সম্পাদকীয়
বাংলায় অনলাইন ইতিহাস চর্চার ওয়েব পত্রিকা
শুধুমাত্র ইতিহাস নিয়ে একটা বাংলা ওয়েব পত্রিকা প্রকাশকরবার প্রবল ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের অনেকের মধ্যে কাজ করছিল।
ইতিহাস কেবলমাত্র তথ্যের ভাণ্ডার নয়, অতীতের ঘটনাবলীর বিবরণ নয়। এক নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাবলীর তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ বিশ্লেষণ করে ইতিহাস। আবার ইতিহাসের ছায়ায় আমরা অনুধাবন করি আজকের ঘটনাক্রম। অতীতের সাথে মিলিয়ে নিই বর্তমানকে। একটা সময়ে ইতিহাস লেখা হয়েছে পরাক্রমশালী রাজন্যের প্রশ্রয়ে। তাদের আশীর্বাদধন্য ঐতিহাসিকরা পোষকের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পূর্ণ আখ্যান লিপিবদ্ধ করতে পারতেন না, হয়ত বিজয়ীপক্ষে থাকায় তারা তা চাইতেনও না। পরাজিতদের ইতিহাস তাই হারিয়ে যায় সময়ের চোরাবালিতে। তবে জয়ীরা যাদের দুর্জন ঠাউরেছেন তারা ছিলেন পরাজিতদের নায়ক। তারা সকলে খলনায়ক ছিলেন না।
রোমান ক্রীতদাস স্পার্টাকাস ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে পরাজিত হয়েছেন। যেটুকু বিবরণ তার সম্পর্কে পাওয়া যায় তা অসম্পূর্ণ। তবু যখন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে আধুনিক যুগে মানুষ আন্দোলন করেছে,তখন তার নাম চলে এসেছে একেবারে পুরোভাগে। ইতিহাস ভুলে গেছে দাস বিদ্রোহের দমনকারীদের নাম। কিন্তু লোককথায়, গল্পে, সিনেমায় স্পার্টাকাস অমর হয়ে গেছে।
সেই ১৮৫৫ সালে উচ্চবর্ণের অত্যাচারী মহাজন, জমিদার, জোতদার ও তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সিধু ও কানু মুর্মুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়েছিল। অসম সেই যুদ্ধে তীর, ধনুক, টাঙি সম্বল করে কামান, বন্দুকের মোকাবিলা করা সম্ভব হয় নি। রাষ্ট্রশক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেই বিদ্রোহ। সেই সময়ে তাদের কথা শহুরে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা জাগায়নি, ওদের পাশে অন্যরা এসে দাঁড়ায়নি। তবে নিপীড়িত উদ্দীপ্ত মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার শিক্ষা পরবর্তী গণআন্দোলনগুলিতে প্রভাব ফেলেছে। একসময়ে হুল বিদ্রোহ ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
ইতিহাস লেখায় তাই সমকালীন রাষ্ট্রশক্তি, বিজয়ীর ভূমিকা যেমন গুরুত্ব পায় আবার তার বিপরীতে সেই সময়ের সাধারণ মানুষের কথা, তাদের জীবন ও লড়াইয়ের কথাও আজকে আরেকদল ঐতিহাসিক চর্চা করেন। শুধু ঘটনার পরিণতি নয়, ইতিহাস বিশ্লেষণে সেই সময়ের নানা কার্যধারা ও তার প্রক্রিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণভূমিকা নেয়। তাই আধুনিক কালে ঘটনার পরিণতিতে আটকে না থেকে নানাজন নানা দৃষ্টিতে ইতিহাসকে দেখেন, নানাভাবে সেই সময়কালকে বিশ্লেষণ করেন।
ইতিহাস শুধু বর্ণনা নয়, ইতিহাস ধরা পরে ঘটনার বিশ্লেষণে। সেই বিশ্লেষণ পথ দেখায় পরবর্তী প্রজন্মকে।
আজকে যে ইতিহাস লেখা হচ্ছে সেখানেও কি আছে শক্তিধরের সন্তোষ উদ্রেকের বাসনা? হয়তো আছে। আবার সেই প্রবণতার বিপরীতে দুর্দশাগ্রস্ত ও সংগ্রামরত মানুষের কথা সমান্তরাল ইতিহাসে লেখা হচ্ছে, হয়েছে। ধর্মীয়, বর্ণগত বা জাতিগত বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে সেই ইতিহাস বিশ্লেষণ করা বড় প্রয়োজন।
আজ থেকে দুই বছর আগে এই উদ্দেশ্যেই আমরা ফেসবুকে একটা ইতিহাসের গ্রুপ তৈরী করেছিলাম।‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’। দুই বাংলার অজস্র শুভানুধ্যায়ীর প্রশ্রয়ে আজ তা বিরাটাকারে ডালপালা মেলেছে। দেশ, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে আলোচনারউত্তরণ হচ্ছে। সেই শুভানুধায়ীরাই আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন।
তাই আজ এই দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা পা ফেলতে সাহস পেলাম; শুধুমাত্র ইতিহাসচর্চার জন্য বাংলা ওয়েব পত্রিকা তৈরী হল। বাংলা ভাষায় এই প্রয়াস সম্ভবত প্রথমবার নেওয়া হল।
আমরা এখানে ইতিহাস নিয়ে আড্ডা দেব। ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে বাছাই করা প্রবন্ধ এখানে প্রকাশিত ও সংরক্ষিত হবে। আবার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করছেন, এমন বিশিষ্ট জনের লেখাও প্রকাশ করা হবে। আকাদেমিক ইতিহাসচর্চার অঙ্গনের বাইরে, কিন্তু আকাদেমিক চর্চা থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, ইতিহাস ও ইতিহাসবোধকে মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ করে তোলার কাজে সৃজনশীল প্রচেষ্টা হিসেবে আমাদের এই মঞ্চ কাজ করবে।
ইতিহাসের সমস্ত দিক নিয়ে চিন্তাশীলপ্রবন্ধ আমরা এই ওয়েব পত্রিকায়তুলে ধরব। প্রবন্ধগুলি লেখক-পাঠক মতবিনিময় ও নতুন চিন্তার নির্মাণে সেতুর ভূমিকা পালন করবে। এই মঞ্চ হয়ত একদিন বহু মানুষের মিলন, আলোচনা ও বিশ্লষণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে।
সম্পাদকমণ্ডলীর তরফ থেকে সকল পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানাই ।