সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

দুই তরুণ: সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা

দুই তরুণ: সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

ডিসেম্বর ২৯, ২০২১ ১২৯৫ 7

(এই প্রবন্ধের সহলেখক হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অনির্বাণ কুন্ডু। অধ্যাপক কুন্ডু মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী এবং ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সের ফেলো)     

(১)

সত্যেন্দ্রনাথ বসু

         কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের সব থেকে পরিচিত ত্রয়ীর অন্যতম হলেন সত্যেন্দ্রনাথ। রামন বা ডি এম বোস শিক্ষক হিসাবেই যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু ক্লাস যখন শুরু হয় তখন তাঁদের দুজনের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না। তখন শিক্ষক হিসাবে ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ ও যোগেশচন্দ্র মুখার্জির পাশাপাশি কয়েকজন গবেষক ছাত্রকেও ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, শিশিরকুমার মিত্র ও অবিনাশচন্দ্র সাহা। প্রথম তিনজনকে স্যার আশুতোষ নিজে ডেকে পড়ানোর দায়িত্বও দিয়েছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথ অবশ্য পড়ানোর সুযোগ পাননি, আগেই বলেছি যে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়। এই পর্বে আমরা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে ১৯১৬ থেকে ১৯২১ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, এরপর চলে যান ঢাকাতে। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ফেরেন ১৯৪৫ সালে। সত্যেন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি যে বিশেষ গবেষণাটির জন্য, তা কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে করা নয়।

         বাঙালী পাঠকের কাছে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর বাংলা জীবনীগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জয়ন্ত বসুর লেখা ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু: এক বহুমুখী প্রতিভা’, পূর্ণিমা সিংহের লেখা ‘বিজ্ঞানসাধনার ধারায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু’ এবং দেবীপ্রসাদ রায়ের ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসুঃ চেনা বিজ্ঞানী, অজানা কথা’। আমাদের একজন (গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়) ‘সত্যেন বোস’ নামে তাঁর একটি ছোট জীবনী লিখেছি। হিন্দু স্কুল থেকে  ম্যাট্রিকে পঞ্চম স্থান, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পরীক্ষাতে প্রথম, গণিতে বিএসসি অনার্স ও মিশ্র গণিতে এমএসসি পরীক্ষাতে প্রথম, এমএসসি পরীক্ষাতে রেকর্ড নাম্বার, এই সবই বহুচর্চিত। ১৯১৫ সালে তিনি ও মেঘনাদ সাহা এমএসসি পাস করেছিলেন। তারকনাথ পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডি ১৯১৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আপেক্ষিকতাবাদ, মেঘনাদ সাহার ক্ষেত্রে বিকিরণ তত্ত্ব এবং শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে ধাতুর পাউডারের তড়িৎ পরিবাহিতা বিষয়ে গবেষণার জন্য মাসিক ১৫০ টাকা করে স্কলারশিপ অনুমোদন করে। দশদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট প্রথম দুজনের প্রয়োজনীয় বই কেনার জন্য ৫০০ টাকা এবং শৈলেন্দ্রনাথের গবেষণার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ২০০০ টাকা অনুমোদন করে। 

         ১৯ মে, ১৯১৬ সিন্ডিকেটের সভাতে ঘোষ ও পালিত জয়েন্ট বোর্ডের মিটিঙের আলোচনা পেশ হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘আমরা সুপারিশ করছি বাবু সত্যেন্দ্রনাথ বসু, এমএসসি  ও বাবু মেঘনাথ (তদেব) সাহা এমএসসি, এদের পদার্থবিদ্যাতে পালিত গবেষক বৃত্তি চালু থাকুক এবং তাদের বৃত্তি ১ জুলাই ১৯১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হোক। তাদের ডিগ্রি মিশ্র গণিতে, কিন্তু তাদের পদার্থবিদ্যাতেও যথেষ্ট জ্ঞান আছে। বিএসসি পরীক্ষাতে পদার্থবিদ্যা তাদের বিষয় ছিল। এমএসসি ছাত্রদের গাণিতিক পদার্থবিদ্যা পড়ানোর জন্য তাদের উপর নির্ভর করা যেতে পারে, একই সঙ্গে তারা ফলিত গণিত বিভাগের কাজেও অংশ নিতে পারবে।’

         সিন্ডিকেট সেনেটের কাছে সুপারিশ করে যে মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথকে ১ জুলাই ১৯১৬ থেকে দু’বছরের জন্য পালিত অধ্যাপকের সহকারী নিয়োগ করা হোক। মনে রাখতে হবে যে পালিত অধ্যাপক পদে রামন যোগ দেবেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে। বোঝাই যায় যে মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ স্বাধীনভাবে পড়াবেন ও গবেষণা করবেন এটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

বিজ্ঞান কলেজে সত্যেন্দ্রনাথ

         দুজনেই একসঙ্গে পদার্থবিদ্যা ও ব্যবহারিক গণিত বিভাগে পড়াতেন ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ কোন কোন বিষয় পড়াতেন তা দ্বিতীয় পর্বেই আমরা দেখেছি, তাঁর তৈরি কিছু প্রশ্নও সেই অধ্যায়ে দেওয়া আছে। ব্যবহারিক গণিত বিভাগে সেই সময় মিশ্র গণিত নামে এমএসসি পড়ানো হত। প্রথম যুগে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সীমারেখাটা খুব সুস্পষ্ট ছিল না। ১৯১৯ সালে বিজ্ঞান কলেজের গভর্নিং বডিতে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ যথাক্রমে পদার্থবিদ্যা ও ব্যবহারিক গণিত বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু রেজিস্ট্রার অফিসের নথিতে দুজনকেই পদার্থবিদ্যা বিভাগে দেখানো হয়েছে। ১৯১৯ সাল থেকে সত্যেন্দ্রনাথের মতো গবেষক ছাত্র যাঁরা ক্লাস নিতেন তাঁদের লেকচারার বলে অভিহিত করা হয়, বছর বছর ২৫ টাকা ইনক্রিমেন্টও দেওয়া হয়।

         এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বই সুপারিশ করেনি, ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে কী পড়তে হবে তা ঠিক করত। ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে তারা মৌলিক গবেষণাপত্র থেকে বিভিন্ন বিষয় পড়বে। সে সময় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বই বিশেষ ছিল না, যে কটি ছিল তাদের অধিকাংশই জার্মান ভাষায় লেখা। মৌলিক গবেষণাপত্রসমূহের একটা বড় অংশ তখন জার্মান ভাষায় লেখা হত। এই পরিস্থিতিতে দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে ভর্তি হন, মেঘনাদ অবশ্য ভাষাটা কিছুটা জানতেন। সেই ক্লাসে তাঁদের সহপাঠী ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।

         সত্যেন্দ্রনাথের সারা জীবনে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা মাত্র সাতাশ, তিনি এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা এই পর্বের শেষে আসবে। এই সাতাশটির মধ্যে পাঁচটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্বে প্রকাশিত। একটি গবেষণা মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ একত্রে করেছিলেন, সেটি গ্যাসের অবস্থা সমীকরণ (Equation of State) বিষয়ে। আজও সেটি স্নাতকস্তরে পড়ানো হয়। তাপগতিবিদ্যা প্রয়োগ করে সুপরিচিত ভ্যান ডার ওয়ালস সমীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন তাঁরা করেছিলেন। এটিই সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্র, প্রকাশিত হয়েছিল ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ১৯১৭ সালে।

         কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে অপর একটি কাজের উল্লেখ করা যেতে পারে। এটিও ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯২০ সালে। এটি সত্যেন্দ্রনাথের একক প্রয়াস।  নিল্‌স বোর ও আর্নল্ড সাতাশসমারফেল্ডের পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে কোনো পরমাণুর শক্তিস্তর নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি তিনি নির্ণয় করেছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বে তাঁর এটি প্রথম পদক্ষেপ, ভবিষ্যতে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি এই বিষয়েই আসবে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদের জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন এই গবেষণাপত্রটি নির্বাচকের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

         মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এই সময় করেছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইন ও হেরম্যান মিনকাওস্কির বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি তাঁরা এই সময় মূল জার্মান থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানচর্চার জনক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। পৃথিবীতে এর আগে এগুলির ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। এই অনুবাদ প্রকাশের জন্য ডি এম বোসের মারফত তাঁরা আইনস্টাইনের থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন।

কলকাতা থেকে ঢাকা

         বাংলাদেশের দ্বিতীয় নগরী ঢাকাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েচিল, তাঁর প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন ফিলিপ হার্টগ। তিনি সত্যেন্দ্রনাথের সম্পর্কে জানতেন, তাই কলকাতাতে এসে তাঁকে ডেকে পাঠান। এর পর ১৯২১ সালের ১৫ জানুয়ারি হার্টগকে লেখা এক চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের রিডার পদের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি ন্যূনতম বেতন চেয়েছিলেন চারশো টাকা, একই সঙ্গে তিনি দু বছর পর স্থায়ীকরণের শর্ত রাখেন। বোঝাই যায় যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী চাকরি তাঁর ভালো লাগছিল না। তিনি এর আগে বিদেশে যাওয়ার জন্য গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তিরও জন্যও আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সেই বৃত্তি বিবাহিতদের দেওয়া হত না। এমএসসি পড়ার সময়েই সত্যেন্দ্রনাথ বিয়ে করেছিলেন।

         ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে মেঘনাদও আবেদন করেছিলেন। তিনি তখন বিদেশে, তাই সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ কেউই সম্ভবত অন্যের আবেদনের খবরটি জানতেন না। ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার জেনকিন্স মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ দুজনেরই প্রশংসা করে সত্যেন্দ্রনাথকেই এগিয়ে রাখেন। এর পরই চারশো টাকা বেতনে রিডার পদে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রনাথ, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পঞ্চাশ টাকা। তবে ঠিক কত টাকা সত্যেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় তখন তৈরি হচ্ছে, বেতনক্রম নিয়ে আলোচনা চলছে। অনুমান করি মাইনে অনেকটাই বেশি হয়েছিল, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি জানাচ্ছে যে সে সময় রিডারদের ন্যূনতম বেতন ছিল সাতশো টাকা।

         ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় ১৯২১ সালের ১৫ জুলাই। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগের বিষয়টি মোটেই সহজ হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার সরকারকে এক কড়া চিঠিতে জানায় যে সত্যেন্দ্রনাথ ও আরো কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ সময়ের অফিসার, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময় যথাযথ নিয়ম মেনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাননি। আশুতোষ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা রত্নগুলিকে ছাড়তে চাইছিলেন না, কিন্তু সকলের স্থায়ী চাকরি বা বেতন বৃদ্ধি ছিল তাঁরও ক্ষমতার অতীত।

         সত্যেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর বিষয়টা নিয়ে এগোয়নি। অন্যদের মধ্যে ছিলেন রসায়নে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁদের ছাড়া  নিয়ে গভর্নিং বডির মিটিঙে আশুতোষের সঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের তীব্র বিতণ্ডা হয়েছিল। প্রফুল্লচন্দ্র জ্ঞানেন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে সেই বিবরণ দিয়ে লিখেছিলেন, ”বড়’ জ্ঞানকে (জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ) লইয়া স্যার আশুতোষ তোলপাড় করিতেছেন breach of faith, contract, ethical principles, etc…. রমেশ মজুমদার, হরিদাস ভট্টাচার্য, সত্যেন প্রভৃতি ঢাকায় যাইতেছেন। … ইহাদিগকে ধরতে-ছুতে পারেন না; কেবল জ্ঞানদ্বয় ও মেঘনাদকে moral obligation ও ethics-এর দোহাই দিয়া আটক করিতে চান।

         মেঘনাদ, জ্ঞানচন্দ্র ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ তিনজনেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন।  আমরা দেখেছি আশুতোষ খয়রা অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে মেঘনাদ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে বিদেশবাসের সময়কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া মাইনে ফেরত দিতে হয়েছিল।

কলকাতাতে দ্বিতীয় পর্ব

         সত্যেন্দ্রনাথ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবেন ১৯৪৫ সালে, গুরুপ্রসাদ সিংহ (খয়রা)  অধ্যাপক পদে তিনি যোগ দেবেন সে বছরের ১ অক্টোবর। বিধুভূষণ রায়ের মৃত্যুর ফলে পদটি শূন্য  হয়েছিল। সেই সময় দাঙ্গার জন্য তিনি আর ঢাকাতে নিরাপদ বোধ করছিলেন না। এর আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৩৮ সালে তাঁকে ডি এম বোসের পদত্যাগের পরে শূন্য পালিত অধ্যাপক পদে আনার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পদে আসেন মেঘনাদ সাহা। বেশ কয়েকবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক পদের নির্বাচক মণ্ডলীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ; আমাদের লেখাতে বিভিন্ন জায়গায় সেই তথ্য পাওয়া যাবে।

         বিধুভূষণ রায়ের সময়ে খয়রা ল্যাবরেটরিতে মূলত এক্স রে গবেষণা হত, সত্যেন্দ্রনাথ সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্ররা মিলে এক্স রে ক্যামেরা, ডিফারেনশিয়াল থার্মাল অ্যানালাইজার,  স্ক্যানিং স্পেকট্রোফটোমিটারের মতো আধুনিক যন্ত্র বানিয়েছিলেন।  তাঁর কাছে গবেষণা করে পূর্ণিমা সিংহ ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম মহিলা হিসাবে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছিলেন, কিন্তু তা স্বাধীনতার পরের ঘটনা। আমাদের আলোচ্য সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি। সেই সময় কলকাতা তথা দেশের পরিস্থিতি বিচার করলে তা আশ্চর্য মনে হবে না, বিশেষ্ করে সত্যেন্দ্রনাথের মতো গবেষণাপত্র প্রকাশে উদাসীন বিজ্ঞানীর জন্য তো নয়ই।

         সত্যেন্দ্রনাথের পড়ানো নিয়ে একটা কথা আজকের দিনে খুব প্রাসঙ্গিক। আমরা জানি তিনি মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান প্রসারের উপর গুরুত্ব দিতেন, সেজন্য ১৯৪৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। বিভাগে দ্বিতীয় পর্বে তিনি অনেক সময়েই এমএসসি ক্লাসে পড়াতেনও বাংলাতে। এই সময়ে গবেষণা ও পড়াশোনার বাইরে বিভাগে তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে পরে আলোচনার ইচ্ছা আছে।

বিজ্ঞান গবেষণা ও সত্যেন্দ্রনাথ

         সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বখ্যাতির পিছনে আছে তাঁর আবিষ্কৃত পরিসংখ্যান। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই নতুন পরিসংখ্যান আবিষ্কার করেছিলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই কাজ করা হয়নি, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের আলোকে পদার্থবিদ্যা বিভাগও আলোকিত হয়েছে। তাই ১৯২৪ সালের সেই বিখ্যাত গবেষণা বিষয়ে অল্প কিছু কথা বলা আবশ্যক। 

         দুটি গবেষণাপত্রই সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়েছিলেন, আইনস্টাইনই সেগুলি অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।    সত্যেন্দ্রনাথ কৃষ্ণ বস্তু সংক্রান্ত প্ল্যাঙ্কের সূত্রকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। যে বস্তু তার উপরে পড়া পড়া সমস্ত তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করে তাকে বলে কৃষ্ণ বস্তু। এই কৃষ্ণ বস্তু থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বিকিরণও হয়, তাকে বলে তাপীয় সাম্যাবস্থার বিকিরণ। চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা থেকে কৃষ্ণ বস্তুর কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কত পরিমাণ বিকিরণ হবে তার সূত্র নির্দিষ্ট করা গেল। কিন্তু বিকিরণ মাপতে গিয়ে সমস্যা দেখা দিল। কোনোভাবেই একটা সূত্র ব্যবহার করে বিকিরণের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা গেলো না।

       ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক একটা সমাধান দিলেন, তিনি বললেন যে তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ যে কোনো পরিমাণ শক্তি নিয়ে আসতে পারে না। যদি ধরে নিই সেই তরঙ্গের শক্তি একটা নির্দিষ্ট মানের গুণিতকে আসে তাহলে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। শক্তি একটা নিদিষ্ট প্যাকেটের মাপে আসে। শক্তির পরিমাণ পূর্ণ সংখ্যায় প্যাকেটে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্যাকেটকে ভাঙা যাবে না। এই প্যাকেটের নাম হল কোয়ান্টাম। আলো এক ধরনের তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। পরে আইনস্টাইন ও আরও অনেকের গবেষণার ফলে দেখা যায় এই প্যাকেট কণিকার মতো কাজ করে, আলোর সেই কণার নাম দেওয়া হয়েছিল ফোটন।

         প্ল্যাঙ্কের সূত্র পরীক্ষাতে পুরোপুরি প্রমাণিত হলেও তার তাত্ত্বিক দিকটা ছিল খুবই গোলমেলে।  আলোকে সেখানে একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ ধরে নিতে হয়। আইনস্টাইন, উলফগ্যাং পাউলি সহ অনেকে নানাভাবে প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ণয় করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের আগে কেউই সফল হননি। সত্যেন্দ্রনাথ শুরুই করেছিলেন আলোকে কণা বলে ধরে নিয়ে, তিনি সাম্যাবস্থায় কোন শক্তির আলোর কণা কতগুলো থাকবে তা হিসাব করেছিলেন। এখানে তরঙ্গের কোনো কথাই আসে না। বোসের গবেষণাপত্রটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন আইনস্টাইন, সারা জীবন তিনি প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে সৌন্দর্যের সন্ধান করেছেন। এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘The Indian Bose has given a beautiful derivation of Planck’s law…’

         তাঁর গবেষণাপত্রে আরও একটা ধারণা প্রচ্ছন্নভাবে ছিল, তা হল দুটি একই শক্তির ফোটন কণাকে কোনোভাবেই আলাদা করে বোঝা যাবে না। একে বলে কণার অভিন্নতা। শুনতে খুব সামান্য মনে হলেও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য বিরাট। পরবর্তীকালে সমস্ত মৌলিক কণার ক্ষেত্রে এই অভিন্নতা প্রমাণিত হয়েছে -– দুটি ইলেকট্রনও অভিন্ন, দুটি প্রোটনও তাই।        

         সত্যেন্দ্রনাথ ভরহীন ফোটন কণার ক্ষেত্রে তাঁর পরিসংখ্যানকে প্রয়োগ করেছিলেন, আইনস্টাইন সেটিকে ভরযুক্ত কণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। সেজন্য এখন আমরা তাকে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান বলি।  দু’ধরনের মৌলিক কণা আছে। একদল হল বোসন, তারা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। এক শক্তিস্তরে যত খুশী সংখ্যায় একই ধরনের বোসন থাকতে পারে। ইলেকট্রন বা প্রোটন হল ফের্মিয়ন, তারা সে পরিসংখ্যান মেনে চলে তাকে বলে ফের্মি-ডিরাক। এক শক্তিস্তরে একটার বেশি একই ধরনের ফের্মিয়ন থাকতে পারে না। পল ডিরাক ও এনরিকো ফের্মি সেই পরিসংখ্যান আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তা সত্যেন্দ্রনাথের দুই বছর পরে।

         পুরানো কোয়ান্টাম তত্ত্বের সেরা চার আবিষ্কারের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের এই গবেষণাটিকে ধরা হয়, অপর তিনটি হল প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইন কর্তৃক আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা ও নিলস বোরের পরমাণুর মডেল। বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান হল প্রথম কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান। পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমীকরণ আবিষ্কারে সোপানের কাজ করেছিল সত্যেন্দ্রনাথের এই গবেষণা।

এক উদাসীন বিজ্ঞানী

         খ্যাতি বিষয়ে উদাসীন সত্যেন্দ্রনাথের জীবনে দুটি ঘটনার কথা স্মরণ করি। আমরা এখন জানি স্পিন মৌলিক কণার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম। স্পিন কী তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই, প্রথম এই স্পিনের কথা পাই জর্জ উলেনবেক ও স্যামুয়েল গোউডস্মিডের লেখাতে ১৯২৫ সালে। তার আগের বছর সত্যেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রে ফোটন কণার স্পিনের কথা ছিল, কিন্তু অনুবাদের সময় আইনস্টাইন সেটি বাদ দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তা নিয়ে কখনো অনুযোগ করেননি। গল্পটা বলার সময় ছাত্ররা বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি বলতেন আবিষ্কারটিই আসল, ব্যক্তি নয়। অবশ্য সে সময় স্পিন সম্পর্কে যা ধারণা ছিল, তা বর্তমানে অনেকটাই পাল্টে গেছে।

         রামন বিক্ষেপের কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি। সেখানে, কোনো অণু থেকে আলোর বিক্ষেপের পর ফোটনের শক্তি পালটে যায়, একে বলে অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ। রামন তখনই বলেছিলেন যে এক্স-রশ্মি দিয়েও এই বিক্ষেপ দেখতে পারা উচিত। ১৯২৮ সালে রামনের ছাত্র কে এস কৃষ্ণন বলেন যে তিনি এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপ দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু খুব সম্ভবত তিনি যেটা দেখেছিলেন সেটা কম্পটন বিক্ষেপের অংশ, রামন বিক্ষেপ নয়। আরো অনেকেই দেখার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি। পৃথিবীতে প্রথম সন্দেহাতীতভাবে এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপ দেখার কৃতিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষকের। তাঁর নাম কমলাক্ষ দাসগুপ্ত। ১৯৫০ সালে পদার্থবিদ্যা বিভাগের খয়রা অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাগারে তিনি এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে নেচার পত্রিকায় তাঁর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কমলাক্ষ একাই প্রবন্ধ দুটির লেখক। যে জিনিস দেখার জন্যে তার আগের কুড়ি-বাইশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, যে প্রবন্ধ সরাসরি নেচারের মত পত্রিকায় প্রকাশিত হবে, সেখানেও সত্যেন্দ্রনাথ, যাঁর গবেষণাগারে কমলাক্ষ গবেষণা করেছেন, যিনি নানারকম ভাবে সাহায্য করেছেন, এবং কমলাক্ষ প্রবন্ধে কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর নামোল্লেখ করেছেন – তাঁর নিজের নামটি প্রবন্ধকার হিসেবে দিলেন না। অথচ চাইলেই দিতে পারতেন। এমনকি ছাত্রকে কোনো কৃতিত্ব না দিয়ে নিজেই পুরো কৃতিত্বের দখল নিতে পারতেন, কলকাতাতেই এরকম একাধিক উদাহরণ আছে। কমলাক্ষ পরে আমেরিকা থেকে এক্স-রশ্মি রামন বিক্ষেপ নিয়ে আরো উন্নত মানের গবেষণা করেন। ইনিও পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন, কিন্তু সে আমরা যে সময় নিয়ে কথা বলছি তার অনেক পরের গল্প।

(২)

মেঘনাদ সাহা (প্রথম যুগ)

         পদার্থবিদ্যা বিভাগের তিন মহারথীর মধ্যে মেঘনাদ সাহার নাম শেষে এলো বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানচর্চাতে  আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। প্রায়শই আমরা বাঙালীর বিজ্ঞান গবেষণার  ইতিহাসে  দুই সহপাঠী মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি, কিন্তু তাদের জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সত্যেন্দ্রনাথ দেশের রাজধানী কলকাতা নগরীর মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, জাতিবিভক্ত হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের অন্তর্ভুক্ত, আত্মপ্রচারে পরাঙ্মুখ। মেঘনাদের পরিবার অত্যন্ত গরীব, ছেলেকে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। পূর্ব বাংলাতে, বর্তমান বাংলাদেশে এক গণ্ডগ্রাম শেওড়াতলিতে জন্ম, যেখানে চতুর্থ শ্রেণির পরে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাঁর বাবার ছিল একটা মুদির দোকান, অন্য মানুষের দয়ার দান ও ছাত্রবৃত্তি সম্বল করে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। জাতপাতের বিচারে তিনি নিচু জাতের মানুষ, হিন্দু হস্টেলে সকলের সঙ্গে একসারিতে বসে খাওয়ার অধিকার তাঁর ছিল না। তাঁর সহায় ছিল প্রতিভা, আত্মবিশ্বাস, প্রবল জেদ ও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

         মেঘনাদ সাহার জীবনও পাঠকের কাছে সুপরিচিত। বাংলাতে লেখা জীবনীর মধ্যে অত্রি মুখোপাধ্যায়ের ‘অবিনাশ মেঘনাদ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের মধ্যে একজন (গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়) তাঁর একটি ছোট জীবনী লিখেছেন। ঢাকার জুবিলি হাই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইণ্টারমিডিয়েট সায়েন্সে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করা  পর্যন্ত তাঁর ও সত্যেন্দ্রনাথের জীবন সমান্তরাল ধারাতে প্রবাহিত হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটে তিনি তৃতীয়;  গণিতে অনার্স ও মিশ্র গণিতে এম এসসি পরীক্ষাতে তাঁর স্থান ছিল সত্যেন্দ্রনাথের ঠিক পরেই।  মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বেন ১৯২৩ সালে, সত্যেন্দ্রনাথের দু’বছর পরে। যাবেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার কলকাতাতে তিনি ফিরে আসবেন ১৯৩৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবনের দুই অধ্যায়কে আমরা দুই ভাগে আলোচনা করব। এই পর্বে থাকবে এক তরুণ গবেষকের নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কাহিনি। এই লেখার একেবারে শেষে পরিণত মেঘনাদ, ছাত্রদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরির তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াস ও  তার সাফল্যের খতিয়ান নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে।

বিজ্ঞান কলেজ

         পালিত গবেষক, পরে পালিত অধ্যাপকের সহকারী এবং তারও পরে পদার্থবিদ্যা বিভাগে গুরুপ্রসাদ সিংহ (খয়রা) অধ্যাপক হিসাবে ১৯১৭ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে মেঘনাদ তেইশটি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন। কোনো মাপকাঠিতেই এই সংখ্যাটা তুচ্ছ করার মতো নয়। মনে রাখতে হবে আজকালকার গবেষক ছাত্রদের মতো গাইড বা সুপারভাইজর তাঁর ছিল না; তিনি যা করেছেন মূলত নিজের চেষ্টাতেই করেছেন। দু’একটি ক্ষেত্রে তাঁর কোনো সহযোগী ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে করা গ্যাসের অবস্থার সমীকরণ বিষয়ে গবেষণার কথা আগেই বলেছি। কলকাতায় বসেই এই সময়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত তাপ আয়নন সমীকরণের মূল কাজটি করেছিলেন, যদিও যখন সে বিষয়ে গবেষণাপত্রগুলি প্রকাশিত হয় তখন তিনি বিদেশে। বিকিরণের চাপ সংক্রান্ত আরো একটি বিখ্যাত গবেষণাও এই সময়ের। এই দুটি কাজই তাঁকে পৃথিবীর সেরা জ্যোতির্পদার্থবিদদের মধ্যে স্থান করে দিয়েছিল। এই অধ্যায়ের শেষে আমরা বিশেষ করে প্রথম পর্বে কলকাতাতে মেঘনাদের বিজ্ঞান গবেষণার দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করব। 

         কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের জন্য গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৃত্তি ছিল প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি, যে কোনো বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য এই বৃত্তি দেওয়া হত। ১৮৬৬ সাল থেকে বম্বের ব্যবসায়ী প্রেমচাঁদ রায়চাঁদের অর্থানুকূল্যে এই বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছিল। তিন বছরের জন্য বৃত্তি দেওয়া হত, বার্ষিক পরিমাণ ছিল ১৪০০ টাকা। মেঘনাদ ১৯১৭ সালে আবেদন করেছিলেন, তাঁর নাম বিবেচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি সেই বছর তা পাননি। দুই বছর পরে আবার আবেদন করেন, সঙ্গে ছিল তিনটি গবেষণাপত্র; On the pressure of light, On radiation pressure and quantum theory, এবং On selective radiation pressure and the radiative equilibrium of the Solar atmosphere। তিনটি গবেষণাপত্রই বর্তমানে বিশেষ পরিচিত। এই বার তিনি বৃত্তি  পেলেন, সেই অর্থ পরের দু’বছর বিদেশবাসের সময়ে তাঁর কাজে লেগেছিল। এই বৃত্তির সাহায্যে গবেষণা সম্পন্ন করার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনাট স্বর্ণপদকও মেঘনাদ পেয়েছিলেন।

         মেঘনাদ ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএসসি ডিগ্রির জন্য থিসিস On the fundamental law of electrical action জমা দিয়েছিলেন। সিন্ডিকেট পরীক্ষক হিসাবে তিনজনের নাম স্থির করে — আওয়েন রিচার্ডসন, আলফ্রেড পোর্টার এবং নর্মান ক্যাম্পবেল। প্রথম দুজন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো, রিচার্ডসন ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পাবেন। ক্যাম্পবেল রাজি হননি, তিনি রিচার্ডসনের সঙ্গে আলোচনা করে অন্য কয়েকজনের নাম পাঠান, সিন্ডিকেট তার থেকে বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের নামে অনুমোদন দেয়। কিন্তু ক্যাম্পবেল তারপরেই লেখেন যে এডিংটনকে ১৯১৯ সালের জুলাই মাসের আগে পাওয়া যাবে না, তার জায়গায় এবেনেজার কানিংহামকে পরীক্ষক করা হোক।  তিনিও রয়্যাল সোসাইটির ফেলো; সিন্ডিকেট সম্মত হয়। পরীক্ষকদের রিপোর্ট আসার পরে ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে মেঘনাদকে ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। তিনি বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম ডিএসসি। 

         এখানে একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। এডিংটনকে জুলাই মাসের আগে পাওয়া যাচ্ছিল না, কারণ তিনি তখন সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের পাশ দিয়ে আসা আলো কতটা বাঁকে তা মেপে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পরীক্ষার কাজে ব্যাস্ত ছিলেন। সেই গ্রহণ হয়েছিল ১৯১৯ সালের ২৯ মে, এডিংটন তা পর্যবেক্ষণের জন্য আফ্রিকা গিয়েছিলেন। এডিংটনের পর্যবেক্ষণ আইনস্টাইনের পক্ষে রায় দেওয়ার পরেই সাধারণ  মধ্যে আইনস্টাইনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথমবার বিদেশে

         ফিরে আসি মেঘনাদের কথায়। ১৯১৯ সালেই তিনি বিদেশ যাওয়ার জন্য গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি পেয়েছিলেন, তিনি লিখেছিলেন তিনি Radiation – with special reference to emission of light from metallic filaments and practical problems of economic illumination নিয়ে গবেষণা করবেন। বার্লিন, প্যারি বা লন্ডন, এই তিন জায়গার তিনটি ল্যাবরেটরির কোনো একটিতে তাঁর কাজ করার কথা ছিল শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডনে কিংস কলেজে আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন, যদিও বৃত্তির আবেদনে সেই কলেজের নাম ছিল না। গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বা প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি একত্রেও দীর্ঘ বিদেশবাসের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না, বিশেষ করে মেঘনাদকে যখন তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের খরচের একটা বড় অংশ দিতে হত। বিদেশ যাত্রার সময় তাঁকে অগ্রজ বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার করতে হয়েছিল।

         মেঘনাদ ইংল্যান্ড যান ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। বিদেশ যাওয়ার সময় স্যার আশুতোষ তাঁকে এক শংসাপত্র দিয়েছিলেন, সেখানে লিখেছিলেন যে তিনি সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন, তিনি যে সমস্ত বিষয়  পড়িয়েছেন তার মধ্যে আছে তাপ ও তাপগতিবিদ্যা, বিকিরণ ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আলোকবিদ্যা, উদস্থিতিবিদ্যা ও পৃথিবীর আকার। শেষেরটি ব্যবহারিক গণিত বিভাগে পড়ানো হত। আমরা দেখব যে প্রথম দুই বিষয়ের সঙ্গে তাঁর গবেষণার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। আশুতোষ এও লিখেছিলেন যে বিদেশে মেঘনাদের গবেষণার উপর তিনি লক্ষ্য রাখবেন, তাঁর আশা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম তিনি অক্ষুণ্ণ রাখবেন।

         লক্ষ্য রাখাটা কথার কথা ছিল না, বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশে পাঠানো গবেষকদের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রাখত। মেঘনাদ ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ১২৫ পাউন্ডের দরখাস্ত করেছিলেন। এই সামান্য অর্থের সঙ্গে ছিল সেই সময়ের দুই সেরা বিজ্ঞানীর সুপারিশ — ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসন ও নিউক্লিয়াসের আবিষ্কর্তা আর্নেস্ট রাদারফোর্ড! হাই কমিশনার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদনটি পাঠিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করেন। দেশপ্রেমী স্যার আশুতোষ পরের দিনই এক চিঠিতে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন না করার জন্য তিরস্কারের সুরে লেখেন বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত অসুবিধা সত্ত্বেও তার সন্তানদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি লেখেন, কখন সন্তানরা বুঝবে যে মাতৃসম শিক্ষায়তনের (alma mater) চরম সঙ্কটের সময় তার পাশে দাঁড়ানো তাদের কর্তব্য? 

         ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে সঞ্চিত নক্ষত্রে বর্ণালী সংক্রান্ত তথ্য মেঘনাদের গবেষণার উন্নতিতে কাজে লেগেছিল, কিন্তু তিনি যে সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছিলেন সেই সুযোগ ইংল্যান্ডে ছিল না। ফাউলারের পরামর্শে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ালথার নার্নস্টের ল্যাবরেটরিতে যান পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন গ্যাসের আয়নন বিভব মাপা, তাঁর সমীকরণে তা কাজে লাগে।

         সত্যেন্দ্রনাথের ঢাকা যাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোভাব আমরা দেখেছি। স্যার আশুতোষ তাঁর সেরা ছাত্রদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। তেমনই এক চেষ্টা ছিল খয়রা অধ্যাপক পদের সৃষ্টি। এর আগেই সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ১১ মে ২০২১ এক চিঠিতে স্যার আশুতোষ মেঘনাদকে একটি অধ্যাপক পদের সম্ভাবনার কথা বলেন। তাঁর গবেষণার জন্য জার্মানি থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে কত খরচ হবে তা জানতে চান; আশুতোষ তাহলে সেই অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করবেন। জুন মাসের ৩০ তারিখে  আশুতোষ লেখেন যে পদার্থবিদ্যাতে নতুন অধ্যাপক পদ তৈরির সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। মাইনে হবে ৫০০ টাকা, তবে তিনি আশাবাদী যে অনতিবিলম্বে তা ৬০০ টাকা করা যাবে। তিনি মেঘনাদের কাছে এও জানতে চেয়েছিলেন তিন, পাঁচ বা সাত — কত বছরের মেয়াদি পদ মেঘনাদের পছন্দ? সিন্ডিকেট আগস্ট মাসে ১২ তারিখ সেনেটের কাছে অন্যান্যদের সঙ্গে মেঘনাদের নাম সুপারিশ করে। মেঘনাদ সেই মাসের ২০ তারিখ চিঠিতে আশুতোষকে সম্মতি জানান এবং গবেষণার জন্য ৫০০ পাউন্ডের (সে সময় ভারতীয় মুদ্রাতে ৬০০০ টাকার কাছাকাছি) প্রয়োজনের কথা বলেন। তিনি নিজে লিখেছিলেন যে সমস্ত শিল্পে উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় তারাও তাঁর তৈরি ল্যাবরেটরি থেকে সাহায্য পাবে। নিজের সম্পর্কে অহেতুক উচ্চ ধারণা মেঘনাদের ছিল না; তাঁর বক্তব্য ছিল তিনি না পারলেও তাঁর তৈরি ল্যাবরেটরিতে এই সমস্ত কাজ করা সম্ভব হবে। বেতনক্রম ৬০০ টাকা থেকে শুরু হলে ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫০ টাকা হলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন।

         বার্লিন থাকাকালীন মেঘনাদ অক্সফোর্ডে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয়দের কংগ্রেসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, ইংল্যান্ডে যাতায়াতের খরচ বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিথ স্মৃতি পুরস্কারের জন্য ছদ্মনামে প্রবন্ধ জমা দিতে হত। মেঘনাদ হেলিওফিলাস এই নামে On a physical theory of the Stellar Spectra এই প্রবন্ধটি জমা দিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র, দেবেন্দ্রমোহন বোস ও   পল ইওহানেস ব্রুলকে নিয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলী তাঁকেই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেন। এটি ছিল তাপ আয়নন সমীকরণ সংক্রান্ত গবেষণার উপর লেখা। ছদ্মনামে লেখা হলেও বিচারকদের কারোরই লেখকের নাম অনুমান করতে  অসুবিধা হয়নি।

         বার্লিন থেকে মেঘনাদ আইনস্টাইনকে এক চিঠিতে লেখেন যে তিনি নার্নস্টের ল্যাবরেটরিতে তাঁর তাপ আয়নন তত্ত্বের সমর্থনে আরো প্রমাণ সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করছেন; কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানী সুপারিশ করলে ভারতের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাঁকে এজন্য সাহায্য করতে রাজি আছেন। আইনস্টাইনের পক্ষে কি তাঁকে সাহায্য করা সম্ভব? এই চিঠি যখন লিখছেন তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। আইনস্টাইনের উত্তরটি পাওয়া যায়নি, তবে মেঘনাদ কয়েকমাস পরে আশুতোষকে লেখেন যে এক ব্যক্তিগত চিঠিতে আইনস্টাইন তাঁকে লিখেছেন বিজ্ঞানের স্বার্থে মেঘনাদের গবেষণাতে সাহায্য করা উচিত। মেঘনাদ বলেন যে বোম্বাইয়ের শিল্পপতি এস আর বোমানজির সঙ্গে তাঁর জার্মানিতে পরিচয় হয়েছে, তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করা যেতে পারে। রাজিন্দর সিং অনুমান করেছেন যে বোমানজিই হলেন আইনস্টাইনকে লেখা চিঠিতে উল্লিখিত ধনাঢ্য ব্যক্তি।

         আইনস্টাইনের সঙ্গে মেঘনাদের বার্লিনে সরাসরি সাক্ষাতও হয়েছিল, আইনস্টাইনকে চিঠিতে মেঘনাদ লিখেছিলেন যে মেঘনাদের গবেষণাতে তিনি যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তার ভরসাতেই তিনি আইনস্টাইনের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। এর পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন, কিন্তু আইনস্টাইন জানান যে সময়ের অভাবে তিনি এই আবেদন গ্রহণে অক্ষম।  

কলকাতাতে গুরুপ্রসাদ সিংহ অধ্যাপক   

       মেঘনাদ ৭ নভেম্বর ১৯২১ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। বেতন ছিল পাঁচশো টাকা, বাড়ি বাবদ ভাতা আরো একশো টাকা। কোনো ইনক্রিমেন্টের সুযোগ ছিল না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন দু’বছরের  কম সময়, এই পর্যায় তাঁর পক্ষে সুখের হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড কী বলছে তা আমরা দেখব, কিন্তু তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্র ও চিঠিপত্রও দেখাচ্ছে যে এই সময় তিনি বিশেষ অগ্রসর হতে পারেন নি। ১৯২০ ও ১৯২১ সালে তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা দশ, পরের দু’বছরে তা নেমে আসে চারে। আবার কলকাতা ছাড়ার পরে দু’বছরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় সাতে। শুধু সংখ্যা অবশ্যই বিবেচ্য নয়, কিন্তু গুণের দিক দিয়ে বিচার করলেও এই দুই বছরে খুব একটা উল্লেখযোগ্য কাজ তিনি করে উঠতে পারেননি। উল্লিখিত চারটির মধ্যে একটি গবেষণাপত্রের কাজ বার্লিনে করা, বাকিগুলিতেও বিশেষ নতুন কোনো কথা পাওয়া যায় না।

         বার্লিন থেকে আশুতোষের সঙ্গে পত্রালাপের পরে যে আশা নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেছিলেন তা পূরণ হয়নি। প্রথম থেকেই বিভাগের মধ্যে রামন ও মেঘনাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছিল। বিভাগের অভ্যন্তরে মেঘনাদের ল্যাবরেটরি তৈরির জায়গা মিলছিল না। রামনের ও ঘোষ অধ্যাপকের ল্যাবরেটরির বাইরে ছাত্রদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যও ঘর লাগত। নতুন অধ্যাপক পদে যোগদানকারীর জন্য কোনো জায়গা আগে থেকে ঠিক করে রাখার প্রশ্ন ওঠে না। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে মেঘনাদ একটা  ঘর চেয়েছিলেন যেখানে তিনি তাঁর অফিস ও ল্যাবরেটরি বানাতে পারবেন। পদার্থবিদ্যাবিভাগে একটা ঘরের কথাও তিনি বলেছিলেন। রামন জানালেন যে মেঘনাদ ঠিক কথা লেখেননি। একটা এক্স-রে যন্ত্র সরিয়ে মেঘনাদের অফিসের জন্য জায়গা করা নিয়েও দুজনের মধ্যে বিরোধ বেঁধেছিল।

         কিন্তু এগুলো ছিল নেহাতই সাধারণ ঘটনা। আসল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অর্থ। রামন বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের গবেষণার মূল খরচ আসে পালিতের অনুদান থেকে, রামন পালিত অধ্যাপক, তাঁর হাতেই খরচের চাবিকাঠি। রামন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করেন, তার জন্য বাজেট বরাদ্দের প্রায় সমস্তটাই খরচ হয়ে যায়। খয়রা তহবিলে গবেষণার জন্য অর্থের পরিমাণ কম, নতুন ল্যাবরেটরি তৈরির পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত। ১৯২১-২২ সালের বাজেটে গুরুপ্রসাদ সিংহ অধ্যাপকের ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য দশ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল, এক পয়সাও খরচ হয়নি, পরের বছর থেকে তা কমে হয় দেড় হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে আর্থিক অনটনই এর কারণ। মেঘনাদের আশা পূরণের কোনো সম্ভাবনা না দেখে তিনি ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। আশুতোষকে তিনি লিখলেন, ‘যখন আমারই খুলে দেয়া পথে ইউরোপ আমেরিকার বিজ্ঞানীরা সাগ্রহে এগিয়ে যাচ্ছেন, এখানে অর্থের অভাবে আমি নিষ্ক্রিয় জড়তাতে ডুবে যাচ্ছি।’

         মেঘনাদের অসন্তোষের কথা গোপন ছিল না। সেই মুহূর্তে তিনিই আন্তর্জাতিক স্তরে সব থেকে বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী, তাই তাঁকে পাওয়ার জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও হাত বাড়াল। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ৭৫০-৫০-১০০০ স্কেলে বেতন ও গবেষণার অন্য সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা বলে আমন্ত্রণ জানালো। মেঘনাদ সিন্ডিকেটকে এই প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বললেন অন্তত ৬৫০ টাকা বেতন ও গবেষণার জন্য ১৫০০০ টাকা তাঁর প্রয়োজন। সিন্ডিকেট অসহায়। সেই মুহূর্তে আশুতোষের সঙ্গে সরকারের বিবাদ তুঙ্গে, তাই তাঁর পক্ষেও কোনো সাহায্য করা সম্ভব হলনা। বেনারসকে ফিরিয়ে দিলেন মেঘনাদ, কিন্তু তার কয়েক মাস পরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। এলাহাবাদে তাঁর স্কেল হবে ৮০০-৫০-১২৫০, এমনকি রামনও কলকাতা থেকে মূল বেতন কখনো ১০০০ টাকার বেশি পাননি। ১৭ সেপ্টেম্বর মেঘনাদ পদত্যাগ করেন, তিন দিন পর খয়রা বোর্ড তাঁর জায়গায় শিশিরকুমার মিত্রকে নিয়োগ করে।

         কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেও কলকাতার সঙ্গে মেঘনাদের যোগাযোগ কখনোই ছিন্ন হয়নি। মেঘনাদও বেশ কয়েকবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পদের বিভিন্ন নির্বাচকমণ্ডলীতে অংশ নিয়েছিলেন।  রামনের সঙ্গে তাঁর বিবাদ ক্রমশ গুরুতর আকার নিয়েছিল। অথচ এর মধ্যেই তিনি রামনকে তাঁর লেখা বিখ্যাত বই A Textbook on Heat (পরবর্তীকালে Treatise on Heat)-এর ভূমিকা লিখতে অনুরোধ করেছিলেন এবং রামন তাঁকে প্রশংসাতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। দুজনের বিবাদ শেষ পর্যন্ত কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে রামনের পক্ষে বিষময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রামন ও মেঘনাদ দুজনেই বাঙালি-অবাঙালি বিভেদকে ব্যবহার করেছিলেন যা তাঁদের পক্ষে একেবারেই সমীচীন হয়নি। রামন এই সমস্ত ঘটনার আগেই কলকাতা ছেড়েছেন; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের ভিতরে তাদের বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েনি।

         মেঘনাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির বাইরে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তাঁর উদ্যাগে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় তৈরি করেছিলেন জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি, যা পরবর্তীকালের জাতীয় প্ল্যানিং কমিশনের পূর্বসূরী। তিনি নির্দল সদস্য হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথম লোকসভাতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতের প্রথম জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তিনি এলাহাবাদে থাকাকালীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমাদের লেখার পরিধির বাইরে।

মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান গবেষণা

         জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাতে বিকিরণের বা আলোর চাপ বিষয়ে মেঘনাদ অপেক্ষাকৃত স্বল্পজ্ঞাত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণা করেছিলেন। বিকিরণের চাপের কথা বিজ্ঞানীরা বাতিল করে দিয়েছিলেন কারণ চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী পরমাণুর ব্যাস আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে অনেক কম, তাই তার চাপ পরমাণুর উপর বিশেষ প্রভাব ফেলার কথা নয়। সাহা দেখালেন যে নবীন কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে বিকিরণের চাপের সম্পূর্ণ নতুন মাপ পাওয়া যায়; তা থেকেই সূর্যের বর্ণমণ্ডলের (chromosphere) বিস্তার, সৌর কিরীট (corona) ইত্যাদির ব্যাখ্যা করা যায়। আলো বা তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ হল ফোটন কণার সমষ্টি। এই কণার শক্তি ও ভরবেগ দুইই আছে। কোনো অণু বা পরমাণু যখন ফোটন কণাকে শোষণ করে, তখন ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী ফোটনের ভরবেগ তার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। ফোটন সূর্যের কেন্দ্র থেকে আসছে, ফলে তার ভরবেগ সাধারণভাবে বাইরের দিকে। তাই ফোটন কণার শোষণের ফলে অণু বা পরমাণুর উপরে একটা চাপ সৃষ্টি হয় যা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীত দিকে কাজ করে। এই চাপের জন্যই সূর্যের বর্ণমণ্ডল এত বিস্তৃত। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মিলনে এই গবেষণাটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। তাঁর লেখাতেই তিনি সাহার কাছে ঋণ স্বীকার করেছিলেন।

         যে কাজের জন্য তিনি তরুণ বয়সে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন তা হল তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ। সূর্যের বা অন্য নক্ষত্রের শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কোন কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ অর্থাৎ অন্ধকার, তা দেখে কোন কোন মৌলের পরমাণু সেখানে আছে তা বলা সম্ভব। বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা নক্ষত্রদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু এই শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে তারকাদের গঠন বা ভৌত প্রকৃতির সম্পর্ক কী সে বিষয়ে কোনো ধারণা করা যাচ্ছিল না। অবশেষে গত শতাব্দীর একদম শুরুতে বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে তারাদের ঔজ্জ্বল্য ও তাদের বাইরের পিঠের তাপমাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ভাবেই নক্ষত্রদের তাপমাত্রার সঙ্গে তার বর্ণালীর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছিল না। অন্য একটা সমস্যা হল যে সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল বর্ণমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়নের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তার ভিতরের অংশ হল আলোকমণ্ডল, যা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়ন নয়, নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর রেখা দেখা যায়। বেশি তাপমাত্রায় আয়নন বেশি হওয়ার কথা, তার বিপরীত ঘটনার কারণ কী হতে পারে?

         নবীন কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান এক্ষেত্রে মেঘনাদকে সাহায্য করল। নিল্‌স বোরের মডেল অনুযায়ী  পরমাণুতে ইলেকট্রনরা কতকগুলি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে অবস্থান করে। কোনো পরমাণুকে আয়ন ইলেকট্রনে ভাঙতে গেলে যে পরিমাণ শক্তি দিতে হয়, তাকে বলে আয়নন বিভব। ১৯২০ সালে Philosophical Magazine – এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধতে সাহা যে সমীকরণ দেন, তা পরবর্তী কালে তাঁর নামে পরিচিত হয়েছে। সাহা ধরে নেন সূর্যের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায় এবং একই সঙ্গে আয়ন ও ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে। এই দুই বিক্রিয়া তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে। সাহার গবেষণার বৈশিষ্ট্য হল যে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেখান পরমাণুর আয়নন বিভব এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আয়নন বিভব, চাপ, তাপমাত্রা ও আয়ননের মাত্রা এই চারটি ভৌত রাশি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। এদের মধ্যে কয়েকটি জানা থাকলে বাকিগুলি সম্পর্কে জানা বা অনুমান করা সম্ভব। সমীকরণ থেকে সাহা দেখালেন যে সূর্যের বর্ণমণ্ডলে তাপমাত্রা, চাপ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা এমন যে সেখানে সমস্ত ক্যালসিয়াম পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নিত হয়ে যায়। আবার কেন্দ্রের আরো কাছের আলোকমণ্ডলের তাপমাত্রা বেশী বটে, কিন্তু চাপও অনেক বেশী। তাই সেখানে ক্যালসিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন ছাড়ার সম্ভাবনা কম। ফলে আলোকমণ্ডলের বর্ণালীতে নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর এবং বর্ণমণ্ডলে আয়নের চিহ্ন দেখার সম্ভাবনা বেশি।

         সাহার গবেষণা আরো এক সমস্যার সমাধান করলো। সূর্যে রুবিডিয়াম, সিজিয়াম ইত্যাদি ধাতুর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সাহা বললেন এদের আয়নন বিভব কম, তাই এরা সহজে আয়নিত হয়ে যায়। আয়নিত হয়নি এমন অবস্থায় ঐ মৌলের পরমাণুর চিহ্ন পেতে হলে অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে দেখতে হবে। সৌর কলঙ্কের তাপমাত্রা কম, তাই সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে রুবিডিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যাবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল সাহার কথা ঠিক।

         সাহার সমীকরণ সহজেই তারার তাপমাত্রার সঙ্গে শোষণ বর্ণালীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে। আগে মনে করা হত যে বিভিন্ন তারার উপাদান হয়তো আলাদা।এখন বোঝা গেল যে তা নয়, তারাদের বর্ণালীর পার্থক্য হয় মূলত তাদের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য। সাহা সমীকরণ আমাদের নক্ষত্রের ভিতরে বিভিন্ন অংশে চাপ ও তাপ নির্ণয় করার সুযোগ করে দিল। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ থেকেই আমরা নক্ষত্ররা কী কী মৌলিক পদার্থও দিয়ে তৈরি তা বার করতে পারি। সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এক তরুণী বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পেইন। সাহার সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছিল যে নক্ষত্রের ভিতর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ পৃথিবীতে হাইড্রোজেনের পরিমাণ খুব কম, হিলিয়াম নেই বললেই চলে। মেঘনাদ সমেত প্রায় কোনো বিজ্ঞানীই তাই বিশ্বাস করতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে কোনো কারণে হয়তো এই দুটি গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণ কাজ করে না। সিসিলিয়া পেইনই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে সাহা সমীকরণ ঠিক, সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাপের গুরুত্ব জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে খুব বেশি। প্রথমত সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করে একটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস। এই প্রক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন হয় তাই হল নক্ষত্র থেকে যে তাপ বা আলো বেরোয় তার উৎস। নক্ষত্রের মূল উপাদান যে হাইড্রোজেন তা না জানলে আমরা কোনোদিনই নক্ষত্রদের শক্তি আসে কোথা থেকে তা বুঝতে পারতাম না। তেমনি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব আমরা বিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত থেকে বুঝতে পারি। এ সবই অবশ্য সাহার গবেষণার অনেক পরের ঘটনা। এক কথায় বলতে পারি যে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে চাপ ও তাপমাত্রা এবং  নক্ষত্রের উপাদান সাহা সমীকরণ জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে গুণগত বিজ্ঞান থেকে আধুনিক পরিমাণগত বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করেছিল। আধুনিক গবেষণাতেও সাহা সমীকরণ বহুল ব্যবহৃত, কিন্তু সে বিষয়ে আলোচনা আমাদের পরিধির বাইরে।

         উপরের দুটি কাজই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে করেছিলেন মেঘনাদ। তাঁর আরও কয়েকটা গবেষণার সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। এলাহাবাদে তিনি ও তাঁর ছাত্র দৌলতসিং কোঠারি বিটা ক্ষয়ের এক নতুন তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনে নিউট্রন মৌলিক কণিকা নয় এই ধরে নিয়ে সে বিষয়েও এক তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন।    নিউট্রন সত্যিই মৌলিক কণিকা নয়, কিন্তু তার গঠন সাহা কোঠারির তত্ত্বের সঙ্গে মেলে না। সেই মুহূর্তে তাঁদের তত্ত্বদুটি ছিল যথেষ্ট অভিনব। পরবর্তীকালে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে দেখা গেছে সে দুটি ঠিক নয়, কিন্তু তা বলে তাঁদের কৃতিত্ব কোনো মতেই কমে না। বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়, কোনো পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করার জন্য সাধারণত একাধিক তত্ত্ব আসে, তারা আরো অনেক ভবিষ্যৎবাণী করে, সেগুলি মিলিয়ে দেখতে হয় যে তাদের মধ্যে কোনটি সঠিকতর। কলকাতায় ফিরে পুত্র অজিত কুমার সাহা ও ছাত্র সমরেন্দ্রনাথ ঘোষালের সঙ্গে নিউক্লিয়াসের গঠন সম্পর্কে মেঘনাদ একটি কাজ করেছিলেন, যা পরিবর্তিত রূপে বর্তমানেও কাজে লাগে। গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি সম্পর্কে তাঁর প্রয়াসের কথা পরে আলোচনাতে আসবে।

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। গবেষণার বিষয় নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা। বর্তমানে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বিজ্ঞানের ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দুটি ছোট জীবনী, নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারীদের অবদান নিয়ে লেখা 'তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ' এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন 'বিজ্ঞানীর বিবেক'।

মন্তব্য তালিকা - “দুই তরুণ: সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা”

  1. সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞানের দুই দিকপাল। তাঁদের শ্রদ্ধা জানালেও কম হয়ে যায়। প্রণাম জানাই দুজনকে…

  2. লেখা দুটি খুবই সুন্দর ।
    অনেককিছু জানতে পারলাম , তার জন্য ধন্যবাদ স্যার ।
    সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা দু’জনেই আমাদের গর্ব ।

  3. অসাধারণ। সত্যেন্দ্রনাথের উদাসীনতার বিষয়ে জানা ছিল না।জানা ছিল না মেঘনাদ এবং সত্যেন্দ্রনাথের গ্যাস সংক্রান্ত যৌথ গবেষণা, জানা ছিলনা সি ভি রমন আর মেঘনাথের ব্যক্তিগত বিরোধ।

  4. অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার ছাত্র অধ্যাপক রঙ্গলাল ভট্টাচার্য আমাদের ল্যাবরেটরি তে গল্প করতে গিয়ে বলেছিলেন, আচার্য্য বসু র তত্ত্বের গাণিতিক প্রশ্নটি অধ্যাপক সাহা তার কাছে উত্থাপন করেছিলেন সমাধানের আশায়, কারণ তিনি জানতেন আচার্য্য বসু ই এটা পারবেন। কিন্তু সমাধানসূত্র টি আইনস্টাইন এর কাছে পাঠানোয় অধ্যাপক সাহা দুঃখিত হয়েছিলেন কারণ তিনি মনে করতেন আইনস্টাইন এর থেকে তারা দুজনে বেশি বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে। অধ্যাপক সাহা র স্মরণ সভায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আচার্য্য বসু একথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রামাণ্য নথি কি আছে জানা নেই।

    1. প্রথম ভাগ অর্থাৎ মেঘনাদ কর্তৃক সমস্যাটার প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ ইতিহাসে স্বীকৃত। মেঘনাদ নিজেও সে কথা লিখেছিলেন। দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ সরাসরি আইনস্টাইনকে পাঠানো নিয়ে মেঘনাদের দুঃখিত হওয়ার বিষয়টি আমি জানিনা। রঙ্গলালদার কাছে অনেক কিছু শোনার সৌভাগ্য হলেও এই তথ্যটা শুনিনি। অনেক গল্পই তুমি আমি একসঙ্গে শুনেছি, কিন্তু তোমাকে যখন এই কথাটা বলেছিলেন, আমি নিশ্চয় উপস্থিত ছিলাম না। থাকলে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার মনে থাকত।

  5. প্রথম ভাগ অর্থাৎ মেঘনাদ কর্তৃক সমস্যাটার প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ ইতিহাসে স্বীকৃত। মেঘনাদ নিজেও সে কথা লিখেছিলেন। দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ সরাসরি আইনস্টাইনকে পাঠানো নিয়ে মেঘনাদের দুঃখিত হওয়ার বিষয়টি আমি জানিনা। রঙ্গলালদার কাছে অনেক কিছু শোনার সৌভাগ্য হলেও এই তথ্যটা শুনিনি। অনেক গল্পই তুমি আমি একসঙ্গে শুনেছি, কিন্তু তোমাকে যখন এই কথাটা বলেছিলেন, আমি নিশ্চয় উপস্থিত ছিলাম না। থাকলে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার মনে থাকত।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।