শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (প্রথম পর্ব)
সময়টা ছিল ২০০৪ সালের জুলাই মাসের প্রায় শেষ দিক। হোয়াইট হাউসে ফরাসি দূতাবাসের মারফত একটা চিঠি এসে পৌঁছালো সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নামে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সচিবরাই উত্তর দিয়ে থাকেন এই ধরনের চিঠিপত্রের। এটাই দস্তুর। কিন্তু প্রেরকের নামটা দেখে চিঠিটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো খোদ প্রেসিডেন্টের কাছে। চিঠিটা পড়লেন তিনি। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। মার্কিন প্রশাসনের নির্দেশে জাপানে টোকিওর কাছে উশিকু শহরের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক একজন বিশেষ বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন প্রেরক। সাথে এটাও জানিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট যদি এই কাজে অপারগ হন তবে দয়া করে শুধু একটা দাবা খেলার বোর্ড সমেত তাকেও যেন সেই কয়েদির সাথে সেই বন্দী শিবিরে একই সেলে রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি। কারণ যে অভিযোগে ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে সেই একই অপরাধে দুষ্ট তিনিও। চিঠিটাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা করলেন না। বরং খুঁটিয়ে আরেকবার পড়লেন তিনি। কারণ চিঠির নিচে যিনি সই করেছেন তিনি খুব সাধারণ মানুষ নন। একডাকে তাঁকে চেনেন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ। ১৯৬৯ সালের প্রাক্তন ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়ান তথা বিশ্বের অন্যতম বিরল প্রতিভাধর দাবাড়ু বরিস স্প্যাসকি।চমকানোর মতো আরও কিছু ছিল চিঠিতে। যে কয়েদির কথা তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি আর কেউ নন। তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী ও দাবায় ১৯৭২ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান তথা ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্রতিভা ববি ফিশার। ঘটনাটা কী ছিল আর জাপানে আটক এক ব্যক্তির জন্যে খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে এইরকম একটা অনুরোধ কেন করা হলো সেটা জানার আগে চলুন আমরা ফ্ল্যাশব্যাকে পিছিয়ে যাই বেশ কিছু বছর।
১৯৭২ সালে সেটাও ছিল জুলাই মাস। সারা পৃথিবীর চোখ তখন আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিক শহরে। পাশেই গ্রিনল্যান্ডকে উত্তর আমেরিকার অংশ হিসাবে ধরা হলেও আইসল্যান্ড কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের এক স্বাধীন সার্বভৌম নিরপেক্ষ দেশ। তখন সোভিয়েত রাশিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শৈত্য-যুদ্ধের সময়। জুলাই মাসের ১১ তারিখ রেইকিয়াভিক শহরেই শুরু হতে চলেছে গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা এক দ্বৈরথ। বরিস স্প্যাসকি বনাম ববি ফিশার। প্রথমজন ইন্টারন্যাশনাল চেস ফেডারেশন, সংক্ষেপে ‘এফ আই ডি ই’ বা ফিডে (FIDE) দ্বারা ঘোষিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান রাশিয়ান দাবাড়ু আর দ্বিতীয়জন ১৯৭১ সালের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের বিজয়ী ও পয়েন্টের নিরিখে সেই সময় ওয়ার্ল্ড ফেডারেশনের তালিকায় একেবারে শীর্ষে থাকা আমেরিকান চ্যালেঞ্জার।
কিন্তু লড়াইটা তখন শুধুমাত্র বরিস স্প্যাসকির খেতাব রক্ষার কিংবা ববি ফিশারের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুজন দাবাড়ুকে কেন্দ্র করে বিশ্বের প্রধান দুটো দেশ আমেরিকা আর সোভিয়েত রাশিয়া এক বিরাট স্নায়ু যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি। যার আঁচটা সরাসরি গিয়ে পড়েছে তামাম বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর উপরে। খেলাটাকে ঘিরে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মিডিয়া কভারেজও কম গেলো না। তারা খেলাটার হাইপ আরও বাড়িয়ে দিলো। গোটা খেলাটাকেই দেখানো হলো ‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এর প্রতিরূপ হিসেবে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দাবার দুনিয়ার একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নেরই রমরমা। দাবা খেলার বোর্ডটাকে তারা ব্যবহার করত পুঁজিবাদের ওপর কম্যুনিজমের আধিপত্যের প্রতীক হিসাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আয়োজিত দশটা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাবি লড়াইতে জয়ী ও তাদের চ্যালেঞ্জাররা প্রত্যেকেই ছিলেন রাশিয়ান। তাই তারা ধরেই নিয়েছিল দাবায় বিশ্বজয়ের খেতাবের ওপর এক মাত্র তাদেরই অধিকার আছে। সোভিয়েত রাশিয়ার ঘরে ঘরে তখন দাবাড়ু। চেস খেলাকে রাশিয়ানরা প্রায় জাতীয় ক্রীড়ার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। এদিকে চাঁদে মহাকাশযান পাঠানো হোক কি নিত্যনতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার, সব ক্ষেত্রেই তুল্যমূল্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও আমেরিকায় তখনও সেভাবে দাবা খেলার সেরকম কোনো পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি।
মূল লড়াইয়ের কাহিনী শোনানোর আগে সংক্ষেপে দুই প্রতিপক্ষের সামান্য পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আর একটা কথাও বলে নিই। এই ঐতিহাসিক দ্বৈরথের চিত্রনাট্যের দুটো পর্ব। প্রত্যেকটা পর্বের স্থায়িত্ব কয়েক মাসের হলেও মাঝখানের বিরতির সময়টা কিন্তু দীর্ঘ। ঠিক কুড়ি বছর।
বরিস স্প্যাসকি
বরিস ভ্যাসিলিয়েভিচ স্প্যাসকি বা সংক্ষেপে বরিস স্প্যাসকির জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩০-শে জানুয়ারি সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ (সেন্ট পিটার্সবার্গ) শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৪১ সালের ৮-ই সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী লেনিনগ্রাদ আক্রমণ করে ঘিরে ফেলায় অবরুদ্ধ শহর থেকে আরো অনেক রাশিয়ান পরিবারের সাথে ট্রেনে পালিয়ে আসার সময় মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বরিস স্প্যাসকি সহযাত্রী কয়েকজনকে দাবা খেলতে দেখে খেলার খুঁটিনাটি শিখে ফেলে। দশ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে লেলিনগ্রাদ শহরে এক চেস টুর্নামেন্টে বরিস স্প্যাসকি সেই সময়ের সোভিয়েত রাশিয়ার চ্যাম্পিয়ান মিখায়েল বোৎভিনিককে হারিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন। এই মিখায়েল বোৎভিনিক খুব সাধারণ চেস প্লেয়ার ছিলেন না। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট শহরে এক ইন্টারন্যাশনাল চেস কম্পিটিশনে যুগ্ম ভাবে চতুর্থ স্থান অধিকার করে আন্তর্জাতিক দাবায় হাতেখড়ি হয় বরিস স্প্যাসকির। এই টুর্নামেন্টের একটা ম্যাচে তিনি ভবিষ্যতের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান (১৯৫৭-৫৮) বিখ্যাত দাবাড়ু ভ্যাসিলি সিমিস্লভকে স্ট্রেট সেটে হারিয়ে সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। সেই বছরই বেলজিয়ামের বন্দর শহর এন্টওয়ার্প-এ আয়োজিত ওয়ার্ল্ড জুনিয়ার চেস চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় স্প্যাসকি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯৫৬ সালের প্রথমদিকে নেদারল্যান্ডে আয়োজিত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে যুগ্মভাবে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বরিস স্প্যাসকি মাত্র আঠেরো বছর বয়সে সেই সময় পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে কনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের শিরোপা অর্জন করেন।
১৯৬৪ সালে আমস্টারডামে বিভিন্ন দাবা খেলিয়ে দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্টে সর্বাধিক সতেরো পয়েন্ট পেয়ে বরিস স্প্যাসকি অন্য তিনজন প্রতিযোগীর সাথে যুগ্ম ভাবে প্রথম স্থান পান। অন্য তিনজনের মধ্যে ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ারই ভ্যাসিলি সিমিস্লভ আর মিখাইল তাল। অন্যজন ডেনমার্কের বেন্ট লারসেন। এখানে অবশ্য একটা কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। এর আগে ১৯৬২ সালের ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন ববি ফিশার। ১৯৬৩ -৬৪ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে তিনি কোয়ালিফাই করা সত্বেও ১৯৬৪ সালের এই ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্টে ববি ফিশার চেস ফেডারেশনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।
নিয়ম অনুযায়ী এই প্রতিযোগিতার প্রথম ছয় জনের সাথে আগের দুই ফাইনালিস্টকে নিয়ে মোট আটজনের মধ্যে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলা হবে। এখানে পুরোটাই নক আউট পর্ব। দুজন করে চারটে কোয়ার্টার ফাইনাল, দুটো সেমি ফাইনাল আর শেষে ফাইনাল। যিনি চ্যাম্পিয়ান হবেন তিনিই নতুন চ্যালেঞ্জার হিসাবে সেই সময়ের দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের কাছ থেকে খেতাব ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার পাবেন। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত লাটভিয়ার রিগা-তে ১৯৬৫ সালের ৭ থেকে ১৩-ই এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে বরিস স্প্যাসকি ফাইনালে মিখাইল তাল-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সাথে সাথে সেই সময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ানের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জার হিসাবে খেতাব ছিনিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন।
১৯৬৬ সালে রাশিয়ার মস্কোতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাবি লড়াইতে টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ানের মুখোমুখি হলেন বরিস স্প্যাসকি। এপ্রিল মাসের নয় তারিখ থেকে জুন মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত দুই মাস ব্যাপী চব্বিশ গেমের এই রুদ্ধশ্বাস লড়াইতে চারটে জেতেন পেট্রোসিয়ান। স্প্যাসকি তিনটে। সতেরোটা গেম ড্র হয়। চেস ফেডারেশনের নিয়ম অনুযায়ী জিতলে এক আর ড্র হলে হাফ পয়েন্ট হিসাবে টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ান পেলেন সাড়ে বারো আর স্প্যাসকি সাড়ে এগারো। মাত্র এক পয়েন্ট বেশি পেয়ে পেট্রোসিয়ান কোনোক্রমে তাঁর দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব ধরে রাখতে সমর্থ হলেন।
বরিস স্প্যাসকি কিন্তু দমলেন না। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর আর নভেম্বর মাস জুড়ে ইন্টারজোনাল চেস টুর্নামেন্টের আসর বসলো উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায়। নিয়ম অনুযায়ী এই প্রতিযোগিতায় প্রথম ছয় জন প্রতিযোগীকে সুযোগ দেওয়া হবে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে। বরিস স্প্যাসকি আর মিখায়েল তাল ঠিক আগের অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ক্যান্ডিডেটস প্রতিযোগিতার ফাইনালিস্ট হিসাবে সরাসরি সেখানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আর আটজনের মধ্যে সেখানে নকআউট পর্বে যিনি জিতবেন তিনিই হবেন নতুন চ্যালেঞ্জার। কিন্তু এই টুর্নামেন্ট নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন ববি ফিশার। ১৯৬৭ সালে তিউনিসিয়ায় এই ইন্টারজোনাল প্রতিযোগিতায় আমেরিকা থেকে ববি ফিশারও অংশ নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় সাতটা ম্যাচ জিতে আর তিনটে ড্র করে দশম রাউন্ড পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলে সবার শীর্ষে থাকলেও উদ্যোক্তাদের সাথে মনোমালিন্যের কারণে তিনি মাথা গরম করে টুর্নামেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যান। যেহেতু তিনি মোট বাইশ ম্যাচের মধ্যে মাত্র দশটা অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম খেলেছিলেন তাই ববি ফিশারের নাম প্রতিযোগিতা থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যাঁদের তিনি হারিয়েছিলেন তাঁদের পয়েন্ট ফিরিয়ে দেওয়া হলো। যাই হোক, সবার নাম আর উল্লেখ করলাম না। এই প্রতিযোগিতার প্রথম ছয় জনের সাথে বরিস স্প্যাসকি আর মিখায়েল তাল-কে নিয়ে মোট আটজনের মধ্যে আয়োজিত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বের ফাইনালে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বরিস স্প্যাসকি স্বদেশীয় ভিক্টর করশনয়-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হলেন। ফলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ান-এর কাছ থেকে চ্যালেঞ্জার হিসাবে খেতাব ছিনিয়ে নেওয়ার আরেকটা সুযোগ চলে এলো স্প্যাসকির কাছে।
১৯৬৯ সালের ১৪-ই এপ্রিল ৩৯ বছর বয়সী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ান মস্কোতে খেতাব ধরে রাখার লড়াইয়ে মুখোমুখি হলেন ৩১ বছরের স্বদেশীয় বরিস স্প্যাসকির। নিয়ম অনুযায়ী ম্যাচে ২৪-টা গেম খেলা হবে। যদি দুজনেই সমান সমান মানে ১২ পয়েন্ট করে পান তবে খেতাব থেকে যাবে টাইগ্রেনের কাছে। আর যদি প্রথমে কেউ সাড়ে বারো পয়েন্ট পেয়ে যান তবে আর কোনো গেম না খেলে তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। জুন মাসের সতেরো তারিখে তেইশ নম্বর রাউন্ড আরম্ভ হলো। বরিস স্প্যাসকি তখন ঠিক বারো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। মানে এই গেমটা ড্র করতে পারলেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব চলে আসবে তাঁর কাছে। আর ঠিক তাই হলো। তেইশতম রাউন্ড ড্র হয়ে গেলো। ইন্টারন্যাশনাল চেস ফেডারেশনের (FIDE) ইতিহাসে দশম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হিসাবে খেতাব জিতে গেলেন বরিস স্প্যাসকি। টাইগ্রেন পেট্রোসিয়ান সাড়ে দশ পয়েন্ট পেয়ে খেলা শেষ করেন।
ববি ফিশার
এবার ববি ফিশারের প্রসঙ্গে আসি। সম্পূর্ণ নাম রবার্ট জেমস ফিশার হলেও সারা দুনিয়া তাঁকে ববি ফিশার নামেই চেনে। ১৯৪৩ সালের ৯-ই মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্মালেও বেড়ে ওঠেন নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনে। তবে ববি ফিশারের জন্ম-বৃত্তান্ত কম চমকপ্রদ নয়। মার্কিন নাগরিক হলেও ফিশারের মা রেজিনা ওয়েন্ডারের জন্ম হয়েছিল সুইজারল্যান্ডে এক ইহুদি পরিবারে। মিসৌরির এক নামকরা কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর ডাক্তারি পড়ার জন্যে তিনি মস্কো যান। সেখানে হ্যান্স গেরহার্ড ফিশার নামে একজন জার্মান বায়ো ফিজিক্সের অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসে দুজনে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৩৮ সালে মস্কোতেই তাঁদের প্রথম কন্যা-সন্তান জোয়ান ফিশারের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষ মাথাচাড়া দেওয়ায় জোসেফ স্তালিনের নির্দেশে জার্মান স্বামীকে মস্কোয় রেখে ১৯৩৯ সালে রেজিনা তাঁর শিশু কন্যাকে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসেন। ১৯৪৫ সালে দুজনের মধ্যে ডিভোর্স হওয়া পর্যন্ত খুব সম্ভবত রেজিনা আর হ্যান্স গেরহার্ডের মধ্যে সেরকম কোনো যোগাযোগ ছিল না।
আমেরিকায় ফিরে এসে রেজিনা বেশ কিছুদিন শিকাগোয় ছিলেন। সেইসময় চারদিকে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। রেজিনার কোনো স্থায়ী কাজ জুটলো না। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়লেন তিনি। ববি ফিশারের জন্মের সময় আক্ষরিক অর্থে রেজিনার নিজস্ব ঘর-বাড়ি বলতে কিছুই ছিল না। বিভিন্ন রকম কাজকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে দুই সন্তানকে একাই মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে রেজিনা তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রথমে ম্যানহাটন আর কিছুদিন পরেই নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে গিয়ে নার্সিং নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর নার্সিংকেই পেশা হিসাবে বেছে নিলেন তিনি। সেই সময় একদিন ছয় বছরের ববি ফিশার তাঁর দিদি জোয়ানের সাথে কোনো এক ক্যান্ডি স্টোর্স থেকে একটা চেস বোর্ড উপহার পান। বাক্সের গায়ে লেখা নির্দেশিকা পড়ে সেটা নিয়েই বাড়িতে মা আর দুই ভাই বোন দাবা খেলা প্র্যাকটিস করতে শুরু করলেন। কিছুদিন পরে মা আর দিদি খ্যান্ত দিলেও ববি ফিশার কিন্তু খেলাটায় মজে গেলেন। নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ সেজে বাড়িতে একাই দাবা খেলে যেতেন ফিশার। পরে কারো মাধ্যমে চেস খেলার খুঁটিনাটি নিয়ে লেখা একটা বই হাতে এলে সেটা দেখে খেলাটা মোটামুটি ভাবে আয়ত্ত করে ফেলতে ববির বেশি সময় লাগেনি। ১৯৫০ সালে রেজিনা তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে মাথা গোঁজার জন্যে ব্রুকলিনে একটা খুব ছোট এপার্টমেন্ট কিনে ফেলেন। ছেলে মেয়ে দুজন তখন স্থানীয় এক স্কুলে পড়ছে। কিছুদিনের পরেই রেজিনা বুঝতে পারেন স্কুলের পড়াশোনার থেকেও ছেলের দাবা খেলায় আগ্রহ অনেক বেশি। সেই বছর ১৪-ই নভেম্বর তিনি ব্রুকলিনের ‘ঈগল নিউজ পেপার’-এ একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে চাইলেন তাঁর ছেলের সমবয়সি কেউ দাবা খেলায় উৎসাহী কিনা যাতে সে ববির পার্টনার হিসাবে সঙ্গ দিতে পারে। এতে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া না গেলেও বিজ্ঞাপনটা আমেরিকার একজন দাবা বিশেষজ্ঞ হেরম্যান হেল্মস-এর চোখে পড়ে। তিনি রেজিনাকে চিঠি লিখে জানান সামনের জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ স্কটিশ চেস চ্যাম্পিয়ান ম্যাক্স প্যাভে ব্রুকলিনে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে আসছেন। সেখানে তিনি একসাথে অনেকের সঙ্গে দাবা খেলায় অংশ নেবেন। মানে সারিবদ্ধ ভাবে অনেক গুলি টেবিলে চেস বোর্ড পেতে বিভিন্ন খেলোয়াড়েরা বসবেন আর ম্যাক্স প্যাভে ঘুরে ঘুরে পর্যায়ক্রমে সবার সাথে খেলতে থাকবেন। হেরম্যান হেল্মস-এর সুপারিশে সেদিন সাত বছরের ববি ফিশারকেও একটা বোর্ডে বসার সুযোগ দেওয়া হলো। ঐটুক একটা বাচ্চা ছেলেকে কম্পিটিশনে খেলতে দেখে তাঁর টেবিলের সামনে বিরাট ভিড় জমতে দেরি হলো না। অবশ্য অঘটন কিছু ঘটলো না। মিনিট পনেরো লড়াই করে ববি ফিশার হেরে গেলেন ম্যাক্স প্যাভের কাছে। কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ানের সাথে অসমবয়সী ববির সেই প্রাণপণ লড়াই জেতার অদম্য চেষ্টা তারিফ কুড়ালো অনেকেরই। সেই অনেকের মধ্যে ববির টেবিলের সামনে সেদিন উপস্থিত ছিলেন ব্রুকলিন চেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট কারমিন নিগ্রো। তিনি কিন্তু সাত বছরের ছেলেটার মধ্যে ভবিষ্যতের গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সম্ভাবনা পরিষ্কার দেখতে পেলেন। তিনি আর দেরি না করে ববি ফিশারকে তাদের চেস ক্লাবে ভর্তি করে নিজের হাতে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করলেন। জন্মগত প্রতিভা তো ছিলই। এবার তাঁর সাথে সঠিক অনুশীলনের মিশেলে ববি ফিশার দাবা খেলাটাকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করে ক্রমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে লাগলেন। এই সময় তিনি ব্রুকলিন ও আশেপাশের শহরের অনেক প্রতিষ্ঠিত চেস খেলোয়াড়দের অনায়াসে হারাতে থাকেন। অনেক পরে নিজের আত্মজীবনীতে ফিশার লিখেছিলেন যে কারমিন নিগ্রো হয়তো বিরাট মাপের দাবাড়ু ছিলেন না কিন্তু একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন আদর্শ।
ক্রমে ববি ফিশারের দাবা খেলার আশ্চর্য প্রতিভার কথা লোকমুখে ছাড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন থেকেই তিনি সবার কাছে এক ‘চাইল্ড প্রডিজি’ অর্থাৎ ‘বিস্ময় বালক’ বলে পরিচিত হতে শুরু করেন। সেই সময় আমেরিকায় চেস চ্যাম্পিয়ান ছিলেন ডোনাল্ড বার্ন। আন্তর্জাতিক দাবা মহলে সবাই তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলতেন। ঘটনাচক্রে সেই ডোনাল্ড বার্নকে একদিন চ্যালেঞ্জ করে বসেন তেরো বছরের ববি ফিশার। প্রথমদিকে বার্ন সাহেব ব্যাপারটাকে কোনো গুরুত্ব না দিলেও মিডিয়ার চাপাচাপিতে বাচ্চা ছেলেটার সাথে তিন রাউন্ডের একটা ম্যাচ খেলতে রাজি হয়ে যান। ফলাফল মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। তিনটে রাউন্ডেই ববি ফিশারের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে ডোনাল বার্ন হার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। একটা রাউন্ডে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের মন্ত্রী মানে ক্যুইনকে হারিয়ে ডোনাল্ড বার্নকে ফাঁদে ফেলে হারিয়ে ছিলেন। এটা ছিল সম্পূর্ণ ববি ফিশারের মস্তিস্ক-প্রসূত। পরে এই চালটাই ‘দ্য ক্যুইন স্যাক্রিফাইস’ নামে বিখ্যাত হয়। এই চাঞ্চল্যকর ম্যাচের পর রাতারাতি ববি ফিশারের নাম সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। চোদ্দ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ান আর পনেরো বছর বয়সে বরিস স্প্যাসকির রেকর্ড ভেঙে সেই সময় পর্যন্ত বিশ্বের সবচাইতে কম বয়সী গ্র্যান্ডমাস্টার হিসাবে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা হয়।
১৯৫৮ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে ‘বিশ্ব দাবা উৎসব’ অনুষ্ঠিত হলো। রেজিনা ফিশারের সাথে রাশিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তাঁর পুত্র ববি ফিশারকে সেই দাবা উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে ক্রুশ্চেভকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন রেজিনা। সেইমতো ববি ফিশারকে আয়োজকদের তরফ থেকে মস্কোতে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠিও পাঠানো হয়। দুর্ভাগ্যবশত সেই আমন্ত্রণপত্র যুদ্ধ পরবর্তী নানা প্রশাসনিক জটিলতার কারনে রেজিনার কাছে পৌঁছালো অনেক দেরিতে। তাছাড়াও শেষ মুহূর্তে প্লেনে যাওয়া আসার প্রয়োজনীয় ভাড়া জোগাড় করতে না পারায় সেবার আর সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে খেলার সুযোগ হলো না ববি ফিশারের। পরের বছর কোনো এক আমেরিকান কোম্পানি ফিশারের মস্কো যাতায়াতের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় জীবনে প্রথমবারের মতো সোভিয়েত দাবাড়ুদের সাথে লড়াই করার সুযোগ চলে আসে ফিশারের সামনে। মস্কো এয়ারপোর্টে নেমেই উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছে ববি ফিশার তাকে সোজা ‘সেন্ট্রাল চেস ক্লাবে’ নিয়ে যাওয়ার জন্যে দাবী করে বসেন। ‘সেন্ট্রাল চেস ক্লাবে’ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ম্যাজিক দেখালেন ববি ফিশার। অবলীলায় হারিয়ে দিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার অত্যন্ত প্রতিভাবান বেশ কয়েকজন উঠতি তরুণ দাবাড়ুকে। সত্যি কথা বলতে ফিশারের সামনে টিঁকতেই পারলেন না প্রতিপক্ষরা। সেই সময় বিশ্ব চেস চ্যাম্পিয়ান ছিলেন রুশ দাবাড়ু মিখাইল বোৎভিনিক। সমবয়সী রুশ দাবাড়ুদের হেলায় হারিয়ে ববি ফিশার মানসিক ভাবে তৃপ্তি পেলেন না। তিনি ট্যুর্নামেন্টের আয়োজকদের কাছে মিখাইল বোৎভিনিকের সাথে একটা ম্যাচ খেলার আবদার করে বসলেন। ববি ফিশার তখন ষোলো বছরের এক কিশোর মাত্র। হঠাৎ করে একজন স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান তাঁর সাথে খেলতে যাবেন কেন ? এছাড়াও মাত্র তেরো বছর বয়সে ফিশারের কাছে আমেরিকায় চেস চ্যাম্পিয়ান ডোনাল্ড বার্নের নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনী জানতেন রাশিয়া চেস ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রেও এরকম কোনো অঘটন ঘটার সম্ভাবনার কথাও বিবেচনার মধ্যে ছিল তাঁদের। ফলে ফিশারের অনুরোধ নাকচ করা হলো। এই ঘটনায় ববি ফিশার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। দেশে ফিরে স্বদেশীয় সাংবাদিকদের সামনে তাঁর মস্কো যাত্রার প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে এক বিতর্কিত মন্তব্য করে বসলেন। তিনি রুশদের শুয়োরের সাথে তুলনা করে বলে ফেলেন যে রাশিয়ার আতিথেয়তা ছিল অত্যন্ত অপ্রীতিকর। তাছাড়া রাশিয়ান মানুষগুলোও সব যাচ্ছেতাই। এই বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে রাশিয়ানদের কাছে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন ববি ফিশার। আবার অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেন এক অঘোষিত যুদ্ধের সূচনা করে দিলেন ফিশার। সারাটা জীবন রুশদের প্রতি তাঁর এই রাগ কোনোদিনই কমেনি।
কুড়ি বছর বয়সে ১৯৬৩-৬৪ সালের আমেরিকান দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের এগারো গেমের ফাইনাল ম্যাচে এগারোটাই জিতে নজির স্থাপন করেন ববি ফিশার। বিশ্ব দাবায় ববি ফিশারের নামটা ক্রমশ পরিচিত হতে শুরু করে।
১৯৬৫ সালে একটা আজব ঘটনা ঘটলো। সেই বছর আগস্ট আর সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে কিউবার রাজধানী হাভানায় ক্যাপাব্লাঙ্কা মেমোরিয়াল ট্যুর্নামেন্টের আসর বসেছিল। ববি ফিশার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চাইলেও কিছু রাজনৈতিক বাধা-নিষেধের কারণে আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রক তাঁর কিউবা যাওয়ার প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র দিতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে হাভানার ট্যুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ ববি ফিশারের জন্যে একটা বিশেষ বন্দোবস্ত করতে রাজি হয়। নিউইয়র্কের ‘মার্শাল চেস ক্লাব’-এ বসে টেলিপ্রিন্টার ট্রান্সক্রিপশন আদানপ্রদানের মাধ্যমে ববি ফিশারকে তাঁর প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে খেলার অনুমতি দেওয়া হলো। ববি ফিশার এইভাবেই খেললেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটা ছিল যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। অনেক সময় ফিশারকে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে টানা আট থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত টানা খেলে যেতে হতো। শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ববি ফিশার তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে। প্রথম হয়েছিলেন ১৯৫৭ সালের রুশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান ভ্যাসিলি সিমিস্লভ। পরবর্তী কালে অবশ্য সিমিস্লভকে বেশ কয়েকবার হারিয়েছিলেন ফিশার। কিন্তু মিডিয়ার প্রচারে এই আশ্চর্য ধরনের খেলার জন্যে ববি ফিশার রাতারাতি সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত হয়ে পড়েন।
প্রথাগত পড়াশোনায় ববি ফিশারের কোনোদিনই মন বসেনি। তাঁর মনোযোগ তখন শুধু দাবা খেলাতেই কেন্দ্রীভূত। মা রেজিনা ছেলের জন্যে মোট আটবার স্কুল বদল করেছিলেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সে হাইস্কুলে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে বেরিয়ে এলেন ফিশার। তবে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে মন বসাতে না পারলেও বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষত ইতিহাসে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ফিশারের। দাবা খেলা নিয়ে চর্চার পাশাপাশি সময় পেলেই নানা ধরনের বই পড়তেন তিনি। নিজে বেশ কয়েকটা বইও লিখেছিলেন।
১৯৬৯ সালে ববি ফিশারের লেখা প্রথম বই ‘মাই সিক্সটি মেমোরেবল গেমস’ প্রকাশিত হয়। আমেরিকা তথা সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় আর অত্যন্ত বিখ্যাত এই বইটা আজও দাবা খেলার শিক্ষার্থীদের কাছে অবশ্যপাঠ্য। ১৯৬১ সালে লেখেন ‘এ বাস্ট টু দ্য কিংস গ্যামবিট’। এরপর ১৯৬৪ সালে ববি ফিশারের লেখা ‘দ্য টেন গ্রেটেস্ট মাস্টার্স ইন হিস্ট্রি’ প্রকাশিত হয়। এই বইতে সেই সময় পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দশজন সেরা দাবা খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন ববি ফিশার। সেই তালিকায় অন্য নজনের সাথে বরিস স্প্যাসকির নামও ছিল। ১৯৬৬ সালে দাবা খেলার উপর ‘ববি ফিশার টিচেস চেস’ লেখেন তিনি। তরুণ শিক্ষানবিশদের জন্যে অপরিহার্য এই বইটা আজও সারা বিশ্বে প্রচণ্ড সমাদৃত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর বহুল প্রচলিত ‘বয়েজ লাইফ’ পত্রিকায় নিয়মিত ‘চেকমেট’ নামে ধারাবাহিক ভাবে কলাম লিখেছিলেন ফিশার। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে ‘মাই সিক্সটি মেমোরেবল গেমস’ নামে আরেকটা বই লেখেন ববি ফিশার। অসংখ্য দাবা শিক্ষার্থীর সাথে সাথে এই বইটা তরুণ বয়সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন ভবিষ্যতের আরেক বিশ্ব চেস চ্যাম্পিয়ান গ্যারি কাসপারভ।
পরবর্তী পর্বের লিংক : শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্যবহুল সুন্দর লেখা। একজন প্রতিভাকে লালন-পালন করতে পারে বলেই রাশিয়া,আমেরিকা এতো এগিয়ে। লেখককে ধন্যবাদ।