সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আজীবন মহাপরিব্রাজক রাহুল সাংকৃত্যায়ন

আজীবন মহাপরিব্রাজক রাহুল সাংকৃত্যায়ন

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

আগস্ট ১১, ২০২০ ১৫১২ 23

অধুনা প্রয়াত বিশিষ্ট ভূগোলবিদ্ সুনীল মুন্সী, যাঁর আরেক ভাই বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ নীহার মুন্সী, একদিন ‘কালান্তর’ পত্রিকা দফতরে গল্পচ্ছলে বলছিলেন, “স্বাধীনতার কয়েক বছর আগের কথা। আমরা তখন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী। বোম্বের পার্টি (সিপিআই) অফিসে গিয়েছি। লাইব্রেরি ছিল নিচের তলায়, আলো খুব কম। সেখানে দেখি এক প্রবীণ ব্যক্তি প্রায়ান্ধকার ঘরে একমনে কতকগুলি বই নিয়ে পড়ছেন, কিছু নোট করছেন। বেশ কয়েকদিন দেখেছি, উনি একইভাবে পড়ে চলেছেন। কেমন একটা গম্ভীর কিন্তু শান্ত চেহারা। পরে জেনেছিলাম, উনি বিশিষ্ট পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন।”

সুনীল মুন্সীর এই স্মৃতিচারণার আগেই রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ঘুমক্কর শাস্ত্র’ (বাংলায় ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’) আর কৈশোরের সেরা বই ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ পড়ে ফেলেছি। অদম্য আকর্ষণ রাহুলের প্রতি। যা পাই, গোগ্রাসে গিলি। গত শতকের নয়ের দশকের শুরু। পাটনা থেকে জগন্নাথ সরকার সম্পাদিত ‘জনশক্তি’ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে এল। রাহুলের ‘দর্শন দিকদর্শন’ নিয়ে অসাধারণ একটি আলোচনা পড়ে আক্ষরিক অর্থে ‘ফিদা’ হয়ে গেলাম। মানুষটাকে জানার ইচ্ছা ক্রমেই বাড়তে লাগল।১৯৯৩-তে ‘কালান্তর’-এ রাহুলজীকে ‘মহাপরিব্রাজক’ আখ্যা দিয়ে প্রবন্ধ লিখি। তাঁর প্রতিলিপি আজ আর আমার কাছে নেই। এখন মনে হয় দাবি করতে পারি, মহাপরিব্রাজক লিখে ভুল করিনি।

পরিব্রাজক মানে যিনি পরিব্রাজনকেই জীবনের লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু নেহাৎ পর্যটনের জন্য নয়। কিছু একটা মহৎ লক্ষ্য নিয়েই তাঁর পথ চলা। কেউ কেউ সামান্য সময় চলেই থেমে যান, তিনি সফরকারী। যিনি আরও দীর্ঘদিন বা বেশ কয়েক বছর চললেন, তিনি পরিব্রাজক। আর, যিনি সব থাকা সত্ত্বেও সারা জীবনই চললেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে, জাগতিক কোনও কিছুই যাকে তাঁর সাধনা থেকে বিরত করতে পারলো না, তিনিই মহাপরিব্রাজক। রাহুল আক্ষরিক অর্থেই তাই। তাঁর সারা জীবনই এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে যাওয়া, এক নাম ছেড়ে আরেক নাম গ্রহণ করা, এক স্ত্রী ছেড়ে আরেক স্ত্রীতে গমন, এক রাজনীতি থেকে আরেক রাজনীতিতে প্রবেশ, এক দেশ থেকে আরেক দেশে গমন – চলা, শুধুই চলা। রাহুল সম্পর্কে ১৯৫১-র ফেব্রুয়ারিতে ভবানী সেনের একটি কবিতা প্রণিধানযোগ্য।

“ঘুম ভাঙো
আর
ভুল ভাঙো
গান করো
আর
কাজ করো
বেঠিক যত হিসেব-কিতেব
ঠিক করো সব ঠিক করো।

জীবন ভরে—
শেখো
কেবল শেখো।
বাধা পেলেই লড়ো।
মরো যদি
লড়ে লড়েই মরো।
চলো কেবল চলো
আগের দিকে চলো।

থামতে যদি হয় কখনো
শিখবে বলে থেমো
একটু থেমে, ভুলটা ভেঙে
সামনে আবার চলো।”

রাহুল সেটাই করেছেন। তৃপ্তি নেই। যা খুঁজছেন, তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জানতে চেয়েছেন, নিজের ভিতরে পেতে চেয়েছেন। এবং সেখানে মনে প্রশ্ন ভেসে আসলে, তার উত্তরের খোঁজে ফের চলেছেন। সারা জীবনে তিনি তখনই থেমেছেন, যখন তাঁকে কোনও ভুলের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। ‘একটু থেমে ভুলটা ভেঙে’ তিনি আবার এগিয়ে গিয়েছেন। সত্যের শেষ সীমা পর্যন্ত যেতে হচেয়েছেন বলেই তাঁর জীবনে শুধুই “বন্দরের বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ। পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা. আর চলিবে না।”

চলার শুরু তাঁর শৈশব থেকেই। জন্ম হয় ১৮৯৩-এর ৯ এপ্রিল তৎকালীন যুক্ত প্রদেশের (আজকের উত্তর প্রদেশ) আজমগড়ের পান্ধা গ্রামে মামাবাড়িতে।জন্মের সময় নাম দেওয়া হয় কেদারনাথ পাণ্ডে। কানিলা চকরপানুর গ্রামের শাক্ত মতাবলম্বী ব্রাহ্মণ গোবর্ধন পাণ্ডে ছিলেন তাঁর বাবা। কেদারনাথের যখন মাত্র ৯ বছর বয়স, তখন নিকটবর্তী গ্রামের পাঁচ বছরের মেয়ে সন্তোষীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ে, না পুতুল খেলা! প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র কেদারনাথ নিজেই জানতেন না বিয়ে মানে কী, সন্তোষীর তো কথাই নেই। একদিনও ঘর করেননি বউয়ের সাথে, তবু সেই বিয়েই তাঁকে ১০ বছর বয়সে ঘরছাড়া করল। পালিয়ে চলে এলেন নালন্দায়।

নালন্দায় তখন অনেকগুলি বৈষ্ণব মঠ, যেগুলি চালাতেন ভূস্বামীরা। তিনি সেখানে এসে দেখলেন, তাঁদের পারিবারিক শাক্ত মতের সঙ্গে অনেক ফারাক নালন্দার বৈষ্ণবদের। অথচ, উভয়েই দাবি করেন, তাঁরা হিন্দু। কেদারের মনে প্রশ্ন জাগে, কিসের ফারাক? কেন? শুরু করলেন মঠে বৈষ্ণব শাস্ত্রের পাঠ। এভাবে চলল বহুদিন। মঠে থাকাকালীন তাঁকে যন্ত্রণা দিল কৃষকদের উপর মঠের মালিক ভূস্বামীদের নিপীড়ন, কিষাণদের সঙ্গে প্রতারণা। যন্ত্রণা অনুভব করতেন নিজের ভিতরে, খুঁজছেন পথ, কীভাবে কিষাণদের জীবনকে বদলে দেওয়া যায়।

মঠের সন্ন্যাসী হিসাবে তাঁকে যেতে হতো কিষাণদের ঘরে ঘরে, শুনতেন তাঁদের জীবনযন্ত্রণার কথা। ভিতরে রক্তাক্ত হন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মঠাধ্যক্ষদের কথা শুনে। মঠের মালিকরা কংগ্রেস দলের সমর্থক। ইতিমধ্যে দেশে স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। মুজফফরপুরে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকির ঘটনা ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি, দিল্লিতে লর্ড কার্জনের উপর বোমার হামলা, আফগানিস্তানে প্রবাসী ভারত সরকার (হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ) গঠন, পেশোয়ার থেকে মিরাটের সেনাশিবিরে অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা, কলকাতার কাছে বজবজে কোমাগাতা মারু জাহাজের যাত্রীদের গণহত্যা এবং ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালা বাগের গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা তাঁকে নাড়িয়ে দিল। ১৯২০ সালে চম্পারণ সত্যাগ্রহের পর ১৯২১-এ তিনিও যোগ দিলেন কংগ্রেসে। কংগ্রেসের আন্দোলনে ভাষণ দেওয়া, সন্ন্যাসী বেশে রাজনৈতিক কাজে সালেমপুর যাওয়া, পারসায় রাজনৈতিক কাজ সংগঠন, রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বন্যাত্রাণ, কৃষকদের সভায় ভোজপুরী ভাষায় ব্রিটিশ-বিরোধী ভাষণ দিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতে থাকলেন। যা অবধারিত, তাই হল। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে বক্সার জেলে ছয় মাস বন্দি রাখল। ১৯২২ সালে জেল থেকে বেরিয়ে হয়ে গেলেন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি।

আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন, কিন্তু তাঁর মনের ভিতরে অজস্র প্রশ্ন। শাক্ত ও বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বের সমাধান তখনও পাননি। হিন্দু ধর্মের দুই ধারার মধ্যে তাঁর প্রশ্নের সমাধান না পেয়ে গেলেন কিষাণ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক বন্ধুপ্রবর আর্যসমাজের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর কাছে। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে যোগ দিলেন আর্যসমাজে। না বদলে হল রাম উদার সাধু। আন্দোলনের কারণে তিন বছর জেল খাটার সময়েই জেলে বসেই পবিত্র কুরআন শরীফ-এর সংস্কৃতে অনুবাদ করলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিহারে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ-এর সঙ্গে সংগঠনের কাজ করা শুরু করলেন। কিন্তু কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়েও তাঁর মনে নানা প্রশ্ন। কংগ্রেসের একদল তখন স্বরাজ পার্টি করেছে, আবার কংগ্রসের মধ্যেই একটা সমাজবাদী ভাবনার শিবির গড়ে উঠছে। একই দলে এত ভিন্ন মত, আবার তাঁদের যারা নেতা, তাঁরাই কিষাণদের নিপীড়ন করে! তিনি ভাবলেন, কোন পথে যাওয়া উচিত।

বেছে নিলেন নিপীড়িত অংশকেই। কৃষকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সঙ্গে পেলেন বিহারের কৃষক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতীম কার্যানন্দ শর্মা, আচার্য নরেন্দ্র দেবের মতো নিবেদিতপ্রাণ মণীষীদের। একসঙ্গে তাঁরা মুঙ্গেরের এক ঘরে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন কৃষকদের সংগঠন গড়বেন। জমির উপর চাষির অধিকার আদায় ও জমিদার-ভূস্বামীদের হামলা ঠেকাতে ১৯২৯ সালে এঁরাই তৈরি করলেন ‘বিহার প্রদেশ কিষাণ সভা’। ভারতের প্রথম কৃষক সংগঠন।

এর পাঁচ বছর পর তৈরি হল কংগ্রেস সোস্যালিস্ট ফোরাম। তিনি সেখানে যোগ দিলেন, পেলেন এন জি রঙ্গ, ইএমএস নাম্বুদিরিপদের মতো মানুষদের। তাঁরা দক্ষিণ ভারতের কৃষক আন্দোলনের সংগঠক নেতা। সিদ্ধান্ত হল, কৃষকদের দেশব্যাপী আন্দোলন ছাড়া ব্রিটিশদের থেকে দাবী আদায় স্পম্ভব নয় বলে একটা সর্বভারতীয় কৃষক সভার জন্ম দিতে হবে। ১৯৩৬-এ লখনউতে বসল কংগ্রেস অধিবেশন। সেখানেই গড়ে উঠল ‘সারা ভারত কৃষক সভা’ (এআইকেএস), যার সভাপতি হলেন আর্যসমাজের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। নেতৃত্বে এলেন কেদারনাথ ওরফে রাম উদার, এন জি রঙ্গ, নাম্বুদিরিপদ, কার্যানন্দ শর্মা, আচার্য নরেন্দ্র দেব, যদুনন্দন শর্মা, রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ, বঙ্কিম মুখার্জি প্রমুখ।

কৃষক সভার গঠনে ও আন্দোলন পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন ১৯২৫ সালে তৈরি কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন। ১৯৩৭-এ কেদারনাথ ওরফে রাম উদার যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪০ সালে মতিহারির কৃষক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন কমরেড রাম উদার। তাঁর কিছুদিনেরমধ্যেই দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাঁর পার্টি সদস্যপদ বাতিল হল।কিন্তু‘লড়ো, শুধুই লড়ো’তো তাঁর রক্তে, তাই বসে না গিয়ে পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে লেগে থাকলেন। কৃষক আন্দোলন করতে গিয়েদেউলি ও হাজারিবাগ জেলে বন্দীও থাকতে হয়। কিছুদিন পরে তিনি আবার পার্টির সদস্যপদ ফিরে পান।

ইতিমধ্যে তাঁর মনে আবার প্রশ্ন জাগছে আর্যসমাজের দর্শন ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তখন তিনি নামী হিন্দুদের কাছেও ব্রাত্য। আর্যসমাজেও দেখছেন নানা সীমাবদ্ধতা। ব্যবহারিক জীবনেও দর্শনের প্রয়োগে ধর্মাচারীদের বিপরীত কাজ তাঁকে সন্দিহান করে তুলেছে। নানা প্রশ্নের জবাব, যা শাক্ত মতে পাননি, বৈষ্ণবে পাননি, এবার আর্যসমাজেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। এই সন্ধানের গতি তাঁকে নিয়ে গেল অন্য দিশায়। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। মনের ভিতরে অনেকদিন ধরে সুপ্ত বহু প্রশ্নের উত্তর পেলেন। ধর্ম পরিবর্তন করে হলেন বৌদ্ধ। এবার নাম নিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। রাহুল অর্থাৎ বুদ্ধ-পুত্রের নাম। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েছেন, অর্থাৎ বুদ্ধপুত্র। সাংকৃত্যায়ন, যিনি কিছু সৎ কাজ, ভাল কাজ করতে চান। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েছেন, কিন্তু গাঢ় লাল চীবরে বৌদ্ধ ভিক্ষু হননি। একদিকে মার্কসীয় বস্তুবাদ, অন্যদিকে বৌদ্ধদর্শনকে পুঁজি করে জ্ঞানতপস্বীর জীবন কাটিয়েছেন। চেয়েছেন, বৌদ্ধদর্শনের মূলতত্ত্বকে পরের প্রজন্মের কাছে তুলে দিতে। মুক্তচিন্তক বলে ধর্মীয় গোঁড়ামিও তাঁকে ছুঁতে পারেনি।

শাক্ত থেকে বৌদ্ধ হওয়া এবং কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট হওয়ার এই যাত্রাই তাঁর গোটা জীবনের পরিব্রাজন নয়। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে জ্ঞানার্জনে তিনি চারবার পদব্রজে তিব্বত গেছেন। একবার গিয়েছেন পায়ে হেঁটে ভয়ঙ্কর মৃত্যুশঙ্কুল উপত্যকা ‘ভ্যালি অফ ডেথ’ পেরিয়ে, জীবন বাজি রেখে। যতবার গিয়েছেন, ততবার নিয়ে এসেছেন বিপুল বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশি। চারবার তিব্বত যাত্রায় তিনি আবিস্কার করেন ৩৬৮টির মত পুঁথি, যার অনেকগুলিই তিনি ভারতে এনেছেন। এছাড়া ৫৫টির মত পুঁথির আলোকচিত্রও তুলে এনেছেন। তিনি তিব্বত থেকে যেসব বই এনেছিলেন, সেগুলি কোনও না কোনও সময়ে ছিল নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। সেই সব পুঁথি ও দস্তাবেজ আনার জন্য তাঁকে ২২টি গাধা ভাড়া করতে হয়েছিল বলে জানা যায়। এই সব পুঁথি ও নথি আছে পাটনা মিউজিয়ামে ‘রাহুল’ বিভাগে। তিব্বত থেকে তাঁর নিয়ে আসা মূল্যবান সামগ্রীগুলিও আছে পাটনা মিউজিয়ামের সেই বিভাগে। আছে,১৬০০ পোড়ামাটির টালিতে লেখা ‘সিংহ সেনাপতি’ বইটির মূল নথি। পালি ভাষা থেকে বৌদ্ধশাস্ত্রেরঅনেকগুলি গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন রাহুলজি, যার মধ্যে বসুবন্ধু রচিত ‘অভিধর্ম কোষ’, ‘খুদ্দক পাঠ’, গুণপ্রভ রচিত ‘বিনয় সূত্র’, ‘মহাপরিনির্বাণসূত্র’ অন্যতম।

পালি ভাষা তিনি পড়তে পারতেন জলের মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখেছিলেন উর্দু ও সংস্কৃত। প্রথাগত শিক্ষাজীবনের সেখানেই ইতি টানলেও নিজের উদ্যোগে পালি ছাড়াও শিখেছেন হিন্দি, বাংলা, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি, রুশ, সিংহলি ভাষা। বিহারে থাকা ও রাজনীতি করার সময়ে ভোজপুরী ভাষা আত্মস্থ করেছিলেন এবং পরে এই ভাষায় ‘জাপানীয়া রাছছ’ (জাপানি রাক্ষস), ‘ই হামার লড়াই’, ‘দেশ রচ্ছক’[দেশ রক্ষক]-এর মতো আটটি নাটকও লিখেছিলেন। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় যাওয়াও তাঁর অনবরত জ্ঞানান্বেষণের নিদর্শন।

তার ৭০ বছরের জীবনে মাত্র ১০টি বছর কেটেছে তাঁর পৈতৃক ভিটেয়। বাকি ৬০ বছরের মধ্যে দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের কেটেছে ৪৫ বছর। এর মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, ইউরোপের নানা দেশ, চিন, নেপাল আর চার চারবার তিব্বত সফর। ভারতের বাইরে প্রথম যান রাশিয়ায় বৌদ্ধ শাস্ত্র পড়াতে। তারপর একই কারণে যান শ্রীলঙ্কায়। কয়েক মাস পড়ানোর পর তাঁর এই পেশা ভাল না লাগায় ফিরে আসেন। বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বহু ক্ষেত্রে গিয়ে অধ্যয়ন ও নিজস্ব খোঁজ চালাতে থাকেন। আবার ডাক পড়ে সমাজবাদী রাশিয়া থেকে। পার্টির অনুমতি নিয়ে গেলেন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায়। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয়বারের রাশিয়া সফর।

লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করার পর আলাপ হল ‘লোলা’ ওরফে এলেনা নারভের্তোভনা কোজেরভস্কায়া নামে এক বিদূষীর সঙ্গে। লোলা কেবল ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, সংস্কৃত ও ইংরেজী জানতেন তাই নয়, লিখতে পারতেন সংস্কৃতেও। রাহুল তাঁর সহযোগিতায় তিব্বতি-সংস্কৃত অভিধান রচনা করার সময়ে তাঁদের সখ্যতা প্রেমে পরিণত হল। রাহুল লোলাকে বিয়ে করলেন। তাদের ভালোবাসার সন্তানের নাম দেন ইগর। ইতিমধ্যে রাহুলজির প্রোজেক্টের কাজ শেষ, দেশে ফেরার সময় আসে। কিন্তু স্ট্যালিনের নেতৃত্ব রাহুলের সঙ্গে লোলা-ইগরের ভারতে আসার প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। চোখের জলে বিদায় নিয়ে আসতে হয় রাহুলজীকে। রাহুলের লেখা একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে ‘উত্তরপুরুষ’। বইটি এখন আর পাওয়া যায় না। কোনও লাইব্রেরিতে বা কখনও কোনও সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের স্তুপে পেলে পড়ে দেখবেন। রাহুলজীর নিজের এই জীবনের খানিক চিত্র পেলেও খুঁজে পেতে পারেন।

রাশিয়া থেকে ফিরে একবার পায়ে হেঁটে তিব্বত গেলেন। সেখান থেকে ফেরার পর জ্ঞানপিপাসায় নানা দেশ সফরে গেলেন। গেলেন ইরান।তাঁর ‘মধুর স্বপ্ন’ উপন্যাসে ইরানে সংগৃহীত জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন। সেখান থেকে ফেরার পর চতুর্থবারের জন্য গেলেন তিব্বত। নেপাল হয়ে ফেরার সময় দার্জিলিং-এ এসে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে সেখানেই চিকিৎসা নিতে হলো। সেই সময় তাঁকে দেখভাল করেছিলেন কমলা নামে এক তরুণী অধ্যাপিকা। বহুদিন লেগেছিল রাহুলজির শারীরিকভাবে সুস্থ হতে। লোলাকে ফেলে আসার পর মনের ক্ষত থেকেই গিয়েছিল। কমলা সেই ক্ষতে ভালবাসার প্রলেপ দিলেন।প্রেমে ভাসলেন রাহুল, বিয়ে করলেন। তাঁদের তিন সন্তান – দুই পুত্র জেতা ও জয়ন্ত এবং কন্যা জয়া।

এই যে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সফর, সন্তোষী থেকে লোলা হয়ে কমলায় থামা – এ সবের পিছনেও তাঁর সেই এক খোঁজ। অজানার উত্তর তাঁকে পেতে হবেই, অতৃপ্তির অবসান ঘটাতে হবেই। খোঁজ, খোঁজ আর খোঁজ। অনুসন্ধান, – জ্ঞানের, দর্শনের। হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য পথে একা মাইলের পর মাইল হাঁটছেন শুধু বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশির সন্ধানে – অতীশ দীপঙ্করের পর যা আর কেউ করেননি। ইরান থেকে বর্তমান বাংলাদেশের কিছু এলাকায় শুধু জানার পিপাসা নিয়ে ঘরসংসার ফেলে কেউ চষে বেড়াননি।

রাহুলজির লেখা বইয়ের তালিকা নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। একটি বইয়ের কথা শুধু বলা দরকার। বইটির নাম ‘সিংহ সেনাপতি’। রাহুলজি নিজেই লিখেছেন,বইটি তাঁর লেখা নয়, তিনি আক্ষরিক অনুবাদক মাত্র। লেখকের নিজেরই নাম ‘সিংহ’। নিজের কাহিনীই লিখছেন সিংহ। লিচ্ছবি গণের শিশুসন্তান সিংহ সার্থদের (বণিক) সঙ্গে কীভাবে তক্ষশীলায় গুরুগৃহে গেলেন অস্ত্রশিক্ষার জন্য, সেখানে গুরুগৃহের পরিবেশ, রীতিনীতি, তৎকালীন জনজীবন, গুরুকন্যাকে বিয়ে করে সিংহর ফেরার পথের নানা সঙ্কট, যুদ্ধ, ফিরে এসে লিচ্ছবি গণের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে লড়াই করে সেনাপতি পদাধিকারী সিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত বইয়ের কাহিনী। শেষ পর্বে সেনাপতি সিংহকে সেই গণরাজ্যের প্রধান অর্থাৎ ‘গণেশ’ পদে আরোহনের অনুরোধ আসছে। মনে রাখা ভাল, রাজতন্ত্রের প্রধান পদ যেমন রাজা, গণরাজ্যের প্রধান পদকে বলা হতো গণেশ। গণের পতি অর্থেই তিনি গণপতি। হস্তিমুখের দেবতা নন।

গণেশ পদে তিনি পারবেন কী না, ভরসা পাচ্ছিলেন না। সেই সময় আক্ষরিক অর্থে ‘সহধর্মিনী’ রোহিনীর অনুরোধে দ্বিধাগ্রস্ত সিংহ যাচ্ছেন পাশের এলাকার আমবাগানে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে এই গুরুতর বিষয়ে আলোচনার জন্য। সেই সন্ন্যাসীএকদা রাজপুত্র ছিলেন বা রাজকার্যে অভিজ্ঞ,সকলে বলেন। সেই সন্ন্যাসীটি স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ। পোড়া মাটির টালির এক একেকটিতে ৩৯টি করে শ্লোক লেখা ১৬০০ টালি রাহুলজি নিজেই ঘটনাচক্রে সন্ধান পেয়ে মাটির তলা থেকে আবিস্কার করেছেন। আক্ষরিক অনুবাদের পর সেগুলি দান করেছেন পাটনা মিউজিয়ামে। ইউরোপের কোনও দেশে হলে শুধু এই জন্য রাহুলজিকে মানুষ মাথায় করে রাখতো। আমাদের এই বাংলার বিদ্বজনের অনেকেই এই বইটির কথাই জানতেন না, আজও জানেন না। অথচ, বইটি বাংলাদেশে বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়ে দেদার বিক্রি হয়।

একদিন পণ্ডিত রামশরণ শর্মা তাঁর ঘনিষ্টমহলে রাহুলজিকে নিয়ে আলোচনায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরু পর্যন্ত রাহুলজিকে সমীহ করে চলতেন। তিনি একটি ঘটনার কথা বলেন। সময়টা সম্ভবত ১৯৬০ কি ১৯৬১। নেহরু জানতে পারেন, সাঁচির বৌদ্ধস্তুপের একটি কক্ষে প্রায়াপোবেশনে অধ্যয়ন করে চলেছেন রাহুলজি। চোখে তখন আর ভাল করে দেখতেও পান না। অন্ধকার ঘরে একটি আলোর নিচে তিনি সারাদিন অধ্যয়ন করেই চলেছেন। কখনও কেউ খাবার দিলে খান। নেহরু ভাবলেন, তাঁকে কিছু অর্থ সাহায্য দেওয়া যাক। তিনি সাঁচি পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বললেন। যাওয়ার সময় নিজের লেখা ‘ডিস্কভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইটি সঙ্গে নিলেন। সাঁচি স্তুপে সরকারি সফরের পর জিজ্ঞাসা করলেন, রাহুলজি কোন ঘরে আছেন। সরকারি সফরনামা এই ঘরে যাওয়ার কোনও পূর্বোল্লেখ ছিল না। তবু তিনি সেখানে গেলেন। পণ্ডিতজীকে দেখে রাহুলজি বিস্মিত। পণ্ডিত নেহরু রাহুলজীকে প্রণাম করে নিজের লেখা বইটি দিয়ে বলেছিলেন, “পড়ে দেখবেন। ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দিলে উপকৃত হবো’। নেহরু ফিরে আসার পর রাহুলজি বই খুলে হেসে ফেলেন। বইয়ের কিছু কিছু পাতার ভিতরে একশো টাকার নোট সযত্নে রাখা। রামশরণ শর্মা বলেছিলেন, পণ্ডিত নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রী হলেও সরাসরি রাহুলজিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার সাহস সাহস পাননি। তাই, বইয়ের পাতার আড়ালে লুকিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৩-তে রাহুলজিকে পদ্মভূষণ সম্মান দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

ঘটনাচক্রে, পদ্মভূষণ সম্মান পাওয়ার আগেই গুরুতর অসুস্থ হন রাহুলজি। তাঁকে নিয়ে আসা হয় দার্জিলিং-এর কাছারি রোডে রাহুল নিবাসে। পদ্মভূষণ গ্রহণ করার কিছুদিন পর, ১৪ এপ্রিল মারা যান রাহুলজি, আর পরের বছর জুলাইতে চলে যান নেহরুও।

তথ্যসূত্র:

১) অধ্যাপক সুনীল মুন্সীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার
২) মহাপরিব্রাজক রাহুল সংকৃত্যায়ন, কালান্তর, ১৯৯৩
৩) সারা ভারত কিষান সভার ইতিহাস
৪) রাহুলজি, দর্শন অউর দিকদর্শন, জনশক্তি, পাটনা, ১৯৯৩
৫) সিংহ সেনাপতি, চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা
৬) রামশরণ শর্মার স্মৃতিচারণ, কলকাতা, ১৯৯০-৯১
৭) রাহুল সাংকৃত্যায়ন – একটি বর্ণময় জীবন, গল্পের সময়
৮) উইকিপিডিয়া।

মন্তব্য তালিকা - “আজীবন মহাপরিব্রাজক রাহুল সাংকৃত্যায়ন”

  1. আমার প্রিয় লেখক। তার লেখা পড়ে ঋদ্ধ
    হয়েছি, জীবনাদর্শন বদলিয়ে গেছে। আরো
    পড়তে চাই, আরো জানতে চাই। তা ছাড়া
    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম
    তাই এ বিষয়ে আমার আগ্রহ বেশী –

  2. খুব খুব ভালো লাগলো রাহুল সঙ্কৃত্যায়নের ওপর মূল্যবান এই লেখা। আমাদের জ্ঞান পিপাসা মেটানোর জন্য আরেকটু বিস্তৃতি পেলে দারুন হোত। কি আশ্চর্য রকমের এই ব্যক্তিত্ব। কেন যে তাঁকে নিয়ে আরো লেখালেখি হয় না, দুর্বোধ্য লাগে।

    1. কৃষ্ণ বাবু, আপনি বিদগ্ধ মানুষ। রাহুলজীকে নিয়ে কোনও একটি নিবন্ধেই লেখা সম্ভব নয়। এমন এক ব্যক্তিত্বকে আময়াদের সামনে পরিচয়ই করানো হয়নি। তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের তো কথাই নেই।

  3. সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুবি ততঃেভরা। অনার ভল্গা থেকে গঙ্গা আমার একটি অন্ততম প্রিয় বই। অনার বিশয়ে বেশি জানতাম না। উপক্রিত হলাম

  4. খুবই সংক্ষেপে এক মহাজীবন-এর আলেখ্যরেখা। পরিচিত গ্রন্থগুলি ছাড়া একটি অন্য স্বাদের বই আছে আমার কাছে। মহামতি আকবরকে নিয়ে রাহুলজীর একটি অসাধারন কাজ। বাংলা অনুবাদে। আমি সাধারন শিক্ষার্থী। অনেক জানলাম। আরো অজস্র জানতে চাই। “ইতিহাস তথ্য ও তর্ক” সমীপে অসংখ্য প্রনিপাত।

  5. ওঁর মহামতি আকবর অসাধারণ একটি বই। স্ট্যালিনকে নিয়ে লেখা বইটিও দারুণ। যে বইটি পাওয়া যায় না, তার নাম ‘উত্তরপুরুষ’। আমি আজও বইটি পেলে কিনে নেব।

    1. আমার অনুরোধ, আপনি সিংহ সেনাপতি আর জয় যৌধেয় পড়ে দেখুন। ভাল লাগবে। তারপর অন্য বই পড়তে পারেন, যেমন কিন্নর দেশে, তিব্বতে সওয়া সাল, ইরানে ইত্যাদি

  6. অসাধারন।আগ্রহ বাড়ে আরও জানার।রাহুলজীর মহামতি আকবর এবং স্টালিন সম্পর্কে কোন আলোচনা পেলে ক্ষিদেটা আরো বাড়ে।সম্ভব কি?

  7. ভবঘুরের শাস্ত্র এর লেখক আমার স্বপ্নের নায়ক। তাঁর সম্বন্ধীয় লেখাটি খুব মনোগ্রাহী। অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

    1. ভবঘুরের পর? কিন্নর দেশে, তিব্বত, ইরানে, বহুরঙ্গী মধুপুরী, সিংহ সেনাপতি… পর পর পড়ে যান

  8. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ঋদ্ধ হলাম। নাম জানতাম। কিন্তু এত তথ্য জানতাম না। ভালো লাগলো।

  9. খুব উপকৃত হলাম পড়ে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর হিন্দিভবনে অধ্যাপনা করেছিলেন। এই সময়ে তাঁর জীবনী সম্পর্কে জানতে চাই। জানাবেন কোন গ্ৰন্থে পাব ?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।