রক্তমৃত্তিকা – প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদ
বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর পুরোনো গতিপথের ধারে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদ রক্তমৃত্তিকার নাম আজ প্রায় বিস্মৃত। আদি মধ্যযুগে এই জনপদ যে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রক্তমৃত্তিকার প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুসমূহের অধ্যয়নে পাওয়া গেছে তার অসংশয়িত প্রমাণ। এই জনপদে স্থাপিত বৌদ্ধ মহাবিহার যে প্রাচীন বাংলায় শাস্ত্রচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, চিনা পরিব্রাজক জুয়ানজ্যাং-এর বর্ণনায় তার প্রমাণও লিপিবদ্ধ। সম্ভবত বাংলায় গুপ্ত অধিকারের সময় রক্তমৃত্তিকার মহাবিহার প্রতিষ্ঠার কাল। সেই সময় থেকে অন্ত মধ্যযুগে ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত রক্তমৃত্তিকা জনপদের গুরুত্ব সম্ভবত কখনও একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। আজও প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা জনপদের স্মৃতি বহন করে চলেছে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর ব্লকের অন্তর্গত রাঙামাটি নামের একটি গ্রাম। এই নিবন্ধের চর্চার বিষয় এই প্রাচীন জনপদের গৌরবময় ইতিহাস।
মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত
১৮৩৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সেনানায়ক জেমস লো মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত তৎকালীন ওয়েলেসলি রাজ্যের (বর্তমান মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যের সেবেরাং পেরাই) উত্তরাংশে এক প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের অবশেষ থেকে একটি স্লেট পাথরের উপর উৎকীর্ণ লেখ খুঁজে পান। ১৮৩৫ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি এই লেখটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিকে উপহার দেন। বর্তমানে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এই প্রস্তরফলকটি ৬৬ সেমি দীর্ঘ ও ৮-৯ সেমি প্রশস্ত। এর একদিকে একটি স্তূপের প্রতিকৃতি খোদিত, আর এই স্তূপের প্রতিকৃতির দুই পাশে উপর থেকে নিচে প্রাচীন দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় উৎকীর্ণ লেখের বাণী। পাথরের ফলকের নিচের অংশটি ভেঙে গেলেও লেখটি প্রায় সম্পূর্ণ ও বোধগম্য। আধুনিক বিদ্বানরা অক্ষরের ছাঁদ দেখে এই লেখটিকে পঞ্চম শতকের বলে অনুমান করেছেন। এই লেখে কোনও একটি বৌদ্ধ সংঘের দ্বারা মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের বাণিজ্যযাত্রা সর্বত সিদ্ধকাম হবার প্রার্থনা লিপিবদ্ধ; সম্ভবত এই মঙ্গলসূচক প্রস্তরফলকটি বাণিজ্যপোতে বহন করা হত। এই লেখে উল্লিখিত মহানাবিক অর্থাৎ পোতাধ্যক্ষ বুদ্ধগুপ্তের বাসস্থান ছিল রক্তমৃত্তিকা। এখনও পর্যন্ত রক্তমৃত্তিকা জনপদের এটিই প্রাচীনতম উল্লেখ। এই লেখটি থেকে অনুমান করা যায় সাধারণাব্দের পঞ্চম শতকের রক্তমৃত্তিকা থেকে ভাগীরথীর বাণিজ্যপথ ধরে তাম্রলিপ্ত হয়ে বাংলার বণিকরা ভারত মহাসাগরের পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যে যেতেন। সম্ভবত বুদ্ধগুপ্তের মত প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সমৃদ্ধ বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রক্তমৃত্তিকা জনপদে গড়ে উঠেছিল এক বা একাধিক বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চার প্রতিষ্ঠান।
জুয়ানজ্যাং-এর বিবরণ
রক্তমৃত্তিকার মহাবিহারের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় চিনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক জুয়ানজ্যাং-এর (৬০২-৬৬৪ সাধারণাব্দ) বিবরণে। সপ্তম শতকের প্রথম দিকে আগত এই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে রক্তমৃত্তিকা ও তার পার্শ্ববর্তী গৌড়ের তৎকালীন রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ও নিকটবর্তী এলাকার ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র পরিস্ফুট। জুয়ানজ্যাং সন-মো-ত-চ (সমতট) থেকে তান-মো-লি-তি (তাম্রলিপ্তি) হয়ে ‘কি-লো-ন-সু-ফ-ল-ন’ (কর্ণসুবর্ণ) উপস্থিত হন। সম্ভবত তিনি তখনকার বাংলার বণিকদের বহুল ব্যবহৃত নদীপথ ধরেই এখানে পৌঁছান। অবশ্য হুই লি লিখিত জুয়ানজ্যাং-এর জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে তিনি পুণ্ড্রবর্ধন থেকে কর্ণসুবর্ণ এসেছিলেন।
জুয়ানজ্যাং-এর দেখা কর্ণসুবর্ণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূমি ছিল নিচু ও স্যাঁতসেতে, আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এই অঞ্চলে নিয়মিত কৃষিকাজের, বিশেষত ফুল ও মূল্যবান কৃষিপণ্য উত্পাদনের প্রাচুর্যের কথা জুয়ানজ্যাং উল্লেখ করেছেন। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী কর্ণসুবর্ণের পরিধি ছিল ২০ লি (৬.৫ কিমি)। এখানকার গৃহস্থরা যথেষ্ট ধনবান ছিলেন। জুয়ানজ্যাং-এর বর্ণনায় বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ নির্বিশেষে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে বিদ্যাচর্চার প্রতি আগ্রহের উল্লেখ থেকে বোঝা যায়, সপ্তম শতকে এখানে বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। জুয়ানজ্যাং এই এলাকায় ১০টি বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম ও ২০০০ শ্রমণের (জুয়ানজ্যাং-এর জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী ৩০০ শ্রমণের) দেখা পান। এই শ্রমণরা শ্রাবকযানী (হীনযানী) সম্মতীয় (সম্মিতীয়) নিকায়ের অনুগামী ছিলেন। এখানে তিনি তিনটি (জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী দুটি) দেবদত্তের অনুগামীদের (গোতমক সম্প্রদায়) সঙ্ঘারামও দেখতে পান। জুয়ানজ্যাং-এর বর্ণনায় এই এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন তীর্থিক, অর্থাৎ শৈব, শাক্ত বা বৈষ্ণব মতাবলম্বী। এই অঞ্চলে ৫০টি দেবমন্দিরের অস্তিত্বের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। রাজধানী কর্ণসুবর্ণের পাশেই অবস্থিত ছিল লো-তো-মো-চি অর্থাৎ রক্তমৃত্তিকা জনপদ। এখানে অবস্থিত সুউচ্চ শিখরবিশিষ্ট মন্দির সমন্বিত মহাবিহারটির প্রকোষ্ঠগুলি ছিল প্রশস্ত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোকিত। জুয়ানজ্যাং-এর বিবরণ অনুযায়ী এই অঞ্চলের বিশিষ্ট বিদ্বানরা এখানে জ্ঞানচর্চার জন্য সমবেত হতেন। এই মহাবিহারের অদূরে ছিল সম্রাট অশোক নির্মিত একটি স্তূপ ও সংলগ্ন একটি বিহার। তিনি এখানে আরও কয়েকটি স্তূপ দেখতে পেয়েছিলেন।
সপ্তম শতক সাধারণাব্দে জুয়ানজ্যাং যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন, তখন শুধু বাংলায় নয়, সারা উপমহাদেশেই শ্রাবকযানী (হীনযানী) বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অর্হৎ সম্মিত স্থাপিত সম্মিতীয় নিকায়ের সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য ছিল। তৎকালীন বাকি তিনটি শ্রাবকযানী নিকায় – স্থবিরবাদী, মহাসাংঘিক ও সর্বাস্তিবাদীদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে অনেক কমে এসেছিল ।
জুয়ানজ্যাং তাঁর বিবরণে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার প্রতিষ্ঠার সম্পর্কে একটি প্রচলিত কাহিনির উল্লেখ করেছেন, এই কাহিনির সত্যতা নির্ণয় করা অসম্ভব। তাঁর উল্লিখিত কাহিনি অনুযায়ী এই অঞ্চলে এক সময় কেউই বুদ্ধের অনুগামী ছিলেন না। এই সময় দক্ষিণ ভারত থেকে এক তীর্থিক (অর্থাৎ শৈব বা বৈষ্ণব মতাবলম্বী) বিদ্বান পেটের উপর (জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী কোমরে) তামার পাত জড়িয়ে, হাতে দণ্ড ও মাথায় জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এই রাজ্যে উপস্থিত হয়ে ঢোল বাজিয়ে সবাইকে তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহ্বান জানাতে শুরু করেন। এক স্থানীয় ব্যক্তি, তাঁকে তাঁর এই অদ্ভুত বেশের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, তাঁর অত্যধিক জ্ঞানের কারণে পেট না ফেটে যায়, সেই আশঙ্কায় তিনি তামার পাত লাগিয়ে রেখেছেন আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষদের প্রতি অনুকম্পাবশত মাথায় আলোকবর্তিকা বহন করেন। দশ দিন পর্যন্ত কোনও স্থানীয় বিদ্বান তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে না আসায় এখানকার শাসক চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি তর্কযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বিদ্বানের সন্ধান শুরু করলে জনৈক প্রজা তাঁকে এক অরণ্যবাসী শ্রমণের সন্ধান দেন। সেই শ্রমণ শাসককে জানান, তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিব্রাজন শুরু করে এই রাজ্যে সাময়িকভাবে অবস্থান করছেন। তিনি আরও জানান, তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতা ও বিতর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও একটি শর্তে তিনি এই তর্কযুদ্ধে অংশ নিতে রাজি আছেন। শর্তটি হল, তিনি তর্কযুদ্ধে অপরাজিত থাকলে, শাসককে একটি সঙ্ঘারাম নির্মাণ করে বুদ্ধের বাণী প্রচার করতে দিতে হবে। শাসক শ্রমণের শর্তে রাজি হলে, শ্রমণ তর্কযুদ্ধের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। তীর্থিক বিদ্বান ত্রিশ হাজার শব্দে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের মত যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করার পর শ্রমণ মাত্র কয়েক শত শব্দে তাঁর যুক্তিজাল খণ্ডন করে, ঐ তীর্থিক বিদ্বানের নিজের সম্প্রদায়ের মত সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করেন। তীর্থিক বিদ্বান কিছু অস্পষ্ট উত্তর দেবার পর শেষে পরাজয় স্বীকার করে প্রস্থান করেন। এখানকার শাসক তখন এই শ্রমণের প্রতি সম্মানবশত রক্তমৃত্তিকায় মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখান থেকেই এই অঞ্চলের অন্যত্র বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। এখানে উল্লেখ্য, জুয়ানজ্যাং তাঁর বিবরণে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা শাসকের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি।
প্রাচীন মহাযানী শাস্ত্রগ্রন্থে জুয়ানজ্যাং বর্ণিত এই কাহিনির প্রায় সমতুল্য একটি কাহিনির উল্লেখ রয়েছে। ‘মহাপ্রজ্ঞাপারমিতোপদেশ’ বা ‘মহাপ্রজ্ঞাপারমিতাশাস্ত্র’ নামের ‘পঞ্চবিংশতিসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যামুলক মহাগ্রন্থ আনুমানিক দ্বিতীয় শতক সাধারণাব্দে মহাযানী দার্শনিক নাগার্জুনের রচনা বলে স্বীকৃত। মূল সংস্কৃত গ্রন্থটি বিলুপ্ত হলেও চতুর্থ শতকে কুচা নিবাসী বিদ্বান সন্ন্যাসী কুমারজীব (৩৪৪-৪১৩ সাধারণাব্দ) এই গ্রন্থের ৯০টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ ‘দা-ঝিদু-লুন’ নামে চিনা ভাষায় কৃত অনুবাদ এখনও বিদ্যমান। ‘দা-ঝিদু-লুন’ গ্রন্থের ষোড়শ অধ্যায়ে শারিপুত্রের (সারিপুত্ত) পিতা তিষ্য সম্পর্কে প্রায় একই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই কাহিনি অনুযায়ী শারিপুত্রের মাতামহ ব্রাহ্মণবংশীয় মাথর তাঁর জ্ঞান ও বিতর্কের ক্ষমতার কারণে মগধের শাসক বিম্বিসারের কাছ থেকে রাজধানী রাজগৃহের কাছে একটি গ্রাম উপহার পেয়েছিলেন। কিন্তু, দীর্ঘদিন চর্চার অভাবে তাঁর সমস্ত জ্ঞান লুপ্ত হয়। এই সময় দক্ষিণ ভারত থেকে তিষ্য নামের এক তরুণ ব্রাহ্মণ পেটের উপর তামার পাত জড়িয়ে, হাতে দণ্ড মাথায় জ্বলন্ত মশাল নিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে রাজগৃহে উপস্থিত হন। তিষ্যকে তাঁর এই বেশভুষার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি জুয়ানজ্যাং বর্ণিত কাহিনির বিদ্বানের মত ঠিক একই উত্তর দেন। তিষ্যকে স্থানীয় অধিবাসীরা মাথরের জ্ঞানের কথা উল্লেখ করলে, তিনি দুন্দুভি বাজিয়ে মাথরকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন। মাথর পরাজিত হবেন জেনেও তিষ্যের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাস্ত হন। বিম্বিসার মন্ত্রীদের পরামর্শে মাথরকে প্রদত্ত সব সম্পত্তি তিষ্যকে প্রদান করেন। মাথর উপায়ান্তর না দেখে তাঁর কন্যা শারির সঙ্গে তিষ্যের বিবাহ দিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যান। তিষ্য ও শারির পুত্র শারিপুত্র।
প্রজ্ঞাপারমিতা শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ জুয়ানজ্যাং ‘মহাপ্রজ্ঞাপারমিতাশাস্ত্র’ গ্রন্থে বর্ণিত শারিপুত্রের পিতার এই কাহিনি জানতেন না, এটা বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব। তা সত্ত্বেও তিনি রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেই একই কাহিনির একটি ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ কেন উপস্থাপন করলেন এই প্রশ্নের উত্তর কি কখনও জানা সম্ভব হবে?
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন
আজ আমরা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে জানি প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা জনপদ ও পার্শ্ববর্তী কর্ণসুবর্ণ মহানগরী কোথায় অবস্থিত ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার সদর বহরমপুর শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে বর্তমানে কর্ণসুবর্ণ (পুরোনো নাম ছিরুটি) রেলস্টেশনের নিকটবর্তী বহরমপুর ব্লকের অন্তর্গত ছিরুটি, যদুপুর ও রাঙামাটি-চাঁদপাড়া গ্রামের অন্তর্ভুক্ত এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সম্ভবত পার্শ্ববর্তী ডাবকাই, সুঙ্গাই, চর খিদিরপুর, চর হালালপুর, কোদলা, সাহাজাদপুর প্রমুখ গ্রামের এলাকাও এই প্রাচীন জনপদদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অঞ্চলের তিনটি প্রত্নক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত উৎখনন করা হয়েছে। এই তিনটি প্রত্নক্ষেত্র রাজবাড়িডাঙা, রাক্ষসীডাঙা ও নীলকুঠি নামে পরিচিত তিনটি উঁচু ঢিপি।
১৯২৮-১৯২৯ সালে কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের একটি দল রাঙামাটি-চাঁদপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত প্রতাপপুর গ্রামের রাক্ষসীডাঙায় খননকার্য চালায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই স্থান থেকে একটি কৃষ্ণবর্ণের বেলেপাথরের অষ্টভূজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাপ্রতিমা ভগ্নাবস্থায় পাওয়া গেছিল। উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু ও অবশেষের নির্মাণশৈলী থেকে প্রাচীন যুগে এখানে যে কোন মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়। সাধারণাব্দের ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে এই প্রত্নক্ষেত্রে একটি বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব অনুমিত হয়। এই বিহারটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার পর মধ্যযুগে এই প্রত্নক্ষেত্রটির জমির উচ্চতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিহারটিকে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার বলে চিহ্নিত করার মত কোন প্রমাণ এই উৎখননে পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের সঙ্গে যৌথভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই প্রত্নক্ষেত্রের দক্ষিণ দিকে আবার খননকার্য চালায়। এই উৎখননে এখানে দুটি কালপর্বে নির্মাণকার্যের প্রমাণ পাওয়া যায় – সাধারণাব্দের ষষ্ঠ-সপ্তম শতক ও অষ্টম-নবম শতক। অনুমান করা হয় জুয়ানজ্যাং বর্ণিত অশোক নির্মিত স্তূপ সংলগ্ন বিহারটি এখানে অবস্থিত ছিল।
১৯৬২ সালের শুরু থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সুধীর রঞ্জন দাসের তত্ত্বাবধানে যদুপুর গ্রামের রাজবাড়িডাঙায় খননকার্য চালানো হয়। এরপর ১৯৬৪-১৯৬৫, ১৯৬৬-১৯৬৭, ১৯৬৮-১৯৬৯, ১৯৭১-১৯৭২, ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৮১-৮২ মরসুমেও এই প্রত্নক্ষেত্রে খননকার্য চালানো হয়। এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির সিলমোহর, মূর্তি ও অন্য প্রত্নবস্তুসমূহের কালনির্ণয় করে, এখানকার নির্মাণের তিনটি পৃথক বস্তুগত সাংস্কৃতিক স্তর দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম স্তরের ব্যাপ্তি আনুমানিক দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক সাধারণাব্দ থেকে চতুর্থ-পঞ্চম শতক সাধারণাব্দ, দ্বিতীয় স্তরের ব্যাপ্তি আনুমানিক ষষ্ঠ-সপ্তম শতক সাধারণাব্দ থেকে নবম-দশম শতক সাধারণাব্দ আর তৃতীয় স্তরের ব্যাপ্তি আনুমানিক নবম-দশম শতক সাধারণাব্দ থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক সাধারণাব্দ। প্রত্যেকটি স্তরের নির্মাণকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রথম স্তরের দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি প্রাকার নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। চতুর্থ-পঞ্চম শতক সাধারণাব্দে প্রথম স্তরের নির্মাণ বন্যায় ধংসপ্রাপ্ত হয়, সমগ্র প্রত্নক্ষেত্রটি এই সময় সাদা বালুকাময় পলিতে আবৃত হয়ে যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতক সাধারণাব্দ থেকে দ্বিতীয় স্তরের নির্মাণের সূচনা হয়; এই স্তরের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণের নিদর্শন হিসাবে পাওয়া যায় একটি বিহারের বেদির অবশেষ, দুটি স্তূপের গোলাকার ভিত্তিভূমি ও চুনের প্রলেপ দেওয়া সিঁড়ির অবশেষ। তৃতীয় স্তরের প্রথম পর্যায়ে নির্মিত একটি পঞ্চায়তন বৌদ্ধ মন্দিরের অবশেষ পাওয়া গেছে। পঞ্চায়তন বৌদ্ধ মন্দিরটি প্রত্নক্ষেত্রের পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল। এই পঞ্চায়তন মন্দিরের আয়তাকার প্রাকার, চার কোণে চারটি চতুষ্কোণ ছোট মন্দির ও মধ্যস্থলে একটি ত্রিরথ মন্দির, মন্দিরের উত্তরদিকে একটি আয়তাকার মণ্ডপ এবং সুরকি দিয়ে তৈরি বেদির অবশেষ পাওয়া গেছে।
রাজবাড়িডাঙায় মোট ৯৮টি সিলমোহর পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ৪১টি সিলের পাঠোদ্ধার করা গেছে। প্রথম মরসুমেই দ্বিতীয় স্তরে পাওয়া যায় এই প্রত্নক্ষেত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার – আনুমানিক সপ্তম শতকের একটি ডিম্বাকৃতি পোড়ামাটির সিলমোহর। এই সিলের উপর খোদিত ধর্মচক্র ও দুটি হরিণের প্রতিকৃতির সঙ্গে ‘শ্রীরক্তমৃত্তিকা মহাবৈহারিক আর্য ভিক্ষু সংঘস্য’ লেখ থেকে এই প্রত্নস্থলটিকে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের অবশেষ বলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। পরবর্তী মরসুমগুলিতে এই প্রত্নক্ষেত্রে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের নাম খোদিত আরও কয়েকটি সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯টি ব্যক্তিগত নাম খোদিত সিলমোহর এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সিলগুলি পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক থেকে সপ্তম-অষ্টম শতকের মধ্যে নির্মিত। এখানে আবিষ্কৃত সিলগুলির মধ্যে অধিকাংশের পাঠোদ্ধার করেছেন প্রত্নলিপিবিদ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
এই প্রত্নক্ষেত্রে একটি শস্যাগার নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সপ্তম-অষ্টম শতকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভস্মীভূত হবার সময় এই শস্যাগারে চাল ও গম সঞ্চিত ছিল। এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে বহুসংখ্যক স্টাকো মুণ্ড ও একটি অষ্টধাতুর ধর্মচক্রও খুঁজে পাওয়া গেছে। এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কৃত ক্ষুদ্রাকার ধাতব বুদ্ধপ্রতিমা ও গণেশ মূর্তি রক্তমৃত্তিকায় তৎকালীন বৌদ্ধ উপাসনা রীতির পরিচায়ক।
এখানে পাওয়া সিলগুলির মধ্যে একটি ষষ্ঠ-অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী কালপর্বের গ্রিক ভাষায় ‘হোরী’ নামাঙ্কিত সিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি। ‘হোরী’ নামে অভিহিত চার ঋতু দেবীদের নামাঙ্কিত সিল থেকে অনুমান করা যায়, গ্রিক বা রোমান বণিকরা ষষ্ঠ-অষ্টম শতকেও রক্তমৃত্তিকা জনপদে আসতেন। আবার এখান থেকে পাওয়া সপ্তম-অষ্টম শতকের পল্লব লিপিতে লেখা পোড়ামাটির সিল থেকে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে রক্তমৃত্তিকা জনপদের বাণিজ্যিক সম্বন্ধের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। রক্তমৃত্তিকায় উত্তর বাংলার বণিকদের অবস্থানের সাক্ষী এখান থেকে পাওয়া ‘শ্রী বণিক বরেন্দ্রস্য’ লেখ সম্বলিত একটি পোড়ামাটির সিল।
২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাঙামাটি-চাঁদপাড়া গ্রামের নীলকুঠি ঢিপিতে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল খননকার্য চালান। এই প্রত্নক্ষেত্রে সাধারণাব্দের দ্বিতীয় শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মানব বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে (একাদশ-দ্বাদশ শতক নাগাদ স্বল্প সময়ের জন্য এই প্রত্নক্ষেত্র পরিত্যক্ত হয়েছিল)। এখানে প্রাপ্ত ভাস্কর্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ধূসর বর্ণের স্লেট পাথরের একটি ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ ফলকের উপর খোদিত সূর্যমূর্তি, সম্ভবত কোন মন্দিরের দেয়ালের অংশ। একটি প্রাচীন বিষ্ণুপ্রতিমা সম্বলিত একটি ক্ষুদ্রাকার পোড়ামাটির ফলক ও আনুমানিক অষ্টম শতক সাধারণাব্দের দেবীমূর্তি খোদিত স্লেট পাথরের একটি ভগ্ন ছোট ফলক এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে উল্লেখনীয় প্রাপ্তি। তবে এই উৎখননের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি সম্ভবত একটি ক্ষুদ্রাকার বেলেপাথরের উপর খোদিত চতুর্ভূজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার প্রতিমা। এখান থেকে আরও বহু সংখ্যক পোড়ামাটি ও পাথরের প্রতিমা ভগ্নাবস্থায় পাওয়া গেছে। এই প্রত্নক্ষেত্রটি প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ নগরের অংশ ছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। সম্ভবত এখানে কোনও ব্রাহ্মণ্য দেবমন্দির নির্মিত হয়েছিল।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে পার্শ্ববর্তী কর্ণসুবর্ণ জনপদ কিছু কালের জন্য খ্যাতি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক কারণে রক্তমৃত্তিকা জনপদের স্থিতিশীলতা ছিল দীর্ঘতর। ভবিষ্যতে এই এলাকায় আরও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন হলে, প্রাচীন বাংলার এই সমৃদ্ধ জনপদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোর বিবর্তন সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানা যাবে আশা করা যায়।
তথ্যসুত্র:
১. Bimal Bandyopadhyay, “A Note on Some Recently Discovered Sculptures in Stone and Terracotta from Excavation at Nilkuthi Mound, Karnasuvarna” in Journal of Ancient Indian History, Vol. XXIV, 2007-2008, J.N. Banerjea Memorial Volume; Kolkata: University of Calcutta, 2008, pp. 52-59.
২. Samuel Beal, Si-Yu-Ki, Buddhist Records of the Western World: Translated from the Chinese of Hiuen Tsiang (AD 629), Vol. 2; London: Trübner & Co., 1884, pp. 201-204.
৩. Samuel Beal, The Life of Hiuen Tsiang by the Shaman Hwui Li; London: Kegan Paul, Trench, Trübner & Co., 1911, pp. 131-132.
৪. B. Ch. Chhabra, “Expansion of Indo-Aryan Culture during Pallava Rule” in Journal of the Royal Asiatic Society of Bengal, Vol. 1, 1935; Calcutta: The Royal Asiatic Society of Bengal 1936, pp. 16-20.
৫. Sudhir Ranjan Das, Archaeological Discoveries from Murśidābād District, West Bengal, Part One; Calcutta: The Asiatic Society, 1971.
৬. সুধীর রঞ্জন দাশ, কর্ণসুবর্ণ মহানগরী: বঙ্গদেশের বিস্মৃত রাজধানী; কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৯২।
৭. Sudhir Ranjan Das, Rajbadidanga: 1962 (Chiruti: Jadupur: An Interim Report on Excavations at Rajbadidanga and Terracotta Seals and Sealings), Reprint; Kolkata: The Asiatic Society, 2003 (1968).
৮. K.N. Dikshit, “Excavations in Bengal” in H. Hargreaves ed. Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1928-29; Delhi: Manager of Publications, pp. 99-100.
৯. A. Ghosh, ed. Indian Archaeology 1962-63 – A Review; New Delhi: Archaeological Survey of India, 1967, p. 46.
১০. A. Ghosh ed., Indian Archaeology 1963-64 – A Review; New Delhi: Archaeological Survey of India, 1965, pp. 62-63.
১১. Michel Jacq-Hergoualc’h and Victoria Hobson trans., The Malay Peninsula: Crossroads of The Maritime Silk Road (100 BC – 1300 AD); Leiden: Brill, 2002, pp. 214-216.
১২. B.B. Lal ed., Indian Archaeology 1968-69 – A Review; New Delhi: Archaeological Survey of India, 1971, p. 43.
১৩. Étienne Lamotte, Le Traité de La Grande Vertu de Sagesse de Nāgārjuna (Mahāprajñāpāramitāśāstra), Tome II, Chapitres XVI-XXX; Louvain: Institut Orintaliste, 1967 (1949), pp. 637-639 Lamotte,.
১৪. Somreeta Majumdar, “Locating the Monastery in Landscape Context: A Preliminary Study of Raktamrittika Mahavihara of Karnasuvarna” in Heritage: Journal of Multidisciplinary Studies in Archaeology, Vol. 7; Thiruvananthapuram: Department of Archaeology, University of Kerala, 2019, pp. 622-641.
১৫. Birendra Nath Prasad, Archaeology of Religion in South Asia: Buddhist, Brahmanical and Jaina Religious Centres in Bihar and Bengal, c. AD 600-1200; New York: Routledge, 2021, p. 163.
১৬. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব, অষ্টম সংস্করণ; কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১৩, পৃ. ১৫৭-১৫৯।
১৭. Rakesh Tewari ed., Indian Archaeology 2009-10 – A Review; New Delhi: The Director General Archaeological Survey of India, 2016, p. 165-168.
ইতিহাস নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। এই রকম সংক্ষিপ্ত তথ্য পছন্দ করি।
অনেক ধন্যবাদ।
তথ্যসমৃদ্ধ।