সঙ্গম সাহিত্য
ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস লেখা যখন শুরু হয়, সবার মনেই যে নামটি প্রথম আসে তা হল ঋগ্বেদ। বেদ মানে জ্ঞান, কিন্তু সেই জ্ঞান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকেন্দ্রিক নয়। তাই এমন একটি সাহিত্যের আলোচনা করাতে চাই, যার জ্ঞান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যের সঙ্গে বিংশ শতকের শুরুর বাঙালির সরাসরি একটা যোগাযোগ ছিল। ১৯৩৭ সালে নলিনীমোহন সান্যাল অনুবাদ করেছিলেন দক্ষিণীদের একটি অতি বিখ্যাত গ্রন্থ, স্বয়ং আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আগ্রহী হয়ে লিখেছিলেন তার অপূর্ব একটি ভূমিকা। যদিও এই সংকলনের প্রকৃত মূল্য ছড়িয়ে পড়তে দক্ষিণ ভারতেই সময় লেগে যায় আরও কয়েক দশক। এখানে তিরুক্কুরলের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে শুধু তিরুক্কুরল নয়, খুব সংক্ষেপে আলোচনা হবে গোটা সঙ্গম সাহিত্যই।
পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলির একটি হচ্ছে তামিল ভাষা। আর এই তামিল ভাষায় লেখা প্রথম সাহিত্যকীর্তি হল ‘সঙ্গম সাহিত্য’। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘সঙ্গম’ শব্দটি এসেছে ‘সংঘ’ শব্দ থেকে যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘পণ্ডিত ও কবিদের পরিষৎ’। কিংবদন্তি অনুযায়ী সুপ্রাচীন অতীতে তামিল দেশে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তিনটি সঙ্গম (কবি সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের হিসেবে এই সঙ্গম তিনটির সম্মিলিত সময়কাল ছিল ৯৯০০ বছর। ৮৫৯৮ জন কবি এই তিনটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭ জন পাণ্ড্য রাজা ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। সঙ্গম-এ অংশগ্রহণকারী কবিদের রচনার সংহিতাই হচ্ছে সঙ্গম সাহিত্য।
প্রথম সঙ্গমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তেন মাদুরাইতে যেটি অবস্থিত ছিল কন্যাকুমারীর কাছে ভারত মহাসাগরে কুমারী নদীর মোহনায়। পরবর্তীকালে এই জায়গাটি ভারত মহাসাগরে ডুবে যায়। এই সঙ্গমটিতে পুরাণ-সুলভ অত্যুক্তি থাকায় এটিকে কিংবদন্তি সঙ্গম বলা হয়। এখানে উল্লেখ রয়েছে শৈব ধারার কয়েকজন দেবতা যেমন – মহাদেব, কার্তিকেয় ও অগস্ত্য মুনি ইত্যাদিরা নাকি উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় সঙ্গমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল থামিরাবারানি নদীর তীরে কাবাদপুরমে। এই জায়গাটিও পরবর্তীকালে ধ্বংস হয়ে যায়। তৃতীয় সঙ্গমটি অনুষ্ঠিত হয় মাদুরাই শহরে।
সঙ্গম সাহিত্য সম্পর্কিত উপরোক্ত কিংবদন্তির কথা প্রথম জানা যায় ৭৫০ সাধারণ অব্দে রচিত ‘ইরাইয়ানার আগাপ্পরুল’-এর ভাষ্যের উপক্রমণিকায়। সঙ্গম সাহিত্যের সাথে জড়িত বেশ কিছু রাজা এবং কবির নাম যেমন – রাজা কাদুনগন এবং উগ্রপপেরুভালুদি-এর উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের লিপিতে এবং স্মারকে। তবে সঙ্গম সাহিত্য বলে যে সত্যিই কিছু ছিল তা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত হয় সাধারণ অব্দের ১৯ শতকের শেষের দিকে যখন ঐতিহাসিক দামোদরণ পিল্লাই এবং স্বামীনাথা আইয়ার পাম গাছের পাতায় লেখা সঙ্গম সাহিত্যের রচনার একটি সংহিতা খুঁজে পান।
স্বামীনাথা আইয়ার তালপাতার পুঁথি থেকে নকল করছেন।
এই সংহিতাটিতে পাওয়া গিয়েছে ৪৭৩ জন কবির (এঁদের মধ্যে বেশ কিছু মহিলা কবিও ছিলেন) ২২৭৯ টি রচনা। এছাড়া আরও ১০২টি রচনা পাওয়া গিয়েছে যেগুলির রচয়িতার নাম নেই। তামিল কিংবদন্তি অনুযায়ী তৃতীয় সঙ্গমে ৪৪৯ জন কবি উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু পিল্লাই এবং আইয়ারের খুঁজে পাওয়া সংহিতাতে রচয়িতার সংখ্যা এবং কিংবদন্তির তৃতীয় সঙ্গমের কবির সংখ্যা বেশ কাছাকাছি, মনে করা হয় যে পিল্লাই এবং আইয়ারের খুঁজে পাওয়া সংহিতাটি হচ্ছে তৃতীয় সঙ্গমের সংহিতা। কিংবদন্তির প্রথম এবং দ্বিতীয় সঙ্গমের স্বপক্ষে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
উপরোক্ত সংহিতাতে, রচনাগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করা করা হয়েছিল ছোট কবিতার ৮টি সংকলনে (এট্টু-কোটাই) এবং দীর্ঘ গানের ১টি সংকলনে (পাট্টুপাট্টু)। ৮টি এট্টু-কোটাই হল নাররিনাই, কুরুনডোগাই, আইনগুরুনুরু, পাদির্রুপপাত্তু, পারিপাডাল, কালিটোকাই, অহনানুরু এবং পুরাণনুরু। পাট্টুপাট্টুর ছিল ১০টি দীর্ঘ গান হল – তিরুমুরুকাররুপপাতাই, কুরিনসিপ্পাত্তু, মালাইপাতুকাতাম, নেতুনআলভাটাই, পাত্তিনাপ্পালাই, পেরুমপানাররুপ্পাটাই, মুল্লাইপ্পাট্টু, মাতুরাইক্ক্যান্সি, পরুনার্রারউপপাতাই এবং সিরুপানাররুপপাতাই। এই রচনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে ছোট রচনাটি ছিল ৩ লাইনের আর সবচেয়ে দীর্ঘ রচনাটি ছিল ৭৮২ লাইনের।
প্রত্যেকটি রচনা আবার তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল – (১) মূল রচনা; (২) পাদটীকা; এবং (৩) ভাষ্য। পাদটীকা এবং ভাষ্য সম্ভবত রচিত হয়েছিল পরবর্তীকালে সংকলকদের দ্বারা। এই পাদটীকাগুলি থেকে আমরা জানতে পারি কবির নাম, পৃষ্ঠপোষকের নাম, রচনার প্রেক্ষাপট এবং অন্যান্য নানান তথ্য। তাই ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই পাদটীকাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখার প্রাথমিক বিষয়বস্তুর হিসাবে সঙ্গম সাহিত্যের রচনাগুলি ছিল দুই ধারার – ‘আকম’ এবং ‘পুরম’। আকম ধারার রচনাগুলির মুখ্য বিষয়বস্তু ছিল মানুষের অন্তর্জগত (প্রেম এবং পরিবার)। পক্ষান্তরে পুরম ধারার রচনাগুলির বিষয়বস্তু ছিল বহির্জগত (যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্বন্ধীয় এবং শাসকদের প্রশংসাসূচক)। ৫টি এট্টু-কোটাই (আইনগুরুনুরু, অহনানুরু, কুরুনডোগাই, নাররিনাই, এবং কালিটোকাই) এবং পাট্টুপাট্টুর ৩টি গান (কুরিনসিপ্পাত্তু, নেতুনআলভাটাই এবং মুল্লাইপ্পাট্টু) ছিল আকম ধারার রচনা। পারিপাডাল ছিল মিশ্র ধারার ধর্মীয় রচনা যাতে মুরুগান এবং বিষ্ণু (বা তিরূমল) এবং মাদুরাইয়ের নিকটবর্তী ভাইগাই নদীর স্তব আছে। কবিতার বাকি সংকলনগুলি এবং বাকি গানগুলি ছিল পুরম ধারার।
‘আকম’ ধারার রচনাগুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল প্রেমিক-প্রেমিকার এবং স্বামী-স্ত্রীর দৈনন্দিন জীবনের মানসিক টানাপড়েন বোঝাতে ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের রূপক হিসেবে ব্যবহার। এই রূপকগুলিকে বলা হতো ‘থিনাই’। প্রত্যেকটি থিনাই-এর নামকরণ করা হয়েছিল যে ভৌগোলিক অঞ্চলকে সেই থিনাই-টি বোঝাতো সেই ভৌগোলিক অঞ্চলের কোন বিশেষ ফুলের নামে। এইরকম থিনাই ছিল ৫টি: কুরিঞ্জি ফুল পাহাড়ি অঞ্চলকে বোঝাতে; মুল্লাই (জুঁই ফুল) পাহাড়ের পাদদেশে বন-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলকে বোঝাতে; মারুতম (জারুল ফুল) উর্বর নদীতীরস্থ অঞ্চল বোঝাতে; নেয়তাল (শাপলা) সমুদ্রকুলবর্তী অঞ্চলকে বোঝাতে; এবং পালাই অনুর্বর ঊষর অঞ্চলকে বোঝাতে। ‘পুরম’ ধারার রচনাতেও রূপকের ব্যবহার হত। তবে পুরম ধারার রচনায় ভৌগোলিক অঞ্চলের বদলে যুদ্ধের বিভিন্ন অবস্থাকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হত।
পাঁচটি থিনাই-এর এলাকার মানচিত্র
উপরোক্ত এট্টু-কোটাই এবং পাট্টুপাট্টুর সাথে সাথে লেখা হয়েছিল একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ – ‘তোলকাপ্পিয়াম’। অনুমান করা হয় যে উপরোক্ত কবিতা এবং গানের সঙ্কলনগুলি রচনা কালের পরে পরেই তোলকাপ্পিয়াম গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন হয়েছিল। তাই তোলকাপ্পিয়ামকেও সঙ্গম সাহিত্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তোলকাপ্পিয়ামের পদ্য সম্বন্ধীয় অংশেই আকম এবং পুরম ধারার সংহিতাবদ্ধ নিয়মাবলী এবং রীতিনীতির সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
সঙ্গম সাহিত্যের রচনাগুলির বয়স নির্ধারণ এবং কালানুক্রম তৈরি করার জন্য ঐতিহাসিকরা তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেন – (১) রচনাগুলিতে প্রাপ্ত তথ্যের ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং পারস্পরিক সঙ্গতি, (২) লেখনশৈলী, এবং (৩) ছন্দ।
প্রাচীন তামিল পুঁথি (চিত্রঋণঃ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ)
সঙ্গম সাহিত্য থেকে সেই সময়কার যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি হল তৎকালীন তামিলদেশের সাথে রোমানদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং উপকূলবর্তী শহরগুলিতে বহুল ভাবে ‘যবন’দের (গ্রিক/রোমান) উপস্থিতি। সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনা অনুযায়ী মুজিরিস/মুচিরি সেই সময়কার মালাবার উপকূলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এই মুজিরিস/মুচিরি বন্দর প্রসঙ্গে সঙ্গম সাহিত্যের অহনানুরু সংকলনের এক কবিতায় বর্ণনা দেয়া হয়েছিল – “the beautifully built ships of Yavanas came, agitating the white foams of Periyaru (river), with gold and returned with pepper, and Muchiri resounded with the noise”। পুরাণনুরু সংকলনের এক কবিতায় যবনদের প্রসঙ্গে বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল – “the cool, sweet-smelling wine, brought by the Yavanas, in beautiful ships and drunk daily from gold cups held by damshels who wore bright bracelets”।
আজকের তামিলনাড়ু এবং কেরালাতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রচুর প্রাচীন রোমান মুদ্রা, আররেনতাইন মৃৎশিল্প এবং প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের দুই হাতলবিশিষ্ট পানপাত্র পাওয়া গিয়েছে যেগুলি ঐতিহাসিকদের মতে সাধারণ অব্দের প্রথম দুই শতকের। আনুমানিক ৭৫ সাধারণ অব্দে জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য ইরিথ্রিয়েন সি’ (ভারত সাগরে ভ্রমণ) এবং ১৫০ সাধারণ অব্দে টলেমির লেখা ‘জিওগ্রাফিয়া’ গ্রন্থে সঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত বেশ কিছু বন্দরের যেমন মুজিরিস/মুচিরি, কাবেরিপত্তনম ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। এই সবের ভিত্তিতে মনে করা হয় যে যে সঙ্গম সাহিত্যের রচনাগুলি সাধারণ পূর্বাব্দের প্রথম শতক থেকে সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় শতকের মধ্যে লেখা হয়েছিল। অবশ্য কয়েকটি তামিল-ব্রাহ্মী লিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সঙ্গম সাহিত্যের কিছু কিছু রচনার বয়স আরো প্রাচীন – সেগুলি রচিত হয়েছিল সাধারণ পূর্বাব্দের দ্বিতীয় শতকে বা তারও আগে।
সাম্প্রতিক অতীতে ভাইগাই নদীর উচ্চ অববাহিকায় ৪টি লিপি সম্বলিত বীরশিলা পাওয়া গিয়েছে যেগুলি সাধারণ পূর্বাব্দের দ্বিতীয়-প্রথম শতকের। এই আবিষ্কার সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণিত গবাদি পশুর অধিকারের লড়াই সম্পর্কিত বীরশিলার ঐতিহাসিক প্রমাণ দেয়। সঙ্গম সাহিত্যের কিছু কবি যে সাধারণ পূর্বাব্দের প্রথম শতকের প্রথম দিকের বা তার একটু আগের, এই আবিষ্কার তার স্বপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবেও কাজ করে।
কিংবদন্তি অনুযায়ী ‘তোলকাপ্পিয়াম’ রচিত হয়েছিল আরও আগে। ‘ইরাইয়ানার আগাপ্পরুল’-এর বিবরণ অনুযায়ী ঋষি অগস্ত্য যিনি ৪৪০০ বছর ধরে চলা প্রথম সঙ্গম এবং ৩৯০০ বছর ধরে চলা দ্বিতীয় সঙ্গমে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি রচনা করেছিলেন প্রথম সঙ্গমের ব্যাকরণ (‘নাল’) অগত্তীয়ম। দ্বিতীয় সঙ্গমের ক্ষেত্রে ব্যাকরণের কাজ করেছিল অগত্তীয়ম, তোলকাপ্পিয়াম এবং আরও তিনটি রচনা। সেই অর্থে তোলকাপ্পিয়াম হল একাধারে তামিল ভাষার প্রথম ব্যাকরণ এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য তামিল ভাষায় লেখা প্রথম রচনা।
অনুমান করা হয় যে বর্তমান সংহিতাটি সংকলিত হয়েছিল সাধারণ অব্দের পঞ্চম শতকে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে সঙ্গম সাহিত্যের অধিকাংশ রচনা রচিত হয়েছিল নিরক্ষর চারণ কবিদের (পানার) দ্বারা মৌখিকভাবে। পরবর্তীকালে সংকলন তৈরির সময় এই রচনাগুলি লিখিত রূপ পায়। তবে এই বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত হল যে সঙ্গম সাহিত্যের অধিকাংশ রচনা প্রথমে মৌখিকভাবে রচিত হলেও, এর রচয়িতা কবিরা ছিলেন স্বাক্ষর এবং শিক্ষিত। এঁদেরকে বলা হত পুলাভার। পুলাভাররা তাঁদের পূর্বসূরি পানারদের চারণ কবিতা রচনা রীতিনীতি অনুসরণ করে তৈরি করেছিলেন সঙ্গম সাহিত্যের রচনাগুলি। এই পুলাভারদের অধিকাংশই ছিলেন দক্ষিণ তামিলনাড়ুর অধিবাসী। তবে বেশকিছু পুলাভারের বাসস্থান ছিল অধুনা কেরল এবং শ্রীলংকার জাফনা অঞ্চলে।
বৈদিক সাহিত্যের সাথে সঙ্গম সাহিত্যের একটা মূল পার্থক্য হল যে যেখানে বৈদিক সাহিত্যের রচয়িতারা ছিলেন শুধু ব্রাহ্মণরা, সেখানে সঙ্গম সাহিত্যের পুলাভাররা এসেছিলেন সমাজের সর্বস্তর থেকে। এঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য, কেউ ছিলেন ব্যবসায়ী, কেউ ব্রাহ্মণ আবার কেউ কৃষক। এই রকম দুই পুলাভার পেরুমকাদুনগো এবং ইলমকাদুনগো ছিলেন চের রাজপরিবারের সদস্য।
পুলাভারদের মধ্যে অনেকে ঘুরে বেড়াতেন এক রাজা/গোষ্ঠীপতির দরবার থেকে আরেক রাজা/গোষ্ঠীপতির দরবারে, আবার অনেক পুলাভার কোনো এক বিশেষ রাজা/দলপতির স্থায়ী সঙ্গী হয়ে যেতেন এবং তাদের পরামর্শদাতার কাজ করতেন। অনেক সময় তাঁরা রাজা/দলপতির যুদ্ধসঙ্গীও হতেন। পুলাভারদের পৃষ্ঠপোষক রাজা/গোষ্ঠীপতিদের বলা হতো ভাল্লাল। বেশ কয়েক ক্ষেত্রে পুলাভার এবং তাঁর ভাল্লালের মধ্যে সম্পর্ক পৃষ্ঠপোষকতা থেকে আজীবন বন্ধুত্ব এবং শুভানুধ্যায়ীর সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল যেমন কপিলার (পুলাভার) এবং পরির মধ্যে, পিসির আন্দিয়ার (পুলাভার) এবং কপ্পেরুঞ্জলানের মধ্যে, আউরাভিয়ার (পুলাভার) এবং আদিগমন আনজির মধ্যে। এই সম্পর্কগুলির গভীরতা এমন ছিল যে যুদ্ধে যখন পরির মৃত্যু হয়, তখন কপিলার তাঁর মৃত পৃষ্ঠপোষকের অবিবাহিত কন্যাদের বিবাহের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর এক পুলাভার আউরাভিয়ার চেরদের হাতে তাঁর পৃষ্ঠপোষক আদিগমনের পরাজয়ের কথা লিপিবদ্ধ করেননি। পরবর্তীকালে, চেরদের সামন্ত রাজা হিসাবে যুদ্ধে গিয়ে আদিগমনের মৃত্যু হলে তা নিয়েও আউরাভিয়ার নীরব থেকেছেন। সম্ভবত নিজের পৃষ্ঠপোষকের দুর্ভাগ্যের কথা লিখতে তাঁর সায় ছিলনা। তাঁর লেখায় শুধু ফুটে উঠেছিল আদিগমনের মৃত্যুর পরের নিঃসঙ্গতার বেদনা। চেরদের হাতে আদিগমনের পরাজয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি পরবর্তীকালে রচিত “তাগাদুর যাত্রিরাই” থেকে, যার উল্লেখ পাওয়া যায় আরও পরের রচনাগুলিতে। আদিগমনের মৃত্যু যে যুদ্ধক্ষেত্রে হয়েছিল তার সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হই বীরশিলার উল্লেখ থেকে।
কর্ণাটকের সিদ্ধেশ্বর মন্দিরে অবস্থিত তিন প্যানেলের বীরশিলা
পুলাভাররা প্রশংসাসূচক রচনা করে রাজা/গোষ্ঠীপতিদের খুশি করার চেষ্টা করতেন এই আশায় যে রাজা/গোষ্ঠীপতিরা তাঁদের ধনসম্পত্তি দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। কথিত যাচ্ছে যে চোল রাজা কারাইকালা পাট্টুপাট্টুর পাত্তিনাপ্পালাই গানটির রচয়িতাকে ১৬০০০০০ খণ্ড সোনা দিয়েছিলেন। ধনসম্পদ ছাড়াও এঁরা রাজকীয় ভোজসভায় আমন্ত্রণ প্রত্যাশা করতেন। এই প্রসঙ্গে এক কবি তাঁর পৃষ্ঠপোষককে বলেছিলেন “I came to see you that we might eat succulent chops of meat, cooled after boiling and soft like the carded cotton of the spinning-women, and drink large pots of today together’। প্রসঙ্গত সেই সময় তামিল দেশে ব্রাহ্মণরাও মাংস এবং তাড়ি খেতেন এবং তার জন্য তাঁদের কোনো সামাজিক ভৎসনার সম্মুখীন হতে হত না। যে সমস্ত রাজা/গোষ্ঠীপতিরা এই কবিদের পুরস্কৃত করতেন না বা পুরস্কার দিতে কঞ্জুসি করতেন, কবিরা তাঁদের রচনায় সেই সমস্ত রাজা/গোষ্ঠীপতিদের বিদ্রূপ করতেন।
সামগ্রিকভাবে অবশ্য এই পুলাভারদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলনা। তাঁদের অনেকেরই গ্রাসাচ্ছাদন কোনরকমে হত এবং অনেক সময়ই তাঁরা জানতেন না তাঁদের পরবর্তী খাবার কখন জুটবে।
সমসাময়িক বৈদিক সাহিত্যের ন্যায় সঙ্গম সাহিত্য নীতিজ্ঞানমূলক ছিলনা। সঙ্গম সাহিত্য ছিল বস্তুবাদী। সঙ্গম সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল সেই সময়কার তামিল দেশের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের আবহাওয়া, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ এবং তাঁদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবন, বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠী এবং তাঁদের যুদ্ধবিগ্রহ এবং ধর্মপালন ইত্যাদি। এই সব বিষয়ে সঙ্গম সাহিত্যের কবিরা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের লেখা কবিতায় এবং গানে। এই সব কারণে সাধারণ অব্দের শুরুর দিকের তামিল দেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সঙ্গম সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত সঙ্গম সাহিত্যের সময় থেকেই তামিল দেশের ঐতিহাসিক কালের শুরু বলে গণ্য করা হয়।
সঙ্গম যুগে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র
সঙ্গম সাহিত্য থেকে তৎকালীন তামিল দেশের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের উপরোক্ত বাণিজ্যিক সম্পর্কের তথ্যাদি ছাড়াও তৎকালীন তামিল দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সমকালীন তামিলদেশ অর্থাৎ আজকের তামিলনাড়ু এবং কেরালার শাসক ছিলেন তিনটি রাজবংশ – চের, চোল এবং পাণ্ড্য। পাণ্ড্যদের রাজ্য ছিল বর্তমান তামিলনাড়ুর দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে। আজকের তামিলনাড়ুর তিন জেলা – তিরুনেলভেলি, রামনাদ এবং মাদুরাই নিয়ে ছিল সেই সময়কার পাণ্ড্য রাজ্য। এদের রাজধানী ছিল মাদুরাই। চোল রাজ্য, পরবর্তীকালে মধ্যযুগের প্রথমভাগে যার নাম হয় চোলমণ্ডলম (করমণ্ডল), পাণ্ড্য রাজ্যের উত্তরপূর্ব দিকে পেন্নার এবং ভেলার নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত ছিল। একদিকে পাহাড় আরেক দিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা চেরদের রাজ্য ছিল পশ্চিম উপকূলে – আজকের কেরালা এবং তামিলনাড়ুর পশ্চিম অংশে, তৎকালীন পাণ্ড্য রাজ্যের উত্তর এবং পশ্চিম দিকে। সঙ্গম সাহিত্যে আঠারো জন চের, বারো জন চোল, বারো জন পাণ্ড্য রাজার নাম পাওয়া গিয়েছে। এই রাজাদের বলা হতো ‘ভেনতার’। এই সমস্ত রাজাদের সম্পর্কে বিবৃতি বিভিন্ন ঘটনাবলীর পারস্পরিক সঙ্গতির ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা চের রাজবংশের বংশানুক্রম বানাতে সক্ষম হয়েছেন। চোল এবং পাণ্ড্যদের ক্ষেত্রে অবশ্য তা সম্ভব হয়নি। এই রাজবংশগুলি ছাড়াও সঙ্গম সাহিত্যে অনেক স্থানীয় গোষ্ঠীপতির (ভেল) উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আই, পরি, আদিগমন, এভ্ভী, ইরুনগো (এই নামগুলি সম্ভবত বংশনাম ছিল) ইত্যাদি । সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনা থেকে মনে হয় যে চের, চোল এবং পান্ড্য – এই তিন রাজবংশের মধ্যে নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। কখনো কখনো সিংহলের রাজার সাথেও এঁদের যুদ্ধ বেঁধে যেত। স্থানীয় গোষ্ঠীপতিরা কখনো দল বেঁধে এঁদের বিরোধিতা করতেন আবার কখনো এক রাজবংশের পক্ষ নিতেন।
সঙ্গম সাহিত্য থেকে সেই সময়কার রাজনৈতিক অবস্থা থেকে আরো জানা যায় যে চের, চোল এবং পাণ্ড্য এই তিন রাজবংশের একাধিক রাজা একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত হত উত্তরাধিকারসূত্রে এবং তা নিয়ে অনেক সময় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে লড়াইদাঙ্গা বেঁধে যেত। রাজার সভা বা ‘মনরম’ ছিল বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ কেন্দ্র। প্রাকৃতিক দ্রব্যের বাণিজ্য এবং যুদ্ধজয় করে পাওয়া ধনসম্পত্তি ছিল রাজকীয় সম্পদের মূল উৎস। প্রত্যেক রাজা পেশাদার সৈন্য দিয়ে গড়া সেনাবাহিনী রাখতেন। রাজারা নিজেরাও যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন।
সঙ্গম সাহিত্যে যে পাঁচটি ভৌগোলিক অঞ্চলকে টিনাই হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, গবেষকদের মতে বাস্তবে এই পাঁচটি ভৌগোলিক অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল এবং এবং প্রত্যেকটি অঞ্চলের অধিবাসীদের মূল জীবিকা ছিল সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। পাহাড়ি অঞ্চলের (কুরিনজি) মানুষের মূল জীবিকা ছিল শিকার; পাহাড়ের পাদদেশে বন-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলের (মুল্লাই) মানুষের মূল জীবিকা ছিল পশুপালন এবং খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কৃষিকাজ; উর্বর নদীতীরস্থ অঞ্চলের (মারুতম) মানুষের মূল জীবিকা ছিল সেচব্যবস্থার সাহায্যে কৃষিকাজ; এবং সমুদ্রকুলবর্তী অঞ্চলের (নেয়তাল) মানুষের মূল জীবিকা ছিল মাছধরা, লবণ বানানো এবং অন্যান্য সামুদ্রিক কাজকর্ম। অনুর্বর ঊষর অঞ্চলের (পালাই) মানুষের পক্ষে যেহেতু কোনো অর্থকরী জীবিকা সম্ভবপর ছিলনা, এই অঞ্চলের মানুষজন গৃহপালিত পশু চুরি এবং রাস্তাঘাটে চুরি-ডাকাতিতে লিপ্ত হতেন। অবশ্য এই ভৌগোলিক অঞ্চলগুলি যে সম্পূর্ণরূপে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এমন নয়। বহু জায়গা ছিল যেখানে একাধিক উপরোক্ত ভৌগোলিক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হত। ফলত সেই সব জায়গার অর্থনৈতিক কার্যকলাপও হত মিশ্র প্রকৃতির। সেই সময়কার তামিল দেশের প্রসিদ্ধ শহরগুলি ছিল কাঞ্চি, কোরকাই, মাদুরাই, পুহার এবং উরাইয়ুর। এই শহরগুলির মধ্যে পুহার বা কাবেরীপত্তনম ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সঙ্গম সাহিত্যের রচনাগুলিতে বিশেষ করে শেষের দিকে রচনাগুলি যেমন পারিপাডাল এবং তিরুমুরুকাররুপপাতাইতে বৈদিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব সুস্পষ্ট। এর একটা কারণ হতে পারে সঙ্গম সাহিত্যের রচয়িতাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ কবিদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি (আনুমানিক ১০ শতাংশ)। এই ব্রাহ্মণ কবিরা ছিলেন সংস্কৃতে সুপণ্ডিত এবং বৈদিক ও পৌরাণিক ধ্যান ধারণার ওপর বিশেষজ্ঞ । আবার এঁরা ছিলেন তামিল দেশের চারণ কবিদের রচনাভঙ্গির সাথে সুপরিচিত। ফলে, এঁরা সঙ্গম সাহিত্যে তামিল চারণ কবিদের রচনা ভঙ্গির সাথে সাযুজ্য রেখেই অনেক বৈদিক ধ্যান ধারণা এবং কিংবদন্তি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তবে সঙ্গম সাহিত্যে ব্রাহ্মণদের উপরোক্ত বৈদিক ধারণা আরোপের কথা মেনে নিয়েও এইটা অনুমান করা হয় যে তৎকালীন তামিল দেশের সামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনে বস্তুতই উত্তর ভারতীয়/বৈদিক সংস্কৃতি ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল। সেই সময়কার তামিল দেশের লোকজন গঙ্গা এবং শোন নদী, মগধের নন্দদের প্রাচুৰ্য এবং পাটলিপুত্র নগর, দাক্ষিণাত্যে মৌর্যদের অভিযান ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এর মূল কারণ ছিল উত্তর ভারতের সাথে তামিল দেশের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এই বাণিজ্যসূত্রে উত্তর ভারত থেকে তামিল দেশে পৌঁছে গিয়েছিলেন উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এবং তাঁদের সাথে সাথে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং জৈন ও বৌদ্ধ শ্রমণরা। আর এঁদের সাথেই তামিল দেশে এসে পৌঁছেছিল উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাস। তবে তার মানে এই নয় যে তৎকালীন তামিল দেশের লোকজন প্রাক-আর্য সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে বৈদিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তৎকালীন তামিল দেশের সমাজ জীবন ছিল মূলত প্রাক-আর্য প্রথার অনুসারী। তার সাথে মানুষজন বেছে বেছে কিছু বৈদিক/আর্য সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য অধিগ্রহণ এবং আত্তীকরণ করতেন। এই বিষয়ে তাদের কোন ছুৎমার্গ ছিলনা। মানুষ রামায়ণ এবং মহাভারতের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। মাদুরাই নামকরণ হয়েছিল ‘মথুরা’র অনুকরণে। বৈদিক দেব-দেবীর আত্তীকরণ হয়েছিল। রাজা এবং গোষ্ঠীপতিরা বিভিন্ন বৈদিক যাগ-যজ্ঞ করতেন। বংশগৌরব বৃদ্ধি করার জন্য অনেক সময় তাঁরা মহাকাব্যিক/ পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনাবলীর সাথে নিজেদের পূর্বপুরুষদের যোগসূত্র স্থাপন করতেন। তবে এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ একমুখী ছিলনা। তামিল সংস্কৃতিও প্রভাব ফেলে বৈদিক সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের ওপর। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে বৈদিক সাহিত্যে কাবেরী নদীর অন্তর্ভুক্তি, একটি পুণ্য নদী হিসাবে।
সঙ্গম সাহিত্যের ভাষা কি মৌলিক তামিল ছিল, নাকি সংস্কৃতের প্রভাবে পরিমার্জিত তামিল ছিল – এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ যাচ্ছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীলকান্ত শাস্ত্রী এবং তার অনুগামীদের মতে তামিল এবং অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষাগুলির গ্রাম্য ভাষা থেকে সাহিত্য রচনার উপযোগী একটি শক্তিশালী এবং রুচিশীল ভাষায় রূপান্তর সম্ভব হয়েছিল সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে। এই বিবর্তন সম্ভব হয়েছিল বিভিন্ন সংস্কৃত শব্দ এবং সাহিত্য রচনার বিভিন্ন ধারণার আত্তীকরণের মাধ্যমে। এই মতবাদের বিপক্ষ মতাবলম্বীদের মতে তামিল ভাষার অস্তিত্ব ছিল অনাদি কাল থেকে এবং এর ওপর সংস্কৃত ভাষার কোনো প্রভাব ছিলনা। সাম্প্রতিক অতীতের কিছু গবেষণা অনুসারে প্রাক-সংস্কৃত দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ করে তামিল সাহিত্যপ্রথার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, যেইগুলি উত্তর ভারতীয় সাহিত্যর বৈশিষ্ট্যের থেকে পৃথক। এদের মতে আদি তামিল সাহিত্যের ছন্দপ্রকরণ সম্পূর্ণভাবেই মৌলিক এবং এর সাথে সংস্কৃত ছন্দ প্রকরণের কোন মিল নেই। প্রাকৃত এবং তামিল ভাষায় রচিত সাহিত্যের সমস্ত কাব্যপ্রকরণ এবং বিষয়ের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই গবেষণা জানায় যে, আদি তামিল সাহিত্য, যার অনুরূপ পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে, এই সবই এক অর্থে ছিল পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষায় কালিদাস বা অন্যান্য কবিদের দ্বারা যে সমস্ত মহান সাহিত্য রচিত হয়েছিল সেগুলির পূর্বসূরি এবং অগ্রদূত। এই কারণে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে সাধারণ পূর্বাব্দের দশম শতকের দাক্ষিণাত্যে মৌখিক ভাষা ছিল এবং পরবর্তীকালের তামিল এবং প্রাকৃত ছিল তার পরিমার্জিত রূপ।
সঙ্গম সাহিত্য ধারার (ঐতিহাসিকরা অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গম সাহিত্যের সময়কালকে তামিল দেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গম যুগ বলে অভিহিত করেন) সমাপ্তি ঘটে সাধারণ অব্দের তৃতীয় শতকে। এই বিষয়ে আমরা ধারণা পাই পাট্টুপাট্টুর ১০টি দীর্ঘ গানের একটি সিরুপানাররুপপাতাই থেকে। সিরুপানাররুপপাতাই-এর লেখক ছিলেন নট্টত্তানার এবং মুখ্য চরিত্র ছিলেন নাল্লিয়াক্কদান। মনে করা হয় যে নাল্লিয়াক্কদান তাঁর রাজত্ব চালিয়েছিলেন সাধারণ অব্দের ২৭৫ সাল নাগাদ এবং তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল আজকের তামিলনাড়ুর দক্ষিণ আর্কট জেলা। তৎকালীন সময় সম্পর্কে, যা সঙ্গম সাহিত্যের শেষ পর্যায়ের সমসাময়িক, নট্টত্তানার সিরুপানাররুপপাতাইতে দুঃখ করে লিখেছেন যে চের, চোল এবং পাণ্ড্যদের রাজধানীতে দানধ্যান প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আগের মত শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকরা আর ছিলেন না। সঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত প্রসিদ্ধ নগরকেন্দ্রগুলি যেমন ভানজি, উরাইয়ুর , মাদুরাই ইত্যাদির প্রাচুর্য তখন ছিল অবক্ষয়ের পথে।
পরবর্তীকালে, সাধারণ অব্দের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে তামিল ভাষায় আরো ১৮টি অপ্রধান রচনা (‘কিলাক্ক্যানাক্কু’) এবং ২টি কাব্য – শীলাপপাতিকরম এবং মণিমেকালাই রচিত হয়। বিষয়বস্তু, ছন্দ এবং রচনাশৈলীর দিক থেকে এই রচনাগুলি ছিল সঙ্গম সাহিত্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই এই রচনাগুলিকে এক সময়ে সঙ্গম সাহিত্যের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হলেও এখন আর সঙ্গম সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়না। এই রচনাগুলিকে বলা হয় সঙ্গমোত্তর সাহিত্য।
(প্রচ্ছদ চিত্রঃ আগস্ত মুনি, যিনি পৌরাণিক মতে প্রথম সঙ্গমের পৌরহিত্য করেন।)
(বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: কুন্তল রায়)
তথ্যসূত্র :
- A concise history of South India – Issues & Interpretation: Edited by Noboru Karashima (Oxford University Press, 2014)
- The Illustrated History of South India, from Prehistoric Times to the Fall of Vijaynagar by K.A.Nilkanta Sastri (Oxford University Press, 2009)
- India’s Ancient Past: R. S. Sharma (Oxford University Press, Seventh impression 2009)
- India A History: From the Earliest Civilisations to the Boom of the Twenty-First Century by John Key (Harper Collins, 2010)
- https://en.wikipedia.org/wiki/Sangam_literature
এই গ্রুপের সাথে সাযুজ্য পূর্ণ চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। উপকৃত হই
ধন্যবাদ
অসাধারণ সুন্দর উপস্থাপনা এবং তথ্য সম্ভার। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ। ডাউনলোড করে রাখলাম। দরকারে এখান থেকেই রেফারেন্স দেওয়া যাবে।
ধন্যবাদ
খুব ভালো
ধন্যবাদ
খুব দরকারী একটা লেখা পড়লাম ।ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ
খুবই ভাল লাগল।
উত্তর ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। কিন্তু পূর্ব ভারতীয় হয়েও আমরা পূর্ব ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে অতটা ভালো জানিনা, বিশেষ করে প্রাচীন ইতিহাস। আর দক্ষিণ ভারত? তা যেন একেবারেই আমাদের জানাশোনা ভারতবর্ষের বাইরে।
কোন প্রশংসাই এ লেখার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
তবু শেষে একটুখানি ত্রুটি ধরার চেষ্টা করি। এক জায়গায় লেখা হয়েছে চুরি-চামারি। অনুর্বর এলাকার মানুষজন চুরি করবেন, ডাকাতি করবেন, কিন্তু চামারি করবেন কেন সেটা বোঝা গেল না।
ঠিক করে দিয়েছি স্যার| এই ভুল’টি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যি ধন্যবাদ|
খুব সুন্দর একটা পোস্ট পেলাম
ধন্যবাদ
অসাধারণ দাদা, বিমোহিত হয়ে গেলাম । অনেক কিছু জানলাম ।
ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগলো। খুব জরুরী বিষয় যেটা বাংলায় কম আলোচিত হয়েছে
ধন্যবাদ
চমৎকার লেখা। খুব ভালো লাগল।
প্রসঙ্গত তামিল ব্যাকরণ নিয়ে আরো দু চার কথা নিবেদন করি।
প্রাচীনতম তামিল ব্যাকরণের নাম তোল্কাপ্পিয়ম। এটি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়েছিল। মূলত ব্যাকরণগ্রন্থ হলেও এতে প্রচুর তামিল কবিতার নিদর্শনও রয়েছে। তোল্কাপ্পিয়ম গ্রন্থটি তিনটি বর্গে বিভক্ত, প্রতিটি বর্গে রয়েছে নয়টি করে অধ্যায় এবং প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে অনেকগুলি সূত্র। বইটিতে সর্বমোট ১৬০০ সূত্র আছে। তোল্কাপ্পিয়মের প্রথম বর্গটির নাম এলুত্তিতিকারম্। এখানে ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক ৪৮০ টি সূত্র রয়েছে। ধ্বনি, তাদের সংখ্যা, বিভাজন, উচ্চারণ, ধ্বনির উৎপত্তি ও সন্ধি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির দ্বিতীয় বর্গের নাম চোল্লতিকারম্। ৪৬০ টি সূত্রে এখানে আলোচিত হয়েছে বাক্যরীতি ও রূপতত্ত্ব। ১, ২, ৩, ৪ নং অধ্যায়ে রয়েছে বাক্যরীতির আলোচনা। ৫ থেকে ৯ নম্বর অধ্যায়ে রয়েছে রূপতত্ত্ব, শব্দগঠন সম্পর্কিত আলোচনা। বইটির তৃতীয় বর্গটির নাম পোরুলতিকারম্। এখানে কাব্যশাস্ত্র বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। কাব্যশাস্ত্রর শ্রেণিভেদ, অলঙ্কার, ছন্দ, রস প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে ৬৬০ টি সূত্রে।
তোল্কাপ্পিয়মে তামিল ভাষার শব্দাবলীকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১) ইয়ারচোল – খাঁটি তামিল শব্দ ২) তিরিচোল – এগুলিও খাঁটি তামিল শব্দ। কিন্তু তামিল কবিতায় ব্যবহৃত হবার ফলে এ সব শব্দে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ৩) তিচৈচ্চোল – প্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আহৃত শব্দ। এগুলি মূলত তেলুগু, কন্নড় ভাষার শব্দ। ৪) বটচোল – সংস্কৃত থেকে গৃহীত শব্দ। সংস্কৃত শব্দসমূহ তামিলে চারভাগে গৃহীত হয়েছে। ক) তৎসম – সংস্কৃত বানান বজায় রেখে খ) অর্ধতৎসম – কৃষ্ণ > কিরুষ্ণন্ গ) তদ্ভব – কৃষ্ণ > কন্নন্ ঘ) তামিলের ধ্বনি পরিবর্তনের সূত্র অনুযায়ী। ব্রাহ্মণ > পিরাম্মন্ (তামিল) > বরামন্ (তেলুগু)।
পি এস সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী মনে করেছেন তোল্কাপ্পিয়ম্ ব্যাকরণে প্রাতিশাখ্য, যাস্কের নিরুক্ত, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ও বিভিন্ন শিক্ষা গ্রন্থের প্রভাব পড়েছে। তিনি তাঁর হিস্ট্রি অব গ্রামাটিকাল থিওরিজ ইন তামিল (১৯৩৪) বইতে আরও অনেক তামিল বৈয়াকরণের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন তোল্কাপ্পিয়মের টীকাকার ইলম্পূরণর্ (খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী), বীরচোলিয়ম্ এর রচনাকার পুত্তমিত্তিরণার্ (একাদশ শতাব্দী), নেমিনাতম্ রচয়িতা কুণবীরপণ্ডিতর্ (ত্রয়োদশ শতাব্দী), নন্নূল রচয়িতা পবণন্তি (ত্রয়োদশ শতাব্দী), পিরযোকবিবেকম্ রচয়িতা চুপ্পিরমনীয় তিট্চিতর্ (সপ্তদশ শতাব্দী) ইত্যাদি।
এই সম্পর্কে আগ্রহীরা দেখতে পারেন তোলকাপ্পিয়াম এর ইংরাজী অনুবাদক সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর এই বইটি। P S Subrahmanya Sastri – History of grammatical theories in Tamil
এই মূল্যবান তথ্যগুলি জানানর জন্য আনেক ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগল বিষয়টি পাঠ করে……………অনেক বিষয় সম্পর্কে অবগত হলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে।
লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে উৎসাহ পেলাম| ধন্যবাদ|
অনেকদিন বাদে খুব সুন্দর একটা পোস্ট ইতিহাস নিয়ে।
ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগল।এখন চোখ বুলিয়ে মনে হল যে ধীরে ধীরে পড়তে হবে।
অবশ্যই| পড়ে আপনার মতামত দেবেন|
আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র। আমাদের স্নাতক প্রথম বর্ষে সঙ্গম সাহিত্যের নির্বাচিত কিছু কবিতা ও তার প্রেক্ষাপট পড়ানো হয় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য হিসেবে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, ধম্মপদ, গীতা, বিষ্ণুপুরাণের সাথে। সে সূত্রেই, স্বাভাবিকভাবেই খুব খুব সাহায্য করলো এই প্রবন্ধটি আমায়।
অনেক শুভ কামনা ও ভালোবাসা।
লেখা’টা আপনার কাজ’এ লেগেছে জেনে ভালো লাগলো| আপনার জন্যেও রইল অনেক শুভকামনা|
সঙ্গম সাহিত্য নিয়ে অনেক বই পড়েছি তবে এত সুন্দর ডিটেলসে কোন লেখা পাইনি বা তাদের লেখা পেলেও ভাষা অত্যন্ত কঠিন হওয়ার দরুন অনেক জায়গায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু আপনার এই লেখাটি পড়ে মনে হল যে বিষয়টি আরও অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠেছে এবং খুব সহজেই পুরো তথ্য থেকে কভার করা হয়েছে ভীষণ ভালো লাগলো আরেকটি ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় একটি পোষ্ট ধন্যবাদ এবং ভবিষ্যতেও চাইবো যে আপনি এরকম অনেক তথ্য আমাদের সাথে শেয়ার করুন…