সম্পাদকীয়
‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক‘ ওয়েব পত্রিকার প্রথম এক মাস – কিছু কথা, কিছু লেখা
দেখতে দেখতে ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ বাংলা ওয়েব পত্রিকার এক মাস পূর্ণ হল। এই সময়টা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সদ্যজাত শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা তো সহজ কাজ নয়। ওয়েব পত্রিকাটি ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, ইতিহাস বিষয়ক আকাদেমিক বিদ্বানদের এই পত্রিকা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। এখানে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে বাছাই করা প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে, আবার অনেকের লেখা সরাসরি এই পোর্টালে প্রকাশিত হচ্ছে।
এই একমাসে বিভিন্ন বিষয়ে দশটি নতুন লেখা এসেছে। আম্বেদকার ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইসলাম, সঙ্গম সাহিত্য, বাংলার বাউল সাধনা ও বাউল গান, নালন্দার শেষ অধ্যায় – বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা, বাংলার জৈন, বাঙালি জৈন কথা, ক্যাতিন গণহত্যা রহস্য, প্রমাণাদি ও রহস্যের সমাধান, জালিয়ানওয়ালাবাগ: পদত্যাগে দেরী কেন?, হারিয়ে যাওয়া এক রাজধানী আর সমুদ্র গুপ্তের মোহর। এসেছে একটি গ্রন্থ পর্যালোচনা – সুলতানি যুগের ইতিহাস চর্চা ও বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি।
চারটি লেখা নিয়ে এবারের সম্পাদকীয়তে আমরা আলোচনা করব।
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইসলাম’ প্রবন্ধটি লিখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অমিত দে। রবীন্দ্রনাথের মুসলিম সমাজ সম্পর্কে মনোভাব কেমন ছিল? হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বিষয়ে তাঁর মতামত কী ছিল? তিনিও কি ইসলাম ও মুসলিম সমাজকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালা রূপ দিতে আগ্রহী ছিলেন? দুই ধর্মের মানুষের সম্পর্কের জটিলতার দায় কার? এক নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রফেসর অমিত দে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সাথে ইসলামের সম্পর্ক।
বিশ্বজিৎ রায় ভূগোলের অধ্যাপক, কিন্তু তাঁর উৎসাহ আছে ইতিহাসেও। তিনি ‘হারিয়ে যাওয়া এক রাজধানী আর সমুদ্র গুপ্তের মোহর’ নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন। দেবলগড় প্রত্নক্ষেত্র দশকের পর দশক ধরে সাক্ষী থেকেছে এক রহস্যময় উদাসীনতার। সেখানে পুকুর কাটার সময়, বাড়িঘর তৈরির সময়, চাষের মাঠে কৃষকের লাঙলের ফলায় উঠে আসে বিরাট বিরাট মূর্তি, প্রাসাদের নক্সাদার পাথরের চাঁই, ধাতুর বুদ্ধমূর্তি, সোনা-রুপোর মুদ্রা, নানা আকার আয়তনের নক্সাদার ইট আরও কত কি! সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে অভিযানে চলুন ইতিহাস সন্ধানী অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়ের সাথে। অতি যত্নে লেখা বিশ্বজিৎ রায়ের এই প্রবন্ধটি স্থানীয় ইতিহাসের রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচনে সচেষ্ট। এধরণের প্রচেষ্টা ইউরোপে হামেশা দেখা যায়। আমরা তাতে বাহবা দেই। নিজের ঘরের মানুষ আজ সেই প্রচেষ্টা নিচ্ছেন, আমরা তাঁর সাথী হতে পেরে গর্বিত।
এছাড়াও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে সঙ্গম সাহিত্য নিয়ে শান্তনু ভৌমিকের লেখাটি। পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে তামিল ভাষা। এই তামিল ভাষায় লেখা প্রথম জ্ঞাত সাহিত্যকীর্তি হল ‘সঙ্গম সাহিত্য’। সেই সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় সামান্য। সত্যি কথা বলতে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প নিয়ে উত্তর ভারতে চর্চা তুলনায় নিতান্তই কম, আর বাংলার ইতিহাস চর্চা সেই ধারাতেই বহমান। শান্তনু সাহস করেছেন দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যময় সাহিত্যের ইতিহাস শোনাতে। শান্তনুকে জানাই অভিনন্দন।
এবার আসি গ্রন্থ পর্যালোচনায়, ‘সুলতানি যুগের ইতিহাস চর্চা ও বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি’। নিয়ে একটু আলোচনা করি। আলোচ্য বইয়ের নাম Muslim Rule in Medieval India: Power and Religion in the Delhi Sultanate। লেখিকা পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা ফৌজিয়া ফারুক আহমেদ। পর্যালোচনা করেছেন ইতিহাসের শিক্ষক ও আজীবন ছাত্র কুন্তল রায়।
রিভিউ পড়ে অনুভব করা যায় এই রিভিউয়েরও রিভিউ করা সম্ভব। সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষের সুলতানি যুগের বিভিন্ন ধারায় ইতিহাস লেখার ইতিহাস, বইটির গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী অংশের আলোচনা, কোথায় বইটি আরও উন্নত হতে পারত – এসবই আলোচিত হয়েছে এই রিভিউয়ে। লেখিকা নিজে কুন্তল রায় কে তার অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সম্পাদকমণ্ডলীর তরফ থেকে সকল লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানাই। আগামী মাসেও আমরা সচেষ্ট হবে নানা স্বাদের প্রবন্ধ নিয়ে আসতে। ইতিহাস নিয়ে আড্ডা দিতে।