আলোক বিজ্ঞানের ইতিহাস: সাহা, বোস ও রামন
নব তরঙ্গ
ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের গোড়ায় বিজ্ঞানবিশ্বে এক বৈপ্লবিক আলোড়ন শুরু হয়েছিল। সনাতনী ধ্যানধারণা ভেঙে পড়ছিল। নতুন বোধ তৈরি হচ্ছিল। নিউটনীয় যান্ত্রিকতার যুগ থেকে অপেক্ষবাদ ও কোয়ান্টাম বীক্ষার যুগে উত্তরণের সেই পর্বে তাত্ত্বিক প্রতীতি ও পরীক্ষামূলক প্রমাণের কাজে যারা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন। আধুনিকতার সেই চেতনা প্রবাহে অগ্রদূত হয়ে ১৯২০’র দশকে সামনে আসেন তাঁরা, এবং দেশীয় জ্ঞানচর্চার ধারায় সঞ্চারিত করেন বিশ্বলোকের সাড়া। পরাধীন দেশের জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক আবেগ তাঁদের যত বিজ্ঞান সাধনার অজানা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ যুগিয়েছে ততই তাঁরা চিন্তায়-চেতনায়-কর্মে-জীবনে হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক। মূলত এই তিন বিজ্ঞানীর আজীবন কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানচর্চার ভিত্তি ও সুবিস্তৃত ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। এঁদের একশ বছর আগে (১৮১৪-৪০) এদেশে আধুনিকতার ঊষাকালের প্রথম আলো আমরা পেয়েছিলাম রামমোহন-ডিরোজিও-ডেভিড হেয়ার ত্রয়ীর স্বল্পস্থায়ী সময়ে। আর, বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞান শিক্ষার দ্বিতীয় জোয়ার এসেছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের কালপর্বে।
পলাশীর যুদ্ধের দু-তিন দশকের মধ্যে ব্রিটিশেরা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বানিয়েছিল সেগুলি ছিল মূলত ব্রিটিশ শাসনের বিচারব্যবস্থাকে ভারতীয় ধারার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে। কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১) ও বেনারস সংস্কৃত কলেজ (১৭৯১) গড়ে তোলা হয়েছিল যথাক্রমে আরবিয়-ইসলামী ও হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারার নিয়মনীতি ও সামাজিক-পারিবারিক আইনকানুন চর্চার কেন্দ্র হিসেবে, যাতে করে ব্রিটিশ বিচারকেরা সেসব জেনে বুঝে নিতে পারেন। ১৭৮৪ সালে উইলিয়াম জোন্স কোলকাতায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ স্থাপন করেন। এটিই ভারতের প্রথম আধুনিক গবেষণাকেন্দ্র, কিন্তু তা ছিল কেবলমাত্র ব্রিটিশদের কাজের জন্য, ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিলনা। পরবর্তীতে ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির সাম্রাজ্য ও শাসনকার্য যত প্রসারিত হয়েছে তত প্রয়োজন পড়েছে এদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের, আর তার পরিপূরক হিসেবে গণশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন প্রাচ্যবাদী মনীষীদের ক্রমবর্ধমান উদ্যোগ। ১৮৫৪ সালের সুবিখ্যাত ‘উডস ডেসপ্যাচ’-এর সুপারিশগুলিতে ব্রিটিশদের তরফ থেকে ভারতে গণশিক্ষা প্রসারের এক সামগ্রিক উদার পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। সেই লক্ষ্যেই কলকাতা ও বম্বে সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। মাধ্যম হিসেবে প্রাথমিক স্কুলে মাতৃভাষা, মিডল স্কুলে মাতৃভাষা ও ইংরেজি এবং উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি—এরকম ভাষা সূত্রের সুপারিশ ছিল উডস ডেসপ্যাচে। প্রতিটি জেলায় সরকারী স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারী সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশ ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই, মহাবিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ শাসকদের এই ‘উদারতা’ মিলিয়ে যায়।
একদম প্রথম পর্বে আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানচর্চা প্রচলন করার ক্ষেত্রে ‘মাদ্রাসা’ ও ‘সংস্কৃত কলেজ’ উভয় দিক থেকেই বাধা এসেছিল। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু চিন্তানায়কেরা অবশ্য অচিরেই তাঁদের ‘দ্বৈত’ স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে ফেলেছিলেন। ইংরেজি ভাষা তথা ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানকে আপন করে নেওয়া প্লাস বাংলা ভাষায় সেসবের ভারতীয় করণ। অন্যদিকে, উপনিবেশ স্থায়ী করতে বিজিত জাতীর মধ্যে থেকে শাসকের বোল-চাল-সংস্কৃতিতে এক তাঁবেদার গোষ্ঠী তৈরি করা ছিল উপনিবেশবাদী প্রভুদের লক্ষ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এই দুই বিপরীতমুখী উদ্দেশ্যর টানাপোড়েনের মঞ্চ হিসেবে বিকাশ লাভ করতে থাকে। এই পর্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও আরও কিছুটা পরে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকাররা পথিকৃৎ। একদিকে প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড বা অ্যাক্টিভিজমের জগতে বিদ্যাসাগর, অন্যদিকে লেখালেখির মাধ্যমে চিন্তাজগতে অক্ষয়কুমার দত্ত ঝড় তুলছিলেন; বহুমুখী কর্মকাণ্ডে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নিজেই হয়ে উঠেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আপনাতে আপনি এক প্রতিষ্ঠান’। ১৮৪৭ সালে আসে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন বেদ বেদান্তের সারসত্যকে তত্ত্ববোধিনীর মাধ্যমে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত তাকে পরিণত করলেন বিজ্ঞান পত্রিকায়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে প্রাঞ্জল বাংলায় পরিচিত করতে থাকলেন সাধারণ বাঙালীদের মধ্যে। বিদ্যাসাগর তাঁর ‘জীবনচরিত’ সিরিজে কেবলমাত্র আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের জীবন নিয়ে লেখার কারণে সমালোচিত হলেন। ব্রাহ্ম নেতাদের সাথে এই মতাদর্শিক লড়াইয়ে নতি স্বীকার না করায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাটাই শেষ পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের। অক্ষয়কুমারের নিম্নলিখিত যে সরল দার্শনিক সমীকরণটি বহুভাবে আজ পর্যন্ত উদ্ধৃত হয়ে আসছে তা সেই দ্বন্দ্বের মেজাজকে প্রকাশ করে-
শ্রম = ফসল
প্রার্থনা + শ্রম = ফসল
সুতরাং, প্রার্থনা = ০
“মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ”-এই অমোঘ বাণী তাঁরই। অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে আধুনিক অভিব্যক্তি দেন বিজ্ঞানের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ সৃজন করে; বাঙালী পায় ‘রসায়ন’ ও ‘পদার্থবিদ্যা’, ‘অঙ্গার’ ও ‘চুম্বক’, ‘আগ্নেয়গিরি’। ঐতিহ্যর পবিত্র ধারণাকে এঁরা সকলে চ্যালেঞ্জ করছিলেন, সনাতনী নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবমুখী চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করছিলেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৭০ সালে এক বক্তৃতায় বলেন “দেশপ্রেম বলতে যদি যা কিছু আমাদের নিজস্ব তার সব কিছুকেই ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধের মত ভালোবাসা বোঝায় তাহলে সেরকম দেশপ্রেম থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়”। ১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লেখেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’, যা এক সর্পিল অন্তর্ঘাতে উল্টে দেয় যুগযুগ ধরে আমাদের অস্থিমজ্জার অন্তর্গত হয়ে যাওয়া দেব/রাক্ষস, ভালো/মন্দর জাতবাদী বয়ান। সমাজের অভিজাত স্তরে এই চর্চিত আলোকিত বৌদ্ধিক আলোড়নের নীচে, প্রায় সমগ্র ঊনবিংশ শতক জুড়ে বাংলার পূর্ব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল আরেক নবজাগরণ। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভাবান্দোলন ও তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাংলার ‘চণ্ডাল’-দের সাংস্কৃতিক জাগরণ, যা মতুয়া/নমশূদ্র আন্দোলন নামে পরিচিত। শ্রেণীস্বার্থে পরস্পর বিরুদ্ধ দুই বর্গের অভ্যন্তরে এই দুই জাগরণেই ভারতের বৌদ্ধ বিপ্লবের ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী উত্তরাধিকারকে পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া ফল্গুধারার মত কাজ করেছে।
১৮৭৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখদের সহযোগিতায় মহেন্দ্রলাল সরকার ও ইউজেন লাফঁ প্রতিষ্ঠা করেন পরাধীন দেশের প্রথম স্বাধীন বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কালটিভেশন অব সায়েন্স’। উদ্দেশ্য ঘোষিত হয়েছিল, “যাঁহারা এক্ষণে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ বিজ্ঞানশাস্ত্র অধ্যয়নে একান্ত অভিলাষী আছেন, কিন্তু উপায়াভাবে সে অভিলাষ পূর্ণ করিতে পারিতেছেন না এইরূপ ব্যক্তিগণকে বিজ্ঞানচর্চা করিতে আহ্বান করা হইবে”। কিন্তু ‘উপায়াভাব’ দূর করতে খুব বেশী সফল হতে পারেননি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, শেষ জীবনে মন্তব্য করেছিলেন যে, লোকের দ্বারে দ্বারে অর্থের জন্য ঘুরে না বেরিয়ে নিজেই ডাক্তারিতে মনোযোগ দিলে হয়তো আরও বেশি অর্থ একত্রিত করতে পারতেন। বিজ্ঞান জগতে এই পর্বের শ্রেষ্ঠ ফসল হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। এই পর্বের চিন্তাচেতনার আলো বিংশ শতকের গোড়ায় নবতরঙ্গের অন্তর্লীন জীবনীশক্তি রূপে পৌঁছে দিয়েছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, যাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও কাজের মৌলিকত্ব ও মরমিয়া সৌন্দর্য এখনও নিত্যনতুন উপলব্ধিতে আবিষ্কৃত হচ্ছে, প্রযুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক কারিগরির বিকাশে; আর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার চিরায়ত ধারার ঐতিহাসিক গতিরুদ্ধতার পেছনে ব্রাহ্মণ্য ‘মায়াবাদ’ ও গোঁড়ামির ভূমিকা এবং চর্চার ধারায় বারবার আসা ছেদের পেছনে ‘আর্য’ থেকে শুরু করে ‘ব্রিটিশ’ পর্যন্ত বহির্দেশীয় শাসককুলের আগ্রাসনের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে দেন ১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ গ্রন্থে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পৃথিবীর বুকে হাঁটাচলা শুরুর আদি পর্ব থেকেই মানুষ আলো-ছায়া লক্ষ্য করে আসছে। কিন্তু, আলোর ঋজুরেখ গতির মূল বিষয়গুলি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রথম লিপিবদ্ধ করেন চীন দেশের বৈজ্ঞানিক দার্শনিক মো-শি (Mo-Zi, ৪৭০-৩৯১ খ্রিস্টপূর্ব) ও তাঁর সম্প্রদায়, গৌতম বুদ্ধর জন্মের প্রথম শতকে। মো-শির প্রধান অবদানগুলি ছিল: লিনিয়ার অপটিকসের মৌলিক ধারণার রূপরেখা — আলোর ঋজুরেখ গতি, ছায়া ও প্রতিচ্ছবি, সমতল অবতল ও উন্নততল আরশি দ্বারা আলোর প্রতিফলন, সূচীছিদ্র ক্যামেরা, এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে আরেক স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় আলোর প্রতিসরণ ও জলের প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়। প্রায় একই সময়ে গ্রীক চিন্তাবিদ ইউক্লিড (৩০০ খ্রিঃপূঃ) তাঁর ‘অপটিকস’ গ্রন্থে আলোর ঋজুরেখ গতি সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং আলোর প্রতিফলন জ্যামিতিক সূত্র আকারে প্রকাশ করেন। আরেক গ্রিক বিজ্ঞানী টলেমি (১০০ খ্রিঃপূঃ) আলোর প্রতিসরণ বিস্তৃতভাবে নিরীক্ষণ করেন।
চোখে আলো প্রবেশ করলে তবে আমরা দেখি, নাকি চোখের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করে বস্তুকে দেখি তা নিয়ে গ্রীক দার্শনিকেরা বহুকাল বিভ্রান্ত ছিলেন। পিথাগোরাস (৫০০ খ্রিঃপূঃ) দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে আমাদের চোখ থেকে নির্গত কোনও আলোকরশ্মিই বস্তুজগৎকে আমাদের চোখে দৃশ্যমান করে তোলে। গ্রেকো-রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর বিজ্ঞানচর্চার বিশ্ব-স্কুল গড়ে ওঠে আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাগদাদ শহরকে কেন্দ্র করে। আল খোয়ারিজমি ও আল কিন্দি ছিলেন যার প্রথম দিককার বিখ্যাত তাত্ত্বিক (আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী দার্শনিক ইবনে সিনা ওরফে আবিসেনা এই সময়েরই তাত্ত্বিক যিনি ভারতীয় গণিতশাস্ত্র রপ্ত করেছিলেন)। তাঁরা পিথাগোরীয় মডেল খারিজ করেন এবং আল হাসান ইবনে আল হাইসাম তাঁর ‘কিতাব আল মানজির’ (১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে আলোকরশ্মির জ্যামিতিক তত্ত্ব ও মানবচক্ষুর আভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত চর্চা করেন। ত্রয়োদশ শতকে এই কিতাবটি ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয় ও ইংরেজ বিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রজার বেকন তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপে দৃষ্টিদোষ নিরসনে লেন্সের ব্যবহার (আদি চশমা) প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিজ্ঞানের ভরকেন্দ্র ততদিনে আবার স্থানান্তরিত হয়েছে ইউরোপে। একাধিক লেন্সের চমৎকার ব্যবহারে নেদারল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয় কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ ও টেলিস্কোপ, জোহানেস কেপলার লেন্সের ফোকাস সংক্রান্ত বিস্তারিত গাণিতিক বর্ণনা হাজির করেন। আর, ইতালীয় বিজ্ঞানী গালিলেও গালিলি নব আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ যন্ত্রটির প্রভূত উন্নতি সাধন করে তা তাক করে বসেন মহাকাশের দৃশ্যমান জগতের তথাকথিত ‘স্বর্গীয় বস্তুপুঞ্জ’-র দিকে, ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৫৭ সালে ফরাসী গণিতজ্ঞ পিয়ে দ্য ফারমা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখান যে আলো একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সময় সেই পথটিই বেছে নেয় যে পথে যেতে সবচেয়ে কম সময় লাগবে। এবং, ১৬৭৬ সালে ডেনমার্কের ওলি রোমার বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদগুলির আবর্তনকাল নিরীক্ষা করে আলোর গতিবেগ মেপে ফেলেন।
আলোর চলাচলের জ্যামিতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এই দু’হাজার বছর ধরে প্রভূত তথ্য ও বৈজ্ঞানিক প্রত্যয় অর্জন করার শেষ দিকে স্বাভাবিকভাবেই নজর পড়ে আলোর ভৌত প্রকৃতির ওপর। আলো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গমন করে এবং সেই গমনের নির্দিষ্ট সসীম গতিবেগ আছে। আলো কি তাহলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণিকার তীব্রগতির প্রবাহ বিশেষ? অনেক দেখে, অনেক ভেবে আইজাক নিউটনের সেরকমই মনে হয়। ১৭০৪ সালে তাঁর ‘অপটিকস’ গ্রন্থে তা ব্যক্ত করেন, কিছুটা দ্বিধাভরে, সিদ্ধান্ত আকারে নয়, প্রশ্ন আকারে। তিনি বিজ্ঞানবিশ্বের সর্বমান্য আলোকবর্তিকা। ফলত ১৭২৭ সালে তিনি প্রয়াত হওয়ার পরও প্রায় একশো বছর পর্যন্ত তাঁর এই ধারণাই মান্য হয়ে ছিল এবং সমস্ত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা সেই ধারণাকেই বিস্তৃত করছিলেন, যদিও অনেক আগে ১৬৩৭ সালে ফরাসী গণিতজ্ঞ রেনে দেকার্ত আলো-কে সর্বব্যাপ্ত স্থিতিস্থাপক মাধ্যমে অসীম গতিতে প্রবাহিত এক ‘চাপ তরঙ্গ’ বা ‘প্রেসার ওয়েভ’ আকারে বর্ণনা করেছিলেন। ডাচ গণিতজ্ঞ ক্রিস্টিয়ান হয়গেন্স ১৬৯০ সালে তরঙ্গরূপে আলোর ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে লিখেছিলেন। তবু ঊনবিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত নিউটন প্রণীত আলোর বস্তুকণিকা মডেল টিকে ছিল। অবশেষে ১৮০২ নাগাদ এক ইংরেজ চিকিৎসক ও পদার্থবিদ টমাস ইয়ুং দেখান যে দুটি উৎস থেকে আসা আলো যদি পাশাপাশি এসে পরস্পরের উপর আপতিত হয় (‘ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট’ নামে খ্যাত) তাহলে পর্দার ওপর একটি প্যাটার্ন বা আলোকপট্টি সৃষ্টি হয় যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে আলো তরঙ্গধর্ম প্রকাশ করে। এক তরঙ্গের ওপর আরেক তরঙ্গের উপরিপাতনে বিভিন্ন ‘নোট’ সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গের এক অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে সকলেরই জানা ছিল।
আলোর তরঙ্গরূপ প্রকাশের এই অকাট্য প্রমাণ হাজির হলেও আলোকতরঙ্গের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব সামনে আসে আরও ষাট বছর পর ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ হিসেবে। তড়িৎ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছিলেন, চুম্বক নিয়েও। ডেনমার্কের বিজ্ঞানী হান্স ওরস্টেড ১৮২০ সালে প্রথম দেখান যে তড়িৎপ্রবাহের দ্বারা চৌম্বক বল তৈরি হয়। মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে বিপরীত ক্রিয়াটিও আবিষ্কার করেন, অর্থাৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের বাড়া-কমায় সৃষ্টি হয় তড়িৎ প্রবাহ। ফ্যারাডে কল্পনা করেছিলেন যে তড়িদাধান আসলে তার চার পাশে অসীম বিস্তৃত এক ক্ষেত্র তৈরি করে যা বহুদূরের অন্য কোনও তড়িদাধানের ওপর তড়িৎ ও চৌম্বক বলের প্রভাব সঞ্চার করে। ‘ক্ষেত্র’ বা ‘প্রভাব ক্ষেত্র’ হল এক শক্তিশালী গাণিতিক কৌশল যা যেকোনও প্রভাবকে স্থান ও কালের অপেক্ষক হিসেবে প্রকাশ ক’রে প্রতিটি স্থানাঙ্কে সেই নির্দিষ্ট প্রভাবের মানকে নির্ণয় করতে চায়। তড়িদাধান তড়িৎ ক্ষেত্রের উৎস, আর তড়িৎপ্রবাহ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের উৎস — এটুকু ফ্যারাডের আগেই বোঝা গেছে, ফ্যারাডে দেখালেন যে চৌম্বক ক্ষেত্রের ওঠা-নামাও তড়িৎ প্রবাহের উৎস। ম্যাক্সওয়েল সামান্য একটু এগিয়ে কল্পনা করে নিলেন যে কেবল চলমান তড়িদাধান নয়, তড়িৎ ক্ষেত্রের ওঠা-নামাও চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎস। তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের কল্পনা ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে একসূত্রে গেঁথে ‘তড়িচ্চুম্বকীয়’ ক্ষেত্রের ধারণা ও সমীকরণ সমূহে পৌঁছে গেলেন ম্যাক্সওয়েল। এই তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক প্রভাব পরস্পরকে ধরে রাখে, একটি প্রভাবের ওঠা ও নামা অপর প্রভাবটির যথাক্রমে নামা ও ওঠাকে নিরন্তর জন্ম দিয়ে চলে, আর এই দুই ওঠা-নামা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গরূপে এগিয়ে চলে যার গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান। ১৮৬৪ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটির সভ্যদের সামনে ম্যাক্সওয়েল তাঁর ভাষণে বলেন, “আমাদের খুব জোরালো কারণ আছে এই সিদ্ধান্ত টানার যে আলো নিজেই —বিকীর্ণ তাপও, অথবা অন্য যে কোনও বিকিরণ, যদি থাকে— আসলে তড়িচ্চুম্বকীয় কম্পন যা তড়িচ্চুম্বকীয় সূত্র মেনে তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে তরঙ্গ রূপে সঞ্চারিত হয়”। সহজ, সুন্দর ও সত্য। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বই পদার্থবিদ্যার প্রথম ‘ক্ষেত্র তত্ত্ব’ এবং তাঁর সমীকরণগুলি হয়ে ওঠে পদার্থবিদ্যার জগতে অশেষ ক্ষমতাবান। জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্তসের মুগ্ধ মন্তব্য, “এই বিস্ময়কর তত্ত্বটি পাঠ করলে মনে হবে যে গাণিতিক সমীকরণগুলির বুঝি স্বাধীন জীবন ও নিজস্ব মেধা আছে, যেন ওরা আদতে আমাদের থেকেও বুদ্ধিমন্ত, উনি ওদের মধ্যে যে অর্থ আরোপ করেছেন তার থেকেও অনেক বেশী যেন ওরা নিজেরাই প্রকাশ করছে”। হাইনরিখ হার্তসই প্রথম ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ পরীক্ষাগারে তৈরি করে দেখান, ১৮৮৭ সালে তিনি পরীক্ষা করে দেখান যে বিদ্যুৎ তরঙ্গ তারের সংযোগ ছাড়াই সঞ্চারিত হয়ে দূরবর্তী স্থানে গিয়েও স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে। হার্তস সৃষ্ট তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ছিল ৭০০ মিলিমিটারের কাছাকাছি। কলকাতায় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বুঝতে পারেন যে হার্তস সৃষ্ট অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ যে আসলে আলোক তরঙ্গের অনুবর্তী তা প্রমাণ করতে হলে অনেক ছোট তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের হার্তস তরঙ্গ তৈরি করতে হবে। ১৮৯৪-৯৯-এর মধ্যে তিনি তৈরি করেন ৫ মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ, সৃষ্টি হয় মাইক্রো ওয়েভ টেকনোলজি। রেডিও রিসিভার ও কোহেয়ারার তৈরি করেন জগদীশ, রোবট টেকনোলজির প্রথম ধাপ শুরু হয়। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বই ছিল তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র। আলোক তরঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ম্যাক্সওয়েলিয় তত্ত্বের সৌন্দর্য ও সাফল্যে মুগ্ধতার কয়েক দশক পেরোতে না পেরোতেই পরীক্ষালব্ধ দুটি বিষয় এই তত্ত্বের ব্যর্থতা হিসেবে সামনে আসে — কৃষ্ণিকা বিকিরণ ও আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। তাছাড়া নিজের তত্ত্বের যে সীমাবদ্ধতা ম্যাক্সওয়েলকেই তাড়িয়ে বেড়াত তা হল চলমান নির্দেশতন্ত্রে তাঁর ইকুয়েশনগুলির ভেঙে পড়া। এই খুঁতটির মোকাবিলা করাই ছিল আইনস্টাইনের প্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তা, যার পথ বেয়ে আইনস্টাইন অপেক্ষবাদের তত্ত্বে পৌঁছান। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে পড়ানোর সময় ম্যাক্সওয়েলিয় তত্ত্বের সিদ্ধান্তগুলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে আলোকণার পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব হাজির করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কোলকাতায় তিনি জগদীশচন্দ্র বোসের ছাত্র ছিলেন।
নতুন আলো
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের জন্ম। ঠিক সেই সময় বিশ্বচেতনার জগৎ এক নতুন দ্বন্দ্বের পর্বে প্রবেশ করছিল যার পূর্ণ প্রকাশ ১৯১৪ সালের মহাযুদ্ধ ও ১৯১৭’র সোভিয়েত বিপ্লবে দেখা গেল। বিজ্ঞান, সাহিত্য ও চারুশিল্প, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি — সমস্ত ক্ষেত্রেই ইউরোপের উন্নয়নসুখে উৎপাতের মত হাজির হচ্ছিল একের পর এক নতুন আবিষ্কার, প্রকাশের নতুন রূপ, নতুন বোধ, নতুন শক্তি। রাজনীতিতে সার্বজনীন (কেবল পুরুষদের) ভোটাধিকার পেয়ে শ্রমিকশ্রেণির পুরুষেরা সাম্যবাদী নেতাদের নির্বাচিত করে মালিকশ্রেণির আতঙ্ক বাড়াতে থাকে; প্রবল নিহিত শক্তি নিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব দরবারে দৃষ্টিগোচর হয়; রাজনৈতিক ইহুদিবাদের উদ্ভব ঘটে, এবং কেবল শিক্ষা ও সম্পত্তিতে অংশীদারিত্বের দাবি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নারী আন্দোলন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সমানাধিকারের সংগ্রামে উন্নীত হয়। খ্রিস্টীয় ভাবধারা তথা রেনেসাঁ পর্ব থেকে আধিপত্য করে আসা প্রকাশধারা নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিল শিল্প সাহিত্যের জগতে। জ্ঞানবিশ্বে সবচেয়ে নির্ধারক ও গভীর প্রভাব সম্পন্ন বিরোধাভাস সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিল পদার্থবিদ্যার মঞ্চে। বিশ্বচরাচর এক অতিকায় যন্ত্রবিশেষ যেখানে স্থান, কাল ও পদার্থ পরস্পর নিরপেক্ষ ও পাত্র নিরপেক্ষ সতত বিরাজমান, আর পদার্থ মাত্রই কতকগুলি অবিভাজ্য পরম অণুর সমাহার — নিউটনীয় বিশ্বের এই যান্ত্রিক ধ্যানধারণার নিশ্চিতি-আয়েশ ক্রমাগত শঙ্কাচ্ছন্ন হচ্ছিল, তথাকথিত ‘যুক্তিসিদ্ধ’ বিশ্বাসের নিটোল অহংকার টাল খাচ্ছিল। তিন টুকরো করে তিন সাম্রাজ্যের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়া প্রিয় জন্মভূমি পোল্যান্ড থেকে প্যারিসে আসা মারিয়া স্কোদস্কা কুরি ‘রেডিওঅ্যাক্টিভিটি’ গবেষণায় ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে দেখিয়ে দেন যে পরমাণু মোটেই ‘পরম’ নয়, বরং তার অন্তরেও আছে আরেক জগৎ যেখান থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন বিকিরণ। পদার্থের সেই হৃদজগতে তাত্ত্বিক যাত্রার দুঃসাহস নতুন ফিজিক্স হিসেবে সামনে আসে। পূর্বোক্ত ‘কৃষ্ণিকা বিকিরণ’ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বার্লিনের পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্ক ১৯০০ সালে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যে, তপ্তবস্তু থেকে নির্গত বিকিরণ নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটেনা বরং টুকরো টুকরো প্যাকেট হিসেবে, অর্থাৎ কোয়ান্টায় ঘটে। এই ধারণা মাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তত্ত্বের অবমাননা। ১৯০৫ সালে সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের ছাব্বিশ বছর বয়সী এক জার্মান কেরানি, নাম তাঁর এলবার্ট আইনস্টাইন, পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে ছ-ছটি মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার মধ্যে যুগান্তকারী হয়ে ওঠে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, দশ বছর পর যার দ্বিতীয় ভাগ —আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব— প্রকাশিত হয়। ব্যাপ্ত হতে থাকে বিশ্বচরাচরের আধুনিক বৈপ্লবিক ধারণা। ‘নিরবধি কাল’ তার সনাতনী পবিত্রতা ও স্বাতন্ত্র্য হারায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই বস্তুজগতের বাইরে অন্য কোনও পরমের উপস্থিতি অবান্তর হয়ে যায়। আইনস্টাইনের ভাষায়, “আগে এটা বিশ্বাস করা হত যে বিশ্বচরাচর থেকে সমস্ত পদার্থকে অপসারণ করে দিলে পড়ে থাকবে কেবল স্থান ও কাল। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী অবশ্য বস্তুসকল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে স্থান ও কালও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়”। ১৯০৫ সালে মনসমীক্ষণের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সামনে আনেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড; রাশিয়ায় আসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক মহড়া —পরবর্তীতে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বর্ণিত ‘ড্রেস রিহার্সাল’— সম্পন্ন হয়; এদেশে শুরু হয় ‘বঙ্গভঙ্গ’ ও তাকে ঘিরে একদিকে স্বদেশী জাগরণের ঢেউ অন্যদিকে পূর্ববঙ্গকে আলাদা প্রদেশ করার সমর্থনে এবং বাঙালী উচ্চবর্ণের অবস্থানের বিরুদ্ধে দলিত-শূদ্রদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিরোধ প্রচেষ্টা; মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ তখন মিডল স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছেন।
স্কুল জীবনের কিছু কথা
কল্লোলিনী কলকাতার গোয়াবাগানের ঈশ্বর মিল রোডের এক মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে ১৮৯৩ সালের ১ জানুয়ারি সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম। পিতা রেল কোম্পানির একাউন্ট্যান্ট, মাতামহ ছিলেন গণিতশাস্ত্রে এম এ পাশ তথা বোদরার বনেদি রায়চৌধুরী পরিবারের সন্তান। আজব ছাত্র সত্যেন। একবার হিন্দু স্কুলে তাঁর অঙ্কের শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছিল পরীক্ষায় সত্যেনকে ১০০ তে ১১০ দেওয়ার জন্য — শিক্ষক উপেন্দ্রনাথ বক্সী জবাবে জানিয়েছিলেন, সত্যেন প্রশ্নপত্রের সবকটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর লিখেছে এবং শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি অঙ্ক ও জ্যামিতিক সমস্যা একাধিক পদ্ধতিতে সমাধান করেছে, ফলত যতটা উত্তর লিখলে একজন ছাত্রকে পুরো নম্বর দেওয়া যায় সত্যেনের খাতায় তার থেকে অনেক বেশী আছে বলেই ১১০ দেওয়া হয়েছে নইলে সত্যেনের প্রতি অবিচার করা হত। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোলকাতায় রাখীবন্ধন কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ। ওদিকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছেন মেঘনাদ —বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অপরাধে— যদিও সত্যিই তিনি সেদিন বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। স্কুল কলেজ বয়কট করার কর্মসূচী চলছিল তখন। তারই মাঝে বাংলার গভর্নর ফুলার সাহেব এলেন স্কুল পরিদর্শনে। কিশোর মেঘনাদ জুতো মোজা না পরে খালি পায়ে এসেছে স্কুলে। এই ‘খালি পা’ গভর্নর সাহেবের প্রতি প্রতীকী অসম্মান প্রদর্শন হিসেবেই গণ্য হল। বহিষ্কার করা হল তাঁকে। মিডল স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে যে মাসিক চার টাকা বৃত্তি পাচ্ছিলেন তা কেড়ে নেওয়া হল। অথচ, বাস্তবে, দরিদ্র পরিবার থেকে আসা মেঘনাদের জুতা-মোজাই ছিল না। ঢাকা শহর থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক দরিদ্র বন্যাপ্রবণ দুর্গম গ্রাম শেওড়াতলিতে তাঁর বাবা জগন্নাথ সাহার ছোট্ট মুদি দোকান, মা ভুবনেশ্বরী দেবী। আট ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম মেঘনাদ, জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর। বাবা চেয়েছিলেন প্রাথমিক স্কুলের পর দোকানদারি করুক মেঘনাদও। মিডল স্কুল ছিল দশ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া গ্রামে। মেঘনাদের জেদ ও দাদা জয়নাথের আগ্রহে সেখানকার এক চিকিৎসক অনন্ত দাশের বাড়িতে স্নেহপূর্ণ আশ্রয় পেলেন। পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার বিনিময়ে বাড়ির কিছু কাজ ও গরু চরানোর কাজ সানন্দেই করে মেঘনাদ। ফাইনাল পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হয়ে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়। দাদা জয়নাথ চটকলের মজুর হিসেবে মাসে যে কুড়ি টাকা বেতন পেতেন তার থেকে পাঁচ টাকা পাঠিয়ে দিতেন ভাইয়ের জন্য, সরকারী বৃত্তি মাসে চার টাকা, আর পূর্ববঙ্গ বৈশ্য সমিতি দিত মাসে আরও দুই টাকা। মোট এগারো টাকায় থাকা-খাওয়া অবশ্য ভালোভাবেই চলে যেত মেঘনাদের। এই অবস্থায় মেধাবী কিশোর মেঘনাদের পক্ষে গভর্নরের সামনে সচেতনভাবে অসম্মান প্রদর্শন একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়। তবে সেদিন তিনি সচেতনভাবে কিছু করে থাকুন বা না থাকুন, কোন মেজাজ তার অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করত তা তাঁর নামেই প্রমাণ। ঝড়-জলের রাতে জন্মেছিলেন বলে বাবা নাম রেখেছিলেন ‘মেঘনাথ’। কিন্তু ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের প্রেরণায় তিনি নিজের নাম বদলে করে দিলেন ‘মেঘনাদ’। এই নাম বোধহয় সারা জীবন তাঁকে সঙ্গ ও সাহস দিয়েছে। যাই হোক, সেই উত্তাল স্বদেশী যুগে সরকারি স্কুল থেকে বহিষ্কার যেমন ছিল তেমনই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বহু ভারতীয় স্কুলে বহিষ্কৃতদের সাদরে ডেকে নেওয়াও ছিল। ফলত দাদার আর্থিক সহযোগিতায় কিশোরী লাল জুবিলি স্কুল থেকে পড়াশোনা চালাতে কোনও অসুবিধা হয়নি। সেখান থেকে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন মেঘনাদ, আর সত্যেন কোলকাতায় হিন্দু স্কুল থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাথ অনার্সে ভর্তি হয়ে একে অন্যকে আজীবন বন্ধু হিসেবে পেয়ে যান এই দুই ছাত্র —মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বোস— মেঘনাদ এলেন ঢাকা থেকে, সত্যেন্দ্রনাথ কোলকাতারই ছেলে। সে বছর বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে জোড়া লাগল দুই বাংলা, ব্রিটিশরা তাদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় কোলকাতা থেকে দিল্লীতে, আর ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে আর্নস্ট রাদারফোর্ড অবিশ্বাস্য সরল এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বসমক্ষে দেখান যে পরমাণুর বেশিরভাগটাই ফাঁকা যার কেন্দ্রে আছে ছোট্ট সলিড একটি ‘পরমাণু কেন্দ্রক’। শিক্ষকদের মধ্যে তখন রসায়নে প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও পদার্থবিদ্যায় জগদীশচন্দ্র বসু। মিশ্র গণিত বিভাগে বিএসসি ও এমএসসি দুটোতেই সত্যেন ফার্স্ট, মেঘনাদ সেকেন্ড। যে বছর বিএসসি পাশ করছেন সে বছরই, ১৯১৩ সালে, নীলস বর তাঁর পরমাণু মডেল পেশ করেন। তিনি বলেন যে পরমাণুর ভেতরে কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রনগুলি বিভিন্ন নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা বর্জন করে ইলেক্ট্রনগুলি এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে যায়। ব্রিটিশ সায়েন্স জার্নাল ‘ফিলসফিকাল ম্যাগাজিন’-এ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই ম্যাগাজিনটি প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে আসত। পদার্থবিদ্যার জগতে বরের তত্ত্বের তাৎপর্য তখন যাঁরা যাঁরা বুঝেছিলেন সত্যেন ও মেঘনাদ নিশ্চয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম দুজন। এর কিছুদিন পরেই ইউরোপে শুরু হয় মহাযুদ্ধ। তারই মাঝে, ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দুই বন্ধু এমএসসি পাস করে যখন বেরচ্ছেন তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ভারতে ফিরে আসছেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, অচিরেই যিনি হয়ে উঠবেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সর্বেসর্বা।
অজানায় ঝাঁপ
১৯০৭ সালে, ইন্ডিয়ান ফাইনান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে সদ্য চাকরি নেওয়া এক তরুণ অফিসার কোলকাতার ট্যাঁকশাল থেকে ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার পথে বৌবাজার স্ট্রিটে “ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অব সায়েন্স” লেখা বোর্ড দেখে ট্রাম থেকে নেমে ভেতরে ঢুকে পড়েন। সেখানে অনেক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি অথচ লোক নাই। কথিত আছে যে প্রায় অজ্ঞাত ও মলিন সেই গৃহের ভেতরে অমৃতলাল সরকার উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন সেই অচেনা যুবককে, বলেন, এতদিন আপনার মত একজনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। অমৃতলালের কাকা ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, যিনি স্থাপন করেছিলেন এই গবেষণাকেন্দ্র, ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন। আর সেই যুবক, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, সেদিন থেকেই লেগে গেলেন ‘কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে’, চাকরির ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ২৫ বছর এখানকার গবেষণাগারে কাজ করেই ১৯৩০ সালে পাবেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার যা ‘সাদা’ মানুষদের বাইরে প্রথম কোনও এশীয় বা ‘কালো’ মানুষের বিজ্ঞানে নোবেল প্রাপ্তি। ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর মাদ্রাজ প্রদেশের (বর্তমান তামিলনাড়ু) তিরুচিরাপল্লীর এক উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম রামনের, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার কৃতি ছাত্র। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মেডিক্যাল টেস্টে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বলেছিলেন “ওই লোকটির (মেডিক্যাল অফিসার) প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব”। মাস্টার ডিগ্রি করতে কলেজে ফিরে ক্লাসের বদলে মনোযোগ দিলেন গবেষণায়। ডিগ্রি পাওয়ার আগেই ১৯০৬ সালে বিখ্যাত ‘ফিলসফিকাল’ ম্যাগাজিনে একটি ছোট্ট নিবন্ধ প্রকাশ করে ফেলেছেন। ১৮০২ সালে বিজ্ঞানী ইয়ুং তাঁর ‘ডাবল স্লিট’ পরীক্ষায় দ্বি-ছেদ বিশিষ্ট বাধার ওপর উল্লম্বভাবে আলো ফেলে আলো ও অন্ধকার রেখার নিয়মিত পট্টি পেয়েছিলেন (সেই ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট)। আলো যে তরঙ্গরূপে চলে তা প্রমাণ হয়েছিল। কিন্তু উল্লম্বভাবে না ফেলে যদি বাঁকাভাবে, দ্বি-ছেদ-বিশিষ্ট বাধাটির তল ঘেঁষে, আলো ফেলা যায়? রামন দেখলেন যে সেক্ষেত্রে আর আলো-আঁধারের পট্টিটি অত নিয়মিত চেহারায় থাকছে না। ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গতত্ত্ব প্রয়োগ করে রামন এই অনিয়মিত পট্টি তৈরী হওয়ার ব্যাখ্যা লিখেছিলেন সেই নিবন্ধে। এর কিছুদিন পরেই ডিগ্রি ও চাকরি নিয়ে কোলকাতায়। আশুতোষ মুখার্জীর ডাকে ১৯১৭ সালে রামন ১১০০ টাকা মাইনের ট্যাঁকশালের চাকরি ছেড়ে চলে এলেন মাসিক ৬০০ টাকা বেতনে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ‘পালিত অধ্যাপক’ পদে। ততদিনে একতারা, বীণা, সেতার, তানপুরা, মৃদঙ্গ ইত্যাদি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সুর-স্বর-সঙ্গতির অ্যাক্যুস্টিক্সের ওপর তাঁর বিস্তারিত গবেষণার ফল ‘নেচার’ সহ বিভিন্ন নামজাদা বিজ্ঞান পত্রিকায় তিরিশটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে তখনই তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় বিজ্ঞানের মুখ্য প্রতিনিধি।
এমএসসি পাশ করে সত্যেন যখন ভাবছিলেন এবার কী করা যায়, মেঘনাদ তখন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ইন্ডিয়ান ফাইনান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসেস’ পরীক্ষা দিয়ে ভালো একটা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অঙ্কশাস্ত্র খুব ভালো লাগে, মেধাবী। কিন্তু, বিজ্ঞান সাধনার বিলাসিতা সাজে না মেঘনাদের। এখন ছোটভাই কলকাতা এসেছে দাদা মেঘনাদের কাছে থেকে লেখাপড়া চালাতে। টিউশন করে চলে মেঘনাদের, চাকরি দরকার। কিন্তু, আইএফএস পরীক্ষায় বসার অনুমতি পেলেননা মেঘনাদ। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা রিপোর্ট করেছে —বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত মেঘনাদ। এরকম সময়ে প্রেসিডেন্সি থেকে সদ্য এম এস সি পাশ করা তিন তরুণ — মিশ্র গণিতের ফার্স্ট সেকেন্ড সত্যেন ও মেঘনাদ এবং পদার্থবিদ্যার ফার্স্টবয় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ গিয়ে দাঁড়ালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সামনে। আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনজনই জানিয়েছেন যে তাঁরা এমএসসির স্টুডেন্টদের পড়াতে পারবেন। বস্তুত আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পঠনপাঠন-গবেষণার বিভাগগুলি প্রথম গড়ে উঠছে, গড়ে উঠছে ইউনিভার্সিটি সায়েন্স কলেজ। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মূলত কলেজগুলির পরীক্ষা পরিচালনাকারী ও নিয়ামকের ভূমিকায়। ব্রিটিশ সরকার নেটিভদের উচ্চশিক্ষায় তেমন আর্থিক সাহায্য দেবেনা, বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে রাসবিহারী ঘোষ, তারকনাথ পালিত ও খয়রাগড়ের রানী বিপুল অর্থ দান করলেন — শর্ত একটাই, কেবলমাত্র ভারতীয়দেরই অধ্যাপনায় বহাল করতে হবে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরামর্শে আশুতোষ বিলম্ব করলেন না তিন তরুণকে নিয়োগ দিতে। প্রভাষক পদে তাঁদের মাস মাইনে ১২৫ টাকা। সত্যেন ও মেঘনাদ শুরু করেছেন গণিত বিভাগ আর শৈলেন পদার্থবিদ্যা। কিছুদিনের মধ্যেই, ফিজিক্সের ল্যাবরেটরিটা দাঁড় করিয়ে, নতুন বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ অবশ্য নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন স্বদেশী বিপ্লবের টানে আর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তাড়ায়। সত্যেন ও মেঘনাদ ট্রান্সফার হয়ে গেলেন পদার্থবিদ্যা বিভাগে। কিছুদিনের মধ্যে রামন এলেন। ১৯১৭-১৯ প্রায় তিন বছর রামন, সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ একত্রে কাজ করেছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে।
বিশ্বযুদ্ধ চলছে, বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল কর্মকাণ্ড যেখানে চলছে সেই পশ্চিম দুনিয়া থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, ইউরোপের গবেষণাপত্র ও বিজ্ঞানের নতুন খবরাখবর নাগালে আসেনা সঠিক সময়ে। পড়াতে গিয়ে তাই নিজেদেরই বানিয়ে নিতে হচ্ছে পাঠ্যবস্তু। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করে নিতেন কে কোনটা পড়াবেন। মেঘনাদ পড়াবেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর সত্যেন্দ্রনাথ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। বইয়ের সন্ধান পেলেই ছুটছেন দুজনে —বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কাছে গিয়ে পাওয়া গেল পদার্থবিদ্যার দুটি বই, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন বসু জার্মানি থেকে ফিরে দিলেন কিছু বই— এভাবেই দুই তরুণ গড়ে তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ। কলকাতার কলেজগুলোর মত ঢাকা কলেজে মূল বিষয়ের বাইরে কোনও ঐচ্ছিক বিষয় নেওয়া যেত না, কিন্তু ঢাকা কলেজের দুই বছর মেঘনাদ প্রাইভেটে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে জার্মান ভাষা পড়েছিলেন রসায়নের অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ সেনের কাছে, যিনি ভিয়েনা থেকে ডক্টরেট করে এসেছেন। সত্যেন্দ্রনাথও কলেজে থাকাকালীন ফরাসী ও জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। দুই বন্ধু মিলে হাত লাগালেন ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এলবার্ট আইনস্টাইনকে পরিচিত করার কাজে। আইনস্টাইন ও মিনকাউস্কির পেপারগুলি জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করলেন দুজনে। আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে অনুবাদের অনুমতি নিয়েছিলেন সত্যেন বোস। অনূদিত নিবন্ধগুলি ইংরেজি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ভূমিকা লিখে দিলেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ যিনি মেঘনাদ-সত্যেনের এক বছরের সিনিয়ার ছিলেন এবং কেমব্রিজ থেকে ট্রাইপস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে এসে ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত এই পুস্তিকাটিই ছিল সারা বিশ্বে আইনস্টাইনের বিশেষ ও সার্বিক অপেক্ষবাদ তত্ত্বের প্রথম অনুবাদ। ১৯১৯ সালেই ২৯ মে এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সুযোগে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণ হয়ে গেছে অপেক্ষবাদের সার্বিক তত্ত্বের অভ্রান্ততা এবং বিজ্ঞানী মহলের পরিচিতির গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীর খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চলে এসেছে আইনস্টাইনের নাম ও ছবি, রাতারাতি দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাত হয়ে গেছেন তিনি; অপেক্ষবাদের মৌলিক ধারণাকে সহজ ভাষায় সাধারণ পাঠকদের কাছে তুলে ধরে সংবাদপত্রে (দ্যা স্টেটসম্যান) লেখার দায়িত্ব তখন মেঘনাদ সাহার ওপরই বর্তায়। ১৯১৯-এর সে বছর ভারত উত্তাল। বিনা বিচারে ভারতীয় নারীপুরুষকে কারাবন্দী করার কুখ্যাত আইন ‘রাউলাট অ্যাক্ট’-এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে দেশের মানুষ। সত্যাগ্রহ, অসহযোগ আন্দোলন। তারই মাঝে স্বাধীনতা বিদ্রোহীদের রক্তে প্লাবিত হয়েছে পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে আর বিশ্বজনতার মাঝে আলোড়ন ফেলতে শুরু করেছে রাশিয়ার সোভিয়েত সরকার। আরও এক বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে যাওয়ার পর মেঘনাদ রাশিয়া যান এবং ‘মাই এক্সপেরিয়েন্স ইন সোভিয়েত রাশিয়া’ পুস্তকে তার বর্ণনা লেখেন। ১৯২০ সালে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে মেঘনাদ চলে গেলেন ইউরোপ।
বোস–আইনস্টাইন কনডেন্সেট
১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক বলেন যে কৃষ্ণিকা বিকিরণ নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটেনা বরং টুকরো টুকরো প্যাকেট আকারে ঘটে। একেকটি প্যাকেটের নাম কোয়ান্টাম। কোয়ান্টামের শক্তি হতে পারে কেবল ঐ বিকিরণের কম্পাঙ্ক (ν) ও প্ল্যাঙ্কের নির্ধারিত ধ্রুবক (h) -এর গুণফল hν-এর পূর্ণ গুণিতক। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত কৃষ্ণবস্তু থেকে নির্গত বিকিরণে কোন কম্পাঙ্কের বিকিরণ কতটা পরিমাণে থাকে তার পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সাথে ফিট করবে এমন একটা ফর্মুলা ম্যাক্স প্লাঙ্ক দিয়েছিলেন। খানিকটা জোরজার করে এডহক সমাধান হলেও এ ছিল এক যুগান্তের ভাবনা। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের প্যাটার্ন ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে আলো, তাপ বা ওই ধরণের যে কোনও বিকিরণ আসলে তরঙ্গ আকারে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়। প্লাঙ্ক স্বয়ং তরঙ্গতত্ত্বের বাইরে আলো-কে ভাবতে পারছেন না তখনও। অথচ তাঁর দেওয়া ফর্মুলা তরঙ্গতত্ত্ব নয়, বিকিরণের কোয়ান্টার কথা বলছে। ম্যাক্সওয়েলীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এরকম আরও একটি নিরীক্ষণ তখন পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। তা হল ‘আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া’। ধাতুর পাত আলো শোষণ ক’রে ইলেক্ট্রন নিঃসরণ করে। ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গতত্ত্ব অনুযায়ী এরকম শোষণ ও নিঃসরণের মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে ধাতুতলে আলোর নিরন্তর আপতন দরকার। অর্থাৎ বহুক্ষণ ধরে আলোক তরঙ্গের শক্তি শোষণ করতে করতে একসময় যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি সঞ্চয় করলে ইলেক্ট্রন ধাতুতল থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে। অথচ বাস্তব পরীক্ষায় নিঃসরণ ঘটছে তৎক্ষণাৎ, আলোর আপতনের মুহূর্তেই এলেক্ট্রন নিঃসরণ হচ্ছে। আইনস্টাইন ১৯০৫ আসলে তাঁর ছয়টি পেপারের একটিতে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা হাজির করেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে। আলোর কোয়ান্টাকে তিনি ‘ফোটন’ নামে অভিহিত করেন। আইনস্টাইনের এই নিবন্ধ ছিল প্লাঙ্কের ধারণার প্রতি জোরালো সমর্থন ও একধাপ এগোনো, আলোর বিকিরণের মত আলোর শোষণও প্যাকেটে বা কোয়ান্টায় হয়। প্রয়োজনীয় শক্তিসম্পন্ন আলো কণাকে শোষণ করে তৎক্ষণাৎ ধাতুতল থেকে ছিটকে যেতে পারে ইলেক্ট্রন। আইনস্টাইন আলো কণাকে ‘ফোটন’ নামে অভিহিত করেন। তবে ফোটনের কোনও তত্ত্ব তিনি হাজির করেননি। ১৯২৪ সালে ফোটনের পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব হাজির করেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস।
১৯১০ সালে পিটার ডিবাই, ১৯১৭তে আইনস্টাইন, ১৯২৩এ এরেনফেস্ট ও উলফগ্যাং পাউলি প্লাঙ্কের সূত্রকে তাত্ত্বিক বনিয়াদে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বোস তাঁর ১৯২৪-এর পেপারে লেখেন “কোনও ডেরিভেশনকেই আমার কাছে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য ও যথাযথ মনে হয়নি… সেগুলির কোনওটিই কোয়ান্টাম কনসেপ্টের অবিচলিত প্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে করা হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্লাসিকাল পথে নির্ণীত ফলাফলের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের নতুন ধারনাকে মিশিয়ে করা হয়েছে”। নিজের মত করে প্লাঙ্কের সূত্র কষে বের করার পেছনে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে প্রাথমিক তাগিদ ছিল তাঁর ছাত্রদের ঠিকঠাক ভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বোঝানো। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তিনি রিডার পদে যোগ দিয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগকে গড়ে তুলছিলেন, রসায়ন বিভাগ গড়েছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। প্রথম থেকেই ছাত্রদের প্লাঙ্কের সূত্র পড়াতে গিয়ে কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল প্লাঙ্ক সূত্রের সব ডেরিভেশনেই ক্লাসিকাল তত্ত্বের বেনোজল মেশানো আছে। ভাবছিলেন সেখান থেকে বেরনোর উপায়। ১৯২৪-এর গোড়ার দিকে মেঘনাদ এলেন এলাহাবাদ থেকে। তিনি সত্যেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ‘জীৎসক্রিফট ফুর ফিজিক’ ম্যাগাজিনে সদ্য প্রকাশিত পাউলি (১৯২৩) এবং এরেনফেস্ট ও আইনস্টাইন (১৯২৩)-এর কাজের দিকে। এই নিবন্ধে পাউলি দেখিয়েছিলেন যে বিকিরণ ও মুক্ত ইলেক্ট্রন তাপীয় ভারসাম্যে থাকতে পারে যদি ইলেক্ট্রন ও আলো-কোয়ান্টার মধ্যে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা একটি নির্দিষ্ট শর্ত মেনে চলে। এরেনফেস্ট ও আইনস্টাইন যৌথভাবে পাউলির কাজকে আরেকটু প্রসারিত করেছিলেন। সেই বছরই কম্পটন ক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়েছিল। সত্যেন বোস আলো-কণার গতিপ্রকৃতি চিনতে পারছিলেন।
১৯২৪ সালে দুটি নিবন্ধ লেখেন বোস। প্রথমটি “প্ল্যাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য লাইট-কোয়ান্টা হাইপোথিসিস” এবং দ্বিতীয়টির শিরোনাম “থার্মাল ইকুইলিব্রিয়াম ইন দ্য রেডিয়েশন ফিল্ড ইন দ্যা প্রেজেন্স অব ম্যাটার”। দুটি পেপারই তিনি ‘ফিলসফিকাল ম্যাগাজিন’-এ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কোনও জবাব আসেনা। এর আগে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার থাকাকালীন এই সুবিখ্যাত ম্যাগাজিনে বন্ধু মেঘনাদের সাথে যৌথভাবে দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এখন পত্রিকার তরফ থেকে কোনও উত্তর না আসায় সত্যেন জুন মাসের ৪ তারিখ তাঁর প্রথম পেপারটি পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে —যিনি তখন খ্যাতির মধ্য গগনে— সঙ্গে একটি চিঠিতে স্যারকে অনুরোধ করলেন এটা লক্ষ্য করতে যে সনাতনী তড়িৎ গতিবিদ্যার কোনরকম সাহায্য ছাড়াই প্লাঙ্ক সূত্রের প্রথম ফ্যাক্টরটি নির্ণয় করেছেন সত্যেন, অনুরোধ করলেন যে যোগ্য মনে হলে পেপারটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করিয়ে যদি ‘জিৎস্ক্রিফট ফুর ফিজিক’-এ ছাপানোর ব্যবস্থা করেন, এবং চিঠির শেষে তাঁকে একথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন যে বছর কয়েক আগে কোলকাতা থেকে একজন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পেপারগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করার অনুমতি চেয়ে পত্র লিখেছিল আর তিনি সে অনুমতি দিয়েছিলেন- এই নিবন্ধকার আসলে সেই ছেলেটিই। আইনস্টাইন পেপারটি পড়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর পাঠালেন সত্যেনের কাজকে “আ বিউটিফুল স্টেপ ফরোয়ার্ড” বলে প্রশংসা করে। আইনস্টাইনের পাঠানো সেই পোস্টকার্ড কার্যত সত্যেন্দ্রনাথের ইউরোপ যাত্রার ছাড়পত্র বা পাসপোর্ট হয়ে যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হার্টগ সাহেব তাঁকে বিলেত যাওয়ার অনুমতি দেন এবং পোস্টকার্ডটি দেখার পর জার্মান দূতাবাস এমনকি কোনও ফি না নিয়েই ভিসা দিয়ে দেয়। প্রথম পেপারটি পাঠানোর দিন দশেকের মধ্যেই বোস তাঁর দ্বিতীয় পেপারটি আইনস্টাইনকে পাঠান, সাথের চিঠিতে আবার লেখেন যে বিকিরণ ও পদার্থের মধ্যে তাপীয় ভারসাম্যের সমস্যাটিকে তিনি নতুন পথে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন এবং এক নতুন সূত্রে পৌঁছেছেন যার সরলতা লক্ষণীয়। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বুনিয়াদী স্বীকৃতিগুলি যে সনাতনী তড়িৎ-গতিবিদ্যার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সে কথাই দুটি নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য ছিল।
১৯০৫ সালে তাঁর প্রথম নিবন্ধে ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলিকে চলমান নির্দেশতন্ত্রেও প্রযোজ্য রূপে পুনর্নির্ণয় করেছিলেন আইনস্টাইন। তা করতে গিয়ে ‘মহাকাল’-এর সুষম চিরবহমানতার ধারণাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। নতুন রূপে ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলি আলোর তরঙ্গরূপে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ধারণাকে আরও সুন্দর ও জোরালো করেছিল। উল্টোদিকে, ঐ একই বছর আলোকতড়িৎ ক্রিয়া সংক্রান্ত তাঁর নিবন্ধে আলো-কণা বা ফোটনের ধারণা প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। তা করেছিলেন শোষণ বা নিঃসরণের মুহূর্তে শক্তি আদানপ্রদানের কোনও এক অজ্ঞাত-কারণ প্রক্রিয়া হিসেবে। কিন্তু আলোকে ‘ফোটন গ্যাস’ হিসেবে ভাবতে রাজি ছিলেন না। তা করতে গেলে, তাঁর মনে হচ্ছিল, ‘আলো’ আবার গিয়ে পড়ে সেই নিউটনীয় যান্ত্রিক বিশ্বে যেখানে পদার্থকণা প্রতিটি মুহূর্তে পরস্পর স্বাধীন সুনির্দিষ্ট স্থান দখল করে থাকে। এক পর্বে তিনি মন্তব্য করেন, “সত্যি বলতে আমি মোটেই মনে করি না যে আলোকে তুলনামূলক ক্ষুদ্র স্থানে স্থানবদ্ধ ও পরস্পর স্বাধীন কোয়ান্টা দ্বারা গ্রথিত বলে বিবেচনা করা উচিৎ… প্রতিসারক মাধ্যমের বিভেদতলে আলোকরশ্মির বিভাজন তো তাহলে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আলোকরশ্মি বিভাজিত হতে পারে, কিন্তু আলোর কোয়ান্টা নিজের কম্পাঙ্ক না বদলে তো বিভাজিত হতে পারেনা।” কম্পটন ক্রিয়া সামনে আসার পর একথা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে শক্তি ছাড়াও আলো-কোয়ান্টার ভরবেগও আছে। কিন্তু, ‘আ বিউটিফুল স্টেপ ফরোয়ার্ড’ বলে প্রশংসা করলেও সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম নিবন্ধটি তিনি সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারেননি, এবং নিজেই তা অনুবাদ করে ‘জীৎস্ক্রিফট ফুর ফিজিক’ পত্রিকায় পাঠানোর সময় সত্যেন্দ্রনাথ প্রণীত ধারণাগুলির মধ্যেকার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম ধারণা—ফোটনের স্পিন কৌণিক ভরবেগের ধারণাকে এডিট করে সনাতনী তরঙ্গতত্ত্বের স্বীকৃতিতে বদলে দেন তিনি। দ্বিতীয় নিবন্ধটিও ছাপানোর ব্যবস্থা করেন আইনস্টাইন। কিন্তু তার সাথে যা মন্তব্য করেন তা সত্যেনের ধারণাকে প্রায় নাকচ করে দেওয়ার সামিল। যে দুটি দোষ তিনি ধরেছিলেন তাও মূলত সনাতনী অবস্থান থেকে। ম্যাক্সওয়েলিয় তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সমন্বয়ই সম্ভবত তাঁর অভীষ্ট ছিল। আহত সত্যেন ১৯২৫ সালের ২৭ জুন তৃতীয় একটি নিবন্ধ পাঠিয়ে তাঁর গুরুকে আলাদা খামে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “…আমি বিকিরণক্ষেত্রকে নতুন স্ট্যান্ডপয়েন্ট থেকে দেখবার চেষ্টা করেছি এবং শক্তির কোয়ান্টাম প্রবাহকে তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাবের প্রবাহ থেকে বিযুক্ত করতে চেয়েছি…”। সত্যেন্দ্রনাথ লিখিত প্রথম ও তৃতীয় নিবন্ধটি পরবর্তীতে ‘আইনস্টাইন আর্কাইভে’ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানান গবেষকেরা।
সত্যেন্দ্রনাথের নির্ণয়ে আলো আলো-কণা দ্বারা গ্রথিত ক্ষেত্র; নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কবিশিষ্ট ও ভরশূন্য আলো-কণাগুলি একে অপরের থেকে প্রভেদহীন ও আভ্যন্তরীণ স্পিন যুক্ত। স্থান-পরিসর তাদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, বরং দশা-পরিসর (ফেজ স্পেস) দখলে তারা কেমন সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যবহার দেখায় সেটাই বিবেচ্য। অর্থাৎ একই স্থানকালে যত খুশি আলোকণা থাকতে পারে, কিন্তু একই দশায় কত আলোকণা আছে বা থাকতে পারে সেটাই মূল কথা। সমগ্র দশা-পরিসরকে —যার আয়তন প্লাঙ্ক ধ্রুবকের ঘনফল— তিনি কতকগুলি আয়তন-কক্ষে ভাগ করেন। নির্দিষ্ট আয়তনকে একটি কোয়ান্টাম কত রকমভাবে দখল করতে পারে তার ওপর নির্ভর করে কক্ষের মোট সংখ্যা। এইভাবে তিনি দেখান যে প্লাঙ্ক সূত্রের প্রথম ফ্যাক্টরটি আসলে বিকিরণের মোট কত সংখ্যক কোয়ান্টাম দশা থাকতে পারে সেই সংখ্যাকে সূচীত করে। এরপর তিনি একটি দশার তাপগতীয় সম্ভাবনার হিসেব কষেন। প্রতিটি কক্ষ যেহেতু একটি একক কোয়ান্টাম দশা হিসেবে গণনা করেছেন তাই বলেন যে, কক্ষগুলিকে কেবল তার সম্ভাব্য দখল-সংখ্যার ভিত্তিতেই শ্রেণীবিন্যস্ত করা যায়। বিকিরণক্ষেত্রটির সুস্থিতি হয় সর্বোচ্চ এনট্রপিতে (কোনও সিস্টেমের তাপশক্তিকে কার্যে রূপান্তরিত করার সময় তাপশক্তির যে অংশটি কাজে আসে না, প্রতি একক তাপমাত্রায় তার পরিমাপকে এনট্রপি বলা হয়)। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বিকিরণক্ষেত্রটির সর্বোচ্চ এনট্রপি নির্ধারণ করে ফোটনগুলির কম্পাঙ্ক বিতরণের সূত্র নির্ণয় করেন সত্যেন্দ্রনাথ। এই বিতরণ সূত্রই আসলে প্লাঙ্ক সূত্র। সম্ভাব্য কোয়ান্টাম দশা কষতে গিয়ে সত্যেন এক জায়গায় প্রাপ্ত ফলকে ২ দিয়ে গুণ করেছিলেন। এই ‘২’ গুণকটি তিনি হাজির করেছিলেন একটি ফোটনের অভ্যন্তরীণ কৌণিক ভরবেগ ‘+’ ও ‘–’ এই দু’রকম হতে পারে কল্পনা করে নিয়ে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কৌণিক ভরবেগের কল্পনা তখন আজগুবি মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিলনা। অন্তত আইনস্টাইনের সেরকমই মনে হয়ে থাকবে। তিনি সত্যেন্দ্রনাথের ব্যাখ্যা কেটে বাদ দিয়ে ‘২’ গুণকটির নিজস্ব ব্যাখ্যা লিখে দিলেন। প্রকাশিত নিবন্ধটিতে লেখা হল, দ্বিগুণ করা দরকার ছিল “ইন অর্ডার টু টেক ইনটু একাউন্ট দ্য ফাক্ট অব পোলারাইজেশন”। আলোর ‘পোলারাইজেশন’ ম্যাক্সওয়েলিয় তরঙ্গ তত্ত্বেরই স্বীকৃতি। সত্যেন্দ্রনাথের শেষ ছাত্র পার্থ ঘোষ বলেছেন যে কোয়ান্টামের ‘স্পিন’ সংক্রান্ত তাঁর প্রাথমিক কল্পনা ও কোয়ান্টাম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও আইনস্টাইনের তা কেটে দেওয়া সম্পর্কে একান্ত আলাপচারিতায় সত্যেন্দ্রনাথ প্রায়শই বলতেন। সত্যেন্দ্রনাথের স্পিন সংক্রান্ত ভাবনার খবর প্রকাশ্যে আসে ১৯৩১ সালে সি ভি রামন ও এস ভাগবন্তম প্রকাশিত “ফোটন স্পিনের পরীক্ষামূলক প্রমাণ” নিবন্ধে। তাঁদের কথায় “কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্স প্রয়োগ করে প্লাঙ্কের বিকিরণ সূত্র নির্ণয়ের লক্ষ্যে তাঁর সর্বজন-বিদিত ডেরিভেশনে প্রফেসর এস এন বোস দশা-পরিসরের বিকিরণপূর্ণ কক্ষসংখ্যার অভিব্যক্তি পান এবং তা থেকে প্রতি একক আয়তনে কোয়ান্টামের সম্ভাব্য বিন্যাসের সঠিক সংখ্যা পেতে তাকে ‘২’ সংখ্যাটি দ্বারা গুণ করতে বাধ্য হন। পেপারটি যেরূপে প্রকাশিত হয় সেখানে এই গুণকটি প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও আলোচনা ছিল না, কিন্তু আমরা প্রফেসর বোসের সাথে এক ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে বুঝি যে তিনি কোয়ান্টামের hν শক্তি ও hν/c ভরবেগ ছাড়াও গতির অভিমুখের সমান্তরাল অক্ষকে কেন্দ্র করে ±h/2π মানবিশিষ্ট এক অভ্যন্তরীণ স্পিন কৌণিক ভরবেগ থাকার সম্ভাবনার কথা কল্পনা করেছিলেন। অর্থাৎ এই ‘২’ ফ্যাক্টরটির উদ্ভব ঘটছে কৌণিক ভরবেগের দুই রকম চিহ্ন অনুসারে কোয়ান্টামের স্পিন ডানহাতি অথবা বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে। এই ধারণা ও সনাতনী তড়িৎ গতিবিদ্যা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের মধ্যে মৌলিক ফারাক আছে।”
সত্যেন্দ্রনাথ বোসের প্রথম নিবন্ধটি হাতে পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আইনস্টাইন বোসের পরিসংখ্যানকে এক-পরমাণু বিশিষ্ট আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছেন এবং আট মাসের মধ্যে সে বিষয়ে নিজের তিনটি নিবন্ধ প্রকাশ করছেন, সত্যেন্দ্রনাথের সাথে কোনরকম আলোচনা ছাড়াই, আইনস্টাইন জানেন যে সত্যেন তখন ফ্রান্সে, তবু তাঁকে ডাকেননি। এমনকি এর মধ্যে দুটি নিবন্ধে তিনি বোস পরিসংখ্যানের প্রণেতা হিসেবে ভুল করে ডি বোসের নাম উল্লেখ করছেন। বার্লিনের প্রুশিয়ান একাডেমিতে পেশ করা এই নিবন্ধগুলির দ্বিতীয়টিতে আইনস্টাইন দেখান যে এক সঙ্কট তাপমাত্রার নীচে গিয়ে একই রকম পরমাণু নিয়ে গঠিত আদর্শ গ্যাসের বেশ কিছু পরমাণু একই কোয়ান্টাম দশা প্রাপ্ত হতে পারে। তিনি লেখেন যে “একটি বিভাজন ঘটে যায়; একটা অংশ ‘ঘনীভূত’ হয়, বাকি অংশ ‘সম্পৃক্ত আদর্শ গ্যাস’ হিসেবে থাকে।” বেশি তাপমাত্রায় বোসন গ্যাসের কণাগুলি বোসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিভিন্ন কোয়ান্টাম দশায় বণ্টিত থাকে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নীচে বেশ কিছু পরিমাণ বোসন কণা সর্বনিম্ন কোয়ান্টাম দশায় জোট বাঁধে। বোসন কণাগুলির কোয়ান্টাম দশার এই ঘনীভূত রূপ ‘বোস আইনস্টাইন কন্ডেন্সেট’ বা বিইসি নামে পরিচিত হয়। ১৯২৮ সালে হিলিয়াম-4 এর অতিপ্রবাহী ধর্ম (সুপারফ্লুইডিটি) আবিষ্কার হয়; ১৯৩৮ সালে এই অতিপ্রবাহতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় বিইসি। পরীক্ষাগারে প্রথম বিইসি গ্যাস তৈরি করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে, যার দুই দশক আগে ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আশি বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে। সেই কলেজের দিনগুলি থেকেই আইনস্টাইনকে তিনি মনে মনে গুরু মেনেছিলেন। আইনস্টাইনের কাছে প্রথম নিবন্ধের সাথে পাঠানো তাঁর চিঠিতে তিনি একথাও লিখেছিলেন যে যদিও তিনি আইনস্টাইনের কাছে সরাসরি কোনও পাঠ নেননি কিন্তু তিনি আইনস্টাইনের লেখা পড়ে পদার্থবিদ্যা শিখেছেন, কাজেই তিনি আইনস্টাইনের শিষ্যপ্রতীম। সত্যেন্দ্রনাথের এই ‘গুরুভক্তি’ মহাভারতের একলব্যের উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয়। ১৯২৪ সালে বোস ইউরোপ যাচ্ছেন। এক বছর প্যারিসে থেকে বার্লিন যাচ্ছেন আইনস্টাইনের সাথে একসাথে কাজ করার অভিপ্রায়ে। তিনি তখন জানেন যে আইনস্টাইন তাঁরই সংখ্যায়ন নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু আইনস্টাইনের সাথে যখন দেখা হল ততদিনে আইনস্টাইন আবার অন্য বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন—একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব, মহাকর্ষের সাথে বাকী বলগুলিকে একত্রিত করে একটি একক জ্যামিতিক ব্যাখ্যার সেই সন্ধানে বাকী জীবন অতিবাহিত করবেন আইনস্টাইন, আর বহু পরে জীবনের শেষদিকে এসে সত্যেন্দ্রনাথ আবার আইনস্টাইনের চিন্তা অনুসরণ করে এই দিশায় চারটি নিবন্ধ রচনা করবেন। আইনস্টাইনের সাথে কাজ করার সুযোগ না পেলেও আইনস্টাইনের সুপারিশপত্র পেয়েছিলেন সত্যেন। বোস বুঝেছিলেন যে আইনস্টাইন তাঁর আইডিয়া পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। দ্বিতীয় নিবন্ধ সম্পর্কে আইনস্টাইনের মন্তব্য তাঁকে আঘাত করেছিল। একথাও বুঝেছিলেন যে তাঁর কোয়ান্টাম স্পিনের প্রস্তাবনা হারিয়ে গেল আইনস্টাইন তা কেটে অন্য ব্যাখ্যা জুড়ে দেওয়ায়। বড় কোমল ও লাজুক মনের মানুষ ছিলেন সত্যেন। প্যারিসে মাদাম কুরি যখন তাঁকে বলেন যে তাঁর কাছে কাজ করতে চাইলে আগে ফরাসী ভাষাটা ভালো করে শিখে আসতে হবে তখন মুখ ফুটে বলতেও পারেননি যে পনের বছর ধরে চর্চা করে ফরাসী ভাষা তিনি ভালই রপ্ত করেছেন, ফলত আর কাজ করা হয়নি সেখানে। ইউরোপে থাকাকালীন কোনও নিবন্ধই প্রকাশ করেননি তিনি। ’২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যেও কোনও নিবন্ধ প্রকাশ করেননি তিনি—তার মূল কারণ হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ গড়ে তোলার ব্যস্ততা আর মৌলিক ও চ্যালেঞ্জিং কোনও সমস্যায় তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট না হওয়া।
সাহার তাপীয় আয়নন
“মৌলিক জিনিস মাত্রেরই আলো ভেঙে প্রত্যেকটির বর্ণচ্ছটার ফর্দ তৈরী হয়ে গেছে। এই বর্ণভেদের সঙ্গে তুলনা করলেই বস্তুভেদ ধরা পড়বে, তা সে যেখানেই থাক, কেবল গ্যাসীয় অবস্থায় থাকা চাই।
পৃথিবী থেকে যে ৯২টি মৌলিক পদার্থের খবর পাওয়া গেছে সূর্যে তার সবগুলিরই থাকা উচিত; কেন-না পৃথিবী সূর্যেরই দেহজাত। প্রথম পরীক্ষায় পাওয়া গেছিল ৩৬টি মাত্র জিনিস। বাকিগুলির কি হল সে প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন বাঙালী বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। নূতন সন্ধানপথ বের করে সূর্যে আরো কতকগুলি মৌলিক জিনিস তিনি ধরতে পেরেছেন। তাঁর পথ বেয়ে প্রায় সবগুলিরই খবর মিলেছে। আজও যেগুলি গরঠিকানা, মাঝপথেই পৃথিবীর হাওয়া তাদের সংবাদ শুষে নেয়।” –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বর্ণনা দিয়েছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ পুস্তিকায়, যে পুস্তিকাটি তিনি “শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রীতিভাজনেসু”-কে সম্বোধিত এক লম্বা কৈফিয়ত সহ প্রকাশ করেছিলেন ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে।
ছোটবেলায় নিজের নাম বদল করে ‘মেঘনাদ’ হয়েছিলেন যিনি তিনি আর একটি ক্ষেত্রে নিজের নাম দিয়েছিলেন ‘সূর্যপ্রেমী’। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিথ পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ছদ্মনামে প্রবন্ধ পাঠাতে হত। ১৯১৯ সালের শেষ দিকে “অ্যা ফিজিকাল থিওরি অব দ্য স্টেলার স্পেক্ট্রা” শিরোনাম প্রবন্ধটি মেঘনাদ পাঠিয়েছিলেন ‘হিলিওফিলাস’ ছদ্মনামে, যার অর্থ সূর্যপ্রেমী। একই সময়ে লিখেছেন প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য একটি প্রবন্ধ। এরপরই, ১৯২০-এর ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিনি চারটি গবেষণা নিবন্ধ রচনা করেন। সেগুলি পরপর পাঠান ‘ফিলসফিকাল ম্যাগাজিন’ পত্রিকায়। প্রথমটিতে সৌর বর্ণচ্ছত্রের তৎকালীন জ্বলন্ত সমস্যা, বিশেষত ক্যালসিয়াম বর্ণালীরেখার অসঙ্গতি বুঝতে তাঁর ‘তাপীয় আয়নন’ তত্ত্বটির অবতারণা; তারপর সেই তত্ত্বের ভিত্তিতে সূর্যের মৌল উপাদান সম্পর্কে আলোকপাত দ্বিতীয়টিতে; তৃতীয়টিতে উচ্চ তাপমাত্রায় বায়বের তাপীয় আয়নন প্রশ্ন ও চতুর্থটি হল তারাগুলির রং নিরীক্ষা করে হার্ভার্ড স্কুল তারাগুলির যে শ্রেণীবিন্যাস করেছিল তার ব্যাখ্যা যা ছয় দশক ধরে রহস্যই হয়ে ছিল। এই বিপুল কার্য সমাধা করে গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বিদেশ বৃত্তি ও তার আগেই পাওয়া পূর্বোক্ত গ্রিফিথ পুরস্কার ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে মেঘনাদ ইউরোপ যাত্রা করেন ছাব্বিশ বছর বয়সে ১৯২০-এর সেপ্টেম্বরে। লন্ডনে ছ মাস থেকে তারপর যান বার্লিন। লন্ডন পৌঁছনোর কিছুদিন পর, ডিসেম্বরে, মেঘনাদ রচিত প্রথম নিবন্ধটি সহ ‘দ্যা ফিলসফিকাল ম্যাগাজিন’ প্রকাশিত হওয়ামাত্র প্রতীচ্যে সাড়া পড়ে যায়। সাহার তাপীয় আয়নন সূত্র জ্যোতির্পদার্থবিদদের সামনে এক লহমায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে, খুলে গেছে অসংখ্য সম্ভাবনার দ্বার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট উইলশন অবজার্ভেটরিতে হেনরি নরিস রাসেল মেঘনাদের তত্ত্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, উত্তেজিত হয়ে মেঘনাদকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন যে মিলে যাচ্ছে তাঁর দেওয়া ইঙ্গিতগুলি। তারাদের আলো ভেঙে পাওয়া যাচ্ছে তারাদের উষ্ণতা ও উপাদানের খবরাখবর, সৌর কলঙ্কে রুবিডিয়ামের রহস্যময় অস্তিত্ব বা ক্যালসিয়াম সোডিয়াম পটাশিয়াম ও জিঙ্কের আচরণবিধি নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে তন্ন তন্ন করে পড়া হচ্ছে মেঘনাদের কাজ, আলোচনা হচ্ছে তা নিয়ে। সাধারণের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘দ্যা অবজারভেটরি’-তে এডওয়ার্ড আর্থার মিলনে ১৯২১ সালে লেখেন — প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর মধ্যে যে কী চমৎকার একটি সম্পর্ক আছে, ভৌত রসায়ন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও পরমাণু তত্ত্বের আশ্চর্য সমাহার ঘটিয়ে সাহা তা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। এতসবের মাঝেও প্রথম ইউরোপ যাত্রা মেঘনাদকে বিমর্ষ করেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে অনেক মধুর অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে লেখা চিঠিতে স্পষ্টত হতাশার সুর ব্যক্ত করেন মেঘনাদ, “বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এক মনে এক ধ্যানে বিজ্ঞান ও দেশের সেবা কর্ত্তে পারে এ রূপ লোকের সংখ্যা ইওরোপেও কম”। এই হতাশার কারণ হয়তো এটাই যে তাঁর কাজ নিয়ে তাঁরই আশপাশে এত এত কাজ হচ্ছে অথচ তা হচ্ছে তাঁকেই বাদ দিয়ে। হয়তো তিনি উপলব্ধি করছিলেন যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতার ফলে তাঁর তত্ত্বের ওপর তাঁর নিজের রাশ স্বাভাবিকভাবেই ক্রমাগত আলগা হতে থাকবে। বৃত্তির যা মেয়াদ ছিল তা পূর্ণ হওয়ার অনেক আগে, ১৯২১ এর নভেম্বরে, কোলকাতা ফেরেন মেঘনাদ। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক পদে তাঁকে আগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সে পদে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এক অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে আরও তিক্ত হয়ে ওঠে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন ও মেঘনাদ সাহার সংঘাত, যার সূত্রপাত আরও আগেই হয়েছিল। ব্যক্তিত্বের সংঘাতের আড়ালে তা বোধহয় ‘ভারতীয়’ জাতীয়তাবাদের অন্দরে বহুজাতীয় বাস্তবতা তথা আঞ্চলিক স্বার্থ-সংঘাতের প্রকাশ ছিল।
রামন ক্রিয়া
কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও তরঙ্গ তত্ত্ব কাছাকাছি চলে আসে রামন ক্রিয়ার ব্যাখ্যায়। তরঙ্গতত্ত্ব দিয়ে রামন ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়, রামন তা-ই করেছিলেন। আবার, রামনের টিমের এই আবিষ্কার আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের আরও এক নিশ্চিতি হিসেবেই স্বীকৃত হয় ও দু’বছরের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পান রামন।
বিচ্ছুরক মাধ্যমে বিচ্ছুরিত আলোর রং বদলে যায়। বেঞ্জিন, জল ইত্যাদি মাধ্যম থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে ১৯২৩ সাল থেকেই রামনের টিম সর্বদাই আপতিত আলো ছাড়াও সামান্য পরিমাণে ভিন্ন কম্পাঙ্কের আলো পাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে তাঁরা একে বিচ্ছুরক মাধ্যমে ভেজাল হিসেবে মিশে থাকা কিছু ফ্লুরোসেন্ট পদার্থের অণুর কারণে ঘটছে বলে মনে করেছিলেন। শেষে, ১৯২৮ সালে বুঝতে পারেন যে, যে অণুগুলি আপতিত আলোর রঙেই বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে তারাই ক্ষেত্রবিশেষে অন্য রঙের বিচ্ছুরণও ঘটাচ্ছে। অণুর মধ্যে পরমাণুগুলি বা আয়নগুলি যে বন্ধনে আবদ্ধ থাকে সেই বন্ধন আলোর আপতনে উত্তেজিত হলে নিঃসরণের রূপ কেমন হতে পারে তার বিজ্ঞানই হল রামন ক্রিয়া। এরকম সংঘাতে তিনরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখা যায়। এক, উত্তেজিত অণুগুলি একই শক্তিসম্পন্ন ফোটন নিঃসরণ করে সর্বনিম্ন দশায় ফিরে আসতে পারে; এই স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ র্যালেই স্ক্যাটারিং নামে জানা ছিল। দ্বিতীয়, এইভাবে উত্তেজিত অণুগুলির কেউ কেউ গ্রাউন্ড লেবেলের থেকে একটু ওপরের ‘ফোনন’ দশায় নেমে আসতে পারে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির ফোটন নিঃসরণ করে; একে বলে স্টোক সরণের রামন ক্রিয়া। তৃতীয় ঘটনাটি হল, কিছু অণু যদি আগে থেকেই পূর্বোক্ত ফোনন দশায় থেকে থাকে তাহলে তারা আপতিত ফোটন শোষণ করে এক ক্ষণস্থায়ী উচ্চতর দশায় উত্তেজিত হয়েই আবার একেবারে সর্বনিম্ন দশায় ফিরে আসতে পারে আপতিত ফোটনগুলির তুলনায় বেশী শক্তিসম্পন্ন ফোটন নিঃসরণ করে; এ হল এন্টি-স্টোক সরণের রামন ক্রিয়া। সাধারণ তাপমাত্রায় খুব কম সংখ্যক অণুই উত্তেজিত ফোনন দশায় থাকে বলে এন্টি-স্টোক সরণের রামন ক্রিয়ার সম্ভাবনা খুব কম হয়। স্টোক সরণের রামন ক্রিয়া বেশী পর্যবেক্ষণ করা যায়। বিচ্ছুরিত আলোর ক্ষমতা বা ‘পাওয়ার’ আপতিত আলোর তীব্রতা ও ‘রামন ক্রস সেকশন’ নামক উপাদানের গুণফলের সমান হয়, যেখানে ‘রামন ক্রস সেকশন’ আপতিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ ঘাতের ব্যাস্তানুপাতিক। ফোটন ও ফোননের আন্তক্রিয়ার কোয়ান্টাম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বদলে রামন অবশ্য এই পরিঘটনাকে আলোক তরঙ্গ ও অণুর পোলারাইজেশনের আন্তক্রিয়া হিসেবেই বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “সুতরাং আলোর বিচ্ছুরণের বিষয়টি তাপগতিবিদ্যা, আণবিক পদার্থবিদ্যা ও বিকিরণের তরঙ্গ-তত্ত্বের এক মিলনক্ষেত্র।”
১৯২৩ সালে কম্পটন ক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। পরমাণুর কক্ষস্থিত ইলেক্ট্রন উচ্চশক্তির আলো-কণার ধাক্কায় পরমাণু ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় আর প্রতিফলিত আলো-কণার কম্পাঙ্ক খানিক হ্রাস পায়। ফোটন যে কেবল শক্তি কোয়ান্টা নয়, বরং তার ভরবেগও আছে তা এই ক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়ে যায়। কম্পটন ক্রিয়া ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক বড় জয়। কিন্তু তরঙ্গতত্ত্বের বিজ্ঞানীরা সহজে তা মেনে নেননি। না মেনে নেওয়াদের দলে তখন রামনও ছিলেন একজন। ১৯২৪ সালে টরন্টোয় এক বিজ্ঞান সম্মেলনে কম্পটনের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে অন্যান্যদের সাথে সাথে প্রফেসর রামন জোরালো সওয়াল করেছিলেন অত তাড়াতাড়ি ক্লাসিকাল তত্ত্বকে ত্যাগ করার বিরুদ্ধে। সেই বিতর্কে তিনি কম্পটনকে বলেছিলেন “আপনি খুব ভালো তার্কিক বটে, কিন্তু সত্য আপনার দিকে নাই”। কম্পটনের আবিষ্কারের বৈপ্লবিক গুরুত্বকে খাটো করলেও সেই সময়েই তাঁর নিজের গবেষণা যে কম্পটনের প্রাপ্ত ফলের খুব কাছাকাছি ছিল তা তিনি কিছুদিন পর বুঝেছিলেন। আলোর বিচ্ছুরণে তাঁদের নিজেদের প্রাপ্ত ফলাফলের প্রকৃত গুরুত্ব তাঁর কাছে “কম্পটন ক্রিয়ার যমজ ভাই হিসেবে পরিষ্কার হয়ে যায় ১৯২৭ সালে”। কম্পটনও পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন, “সম্ভবত সেই টরন্টো বিতর্কই দুবছর বাদে তাঁকে রামন ক্রিয়া আবিষ্কার করতে চালিত করেছিল”। তরঙ্গই ছিল রামনের বরাবরের বিচরণ ক্ষেত্র। কম বয়স থেকেই ইউরোপীয় সনাতনী তরঙ্গ বিজ্ঞানকে ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যের সাথে সমন্বিত করে তিনি এক ভারতীয় আধুনিক ধারার জন্ম দিচ্ছিলেন যা রামন ক্রিয়া রূপে পরিণতি পায়। রামন ক্রিয়ার ব্যাখ্যায় তরঙ্গতত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের ঘনিষ্ঠতার কারণেই সম্ভবত বর-সমারফেল্ডদের পুরনো কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও ব্রয়লী-হাইসেনবার্গদের ম্যাট্রিক্স তত্ত্বের সংযোগসূত্র হিসেবে রামন ক্রিয়াকে অভিহিত করেন অনেকে।
কম্পটনের আবিষ্কারে কণারূপে ফোটনের ভরবেগ নিশ্চিত হওয়ার অনেক আগেই আলো-কণার ভরবেগকে হিসেবের মধ্যে এনে ফেলেছিলেন মেঘনাদ সাহা। ধূমকেতুর লেজ সবসময় সূর্যের দিক থেকে দূরে সরে যায় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ১৯১৯ সালেই এস্ট্রোফিসিক্যাল জার্নালে মেঘনাদ সাহা “অন রেডিয়েশন প্রেসার অ্যান্ড দ্যা কোয়ান্টাম থিওরি” শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলেন। ম্যাক্সওয়েলের সনাতনী তরঙ্গতত্ত্বেও বিকিরণ কোন বস্তুপুঞ্জের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। কিন্তু বিকিরণ যে বাধার ওপর চাপ ফেলছে সেই বাধার আকার যদি আপতিত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হয়ে যায় তখন ম্যাক্সওয়েলীয় তত্ত্ব মোতাবেক সেই চাপ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ধূমকেতুর বায়ব লেজের অণুগুলির ক্ষেত্রে সুতরাং সূর্যের আলোর চাপ কার্যকর হওয়ার কথা নয়। অথচ সেই বায়ব লেজ সর্বদা সূর্যের থেকে দূরে সরে থাকে। মেঘনাদ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে মহাকাশের জ্বলন্ত বস্তুগুলির উপরিতলের বায়ব অবস্থায় থাকা অণুগুলি আলোকণার দ্বারা ধাক্কা বা ‘কিক’ খায়। একেকটি কিক-এ অণুটিতে যে পরিমাণ গতির সঞ্চার হয় তা অণুটির স্বাভাবিক কক্ষগতির তুলনায় খুব সামান্য বটে, কিন্তু অণুগুলির ওপর প্রতি সেকেন্ডে এই কিক-এর সংখ্যা যদি অনেক হয়ে যায় তাহলে ফলশ্রুতিতে বায়ব উপরিতলের অণুগুলি লেজের আকারে সূর্য থেকে দূরে সরে যাবে। সাহার সেই নিবন্ধ ছিল জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগ। সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদদের সংস্কারহীন মনে আলোক-কণা খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরা দিয়েছিল। ইউরোপীয় মনের মত তাঁদের মনে ম্যাক্সওয়েলীয় তত্ত্বকে রক্ষা করার কোনও দায় হয়তো চেপে ছিলনা। ১৯০৫-এর আইনস্টাইনের ফোটন প্রস্তাবনা ও ১৯১৩-এর বর মডেলকে তাঁরা সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যে গ্রহণ করেছিলেন এবং মহাকাশের নক্ষত্রসমূহ আর অণু-পরমাণুর হৃদয়ের অজানা জগতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কম্পটন ক্রিয়া আবিষ্কার সত্যেন্দ্রনাথ বা মেঘনাদের কাছে নিজেদের ধারণার জোরালো প্রমাণ হিসেবে এলেও কোনও গূঢ়তর সত্য নিয়ে হাজির হয়নি। ফোটনের ভরবেগ তাঁরা আগেই ব্যবহার করেছিলেন। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেঘনাদ সত্যেনকে কম্পটনের নিবন্ধ দেখানোর পর সত্যেন খুব স্বাভাবিক গতিতেই আরও দুটি মৌলিক তাত্ত্বিক চিন্তা করেছিলেন — ফোটন গ্যাসে ফোটনগুলির পরস্পরের সাথে অপ্রভেদ্যতা বা ইনডিস্টিংগুইশেবলিটি ও ফোটনের আভ্যন্তরীণ কৌণিক ভরবেগ বা স্পিন অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম। অবস্থার সমীকরণ নির্ণয়ে অণুগুলির নির্দিষ্ট সীমায়িত আয়তনের প্রভাব কী হবে সেই প্রশ্নে ১৯১৮ ও ১৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন দুই বন্ধু একত্রে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। এই একই সময়ে রামনও সেখানে ছিলেন। রামনের সাথে কি তাঁদের আলোচনা হত? ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে একচ্ছত্রাধিপতি হয়ে ‘রামন কেবলমাত্র দক্ষিণ ভারতীয় ছাত্রদেরই সুযোগ দিচ্ছে’ এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ’১৭ সাল থেকেই রামন ও সাহার ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছিল। ১৯২১ সালে মেঘনাদ ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা প্রফেসর পদে যোগ দেওয়ার পর তাঁর একটা এক্সপেরিমেন্টের মাঝে ল্যাবরেটরিতে তালা লাগিয়ে রামনের চলে যাওয়ার অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। পরবর্তীতে আবার সাহা ও শ্রীবাস্তব প্রণীত, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত পাঠ্যপুস্তক ‘আ ট্রিটিজ অন হিট’-এর ভূমিকাও লিখে দিচ্ছেন রামন। সত্যেনের সাথে রামনের কোনও দ্বন্দ্বের খবরও কোথাও পাওয়া যায়না। তবু, এক বিভাগে থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণা করা সত্ত্বেও রামনের সাথে তেমন অন্তরঙ্গ আদানপ্রদান সম্ভবত ছিলনা। তার কারণ বোধহয় রামনের মূলত পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যায় বিচরণ এবং সনাতনী তত্ত্বে অনুরাগ ও অর্বাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বকে তেমন আমল না দেওয়া। রামন ক্রিয়া অবশ্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত কোয়ান্টাম তত্ত্বে এনে ফেলেছিল। সত্যেন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া স্পিন কৌণিক ভরবেগের প্রস্তাবনা সম্পর্কে ফোটনের স্পিন সংক্রান্ত নিবন্ধে রামনের দেওয়া সাক্ষ্যের কথাও জানি আমরা। শব্দবিজ্ঞান, আলোকবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, কেলাসতত্ত্ব সহ বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে সারা জীবন কাজ করেছেন। একক বা যৌথভাবে চারশো তিরিশটির ওপর নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন সারা জীবনে, যা এক কথায় বিস্ময়কর।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের অভ্রভেদী অহঙ্কারী ব্যক্তিত্ব সর্বজনবিদিত। কোলকাতা আসার কিছুদিনের মধ্যেই মাথায় বেঁধে নেন তাঁর বিখ্যাত পাগড়ি। দক্ষিণ ভারতে পাগড়ির তত চল নাই। কিন্তু তিনি তা ধারণ করলেন বাকি সকলের মাঝে নিজেকে অনন্য করার লক্ষ্যে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেডিক্যাল টেস্টে বাদ পড়ার পর তাঁর মন্তব্য সিভিল সার্ভিসের মত কাজের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা অথবা/ও বিজ্ঞান গবেষণায় মনস্থির করে ফেলাকে দেখিয়ে দেয়। ফাইনান্স সার্ভিসের পরীক্ষার পর মন্তব্য করেন, “ওখানে জড়ো হওয়া সমস্ত ক্যান্ডিডেটদের দিকে একবার তাকিয়েই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমিই ফার্স্ট হতে চলেছি”। তাঁর সমস্ত গবেষণাপত্রের ভাষাতেই এই চরম আত্মবিশ্বাসের ঝঙ্কার লক্ষ্য করা যায়। টরন্টো বিতর্কের পর কানাডা হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেকে তিন মাস থাকার সময় স্বেইন রোসেল্যান্ডকে বলেছিলেন যে তাঁর লক্ষ্য হল “মহৎ কোনও আবিষ্কার করা ও নোবেল প্রাইজ পাওয়া”। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ইউরোপ যাচ্ছেন নিজেদের তাত্ত্বিক আবিষ্কারকে পরখ করে নিতে ও পদার্থবিদ্যার দিকপালদের সাথে একত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেদের বোধকে আরও ঝালিয়ে নিতে। আমরা দেখেছি যে সে যাত্রায় তাঁরা দুজনেই মর্মে আঘাত পেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই প্রতিকুল পরিবেশে বড় হওয়া মেঘনাদ সাহাও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে চিঠি লিখে তিক্ত মন্তব্য করছেন। অসীম প্রতিভাধর অথচ অগোছালো ও কোমল হৃদয় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পক্ষে আঘাত যথেষ্ট জোরালো হয়েছিল বলেই মনে হয়। প্রথমবার ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন দুজনের গবেষণা কাজেই একধরণের নিষ্প্রভতা সুস্পষ্ট। কিন্তু রামনের বিদেশযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত প্রফেসর পদে যোগ্যতার অন্যতম শর্ত ছিল বিদেশবৃত্তি নিয়ে ইউরোপ থেকে পড়াশোনা করে আসা। আশুতোষ মুখার্জী রামনকে পালিত প্রফেসর পদের জন্য ডাকলে রামন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর ক্ষেত্রে ওই শর্ত চলবে না, তিনি পড়াশোনা করতে বিদেশ যাবেন না। ইউরোপ, আমেরিকার বিজ্ঞান সম্মেলন ও বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলিতে অহঙ্কারী দাপটে পাগড়ি পরিহিত ভারতীয় পরিচিতি জাহির করে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশে তাঁর নিজস্ব এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিদ ছাত্রদের একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী টিম দাঁড় করিয়ে। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে নির্মম নিস্পৃহ ছিলেন রামন। আইএসিএসের প্রথমদিককার দিনগুলিতে যখন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ল্যাবে গিয়ে পৌনে ন’টায় বাড়ি ফিরে গোগ্রাসে গিলে ট্যাক্সি (ঘোড়ার গাড়ি) ধরে দ্রুত অফিস, অফিস করে সোজা ল্যাব ও সেখান থেকে রাত্রি দশটায় বাড়ি, ছুটির দিনগুলিতে ভোর থেকে রাত্রি ল্যাবে —প্রাত্যহিক এই রুটিনে তাঁর স্ত্রীর অভিমানের দিকে ফিরেও তাকাননি বলে জানা যায়। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র বসুর পরীক্ষাগারের মূল সহকারী এক্সপেরিমেন্টালিস্টকে তিনগুণ মাইনের লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বলে স্বয়ং জগদীশচন্দ্র অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। ১৯২৭ সালে কম্পটন নোবেল পেয়েছেন শুনেই কৃষ্ণানের কাছে রামন মন্তব্য করেন যে তাঁরা ঠিক লাইনেই এগোচ্ছেন, কাজটা করতেই হবে এবং নোবেল প্রাইজ পেতেই হবে। তখনও রামন ক্রিয়া আবিষ্কার করেননি, কিন্তু তাঁদের কাজকে ‘কম্পটন ক্রিয়ার যমজ ভাই’ হিসেবে বুঝেছেন। পরের বছর ‘নিউ রেডিয়েশন’ আবিষ্কার করেই কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে তা ঘোষণা করছেন। ’২৯-এও নোবেল পুরস্কারের তালিকায় নিজের নাম না দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে নিউজ পেপার ছুঁড়ে ফেলছেন আর ১৯৩০-এ পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগেই পুরস্কার আনতে যাওয়ার জন্য জাহাজের টিকিট বুক করে ফেলছেন। নিজের কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করার পাশাপাশি তিনি যে নোবেল পুরস্কারের রাজনীতিটাও আগেভাগেই বুঝে রেখেছিলেন তা সুস্পষ্ট হয় নীলস বরকে লেখা তাঁর চিঠিতে। ইউরোপ আমেরিকার বিজ্ঞানী মহলে এক ব্যাপক যোগাযোগ তিনি গড়ে তুলেছিলেন। সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে তাঁর হয়ে সুপারিশ করার জন্য সরাসরি লবি করেছিলেন। ১৯২৮ সালে নীলস বরকে লেখা তাঁর চিঠির এই লাইনগুলি উল্লেখযোগ্য, “বিগত দিনগুলিতে আপনি আমাকে যে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন তা আপনার কাছে আমার একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ করার সাহস যোগাচ্ছে। আপনি তো জানেন যে নতুন বিকিরণ ক্রিয়ার ওপর আমার কাজ বিজ্ঞানী মহলে উৎসাহের সাথে গৃহীত হয়েছে, এবং আমি নিশ্চিত যে যদি আপনি আপনার প্রভাবশালী সমর্থন আমাকে দেন তাহলে পদার্থবিদ্যার নোবেল কমিটি সুপারিশ করতে পারে প্রথমবারের জন্য ভারতে ১৯৩০-এর পুরস্কারটি যাতে যেতে পারে… আপনাকে লিখতে আমার খুবই দ্বিধা হচ্ছিল, এবং লিখতে সাহস করলাম শুধুমাত্র এই কারণেই যে আমি নিশ্চিত যে ভারতের বিজ্ঞানচর্চার আকাঙ্ক্ষার প্রতি আপনি সহানুভূতিশীল…”। এহেন রামন নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। অনেক পরে তিনি তাঁর কান্নার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “যখন নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হল তখন প্রথমে আমি তা ব্যক্তিগত জয় হিসেবেই দেখেছিলাম… কিন্তু যখন সেই ভিড়ে ঠাসা সভাকক্ষে গিয়ে বসলাম এবং আমার চারপাশে কেবল পশ্চিমা মুখের জনসমুদ্র দেখলাম, এবং আমি, একমাত্র ভারতীয়, আমার পাগড়ি আর গলাবন্ধ কোটে, তখন আমার মনে উদয় হল যে সত্যিই আমি আমার দেশ ও জনতাকে প্রতিনিধিত্ব করছি… আমি পেছন ফিরে দেখলাম ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক, তার নীচে আমি বসে আছি, তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে আমার হতভাগ্য দেশ, ভারত, তার নিজের একটা পতাকাও নাই — এর ফলে আমার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া ট্রিগার হল…”।
বিজ্ঞান বিপ্লব
দেশাত্মবোধক আবেগ যে তাঁদের বিজ্ঞানচর্চার পেছনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে তা এই তিন বিজ্ঞানীই বিভিন্ন সময় বলেছেন। কম বয়সে সত্যেন বোস অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের নিজস্ব ক্ষেত্র ও সংগ্রামের ময়দানকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ফেলার নিরিখে মেঘনাদ সাহা ছিলেন অনন্য। প্রথমবার ইউরোপ গিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে লেখা তাঁর চিঠির সেই আক্ষেপ নিশ্চয় মনে আছে, যেখানে তিনি লিখছেন, “বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এক মনে এক ধ্যানে বিজ্ঞান ও দেশের সেবা করতে পারে এ রূপ লোকের সংখ্যা ইউরোপেও কম”। লক্ষ্য করা যায় যে তাঁর চেতনায় বিজ্ঞান ও দেশসেবা অবিচ্ছেদ্য দুই বিষয়। বস্তুত তাঁর সমগ্র জীবনই ছিল প্রতিকূলতা ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম ও উত্তরণের এক বৈপ্লবিক সঞ্চারপথ। জার্মান ভাষায় দক্ষতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুদের মাঝে তাঁর ডাকনাম হয়ে গেছিল ‘আইগেনশ্যাফট’, যার অর্থ অদম্য অবিনাশী চারিত্রিক দৃঢ়তা। কোনও কোনও গবেষক বলতে চেয়েছেন যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ‘ভদ্রলোক ক্যাটেগরিতে উন্নীত’ হয়ে যাওয়ায় জাতবর্ণের দলন তাঁকে আর মোকাবিলা করতে হয়নি। কিন্তু অতটা নিশ্চিতভাবে হয়তো তা বলা যায়না। স্কুলে থাকাকালীন সরস্বতী পূজার অঞ্জলি থেকে বিতাড়িত হওয়া, কলকাতায় ইডেন হিন্দু হস্টেলে সকলের থেকে আলাদা হয়ে বারান্দায় বসে খেতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি নিশ্চয় তাঁকে ব্যথিত করত, সহপাঠী বন্ধুদের হীনতা লজ্জিত করত নিশ্চয় তাঁকে। কোনদিন প্রতিবাদ করেননি, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছেও কখনও বলতে চাইতেন না, পরবর্তীতে জাতবর্ণ ব্যবস্থার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলতে গিয়েও কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেননি। হিন্দু হস্টেলের সরস্বতী পূজার মঞ্চ থেকে ‘নিচু জাত’ বলে নামিয়ে দেওয়ার পর বন্ধু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ সহ কয়েকজনের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এবং প্রতিবাদ করে মেঘনাদকে নিয়ে হস্টেল ত্যাগ করে কলেজস্ট্রিটের মেসবাড়িতে এসে ওঠেন। এই মেসবাড়িতেই মেঘনাদ ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন বাঘা যতীন ও তাঁর যুগান্তর গোষ্ঠী সহ সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে। ঢাকায় থাকাকালীনই পুলিন দাসের গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সংগঠনে যোগ দেননি, সম্ভবত হিন্দু আচারানুষ্ঠানের প্রতি ওই গোষ্ঠীটির আদিখ্যেতার কারণে। কোলকাতায় বাঘা যতীনের যুগান্তর গোষ্ঠী ছিল সেসব থেকে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই মুক্ত। কিন্তু বাঘা যতীন নিজেই নিষেধ করলেন মেঘনাদকে। মেঘনাদের মত মেধাবী ছেলের পক্ষে বিপ্লবীদের সংশ্রব এড়িয়ে বরং বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই দেশ গড়ার কাজ চালানো বেশী দরকার — এরকম পরামর্শ তিনি দিয়েছিলেন এবং মেঘনাদ তা মেনে নিয়েছিলেন। মেনে নিলেও দায়িত্ব থেকে যে পিছপা হননি তাও জানা যায়। যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি তখন একযোগে কাজ করছে। ইউরোপে মহাযুদ্ধ তাঁদের সামনে সুযোগ খুলে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় বিপ্লবীরা দ্রুত যোগাযোগ গড়ে তুলছেন নিজেদের মধ্যে। গদর পার্টির লোকজন গোপনে দেশে ফিরছে। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সবাই। প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় জার্মানি। জাহাজে করে গোপনে অস্ত্র নামবে বঙ্গোপসাগরের উপকুলে। নোয়াখালীর হাতিয়া, সুন্দরবনের রায়মঙ্গল ও উড়িষ্যার বালেশ্বর, এই তিন বন্দরে। বালেশ্বরের দায়িত্বে বাঘা যতীন এবং রায়মঙ্গলের দায়িত্বে ছিলেন যদুগোপাল মুখার্জী ও মেঘনাদ সাহা। ‘হেনরি’ জাহাজটি যে সাংহাই বন্দরেই ধরা খেয়ে গেছে সেই সংবাদের তারবার্তা কলকাতার যুগান্তর অফিসে এসে পৌঁছোয়নি, ফলত রায়মঙ্গলে অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল মেঘনাদদের। অন্যদিকে ময়ুরভঞ্জে তাঁর গোপন আস্তানা ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ার পর বালেশ্বরে গুলির লড়াইয়ে বাঘা যতীনের মৃত্যু হয় ১৯১৫-এর ৯-১০ সেপ্টেম্বরে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা মেঘনাদের নামে রিপোর্ট করায় আইএফএস পরীক্ষায় বসতে পারলেন না তিনি। আইএফএসের উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে রামনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসা দেখে নিশ্চয় মেঘনাদের এই দুঃখ দূর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে রয়াল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য নাম প্রস্তাবিত হওয়ার পরও গোয়েন্দা রিপোর্টের কারণে দু’বার তা আটকে গিয়েছিল, তৃতীয়বারে এফআরএস হন তিনি। তাপীয় আয়নন সংক্রান্ত চারটি নিবন্ধ লিখে ফেলার পর ইউরোপ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯২০ সালের শেষদিকে লন্ডন যখন পৌঁছলেন তখন সেখানে থাকার জায়গাও ঠিক নেই তাঁর, কোনও বিজ্ঞানীর অধীনে বা কোনও গবেষণাগারে কাজ নিয়েও তো যাননি। ইচ্ছে ছিল কেমব্রিজে থাকার, কিন্তু সেখানে আশ্রয় না জোটায় খরচ সামলাতে পারবেন না বুঝে ফিরে এসে লন্ডনেই থাকতে হয়, লন্ডনে তখন তাঁরই সমবয়সী শান্তি স্বরূপ ভাটনগর সহ কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক ছিলেন। ছ’মাস পর যখন বার্লিন পৌঁছলেন তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন বাঘা যতীনের আরেক কমরেড নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে এম এন রায়। রায় তখন মেক্সিকোতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছেন এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি হিসেবে মস্কো ও বার্লিনের মধ্যে পাক খাচ্ছেন। মেঘনাদকে তিনি বার্লিনের বামপন্থী রাজনৈতিক মহলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আর রাজি করালেন সংগঠনের এক গুপ্ত কোডের বাহক হতে। কিছুদিন পর শস্ত্রবিদ নলিনী গুপ্ত, যিনি বেঙ্গল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি গড়ছেন, কলকাতা এসে সেই গোপন কোড উদ্ধার করতে প্রথমেই দেখা করেছিলেন মেঘনাদের সাথে। গুপ্ত বিপ্লবী দায়িত্ব ছিল বলেই কি বৃত্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগে মেঘনাদ দেশে ফিরেছিলেন? দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বন্যার্ত মানুষদের পাশে। বিজ্ঞান সাধনার ‘গজদন্ত মিনার থেকে জনসাধারণের মাঝে নেমে আসা”-র কথা কি তখন থেকেই ভাবছেন? এই সময়েই কি বাংলার দুঃখ দামোদর নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের চিন্তা শুরু হয়েছিল তাঁর? অথবা নদীনালার দেশ পূর্ববঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই এসব ভাবতেন তিনি। ঘরে ঘরে বিজলি বাতির স্বপ্ন কি সেই শেওড়াতলি গ্রামে রাতের বেলা বাবার নিষেধ না মেনে কুপি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করে মার খাওয়ার সময় থেকেই দেখতেন? ১৯৩৪ সালে বম্বে বিজ্ঞান কংগ্রেসে সাধারণ সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উদস্থিতিবিদ্যাচর্চা বা হাইড্রোডায়ানামিক্সের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তাঁরই ভাবনা ও পরিকল্পনার ফসল; কিন্তু কয়লা শিল্পের শিল্পপতিদের অন্তর্ঘাতে ডিভিসি থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ঝাড় খেয়েছিল।
তিরিশের দশকে একদিকে গ্রেট ডিপ্রেশনে পুঁজিবাদী বিশ্বের সংকট ও তার বিপরীতে সোভিয়েতের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার অর্থনীতিতে চোখ ধাঁধানো সাফল্য এদেশের নব প্রজন্মকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছিল। মেঘনাদের চিন্তাচেতনায় এই সময়ের প্রভাব স্পষ্ট। বিজ্ঞান ও কারিগরিতে স্বয়ম্ভরতা তথা নিজের জনশক্তির ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তোলা ব্যাপক ভারী শিল্পকে দেশের অগ্রগতির মূল শর্ত হিসেবে ভাবতে ও তা প্রচার করতে শুরু করেন। প্রথমবার ইউরোপ ঘুরে দেশে ফেরার পরপরই মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আজাদ যুগান্তর গোষ্ঠীর এক আগুনখোর তরুণ বিপ্লবী ছিলেন এবং খিলাফৎ আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ’২৩ সালে গান্ধীর সুপারিশে মৌলানা আজাদ কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হওয়ায় মেঘনাদ তাঁর প্রতি আরও আকৃষ্ট হন। এই বছরই মেঘনাদ কোলকাতার পাঠ চুকিয়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে সপরিবারে চলে গেছেন এলাহাবাদ। সেখানে সবর্ণ হিন্দুদের সামাজিক বয়কটের মুখে পড়েছেন, যদিও ওসব তার অনেক আগে থেকেই গা-সওয়া। জায়গা কিনে বড় বাড়ি বানিয়েছেন এলাহাবাদ শহরে, যে শহরে পঞ্চাশ বছর ধরে বসবাস করছে জওহরলাল নেহরুর পিতৃকুল। এলাহাবাদ আকাদেমির সূত্রে এখানেই জওহরলালের সাথে মেঘনাদের আলাপ ও তীব্র আকর্ষণ। সুভাষচন্দ্রের সাথে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল —কলেজের দিনগুলিতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘ময়দান ক্লাব’-এর বৈঠকে সুভাষও যেতেন। ১৯২২ সালে সুভাষ যখন বঙ্গীয় যুব সম্মেলন করেছিলেন তখন সদ্য বিলেত ফেরত মেঘনাদকেই তার সভাপতি করা হয়। ১৯৩৮-এ সুভাষ কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হওয়ার পর মেঘনাদ তাঁর বাড়ি গেলেন, কেন্দ্রে ক্ষমতা পেলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস কী কী করবে তার কোনও পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী আছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করতে —এলাহাবাদের পাঠ চুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছেন তার অনেক আগেই। ততদিনে গান্ধিনীতিতে তাঁর আস্থা টলে গেছে, স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছেন যে শুধুমাত্র চরকা বা গ্রামীণ শিল্পনীতি দিয়ে দেশ-দশের উন্নতি হবেনা, প্রয়োজন সুপরিকল্পিত জাতীয় অর্থনীতি। সুভাষ তাঁর সাথে বহুলাংশে একমত হলেন। জাতীয় পরিকল্পনা সমিতির সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রথমবার ইউরোপ সফরের সময় বার্লিন ও মিউনিখে থাকাকালীন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সাথেও আলাপ হয়েছে এবং কবির কাছ থেকে শান্তিনিকেতনে আসার নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। সেই নিমন্ত্রণে ১৯৩৮-এ শান্তিনিকেতনে গিয়ে মেঘনাদ তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করলেন এক ভাষণে। বিজ্ঞাননির্ভর নয় এমন সব প্রাচীন আদর্শকে আঁকড়ে থাকাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন। প্রকারান্তরে গান্ধিনীতিকেই আক্রমণ করলেন। “সবই ব্যাদে আছে” এই সুবিখ্যাত বক্রোক্তি সেই পর্বেই মেঘনাদের করা। সুভাষ ও মেঘনাদের চিন্তাভাবনা রবীন্দ্রনাথেরও মনঃপূত হয় এবং তিনি স্বয়ং এই মর্মে জওহরলালকে চিঠি লেখেন। সব মিলিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের বলয়ে একজন প্রভাবশালী প্রফেসর হয়ে উঠছিলেন মেঘনাদ, একই সাথে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অস্বস্তির কারণও। শেষ পর্যন্ত জওহরলালকে চেয়ারম্যান করে কংগ্রেস কর্তৃক জাতীয় পরিকল্পনা সমিতি (ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন) গঠন ও তার রিপোর্ট তৈরি করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন মেঘনাদ। অনেক আগেই তিনি নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গবেষণা ও গবেষক তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। কলকাতায় একটি সাইক্লোট্রন সেন্টার গড়তে উঠে পড়ে লেগেছিলেন —দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে তাঁর সেই দুঃসাহসিক উদ্যোগ ধাক্কা খেয়েছিল তাঁর ছাত্রের পাঠানো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সহ জাহাজ সমুদ্রে ডুবে যাওয়ায়। কেন্দ্রকবিদ্যায় পারঙ্গম এক বিজ্ঞানী গোষ্ঠী গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে বিজ্ঞানচর্চা বা নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রকবিদ্যা চর্চার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণ। ফলত ভারত সরকারের আণবিক শক্তি বিভাগে তাঁকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছিল। স্বাধীন গবেষণার কাজেও পদে পদে তাঁকে ঠোক্কর খেতে হয়েছিল- নেহরু সরকারের আনুকূল্য পেয়ে ডিএইতে ঘাঁটি গেড়ে বসা অভিজাততান্ত্রিক বিজ্ঞানীগোষ্ঠীর নিষ্ঠুর বিরোধিতার দ্বারা। ১৯৫১ সালে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে বামপন্থীদের সমর্থনে নির্বাচন লড়ে কংগ্রেস প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাস্ত করেন তিনি। এই সমগ্র পর্ব জুড়ে কংগ্রেসের সংরক্ষণশীল উদারপন্থা ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোসপন্থার বিরুদ্ধে বামপন্থী মেঘনাদের দ্বন্দ্ব বাড়তে বাড়তে তীব্র চেহারা নিয়েছিল। জওহরলালের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার নজির অনেক চিঠিপত্রেই ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তাঁর সাথে মতাদর্শিক সংগ্রামে কখনও ছাড় দেননি। পার্লামেন্তারিয়ান হিরেন্দ্রনাথ মুখার্জির একটি বহুশ্রুত বর্ণনায় তার উল্লেখ আছে — ডক্টর সাহার পেশ করা বক্তব্যে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহরু, যিনি সাধারণত খুবই ভদ্র ব্যবহার করে থাকেন, ফেটে পড়ে বলেন যে বিজ্ঞান চর্চায় সংযুক্ত না থেকে এইসব বেকার কার্যকলাপে যুক্ত হওয়াটা সাহার উচিৎ হয়নি। জবাবে সাহা বলেন যে বর্তমানে রাজ করা রাজনৈতিক নেতারা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার পরও বহুকাল মেঘনাদ সাহার মত বৈজ্ঞানিকদের মানুষ স্মরণ করবে।
উপসংহার
ভারতে বিজ্ঞানচর্চা আধুনিক ইউরোপিয় ধারা নিতে শুরু করেছিল ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক থেকে। ভারত কখনও বহির্দেশীয় জ্ঞানভাবনার প্রতি রুদ্ধদ্বার ছিলনা। স্মরণাতীত কাল থেকে ভারতে বহু জাতি এসেছে ও সেসব মিলেমিশে এখানকার সমাজ বিকশিত হয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় আগ্রাসন ছিল সেসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের। ইউরোপীয় আগ্রাসনের সম্মুখীন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ভারত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়লেও সমাজ জীবনে বিবিধের মাঝে মিলনের একপ্রকার স্থিতিশীল ভারসাম্য অর্জিত হচ্ছিল যাকে ভারতীয় আধুনিকতার ঊষাকাল বলা যেতে পারে। ইউরোপীয় আগ্রাসন ভারতীয় সমাজের এই স্বাভাবিক বিকাশধারাকে তছনছ করে দিয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদরা বিজ্ঞান উৎপাদনে নিজস্ব অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ইউরোপের সাধারণ বিদ্বান সমাজ পরাধীন জাতির মানুষের এই স্বাধীন বৌদ্ধিক ভূমিকাকে স্বীকার করার মানসিকতা তখন অর্জন করতে পারেনি। মেঘনাদ ও সত্যেনের কাজকে তাঁরা ইউরোপে বসে ইউরোপীয় পদার্থবিদদের গাইডেন্সে করা বলেই ভেবে এবং লিখে এসেছে বরাবর। অনেক পরে শেষ পর্যন্ত এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাতে স্বয়ং মেঘনাদ এক দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন তাঁর নিজের জীবন ও তাত্ত্বিক গবেষণা সম্পর্কে তাঁদেরকে অবহিত করতে। মেঘনাদদের আত্মপ্রকাশের আরও প্রায় এক শতাব্দী পর অতি সম্প্রতি সত্যেন, মেঘনাদ ও জগদীশচন্দ্রদের অবদান নিয়ে নতুন করে আগ্রহ ও স্বীকৃতির ঢল নামতে দেখা গেছে। অষ্টাদশ শতক জুড়ে (১৭২০-১৮২০) ইউরোপীয়রা ইউরোপের বাইরে যেখানে যা বিজ্ঞান ও কারিগরির সন্ধান পেয়েছে দুহাত ভরে তা সংগ্রহ করেছে ও নথিভুক্ত করে নিজেদের দেশে পাঠিয়েছে। জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি কারিগরি, ইস্পাত নির্মাণ, বরফ বানাতে শীতলীকরণ পদ্ধতি ও চিকিৎসা বিদ্যার বহু ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে তৎকালীন চর্চা ও প্রয়োগের বিস্ময়মুগ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায় এই পর্বের ইউরোপীয়দের নথিগুলিতে। একশ বছরের মধ্যেই —উপনিবেশবাদ যতই ব্যাপ্ত হতে থাকে, আহরিত জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্ত হতে হতে তা যতই বিশ্বজনীন আধুনিক চেহারা নিতে থাকে, উপনিবেশের পুরনো সমাজের সমস্ত কিছু যতই ইউরোপীয় চেহারা নিতে থাকে— উপনিবেশবাদী প্রভুরা গল্পটা বদলে দিয়ে বলতে থাকে যে জ্ঞান বিজ্ঞান সবই ইউরোপীয়দের সৃষ্টি, তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে উপনিবেশের মানুষগুলো যুক্তিনির্ভর চিন্তাই করতে পারেনা “অসভ্য ব্যাকওয়ার্ড বর্বর”, পরাধীন জাতিগুলিও বুঝি সেরকমই বিশ্বাস করতে শুরু করে। আধুনিকতার চিরন্তন গ্রাহক হয়ে থাকার বদলে আধুনিকতার স্রষ্টা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস তৈরি করছিল সাহা-বোস-রামনদের কাজ। বর্তমান চলতি পর্বে ভারতে বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলি স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে কতটা এগোতে পেরেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চিরন্তন খাতক হয়ে থাকার বদলে কত মাত্রায় তার উৎপাদকের ভূমিকা নিতে পেরেছে, ব্যাপক সাধারণ জনতার বিজ্ঞান চেতনায় কতটা আলোড়ন জাগাতে পারছে তা আলোচনার বিষয় হতে পারে। বহু প্রতিভাধর বিজ্ঞানী জন্মেছেন, গবেষণার গড় মানেও প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞান কি মানুষের মাঝে পৌঁছাতে পারল? মেঘনাদ সারা জীবন এই লক্ষ্যে লড়েছিলেন। ইউরোপের বিজ্ঞান ও কারিগরিকে ভারতে যান্ত্রিকভাবে প্রতিস্থাপন না করে বরং দেশের মানবসম্পদের বিকাশ ঘটিয়েই স্বয়ম্ভর হতে হবে আমাদের—এই ছিল মেঘনাদের বিজ্ঞানভাবনার মূল কথা। এই লক্ষ্যেই তিনি “গজদন্ত মিনার ছেড়ে জনগণের মাঝে নেমে আসা”-র কথা বলেছিলেন, দেশের নেতাদের সাথে আজীবন তীব্র লড়াই করেছিলেন এবং চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কখনই নিজেকে সেই লড়াই থেকে সরিয়ে নেননি। সত্যেন্দ্রনাথও সেই লক্ষ্যেই সারা জীবন কাজ করেছেন, বিশ্বজনীন জ্ঞানবিজ্ঞানকে গ্রহণ করেই মাতৃভাষা তথা দেশজ ভিত্তিতে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। রামনও ছিলেন সেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি।
তথ্যসূত্রঃ
১. বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. অবিনাশ মেঘনাদ সাহা: বিজ্ঞান সমাজ রাষ্ট্র, অত্রি মুখোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ, ২০১২
৩. সত্যেন্দ্রনাথ বোস রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৯৯৮
৪. আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্যান্য রচনা, অমলকুমার রায়চৌধুরী, লেভান্ত বুকস, ২০০৭
৫. বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চা প্রাক-স্বাধীনতা পর্ব, বলাকা, সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা, ডিসেম্বর ২০০৯
৬. Bhadrolok Physics And The Making Of Modern Science In Colonial India, Somaditya Banerjee
৭. Bose’s e-Archive, snbproject/purnimasinha
৮. Life With Meghnad Saha, Chitra Roy
৯. The Era of Science Enthusiasts in Bengal (1841 – 1891) Akshaykumar, Vidyasagar and Rajendralal, A K Biswas
১০. Jorney into light: life and science of C. V. Raman, Ganeshan Venkatraman
১১. Dispersed Radiance : Caste Gender and Modern Science in India, Abha Sur
১২. Science and Civilization in China, Joseph Needham
১৩. Meghnad Saha’s Two International Faces : Politics in Science and Science in Politics Between the Wars, Robert S. Anderson (The Internationalist Moment: South Asia, World and World Views, 1917-39)
১৪. Santimay Chatterjee and Enakshi Chatterjee, 2005, Satyendranath Bose. (Calcutta National Book Trust 2005)
১৫. Indian Science and Technology in the Eighteenth Century, Dharmapal, Collected Worrks
১৬. অনুশীলন সমিতির ইতিহাস, জীবনতারা হালদার, র্যাডিকাল
বাংলা তথা বাঙালির বিজ্ঞান চর্চা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিজ্ঞান সাধক বাঙালির সোচ্চার উপস্থিতির ইতিহাস সংক্রান্ত এক অমূল্য দলিল এটি। শুধু ইতিহাস নয়, বিজ্ঞানের জটিল ও কঠিন তত্ত্ব যেমন অবলীলাক্রমে আপনি সহজ সরল বাংলায় উপস্থাপন করেছেন তার জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। শুধু একটা বিষয়, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে সত্যেন বোস ও মেঘনাদ সাহার অবস্থান আরেকটু বিস্তারিত লিখলে ভালো হতো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি ঠিকই বলেছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে সত্যেন বোসের অ্যাক্টিভিজম নিয়ে কিছু কথা লেখা জরুরি ছিল। ষাটের দশকে বিভিন্ন সভা সমিতিতে এ বিষয়ে ভাষণ দিয়েছেন। এগুলির মধ্যে ১৯৬২ সালে হায়দরাবাদে “আংরেজি হঠাও” সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য খানিকটা উদ্ধৃত করছি ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন’ থেকে,
“কেবল একটা শ্রেণীর মধ্যে জ্ঞান যদি আবদ্ধ থাকে তাহলে উন্নতি তত দ্রুত হয় না…দেশের সাধারণ লোকই দেশ…ইংরেজি ভাষার দ্বারা বহুদিন চেষ্টা করলেও আমাদের দেশে জনজাগরণ হয়নি। …যাঁরা বলেন, ইংরেজী যদি কম শেখানো হয় তাহলে আমাদের দেশের জানালা বন্ধ করে দেওয়া হবে- যার মধ্যে দিয়ে আসে জ্ঞানের আলোক ও স্বাধীনতার বাতাস, তাঁরা ভুল ধারণা করেছেন যে, চিরকাল ভারতবর্ষের চতুর্দিকে কারাগারের উঁচু পাঁচিল থাকবে এবং আলো আসবে উপর থেকে যেটা কেবল মাত্র উপরতলার শিক্ষিত লোকের কাছে পৌঁছবে এবং সেটা তাঁরা যেমন বুঝবেন সেই রকম নীচের অজ্ঞ লোকেদের কাছে পৌঁছে দেবেন। এইভাবে দেশের উন্নতি করা কষ্ট দায়ক। তাছাড়া সকলের দায়িত্ব অল্পসংখ্যক লোকের একটি শ্রেণীর উপর চিরকালের জন্য চাপানো উচিত নয়।”
শিক্ষার প্রশ্নকে গ্রামসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীপ্রশ্ন বলেছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় সমাজে সবচেয়ে আদি ও গভীরতম বৈষম্য শিক্ষার সুযোগ বা অধিকারের বৈষম্য। সত্যেন্দ্রনাথের উপরোক্ত ভাষণে অত্যন্ত কৌশলি কিন্তু স্পষ্ট কথায় মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার বনাম ইংরেজি আধিপত্যের মৌলিক রাজনৈতিক দিকটি প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়। বিজ্ঞানের পরিভাষার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, “আমি বিশুদ্ধবাদী নই; তাই ইংরেজী টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানাই। আমাদের ছেলেরা যদি ওই শব্দ সহজেই বোঝে তবে ধার-করা শব্দ হিসেবেই তা টিকে থাকবে ও সমৃদ্ধ করবে আমাদের জাতীয় শব্দ ভাণ্ডার”(১৯৬৩, রাঁচি ভার্সিটির সমাবর্তন ভাষণ)। হায়দরাবাদের ভাষণেই তিনি একথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, “শুধু একটা নাম খারিজ করে, একটা নাম কেটে দিয়ে আরেকটা নাম চালালেই আমাদের নতুন যুগের আহ্বান সার্থক হয়ে উঠবে না।”
ইংরেজি তো নয়ই, উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অন্য কোনও ভাষার মাধ্যমেই যে ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয় – এই ছিল তাঁর মূল কথা,
“ঐক্যানুভুতিকে জাগিয়ে রাখা সাধনা বিশেষ। মুখের কথায় ঐক্য হয় না। আমার মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের লোকেদের নিজেদের ভাষার মধ্যে দিয়ে বুঝতে হবে আমাদের ঐতিহ্য কি এবং কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের লোকের সঙ্গে আমাদের মিলন ছিল…আমাদের দেশের ঐক্য আগে যেভাবে অনুভুত হত তার তুলনায় আজকের দিনে যা আমরা গরে তুলব সেটা আরও বিশেষ বৈচিত্র্যসম্পন্ন হবে…কেবলমাত্র রাজকীয় মঞ্চ থেকে একতার কথা বললে চলবে না। আমাদের বলতে হবে প্রত্যেক ঘরের কোণ থেকে এই একতার বাণী…এই জন্যই মাতৃভাষা দরকার।”
মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস নিয়ে প্রযোজনীয় লেখা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই অলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও লেখকের ইতিহাসবোধ ও সহজ সাবলীল লেখা পড়ে অনেক অজানা বিষয় জানতে বুঝতে পারলাম।
ধন্যবাদ নবেন্দুদা।
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা
অত্যন্ত মনোগ্রাহী, তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ।
গত শতকের পঞ্চাশ দশকের পর থেকে সত্যেন-মেঘনাদ-প্রফুল্লচন্দ্র-জগদীশ-প্রশান্তচন্দ্র-ব্রহ্মচারী-অমল-দের আমরা আর পাইনি। অথচ বিশ্বের এই বিশ্বসেরা বাঙালি বিজ্ঞানীরা আর কেন তৈরি হলেন না? এঁদের পিয়ার রিভিউড জার্নাল, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, সাইটেশন ইনডেক্স দরকার পড়েনি, তখন ছিলও না। অথচ স্বীকৃতির বাধা, পুঁজি আর পরিকাঠামোর অভাব সত্ত্বেও বিজ্ঞানকে শুধু অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে যাননি, গড়ে তুলেছেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। হঠাৎ ওঁদের মতো বিজ্ঞানীরা আর কেন তৈরি হলেন না? কী করে একসময়কার নিরন্তর ফল্গুধারা বন্ধ হয়ে গেল? বিজ্ঞান কর্মপদ্ধতি অবশ্যই পাল্টেছে, দলবদ্ধ গবেষণাই এখন দস্তুর, তবে শুধু তা দিয়ে এর ব্যাখ্যা বোধ হয় পাওয়া যাবে না। ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি, তাঁর প্রতিভা, তাঁর নিরলস সাধনা সর্বকালেই আবিষ্কারের নিয়ামক ছিল ও থাকবে। তথাপি বাস্তবিকই কিছুর একটা অভাব ঘটেছে। নইলে ওই মাপের বিজ্ঞানীদের হঠাৎ এদেশে আকাল পড়তে পারে না।
যদি বলি তার কারণ, এক, তখনকার জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ওঁদের ছিল অদম্য জেদ, একরোখা, কুছপরোয়ানেই মনোভাব, আমরা পরাধীন জাতি হিসেবেও সাহেবদের থেকে কম যাইনা তা দেখিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। দুই, সমকালীন লিবারেল এডুকেশনের কল্যাণে তাঁরা ছিলেন বহু বিষয়ে, ভাষায় পন্ডিত, যা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে analogy টানতে পারদর্শী করে তোলে, মনকে প্রস্তুত করে অশ্রুত, অজ্ঞাত ক্রিয়ার তাৎপর্য তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করতে; আর এহেন serendipity যে আবিষ্কারে বিরাট ভূমিকা নেয় তা আজ প্রায় সকলেই শিকার করে। পাস্তুর বলেছিলেন না chance favours the prepared mind?
আপনাদের মত জানতে উৎসুক থাকলাম।