ আর উপর উপর কিছু প্রত্ন সংগ্রহে ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি আর পুনের ডেকান কলেজ। তারপরে, এরাই আবার ২০০৫ থেকে ২০০৯ অবধি নতুন করে জরীপ আর বেশ কিছুটা খননের কাজ করেন। এই প্রত্ন গবেষণায় যুক্ত ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, ডেকান কলেজ পুনে, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এর জন্য অর্থের যোগান দিয়েছে ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন (আমেরিকা), অ্যাকাডেমিক সিনেট – ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যানথ্রপলোজি অ্যান্ড কটসেন ইনষ্টিটিউট, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি এবং অ্যাহামসন ফাউন্ডেশন।

বি. বি. লালের সময়ে শিশুপালগড় প্রত্নক্ষেত্রকে চারটি কালস্তরে ভাগ করা হয়েছিল।

  • কালস্তর ১ – প্রারম্ভিক কাল, সাধারণ পূর্বাব্দ ৩০০ থেকে ২০০
  • কালস্তর ২ ক – প্রারম্ভিক মধ্যকাল, সাধারণ পূর্বাব্দ ২০০ থেকে ১০০ সাধারণাব্দ
  • কালস্তর ২ খ – অন্তিম মধ্যকাল, সাধারণাব্দ ১০০ থেকে ২০০ 
  • কালস্তর ৩ – অন্তিম কাল, সাধরণাব্দ ২০০ থেকে ৩৫০

এম. এল. স্মিথ এবং আর. কে. মোহান্তির নেতৃত্বে ২০০২ থেকে ২০০৯ অবধি কাজের পর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ডেকান কলেজ পুনে কালস্তর নির্ণয় করে কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে। এবার সময়কাল পাওয়া গেল সরাসরি কিছুটা ঘনবসতির অস্তিত্ব ৫০০ -৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ, আর এলাকার সামগ্রিক সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের কাল ৭০০ থেকে ৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।

প্রশ্ন উঠবে, বি. বি. লাল যেখানে প্রাথমিক স্তরকে ৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ ধরেছেন, সেখানে স্মিথ-মোহান্তি সেটাকে কি করে ৭০০ সাধারণ পূর্বাব্দ বলছেন? এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, বি. বি. লাল কার্বন ডেটিং-এর সুযোগ পাননি। কারণ, তখন সে সুবিধা ছিলই না। তাঁর সময়ের হিসেব অনেকটাই আনুমানিক। সাধারণত মৃৎপাত্রের রঙ, গড়ন, নক্সা– এই সবই ছিল সেই ধারণার ভিত। বি. বি. লাল লিখেই গেছেন যে, তিনি সময়ের ব্যাপারে একটু সাবধান থেকেই বলছেন, আরেকটু প্রাচীন হতেই পারে। কাজেই বি. বি. লাল ভুল করেছিলেন এমন নয়, আসলে উনি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য পাননি।

বি. বি. লাল যেমন দেখেছিলেন, শিশুপালগড় এখন আর তেমন নেই। প্রত্ন এলাকাটি অযত্নে অবহেলায় ঘাসজঙ্গলে ভরা। বি. বি. লাল দেখেছিলেন প্রায় বর্গাকার আকৃতির শহরটি, একেবারে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিক ঠিক রেখে গড়া। চতুর্ভুজের একেকটি বাহু প্রায় এক কিলোমিটার। চারদিকের দেওয়াল তখনও জমি থেকে ২৫-৩০ ফুট উঁচু। এই দেওয়ালের নিচের দিক মাটির হলেও উপরের অংশ ছিল ইটের।

চারদিকের দেওয়ালেই শহরে প্রবেশের দুটো করে চওড়া দরজা। বড় দরজা ছাড়াও চারদিকেই ছোট দরজাও ছিল। চতুর্ভুজের চার কোণে নজরদারি টাওয়ার। একটি বাদে সবকটি টাওয়ার ধ্বসে গেছে। যেটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি মাটির তৈরি। যদিও ভেতরে রাস্তা সেভাবে বোঝা যাচ্ছিল না, তবু সহজেই অনুমান করা যায়, চওড়া দরজা থেকে চওড়া রাস্তা চলে গিয়েছিল ভেতরে।

শহরের প্রতিরক্ষা দেওয়ালের নিচে খনন করেই বি বি লাল শহরের বয়স বলেছিলেন। পরবর্তী কালে স্মিথ-মোহান্তি একই দেওয়ালের নিচে আরও গভীরে খনন করেন। একেবারে অব্যবহৃত মাটির স্তর অবধি। সেখানেই নিম্নতম স্তরের থেকে পাওয়া নমুনার কার্বন ডেটিং করে জানতে পারেন, দেওয়ালে ভিতই তৈরি হয়েছিল ৫০০ থেকে ৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দে। ভিতের নিচেও ছিল জনবসতির চিহ্ন। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও রাজধানী নগরী ফাঁকা মাঠে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কিছুটা কমই থাকে। কারণ, আর কিছু না হোক, নগরী গড়ার জন্য শ্রমিকের জোগান তো চাই। আর, লোকজন বসতি না থাকলে সেটি হবে ঘন বন। বন কেটে শহর গড়ার ঝামেলা ও খরচ অনেক বেশি।

নগরীর দেওয়াল এই আগেকার জনবসতির উপরের জনবসতিকে বরাবরের জন্য দুই ভাগে ভাগ করে দেবে। সৃষ্টি হবে দুই ধরণের নাগরিক। নগরীর ভিতরের আর বাইরের বাসিন্দা। নগরীর ভেতরে সবার ঠাঁই হওয়ার কথা নয়। ফলে নগরীর বাইরের বসতিও উবে যাবে না। যায়ও নি। অনুমান, নগরীর ভিতরে ব্যবসায়ী বা বহিরাগতদের ঠাঁই হতো না। তাদের বাইরেই থাকতে হতো। আর, তাদের নিত্য যাতায়াতের জন্যই গড়া হয়েছিল ছোট ছোট দরজা।


নগরীর দেওয়ালের বাইরে দিয়ে ছিল পরিখা। অনুমান, একটি ছোট নদী ছিলই। সেই নদীকেই চারদিকে খাত কেটে নগরীর চারপাশে জলপূর্ণ পরিখার সৃষ্টি করা হয়। বি. বি. লালের খননকালে বোঝা গেল, এখানে বসতি ছিল পূর্বাব্দের তৃতীয় শতকের প্রথম থেকে সাধারণাব্দের চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি অবধি। এই পুরো সময় একই সংস্কৃতির লোকেরাই বসবাস করতো। যদিও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছিল স্বাভাবিক ভাবেই, তবু তা ছিল একই সংস্কৃতির। যেমন, একেবারে গোড়াতে ছিল মসৃণ লাল রঙের মৃৎপাত্র, শেষ দিকে তা হয়ে যায় গেরুয়া রঙের কোনওমতে বানানো মৃৎপাত্র। সময়ের তালে তালে কোনও কোনও ধরণের পাত্রের ব্যবহার বাতিল হয়েছে, বদলে এসেছে নতুন ধরনের পাত্র।

বি. বি. লালের মতে, নগরীর প্রতিরক্ষা দেওয়াল তৈরি শুরু হয় সাধারণ পূর্বাব্দের দ্বিতীয় শতকের শুরুতে। প্রথম দিকে দেওয়াল ছিল মাটির, ২৫ ফুট উঁচু আর ১১০ ফুট চওড়া। দ্বিতীয় পর্বে এই দেওয়ালের উপর দিকে, ৪ থেকে ৬ ফুট, ল্যাটেরাইট নুড়ি পাথর মাটির সঙ্গে মিলিয়ে যোগ করা হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে মাটির দেওয়ালে বাইরে আর ভেতরের দিকে পোড়া মাটির ইটের আস্তরণ দেওয়া হয়। এই দেওয়াল অটুট ছিল শহর জনশূন্য হওয়ার পরেও।

২৫ ফুট চওড়া প্রবেশদ্বার ছিল সযত্নে কাটা ল্যাটেরাইট পাথরের বড় বড় টুকরো বসিয়ে বানানো। একটি প্রবেশ দ্বারের পাশে দ্বাররক্ষীর ঘরও ছিল। সম্ভবত, ব্যবসায়ীদের পণ্যের উপর ধার্য কর আদায়ের জন্য।

দুর্গনগরীর ভেতরে বসবাস এলাকায়ও খনন করা হয়। বেশিরভাগ এলাকায় ১৪.৫ ফুট গভীরে নিচ থেকে জল ওঠে। এক জায়গায় ২৪ ফুট গভীর খনন হয়। খননের জায়গাগুলিতে দেখা গেছে, কালের পরিবর্তনের সঙ্গে জনবসতির শৈশব, যৌবন থেকে বার্ধক্যের অবক্ষয়ের ছাপ। সব মিলিয়ে একটি ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন বসবাসের বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না।

কালস্তর ১ প্রারম্ভিক কাল – সাধারণ পূর্বাব্দ ৩০০ থেকে ২০০ (বি. বি. লাল), সাধারণ পূর্বাব্দ ৭০০-৬০০ (স্মিথ ও মোহান্তি, কার্বন ডেটিং)

এই স্তরে মৃৎপাত্র ঘূর্ণিচাকে বানানো, তবে সাদামাটা কোনও অলংকরণ নেই। রঙ হাল্কা ধুসর থেকে টেরাকোটা লাল। এই স্তরে বসবাসের ঘরের কোনও ভিত না পাওয়ায় অনুমান কাঠের বাড়িই ছিল। তবে, এই স্তরে খুব চওড়া খনন হয়নি বলে বসবাসের ঘর নিয়ে নির্দিষ্টভাবে সঠিক কথা বলা কঠিন ছিল। ওই স্তরে প্রতিরক্ষা দেওয়াল তৈরি হয়নি।

কালস্তর ২ ক – প্রারম্ভিক মধ্যকাল, সাধারণ পূর্বাব্দ ২০০ থেকে ১০০ সাধারণাব্দ (বি. বি. লাল),  সাধারণ পূর্বাব্দ ৫০০ (স্মিথ ও মোহান্তি, কার্বন ডেটিং)

এই স্তরে শিশুপালগড়ের মৃৎপাত্র অনেক উন্নত। ঘূর্ণিচাকে বানানো মসৃণ, সঠিক মাত্রায় পোড়ানো পাত্রের গায়ে রঙিন বা খোদাই করা নানা নক্সা। মৃৎপাত্রের আকারেও অনেক বৈচিত্র্য এসে গেছে। মেগালিথ সংস্কৃতির লাল কালো নক্সার পাত্রও দেখা গেছে কিছু। এই স্তরের উপরের দিকে টেরাকোটার কানের গয়না, আগাটে, কার্নেলিয়ান, কোয়ার্টজের মত মূল্যবান পাথরের পুঁতি সহ পাওয়া গেছে লোহার নানা উপকরণ।

এই স্তরে ঘরের ভিত বানানো হচ্ছিল ছেনিতে কাটা ল্যাটেরাইট পাথরের চাঁই দিয়ে। তবে খুব সরু করে খনন করার জন্য ঘরের গঠন বা আয়তন বোঝার কোনও উপায় ছিল না। আর পাওয়া গেছে দেড় ফুট ব্যাসের পোড়া মাটির কুয়ার রিঙ। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, এই স্তরেই নগরীর প্রতিরক্ষা দেওয়াল তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল।

কালস্তর ২খ -অন্তিম মধ্যকাল, সাধারণাব্দ ১০০ থেকে ২০০

এই পর্যায়ে নগরের উন্নতির চরম পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমাবনতিরও লক্ষণ দেখা গেল। মাটির বাসন আগের উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। ওজনে হাল্কা, নক্সায় বৈচিত্র্য কম। রঙ আগেকার লালের বদলে অনেক সময়ই গেরুয়া। উল্লেখ্য, এই স্তরে খুব সামান্য কয়েকটি উত্তর ভারতীয় গঙ্গা অববাহিকার উজ্জ্বল কালো মৃৎপাত্রও দেখা গেল। এই স্তরে আমাদের দেখা কেটলির মত হাতল লাগানো ঢাকনাওয়ালা পাত্রও পাওয়া গেছে।

এই স্তরে যথারীতি টেরাকোটার কানের দুল ছাড়াও ছিল টেরাকোটার বোতাম আর কাঁচের চুড়ি। (কাঁচের পুঁতি সাধারন পূর্বাব্দের পঞ্চম শতাব্দীতেই পাঞ্জাবে ছিল) লোহার সরঞ্জাম নিচের স্তর থেকেই ছিল। টেরাকোটার বোতামের উপর নক্সা থাকত পশুর বা মানুষের মুখ। তবে ধারণা করা হয়, মানুষের মুখের ক্ষেত্রে রোমান মুদ্রার নক্সা থেকে নকল করা।

কালস্তর-৩  অন্তিম কাল, সাধরণাব্দ ২০০ থেকে ৩৫০

এই স্তরে মৃৎপাত্রের রঙ গেরুয়া রঙে চোবানো। তবে রঙের বদল সংস্কৃতির বদল হয়নি। কারণ, রঙ বদলালেও বাসনের গড়ন, নক্সা এইসবে বিশেষ কোনও বদল হয়নি। বোতাম, কানের দুল এই সব আগের মতই ছিল।

শিশুপালড়ের মানচিত্র

নিচের দিকে সরু খোঁড়া হলেও উপরের দিকে এই স্তরে চওড়া করেই খোঁড়া হয়েছিল। ফলে ঘরের গঠন বোঝা গেল। দুটো ল্যাটেরাইট পাথরের বাড়ির মাঝখানে ছিল দুই ফুট ফারাক। এই রকমের ফারাক রেখে বাড়ি দেখা গেছে তক্ষশীলাতেও।

এক কামরার ঘর ছাড়া দুই কামরার ঘরও ছিল শিশুপালগড়ে। ৮X৯ ফুট, ১০X৯ ফুট দুই কামরা সামনে বারান্দা ৩৩X২৫ফুট। পোড়া ইটের ঘরও ছিল। আর পাওয়া যায়, ঢালাই করার ছাঁচে টেরাকোটা কয়েন (মুদ্রা)।

শিশুপালগড়ে আরও নানা কয়েন পাওয়া গেছে। উল্লেখযোগ্য হল, হুবিস্কের তামার কয়েন আর সোনার কয়েন – যার এক পিঠ কুষাণ অন্য পিঠ রোমান। এছাড়াও পাওয়া গেছে নানা রকমের গোল ও চৌকো তামার কয়েন। (সাধারণাব্দ ১০০ থেকে ২০০) তিনটি কয়েনে পাঞ্চ করা ছিল এরান (মধ্যপ্রদেশ), চৌকো সীসার কয়েন (২০০ থেকে ৩৫০ সাধারণাব্দ) এবং সোনার কয়েন।

বোঝা গেল, শেষের দিকে সীসার কয়েনই বেশি ব্যবহার হতো। অবশ্য শুধু এখানেই না, সম্বলপুরেও সীসার কয়েন পাওয়া গেছে। কারণটা সম্ভবত, ঐ এলাকায় সহজে খনিজ সীসা পাওয়া যেতো।

শিশুপালগড়ের প্রতিরক্ষা দেওয়াল বেশ নজরকাড়া। এই দেওয়াল তৈরি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেখানে লোকবসতি ছিল। পাঁচ ফুট গভীর জনবসতি স্তরের উপরে গড়া হয়েছিল এই দেওয়াল। দেওয়ালের আঠালো মাটি কাটা হয়েছিল দেওয়ালেরই পাশ থেকে। ফলে, মাটি বাইরে থেকে আনার খরচ ও সময়, দুই-ই বেঁচে গেল। লাভ হল, দেওয়ালের ধার ঘিরে প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর হিসাবে চারদিকেই পরিখা। এবার সেই পরিখার সাথে নদীকে জুড়ে দেওয়া তো সহজ কাজ।

দেওয়ালের উপরের দিকে ছিল কিছু রহস্যময় ফুটো। দুই ফুট দুরে দুরে ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ফুটোগুলো একফুট গভীর, ল্যাটেরাইট নুড়ি পাথর দিয়ে জ্যাম করা, বাইরের দিকে আবার যথারীতি মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া। এর প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়নি।

সাধারণ জনবসতির মধ্যে হঠাৎ কেন এমন বিশাল দেওয়াল তৈরির দরকার পড়ল, সেটাও বোঝা যায়নি। তবে অনুমান করা যেতেই পারে, যে রাজশক্তি এই নগরদুর্গ গড়েছিল, তা স্থানীয় ছিল না। এমনটা ভাবার কারণ, দেওয়ালের নিচের মৃৎপাত্র লাল রঙের। আর দেওয়াল তৈরি হওয়ার স্তরে এসে গেলো লাল-কালো মৃৎপাত্র। এই লাল কালো মৃৎপাত্রকে দক্ষিণ ভারতে মেগালিথ কালের বলে ধরা হয়।

ফলে একটা ধারণা হতে পারে যে, রাজবংশটি এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকে। প্রসঙ্গত, রাজা খারবেল-এর শিলালিপিতে ‘চেটি’ শব্দ থেকে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় অনুমান করেন, এই বংশ ছিল দক্ষিণ ভারতের চেদী রাজবংশের অংশ। তবে অনেকেই এই মত সমর্থন করেন না। আরেকদল বলেন, খারবেল শব্দটিই তো দ্রাবিড় শব্দ। তাতেও অবশ্য অনেকের আপত্তি।

প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মাঝে প্রবেশ দ্বার। প্রবেশদ্বারটি খুব ভেবে চিন্তে যত্ন করে বানানো। কয়েকবার সারাইও করা হয়েছে। এই প্রবেশদ্বার দিয়ে যানবাহন শহরের ভিতরে প্রবেশ করতো। যানের চাকার তেমনই দাগ পাওয়া গেছে। দুই চাকার মাঝখানের ফাঁক ছিল ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি।

গড়ের পশ্চিমের দরজার রেখাচিত্র

দেওয়ালে শত্রু আক্রমণের চিহ্ন নেই। তবে, এক জায়গায় দেওয়ালের অনেকটা আচমকা ধ্বসে যাবার চিহ্ন আছে। সেই ধ্বস আর তার পরের সারাই কাজের ধরণ দেখে অনুমান করা হয়, এর জন্য দায়ী উড়িষ্যায় মাঝে মাঝে আসা কোনও ভয়াবহ সাইক্লোন।

তবে এই প্রাচীন শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মাঝের প্রবেশদ্বার যেমন তাদের স্থাপত্য  কাজের নিপুণতার চিহ্ন, তেমনি চমক লাগা স্থাপত্যের চিহ্ন হল ১৬টি পাথরের স্তম্ভ। স্তম্ভগুলি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। একসারিতে আটটি আর দুটো সারিতে চারটি করে আরও আটটি স্তম্ভ। মাঝখানের ৮০ X ৯০ফুট এলাকা খোঁড়া হয়নি। খুঁড়লে হয়তো আরও স্তম্ভের চিহ্ন পাওয়া যেতো।

এক একটি স্তম্ভ মাটির উপর ১৪-১৫ ফুট খাড়া উঁচু। এগুলির কম করেও তিন চারফুট মাটির নিচে থাকার কথা। স্তম্ভের উপরদিকে চৌকো, সাথে খাঁজকাটা। খাঁজগুলো কাঠের বিম ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত। স্তম্ভের গায়ে কিছুটা কারুকাজও আছে। বি. বি. লাল জানাচ্ছেন, এই কারুকাজ যেমন সাঁচি বৌদ্ধ স্তূপের সাথে মেলে, তেমনই উদয়গিরি খণ্ডগিরি শিল্পের ছাপও আছে। বি বি লাল এই স্তম্ভ ঘেরা এলাকায় খননকাজ চালাননি, মূলত অর্থের অভাবে।

শেষের কথা ১

মর্টিমার হুইলারের লক্ষ্য ছিল সমগ্র দক্ষিণ ভারতের একটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা ও তার সময় নির্ধারণ। যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর ভারতের প্রত্ন ইতিহাস অনেকটাই জানা গেছে, এবার দক্ষিণ ভারতেরটা জুড়লে ফাঁক থাকবে শুধু মধ্যগঙ্গা এলাকা। এটুকু হলেই গোটা ভারতের প্রত্ন সংস্কৃতির ইতিহাস বলার জায়গায় আসা সম্ভব হবে।

তাঁর পরিকল্পনায় পূর্ব ভারতের কোনও ঠাঁই ছিল না। সামগ্রিকভাবে এখনও সম্ভবত নেই। কারণ, একটা প্রচলিত ধারনা যে, পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের প্রকৃত প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নযুগের ধারাবাহিক সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। এখানে ওখানে দুই একটা পেলে তাকে ব্যতিক্রম ভাবা হয়। আর উত্তর-পূর্ব ভারতকে ধরে নেওয়া হয়, খুব বেশি হলে দেড় বা টেনেটুনে দুই হাজার বছর আগের। যদিও ইদানীং উত্তর-পূর্ব ভারতে স্থানীয় চেষ্টায় সেটাকে চার হাজার বছর আগের বলে প্রমাণ করা গেছে, তবে সেটা মুল ভারতীয় প্রত্ন ভাবনায় এখনও গুরুত্ব পায় নি। ছুটকো ঘটনা বলে ছাড়া আছে। বাংলায় পাণ্ডু রাজার ঢিবি, অযোধ্যা পাহাড়ের বেশিরভাগ প্রত্নক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ হয়েছে, প্রত্ন সামগ্রীর বৈশিষ্ট্য দেখে। কার্বন ডেটিং-এর বালাই প্রায় নেই। ফলে এদের প্রাচীনত্বও যথাযথ গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব খানিক দিলেও ‘ছুটকো ঘটনা’ বলে পাশে সরিয়ে রাখা যেতে পারে, সেই ধারণা এখনও বহাল আছে।

ফিরে আসি মর্টিমারের দক্ষিণ ভারতীয় প্রত্নকালের খোঁজের কথায়। দক্ষিণ ভারতীয় মেগালিথ সংস্কৃতির লাল-কালো মৃৎপাত্র শিশুপালগড়ে পাওয়াতে মর্টিমারের ধারণাই পূর্ণতা পেল। জানা গেল, দক্ষিণ ভারতের প্রত্নসংস্কৃতি উড়িষ্যা অবধি বিস্তৃত ছিল।

তবে তাঁর ধারণার থেকে আলাদা পূর্ব-ভারতীয় প্রত্ন সংস্কৃতির অস্তিত্ব পাওয়া গেল কি না, বা কতটা বোঝা গেল, তা নিয়ে আপাতত এ. এস. আই নীরব। এবং আমরা জানি, বর্তমানে এ. এস. আই. ব্যস্ত মধ্যগঙ্গার প্রত্ন-ইতিহাস নিয়ে।

শেষের কথা ২

শিশুপালগড়ের গুরুত্ব শুধুই প্রত্ন দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃতির সীমা অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে ইতিহাসের কালেরও যোগ আছে। এবং, ছোট হলেও, একটা ধাঁধার জন্ম দেয় শিশুপালগড়।

শিশুপালগড়কে রাজা খারবেলের কলিঙ্গনগরী বলে সবাই এককথায় স্বীকার করতে রাজী নন। যেহেতু কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু এটাও ঠিক, খারবেল কলিঙ্গের পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা ছিলেন। অশোকের মৃত্যুর পরে খারবেল যখন রাজ সিংহাসনে বসেন, কলিঙ্গ তখন আর মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীন নয়। খারবেল একজন স্বাধীন রাজা। অশোকের মৃত্যুর কিছু পরে সিংহাসনে বসলেও খারবেলের সেনাবল বা সম্পদের কোনও অভাব ছিল না।

শিশুপালগড়ে বৌদ্ধ ধর্মের কোনও স্মৃতি চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাজা খারবেল, তাঁর শিলালিপি অনুযায়ী, সর্বধর্মের পূজারী ছিলেন। তবে, শিলালিপির দুই একটি শব্দ থেকে অনুমান করা হয়, খারবেল নিজে সম্ভবত জৈনধর্মালম্বী ছিলেন।

যেহেতু কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে শিশুপালগড়ের জীবনযাত্রায় কোন ফাঁক পড়েনি, বা তাদের জীবনযাত্রার গুনগত মানেও কোনও লক্ষণীয় অবনতি দেখা যায়নি, তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, অশোকের শিলালিপির কলিঙ্গ যুদ্ধের বর্ণনার মতো কলিঙ্গ কি সত্যিই অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? কলিঙ্গের সমকালীন অন্যতম বড় দুর্গনগরী শিশুপালগড়ে যুদ্ধের আঁচ লাগলো না কেন? শুধু যে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর অটুট বলেই এমন ভাবনা মাথায় আসবে তা নয়। প্রতিরক্ষা প্রাচীর অটুট থাকতেই পারে, যদি তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুরে হয়, অথবা যুদ্ধের পরেই আত্মসমর্পণ করে থাকে শিশুপালগড় দুর্গনগরী। কিন্তু, সেক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেকের মৃত্যুর ফলে নগরের আর্থিক কার্যকলাপে একটা ঢিমেভাব আসার কথা ছিল। তারও কোনও প্রমাণ নেই। নগরের সমৃদ্ধির ধারা ও জনজীবনের স্বাভাবিকতা ছিল অটুট।

লক্ষণীয়, অশোকের শিলালিপি কিন্তু শিশুপালগড় দুর্গনগরীর একটু দুরে তোশালীতে ছিল। এবং অশোক তোশালীর প্রশাসনিক অধিকর্তাকেই তাঁর নীতি প্রয়োগের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তবে কি ধরে নিতে হবে যে, শিশুপালগড় অশোকের জয়যাত্রার বাইরে ছিল। প্রায় অভাবনীয়, তবু তেমন ইঙ্গিত তো দেখাই যায়।

আবার যদি ধরা হয় যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অশোকের শিলালিপির বর্ণনা মতোই বিশাল ছিল, তবে বলতেই হয়, গোটা কলিঙ্গ, বিশেষ করে শিশুপালগড়, অভাবনীয় দ্রুততায় ও দক্ষতায় সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি সামলে নিয়েছিল। তাহলে প্রমাণ হয়, এখানকার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক শক্তি আর কলিঙ্গবাসীর চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল অভাবনীয় রকমের সংগঠিত।

শিশুপালগড়ের নাম দুটো শিলালিপি থেকেও পরিষ্কার কিছু বোঝা গেল না। এই ধাঁধার আরেক সমাধান হতে পারে। হয়তো, অশোকের আমলে শিশুপালগড়ের নাম ছিল তোশালী। পরে খারবেলের আমলে তা স্বাধীন হয়ে নামাঙ্কিত হয় কলিঙ্গনগরী। কলিঙ্গবাসীর নবজাগরণের অহমিকার প্রতীক হিসাবে।

যে কলিঙ্গবাসীর কলিঙ্গনগরীর চারিত্রিক দৃঢতার পরিচয়ে অটুট ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেও, তা জনশূন্য হয়ে গেল এক হাজার বৎসর পরে। সামান্য দুরে ভুবনেশ্বরের শিব মন্দির নির্মাণের সূত্রে।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসে আমার মনে। লোকবিশ্বাস, ভুবনেশ্বরের একটি শিব মন্দির সাধারণ প্রথম শতাব্দীতে তৈরি, এবং ভাবা হয়, মন্দিরটি গড়েছিলেন রাজা খারবেল। যদিও, মন্দিরের গঠন শৈলী বলে, মন্দিরটি অত পুরনো নয়। তা ছাড়া বাকি সব মন্দিরই তৈরি হয়েছে ষষ্ঠ শতকে।

মন্দির যদি ষষ্ঠ শতকে তৈরি হয়ে থাকে, তবে তৃতীয় বা চতুর্থ শতকে শিশুপালগড় জনশূন্য হওয়ার জন্য মন্দির দায়ী হতে পারে না, যদি না, শিশুপালগড় জনশূন্য হওয়ার কাল চতুর্থ শতকের বদলে ষষ্ঠ শতক না হয়।

শিশুপালগড়ের শেষ প্রত্ন অনুসন্ধানে স্মিথ-মোহান্তির রিপোর্ট বলছে, শেষ পর্যায়ে কেবল শহরের উত্তর দিকেই জনবসতি অবশিষ্ট ছিল এবং সে জনবসতিতে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কোন চিহ্ন নেই।

সেখানকার মাটির উপরের স্তরে ও অল্প নিচে পাওয়া মৃৎপাত্রের কার্বন ডেটিং করার কথা ভাবাই হয়নি। কারণ, ওই স্তরে যে কোন জিনিস নবীন কার্বনকণা সমৃদ্ধ হবেই। ফলে ডেটিং-এর ফলও ভুলই হবে।

তাহলে কি শিশুপালগড় প্রকৃতভাবে জনশূন্য হয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীতে? যেহেতু নতুন রাজবংশের উৎসাহে ভুবনেশ্বরের দিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছিল, তাই হয়তো পঞ্চম শতাব্দী থেকেই লোকজন ভুবনেশ্বরের দিকে সরে যেতে শুরু করে। আর সেই শহর ত্যাগের সমাপ্তি ঘটে ষষ্ঠ শতাব্দীতে।

শিশুপালগড়ের আয়ু তবে ধরতে হয়, সাধারণ পূর্বাব্দের সপ্তম শতক থেকে সাধারনাব্দের ষষ্ঠ শতক অবধি। এক হাজার বৎসর। ফলে বোঝা গেল, উত্তর-পশ্চিমে যখন পারসিক সাম্রাজ্যের প্রভাবে নগর গঠন প্রক্রিয়া চলছে, একই সময়ে পূর্ব ভারতের উড়িষ্যায় একটি সংস্কৃতি এতটাই আধুনিক পর্যায়ে চলে এসেছে যে, তারা শক্তিশালী নগরদুর্গ গঠন করতে সক্ষম ছিলেন, আর সে নগরের আয়ুষ্কাল হবে দীর্ঘ এক হাজার বছর।

তথ্যসূত্রঃ-

১. Sisupalgarh 1948: An Early Historical Fort in Eastern India. By B.B. Lal. Ancient Inida Bulletin of the Archaeology Survey of Inida No.5. (January 1949)

২. Archaeology at Sisupalgarh: The Chronology of an Early Historic Urban Centre in Eastern India. By Monica L Smith and Rabindra Kumar Mohanty

মন্তব্য তালিকা - “শিশুপালগড়”

  1. এই শিশুপালগড় একটি দুর্গ নগরী ছিল। আপনার লেখা পড়ে স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা জন্মাল। ধন্যবাদ এমন একটি ইতিহাস উপেক্ষিত স্থানকে সকলের দৃষ্টি গোচরে করার জন্য ।

    1. স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে তো হবেই। তবে সেটা এখন আগাছা আর ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা এলাকা। আমি যাই নি তবে সদ্য তোলা কিছু ছবি দেখেছি । চরম অবহেলা। অথচ পূর্ব ভারতের এটি ছিল প্রাচীনতম দুর্গনগরী। যে নগরী তৈরীর সময়ই ৫০০ সাধারন পূর্বাব্দেই তাকে দুর্গনগরী হিসাবে গড়া হয়েছিল । যা প্রমাণ করে আরো কম করেও আরো একশ বৎসর আগে সেখানে একটি শক্তিশালী রাজত্বে সুচনা হয়েছিল। সেই প্রাচীন রাজত্বের ইতিহাস এখনো অজানা।

  2. এতবার ভুবনেশ্বর গিয়েছি কিন্তু শিশুপাল নগরীতে যাইনি জানতাম না, পোস্টটি এত বিশ্লেষণাত্বক সব তথ‍্য পরিস্কার হয়ে চোখে ভাসছে যেন কত পরিচিত জায়গা, অনেক ধন্যবাদ জানাই

    1. ধন্যবাদ। সত্যি এটা খুব আফসোসের কথা যে সম্ভবত পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম দুর্গনগরীর কথা কেউ জানে না। অথচ এটি মাথা উঁচিয়ে দাঁডিয়ে ছিল এক হাজার বৎসর ধরে। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের সময়ও সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং সম্ভবত সম্রাট অশোক এর অধিকার পান নি। কারন এখানে অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের কোন ছাপ পড়েনি ।
      কোন অজ্ঞাত কারণে এটির নামও কেউ উল্লেখ করে না তা বলা কঠিন। উড়িষ্ঠা পর্যটন মানচিত্রে এর তেমন উল্লেখযোগ্য প্রচারও নেই। তাই ভুবনেশ্বর গিয়েও আর আধ ঘন্টার রাস্তা যাওয়া হল না। আমার পরিচিত কেউ যায় নি। কেউ জানে না। আমি নিজে বার তিনেক ভুবনেশ্বর গেছি। আমিও জানতাম না।

  3. খারাভেলা ছিলেন সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্নির সমসাময়িক| তাঁর হাতিগুম্ফা লিপি থেকে জানা জায় যে নন্দদের সময়ে কাটা একটি খাল সংস্কার করিয়েছিলেন| অর্থাৎ নন্দদের সময় কলিঙ্গ/উড়িষ্যা মগধ-এর অধীনে ছিল বোধহয়|

    1. বি বি লাল এবং মহান্তি দুজনই লিখছেন খারবেলা স্বাধীন রাজা ছিলেন। তিন আশপাশের কয়েকটি এলাকাতেও আক্রমণ ও রাজ্য জয় করেছিলেন।
      খারবেলা অশোকের পরে। কাজেই নন্দবংশ তখন থাকার কথা নয়।

      1. না, না, স্যার| আমি যেটা বলতে চেয়েছি সেটা হল যে নন্দদের সময়ে (যারা মৌর্য’দেরও আগে) কলিঙ্গ সম্ভবত মগধের অধীনে ছিল| কারণ হাতিগুম্ফা লিপি অনুযায়ী, খারাভেলা’র সময়, নন্দদের কাটানো একটা খালের সংস্কার করা হয়েছিল|

  4. খুব ভালো লাগলো। ছাত্র জীবনে উৎকল বিশ্ব বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম এবং অদূরে ই প্রতনখনন করেছি। কিন্তু তখন ও জানা ছিল না কাছেই রয়েছে শিশুপালগড়। অনেক তথ্য জানতে পারলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ, এই সুন্দর তথ্য জানানোর জন্য।

    1. ধন্যবাদ । এটাই অবাক ব্যাপার। প্রায় কেউ জানে না । অথচ ভীষণ গুরুত্ব পূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র এটি।

  5. খুবই তথ্যসমৃদ্ধ কিন্তু প্রাঞ্জল লেখা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এতটাই সুন্দর বর্ণনা। ৭০০ BCE তে অর্থাৎ বুদ্ধর দুশো বছর আগে, ষোড়শ মহাজনপদের আগে এবং তার বাইরে নগরের অস্তিত্ব পাওয়াটা বেশ যুগান্তকারী। এর সঙ্গে তামিলনাড়ুর কীড়াডি যোগ করলে নগরায়ণের ইতিহাস অনেকটাই পুরোনো ও দক্ষিণমুখী হবে।

  6. এটাই বড় কথা। ষোড়শ মহাজনপদের আগেকার। এবং শুরু থেকেই এটিকে দূর্গনগরী হিসাবেই পরিক্পনা করেই তৈরী করা হয়েছিল।
    এতে আরেকটি জিনিষ পরিস্কার হয় যে তারও অনেক আগে থেকেই নগর গঠন চলছিল এই এলাকায়। কেন না আগে কোন নগর না বানিয়ে প্রথমেই কেউ দূর্গনগরের ধারনা করবে এমনটা সম্ভব না।
    মর্টিমারের আমলে সবে দক্ষিণ ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। (তার কৃতিত্বও ওনার।)
    ওনার লেখা এ।এস।আই এর মুখপত্রে শেষ লেখায় উনি লিখেছিলেন দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন সংস্কৃতির সম্ভাবনা বিশাল । পাওয়া যায় নি তখনো। কিন্তু পাবার সম্ভাবনা আছে ।
    এখন সেগুলো বের হয়ে আসছে।
    হতে পারে দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির প্রান্ত ছিল এই শিশুপালগড়।
    তবে তা হলে মর্টিমারের ধারনার পূর্বভারতীয় সংস্কতির খোঁজ পাওয়া আজও হয় নি।
    অথবা শিশুপালগড় ছিল দুইএর সংযোগ কেন্দ্র। এমনও হতে পারে।

  7. কত নতুন তথ্য দিলেন।আরেকবার ওদিকে যাওয়ার সুযোগ এলেই অন্তত চোখের দেখা দেখে আসব।আর আবার আপনার এই লেখা পড়ব।

    1. ধন্যবাদ । আমি নিজে দেখিনি। আপনি দেখে এলে লিখুন চাক্ষুষ বর্ণনা। অপেক্ষায় থাকব। তবে কিছু ছবি ও ভিডিও দেখেছিলাম লেখার আগে । দেখলাম সবটাই জঙ্গল আর আগাছায় ভরা। অবহেলার চুড়ান্ত।

    1. না ঠিক এক হাজার বৎসরের ফাঁক নেই। হরপ্পা শহর ও আরো কয়েকটি ছোটখাট শহর ১৩৫০ অবধি টিকেছিল বলেই মনে পড়ে। তাহলে ফাঁক হল ৪৫০ বৎসর। তারপরেও ভাবতে হবে ৭০০ সাধারন পূর্ববাব্দে জনবসতির পত্তন ও তার এক দেড়শ বৎসরের মধ্যে এটিকে পরিক্লপিত ভাবে দূর্গনগরী গড়া থেকে বোঝা যায় যে এখানে জন বসতিরও আগে একটি সমাজ ব্যবস্থার শুরু হয়েছিল, যারা সক্ষম ছিল রাজ্য গঠনের , যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ার কথা ভাবার। একটি নগরী গড়তে প্রভুত অর্থ ও শ্রম ব্যায় ও উপযুক্ত সংগঠনের ও দরকার। সে সবই এদের করায়ত্ব ছিল।
      এর কিছুই কিন্তু হরপ্পা সভ্যতায়র নগরগুলোতে আমরা পাইনি। হরপ্পা সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা ছিল ভিন্ন সুরে বাঁধা।
      হরপ্পা সভ্যতার সাথে শিশুপালগড়ের কোন যোগসুত্র নেই বলেই মনে হয়। স্থাপত্য জীবনধারা বা সামগ্রীক ভাবে প্রত্ন নিদর্শনের দিক থেকে যোগসূত্র দেখা য়ায় না।
      শিশুপালগড় সম্ভবত ছিল এক ভিন্ন সংস্কৃতির লোকেদের গড়া। এখানেই শিশুপালগড়ের নজরকাড়া বৈশিষ্ট।

  8. কি বলি! অসামান্য ধারাবাহিক বিশ্লেষণ, আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে ধাপে ধাপে ডায়াগনোসিসে পৌঁছুনোর মতো। আমার বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও নতুন করে আগ্রহ জাগলো আবার দেখার জন্য নতুন চোখে।

  9. চমৎকৃত হলাম। ভারতের পূর্বাঞ্চলে নগর সভ্যতার এতটা প্রাচীন ইতিহাস ঠিকঠাক সময়কাল ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। আপনার দাবীটি মান্য। পূর্ব ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে ব্রাত্য করে রাখা আছে। সর্বত্র তো আর exception doesn’t prove the rule খাটে না! শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একাধিক ঐতিহাসিক উপন্যাস ও ছোটগল্পে কিছুটা সন্ধান দিয়ে গেছেন বটে, তবে তাতে কল্পনার মিশ্রণ বেশী। কারণ তা সাহিত্য।
    আপনার এই বিদগ্ধ লেখাটি অনেকটা আলো ফেলল পূর্ব ভারতের নগর সভ্যতার প্রামাণ্য উদাহরণকে চোখের সামনে এনে। এ বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে সুবিধা হবে।
    শ্রদ্ধা ও নমস্কার জানবেন।

    1. ধন্যবাদ। আমাদের পূর্ব ভারতে প্রাচীণ ইতিহাস নিয়ে যা কিছু আলোচনা হয় তার সবই অনুমান ভিত্তিক। এমন নয় যে সব অনুমানই কল্পনা ভিত্তিক। তবু অনুমান সব সময়ই অনুমান। তাকে যথাযথ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে অনুসন্ধানের প্রমাণের ভিত্তিতে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা প্রায় নেই। ঙয়ত আমরা কাঠখোট্টা বৈজ্ঞানিত তথ্যের চেয়ে বেশি করে সাহিত্য মিশ্রিত ইতিহাসে ভরসা রাখি।
      তাছাড়া গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে প্রত্ন অনুসন্ধানের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনায় পূর্বভারতের খুব কিছু গুরুত্ব নেই। এটা নির্মম সত্য। মর্টিমার তবু ভারত জোড়া একটা প্রত্ন মানচিত্র তৈরীর কথা ভেবেছিলেন। বর্তমানে কিন্তু সমস্ত গুরুত্ব হরপ্পা সভ্যতার জন্ম ও তার পরেকার ঘটনাবলী তথা গঙ্গা অববাহিকায় বা মধ্য গঙ্গা এলাকায় দ্বিতীয় নগরায়ন, ও রাজনীতির ক্ষমতা কেন্দ্র নিয়ে ।
      এখানে পূর্ব ভারতের গুরুত্ব নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।