কল্পবিজ্ঞান, সময় এবং আধুনিক মানুষের স্বপ্ন ও আশঙ্কা
একটি বিখ্যাত গল্প
আর্থার সি ক্লার্কের সেই দুর্দান্ত গল্পটা বোধহয় আপনার পড়া আছে, তাই না – ‘দ্য নাইন বিলিয়ন নেমস অফ গড’? সেই যে, সত্যজিৎ রায় যার এক অনবদ্য বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, তার নাম ছিল – ‘ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম’? মনে পড়ছে না? আচ্ছা, একটু ধরিয়ে দিচ্ছি। তিব্বতের এক বৌদ্ধ গুম্ফার প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীরা এক পশ্চিমা কোম্পানির কাছে একটি মস্ত কম্পিউটারের বরাত দিয়েছেন। তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের আরাধ্য ঈশ্বরের আছে নয় লক্ষ কোটি নাম, এবং সেই সব কটি নাম যদি তাঁদের ভাষায় সম্পূর্ণভাবে লিখে ফেলা যায়, তাহলেই জগতের সমাপ্তি। জগতের অস্তিত্ব তো ঈশ্বরের নাম জপ করার জন্যেই, কাজেই সে কাজ একবার সমাধা হলে আর জগতের দরকার কি?
তবে কিনা, ন’ লক্ষ কোটি নাম জপ করে ফেলা তো আর মুখের কথা নয়! অতএব, যতদিন তা সম্পন্ন না হচ্ছে, ততদিনই বিলম্বিত হতে থাকবে ঈশ্বরপ্রাপ্তি, প্রলম্বিত হতে থাকবে এই জগত-চরাচরের বিষণ্ণ অকারণ অস্তিত্ব। তাই, সেই দুর্গম বৌদ্ধ গুম্ফার উদ্বিগ্ন অথচ দৃঢ়সংকল্প সন্ন্যাসীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ সমস্যার সমাধানকল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয়। তাঁদের ভাষার যতগুলো অক্ষর আছে সবগুলোর যত রকম বিন্যাস ও সমবায় হতে পারে তার সবগুলোই যদি হিসেব করে বানিয়ে ছাপিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম তার মধ্যেই থাকার কথা – এই রকম তাঁদের প্রত্যাশা। এখন, একটা কম্পিউটর যেহেতু সেটা খুব অল্প সময়েই করে দিতে পারবে, তাই তাঁরা এক সুদক্ষ মার্কিন কম্পিউটর-কোম্পানিকে বরাত দিয়েছেন কর্মটি সুসম্পন্ন করার জন্য। কাজেই, তাদের লোকেরা যথারীতি এল, কাজটা করে ফেলল, এবং কাজ সেরে গুম্ফা থেকে বেরিয়ে বিমানে ওঠার আগে সন্ধ্যার আকাশে তাকিয়ে দেখল, এক এক করে মুছে যাচ্ছে উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা। এভাবেই, আর্থার সি ক্লার্কের এই বিখ্যাত গল্পে, ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম জপ করা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যেতে থাকে বিশ্বচরাচর!
লেখার গোড়ায় এ গল্পটার এমন সবিস্তার উল্লেখ কেন? নিঃসন্দেহে, এটি আধুনিক আন্তর্জাতিক কল্পবিজ্ঞানের এক বিখ্যাত এবং নির্ভুল প্রতিনিধি বলে। কিন্তু, শুধু সেই কারণেই কি? না, তা বোধহয় নয় – বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্প তো আর এই একটামাত্র নয়। তবে?
সে উত্তর এ লেখায় দেব না। তবুও, পাঠক হয়ত সে প্রশ্নের উত্তরের একটা ইঙ্গিত পাবেন, এ লেখাটি পড়া সাঙ্গ হলে।
কারে কয় কল্পবিজ্ঞান?
কল্পবিজ্ঞান আমরা সকলেই বোধহয় পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি, এবং রোমাঞ্চিতও হয়েছি। জুলে ভার্ন-এর চন্দ্রাভিযান, এইচ জি ওয়েল্স্-এর সময়-ভ্রমণ বা স্পিলবার্গের ছবির ভয়ঙ্কর সেই ডাইনোসরেরা কাকে না রোমাঞ্চিত করবে? ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ সিনেমার সেই কিশোর রোবোট, যাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে শুধু ভালবাসার জন্যেই, অথচ সে তার মানুষ-মায়ের কাছ থেকে সেভাবে ভালবাসা না পেয়ে সারাজীবন ঘুরে বেড়াল একটু ভালবাসার জন্য – কে না মন খারাপ করবে তার জন্য? কিন্তু, শুধু এই তাৎক্ষণিক রোমাঞ্চে বোধহয় কল্পবিজ্ঞানের সবটুকু তাৎপর্য বুঝে ওঠা যায় না, যদি না তা নিয়ে একান্তে একটু ধ্যান করা যায়, যদি না পাওয়া যায় গালে হাত দিয়ে ধীরস্থির হয়ে একটু ভাববার মত অবসর। তো, কীভাবে কোথা দিয়ে শুরু হবে সে ভাবনা? আসুন তাহলে, একটা মৌলিক প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যাক। কাকে বলে কল্পবিজ্ঞান?
রসগোল্লা কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তরে আমার এক পূর্ববঙ্গীয় বংশজাত বন্ধু হেসে বলেছিলেন, ‘আরে হেইডা আবার একখান কোশ্চেন অইল? রস অইতে অইব, আর গোল্লা অইতে অইব। তাইলেই অইয়া গেল গিয়া রসগোল্লা!’ আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকি, শুধু রস দিয়ে আবার গোল্লা হয় কখনও? রসটা থাকবে কোথায়, শূন্যে ভাসবে নাকি? উত্তরে বন্ধু খুবই শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘হেই জইন্যই তো তোমারে আলম্বুশ কই! রসগোল্লায় রসডাই প্রধান আকর্ষণ তাই অইডাই কইলাম। অইডা যে ছানা দিয়া তৈয়ার হেইডা তো ব্যাবাক লোকেই জানে, আবার মুখ ফুইট্যা কওনের কী আসে?’ কী আর বলব বলুন, শুনে তো অপ্রস্তুতের একশেষ! শেষে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসি, আচ্ছা, রসগোল্লা নিয়েই যদি এত গণ্ডগোল, তাহলে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে কী হবে?
অথচ দেখুন, আজকের দিনে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও তো উপায় নেই। ‘স্টার ওয়ার্স’ সিনেমায় লেজার রশ্মির তরোয়াল দিয়ে সেই ধুন্ধুমার যুদ্ধের কথাই বলুন, আর্থার সি ক্লার্কের ‘দি স্টার’-এর মত অসাধারণ গল্পের কথাই বলুন, স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘টু থাউজ্যান্ড ওয়ান : আ স্পেস ওডিসি’-র মত ক্লাসিক সিনেমায় সেই অনন্যসাধারণ স্বপ্নিল মহাকাশযাত্রার কথাই বলুন, আইজ্যাক আসিমভের গল্পের সেই বিদ্রোহী রোবোটের কথাই বলুন, কিম্বা আমাদের এই বাংলার ঘরের নায়ক বিমল আর কুমারের মঙ্গলগ্রহ অভিযানের কথাই বলুন — ‘সায়েন্স ফিকশন’ বা কল্পবিজ্ঞান ছাড়া আজ যেন জীবনটাই বৃথা। এই দেখুন না, আজকাল এই বাংলা ভাষায় ছোটদের জন্য যত পত্রিকা বেরোয়, তার প্রায় প্রতিটা সংখ্যাতেই থাকছে একটা দুটো কল্পবিজ্ঞানের গল্প — যদিও অবশ্য সে সবের মান সব সময় হয়ত খুব ভাল নয়। আচ্ছা ভাবুন তো, এক দুর্দান্ত হাইটেক গাড়ি চড়ে পাড়ি দিয়েছেন মহাশূন্যের গভীরে কিম্বা মহাসমুদ্রের অতলে, আর সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অভাবিত বিপদ, অজানা সব বিস্ময়। উফ্ফ্, গায়ে যেন কাঁটা দেয়, তাই না?
তাহলে এবার ভাবতে হয়, কাকে কল্পবিজ্ঞান বলে — কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে বলতে পারব, এইটা একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হয়েছে? হ্যাঁ, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে এখানে বিজ্ঞানটা থাকতে হবে, আর কল্পনাটাও থাকতে হবে। বিজ্ঞানের বা প্রযুক্তির প্রসঙ্গ নেই এ রকম গল্প বা সিনেমাকে মোটেই কল্পবিজ্ঞান বলা যাবে না, আর বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সব তথ্য ও তত্ত্বের দফারফা করলেও হবে না। কিন্তু আবার, জানা বিজ্ঞানের মধ্যে আটকে পড়ে থাকলেও হবে না, যা আজও ঘটেনি এমন পরিস্থিতিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নির্মাণ করতে হবে।
কিন্তু, স্রেফ এ দুটো হলেই হয়ে গেল? আর, একখানা নিটোল গল্প লাগেনা বুঝি? আমার সেই বন্ধু এ প্রশ্ন শুনলে হয়ত ফিচেল হেসে বলতেন, ‘কল্পবিজ্ঞানে যে একখান ভাল গল্প লাগে হেইডা তো ব্যাবাক লোকেই জানে, এই কথাডা আবার মুখ ফুইট্যা কওনের কী আসে?’
কল্পবিজ্ঞান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
কল্পবিজ্ঞান ঠিক কবে থেকে শুরু হল এ নিয়ে কল্পবিজ্ঞান-ঐতিহাসিকদের মধ্যে দু রকম মত পাওয়া যায়। একদল বলেন, এ আসলে অতি প্রাচীন ব্যাপার। কারণ, কল্পবিজ্ঞানের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য — যেমন সুদূরের পানে চেয়ে কোনও এক অ্যাডভেঞ্চার, নানা অভাবিত দৃশ্য দেখা, অকল্পনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়া, অদ্ভুত সব জন্তু-জানোয়ার, মানুষ এবং মানব-সদৃশ বিচিত্র সব প্রাণির মোকাবিলা করা — এইসব ব্যাপার অনেক প্রাচীন বইতেও আছে। দুহাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা গিলগামেশের কাব্য, ব্যাবিলন সভ্যতার এক অনবদ্য সৃষ্টি, এইরকম সব ঘটনায় ভরপুর। আবার দুশো খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাচীন সিরীয় গল্পকার ‘লুসিয়ান অফ সামোসাতা’ লিখেছিলেন চন্দ্রবাসী আর সূর্যবাসীদের মধ্যে শুক্রগ্রহের দখল নিয়ে এক মহাজাগতিক যুদ্ধের কাহিনী। এমন উদাহরণ হয়ত খুঁজলে আরও পাওয়া যেতে পারে। এধরনের কিছু উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও কাব্যগ্রন্থগুলোতেও। তবুও কিন্তু এগুলোকে সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য বলে মানতে সবাই রাজি নন, যেহেতু এগুলো লেখা হয়েছিল স্রেফ ‘ফ্যান্টাসি’ বা কল্পকাহিনী হিসেবেই। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। তাই আরেক দল ঐতিহাসিক বলতে চান যে, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য আসলে একান্ত আধুনিক কালেরই ব্যাপার, যার নাড়ির যোগ হল গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভবের সাথে। স্থান-কাল অতিক্রম করে সুদূরের কল্পনা করারও তো একটা প্রস্তুতি লাগে, সাহস লাগে। কে জোগাবে সে সাহস, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া!
সেই ষোড়শ শতকে জিওর্দানো ব্রুনো যখন ধর্মের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ঘোষণা করলেন যে, পৃথিবীর বাইরেও অসংখ্য গ্রহ আছে এবং সেখানে থাকতে পারে প্রাণও, তখন তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল কোপার্নিকাসের নতুন মহাকাশতত্ত্ব। ওই ষোড়শ শতকেই ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন ‘নিউ আটলান্টিস’, যাতে তিনি এক দ্রষ্টার চোখ দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কথা। আসল কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যের আভাস পাওয়া যেতে লাগল কিন্তু তখন থেকেই। ষোড়শ শতকের গোড়ায় টমাস মূর-এর ‘ইউটোপিয়া’, সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সিস গডউইন-এর ‘দ্য ম্যান ইন দ্য মুন’, আর অষ্টাদশ শতকে জোনাথন সুইফ্টের সুবিখ্যাত রচনা ‘গালিভার্স ট্রাভেল্স’, বা প্রবাদপ্রতিম যুক্তিবাদী দার্শনিক ভোলতেয়রের ‘ম্যাক্রোমেগাস’। এ রকম আরও আছে। কিন্তু, এ রকম লেখালিখিও আসলে ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
জনমানসে কল্পবিজ্ঞানের আসল প্রতিষ্ঠাটা এলো উনিশ শতকে, যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষমতা নিয়ে আশা ও আশঙ্কা দুটোই বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ নামক একটি মাত্র কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসই অমর করে দিয়েছিল মেরি শেলিকে, উনিশ শতকের গোড়াতেই। আর, আরেকটু পরের দিকে, জুলে ভার্ন ও এইচ জি ওয়েল্স্-এর মত লেখকেরা স্রেফ পেশাদার কল্পবিজ্ঞান-লিখিয়ে হিসেবেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলেন। তারপর বিশ শতকে কল্পবিজ্ঞান হয়ে উঠল সর্বব্যাপী, বিশেষত ‘সিনেমা’ নামক নতুন মাধ্যমটিকে ভর করে।
আর আজ এই একুশ শতকে, মহাজাগতিক প্রেক্ষিতে মানুষকে নিয়ে ভাবার জন্য বোধহয় শুধু এই একটিই শিল্পমাধ্যম আছে!
কল্পবিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ ও বাস্তবতা
কল্পবিজ্ঞানের প্রধান উপাদান তো বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত কল্পনা, আর বিজ্ঞানের নিজস্ব নির্মাণ যুক্তি-তথ্য-প্রমাণ দিয়ে। কিন্তু, তাই-ই যদি হয়, তাহলে তো ‘সায়েন্স ফিকশন’ বা কল্পবিজ্ঞানের লেখায় বিজ্ঞানের কিছু মৌলিক মূল্যবোধ অটুট থাকার কথা। না, যুক্তি তথ্য দিয়ে সব কিছু প্রমাণ করে তবেই কল্পবিজ্ঞান লিখতে হবে — এমন দাবি নিশ্চয়ই পাগলেও করবে না। কল্পবিজ্ঞান তো আর বিজ্ঞানের গবেষণা নয়, এ হল শিল্পীর সৃষ্টি। উপভোগের আনন্দটাই এখানে বড় কথা। এখানে থাকবে বিজ্ঞানকে ঘিরে অপূর্ব সব বিচিত্রসুন্দর কল্পনা, উত্তেজনাকর অভিনবত্ব, সুতীব্র সব স্বপ্নকল্প নির্মাণ। সে সব শৈল্পিক নির্মাণ আমাদের জানা-চেনা বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে নিশ্চয়ই আটকে পড়ে থাকবে না — কিন্তু আসল প্রশ্নটা সেখানেই — তাই বলে কি সুরক্ষিত থাকবে না আমাদের বিজ্ঞানচর্চার মৌলিকতম মূল্যবোধগুলোও?
‘বিজ্ঞানচর্চার মৌলিকতম মূল্যবোধগুলো’ বলতে এখানে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? এই যেমন ধরুন, যতই উদ্দাম কল্পনা থাকুক, প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যকে নস্যাৎ না করা। অলৌকিকতা-তন্ত্র-মন্ত্রকে প্রশ্রয় না দেওয়া। জগৎকে আমরা ক্রমাগত জানতে থাকব, এবং সে জ্ঞান শেষপর্যন্ত মানুষকে মঙ্গলের দিকেই নিয়ে যাবে — এই প্রত্যাশাকে জাগিয়ে রাখা। আমাদের কল্পবিজ্ঞান কি এগুলো সুরক্ষিত রাখতে পারছে? যদি পারে, তাহলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত ভিনগ্রহীদের অলৌকিক ক্ষমতার দরকার পড়ে কেন? কেন ‘স্টার ওয়ার্স’-এর হাইটেক স্পেস-এজ সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সম্রাট আর মধ্যযুগীয় ‘নাইট’-রা? কেনই বা তবে প্রফেসর শঙ্কু প্ল্যানচেট করে ভূত নামান? কেনই বা আর্থার সি ক্লার্কের বিখ্যাত গল্পে ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম জপ করা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যেতে থাকে বিশ্বচরাচর? এ কি স্রেফ রোমাঞ্চলাভের আশায় বাস্তব থেকে মুখ ফেরানো, অথবা আসলে, কোনও এক গূঢ় অর্থে, বাস্তবেরই ছবি? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রচণ্ড উন্নতির বিপরীতে আমাদের ব্যক্তিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক জীবনে যে অযুক্তি অন্ধত্ব অসহায়তা কর্তৃত্ব হিংস্রতা প্রতারণার দাপট, এ কি তবে সেই বাস্তবেরই এক অনিচ্ছাকৃত উল্টো প্রতিবিম্ব — কল্পবিজ্ঞানের আয়নায়?
একটা কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু একদা গঙ্গানদীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’, এবং গঙ্গানদী নাকি তাঁকে উত্তর দিয়েছিল, ‘মহাদেবের জটা হইতে’। একই প্রশ্ন তিনি যদি আজ কল্পবিজ্ঞানকে করতেন, সে হয়ত তাঁকে উত্তর দিত, ‘আধুনিক মানুষের স্বপ্ন ও আশঙ্কা হইতে’!
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের প্রথম লেখক জগদীশচন্দ্র কি সে উত্তরে সন্তুষ্ট হতেন? কে জানে!
প্রধান তথ্যসূত্র
১। ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য গল্প, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ, ১৯৮৭
২। Science Fiction : A Very Short Introduction, David Seed, Oxford University Press, 2011
৩। প্রোফেসর শঙ্কু, তাঁর ‘বিজ্ঞান’ এবং বাঙালির বিজ্ঞানবোধ, দেবাশিস্ ভট্টাচার্য, ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ আন্তর্জাল পত্রিকা, ০১/০১/২০২০
[লেখাটি সলিলদা, মানে সলিল বিশ্বাসের স্মৃতিতে উৎসর্গ করলাম। অপ্রথাগত ও বয়স্ক শিক্ষার তত্ত্ব ও প্রয়োগে তিনি একটি অতি পরিচিত নাম, কিন্তু তিনি যে কল্পবিজ্ঞানের একজন সেরা লেখক ও অনুবাদক, এ কথা অনেকেই জানেন না। কল্পবিজ্ঞান চর্চার সূত্রে তাঁর সান্নিধ্য ও স্নেহ আমি লাভ করেছিলাম শেষ কয়েক বছর। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অতি সম্প্রতি। একটি তুচ্ছ লেখা ছাড়া তাঁর স্মৃতিকে আর কীই বা দিতে পারতাম?]
খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।
অনেক ধন্যবাদ। যে কোনও পরামর্শ-মতামত-বিশ্লেষণের সাগ্রহ অপেক্ষায়।
খুবই ভাল লগলো!
Food for thought
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।