বিদ্যার জাহাজ: রামেন্দ্রসুন্দর
(এক)
২০২০ সালের ১২ই জুলাই একটি বহুলপ্রচারিত দৈনিকের পাত্র/পাত্রী কলমে নিম্নলিখিত এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল।
“পঃবঃ সরকারী অফিসার (30+, 6′) বৈদিক ব্রাহ্মণ (আচার্য্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী পরিবারের) পিতা পঃবঃ সরকারের কর্মরত (IAS)-র একমাত্র পুত্র। কলিকাতায় নিজস্ব বাসস্থান। উচ্চ পরিবারের শিক্ষিতা, ধর্মপরায়ণা, মার্জিতা, রুচিশীলা, দীর্ঘাঙ্গী, ২৫ এর মধ্যে সুন্দরী ব্রাহ্মণ পাত্রীর (সরকারি চাকুরীরতা এবং কলকাতা নিকটস্থ অগ্রগন্যা) অভিভাবকরা যোগাযোগ করুন। সত্ত্বর বিবাহে ইচ্ছুক। পিতা …। যোগাযোগ…”
পাত্রপুরুষটি বিজ্ঞানভিক্ষু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘আদর্শ’উত্তরসূরি-ই বটে !
আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কথা যখন উঠলোই তখন এই সুযোগে দুকথা আলোচনা করা যেতেই পারে এই বিরল শিক্ষাবিদের প্রসঙ্গে।
ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্ব। বাংলাভাষায় আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা তখন সবে খানিকটা সাবালক হয়ে উঠেছে। ঠিক ওই অবস্থায় বঙ্গসাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভূত হলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যাঁর বিজ্ঞান রচনায় যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, তীক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও মৌলিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া গেল, বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্যে তা অভিনব। সে যুগে বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলিকে রামেন্দ্রসুন্দর যেরূপ সহজ সরল করে মনোজ্ঞ ভাষায় সর্বসাধারণের জন্য পরিবেশন করেছিলেন, বলা যায় এর আগে তা এমন কেউ করেন নি।
এইখানে একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই জেগে উঠছে আপনাদের মনে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞান চর্চাকারী আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কথা লিখতে বসে লেখাটা এমন অদ্ভুতভাবে আরম্ভ করলাম কেন? সত্যি কথা বলতে কি এইরকম ধান ভানতে শিবের গীত গাইবার একটি গূঢ় কারণ আছে। হয়তো প্রবন্ধ শেষে সুধী পাঠক পাঠিকারা সেই কারণটির দর্শন পেলেও পেতে পারেন।
(দুই)
১৮৬৪ সালের ২০শে আগস্ট (বাংলা ১২৭১ সালের ৫ই ভাদ্র) মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দিতে অঞ্চলের জেমো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রামেন্দ্রসুন্দর। বাবা গোবিন্দসুন্দর ত্রিবেদী এবং মা চন্দ্রকামিনী। শুনলে অবাক হতে হয়, যে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত হয়েছেন রামেন্দ্রসুন্দর, তিনি কিন্তু জন্মসূত্রে বাঙালী ছিলেন না। জীবনীকার আশুতোষ বাজপেয়ীর মতে রামেন্দ্রসুন্দরের পূর্বপুরুষ মনোহররাম তেওয়ারি “বন্ধুলগোত্র বন্ধুলাঙ্গিরস-বার্হস্পত্যপ্রবর যজুর্ব্বেদান্তর্গত মান্ধ্যাদিন শাখাধ্যায়ী জিঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ”[১]সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জিঝৌতিয়া ব্রাহ্মণরা কনৌজিয়া বা কান্যকুব্জ শ্রেণীর একটি শাখা। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা আদতে মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল এবং চম্বল উপত্যকার অধিবাসী। সম্ভবত মারাঠা দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে অথবা মুঘল দ্বারা নিগৃহীত হয়ে, কয়েকঘর জিঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ বাংলাদেশে এসে পুণ্ডরীক গোত্রে উৎপন্ন ফতেসিংহ রাজবংশকে আশ্রয় করে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অন্তর্গত ফতেসিংহ পরগণায় বসবাস আরম্ভ করেন। রামেন্দ্রসুন্দরের পূর্বপুরুষ মনোহররাম ও হৃদয়রাম এইভাবেই তাঁর জন্মের দুশো বছর আগে থেকেই মুর্শিদাবাদে এসে জেমোকান্দির নিকটে টেঁয়াগ্রামে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এই তিন চার পুরুষে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাঁদের সকলেরই মোটামুটিভাবে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল এবং এক অর্থে তারা বাঙালিদের মতই বাংলার চর্চা করতে শিখেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, গোবিন্দসুন্দর ত্রিবেদী ‘বঙ্গবালা’নামে একটি বাংলা উপন্যাস লেখেন। উপন্যাসটির ভূমিকা পয়ার ছন্দে লেখা। রামেন্দ্রসুন্দরের অন্যতম জীবনীকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতে, “এই ভূমিকাটি পাঠ করলে মনে হয়, আলস্য ও জড়তার মোহপাশে আবদ্ধ বাঙালী জাতিকে তিনি দেশরক্ষার মুক্তিযজ্ঞে এবং কর্ম কোলাহলের মধ্যে অবতরণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।”[২]গোবিন্দসুন্দরের সাহিত্যপ্রীতি ও দেশপ্রেম উত্তরাধিকারসূত্রে পুত্র রামেন্দ্রসুন্দরের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল বলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান।
পাঁচ বছর বয়সে পদার্পণ করবার পর রামেন্দ্রসুন্দরের বিদ্যাচর্চার আয়োজন করা হল। পিতা ও পিতৃব্যের প্রচেষ্টায় ঘরেই বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ সমাপ্ত হলে তাঁকে ভর্তি করা হয় জেমোর পাঠশালায়। বাল্যকাল থেকেই গণিতে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেল। পাটিগণিত, জ্যামিতি ও শুভঙ্করী বিষয়ক সমস্যার সমাধানে ছোটবেলা থেকেই তিনি সুপটু ছিলেন। ১৮৭০ সালে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করা হল। প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থানটি ছিল তাঁর বাঁধা। এগারো বছর বয়সে ছাত্রবৃত্তি পাওয়ার পর ১৮৭৬ সালে তিনি ভর্তি হলেন কান্দি ইংরেজি স্কুলে। এখানেও একইরকম প্রতিভার নিদর্শন রাখেন রামেন্দ্রসুন্দর। তবে শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, পাঠ্যতালিকার বহির্ভূত বহু জ্ঞানগর্ভ বই পড়বার অভ্যাস তাঁর মধ্যে দেখা যায় স্কুল জীবন থেকেই। রামেন্দ্র-চরিতকার আশুতোষ বাজপেয়ী লিখেছেন, “এন্ট্রান্স স্কুলে পড়িবার সময় রামেন্দ্রসুন্দরের পাঠাভ্যাস-প্রবৃত্তি অতিমাত্র প্রবল হইয়া ওঠে। নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ব্যতিরেকে তিনি নানা বিষয়ের নানাবিধ পুস্তক পাঠ করিয়া প্রভূত জ্ঞানসঞ্চয় করিয়াছিলেন। তখন তিনি এলফিনস্টোন, গ্রীন, হিউম, গিবন প্রভৃতি রচিত বড় বড় গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন।”[৩]
এইসময়ে রামেন্দ্রসুন্দরের জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনার আগেই ১৮৭৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জেমো রাজপরিবারের নরেন্দ্র নারায়ণের কনিষ্ঠ কন্যা ইন্দুপ্রভা দেবীর সাথে রামেন্দ্রসুন্দরের বিয়ে হল। আর তিনি যখন হাইস্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র তখন প্রয়াণ ঘটল তাঁর পিতা গোবিন্দসুন্দরের।
রামেন্দ্রসুন্দর ১৮৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন। কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। আরম্ভ হল রাশিরাশি ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের বই পড়া। ১৮৮৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন রামেন্দ্রসুন্দর এবং একটি স্বর্ণপদক ও বৃত্তি পেলেন। বি.এ পড়বার সময় তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হল বিজ্ঞানশাস্ত্রে। একই কলেজ থেকে ১৮৮৬ সালে বিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন রামেন্দ্রসুন্দর। এবার তিনি বৃত্তি পেলেন মাসিক চল্লিশ টাকার। বৃত্তি পেলেন পরবর্তী পরীক্ষা এম.এ-তেও। ১৮৮৭ সালে এম.এ পরীক্ষায় বিজ্ঞানশাস্ত্রে স্বর্ণপদক ও পুরস্কারসহ প্রথম স্থান অধিকার করলেন।
আগেই বলেছি, রামেন্দ্রসুন্দর শৈশবকাল থেকেই মেধাবী ছিলেন। সেকালের প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত রসায়ন শিক্ষক আলেকজ়ান্ডার পেডলার-এর মতে, এরকম তীক্ষ্মধী ছাত্র তিনি এদেশে আর পাননি। পেডলার সাহেব একবার রামেন্দ্রসুন্দরের উত্তরপত্র পরীক্ষা করবার পর পরের দিন ক্লাসে এসে বলেন, “আমি এ পর্যন্ত যত রসায়নের কাগজ দেখিয়াছি তম্মধ্যে এইখানি ‘out of the way the best’।”[৪]এই পেডলারসাহেবের অনুপ্রেরণাতেই এম.এ পরীক্ষার পর রামেন্দ্রসুন্দর ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ’বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। ১৮৮৮ সালে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পেলেন তিনি। অবিশ্বাস্য মনে হবে, ওই বৃত্তির পরিমাণ তখনকার দিনে ছিল আট হাজার টাকা।
(তিন)
শুনলে অবাক হতে হয়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কর্মজীবনের সূত্রপাত হয়েছিল শিক্ষক বা অধ্যাপক হিসেবে নয়, বরং পরীক্ষক হিসেবে। ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার ভূগোলের পরীক্ষক নিযুক্ত হলেন তিনি। ইতিমধ্যে এই কৃতি ছাত্রটির কাছে একাধিক লোভনীয় চাকুরীর অফার আসা শুরু হল। ওই বছরই বাঙ্গালোর কলেজে অধ্যক্ষ ও মানমন্দিরের তত্ত্বাবধায়কের পদ গ্রহণের প্রস্তাব আসে রামেন্দ্রসুন্দরের কাছে। শিক্ষাগুরু পেডলার সাহেবের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, তাঁর প্রিয় ছাত্র ওই পদটি গ্রহণ করেন। কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর ততদিনে স্থির করে নিয়েছেন যে বাঙালীর শিক্ষা ও সাধনার প্রাণকেন্দ্র কলকাতাতে থেকেই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা করবেন। তাই তিনি বাঙ্গালোর গেলেন না। ১৮৯১ সালে রিপন কলেজে (পরবর্তীকালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) বি.এ-তে বিজ্ঞানের পাঠক্রম শুরু হল। কলেজের কর্মকর্তাদের প্রস্তাবে পরের বছর রামেন্দ্রসুন্দর পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের অধ্যাপক রূপে রিপন কলেজে যোগ দিলেন।
গতানুগতিক শিক্ষক ছিলেন না রামেন্দ্রসুন্দর। শোনা যায় রসায়ন পড়ানোর সময়ে তিনি প্রথমেই সরাসরি পাঠ্যবিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন না। বরং প্রথমে রাসায়নিক পরীক্ষা দেখিয়ে ছাত্রদের কৌতূহলের উদ্রেক করতেন। তারপর পরীক্ষিত বিষয়টি সহজ করে বাংলায় ব্যাখ্যা করতেন। রামেন্দ্রসুন্দরের সময় বিজ্ঞানশাস্ত্র ইংরেজি ভাষার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল, দূর্বোধ্য বিদেশি ভাষা আয়ত্ত করে বিজ্ঞান শিক্ষা দুরূহ ছিল, তখন এই বাঙালী অধ্যাপক বিজ্ঞানের জটিল তথ্যগুলো সহজতর করার জন্য বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। সেসব বক্তৃতা শোনার জন্য বিভিন্ন কলেজের ছাত্র এসে ভিড় করত তার কাছে।
অধ্যাপক হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দরের কৃতিত্ব অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেল। ১৮৯৪ সালে সেনেটের সদস্য হলেন তিনি। দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি সেনেটের সদস্য ছিলেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ — এই ছয় বছর তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের ‘Mathematical & Experimental Board of Study’র সভ্য। ইতিমধ্যে ১৯০৩ সালে তিনি রিপন কলেজ পরিচালনার দায়িত্বভার পেলেন। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ দীর্ঘ ষোলো বছর তিনি কলেজটির অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামেন্দ্রসুন্দর অধ্যাপনা করেন নি বটে, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের সঙ্গে তিনি বরাবরই জড়িয়ে ছিলেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও বিজ্ঞান শাখার সভ্য ছিলেন বারো বছর। মাতৃভাষায় তথা বাংলায় শিক্ষাদান ছিল তাঁর একনিষ্ঠ লক্ষ্য। যে পদেই থাকুন না কেন, বরাবরই তিনি বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছেন। বস্তুত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসার করবার জন্য রামেন্দ্রসুন্দরের মধ্যে যেন একপ্রকার জেদ কাজ করতো। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলা ভাষায় সাধারণ পাঠকের কাছে বিজ্ঞান প্রচার তাঁর একটি অসাধ্য সাধন কাজ। বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধন উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি বিজ্ঞানী হয়েও সার্থক সাহিত্যিক। এই ব্যাপারে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি — ১৯১৪ সালে কলকাতা টাউন হলে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনে বিজ্ঞান শাখার সভাপতি ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেশকরূপে বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। তিনি এর প্রতিবাদস্বরূপ প্রবন্ধ পাঠ প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, “ইংরেজি রচনায় আমি অভ্যস্ত নহি। বাংলা ভাষায় লিখিবার অনুমতি দিলে আমি ‘বেদ’সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়িতে পারি।”[৫]শেষে উপাচার্য স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী বাংলাতেই তাঁকে প্রবন্ধ পাঠের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধের এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সেই সম্মেলনের প্রদত্ত ভাষণে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন, “বাঙলা ভাষা এখনও বিজ্ঞান প্রচারের যোগ্য হইতে বিলম্ব রহিয়াছে৷ কিন্তু এই বিলম্ব ক্রমেই অসহ্য হইয়া পড়িতেছে। এ বিষয়ে অবহিত হইবার জন্য আপনাদিগকে অনুরোধ করিতেছি৷ মাতৃভাষাকে এতদ্বর্থে সুগঠিত করিয়া লইবার জন্য যে যত্ন ও পরিশ্রম আবশ্যক, আপনাদিগকেই তাহা করিতে হইবে। সম্মেলনের বিজ্ঞান শাখা যদি বঙ্গভাষার এই অঙ্গের পুষ্টি সাধনে সাহায্য করে, তাহা হইলে তাহার অস্তিত্ব নিরর্থক হইবে না৷ আমাদের বাঙ্গালা ভাষা বর্তমান অবস্থায় যতই দরিদ্র এবং অপুষ্ট হউক, উহা দ্বারা বিজ্ঞানবিদ্যার প্রচার যে একেবারে অসাধ্য তাহা স্বীকার করিতে আমি প্রস্তুত নহি। আমি আশা করি এই সাহিত্য সম্মেলনে যাঁহারা বিবিধ বিজ্ঞানের আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের কৃতকার্যতাই আমার বাক্য সমর্থন করিবে। এমন এক সময় ছিল, যখন স্কুল এবং কলেজের শিক্ষক এবং অধ্যাপকগণ আপনাদের মধ্যে এবং ছাত্রগণের সহিত কথোপকথনে বাঙ্গালার ব্যবহার বেয়াদপি বলিয়া গণ্য করিতেন। এখনও সর্ব্বত্র সেই ভাব চলিত আছে কিনা জানি না। ক্লাশে বসিয়া অধ্যাপনার সময় বাঙ্গালার ব্যবহার বোধহয়, এখনও অধিকাংশ স্থলে লজ্জার হেতু বলিয়া বিবেচিত হয়। আমি স্বয়ং অধ্যাপনা ব্যবসায়ী। বিজ্ঞানবিদ্যার সহিত আমার আর কিছু সম্পর্ক থাকুক না থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারণ অনুসারে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যার অধ্যাপনাই আমার জীবিকারূপে গ্রহণ করিয়াছি এবং সেইজন্য অন্ততঃ জীবিকার অনুরোধে যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞান আলোচনাও আমাকে করিতে হইয়াছে। অধ্যাপকের আসনে বসিয়া বাংলাভাষায় অধ্যাপনা যদি আপনারা অপরাধ বলিয়া গণ্য করেন, তাহা হইলে আমার মতো অপরাধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্ঘমধ্যে খুঁজিয়া মিলিবে না।”[৬]‘মানসী’পত্রিকার বৈশাখ ১৩২১ সংখ্যায় রামেন্দ্রসুন্দরের এই অভিভাষণটি ছাপা হয়। পরবর্তীকালে স্থান পায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্রের প্রথম খণ্ডে।
চার)
সাহিত্য সম্বন্ধীয় ভারতের অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্ৰাণস্বরূপ ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। ১৩০১ বঙ্গাব্দের ১৪ই শ্রাবণ রামেন্দ্রসুন্দর সাহিত্য পরিষদের সভ্য হন। এর মাত্র কয়েকমাস আগে, ১৭ই বৈশাখ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গঠিত হয়েছিল। পরিষদের কার্যালয় ছিল শোভাবাজারের মহারাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের বাড়িতে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৪ঠা ফাল্গুন কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে পরিষদের কার্যালয় স্থানান্তরিত হল। কিন্তু ভাড়া বাড়িতে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, অতএব চাই নিজস্ব ভবন। রামেন্দ্রসুন্দর তাই পরিষদের জমি সংগ্রহ ও ভবন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। কাশিমবাজারের মহারাজা মণিন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সৌজন্যে সার্কুলার রোডে সাত কাঠা জমি পাওয়া গেল। কিন্তু গৃহ নির্মাণের অর্থ কোথায়? রামেন্দ্রসুন্দর হাল ছাড়লেন না, স্রেফ অর্থের অভাবে সাহিত্য পরিষদের নিজস্ব গৃহ নির্মাণের কাজ পণ্ড হবে — এমন একটা পরাজয় তিনি মেনে নিতে রাজি হলেন না। সাহিত্য পরিষদকে যথাসাধ্য সাহায্যের জন্য দেশবাসীর কাছে একটি উদাত্ত আহ্বান জানালেন রামেন্দ্রসুন্দর ‘ভারতী’পত্রিকার বৈশাখ ১৩১২ সংখ্যায়। ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ’শীর্ষক সেই প্রবন্ধে একটি মর্মস্পর্শী ও আন্তরিক আবেদন জানালেন রামেন্দ্রসুন্দর — “চাই এখন বঙ্গবাসীর সহানুভূতি — লোকবল চাই আর অর্থবল চাই।গরীবের দেশের গরীব সভা ভিক্ষার ঝুলি স্কন্ধে করিয়া স্বদেশীর নিকট দাঁড়াইয়াছে ; বাঙ্গালা ভাষায় যাঁহার অনুরাগ আছে, বাঙ্গালা সাহিত্যে যাঁহার শ্রদ্ধা আছে, বাঙ্গালীর ইতিহাস যিনি জানিতে চাহেন, তিনি সেই ঝুলিতে মুষ্টিভিক্ষা অর্পণ করুন। ভিক্ষাভাণ্ডে মাসে মাসে আট আনা প্রদান করিয়া তাঁহারা সাহিত্য পরিষদের সাধু সংকল্পে সহায়তা করুন। যাঁহারা এই ভিক্ষাদানে অসমর্থ, তাঁহারাও পরিশ্রম দিয়া সাহায্য করতে পারেন। পুরাতন পুঁথি সংগ্রহ করিয়া দিন ; প্রাদেশিক গল্প সংগ্রহ করিয়া, ব্রতকথা, গ্রাম্য কবিতা, গ্রাম্য গান, ছেলেভুলানো গল্প, গ্রাম নগর পীঠস্থান দেবস্থান প্রভৃতির বিবরণ, দেবস্থানীয় ইতিহাসের টুকরো, কিংবদন্তীর ভগ্নাংশ, যাহা কিছু দুই চোখে দেখিতে পান, দুই হাতে কুড়াইয়া পান, পরিষদের কার্যালয় লক্ষ্য করিয়া সবেগে নিক্ষেপ করিতে থাকুন। পরিষৎ ভিক্ষুক, পরিষৎ তাঁহাদিগকে বেতন দিবার ক্ষমতা রাখেন না, তাঁহারা দয়া করিয়া পরিষৎকে ভিক্ষা দিন।”[৭]
অবশেষে রামেন্দ্রসুন্দরের একান্ত প্রচেষ্টায় লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের কাছ থেকে পরিষদের গৃহ নির্মাণের অর্থ যোগাড় হল। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ২১শে অগ্রহায়ণ পরিষদের নিজস্ব ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন হল। এই অনুষ্ঠানের পূর্বে রামেন্দ্রসুন্দর যে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, পরিষদের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকা উচিত। শোনা যায়, কলেজ থেকে প্রায় দিনই বাড়ি ফিরতেন না তিনি, চলে যেতেন পরিষদে। বাড়িতেও সারাক্ষণ ওই একই চিন্তা। জীবনসঙ্গিনী ইন্দুপ্রভা দেবী রসিকতা করে নাকি বলতেন, “সাহিত্য-পরিষদ হল তাঁর সতীন।”[৮]বাস্তবিক অর্থেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ছিল রামেন্দ্রসুন্দর ধ্যান-জ্ঞান। সাহিত্যসেবীরা এখানে মিলিত হয়ে সাহিত্যের উন্নতিকল্পে আলাপ আলোচনা করবেন, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার করে স্বদেশের উন্নতি বিধান করবেন — এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। জলধর সেনের ভাষায়, রামেন্দ্রসুন্দর “প্রকৃত পক্ষে ছিলেন তাহার ঋত্বিক ও আচার্য, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘এক মাত্র সারথি’।”[৯]
(পাঁচ)
রামেন্দ্রসুন্দরের মৃত্যুর পর ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৮ই শ্রাবণ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট সভাঘরে রামেন্দ্র স্মৃতিসভায় পঠিত বক্তৃতায় সাহিত্যিক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর সম্বন্ধে একটি কালজয়ী মন্তব্য করেছিলেন। সুরেশচন্দ্র বলেছিলেন, “দর্শনের গঙ্গা, বিজ্ঞানের সরস্বতী ও সাহিত্যের যমুনা — মানব চিন্তার এই ত্রিধারা রামেন্দ্র-সঙ্গমে যুক্তবেণীতে পরিণত হইয়াছিল।”[১০]বাস্তবিক অর্থেই সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন — তিনটি বিষয়েই রামেন্দ্রসুন্দরের পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। বিজ্ঞানের ছাত্র, বরং বলা ভালো বিজ্ঞান-তাপস হলেও প্রকৃত অর্থে যাকে বিজ্ঞানী বলা হয়, তা কিন্তু তিনি ছিলেন না। কারণ বিজ্ঞানের কোনো বিষয় নিয়ে তিনি কোনোদিন গবেষণা করেন নি, পরীক্ষাগারে বসে কোনও বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার দ্বারা কোনও নুতন তত্ত্ব বা তথ্যও আবিষ্কার করেন নি। তাই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মুল কৃতিত্ব এই যে, তিনি কোনও মৌলিক গবেষণা বা আবিষ্কার না করে মূলত লেখনীর মাধ্যমেই একজন বিজ্ঞানী ও শাস্ত্রজ্ঞের মর্যাদা লাভ করেছেন। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি যেভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও সূত্রের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন, এক কথায় তা অনন্যা। আবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দার্শনিক তত্ত্বের মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যাতেও তিনি পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। ‘বঙ্গসাহিত্যে বিজ্ঞান’গ্রন্থের লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতে, “রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনায় যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণকুশলতা ও মৌলিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া গেল, তা একক ও অভিনব।”[১১]বাস্তবিকই, বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলি রামেন্দ্রসুন্দর যেমন সহজ সরল করে বুঝিয়েছেন, ইতিপূর্বে কোনও বিজ্ঞানলেখকই তা করতে সফল হন নি। বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্যে তা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ছাড়াও তিনি দর্শন ও সংস্কৃত শাস্ত্রের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সহজ বাংলায় পাঠকের উপযোগী করে তুলে ধরেছিলেন। ঘরোয়া ও সরস ভঙ্গীতে বিজ্ঞানের তত্ত্বকথাকে উপস্থাপনের এই অনবদ্য রীতি রামেন্দ্রসুন্দরের একান্ত নিজস্ব শৈলী৷
রামেন্দ্রসুন্দর বহু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন। তবে তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্গত সেই সকল প্রসঙ্গ যা জগৎ-তত্ত্বের মুল রহস্য অনুসন্ধান করে। কারণ তাঁর বিজ্ঞানসাহিত্যের মুল ভিত্তিভূমি ছিল দর্শন — প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ই। জলধর সেন লিখেছেন, “রামেন্দ্রসুন্দরের কর্মজীবন ছিল শিক্ষা বিভাগে এবং শিক্ষকের কাৰ্যে, মাত্র বিজ্ঞানের বা রসায়নের পরীক্ষার গৃহেই তিনি তাঁহার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতেন না ; পরন্তু সভ্য মানবসমাজের অতীত ইতিহাসের গুপ্ত মর্মকথা বলিবার নানা ভাবে নানা চেষ্টা তিনি করিয়াছেন। জীবতত্ত্ব হইতে আরম্ভ করিয়া তিনি মিশর, হিব্রু, গ্রিক ও রোমক ইতিহাসের আলোচনা করিয়া ভারতের সভ্যতার সহিত তাহার সামঞ্জস্য বিধান করিতে বহু শ্ৰম স্বীকার করিয়াছেন।”[১২]এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানের দর্শনের মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসেও ছিল রামেন্দ্রসুন্দরের আকর্ষণ। তিনি বলেছিলেন, “বিজ্ঞান — বিজ্ঞান — আমরা বিজ্ঞান চর্চ্চা করিব। যেন পদার্থবিদ্যা, আর রসায়নশাস্ত্র আর দেহতত্ত্ব লইয়াই বিজ্ঞান ! যেন কলের গাড়িতে আর টিনের কানেস্তারেই বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ ! মানবতত্ত্ব যেন বিজ্ঞানের পরিধির বাহিরে — ইতিহাসালোচনা যেন বিজ্ঞানের সীমার বহির্গত !”[১৩]
তাঁর বিজ্ঞান সাহিত্যে যুক্তিবাদী আলোচনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করা এবং শব্দাড়ম্বর ও বাহ্যাড়ম্বর এড়িয়ে সুসমঞ্জস যুক্তিসম্মত সত্যে পৌঁছোনোর বিষয়টা তাঁর স্বকীয় অসাধারণ ক্ষমতাকেই প্রকাশ করে ৷ রামেন্দ্রসুন্দরের সাহিত্যজীবনের শুরু সেই পাঠদ্দশায়। তাঁর প্রথম রচনা ‘মহাশক্তি’শীর্ষক প্রবন্ধটি নবজীবন পত্রিকায় ১২৯১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ভারতী’ও ‘সাধনা’পত্রিকা ও অন্যান্য সাহিত্যপত্রে একের পর এক তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধসমূহ লিখিত ও প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধগুলিতে বিষয় হিসেবে স্থান পায় পৃথিবীর বয়স সংক্রান্ত বিতর্ক, রেডিয়েশনের তরঙ্গতত্ত্ব, আণবিক তত্ত্ব, কসমিক ক্যাটাস্ট্রফির সম্ভাব্যতা, মাধ্যাকর্ষণ, লাইট স্পেকট্রাম, থার্মোডিনামিকসের নীতিসমূহ৷ এছাড়াও তিনি বিজ্ঞানের পরিসর (scope), পদ্ধতি (method) ও তাৎপর্য (spirit) নিয়েও প্রবন্ধ রচনা করেন৷ প্রথম গ্রন্থ ‘প্রকৃতি’প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। এই গ্রন্থে তিনি ডারউইন, হেলমহোলৎজ, কেলভিন, হার্ৎজ, ম্যাক্সওয়েল, ও হাক্সলি প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকদের আবিষ্কৃত তথ্যাদিকে ভিত্তি করে আলোচনা করেছেন। ১৯০৪ সালে রচিত ‘জিজ্ঞাসা’গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান-দর্শনের এমনকিছু প্রশ্ন নাকি তুলেছিলেন যা যুগে যুগে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের ভাবিয়েছে। তাঁর অপর গ্রন্থ ‘বিচিত্র জগৎ’তাঁর মৃত্যুর পর ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর শেষ গ্রন্থ ‘জগৎ কথা’প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে।
রামেন্দ্রসুন্দর কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেন মধ্যে ১৮৯১ সালে রচিত ‘Aids to Natural Philosophy’ গ্রন্থখানি বিখ্যাত। বাংলায় রচিত রামেন্দ্রসুন্দরের প্রথম বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘পদার্থবিদ্যা’র, প্রকাশ ১৮৯৩ সালে। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা ভাষায় রচিত এযাবৎকালের সমস্ত গ্রন্থই গ্যানো রচিত পদার্থবিদ্যার গ্রন্থকে অবলম্বন করেই রচিত হয়েছিল৷ গ্যানোর ব্যাখ্যাপ্রনালী অনেক স্থলেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। রামেন্দ্রসুন্দরও গ্যানোকে অনুসরণ করলেও গ্যানোর গ্রন্থের ত্রুটিগুলি পরিহার করেন তিনি। ‘ভূগোল’প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে, ‘বিজ্ঞান কথা’ও বিজ্ঞান পাঠ’১৯০২ সালে।
বৈজ্ঞানিক পরিভাষা প্রচলিত করবার ব্যাপারে রামেন্দ্রসুন্দর বরাবরই সচেতন এবং আগ্রহী ছিলেন। সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নিয়ে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধগুলি হল, ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা’, ‘রাসায়নিক পরিভাষা’, ‘বৈদ্যক পরিভাষা’, ‘ভৌগোলিক পরিভাষা’এবং ‘শারীরবিজ্ঞান পরিভাষা’। প্রবন্ধগুলি পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শব্দকথা’গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘মায়াপুরী’রামেন্দ্রসুন্দরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। বস্তুত দর্শনের ভিত্তির উপর সমস্ত রচনাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বিজ্ঞানই আলোচ্য গ্রন্থের মুল উপজীব্য। এই প্রবন্ধে বিজ্ঞানের যান্ত্রিক দিকের বদলে তার মননগত দিকটির প্রতিই বিজ্ঞানীর আকর্ষণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক জড় জগৎকে স্বার্থসাধনে নিয়োগ করিয়া জীবনযুদ্ধে সাহায্য লাভ করিতেছেন বটে ; কিন্তু এই জগতের প্রতি চাহিয়া, এই জগতের নিয়ম-শৃঙ্খলা আবিষ্কার করিয়া, এই জগতের আঁধারে আলোক আনিয়া, এই জগতের অজ্ঞানাধিকৃত অংশে জ্ঞানের অধিকার প্রসার করিয়া বৈজ্ঞানিক যে পরম আনন্দ লাভ করেন, যাহার নিকট এই টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন, ডাইনামো ও মোটর, বৈদ্যুতিক ট্রাম ও বৈদ্যুতিক আলো, স্টিমশিপ আর এরোপ্লেন অতি তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর পদার্থ।”[১৪]
(ছয়)
কেবলমাত্র বিজ্ঞান, দর্শন বা সাহিত্যজগতে বুঁদ হয়ে থাকা নয় — রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। এবং তখনকার বুদ্ধিজীবীদের একটা বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যেও মূর্ত হয়েছিল — এখনকার বুদ্ধিজীবীদের মতো শাসকগোষ্ঠীর ধামাধরা ছিলেন না তাঁরা। ইতিমধ্যে বাংলার বুকে নেমে এসেছে বঙ্গভঙ্গের ঘোর দুর্যোগ। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। ১৩১২ বঙ্গাব্দের ৩০শে আশ্বিন। বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক দিনটিতে কলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে সারা বঙ্গদেশ জুড়ে পালিত হল অরন্ধন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধী প্রতিক্রিয়ায় রামেন্দ্রসুন্দর মাসখানের মধ্যেই রচনা করেন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা (১৯০৬) গ্রন্থখানি। দেশ ও জাতির সংকটপূর্ণ সময়ের সন্ধিক্ষণে অসামান্য রচনা, প্রায় তিন হাজারের মতো শব্দ সংখ্যা দিয়ে যা স্বদেশপ্রেমের সুসংবদ্ধ রূপ নিয়ে সৃষ্ট, ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’, ‘বঙ্গদর্শন’এর ১৩১২ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞান লেখক রামেন্দ্রসুন্দর এখানে স্বদেশপ্রেমিক৷ জাতীয়তাবোধ, স্বাদেশিকতা এসব মানসিকতা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমেই একটা সুস্পষ্ট মূর্তিতে বাঙালি মানসে জেগে উঠছিল — সেই সময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই যেন ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’-র অভিনব সৃষ্টি যার শেষাংশে রামেন্দ্রসুন্দর এই ব্রতের উদযাপনের পদ্ধতি বিবৃত করেছিলেন নিম্নলিখিত ভাষায় — “প্রতি বৎসর আশ্বিনে বঙ্গবিভাগের দিনে বঙ্গের গৃহিণীগণ বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত অনুষ্ঠান করিবেন। সে দিন অরন্ধন। দেবসেবা ও রোগীর ও শিশুর সেবা ব্যতীত অন্য উপলক্ষে গৃহে উনুন জ্বলিবে না। ফলমূল চিড়ামুড়ি অথবা পূর্ব্বদিনের রাঁধা-ভাত ভোজন চলিবে। পরিবারস্থ নারীগণ যথারীতি ঘট স্থাপন করিয়া ঘটের পার্শ্বে উপবেশন করিবেন। বিধবারা ললাটে চন্দন ও সধবারা সিন্দুর লইবেন। হরীতকী বা সুপারি হাতে লইয়া বঙ্গলক্ষ্মীর কথা শুনিবেন। কথাশেষে বালকেরা শঙ্খধ্বনি করিলে পর ঘটে প্রণাম করিবেন। প্রণামান্তে বাম হস্তের (বালকের দক্ষিণ হস্তের) প্রকোষ্ঠে স্বদেশী কার্পাসের বা রেশমের হরিদ্রারঞ্জিত সূত্রে পরস্পর রাখী বাঁধিয়া দিবেন। রাখীবন্ধনের সময় শঙ্খধ্বনি হইবে। তৎপরে পাটালি প্রসাদ গ্রহণ করিবেন। সংবৎসরকাল যথাসাধ্য বিদেশী, বিশেষতঃ বিলাতী দ্রব্য বর্জ্জন করিবেন। সাধ্যপক্ষে প্রতিদিন গৃহকৰ্ম্ম আরম্ভের পূর্বে লক্ষ্মীর ঘটে মুষ্টিভিক্ষা রাখিবেন এবং মাসান্তে বা বৎসরান্তে উহা কোনরূপ মায়ের কাজে বিনিয়োগ করিবেন।”[১৫]
এই সময়েই কংগ্রেসের চরমপন্থী ধারার একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পাই, যিনি নরমপন্থী বা মডারেটদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে ফেলছেন এবং আবেদন-নিবেদনের রাজনীতিকে বারংবার প্রত্যাখ্যান করছেন। চরমপন্থী দলের শীর্ষস্থানীয় বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল অথবা অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও চরমপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন পরিসরে তাঁর উপস্থিতি লক্ষণীয়। সেই সময়ের চরমপন্থীদলের আন্দোলনের রূপরেখা, বিশেষত স্বদেশী, পল্লীসংস্কার এবং জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন — ইত্যাদি কর্মসূচীতে ‘স্বদেশী সমাজ’প্রবন্ধের স্পষ্ট অনুপ্রেরণা ছিল। এই প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মন্তব্য লক্ষণীয় — “স্বদেশীর আগুন যখন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তখন রবীন্দ্রনাথের লেখনী তাহাতে বাতাস দিতে ত্রুটি করে নাই। বেশ মনে আছে, ৩০শে আশ্বিনের পূৰ্ব্ব হইতে হপ্তায় হপ্তায় তাঁহার এক একটা নূতন গান বা কবিতা বাহির হইত, আর আমাদের স্নায়ুতন্ত্ৰ কাঁপিয়া আর নাচিয়া উঠিত। নিষ্ফল ও অনাবশ্যক আস্ফালনে তিনি কখনই উপদেশ দেন নাই ; কিন্তু সে সময়টায় যে উত্তেজনা ও উন্মাদনা ঘটিয়াছিল, তাহার জন্য রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব নিতান্ত অল্প ছিল না।”[১৬]
বয়কট আন্দোলনে গ্রামের গরীব কৃষিজীবী মানুষের কাছ থেকে যে কোনও সাড়া পাওয়া যায় নি, বয়কটের তাৎপর্য যে তাঁরা বোঝেন নি ; এটা রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। গ্রামের নিরক্ষর কৃষিজীবীদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি ছিল না যে, তা নয় ; কিন্তু তাকে জাগিয়ে তুলতে হলে একটা দীর্ঘদিনের প্রয়াস প্রয়োজন, এটাই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য। অর্থাৎ জন-সংযোগের মাধ্যমে গণ-চেতনার বৃদ্ধি। ‘প্রবাসী’পত্রিকার শ্রাবণ ১৩১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনে গ্রাম সংগঠনের তাৎপর্য সম্বন্ধে অবহিত করান যদিও সেই প্রস্তাব নরমপন্থী বা চরমপন্থী — কেউই গ্রহণ করবার আগ্রহ দেখান নি। ‘প্রবাসী’র আশ্বিন সংখ্যায় লিখিত একই নামের প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো বক্তব্যের বিরোধিতা করলেও তাঁর অবদানের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত প্রস্তাব সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দরের বক্তব্য ছিল — “উত্তেজনার বশে আমরা দুই বৎসর ধরিয়া ইংরেজের অনুগ্রহ লইব না, ইংরেজের শাসনযন্ত্র অচল করিয়| দিব বলিয়া লাফালাফি করিয়া আসিতেছি ; এবং ইংরেজ রাজা যখন সেই লাফালাফিতে ধৈৰ্য্যভ্রষ্ট হইয়া লগুড় তুলিয়া আমাদের গলা চাপিয়া ধরিয়াছেন, তখন আমাদের সেই অস্বাভাবিক আস্ফালনের নিষ্ফলতা দর্শনে ব্যথিত হইয়া রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন — ও পথে চলিলে হইবে না — মাতামাতি লাফালাফির কৰ্ম্ম নহে, নীরবে ধীরভাবে কাজ করিতে হইবে। … কাজ করিতে হইবে — এই কথাটা নূতন নহে। আমাদের আস্ফালনের ও চীৎকারের মাত্রা যখন চরমে উঠিয়াছিল, তখনও এক দল — যাহারা বিজ্ঞের দল বলিয়া পরিচিত, তাহারা কেবলই বলিতেছিলেন — চীৎকার ছাড়, কাজ কর। দুঃখের বিষয় এই যে, তাহারাও ‘কাজ কর’, ‘কাজ কর’বলিয়া চীৎকার করিয়া কেবল চীৎকারের পরিমাণই বাড়াইতেছিলেন, উপদেশের পরিবর্তে তাঁহারা স্বয়ং কিঞ্চিৎ কাজ করিলে আমরা একটা কৰ্ত্তব্যের আদর্শ দেখিতে পাইতাম, দেশও উপকৃত হইত। … এ পক্ষ হইতে বলা হইতেছিল, কেন — আমরা কি কেবলই চেঁচাইতেছি? কাজ কি কিছুই করিতেছি না? শ্রাবণের ‘প্রবাসী’রই ‘কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য’প্রবন্ধে সাক্ষ্য দিতেছে, আমরা এক বৎসরে ভারতে আমদানি কাপড়ের মূল্য ৩৯ কোটি টাকা হইতে ৩৭ কোটি টাকায় নামাইয়াছি, ইহা কি কাজ নহে? আর এই ষে বঙ্গলক্ষ্মী মিল, শিক্ষা-পরিষৎ, টেকনিক্যাল ইনষ্টিটুট ইত্যাদি, এ সকল কি কাজ নহে? … রবীন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই এ কাজকে নগণ্য বলিয়া উপেক্ষা করেন না, বরং উহাদিগকে গণ্য করিয়াই আরও একটু ভিতরে যাইয়া তিনি বলিতেছেন, কেবল বড় বড় কাজ কেন, আরও ছোট ছোট কাজ আমাদের অনেক আছে, যে যেমন ব্যক্তি, সে তেমনই ভাবে আপনার ক্ষমতার অনুযায়ী কাজ হাতে লইয়া লাগিয়া যাও, দেশে গাঁয়ে গাঁয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শান্তিরক্ষা, কৃষি, শিল্প, অন্নদান, বিচার ইত্যাদি সহস্র ছোটবড় কাজ আমাদের কর্ত্তব্য রহিয়াছে, উহাতে যে যেমন পার লাগিয়া যাও। … দল পাকাইয়া কাজ করিবার ক্ষমতা থাকে, ভাল ; দল পাকাইতে না পার, আপনার চেষ্টায় যে যা পার হাতে লও, তাহাতেই স্বদেশের সহিত প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপিত হইবে, স্বদেশকে অন্তরঙ্গভাবে আত্মীয়ভাবে চিনিতে পারিবে, স্বজাতি একটা জীবন্ত রক্তমাংসে গঠিত পদার্থ বলিয়া জানিতে পারিবে। রবিবাবুর উপদেশের তাৎপর্য্য আমি ইহাই বুঝিয়াছি। আরও বুঝিয়াছি যে, রবিবাবু কেবল ‘কাজ কর’, ‘কাজ কর’, বলিয়া উপদেশ দিয়৷ চিৎকারের মাত্রাই বাড়াইতেছেন না, বরং কোন পথে কাজ করা যাইতে পারে, তাহার দুই একটা নমুনাও নিজের হাতে লইয়া দেখাইতেছেন।”[১৭]
(সাত)
আগেই বলেছি, দর্শন ছিল রামেন্দ্রসুন্দরের অতীব প্রিয় সাবজেক্ট। সাংখ্যদর্শনের কাছে জার্মান দর্শনের ঋণ কতটা, রামেন্দ্রসুন্দর এই সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বহু আলোচনা করিয়াছিলেন। তাঁর একটি দার্শনিক প্ৰবন্ধ অধ্যাপক নিখিলনাথ মৈত্র জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং তা জার্মানীর সেরা একটি দার্শনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং শোনা যায় সে দেশের দার্শনিক মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। জলধর সেনের ভাষায়, “পাশ্চাত্য দেশে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি ম্যাক্সওয়েল” বা কেলভিনের ন্যায় খ্যাতিলাভ করিতেন।”[১৮]
বিজ্ঞানালোচনা করতে গিয়ে ‘বিচিত্র জগৎ’গ্রন্থে ‘বিজ্ঞান-বিদ্যায় বাহ্য জগৎ’প্রবন্ধের প্রারম্ভে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন, “আমি যেভাবে আলোচনা করিব, সেভাবে আর কেহ আলোচনা করিয়াছেন কি না, তাহা আমি জানি না। দার্শনিক-সাহিত্যে আমার বিদ্যার দৌড় যতটুকু, তাহাতে আমি বলিতে পারিব না যে, অন্য কেহ এরূপ আলোচনা করেন নাই। যদি কেহ আমার সমর্থন করিয়া থাকেন বা করেন, তাহাতে আমার আনন্দই হইবে।”[১৯]নিঃসন্দেহে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা তাঁর হাতেই সাবালকত্ব লাভ করে, অক্ষয়কুমার দত্তের অসামান্য প্রারম্ভিক অবদানের কথা মনে রেখেও একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। অথচ রামেন্দ্রসুন্দরের পরের প্রজন্মের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞানদর্শনের, বরং বলা যায় তাঁর জীবনদর্শনের, প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। কি ছিল এই চিন্তা-সংঘাতের বিষয়বস্তু তা নিয়ে আলোচনা করবার আগে রামেন্দ্রসুন্দরের আরও কয়েকটি অবদান নিয়ে সামান্য আলোচনা করতে হবে।
আমরা দেখেছি, রামেন্দ্রসুন্দর সাহিত্যসাধনার যাত্রা শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানের আলোকোদ্ভাসিত পথ ধরে। কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির রহস্যভেদ করতে গিয়ে তাঁর মনে যে প্রশ্নগুচ্ছের উদয় হচ্ছিল বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার তাদের উত্তর মিলছিল না। বস্তুত এইখান থেকেই বিজ্ঞানের আলোকময় পথ ছেড়ে দর্শনের কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যময় পথে রামেন্দ্রসুন্দরের যাত্রা আরম্ভ হল। ‘মায়াপুরী’প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, “প্রত্যক্ষগোচর, অনুমানলব্ধ ও কল্পিত, এই তিন অংশ একত্র করিয়া বৈজ্ঞানিক বিশ্বজগতের একটি মূর্ত্তি গড়িয় লইয়াছেন। বিশ্বজগতের প্রকৃত মূর্ত্তি যে কি, তাহা কোনও বৈজ্ঞানিকের জানিবার উপায় নাই। তাঁহার কয়টা ইন্দ্রিয় প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের ফলে অভিব্যক্ত হইয়াছে, তদ্দ্বারা রূপ রস গন্ধ শব্দ স্পর্শ ভিন্ন আর কোনও কিছু জ্ঞানগম্য বা কল্পনাগম্য হইবার উপায় নাই। যদি ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা অধিক থাকিত, অথবা এই ইন্দ্রিয়গুলিই অন্যরূপ জ্ঞানের আমদানি করিত, তাহা হইলে জগতের মূর্ত্তিও তাহার নিকট অন্যরূপ হইত।”[২০]
প্রায় একই রকমের উক্তি দেখতে পাওয়া যায় ‘বিজ্ঞানের পুতুলপূজা’প্রবন্ধটিতেও, “যে সকল জাগতিক সত্য লইয়া আমরা স্পর্ধা করি ও তাহাদিগকে সনাতন সার্বভৌমিক সত্য বলিয়া নির্দেশ করি, মূল অন্বেষণ করিলে দেখা যাইবে, উহারা সর্বত্রই মনঃকল্পিত সত্য। সত্যরূপী পরম দেবতা কোথায় কিভাবে আছেন আমরা জানিনা ; আমরা কেবল ‘উপাসকানাং সিদ্ধ্যর্থং’কতকগুলা মনগড়া পুতুল স্বহস্তে নির্মাণ করিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়াছি এবং ঢাক-ঢোল বাজাইয়া তাহাদের পূজা করিতেছি। … আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয় যেভাবে যেরূপে আমাদের জানায়, তেমনিভাবে সেইরূপে আমরা জানিতে পারি। দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ প্রভৃতি পরিচিত ব্যাপারের উপযোগী বর্তমান ইন্দ্রিয়গুলি না থাকিয়া অন্য কোনওরূপ ব্যাপারের উপযোগী অন্য কোনওরূপ ইন্দ্রিয় যদি আমাদের থাকিত, তাহা হইলে আমাদের প্রত্যক্ষ জগতের মূর্তি সম্পূর্ণ অন্যরূপ হইত। … এবং বিজ্ঞানশাস্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় সেই একই জগতের মূর্তির অন্যরূপ বিবরণ দিত।”[২১]‘জ্ঞানের সীমানা’প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বললেন, “জড়জগতের অস্তিত্ব কল্পনামাত্র। এই কল্পনা জীবনরক্ষার একটা উপায় বা কৌশল। প্রকৃতি করাইতেছেন, তাই যথানিযুক্তবৎ করিতেছি।”[২২]
সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই রামেন্দ্রসুন্দরের এই দর্শনটারই বিরোধিতা করেছেন। আশীষ লাহিড়ী ‘অন্য কোনো সাধনার ফল গ্রন্থে রামেন্দ্রসুন্দরের ১৯১৩ সালে প্রকাশিত ‘বিচিত্র জগৎ’গ্রন্থে লিখিত তাঁর বিজ্ঞান-দর্শনের মূল বক্তব্যটি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনা অতি কঠিন দার্শনিক আলোচনা, তবে সে আলোচনার নির্যাস বোধহয় এই যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু মেঘনাদ সাহার মতোই নিজেও ছিলেন বাস্তববাদী কাজেই বাস্তব জগতের প্রকৃত অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর মনে কোনও সংশয় ছিল না। “তিনি জানেন, পদ্ধতিতন্ত্র নিয়ে, যৌক্তিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে কতরকম কঠিন বিধিনিষেধের বাধা পার হয়ে তবে বিজ্ঞান কোনও একটা ধারণাকে সাময়িকভাবে সত্য বলে স্বীকার করে। সেই সত্য পুরোপুরি না হোক, আংশিকভাবে বাস্তব জগৎকে অনুধাবন করার কাজে লাগে। অথচ রামেন্দ্র বিজ্ঞানের এই অনন্যতাকে অস্বীকার করছেন, বলছেন বিজ্ঞানীর জগৎ আসলে এক কাল্পনিক জগৎ। বৈদান্তিক মায়াবাদের প্রভাব এখানে খুবই স্পষ্ট। একদিকে বৈদান্তিক মায়াবাদ, অন্যদিকে বেদপন্থী সমাজের স্বপ্ন, এই দুয়ের মধ্যে পরিষ্কার সাযুজ্য দেখতে পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ।”[২৩]
রামেন্দ্রসুন্দরের পাণ্ডিত্য ছিল বহুমুখী। বিজ্ঞানদর্শনের পথে চলতে গিয়ে তিনি ফিরে তাকালেন বেদ-ব্রাহ্মণ-আরণ্যক উপনিষদের প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে। স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিয়ে ভাবলেও তখনও এদেশের শাস্ত্রগ্রন্থসমূহের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেনি। সে পরিচয় লাভ করবার আকাঙ্খা জাগলো দীঘাপতিয়া রাজবংশের শরৎকুমার রায়ের প্রভাবে। এই প্রথম রামেন্দ্রসুন্দরের মনে হল, “আমাদের দেশের পুরাতন কথা যে আমরা জানি না বা জানিবার যত্নও করি না, এবং ইহার অপেক্ষা লজ্জার বিষয় আমাদের পক্ষে আর কিছুই হইতে পারে না …।”[২৪]বেদচর্চা শুরু করলেন রামেন্দ্রসুন্দর এবং যথারীতি এক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করলেন, যার প্রমাণ পাওয়া গেল ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’এর বঙ্গানুবাদ (১৯১১) ও ‘যজ্ঞকথা’ (১৯২০) গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে।
‘যজ্ঞকথা’প্রবন্ধের প্রারম্ভে বেদপন্থী সমাজের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর এবং এই সমাজে যজ্ঞের উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলছেন, “আমাদের যে সমাজের চলিত নাম হিন্দু-সমাজ, আমি সেই সমাজকে বেদপন্থী সমাজ বলিব। এই সমাজ বেদের শাসন মানে এবং বেদের আনুগত্য স্বীকার করে। বেদপন্থী সমাজের প্রধান অনুষ্ঠানই যজ্ঞানুষ্ঠান।”[২৫]‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’এর বঙ্গানুবাদ করবার সময়ে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন, “ভারতবর্ষের বেদপন্থী সমাজে জন্মিয়া ভারতবর্ষের পুরাতনী বিদ্যার অজ্ঞতা নিতান্ত ভাগ্যহীনতার লক্ষণ বলিয়া আমি বোধ করিতাম। এই সুযোগ অবলম্বনে সেই মহতী বিদ্যার যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান লাভ করিতে পারিব, এই প্রলোভন ত্যাগ করিতে আমি সমর্থ হই নাই।”[২৬]এর ফলে পাওয়া গেল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’এর একটি সুন্দর বাংলা অনুবাদ, যা পড়ে শান্তিনিকেতন থেকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিতে লিখেছিলেন, “ব্রাহ্মণটির শরীরের আয়তন দেখিয়া আমার মনে হইল যে, ব্রাহ্মণভোজন বৈদিকযুগের যাগযজ্ঞের মুখ্যতম উদ্দেশ্য ছিল — দ্যুদেবদের তুষ্টিসাধনের সঙ্গে ভূদেবদের পুষ্টিসাধন অবিচ্ছেদ্য সৌহার্দ্য-সূত্রে বাঁধা ছিল। ব্রহ্মবাদীরা মাঝে মাঝে আসিয়া detective officer-দিগের ন্যায় খানাতল্লাসী করিতেছেন — আর ব্রাহ্মণটি চটপট তাহার একটি সদুত্তর দিয়া আপনাকে সাফাই করিতেছেন — ইহার ন্যায় সরস সামগ্রী কোথাও আমি দেখি নাই — অতি চমৎকার ব্যাপার !”[২৭]
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর এইরূপ বিজ্ঞানের সাথে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে মেলাতে যাওয়ার পদ্ধতি তাঁকে একপ্রকার ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায় যার তীব্র সমালোচনা করেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। রামেন্দ্রসুন্দর লিখিত ‘যজ্ঞকথা’ও অনুবাদিত ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’গ্রন্থদুটি এবং আরও কিছু প্রবন্ধে একাধিকবার দেখা গেল তিনি বেদপন্থী সমাজের হয়ে ওকালতি করছেন এবং বর্ণাশ্রমবাদ ইত্যাদি প্রাচীন কুপ্রথাগুলিকে জাস্টিফাই করবার চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ১৯১০ সালে লিখিত ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেছিলেন — “আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ। আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি ; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। … আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না — ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়। তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই।”[২৮]রবীন্দ্রনাথের শেষোক্ত বক্তব্যটি সম্বন্ধে চূড়ান্ত দ্বিমত পোষণ করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘প্রবাসী’পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’প্রবন্ধে। রামেন্দ্রসুন্দর লিখেছেন, “বাঙ্গলা দেশের অনেক স্থানে এক আসনে হিন্দু মুসলমান বসে না, ঘরে মুসলমান আসিলে এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, ইহার জল ফেলিয়া দেওয়া হয় ; ইত্যাদি যে কয়টি কারণের উল্লেখ রবিবাবুর প্রবন্ধমধ্যে দেখিলাম, সে কারণগুলিকে ততটা ভয়াবহ মনে করি না। হিন্দুর শাস্ত্রে এরূপ বিধান থাক আর নাই থাক, মুসলমানেরা ইহা জানেন যে, হিন্দু জ্ঞানে হউক, অজ্ঞানে হউক, উহা শাস্ত্রবিধানবৎই মানিয়া থাকেন। আজকাল রাগের মাথায় হিন্দুর বিরুদ্ধে অছিলা খুঁজিতে গিয়া মুসলমানেরা যদি ঐ সকল কথার উল্লেখ করিয়াও থাকেন, তথাপি ইহা সত্য যে, বহুকালের একত্র বাসে বাঙ্গলা দেশের মুসলমান হিন্দুর ঐরূপ ব্যবহারে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছেন এবং হিন্দুর ঐ ব্যবহার যে মুসলমানের প্রতি ঘৃণার ব্যঞ্জক নহে, কেবল হিন্দুর শাস্ত্রভক্তি বা লোকাচারভক্তিরই ফল মাত্র, তাহাও মানিয়া লইয়াছেন। ঐ ব্যবহারের আমি কোনরূপ সমর্থন করিতেছি না এবং ঐ ব্যবহারের মূলে যে ঘৃণা নাই, তাহাও বলিতেছি না। মূলে ঘৃণা থাকিলেও উহা এখন সামাজিক প্রথা বা convention মাত্রে পরিণত হইয়াছে। হিন্দু যেমন পুতুল পূজা করে, সেইরূপ পান, আহার, উপবেশন প্রভৃতি বিষয়েও কতকগুলি অদ্ভূত নিয়মের বাধ্য বলিয়া আপনাকে মনে করে, — মুসলমান সমাজ ইহা বহু বৎসরের একত্র বাসে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, এবং একত্র সদ্ভাবে বাস করিতে হইলে এ বিষয়ে হিন্দুকে ক্ষমা করিয়া চলিতে হইবে, ইহাও মুসলমান সমাজ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। … ফলে আজ পূৰ্ব্ববঙ্গে হিন্দু মুসলমান সমাজে যে বিদ্বেষের উৎপাত দৃষ্ট হইতেছে, তাহাতে আতঙ্কিত হইবার তেমন কারণ দেখি না। মুসলমান যে কারণেই হউক ক্ষণেকের জন্য আত্মবিস্মৃত হইয়া, হিন্দু প্রতিবেশী ও হিন্দু ভ্রাতার মনে দারুণ ক্লেশ দিয়াছেন, কিন্তু কালে তাহারা আপনার ভ্রম বুঝিতে পারিবেন, সন্দেহ করি না।”[২৯] এক্ষেত্রে একটাই কথা বলবার আছে, স্বদেশী বিশেষত চরমপন্থী আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন স্তরে ক্রমাগত হিন্দুপ্রতীকগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে যে এই বিদ্বেষের আগুনে বাতাস দিয়ে চলেছেন তা রবীন্দ্রনাথ বুঝলেও বেদপন্থী রামেন্দ্রসুন্দর বুঝতে পারেন নি।
এই কারণেই সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের রক্ষণশীলতার পক্ষে “সাফাই গাইবার প্রবৃত্তিটি বোধহয় বেদপন্থী ত্রিবেদীসন্তানের মধ্যে প্রবেশ করল। তার নিদর্শন পাই তাঁর ‘নানা কথা’র মধ্যে।”[৩০] সত্যেন্দ্রনাথ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। আমরাও কয়েকটি দেওয়ার চেষ্টা করি। ‘ইংরেজি শিক্ষার পরিণাম’প্রবন্ধে মাঝারি মাপের কেরানি-উৎপাদক ঔপনিবেশিক শিক্ষাকলের প্রতিকার হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দর পুরাকালের বিশুদ্ধ বৈদিক শিক্ষা ও সমাজপ্রণালী ফিরিয়ে আনার কথা বললেন, “ভারতবর্ষের, অর্থাৎ যে দেশের মধ্যে এক সুবৃহৎ মানবসম্প্রদায় অতি প্রাচীন কাল হইতে কেবল জ্ঞানার্জ্জনের জন্য ধনলালসা ও ভোগাকাঙ্খা পরিত্যাগ করিয়া চিরজীবন পর্ণকুটির ও শাকান্ন লইয়া তৃপ্ত থাকিত। অধ্যয়ন ও অধ্যাপন ভারতের ব্রাহ্মণের জীবনের ব্রত ছিল। তাহার কোষে অর্থ ছিল না, তাহার হস্তে তরবারি ছিল না ; অধ্যয়ন ও অধ্যাপন মাত্র ব্রত করিয়া সে জীবনের সমুদয় ভোগাকাঙ্খা বিষর্জ্জন দিয়াছিল ; এবং এই গরীয়ান স্বার্থ-সংহারের জন্য সমাজ তাহাকে শীর্ষ স্থানে বসাইয়া পূজা করিত। অদ্যাপি চতুষ্পাঠীর ব্রাহ্মণ অধ্যাপক হিন্দু সমাজের শীর্ষস্থানে দণ্ডায়মান আছেন ; কোটিপতির মুকুট-মণ্ডিত মস্তক তাঁহার চরণরেণু স্পর্শ করিয়া কৃতার্থ হয়। এখনও সেই প্রাচীন কালের পদ্ধতির বিশুদ্ধ ধারা ক্ষীণস্রোতে এদেশে বহিয়া আসিতেছে। এখনও নাকি সিন্ধুতীর ও কৃষ্ণাতীর হইতে শিক্ষার্থী নবদ্বীপের চতুষ্পাঠীতে ভক্তি মাত্র দক্ষিণা ও উপহার লইয়া শিক্ষক সমীপে উপস্থিত হয়। তাহারা কি শেখে কি না শেখে, তাহা দেখিবার প্রয়োজন নাই। কি তাহাদের উদ্দেশ্যে, কি তাহাদের আকাঙ্খা, কিসে তাহাদের তৃপ্তি কেবল তাহাই দেখিয়া নয়ন সার্থক কর।”[৩১]
এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল সমালোচনা করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’প্রবন্ধে। যদিও তিনি রামেন্দ্রসুন্দরের নাম উল্লেখ করেন নি, তাহলেও তাঁর মন্তব্যটি পড়লে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাবে, আচার্যের লক্ষ্য কে বা কারা ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, “… খৃঃ অঃ দ্বাদশ শতাব্দী হইতে ইউরোপ খণ্ডে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রথম প্রবাহিত হয়। প্রায় সেই সময় হইতেই ভারতগগন তিমিরাচ্ছন্ন হইল। অধ্যাপক বেবর (Weber) যথার্থই বলিয়াছেন যে, ভাস্করাচার্য্য ভারতগগনের শেষ নক্ষত্র। সত্য বটে, আমরা নব্য স্মৃতি ও নব্য ন্যায়ের দোহাই দিয়া বাঙ্গালীমস্তিষ্কের প্রখরতার শ্লাঘা করিয়া থাকি, কিন্তু ইহা আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে সময়ে স্মাৰ্ত্ত ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর প্রভৃতি মন্থন ও আলোড়ন করিয়া নবম বর্ষীয়া বিধবা নির্জ্জলা উপবাস না করিলে তাহার পিতৃ ও মাতৃকুলের উৰ্দ্ধতন ও অধস্তন কয় পুরুষ নিরয়গামী হইবেন, ইত্যাকার গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন, যে সময়ে রঘুনাথ, গদাধর ও জগদীশ প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায়গণ বিবিধ জটিল টীকা টিপ্পনী রচনা করিয়া টোলের ছাত্রদিগের আতঙ্ক উৎপাদন করিতেছিলেন, যে সময়ে এখানকার জ্যোতির্ব্বিদবৃন্দ প্রাতে দুই দণ্ড দশ পল গতে নৈৠত কোণে বায়স কা কা রব করিলে সে দিন কি প্রকারে যাইবে ইত্যাদি বিষয় নির্ণয় পূৰ্ব্বক কাকচরিত্র রচনা করিতেছিলেন, যে সময়ে এ দেশের অধ্যাপকমণ্ডলী ‘তাল পড়িয়া ঢিপ করে, কি ঢিপ করিয়া তাল পড়ে’ইত্যাকার তর্কের মীমাংসায় সভাস্থলে ভীতি উৎপাদন করিয়া সমবেত জনগণের অন্তরে শান্তিভঙ্গের আয়োজন করিতেছিলেন, সেই সময়ে ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন প্রভৃতি মনস্বীগণ উদীয়মান প্রকৃতির নূতন নূতন তত্ত্ব উদঘাটন পূর্বক জ্ঞানজগতে যুগান্তর উপস্থিত করিতেছিলেন ও মানবজীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতেছিলেন।”[৩২]
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না, নবদ্বীপের টোল সংস্কৃতি সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনোভাব। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন বিদ্যাসাগর ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করে শিক্ষাসংসদের সচিব মৌয়াটকে লেখা বিখ্যাত প্রতিবেদনটিতে লিখেছিলেন, “Anumana Chintamani is a work of the modern school of Nyaya Philosophy, on deduction, by Gangeshopadhyaya. His reasoning is similar to that of the schoolmen of the middle age of Europe. This treatise is what Bacon would call a ‘cobweb of learning’. In the study of this work insurmountable difficulties are to be met with. … Khandana is by Sriharsha. The object of the author in this work is to refute all the then existing systems of philosophy, and to establish his favourite, the Vedantic. This work is of high repute. The author has handled the subject in the most abstruse style, and has actually made it what they call ‘muddy metaphysics’.”[৩৩]
একই গ্রন্থে (নানা কথা) ‘বর্ণাশ্রমধর্ম্ম’শীর্ষক প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর মন্তব্য করেছিলেন, “একালে যে মনুর সময়ের বর্ণাশ্রমধর্ম্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে, ইহা কেহ আশা করেন না, বোধ করি ইচ্ছাও করেন না। সে দিন নাই, হইবেও না। কিন্তু বিপ্লব কোনোকালেই বাঞ্ছনীয় নহে। পুরাতন আদর্শ পুরাতন ভিত্তির উপর বজায় থাকুক, ইহাই প্রার্থনীয়। সেই আদর্শ কালানুযায়ী মূর্ত্তি গ্রহণ করুক, তাহাতে ক্ষতি নাই।”[৩৪] সামাজিক ব্যবস্থার এই স্থিতিশীলতার পক্ষে কেন রামেন্দ্রসুন্দর ওকালতি করলেন? এর উত্তরটা তিনি ওই একই প্রবন্ধে দিয়েছিলেন, “ইংরাজীতে যাকে Discipline বলে, আমাদের সমাজে বর্ণধর্ম্ম কতকটা সেই ডিসিপ্লিনের কাজ করে।”[৩৫]
গবেষক আশীষ লাহিড়ী লিখছেন, “বস্তুতঃ, এই মনোভাব যিনি পোষণ করেন, তাঁর সম্পর্কে বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো রচনায় আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে মানুষটির নাম রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন বিজ্ঞান-আলোচনার জন্যই। কি বিচিত্র ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গতি।”[৩৬]
দেশের পুরাতন সমাজব্যবস্থার ব্যাপারে রামেন্দ্রসুন্দরের মনোভাব স্পষ্টতর হয়ে ওঠে ‘সামাজিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার’প্রবন্ধে। রামেন্দ্রসুন্দর বলেছেন, “যে পুরাতন ধর্ম্মমার্গ এই পুরাতন সমাজকে বিঘ্ন বিপত্তি হইতে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহাকে আমি অকপটভাবে ভক্তি করি। … যদি আমাদের সামাজিক ব্যাধির কোনো ফলপ্রদ চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়, তাহা এই আত্মসমাজের প্রতি অকপট শ্রদ্ধা ও অবিচলিত ভক্তি। … যদি আমরা কখনও রঙ্গমঞ্চের অস্বাভাবিক প্রহসনের অভিনয় ত্যাগ করিয়া প্রকৃত মনুষ্যোচিত কর্ম্মক্ষেত্রে বিচরণ করিতে চাই, আমাদের এই প্রাচীন সমাজের প্রতি অকপট শ্রদ্ধা হইতেই সেই ক্ষমতা উৎপন্ন হইবে। যাঁহারা এই পুরাতন সমাজের সহিত সকল সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়া বিদেশ হইতে আনিত বা চৌর্য্যলব্ধ উপকরণ দ্বারা নূতন সমাজ গড়িতে চাহেন, তাঁহারা মূলোচ্ছেদনের পর শাখা হইতে ফলপ্রাপ্তির কামনা করেন। যাঁহারা এই পুরাতন সমাজকে অদ্য হীনবল ও অধঃপতিত ও শাসনবিষয়ে অসমর্থ দেখিয়া ইহার প্রতি নির্ম্মম বিদ্রূপবাণীর প্রয়োগ করেন, তাঁহাদের কাপুরুষত্ব অবজ্ঞেয়।”[৩৭]
এই পর্যায়ে আবার মনে পড়ে যাচ্ছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ‘বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’প্রবন্ধে লিখিত সতর্কীকরণ, “সহস্রাধিক বৎসরের ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, সমগ্র ভারতবাসী অহিফেনসেবীর ন্যায় জড়, নিস্পন্দ ও অসাড় হইয় পড়িয়া আছে। জগতের ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে এই দেখিতে পাওয়া যায় যে, যখন যে জাতি এইপ্রকার হীনাবস্থায় পতিত হয়, তখন পুরাতনের প্রতি একটা অযথা অতিরিক্ত শ্রদ্ধা স্থাপন করে, এবং আত্মশক্তির উপর সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসহীন হইয়া পড়ে।”[৩৮]প্রাচীন ভারতীয় সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দরের এই স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর-পন্থী সেকুলার যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কড়া টিপ্পনী, “এই যুক্তির ওপর ভিত্তি করলে বর্তমানে (প্রবন্ধটি আগস্ট, ১৯৬৪ সালে লিখিত) পাকিস্তানের ইসলামীয় রাজ্যস্থাপন বা জনসঙ্ঘের হিন্দুরাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনাকে সমালোচনা করা চলবে না।”[৩৯] শুধু তাই নয়, সত্যেন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, “রামেন্দ্রসুন্দরের সমাজরক্ষণশীলতা শেষ অবধি পুরাতনী মনোভাবে পরিণত হয়েছে। গান্ধীবাদী ও হিন্দু সঙ্ঘওয়ালা স্বতন্ত্রবাদীদের মধ্যে সাদৃশ্য প্রবল। রিপন কলেজে শিক্ষকমহলে তখনকার দিনে এই মনোভাবের বিকাশই প্রশংসিত হত।”[৪০] রামেন্দ্রসুন্দরের এই রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ সখেদে মন্তব্য করেছেন, “মাঝে মাঝে মনে হয়, ত্রিবেদী মশায়ের মতো তত্ত্বজিজ্ঞাসু শিক্ষক যদি রিপন কলেজের মত স্থানে কাল না কাটিয়ে এমন কোনো স্থানে অধ্যাপনা করতেন — দেশের নবীন মনের সঙ্গে যেখানে সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব ছিল, তাহলে এই সাময়িক একদেশদর্শী তর্করাশির পরিবর্তে হয়তো চিরস্থায়ী মৌলিক চিন্তাভাবনা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেতে পারতাম।” [৪১]
সত্যেন্দ্রনাথের এই শেষোক্ত মন্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ঘটনা তুলে দিচ্ছি আশুতোষ বাজপেয়ীর জীবনচরিত গ্রন্থ থেকে, “১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর সাডলার কমিশন রিপন কলেজ পরিদর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। কমিশনের কর্ত্তা ইংল্যান্ড হইতে আগত সাডলার সাহেব রামেন্দ্রসুন্দরের বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানবত্তার পরিচয় পাইয়া একান্ত মুগ্ধ হইয়াছিলেন, তিনি বিস্ময়বিমুখ চিত্তে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন — বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে এরূপ লোক নিযুক্ত না করিয়া কতকগুলি ছোকরা নিযুক্ত করা হইয়াছে কেন? তিনি উত্তরে শুনিয়াছিলেন, ‘This is the fate of our country.’ইহাই আমাদের দেশের ভাগ্য।” [৪২] সত্যেন্দ্রনাথ ওই ছোকরাদের পরিচয় দিয়েছেন — ডাঃ মেঘনাদ সাহা, ডাঃ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ডাঃ সুধাংশু ব্যানার্জী, ডাঃ নিখিলরঞ্জন সেন প্রভৃতি। প্রথমজন তো বটেই, বাকিরাও স্বনামধন্য !
‘চিরস্থায়ী মৌলিক চিন্তাভাবনা’ বলতে সত্যেন্দ্রনাথ কী বোঝাচ্ছেন, তিনি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর পরবর্তী মন্তব্যে, “এমন কিছু মৌলিক দর্শনতত্ত্ব লেখা, যার মধ্যে প্রতীচ্যের বিজ্ঞান, দর্শন, বিবর্তনবাদের সঙ্গে এদেশের অন্বয়বাদ এবং বৌদ্ধ হেতুবাদের সমন্বয় থাকবে।”[৪৩] সত্যেন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, যে মানুষটি বাংলায় বিজ্ঞান-প্রচারের জন্য চিরনমস্য হয়ে রয়েছেন, তিনিই অবশেষে “বর্তমান বিজ্ঞানের আবশ্যকতা” স্বীকার করতেন না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একবার রামেন্দ্রসুন্দরকে “বিদ্যার এত বড়ো জাহাজ” বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সেই জাহাজভরা বিদ্যা থেকে লাভ তখনই হত যদি তা মানবকল্যাণে কাজে লাগতো। শাস্ত্রীমশাইয়ের মন্তব্যের রেশ টেনে খানিকটা শ্লেষের সঙ্গেই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন — “আমাদের দুঃখ হয় ‘বিদ্যার এত বড়ো জাহাজ’থেকে কোনো চিরস্থায়ী সম্পদ নামানো সম্ভব হল না। তাঁর রচনাবলী বেশি ভাগ সাময়িকীতে প্রকাশিত জনপ্রিয় এবং মুখরোচক প্রবন্ধে ভরা। খুব কম প্রবন্ধ পড়ি যাতে তাঁর গভীর সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ও মৌলিক চিন্তার সাক্ষ্য দেয়। কে জানে রামেন্দ্রসুন্দরের নিজের মনেও এইরূপ কোনো মৌলিক নিদর্শন রাখার ইচ্ছে ছিল কিনা !”[৪৪] কথাগুলি সত্যেন্দ্রনাথের মতো বিজ্ঞানী বলেছেন বলেই তা আমাদের ভাবাতে বাধ্য করে।
ভারতে বিজ্ঞানচর্চায় যাঁরা যুগান্তর এনে দিয়েছিলেন, যেমন সত্যেন্দ্রনাথ বসু অথবা মেঘনাদ সাহার থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর এই দূরত্বের প্রসঙ্গটি সত্যিই ভাবায়। বিষয়টি আশীষ লাহিড়ী সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আশীষবাবু বলেছেন, সত্যেন্দ্রনাথের “অভিমান ভরা বক্তব্য হল, যে-দেশ বিশ্ববিজ্ঞানের অঙ্গনে ভালো করে ঢুকতেই পারলো না, সেই দেশের বিজ্ঞান-দার্শনিকরা যদি গোড়া থেকেই মায়াবাদী ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রায় দেন যে বিজ্ঞানের প্রতীত বাস্তবতা আসলে বাস্তবতা নয় — তখন সেটা এ দেশে বিজ্ঞান-সংস্কৃতির প্রসারের পথে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায়, তা বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে সহায়ক হয় না। তাঁর মতে, বিজ্ঞান-বিরহিত মায়াবাদী দর্শন সম্পর্কে প্রাচ্যবাদী মোহ রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান-দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।”[৪৫]
(আট)
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের এই মূল্যায়ন মোটের ওপর ঠিক হলেও, তাঁর চিন্তাধারার অন্য এমন কতগুলো মাত্রা ছিল, যা তাঁকে সরাসরি বিজ্ঞানবিরোধী শিবিরে ঠেলে দেয়নি। এই প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দরের ‘ফলিত জ্যোতিষ’প্রবন্ধটির উল্লেখ করা যায়। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রদীপ’পত্রিকার চৈত্র, ১৩০৫ সংখ্যায়, ইংরেজি ১৮৯৯ সালে। এই ‘ফলিত জ্যোতিষ’ প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর স্রেফ জ্যোতিষীদের সম্মুখসমরে আহ্বান করেই ক্ষান্ত হন নি, আক্ষরিক অর্থেই ফালাফালা করে কেটেছিলেন জ্যোতিষশাস্ত্র নামক ছদ্মবিজ্ঞানটিকে।
প্রবন্ধটির প্রথমদিকেই রামেন্দ্রসুন্দর তাঁর অনবদ্য ভাষায় বাস্তবিক অর্থেই জ্যোতিষীদের নিয়ে রীতিমত বিদ্রূপ করেছেন — “তাঁহারা তর্ক করিতে বসিবেন রামচন্দ্র খাঁয়ের পুত্রের জন্মকালে বুধগ্রহ যখন কর্কটরাশিতে প্রবেশ করিয়াছে, তখন সেই পুত্র ভাবীকালে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের রাজা হইবেন, তাহাতে বিস্ময়ের কথা কি? ইহা অসম্ভব কিরূপে? বিশেষত যখন স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, যে প্রত্যহ সূর্যোদয় হইবামাত্র পাখী সব রব করিতে থাকে, কাননে কুসুমকলি ফুটিয়া উঠে, এবং গোপাল গরুর পাল লইয়া মাঠে যায়। আমরা বৎসর বৎসর দেখিয়া আসিতেছি, যে সূর্যদেব বিষুবসংক্রমণ করিবামাত্র দিনরাত্রি অমনি সমান হইয়া যায় ; তখন শনিশুক্রসঙ্গম ঘটিলে সাইবেরিয়াতে ভূমিকম্প ঘটিবে, ইহাতে বিচিত্র কি? আবার চন্দ্রোদয়ে সমুদ্রের বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠে, ইহা যখন কবি কালিদাস হইতে বৈজ্ঞানিক কেলভিন পর্যন্ত সকলেই নির্ব্বিবাদে স্বীকার করিতেছেন, তখন সেই চন্দ্র বৃহস্পতির সমীপস্থ হইলে লুই নেপোলিয়নের দৌহিত্রের শিরঃপীড়া কেন না ঘটিবে? একটা যদি সম্ভব হয়, আর একটা অসম্ভব কিসে হইল? বিশেষতঃ মহাকবি সেক্ষপীয়র যখন বলিয়া গিয়াছেন, স্বর্গে ও মর্ত্ত্যে এমন কত কি আছে, যাহা মানবের জ্ঞানাতীত !”[৪৬]প্রবন্ধের শেষে তিনি রীতিমত একটি সিরিয়াস চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে। “একটা সোজা কথা বলি। ফলিত জ্যোতিষকে যাঁহারা বিজ্ঞানবিদ্যার পদে উন্নীত দেখিতে চাহেন তাঁহারা এইরূপ করুন। প্রথমে তাঁহাদের প্রতিপাদ্য নিয়মটা খুলিয়া বলুন। মানুষের জন্মকালে গ্রহনক্ষত্রের স্থিতি দেখিয়া মানুষের ভবিষ্যৎ কোন নিয়মে গণনা হইতেছে তাহা স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হইবে। কোন গ্রহ কোথায় থাকলে কি ফল হইবে, তাহা খোলসা করিয়া বলিতে হইবে। বলিবার ভাষা যেন স্পষ্ট হয় – ধরি মাছ না ছুঁই পানি হইলে চলিবে না। তাহার পর হাজার খানেক শিশুর জন্মকাল ঘড়ি ধরিয়া দেখিয়া প্রকাশ করিতে হইবে ; এবং পূর্ব্বের প্রদত্ত নিয়ম অনুসারে গণনা করিয়া তাহার ফলাফল স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ করিতে হইবে। … পূর্ব্বে প্রচারিত ফলাফলের সহিত প্রত্যক্ষ ফলাফল মিলিয়া গেলেই ঘোর অবিশ্বাসীও ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসে বাধ্য হইবে ; যতটুকু মিলিবে ততটুকু বাধ্য হইবে। হাজারখানা কোষ্ঠীর মধ্যে যদি নয়শো মিলিয়া যায়, মনে করিতে হইবে, ফলিত জ্যোতিষে অবশ্য কিছু আছে ; যদি পঞ্চাশখানা মাত্র মেলে তবে মনে করিতে হইবে, তেমন কিছু নাই। হাজারের স্থানে যদি লক্ষটা মিলাইতে পারো, আরও ভালো। বৈজ্ঞানিকরা সহস্র পরীক্ষাগারে ও মানমন্দিরে যে রীতিতে ফলাফল গণনা প্রকাশ করিতেছেন সেই রীতি আশ্রয় করিতে হইবে। কেবল নেপোলিয়নের ও বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী বাহির করিলে অবিশ্বাসীর বিশ্বাস জন্মিবে না। চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার হয়, তবে রামকান্তের জজিয়তি কেন হইবে না, এরূপ যুক্তিও চলিবে না।”[৪৭]
‘প্রাণময় জগৎ’প্রবন্ধে যখন তিনি বলেন, “আমি বৈজ্ঞানিকতার স্পর্ধা রাখি না ; কিন্তু আমি বৈজ্ঞানিকতাজীবী বিজ্ঞানভিক্ষু। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষালব্ধ প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভিন্ন অন্য প্রমাণ ব্যবহারিক বিদ্যায় আমার নিকট অগ্রাহ্য।”[৪৮]অথবা ‘ফলিত জ্যোতিষ’প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক মনন নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেন, “কোনও একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা কি না এবং ঘটনাটা প্রকৃত কি না তাহা রেজিস্টারির পূর্ব্বে জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম স্বীকার করিতে হয়। … তিনি অতি সহজে অত্যন্ত ভদ্র ও সুশীল ব্যক্তিকেও বলিয়া বসেন, তোমর কথায় আমি বিশ্বাস করিলাম না। … নিজের উপরেও তাঁর বিশ্বাস অল্প। … কোথায় কোন্ ইন্দ্রিয় তাঁহাকে প্রতারিত করিয়া ফেলিবে … এই ভয়েই তিনি সর্ব্বদা আকুল।”[৪৯]তখন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কট্টর প্রয়োগবাদী, যুক্তিধারা নিখাদ আরোহী। একইভাবে ‘প্রজ্ঞার জয়’গান গেয়ে ‘বেদপন্থী’ বিজ্ঞান-দার্শনিক মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, “এই প্রজ্ঞার অস্ত্র বিজ্ঞানময় অস্ত্র। বৈজ্ঞানিক এই বিজ্ঞানাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া বাঙ্ময় জগৎ নির্ম্মাণ করিয়াছেন, এবং বাঙ্ময় জগতের অনুশাসনে প্রত্যক্ষ জগৎকেও আপনার বশীভূত করিয়াছেন। বিজ্ঞান-বিদ্যার এইজন্য এত স্পর্ধা। মানুষের কারবার প্রত্যক্ষ জগতে। প্রজ্ঞাবলে সেই প্রত্যক্ষ জগৎ মানুষের বশীভূত। প্রজ্ঞাবান মনুষ্য প্রত্যক্ষ জগতের প্রভু ; অতএব প্রজ্ঞারই জয়, …।”[৫০] এটা আর যাই হোক, মায়াবাদী দার্শনিকের কণ্ঠ নয়। একই কথা আশীষ লাহিড়ীরও, “এই রামেন্দ্র বিজ্ঞান-বিরোধী মায়াবাদী নন।”[৫১]
সত্যি বলতে কি উনিশ শতকে জাত বেশির ভাগ বাঙালি মনীষীর মতো রামেন্দ্রসুন্দরও মানসিক দোলাচলের বশীভূত। বুদ্ধিজগতে আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্ব তাঁর কাছে সমধিক ; কিন্তু মনের গহনে তিনি প্রাচীন হিন্দু ভারতের ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। আসলে প্রতিটি যুগেরই নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যা কারও পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার একই সঙ্গে প্রতিটি যুগে শ্রেণী সীমাবদ্ধতা বলেও একটি শর্ত আছে এবং নিজের শ্রেণী অবস্থান বজায় রেখে তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি ব্যক্তির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই দুই-এর অধ্যয়ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির উপর গুরুত্ব আরোপ করা মানেই সত্য থেকে সরে যাওয়া।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বড়োই প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল রামেন্দ্রসুন্দরের। চিরকাল দুজনেই পথ চলেছিলেন দেশপ্রেম ও সাহিত্যসাধনার আদর্শকে সামনে রেখে। একে অপরের সাহিত্যের প্রতি তো বটেই, মানুষ হিসেবেও ছিলেন পরম অনুরাগী। সেই অনুরাগের একটি কাহিনী জানিয়েই এ প্রবন্ধ শেষ করবো।
১৩২৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাস। পরপর কন্যা গিরিজাদেবী ও মাতা চন্দ্রকামিনী দেবীর মৃত্যুর চরম আঘাতে রোগজীর্ণ রামেন্দ্রসুন্দর শয্যাগত হয়ে পড়লেন। বহুমূত্ররোগ, জ্বর প্রভৃতি উপসর্গে আচার্যদেবের জীবনপ্রদীপ ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠলো। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেলেন। এমন সময়ে সংবাদপত্রে খবর বার হল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই জঘন্য গণহত্যার প্রতিবাদ করে বড়লাটকে চিঠি লিখেছেন তিনি। প্রিয় বন্ধুকে শেষবারের মতো অন্তরের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন মৃত্যুশয্যায় শয়ান রামেন্দ্রসুন্দর। ১৯শে জ্যৈষ্ঠ অনুজ দুর্গাদাস ত্রিবেদী খবর দিলেন রবীন্দ্রনাথকে। খবর পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই বন্ধুর শয্যাপাশে ছুটে এলেন রবীন্দ্রনাথ। রামেন্দ্রসুন্দর জানালেন তাঁর শেষ ইচ্ছে — বড়লাটের কাছে লেখা চিঠিটি তিনি কবির নিজের মুখে শুনতে চান। একটি নীল কাগজ বার করে উদাত্ত কণ্ঠে হয়তো চোখের জলে ভেজা ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের কাছে লেখা এই অগ্নিগর্ভ চিঠিটি পড়ে শোনালেন রবীন্দ্রনাথ।
এর পরের কথা শোনা যাক সত্যেন্দ্রনাথের লেখনী থেকে। “একটা গভীর পরিতৃপ্তি ফুটে উঠলো ত্রিবেদী তাপসের মুখে। শারীরিক অসুস্থতার তীব্রতা তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের শিখা বুঝি এমনি করেই জ্বলে ওঠে। কম্পিত কণ্ঠে রামেন্দ্রসুন্দর বললেন — আমি আর উঠতে পারি না — দয়া করে আপনার পদধূলি আমার মাথায় দিন। কবিগুরু বিদায় নিলেন — এদিকে রামেন্দ্রসুন্দর তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সে তন্দ্রা আর ভাঙলো না।”[৫২]২৩শে জ্যৈষ্ঠ রাত দশটার সময় জীবনদীপ নিভে গেল রামেন্দ্রসুন্দরের। মহাপ্রয়াণকালে শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলে আরেকজন সাহিত্যসাধক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বড় আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমাদের চক্ষের সম্মুখে বিদ্যার এত বড় জাহাজ ডুবিয়া গেল।”[৫৩]
তথ্যসূত্র :
১) রামেন্দ্রসুন্দর : জীবন কথা, আশুতোষ বাজপেয়ী, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৯২৪, পৃষ্ঠা ১
২) পথিকৃৎ রামেন্দ্রসুন্দর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ১৮৭
৩) রামেন্দ্রসুন্দর : জীবন কথা, আশুতোষ বাজপেয়ী, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৯২৪, পৃষ্ঠা ৪১
৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮
৫) রামেন্দ্রসুন্দর : সেরা রচনা সম্ভার, সমীর রক্ষিত কমল চৌধুরী সম্পাদিত, ডি এম লাইব্রেরী, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৫
৬) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ২৯২
৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৩
৮) পথিকৃৎ রামেন্দ্রসুন্দর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ২০৫
৯) বঙ্গ গৌরব দ্বিতীয় খণ্ড, জলধর সেন, ম্যাকমিলান এণ্ড কোম্পানি লিমিটেড, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১৪২
১০) সাহিত্য মাসিকপত্র ও সমালোচনা আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যা, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত, ১৯১৯, পৃষ্ঠা ৪১১
১১) বঙ্গসাহিত্যে বিজ্ঞান, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ২২৩
১২) বঙ্গ গৌরব দ্বিতীয় খণ্ড, জলধর সেন, ম্যাকমিলান এণ্ড কোম্পানি লিমিটেড, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১৪২
১৩) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ২৬৯
১৪) জিজ্ঞাসা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সংস্কৃতপ্রেস ডিপজিটরি, ১৯২০, পৃষ্ঠা ৩৮৮
১৫) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ৫
১৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮৩
১৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮৩-৪৮৪
১৮) বঙ্গ গৌরব দ্বিতীয় খণ্ড, জলধর সেন, ম্যাকমিলান এণ্ড কোম্পানি লিমিটেড, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১৪৩
১৯) রামেন্দ্র রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৫০, পৃষ্ঠা ২০৮
২০) জিজ্ঞাসা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সংস্কৃতপ্রেস ডিপজিটরি, ১৯২০, পৃষ্ঠা ৩৮৪
২১) রামেন্দ্রসুন্দর : সেরা রচনা সম্ভার, সমীর রক্ষিত কমল চৌধুরী সম্পাদিত, ডি এম লাইব্রেরী, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৭৩
২২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪০
২৩) অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৯৪
২৪) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ১১৩
২৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১
২৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১১৪
২৭) রামেন্দ্রসুন্দর : জীবন কথা, আশুতোষ বাজপেয়ী, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৯২৪, পৃষ্ঠা ১৯২
২৮) রবীন্দ্র রচনাবলী দশম খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৪১, পৃষ্ঠা ৬২৭-৬২৮
২৯) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ৪৯৫-৪৯৮
৩০) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্মা সম্পাদিত, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৮৫
৩১) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ৩১৩
৩২) আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী, রমেশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত, চক্রবর্তী চ্যাটার্জী এণ্ড কোম্পানী লিমিটেড, ১৯২৭, পৃষ্ঠা ১-২
৩৩) করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৭১৬
৩৪) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ৩২৮
৩৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৯
৩৬) অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৯১
৩৭) রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ৩৯৩
৩৮) আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী, রমেশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত, চক্রবর্তী চ্যাটার্জী এণ্ড কোম্পানী লিমিটেড, ১৯২৭, পৃষ্ঠা ৪
৩৯) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্মা সম্পাদিত, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৮৭
৪০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯
৪১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯
৪২) রামেন্দ্রসুন্দর : জীবন কথা, আশুতোষ বাজপেয়ী, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৯২৪, পৃষ্ঠা ১২১
৪৩) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্মা সম্পাদিত, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯০
৪৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯
৪৫) অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৯৫
৪৬) জিজ্ঞাসা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সংস্কৃতপ্রেস ডিপজিটরি, ১৯২০, পৃষ্ঠা ২৬২
৪৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৮-২৬৯
৪৮) রামেন্দ্রসুন্দর : সেরা রচনা সম্ভার, সমীর রক্ষিত কমল চৌধুরী সম্পাদিত, ডি এম লাইব্রেরী, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৭৮
৪৯) জিজ্ঞাসা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সংস্কৃতপ্রেস ডিপজিটরি, ১৯২০, পৃষ্ঠা ২৬৫-২৬৬
৫০) রামেন্দ্র রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৫০, পৃষ্ঠা ৪৪৭
৫১) অন্য কোনো সাধনার ফল, আশীষ লাহিড়ী, পাভলভ ইনস্টিটিউট, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৯৬
৫২) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্মা সম্পাদিত, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯১
৫৩) পথিকৃৎ রামেন্দ্রসুন্দর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ২১৯