ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ স্মরণে
শতবর্ষ পূরণের কিছুদিন আগে চলে গেলেন বিশ শতকের ইতিহাস চর্চার অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ (২৩ মে ১৯২৩ – ২৮ এপ্রিল ২০২৩) । অধ্যাপক গুহ এবং তাঁর সঙ্গীরা মিলে “নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা” নামে যে ইতিহাস রচনার ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন তার প্রভাব আমাদের দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও পৌঁছেছিল। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা যে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনীতি থেকে তার প্রেরণা সংগ্রহ করেছিল, সেকথা অধ্যাপক রণজিৎ গুহ নিজেই বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন।
ছাত্রাবস্থা থেকেই বাম এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন রণজিৎ গুহ। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশিষ্ট মার্কসবাদী অধ্যাপক সুশোভন সরকারের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। এম এ পাশ করার পর তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করার সময় জমিদারি শোষণ ও জনযুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। পার্টির কাজ নিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে। সেখানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ অবধি ছিলেন রণজিৎ গুহ। সদ্য বিপ্লবোত্তর চিনকে ১৯৪৯ এ স্বচক্ষে দেখার সুযোগও হয়েছিল তাঁর। দেশে ফেরার পরে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’য় নিয়মিত লিখতেন তিনি। তবে ১৯৫৬ সালে, স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায়, ক্রুশ্চেভ ঘোষিত নিস্তালিকীরণের দিনগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়া যখন হাঙ্গেরি আক্রমণ করে সেইসময়, সারা বিশ্বের নানা দেশের বহু বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো থেকে সরে আসছিলেন। রণজিৎ গুহও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। কিছুদিন বিদ্যাসাগর কলেজ, চন্দননগর কলেজ ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে পড়ানোর পরে এরপর তিনি পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান।
অধ্যাপক রণজিৎ গুহ আবারও সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছিলেন ৭০ এর দশকে। তিনি নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদার তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সি পি আই (এম এল) এর সঙ্গে বিভিন্ন সূত্রে এই সময় থেকে তাঁর এক নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল। কথিত কিন্তু অলিপিবদ্ধ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে তিনি পার্টিকে নানাসময় নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতাও করেছিলেন। গোপনভাবে এই কাজ করে চলার মধ্যে যে যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল তা বলাই বাহুল্য। এই সহায়তার লিখিত নথিপত্রও সেকারনে পাওয়া কঠিন। সি পি আই (এম এল) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা লিবারেশন পত্রিকার সম্পাদক সুনীতিকুমার ঘোষ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ানোর সময় রণজিৎ গুহর সহকর্মী ছিলেন। তাঁদের এই যোগাযোগ সেই সময় সহায়ক হয়েছিল।
সি পি আই (এম এল) রাজনীতির প্রথম ধারাটি ভেতরের কিছু ভুলভ্রান্তি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পড়ে দমিত হলো, কিন্তু অধ্যাপক রণজিৎ গুহ এই রাজনীতি থেকেই খুঁজে পেলেন ইতিহাসচর্চার নতুন দৃষ্টিকোণ। তিনি অনুভব করেছিলেন যে ভারতীয় ইতিহাস এতদিন হয়েছে মূলত উচ্চবর্গর দৃষ্টিকোণ থেকেই। নিম্নবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশের ইতিহাস চর্চা বা লেখালেখি কিছুই সেভাবে এতাবৎ হয় নি। এই ভাবনা থেকেই ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা’ নামক একটি নতুন ধারার জন্ম দিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। ইতালির মার্কসবাদী নেতা আন্তোনিও গ্রামশি মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট জমানায় জেলে থাকার সময় যে সব লেখালিখি করেছিলেন সেখানে তিনি বিশেষ প্রয়োজনে শাসকের দৃষ্টিকে আড়াল করার জন্য ‘সাব অল্টার্ন’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ অর্থে সামরিক ভাবে অধস্তন ব্যক্তি বোঝানো এই ‘সাব অল্টার্ন’ শব্দটির ব্যঞ্জনা গ্রামশির লেখায় শুধু প্রলেতারিয়েতের প্রতিশব্দ হিসেবেই সীমিত থাকে নি। এর সঙ্গে নিম্নবর্গের, বিশেষত কৃষকের সাংস্কৃতিক মনন ও মনস্তত্ত্বের দিকটিকেও নিবিড়ভাবে যুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি।
এই দেশে নিম্মবর্গের ইতিহাস চর্চা শুরুর অতি জরুরি কাজটিতে অধ্যাপক রণজিৎ গুহর বিশিষ্ট সহকারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী, অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, অধ্যাপক শাহিদ আমিন, অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ। ভারতীয় উপমহাদেশের নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। ১৯৮৩ সালে হয় সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম সম্মেলন। দু দশকের মধ্যেই এটির দশটি খণ্ড প্রকাশিত হয় এবং সমান্তরালভাবে অনুষ্ঠিত হয় ছটি সম্মেলনও। এতজন ইতিহাসবিদকে নিয়ে এই ধরনের সমবায়ী ও সমন্বয়ী একটা প্রকল্প কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চালানো সম্ভব হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গুহ খানিক রসাভাষেই জানিয়েছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হওয়ার পূর্বতন অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছে। সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম পাঁচ ছটি খণ্ড বেরনোর পর অবশ্য এই ধারায় একটা বড় বাঁকবদল করতে হয়েছিল, মূলত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের তোলা কিছু প্রশ্নকে ভিত্তি করে। নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র চৈতন্য অন্বেষণের সেই সঙ্গত প্রশ্নের পর নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা সামগ্রিকভাবে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল ইতিহাসে নিম্নবর্গের নির্মাণের প্রক্রিয়াগুলির বিশ্লেষণের প্রতি।
আমরা সবাই জানি যে কৃষক আন্দোলন এবং জমি আন্দোলনের ভিতে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নকশালবাড়ি আন্দোলন ছিল রণজিৎ গুহ’র নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার উদ্যোগের মূল ভিত। তাই অধ্যাপক গুহ’র নিজস্ব বইপত্রের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানে তিনি ভীষণভাবে নজর দিয়েছেন কৃষকের জীবন ও জীবিকার প্রশ্নের দিকে, তাঁর জমির অধিকার এবং জমির সুষম বন্টনের দিকে।
রণজিৎ গুহ স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট। ছয় খণ্ডের সেই বিস্তারিত রিপোর্ট মন দিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে উদ্ভূত নানা প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র গেছিলেন তাঁর মাস্টারমশাই নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের কাছে। কিন্তু সেই সময় প্রশ্নগুলির নিরসন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কিন্তু সেখানেই থেমে যান নি গবেষক রণজিৎ গুহ। ছাত্রজীবনের সেই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে এরপর তিনি ক্রমাগত অনুসন্ধান চালিয়ে গেছিলেন। এই অনুসন্ধান তথা সুবিশাল গবেষণার ভিতে তিনি লিখেছিলেন ‘এ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকা’ নামে বাংলায় প্রকাশিত) নামে একটি ছোট কিন্তু বীজগর্ভ বই। ১৯৬৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত এই বইটিই ছিল তাঁর প্রথম বই। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে বলেছিলেন ‘আধুনিক বাঙালি সমাজের ভিত্তি’ সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্মাণ কীভাবে হয়েছিল এই বইটিতে অধ্যাপক রণজিৎ গুহ সেইটিই দেখিয়েছিলেন।
সমকালীন ইংলণ্ড যখন সামন্ততন্ত্র ও বাণিজ্য পুঁজিবাদ ভেঙে অবাধ পুঁজিবাদের দিকে এগোচ্ছিল, উপনিবেশের দুনিয়াতে তখন জমিদারি প্রথাকে চিরস্থায়ী করার মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের নক্সাকে নতুন করে বাংলার বুকে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করছিল ঔপনিবেশিক শাসক। ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্রশিল্পের প্রসারের স্বার্থের সঙ্গে তাই মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে শুধু বাংলা আর ব্রিটেনকেই মেলান নি অধ্যাপক গুহ, বরং গোটা দুনিয়ার রাজনীতির জগতে ও চিন্তার দুনিয়ায় সে সময় যে পালাবদলের পর্ব চলছিল, তাকেও সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
রণজিৎ গুহ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিজয়যাত্রা শুরু হলেও ১৭৬৪ র বক্সার যুদ্ধের পর থেকেই এদেশের ভূমি ব্যবস্থার ইতিহাসে আসল বদল আসা শুরু হয়। প্রথম দশ বছরে পুরনো ব্যবস্থার ভাঙনের দিকটিই ছিল প্রধান। ভারতের স্বাধীন চাষী আর কারিগরদের স্বার্থকে পদদলিত করে কোম্পানী প্রাধান্য দিতে শুরু করে ব্রিটেনে কাঁচামালের রপ্তানী আর শিল্পদ্রব্যের আমদানিকে। চাষী ও কারিগরদের অনেকেই ভূমিহীন গরীব ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়। ১৭৭৬ সালে একদিকে মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হল ও অন্যদিকে কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকারের বিরুদ্ধে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে লেখা অ্যাডাম স্মিথের ম্যাগনাম ওপাস ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ প্রকাশিত হয়েছিল। রণজিৎ গুহ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন একদিকে কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বজায় রাখার জন্য পুরনো সামন্তী শক্তি আর নতুন বুর্জোয়া শক্তি কীভাবে ইংলণ্ডের পার্লামেন্টে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছে। এই বিতর্কে তখনও অবধি সামন্তীদের রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয় নি। এমনকী তাঁদের থেকে অর্থসাহায্য নিয়েই মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষের অনেককে, যেমন ১৭৮৪ র ভারত শাসন আইনের রচয়িতা পিটকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়েছিল ও মন্ত্রী পদে বসে সাহায্যের হিসেব মিটিয়ে দিতে কোম্পানির আমদানি করা চায়ের ওপর কর হ্রাস করতে হয়েছিল। তবে এতদ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বদল আসছিল। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট থেকে পিটের ভারত শাসন আইন ১৮৭৪ পর্যন্ত আইনী সংস্কারে এর ছাপ রয়েছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে থাকবে না ব্রিটিশ রাজের হাতে, তাই নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়া, ইঙ্গ ফরাসী দ্বন্দ্ব সহ নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা কীভাবে তাতে প্রভাব ফেলেছিল সেই সবও রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামন্তী পুঁজিবাদী দ্বন্দ্বের রেশ এদেশের কোম্পানি শাসনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল, কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেক্টরদের মধ্যে এই সংক্রান্ত চিন্তা ও নীতির দ্বন্দ্ব কী ধরনের ছিল, তার এক বিস্তারিত আলোচনা রণজিৎ গুহ করেছেন। এই আলোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপটের আখ্যানটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। এই দ্বন্দ্বের একদিকে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, অন্যদিকে ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। হেস্টিংস কোম্পানীর অধীনেই এদেশের জমির মালিকানা রেখে ইজারাদারদের হাতে রাজস্বের ভার দেওয়ার নীতির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো অবাধ পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষের লোকেদের মনে হয়েছিল জমির মালিকানা জমিদারদের হাতেই দিতে হবে। চিরস্থায়ী ভিত্তিতে জমির মালিকানা নিজেদের হাতে পেলে তবেই তারা কৃষির উন্নতির দিকে মনোযোগী হবে। কৃষির উন্নতি হলে তবেই দেশের আর্থিক বিকাশ সম্ভব হবে। জমিদারদের ফিলিপ ফ্রান্সিস ও মুক্ত পুঁজির পক্ষে থাকা অন্যান্য লোকেরা ধনী কৃষক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বড় জমিদারী ভেঙে অনেক বেশি পরিমাণ জমিদার তথা ধনী কৃষক সৃষ্টি করার দিকেও তাঁদের আগ্রহ ছিল। প্রথম পাঁচশালা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও রাজস্ব সংকটের প্রেক্ষিতে হেস্টিংসরাও বুঝতে পারছিলেন ইজারাদারী ব্যবস্থার অসাড়তা। ফলে নতুন এক বন্দোবস্তের দিকে তাঁরাও যেতে চাইছিলেন। জমির অধিকার জমিদার আর রায়তের মধ্যে কীভাবে বন্টিত হবে এই নিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস ও হেস্টিংসের মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ ছিল। হেস্টিংস ও বারওয়েল চেয়েছিলেন রায়তের সঙ্গে বন্দোবস্ত। কিন্তু রায়ত ও জমিদার উভয়ের অধিকারের মধ্যে ফিলিপ ফ্রান্সিস পুঁজিবাদী কৃষক ও কৃষির বিকাশের স্বার্থে জমিদারের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পক্ষেই দাঁড়ালেন। তবে রায়তের অধিকারের প্রশ্নে তার প্রজাসত্ত্ব ও পাট্টার গুরুত্ব ফ্রান্সিসকে মেনে নিতে হল। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সঙ্কট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখান যে ফ্রান্সিস ভেবেছিলেন কৃষকের তুলনায় অঢেল জমি থাকায় কৃষক শ্রমশক্তি বেচার ক্ষেত্রে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি উলটে যায় ও নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফজলুল হক মন্ত্রীসভা এই পরিপ্রেক্ষিতেই ফ্লাউড কমিশন গঠন করেন ও তার ছয় খণ্ডের বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ার পরেই রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
অধ্যাপক রণজিৎ গুহ যখন ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনগুলির ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা কৃষক চৈতন্য বা মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবছিলেন তখন আমরা বুঝতে পারি সেখানেও তাঁর কমিউনিস্ট শিকড়, নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদারের প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রভাব পড়েছে। Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India বইটি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। এই বইতে মার্কসবাদের প্রচলিত ধারাটিকে মনে রেখেও ভারতীয় কৃষকের চৈতন্যকে বোঝার জন্য কিছু নতুন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করা প্রয়োজন বলে রণজিৎ গুহর মনে হয়েছিল। কারণ কৃষকের চেতনায় একইসঙ্গে সংঘাত ও সমন্বয়ের দুই বিপ্রতীপ সূত্র কাজ করে। কীভাবে ইতিহাসবিদ কৃষক চৈতন্যের এই জটিলতাকে ধারণ করবেন তার সমস্যাবলী নিয়ে এই বইতে নানা কথা তুলেছিলেন রণজিৎ গুহ। উপরোক্ত বইদুটির পাশাপাশি রণজিৎ গুহর ইংরাজীতে লেখা অন্যান্য বইপত্রের মধ্যে অন্যতম; History at the limit of world history, Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, The Small Voice of History ইত্যাদি।
জীবনের শেষ তিন দশকে রণজিৎ গুহ মূলত লিখেছিলেন বাংলা ভাষাতেই। তবে এই সময়কালে ইতিহাসের পরিধি ছাড়িয়ে সাহিত্য, দর্শন এবং বাঙালি মনীষার অবদানের নানা দিককেও ছুঁতে চেয়েছিল তাঁর লেখালিখি৷ তিনি যেমন মনে করতেন ইতিহাসকে কেবল শুষ্ক দলিল দস্তাবেজ থেকে বোঝার একদেশদর্শিতা থেকে সরতে হবে, তেমনই সাহিত্যের সাহায্য ইতিহাসবোধ গঠন ও তাকে উপলব্ধির ক্ষেত্রে অপরিহার্য বলেও তিনি বিশ্বাস করতেন। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অধ্যাপক গুহ যেমন লিখেছিলেন, তেমনই তিনি লিখেছিলেন জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণকে নিয়ে। সমান্তরালভাবে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুর মতো তাঁর সমকালীন আধুনিক কবিদের রচনাকেও।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায় অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ছিলেন তাই। অসামান্য মৌলিক চিন্তাশক্তির অধিকারী এক ইতিহাসবিদের পাশাপাশি সেই পরিচয়ও তাঁকে নিত্য স্মরণীয় করে রাখবে।
আকর
· A rule of property for Bengal : an essay on the idea of permanent settlement, Paris: Mouton & Co., 1963, New edition: Duke University Press,
· Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India, Oxford University Press, Delhi, 1983, New edition: Duke Univ Press, 1999,
· An Indian Historiography of India: A Nineteenth Century Agenda & Its Implications. Calcutta: K.P. Bagchi & Company. 1988.
· Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, Harvard University Press, 1998
· The Small Voice of History, Permanent Black, 2009
· Subaltern Studies (Ed) – Vol 1 to 10 – Oxford University Press
· রণজিৎ গুহ রচনা সংগ্রহ – আনন্দ পাবলিশার্স
রনজিৎ গুহ একজন শ্রদ্ধেয় গবেষক ও লেখক। জীবন সায়াহ্নে তাকে আর এস এস -‘এর আক্রমণের শিকার হতে হয় ব্যাঙ্গালোরে। ফ্রান্সিস ফ্লাউড ৬ খণ্ডের রিপোর্টের নির্যাস নেপাল মজুমদার দেশহিতৈষী শারদ সংখ্যায় লিখেছিলেন। তা অনেক দিন আগে। তার দু’দশক পরে যখন তেভাগার পথ ধরে বইটি লেখার প্রস্তুতি শুরু করি তখন আর তা খুঁজে পাই নি। যদিও ঐ বইটির জন্য তার বিশেষ প্রয়োজনও হয় নি। কিন্তু নেপাল বাবুর ঐ নিবন্ধটা হারিয়ে যাওয়ায় আফশোষ হয়। আপনারা যদি কেউ ঐ রিপোর্টের মূল বিষয়গুলি নিয়ে আলোকপাত করতে পারেন, তবে ভালো হয়।