সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রেনেসাঁস, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বঙ্গীয় মুসলমান সমাজ

রেনেসাঁস, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বঙ্গীয় মুসলমান সমাজ

শিবাশীষ বসু

আগস্ট ১১, ২০২০ ২৩৮৩ 15

ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালী হিন্দু মুসলমান সমাজ ব্রিটিশ আমলে প্রবেশ করে। এই উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে, ব্রিটিশ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ মোটামুটিভাবে ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তকদের বিরুদ্ধে হালের সমালোচকদের মনে একটা স্টিরিওটাইপ ধারণা আছে যে একমাত্র কেরাণী সম্প্রদায় তৈরি করবার জন্যেই এর সৃষ্টি। ধারণাটি নিতান্তই একপেশে না হলেও আংশিক সত্যি। বিষয়টি বোঝবার জন্য এইখানে একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসকদের কোনও শিক্ষানীতি ছিল না, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করবার নীতি নিয়েই চলছিল শাসকগোষ্ঠী। বরং বলা যায় যে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বারা কলকাতায় মাদ্রাসা এবং ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে জোনাথন ডানকান দ্বারা বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁদের প্রাচ্যপ্রীতিই পরিস্ফুট হয়েছিল। মাদ্রাসায় প্রাচীন আরবী ও ফারসী রীতি অনুসারে এবং সংস্কৃত কলেজটিতে মনুপ্রণীত ধর্মশাস্ত্রের নির্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হত। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে, “পূর্ব্বোক্ত উভয় নিয়ম দ্বারাই প্রতিপন্ন হইতেছে, যে তদানীন্তন রাজপুরুষগণ হিন্দু ও মুসলমানগণের প্রাচীন রীতিনীতির প্রতি হস্তার্পণ করিতে অতীব কুণ্ঠিত ছিলেন।” [১] প্রকৃতপক্ষে, এই দু’টি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কিছু পণ্ডিত ও মৌলবী সৃষ্টি করা, যাঁরা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক আইনকানুন বুঝিয়ে দিতে পারবেন। অবশেষে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সনদের পত্র পুনর্গ্রহণের সময় লর্ড মিন্টোর প্রচেষ্টায় ভারতীয় প্রজাকুলের মধ্যে বিদ্যার প্রসার, পণ্ডিতদের উৎসাহদান ও জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে ভারতবর্ষে শিক্ষাখাতে বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের কথা প্রস্তাবিত হলেও তা মোটেই বাধ্যতামূলক ছিল না। এমনকি সংস্কৃত, আরবী, ফারসী, না ইংরেজী – কীরূপ শিক্ষার জন্য এই টাকা ব্যয় করা হবে, তারও কিছু স্থির করা হয় নি। ফলে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে এবং জেনারেল কমিটি এক কথায় পাশ্চাত্যবাদীদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছে, “Tuition in European sciences is neither among the sensible wants of the people nor in the power of Government to bestow.” [২] পাশ্চাত্য শিক্ষাদানে কোম্পানীর আগ্রহ না থাকবার অন্যতম প্রধান কারণ হল, তখন ফরাসী বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণী সমগ্র ইউরোপকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে – এমন অবস্থায় ভারতীয় প্রজাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসার লাভ করলে তারাও ওই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, হয়তো এই আশঙ্কাও শাসকগোষ্ঠীর মনে কাজ করছিল।

এই নীতিরই ফলশ্রুতিতে ১৮১৪ থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত কিছুই করা হয় নি বললে অত্যুক্তি হবে না। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হিন্দু কলেজ ছিল সম্পূর্ণরূপে বেসরকারী উদ্যোগের ফল। বোধহয় সেই কারণেই কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কলকাতায় প্রস্তাবিত সংস্কত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে ১৮২৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর রামমোহন রায় লর্ড আর্মহার্স্টকে যে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ চিঠিখানি লেখেন তাতে তিনি সংস্কত শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্ধকারের হাতিয়ার বলে নিন্দাবাদ করেন এবং ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের আলো বিকিরণের জন্য উদার ও উচ্চমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সুপারিশ করেন। [৩] প্রকৃতপক্ষে রামমোহন সরকারের নূতন আরেকটি সংস্কৃত কলেজ খুলবার অপ্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলেছিলেন – “… to impart such knowledge as is already current in India.” রামমোহনের মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে কারণ, সংস্কৃত না কেবল “… load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use.” বরং তার সঙ্গে সঙ্গে “the Sanskrit system of education would be the best calculated to keep this country in darkness, …”, এর পরিবর্তে রামমোহন চেয়েছিলেন, “… a more liberal and enlighted system of instruction, embracing Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anantomy, with other useful sciences, which may be accomplished with the sum proposed by employing a few gentlemen of talent and learning educated in Europe and providing a collage furnished with necessary books, instruments and other aperatures.” [৪] যদিও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী থেকে রামমোহনের এই প্রতিবাদমূলক চিঠিখানিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় নি, তবুও এই চিঠিখানির মাধ্যমে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ভারতীয় পাশ্চাত্যশিক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শিবনাথ শাস্ত্রী রামমোহনের এই ঐতিহাসিক চিঠিখানিকে “নবযুগের প্রথম সামরিক শঙ্খধ্বনি” [৫] বলে অভিহিত করেছিলেন।

ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী এই দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। অবশেষে বেন্টিঙ্ক-মেকলে-ট্রেভলিয়ন ব্লক সাম্রাজ্য শাসনের প্রয়োজনে ও আর্থিক সম্পদকে বাণিজ্য ও শিল্পের স্বার্থে শোষণের উদ্দেশ্যে ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষপাতী হলেন। ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দের ৭ই মার্চ বেন্টিঙ্ক এই প্রস্তাবে সাক্ষর করলেন। অর্থাৎ, রামমোহন যে চিঠি আমহার্স্টকে লিখেছিলেন তার বারো বছর পর তাঁর নীতি জয়যুক্ত হল – প্রাচ্যবাদীদের পরাজয় ঘটল।

টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তাঁর কুখ্যাত প্রতিবেদনের ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে যা ঘোষণা করেছিলেন – “We must at present do our best to form a class of persons Indian in blood and colour and English in taste, opinions in morals and in intellect.” [৬] ইতিহাস কিন্তু অনেক আগে থেকেই অসচেতনভাবে সেই প্রয়োজনই সাধন করে চলেছিল। এর জন্য মূলত দায়ী ভারতীয়, বিশেষত হিন্দু, সমাজব্যবস্থা। প্রাক-ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় সমাজ কাঠামোতে ব্যক্তির নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল না। সে ছিল সম্পূর্ণভাবে পরিবার ও সমাজের অধীন। ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্ব অস্বীকৃত বলেই তার জীবন ছিল একান্তভাবেই পরিবারের শাসনাধীন এবং একইভাবে পরিবারগুলি ছিল গ্রাম্য সমাজপতিদের শাসনাধীন। “তাদের শাসন-ক্ষেত্রের চৌহদ্দি খুব বিস্তৃত ছিল না, এবং বিস্তৃত ছিল না বলেই তার বিধান নির্মম, প্রতিবাদহীন, তার ন্যায়-অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে কোনো আপীল নেই। ফলে তার বাইরের আকৃতি গ্রাম্য হলেও, তার চক্ষু গ্রাম্য দেবতার মতো রক্তবর্ণ, দুর্বার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রেরণায় স্বৈরাচারী। ইংরেজ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা, সামাজিক বিধিব্যবস্থা, ভূমি-সম্পর্ক, ইংরেজদের ব্যক্তিগত সাহচর্য, ইংরেজী পঠনপাঠন ইত্যাদি পূর্বতন স্বৈরাচারী শাসনের ইমারত চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়।” [৭]

এমনকি ১৮৫৩ সালের ১০ই জুন লিখিত ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ শীর্ষক প্রবন্ধে, যা নিউ ইয়র্কের ডেলি ট্রিবিউন পত্রিকায় ২৫শে জুন প্রকাশিত হয়েছিল, কার্ল মার্কস প্রাক্ ঔপনিবেশিক যুগের ভারতবর্ষের গ্রাম সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, “… এ কথা যেন না ভুলি যে, এই সব শান্ত-সরল (Idyllic) গ্রাম-গোষ্ঠীগুলি যতই নিরীহ মনে হোক প্রাচ্য স্বৈরাচারই তার দৃঢ় ভিত্তি হয়ে এসেছে চিরকাল, মনুষ্য-মানসকে তারাই যথাসম্ভব ক্ষুদ্রতম পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, তাকে বানিয়েছে কুসংস্কারের অবাধ ক্রীড়ণক, তাকে করেছে চিরাচরিত নিয়মের ক্রীতদাস, হরণ করেছে তার সমস্ত কিছু মহিমা, ও ঐতিহাসিক কর্মদ্যোতনা।” [৮]

১৮৩০ সালে ডিরোজিও শিষ্যগণও প্রায় একই ভাষায় এবং একই কারণে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে ওকালতি করেছেন কারণ, ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা তাঁদের মধ্যে এনে দিয়েছিল বদ্ধ সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তির বাতাস। পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের মুখগুলি যে আদর্শ, নীতি ও যুক্তিবাদী মানসিকতার সঙ্গলাভ করেন, বলা বাহুল্য, প্রাচীন অথবা সমকালীন ভারতীয় চিন্তায় তার নিদর্শন ছিল না। এর ফলে ভারতের সমাজ ইতিহাসে ব্যক্তিমানুষ এই প্রথম পরিবার তথা সমাজপতিদের শাসনশৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করবার অধিকার লাভ করল। পূর্বতন যুগের সামাজিক শ্রেণীবিচারের একমাত্র মানদণ্ড ছিল বংশকৌলিন্য তথা উঁচুজাত। “সওদাগরশ্রেণী, কারিগরশ্রেণী অথবা অবস্থাপন্ন কৃষকশ্রেণী ধনসম্পত্তির দিক দিয়ে উচ্চশ্রেণীভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করলেও তাদের সেই শ্রেণীমর্যাদা দেওয়া হত না।” [৯] ব্রিটিশ শাসনে সেই সামাজিক অচলায়তন ভেঙে এক সামাজিক গতিশীলতার সৃষ্টি হল। শিক্ষার অধিকার সকলকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে দিল। নবসৃষ্ট এই মধ্যবিত্ত এবং বিদ্বৎসমাজ ছিলেন সম্পুর্ণরূপে (তদানীন্তন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে) শৃঙ্খলমুক্ত এবং স্বাধীন – পুর্বতন ব্রাহ্মণ্যসমাজের প্রতি আনুগত্যহীন। “আর ইতিহাসেরও সাক্ষ্য এই, এবং বিশ্বজোড়া মানব অভিজ্ঞতায় এটা পরীক্ষিত সত্য যে, এরূপ একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব ব্যতিরেকে রেনেসাঁস অথবা সমাজসংস্কার কোনো আন্দোলনই বাস্তবায়িত হয় না।” [১০]

যদিও ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শাসনকার্য পরিচালনায় সহযোগীতার মাধ্যমেই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হয়, তাহলেও দেখা গেছে জাতিধর্ম নির্বিশেষে নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি দরিদ্র পরিবারের সন্তানও অর্জিত বিদ্যার বিনিময়ে (এক্ষেত্রে মূলত ইংরেজি ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনের কথা বলতে চাইছি) অর্থ উপার্জন করে, না কেবল সমাজে প্রতিপত্তিশালী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজেও প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মেকলের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কুড়ি বছরের মধ্যেই চতুর ইংরেজ রাজপুরুষদের কাছে উচ্চশিক্ষিত বাঙালী আতঙ্কের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। নরহরি কবিরাজ দেখিয়েছেন, “এলিনবরা উডকে সাবধান করলেন এই বলে, ‘Education will be fatal to British rule.’ উড সাহেব ডালহৌসিকে লিখে পাঠালেন, ‘নেটিভ’রা শিক্ষা পেয়ে বুদ্ধিমান হয়ে উঠলে বিপদ হবে।” [১১] চতুর উড বুঝতে পেরেছিলেন যে উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রা চাকরী না পেলেই সরকার বিরোধী অসন্তুষ্ট শ্রেণীতে পরিণত হবে। তাই তিনি বলেছিলেন, “I am against providing our future detractors, opponents and grumblers.” [১২] সুতরাং সমালোচকরা যতোই নবজাগরণকে তুচ্ছ অথবা হেয় জ্ঞান করুন না কেন, ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই বঙ্গদেশে নবজাগরণের পদধ্বনি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আধুনিক ভাষাশিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, পত্রপত্রিকার প্রকাশ, সভাসমিতি গঠন, বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশ, নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, শিক্ষা-ধর্ম-সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং তার দ্বারা মুক্তচিন্তা ও মানবতাবাদের বিকাশ – প্রভৃতির মাধ্যমেই নবজাগরণের আত্মপ্রকাশ হয়। ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের মতে, “তৎকালে ইউরোপীয় প্রথায় যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা ও ভাবনার ভিত্তিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিভাগের অনুশীলন দ্বারা মানসিক উন্নতি এবং জ্ঞান, বুদ্ধি ও কর্মশক্তির নব নব উদ্দীপনই যে ইহার আদর্শ ছিল – তৎকালে নূতন প্রণালীতে শিক্ষিত ছাত্রবৃন্দের কার্যধারা আলোচনা করলেই তাহা বেশ বুঝা যাইবে।” [১৩]

বিনয় ঘোষের মতে, এই নব্যবঙ্গের প্রধান ট্র্যাজেডি হল, “বাংলার এই নূতন বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালী বিদ্বৎসমাজ’ না বলে বিশেষ অর্থে ‘বাঙালী হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত।” [১৪] স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে এইপ্রকার অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে – হিন্দুরা? মুসলমানরা? নাকি ব্রিটিশরা? আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে, এই ট্র্যাজেডির রচয়িতা প্রধানত ইংরেজ শাসকরা এবং উদীয়মান হিন্দু সম্ভ্রান্ত সমাজ, কারণ, ইয়ংবেঙ্গল, রামমোহন ও ব্রাহ্মসমাজ এবং বিদ্যাসাগরসহ পরবর্তী সমাজসংস্কারকেরা প্রধানত হিন্দুসমাজের শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন এবং মুসলমান সমাজের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল না।” কিন্তু এমনটা মনে করবার কারণ নেই যে তাঁদের এইরূপ মনোভাবের পিছনে কোনও সঙ্কীর্ণ মুসলমান বিদ্বেষ কাজ করছিল। বিনয়বাবুর মতে, এর “আসল ঐতিহাসিক কারণ, নূতন হিন্দু মধ্যশ্রেণীর বিকাশ ও বৃদ্ধি।” [১৫] এই মধ্যশ্রেণীই সর্বত্র নবযুগের ধারক ও বাহক। হিন্দুসমাজ তখন অশিক্ষা, দুর্নীতি, ধর্মীয় অনাচার, ব্যাভিচারের পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল, তাই enlightment এবং humanism এর অগ্রদূতরা হিন্দু সমাজের বাইরের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো সময় পান নি। ফলস্বরূপ মুসলমান সমাজের উন্নতির দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল না। ইয়ংবেঙ্গলের কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র, রাধানাথ শিকদার অথবা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এঁদের রিফর্মেশন আন্দোলন স্রেফ ঐতিহাসিক কারণে হিন্দুসমাজের মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও এঁদের সাম্প্রদায়িক বলে অভিযুক্ত করা স্রেফ মূর্খতার নামান্তর।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ঊনিশ শতকের প্রথমভাগের এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, প্রধানত হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকেই গড়ে উঠেছিল। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর কারণ আর কিছুই নয়, হিন্দু সমাজের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী। ইংরেজরা আসবার আগে সুদীর্ঘ মুসলিম রাজত্বকালেও দেখা গেছে তারা সে আমলের রাজভাষা আরবী ও ফারসী শিখতে দ্বিধাবোধ করে নি এবং তার ফলে মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর দরবারেও নানাবিধ সুযোগসুবিধা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। সালাহউদ্দীন আহমেদ তাঁর ‘আধুনিকতাবিমুখ বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশের বিকাশ সমস্যা’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, “নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় বাংলার জমিদারদের তিন-চতুর্থাংশ এবং অধিকাংশ তালুকদার হিন্দু ছিলেন। মোগল শাসনব্যবস্থার অধীনে মুর্শিদকুলী খান বহুসংখ্যক হিন্দুকে রাজকর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করেন। বস্তুত মুসলমান আমলে এদেশের রাজস্ব বিভাগের চাকুরি প্রায় একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের হাতে ছিল।” [১৬] একইভাবে ব্রিটিশ রাজত্ব এদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হিন্দু সমাজ ইংরেজি ভাষা শিখতে সর্বাধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, বিশেষত ঊনিশ শতকের যুক্তিবাদী, উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, এই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে বাঙালীর জীবনে যে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয় তা বাঙালী মুসলমানদের কি পরিমাণে স্পর্শ করেছে? এই আলোচনায় ঢোকার আগে কয়েকটি রিপোর্টের পারস্পরিক তুলনা দেওয়া আবশ্যক। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারের একাধিক জেলা পরিভ্রমণ করে উইলিয়াম অ্যাডাম তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে দেখান বঙ্গের পাঠশালাগুলিতে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা ৯৪.৫৭% এবং মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ৫.২৪%। এরপর সরকারি সহযোগিতায় বঙ্গ জুড়ে সূচনা হয় আধুনিক শিক্ষার প্রসারের। এবার এর সঙ্গে ১৮৭১-৭২ সালে প্রাপ্ত শিক্ষাবিভাগের রিপোর্টের একটি পরিসংখ্যানের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে বাংলায় স্কুলছাত্রের মধ্যে হিন্দুছাত্র ৭৭.৪৫% এবং মুসলমান ছাত্র ১৪.৫৩%। [১৭] অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক ও মধ্যশিক্ষায় মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু উল্লিখিত গ্রন্থটিতে বিনয় ঘোষ আরেকটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন। তা হল ১৮৮১-৮২ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রসংখ্যার তুলনা – হিন্দুছাত্র ৯২.৪১% এবং মুসলমান ছাত্র মাত্র ৩.৮৭%। এইখানেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি বাঙালী মুসলমান উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত ছিল না? নাকি কারণটা ভিন্ন কিছু? দেখা যাক।

প্রথমত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনে যাঁরা জড়িত ছিলেন সেই দোভাষী, দালাল, বেনিয়ান, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান, মুনশী, কেরানি ইত্যাদির অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। ইংরেজদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকবার ফলে এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার ফলে এইসব পরিবারের সন্তানরাই প্রথমে পাশ্চাত্য শিক্ষার এবং উচ্চশিক্ষার সংস্পর্শে আসেন।

দ্বিতীয়ত, ‘Stadtluft mach freit’ – খুব প্রাচীন একটি জার্মান প্রবাদ, — এর বাংলা অর্থ হল – নগরের হাওয়ায় মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়। কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হয়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতকের বাঙালীর ক্ষেত্রে। ঊনিশ শতকে মুক্তচিন্তাকামী বাঙালির স্বপ্নের নগরী ছিল কলকাতা মহানগর। কলকাতা সন্নিহিত জেলাগুলি, যথা হুগলী, হাওড়া, চব্বিশ পরগণা, মেদিনীপুর বা নদীয়া বরাবরই হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এই অঞ্চলের মানুষ মহানগরীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের অধিকতর সুযোগ পেয়েছিল। সুযোগ পেয়েছিল উচ্চশিক্ষার।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল বরাবরই দুর্বল। তাদের মধ্যে কৃষিজীবীর সংখ্যাই ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি, চাকুরিজীবীর সংখ্যা কম। বস্তুত, নবাবী আমলে স্রেফ বিচার বিভাগেই মুসলমানদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু এই অভিজাত শ্রেণীর একটি বিরাট অংশই ছিলেন বহিরাগত, যাঁদের আধিপত্য প্রধানত মুসলিম রাজশক্তির উপরই নির্ভরশীল ছিল। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই রাজশক্তির যখন পতন হয়, তার উপর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক কাঠামোটিও ভেঙে পড়ে। যারা প্রশাসনিক বিভিন্ন কার্যে যুক্ত ছিলেন, খ্রিষ্টানের গোলামী করা মর্যাদা হানিকর মনে করে তাঁরও চাষবাসের পেশায় ফিরে যান। এই কারণেই ইংরেজের রাজত্বে যখন আর্থিক জীবনকে নূতনভাবে গঠন করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল তখন হিন্দুরা এই অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেন, কারণ, তাঁদের বাদশাহী আমলের প্রতি কোনও স্বার্থগত এবং ধর্মীয় আনুগত্য ছিল না। পক্ষান্তরে, দেখা যাবে যে মুসলমানরা এই নূতন অর্থনৈতিক জীবনচর্চা অস্বীকার করলো। ফলস্বরুপ, উভয় সমাজের উপরাংশে একটা রেশারেশির ভাব সৃষ্টি হল যা ঊনিশ শতকের শেষাংশে এবং বিশ শতকে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছিল।

চতুর্থত, বাংলার মুসলমানরা পাশ্চাত্য-শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গোড়া থেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। সম্ভবত এই ক্ষোভের কারণ, ইংরেজ দ্বারা দেশের শাসকশ্রেণী থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, “If ever a people stood in need of a career, it is the Musalman aristocracy of Lower Bengal. Their old sources of wealth have run dry. They can no longer sack the stronghold of a neighbouring Hindu nobleman.” [১৮] এইভাবে বাঙালী সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে তাঁরা স্বভাবতই ইংরেজদের দায়ী করতেন। “During the last seventy five years the Musalman houses of Bengal have either disappeared from the earth, or at this moment being submerged beneath the new strata of society which our rule has developed.” [১৯]
পঞ্চমত, বদরুদ্দীন উমরের মতে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজ রাজত্বের প্রথম অধ্যায়ে ক্ষয়িষ্ণু মুসলমান সামন্তশক্তির এবং তাঁদের তাঁবেদারদের মিথ্যে প্রচার, যা ছিল, মুসলমানদের সাম্রাজ্য হারানোর কথা। ” মোগল সাম্রাজ্যের দেশীয় চরিত্রকে অগ্রাহ্য করে তার ধর্মীয় চরিত্রের উপরেই এক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব আরোপ করেছিল। অর্থাৎ তাদের মতে মোগল সাম্রাজ্য আসলে ভারতীয় ছিল না, ছিল মুসলমানদের রাজ্য। কাজেই ইংরেজ রাজত্বে সমগ্র মুসলমান সমাজই হল রাজ্যহারা – ‘রাজার জাতি’ থেকে তারা পরিণত হল প্রজার জাতিতে।” [২০] বাঙালী মুসলমানদের এই ইংরেজবিদ্বেষের ফলে কয়েক শতাব্দী আগে যেমন হিন্দুরা সংস্কৃত শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন, ঊনিশ শতকের মুসলমানদের অধিকাংশই তেমনই আরবী-ফারসী তথা মক্তব-মাদ্রাসার প্রতি অনুরক্ত রইলেন। বিনয় ঘোষের মতে, “বাংলার মুসলমানদের নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে এই গোঁড়ামি, দম্ভ ও রক্ষণশীলতা এবং স্বাভাবিক ইংরেজ-বিদ্বেষের জন্য সে-সময় ইংরেজদের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও শাসন-ব্যবস্থার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তাঁদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায় নি।” [২১]

তাই কলকাতা মাদ্রাসা এবং হুগলী মহসীন কলেজের তৎকালীন ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো, “১৮৩৫ সালে যখন ইংরেজিশিক্ষার পক্ষে বেন্টিঙ্ক-মেকলের নূতন নীতি প্রবর্তিত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে কলকাতার মুসলমানসমাজ তীব্র প্রতিবাদ করেন। আট হাজার মুসলমানের স্বাক্ষরসহ একটি প্রতিবাদপত্র গভর্নমেন্টের কাছে পাঠানো হয়। [২২] কলকাতা মাদ্রাসার ইউরোপিয়ান অধ্যক্ষ স্প্রেঙ্গার সাহেব যখন মাদ্রাসার শিক্ষাপদ্ধতি সংস্কার করার চেষ্টা করেন, তখন মাদ্রাসার মুসলমান ছাত্ররা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। একদিকে, ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজে মুসলমানদের পড়বার অধিকার ছিল না ; অপরদিকে, কলকাতা ও শহরতলীর খ্রিষ্টান মিশনারী বিদ্যালয়গুলিতে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে মুসলমান অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানদের পাঠাতেন না। হাজী মহম্মদ মহসীন নিজের উইলে তাঁর যথাসর্বস্ব জনশিক্ষার জন্য দান করেছিলেন। “১৮৩৬ সালে চুঁচুড়ায় হুগলী মহম্মদ মহসীন কলেজ স্থাপিত হলে তিনদিনের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হয় ১২০০, প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে ৩০০। ইংরেজি বিভাগে মুসলমান ছাত্র হয় ৩১ জন, হিন্দু ৯৪৮ জন। [২৩] কিন্তু কয়েকবছর পর উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিনিধিরা “যখন দেখল যে, মহসীন তহবিলের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হুগলী কলেজে মুসলমান ছাত্রের তুলনায় হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেশি তখন তারা সরকারী তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেই কলেজের ব্যয়ভার মহসীন তহবিল থেকে দেওয়ার ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি করল।” [২৪] আবদুল লতিফের মতো রক্ষণশীল সমাজপতিদের প্রবল বিরোধিতায় বাধ্য হয়ে সরকার ১৮৭২ সালে হুগলী কলেজ থেকে মহসীন তহবিল প্রত্যাহার করে নিয়ে সেই অর্থে হুগলী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মাদ্রাসা স্থাপন করে এবং মুসলমান সমাজ সামন্ততান্ত্রিক রক্ষণশীল পশ্চাদমুখী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়। বদরুদ্দীন উমর আক্ষেপ করে বলেছেন, “উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমান ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজকে উদ্ধার করার জন্য কোনও বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব হয় নি।” [২৫]

এর ফলটা কি দাঁড়ালো? বিনয় বাবুর মতে কলকাতা মাদ্রাসা (ওয়েলসলি) থেকে হিন্দু কলেজ (কলেজ স্কোয়ার, গোলদীঘি) বেশি দূর নয় কিন্তু “১৮৫০ সালে যখন মাদ্রাসার ইংরেজ অধ্যক্ষকে মুসলমান ছাত্ররা ইটপাটকেল ও পচা ফল ছুঁড়ে মেরেছিলেন, তখন ওয়েলসলি থেকে গোলদীঘির দূরত্ব একটি যুগের দূরত্বে পরিণত হয়েছে বলা চলে। [২৬] ফলে একদিকে যেমন হিন্দুসমাজে ক্রমেই একটি শিক্ষিত পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সমাজের বিকাশ হয়েছে, অন্যদিকে মুসলমান সমাজে পুরানো অভিজাত সমাজ ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে এবং দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর সংখ্যা বেড়েছে এবং বিদ্বৎসমাজেরও বিকাশ হয় নি।

আর একটি ক্ষতি হয়েছে চাকুরীক্ষেত্রেও। ১৮৩৭ সালে সরকার অফিস আদালতে প্রচলিত ফারসীর বদলে ইংরেজি ভাষা চালু করবার আদেশ দেয়। ১৮৪৪ সালে সরকারের সমস্ত বিভাগে স্রেফ ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়। “এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্য চিরতরে মুদ্রিত হয়ে গেল। ১৮৪৫-৫২ খ্রীস্টাব্দে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকাতেও কোনো মুসলমান লোকের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই। আসল কথা হচ্ছে, এসব পরীক্ষার মান এত উচ্চ ছিল যে মক্তব-মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে মুসলমানরা সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নি।” [২৭] হান্টার সাহেব বলেছেন, “The staff of Clerks attached to the various offices, the responsible posts in the Courts, and even the higher offices in the Polices, are recruited from the pushing Hindu youth of the Government school.” [২৮] “… and, in fact, there is now scarcely a Government office in Calcutta in which a Muhammadan can hope for any post above the rank of porter, messenger, filler of ink-pots and mender of pens.” [২৯] হান্টার মোটেই অতিশয়োক্তি করেন নি। ১৮৭১ সালে বাংলার প্রাদেশিক সরকারি চাকরির সংখ্যাতত্ত্ব দেখায়, মোট ২১১১ জন সরকারি কর্মচারির মধ্যে হিন্দু ৬৮১ এবং মুসলিম ৯২ জন। “এই অসহযোগিতা ও গোঁড়ামির জন্যই তাঁরা শিক্ষা ও সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পিছনে পড়ে গেছেন।” [৩০]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে ঊনিশ শতকের তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত বাংলার নবজাগরণে মুসলমান সম্প্রদায়ের জড়িত না থাকার মূল কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচ্যুতির ফলে জাতিগত অভিমান এবং খানিকটা পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের প্রতি বিরূপ মনোভাব, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে তাঁরা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তবে ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের আগ্রহ হিন্দু সমাজের মতো মুসলমান সমাজের ছিল না হয়তো, এ-কথাও যেমন ঠিক, তেমনি এ-কথাও সত্য যে মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাবের কারণে ইংরেজ শাসকরাও হিন্দুদের মতো শিক্ষার সুযোগ মুসলমানদের দেন নি। আব্দুল লতিফ খান, সৈয়দ আমির হোসেন প্রমুখ বাংলার শিক্ষিত মুসলমান মুখপাত্রে আলোচনা থেকে, বিচারপতি ফিয়ার, রেভারেন্ড লঙ প্রমুখ বিশিষ্ট ইংরেজদের সমালোচনা থেকে এবং হিন্দু পেট্রিয়ট, দি বেঙ্গলি প্রভৃতি পত্রপত্রিকার মন্তব্যের মধ্যে মুসলমানদের গোঁড়ামির চাইতেও ইংরেজদের এই মুসলমান বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষত সিপাহী বিদ্রোহের পরে দীর্ঘকাল মুসলমান সমাজ যেন ছিল ব্রিটিশ সরকারের দুয়োরানী।

এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাক। ঊনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হল যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে তা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। নগরবাসী অভিজাত শ্রেণীর মুসলমান সমাজের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর এবং প্রধানত উর্দুভাষী। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গে মুসলমান মৌলবীরাও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা উর্দু ও ফারসী ভাষারই চর্চা করতেন, বাংলাভাষায় গদ্য বা পদ্য কিছুই লেখেন নি। কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির পরিচালক কমিটিতে চারজন মুসলমান সদস্য ছিলেন কিন্তু তাঁরাও কোনোকালে বাংলা ভাষার চর্চা করেন নি, তাঁদের উপর উর্দু ও ফারসী পুস্তক প্রণয়ন এবং তা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল। এমনকি ১৮৩১ সালে শেখ আমানুল্লাহ সম্পাদিত ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ এবং ১৮৪৬ সালে রজব আলী সম্পাদিত ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ পত্রিকাতে বাংলা লেখা হত বটে “কিন্তু তা ছিল উর্দু-ইংরেজী সংবাদের তরজমা মাত্র ; সে তরজমাও অত্যন্ত দুর্বল ছিল, বাংলা গদ্যের কোনো আদর্শ বহন করে নি তা।” আধুনিক মন ও মননের বাহন হিসাবে যে বাংলা গদ্যের বিকাশ হয়েছিল, ঐযুগে বাংলার মুসলমান তার অংশভাগী ছিল না। [৩১] পক্ষান্তরে, বাংলার মুসলমান জনসাধারণের বেশিরভাগটাই ছিলেন দরিদ্র গ্রামবাসী এবং তাদের ভাষা বাংলা। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে ভাষাগত তো বটেই, আসমান-জমিন সাংস্কৃতিক পার্থক্যও বিদ্যমান ছিল। ঊনিশ শতকের শেষভাগে যখন নগরবাসী অভিজাত মুসলমান নিজেদের দ্বিধা কাটিয়ে উঠে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তার সুফল কিন্তু গ্রামীণ অঞ্চলের সাধারণ মুসলমান সমাজ পায় নি। এই অভিজাতরা বাংলার সমগ্র মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব দাবী করলেন কিন্তু গ্রামবাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ-সাধনের জন্য কিছুই করলেন না। সালাহউদ্দীন আহমেদের মতে, “এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে নবাব আবদুল লতিফের মত ব্যক্তি নেহাৎ জাগতিক প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ঘোর রক্ষণশীল। সমকালীন মুসলমান সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে প্রতিহত না করে তিনি এগুলির সঙ্গে আপস করতে চেয়েছিলেন।” [৩২] এই প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে তাঁর বেশ তুলনা করা যায়। বরং সৈয়দ আমীর আলি তুলনামূলকভাবে কিছুটা প্রগতিশীল ছিলেন এবং তিনি মুসলমানদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার বদলে আধুনিক পাশ্চাত্য ও কারিগরী শিক্ষা প্রচলনের মতাবলম্বী ছিলেন। তিনি হাজার বছর আগে আলেমদের তৈরি করা ইসলামী বিধি ও অনুশাসনগুলিকে ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় যুক্তিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করবার প্রচেষ্টা করলেও সে সব আইনকানুন পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে উঠবার সাহস সঞ্চয় করতে পারেন নি।

১৮৮২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপণ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্তের জন্য উইলিয়াম হান্টারের সভাপতিত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান নেতা ও মুখপত্র আবদুল লতিফ লিখিতভাবে কমিশনকে বলেন যে, “নিম্নশ্রেণীর মুসলমান, যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয়, তাদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙলায় শিক্ষা দেওয়া চলতে পারে। তবে হিন্দু প্রভাবিত সংস্কৃত-শব্দবহুল বাঙলার মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন সংস্কৃত শব্দের পরিবর্তে বাঙলায় নূতন করে আরবি ফারসি শব্দসমূহ আমদানি করা অর্থাৎ বাঙলা ভাষাকে ‘উপযুক্তভাবে পরিশোধিত’ করা।” [৩৩] উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের জন্য লতিফ সাহেবের সুপারিশ ছিল অন্য রকম। তাঁদের জন্য তিনি উর্দু মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন কারণ, উর্দু না জানলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান মহলে কোনোপ্রকার গতিবিধি সম্ভব নয়। লতিফ সাহেবের আত্মজীবনী, ‘A short account of my life’ গ্রন্থ থেকে তথ্যসূত্র নিয়ে বদরুদ্দীন উমর দেখিয়েছেন, লতিফ সাহেব মনে করতেন, “উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানরা আরব, ইরান, তুর্কি ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলমান বিজেতা, শাসনকর্তা, ধর্মনেতা, আলেম প্রভৃতিদের বংশধর। অর্থাৎ তাঁরা বাঙালী নন, কাজেই বাঙলা তাঁদের মাতৃভাষাও নয়। সেই হিসেবে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের বাঙলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের প্রশ্ন তাঁর কাছে ছিল সম্পুর্ণ অবান্তর।” [৩৪]

হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন, মধ্যযুগেই “বাঙালি মুসলমান ভাষাপ্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল ; একগোত্রে ছিল গুটিকয় সুবিধাবাদী সুবিধাভোগী, যাদের স্বপ্নে ছিল ইরানতুরান, আরবিফারসি ; অন্য গোত্রে ছিল বিশাল বাঙালি মুসলমান শ্রেণী, বাংলাদেশ ও বাঙলাই ছিল যাদের বাস্তব ও স্বপ্ন। … আঠারো-ঊনিশ শতকেও একদল বিরুদ্ধতা করে যাচ্ছিল বাঙলা ভাষার সাথে ; কেউ কেউ প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল ফারসিকে, কেউ নতজানু হচ্ছিল ইংরেজির শুভ্র পদতলে। আবদুল লতিফ সরকারকে জানিয়েছিল মুসলমানের ভাষা উর্দু, বাঙলা নয়।” [৩৫] হুমায়ূন আজাদ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “আবদুল লতিফের মতো সুবিধাবাদী সমাজবিলগ্নরাই ঊনিশ-বিশ শতকে সৃষ্টি করে উর্দু-বাঙলা কলহ। সমাজবিলগ্নরা দাবী করতে থাকে যে উর্দুই মুসলমানের ভাষা; এক আহমরি ভাষা, যার পদ্যে পদ্যে ইসলামি সুগন্ধ আর পেশিতে ইসলামি জোশ ! অন্যদিকে বাঙলা অমুসলমানের ভাষা – ভীরু ও পৌত্তলিক। [৩৬] তাই এই সময়ের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতা হস্তচ্যুত অভিজাত মুসলমান সমাজ অন্ধ আক্রোশে পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সংস্কৃতি ইত্যাদি সবকিছুই বর্জন করেছেন, অন্যদিকে ‘অভিভাবকহীন’ বাংলার মুসলমান সমাজ সবার অলক্ষে একশ্রেণীর ধর্মান্ধের কুক্ষে কুক্ষিগত হলেন। “এরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ‘ফতোয়া’ জারি এবং কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ‘ জেহাদ’ ঘোষণা করল। সর্বোপরি এরা বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ধরণের ‘জগা-খিচুড়ি ভাষা ও তমদ্দুন’এর প্রবর্তন করল।” [৩৭]

ব্যতিক্রম কি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। তৎকালীন প্রগতিশীল মুসলমান সমাজের অন্যতম পুরোধা দেলওয়ার হোসেন বাংলার সকল শ্রেণীর মুসলমানদের দেশজ ভাষা শেখা ও চর্চা করবার উপর জোর দিয়েছেন বারেবারেই। তাঁর মতে অভিজাত শ্রেণীর শিক্ষিত নগরবাসী মুসলমান সমাজ বাংলাভাষাকে অবহেলা করবার ফলেই তাদের সঙ্গে গ্রামবাংলার মুসলমান জনসাধারণের চিন্তাধারার আদানপ্রদান হয় না। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে তীব্র আক্রমণ হেনে তিনি বলেছিলেন, “Utterly unsuited to the times, and it is a mere waste of means to supply people with what has no present value and will be of no future use.” [৩৮]

হুমায়ূন আজাদ লিখছেন, “কিন্তু বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ ও সমাজ-লগ্ন অংশটি নিজেদের স্বরূপ ও স্বদেশ ও ভাষা শনাক্তিতে ভুল করে নি।” [৩৯] সেই অংশের কিছু বক্তব্য হুমায়ূনবাবু তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছেন, যার কয়েকটি উদাহরণই বর্তমান প্রবন্ধে যথেষ্ট হবে। হামেদ আলী ‘বাসনা’ পত্রিকায় লেখেন, “আমাদের পূর্বপুরুষগণ আরব, পারস্য আফগানিস্তান অথবা তাতারের অধিবাসী হউন আর এতদ্দেশবাসী হিন্দুই হউন, আমরা এক্ষণে বাঙালী, আমাদের মাতৃভাষা বাঙলা।” মোহম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী ‘ কোহিনুর’ পত্রিকায় সগর্বে ঘোষণা করেন, “বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা বাঙলা, ইহা দিনের আলোর মতো সত্য।” সৈয়দ এমদাদ আলী ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-য় লিখেছিলেন, কেহ কেহ উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইলেও বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাঙলা এ বিষয়ে কোনো মতদ্বৈধ থাকা উচিত নয়।” পাঠকপাঠিকাগণ, এইখানে একটা প্রশ্ন রাখি – এই তিনজনের বক্তব্য মনে হচ্ছে কি যে, মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা নবজাগরণের যুগে উদ্ভূত আধুনিক বাংলাকে ব্রাত্য করে রেখেছিলেন? ঊনিশ শতকের শেষ দিকে আরবী-ফারসী নামওলা পত্রিকার সাথে একই সরণিতে বিরাজ করেছে ‘সুধাকর’, ‘মিহির’, ‘হিতকারী’, ‘লহরী’ ইত্যাদি নামের পত্রিকা।

বাংলা ভাষায় উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে আবদুল লতিফ যেমন তাদের মাতৃভাষায় সংস্কৃতি চর্চার উদ্যোগকে বিনষ্ট করেছিলেন তেমনই সৃষ্টি করেছিলেন একটি বিচ্ছিন্নতার মনোভাবও। বদরুদ্দীন উমরের মতে, “ঊনিশ শতকে আবদুল লতিফের এই বিভ্রান্তিকর জাতিতত্ত্বের পরবর্তী সংস্করণ যে বিশ শতকের মহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।” [৪০] এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে ঊনিশ শতকে যতখানি উন্নতি করতে সমর্থ হয়েছিল, মুসলমানরা তা করতে সক্ষম হয় নি।

পরিশেষে বলি, বদরুদ্দীন উমর একবার স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “বিদ্যাসাগর পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে যে গদ্যসাহিত্যের সৃষ্টি করেছেন সেই গদ্যরীতিই সমগ্রভাবে বাঙালীর দ্বারা স্বীকৃত, অনুসৃত এবং নব-নবরূপে রূপান্তরিত।” [৪১] আসলে বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের দ্বারা সৃষ্ট ও পুষ্ট ভাষা বাংলার সংস্কৃতিকে সাম্প্রদায়িকতার দোষ থেকে মুক্ত করতেই সাহায্য করেছে।

তথ্যসূত্র :

১) শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, এস কে লাহিড়ী এ্যান্ড কোং, ১৯০৯, পৃষ্ঠা ৭২
২) নরহরি কবিরাজ সম্পাদিত, ঊনিশ শতকের তর্ক ও বিতর্ক, কে পি বাগচি এ্যান্ড কোং, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ১২৩
৩) অরবিন্দ পোদ্দার, রেনেসাঁস ও সমাজমানস, উচ্চারণ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৭
৪) সোফিয়া ডবসন সম্পাদিত, লাইফ এণ্ড লেটারস অফ রাজা রামমোহন রায়, হেমচন্দ্র সরকার প্রকাশিত, ১৯১৪, পৃষ্ঠা ১০৭-১০৯
৫) নরহরি কবিরাজ সম্পাদিত, ঊনিশ শতকের তর্ক ও বিতর্ক, কে পি বাগচি এ্যান্ড কোং, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ১২৫
৬) এইচ সার্প, সিলেকশন ফ্রম এডুকেশনাল রেকর্ডস ১ম খণ্ড, ব্যুরো অফ এডুকেশন, ১৯২০, পৃষ্ঠা ১১৬
৭) অরবিন্দ পোদ্দার, ঊনবিংশ শতাব্দির পথিক, ইন্ডিয়ানা লিমিটেড, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ৩৬
৮) কার্ল মার্কস ফ্রেডরিক এঞ্জেলস রচনা সংকলন প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, ভারবি, ২০০০, পৃষ্ঠা ১২
৯) বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, ১৯৪৮, পৃষ্ঠা ৪০
১০) অরবিন্দ পোদ্দার, রেনেসাঁস ও সমাজমানস, উচ্চারণ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৯
১১) নরহরি কবিরাজ সম্পাদিত, ঊনিশ শতকের তর্ক ও বিতর্ক, কে পি বাগচি এ্যান্ড কোং, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ১২৭
১২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৭
১৩) রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস: আধুনিক যুগ, জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্স, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১২৯
১৪) বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বৎসমাজ, প্রকাশ ভবন, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ২২
১৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬
১৬) শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত, ‘জিজ্ঞাসা’ সংকলন, প্যাপিরাস, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৮০
১৭) বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১, পৃষ্ঠা ৩১১
১৮) ডাবলু ডাবলু হান্টার, দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ট্রাবনার এ্যাণ্ড কোম্পানী, ১৮৭৬, পৃষ্ঠা ১৫৮
১৯) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৫
২০) বদরুদ্দীন উমর, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, প্যাপিরাস, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৭
২১) বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, ১৯৪৮, পৃষ্ঠা ৭১
২২) বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বৎসমাজ, প্রকাশ ভবন, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ২৪
২৩) বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বুক ক্লাব, ২০০০, পৃষ্ঠা ১৮১
২৪) বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৪৭
২৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৯
২৬) বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বৎসমাজ, প্রকাশ ভবন, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ২৪
২৭) এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, অনন্যা, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৭৫
২৮) ডাবলু ডাবলু হান্টার, দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ট্রাবনার এ্যাণ্ড কোম্পানী, ১৮৭৬, পৃষ্ঠা ১৬৭
২৯) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭০
৩০) বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, ১৯৪৮, পৃষ্ঠা ৭২
৩১) ওয়াকিল আহমদ, ঊনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা, সাহিত্য একাডেমী, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৩৫
৩২) শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত, ‘জিজ্ঞাসা’ সংকলন, প্যাপিরাস, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৮১
৩৩) বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৩৫
৩৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৫
৩৫) হুমায়ূন আজাদ, বাঙলা ভাষার শত্রু মিত্র, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৮
৩৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯
৩৭) এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, অনন্যা, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৩১
৩৮) শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত, ‘জিজ্ঞাসা’ সংকলন, প্যাপিরাস, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৮০
৩৯) হুমায়ূন আজাদ, বাঙলা ভাষার শত্রু মিত্র, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৯
৪০) বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৩৫
৪১) বদরুদ্দীন উমর, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, প্যাপিরাস, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৪০

মন্তব্য তালিকা - “রেনেসাঁস, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বঙ্গীয় মুসলমান সমাজ”

  1. এমন লেখা শুধু ভালো বললে কম বলা হয়,
    বরং বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয় । বিশেষত আজকের বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বড় দুঃসময়, পড়ার লোক যে বাড়েনা।

  2. অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে চর্চা করেছ, শিবাশীষ । ‘বাংলার রেনেসাঁ’ নামক ফেনোমেননটিকে ঠিকঠাক বোঝাটা বাঙালি তথা সমগ্র ভারতীয় সমাজের আধুনিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করার পক্ষে অপরিহার্য, অথচ সে নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ও বিভ্রান্তি আছে । এই বিতর্ক ও বিভ্রান্তির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বাংলার রেনেসাঁতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ । রেনেসাঁর কুশীলবেরা মুসলমান ও নিম্নবর্গের বিরোধী ছিলেন, এমন একটা বোকা বোকা ভাসা ভাসা অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায় । অথচ বাংলায় যে মুসলমানদের বিকাশের একটি সম্পূর্ণ আলাদা ধারা আছে, এবং সেটাও আবার অভিজাত ও নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে আলাদা, এই কথাটা অনেকেই বোঝার চেষ্টা করেন না । এর পেছনে হিন্দু জমিদার ও মধ্যশ্রেণির সাম্প্রদায়িক মনোভাব যেমন আছে, তেমনিই মুসলমান সমাজের অভিজাত ও নিম্নবর্গীয় উভয় অংশেই আধুনিকতাবিরোধী মনোভাবও (আলাদা কারণে ও ধরনে যদিও) একটি বড় ব্যাপার । চাইলেই যে সে সমাজের বাইরে থেকে কেউ তার পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন না, এই কথাটা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না । আমাদের দেশে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের বিকাশের পথে গোড়া থেকেই এ এক সমস্যা ।

    1. অনেক ধন্যবাদ দেবাশিসদা। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে এটুকু বোঝানোর প্রচেষ্টা করেছি যে উনিশ শতকে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে নবজাগরণের ফুলটি না ফোটবার দায় স্রেফ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত ভুল দর্শন, তাদের নিজস্ব কিছু দায়দায়িত্বও ছিল।

      1. শুধু দায়িত্বের প্রশ্ন নয় ভাই, সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতিটাও বিবেচনার বিষয় । সব ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সব কিছু সম্ভব হয়না, সমাজে যে কোনও বড় পরিবর্তন ঘটতে গেলে তার পক্ষে উপযোগী কিছু প্রস্তুতি ও প্রেক্ষিত লাগে, এইটা না বুঝতে পারলে যে ইতিহাসচর্চার আর কোনও মানেই থাকেনা — এই সোজা কথাটা অনেকেই বুঝতে পারেন না ।

        এবং তারপরেও, শেষ সত্যিটা এটাই যে, মুসলমান নেতৃবর্গের এত পশ্চাৎপদতা ও সংরক্ষণশীলতা সত্ত্বেও মুসলমান সমাজকে তাঁরা নবজাগরণ ও আধুনিকতার ঢেউ থেকে চিরকালের জন্য সরিয়ে রাখতে পারেন নি । কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখের বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন, বেগম রোকেয়ার মত আধুনিকতাবাদী নারী-অধিকারপ্রবক্তা, আরজ আলি মাতুব্বরের মত সম্পূর্ণ নিরক্ষর কৃষক থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বশিক্ষিত যুক্তিবাদী নাস্তিক হয়ে ওঠা অত্যাশ্চর্য ফেনোমেনন — এ সব কিছুই ঘটতে পারত না তথাকথিত ‘হিন্দু মধ্যবিত্ত’ নবজাগরণটি না ঘটলে — যতই তা সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হোক । ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী চিন্তা ও মূল্যবোধের আভ্যন্তরীণ শক্তিটা ওইখানেই — ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে একবার ওটা ঢুকে পড়লে আর তাকে তাড়ানো যায় না ।

  3. খুব ভালো একটা লেখা। আধুনিকতার সাথে বাঙালি (এবং ভারতীয়) মুসলিমদের দূরত্বের বিষয়টি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আবেশ বা ঘোরের মধ্যে থাকা তথাকথিত অভিজাত এবং গ্রামীন তথা নিম্নবর্গের মুসলিমদের পার্থক্যও সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।
    ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।