রবীন্দ্রনাথের জনস্বাস্থ্য ভাবনা
পর্ব ১
রবীন্দ্রনাথ কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, গায়ক, অভিনেতা ইত্যাদি ছিলেন, তার ওপরে ছিলেন বড় মাপের একজন চিন্তাবিদ। শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর স্থানও আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। যে দিকটা আমরা কম জানি তা হল, গ্রাম-সংগঠনের জন্য তিনি জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলির এক বিরাট অংশ শিক্ষা ও পল্লী-উন্নয়ন নিয়ে লেখা। বিশ্বভারতী নিয়ে তিনি যখন লিখেছেন, সেখানেও এই দুটো বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর সমস্ত উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষা, এ-কথা বলাই যায়। এসবের বাইরেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ও ক্ষমতা বিভিন্ন দিকে তার শাখাবিস্তার করেছিল।
১৯২৯ সালে এক চিঠিতে তিনি প্রশান্ত মহলানবিশকে লিখেছিলেন, “তুমি তো জান আমি চিকিৎসাবায়ুগ্রস্ত …”। এটা নেহাত কথার কথা নয়। ডাক্তারি পাশ করেননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বহু ডাক্তারি বই তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন, আর নিজের ও আত্মীয়-বন্ধুর ওপরে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করা তাঁর প্রায় নেশাই ছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও গ্রামের গরীব মানুষদের ওপরেও নিয়মিতভাবেই ডাক্তারি করেছেন। মূলতঃ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন তিনি, তবে পরে বায়োকেমিক পদ্ধতি বেছে নেন।
অজানা কোনও কারণে চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষক ও প্রবন্ধকারগণ চর্চা কম করেছেন। তবে রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষের সময় থেকে বিগত দশ বছরে চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও দু-একটি বই চোখে পড়ল। কিন্তু তাতে জনস্বাস্থ্য প্রায় অনুচ্চারিত। জনস্বাস্থ্য ব্যাপারটা সাধারণ চিকিৎসার থেকে আলাদা। তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্রে আলাদা প্রবন্ধও সেরকম নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বলতে গিয়ে আমি তাঁর কয়েকটি লেখাপত্র, কর্ম ও চিন্তার কথা তুলে ধরব। এগুলি অপরিচিত কিছু নয়, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে এদের মূল্যায়ন হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়ন মডেল ও জনস্বাস্থ্য
রবীন্দ্রনাথের জনস্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে ভাবতে গেলে অবশ্যই তাঁর (জনের) স্বাস্থ্য নিয়ে লেখা ও বলা কথাগুলির গুরুত্ব রয়েছে। তিনি জনস্বাস্থ্য নিয়ে স্বয়ং যে কাজকর্ম করেছিলেন সেগুলির বিশ্লেষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। শান্তিনিকেতনে, বিশেষ করে শ্রীনিকেতনে, তিনি পল্লীগঠনের যে কাজ হাতে দিয়েছিলেন তার মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ক, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক, চিন্তাভাবনা কিছুটা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগ নিয়ে তিনি বহু আক্ষেপ করেছিলেন। ম্যালেরিয়া নিয়েই তাঁকে বহুবার খেদোক্তি করতে হয়েছে। তাঁর স্বভাবধর্ম তাঁকে কেবল আক্ষেপ আর খেদ করে স্থির থাকতে দেয়নি। তিনি নির্দিষ্ট কর্মসূচী নেবার চেষ্টা করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনের সিংহ সদন
রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়নের মডেলে স্বাস্থ্য উন্নয়ন একটি মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। এই মডেলটি আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর পরিকল্পনার একটা মৌলিক এলাকা ছিল স্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য কথাটা তখনও এমন চালু হয়নি, হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ওই কথাটাই ব্যবহার করতেন। তাঁর মডেল নিয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পল্লীউন্নয়নের গোড়াতেই কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার বলে তিনি ভেবেছিলেন ও পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মধ্যে রয়েছে আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, স্বাস্থ্য, পল্লী সংগঠন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের যে জায়গাগুলো আলাদা করে তৈরি করা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া বিতাড়ন, স্যানিটারি ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রসব (মা ও শিশুর যত্ন), কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম। প্রশিক্ষণের মধ্যেও রয়েছে ধাত্রী-প্রশিক্ষণ। সুতরাং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে কাজ করছিলেন তাই নিয়েই আলাদা করে নিবন্ধ রচনা করা যায়।
কিন্তু আমি বর্তমানে সে প্রচেষ্টায় যাব না। কারণ আমার ধারণা, জনস্বাস্থ্য-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আসল অবদান তিনি কী কী করেছিলেন, সেখানে নয়। তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তার পুরো ফসল কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানোর চেষ্টা তিনি নিজে করে যেতে পারেননি। ফলে চিন্তাভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর মধ্যে দিয়ে তার যে সংশোধন-পরিমার্জনার প্রক্রিয়া চলতে পারত তাও সম্ভব হয় নি। এমনকি সেইসব চিন্তার যৌক্তিক পরিণতি কী কী হতে পারে তা নিয়েও তিনি হয়তো পুরোটা তলিয়ে ভাবেন নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে শান্তিনিকেতনে কিন্তু তিনি অনেকটাই সে চেষ্টা করতে পেরেছিলেন। তাঁর শিক্ষাভাবনা কাজে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু স্বাস্থ্যভাবনা হাতেকলমে কাজে পরিণত হয়নি বললেই চলে।
“আমি দেশের কাজের মধ্যে একটি কাজকেই শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিয়েছিলুম; জনসাধারণকে আত্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠা দেবার শিক্ষা দেব বলে এতকাল আমার সমস্ত সামর্থ্য দিয়েছি । … অশক্তকে শক্তি দেবার একটিমাত্র উপায় শিক্ষা – অন্ন স্বাস্থ্য শান্তি সমস্তই এরই ‘পরে নির্ভর করে।” [‘রাশিয়ারচিঠি’]
সুতরাং তাঁর শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে ম্যালেরিয়া বিতাড়ন, স্যানিটারি ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রসব ও তৎপরবর্তীকালে মা ও শিশুদের যত্ন, কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম ইত্যাদিকেই কেবলমাত্র দেখলে চলবে না। তাতে ‘একটি গাছ দেখতে গিয়ে অরণ্যকে বিস্মরণ’ হয়ে যায়। অনেকেই শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান তৈরি, কোপাই-এর জলে আশ্রমের ছাত্রদের সাঁতার কাটানো, বা ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী থেকে ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’ খাওয়ানোর মধ্যে জনস্বাস্থ্যবিদ রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় খুঁজে পাবেন। বা নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাটা – “নিন নেপালবাবু, আপনার [আশ্রমের] ড্রেন তৈরির টাকা” – বলে দান করেছিলেন কিনা সে-বিতর্কের মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যভাবনার গুরুত্ব খুঁজবেন। আমি তাঁদের সঙ্গে তর্কে যাব না। আজকে আমি অন্য রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নেব তাঁর না-করা কাজের মধ্যে, মানুষ ও সমাজ নিয়ে তাঁর চিন্তার মধ্যে।
জনস্বাস্থ্যে জনগণের অংশগ্রহণ ও রবীন্দ্রভাবনা
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা নিয়ে যতটা আগ্রহ ছিল, যতটা হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ততটা ছিলনা। তার কারণ তিনি নিজেই স্পষ্ট করে বলে গেছেন। শিক্ষার যথার্থ ব্যবস্থা হলে মানুষ নিজেই নিজের ভাল করতে পারবে, আর সেটা সবচেয়ে বড় কথা। রবীন্দ্রের কাছে শিক্ষা হল সেই আলো যা মানুষকে তার নিজের কাজ করার ক্ষমতা দেয়। ব্রিটিশরাজ সেই শিক্ষা থেকে ভারতকে বঞ্চিত করে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাই কেড়ে নিয়েছে। সাইমন কমিশন ভারতের মানুষের ও সংগঠনের অনেক দোষ-ত্রুটি ধরে তারপর ইংরেজের এটুকু মাত্র দোষ কবুল করেছে যে, ভারতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সে-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, এ যেন চলতে ফিরতে হোঁচট খায় বলে কাউকে প্রচুর গালাগালি করে গলা খাটো করে বলা, ‘আমি অবশ্য ওর সব বাতি নিভিয়ে রেখেছি।’ [‘রাশিয়ার চিঠি’]
বিশ্বভারতীতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে অতি ছোট পরিসরে যেটুকু কাজ রবীন্দ্রনাথ করবার পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং কিছুটা করেওছিলেন, সেখানে তাঁর এই শিক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যে পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটি দেখতে পাওয়া কঠিন নয়। আজকের ভাষায় একে জনগণের ক্ষমতায়নের দিকে একটি পদক্ষেপ বলে ভাবতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনায় ধাত্রী-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁর পল্লীউন্নয়নের কাঠামোতে ধাত্রী-প্রশিক্ষণ রয়েছে গ্রামের মেয়েদের প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসেবে, সে-ব্যাপারটা অত্যন্ত অর্থবহ।
“আমাদের মাননীয় বন্ধু ডাক্তার গোপালচন্দ্র চ্যাটার্জী যে কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন এ যদি শুধু মশা মারার কাজ হত তা হলে আমি একে বড় ব্যাপার বলে মনে করতুম না। দেশে মশা আছে এটা বড়ো সমস্যা নয়, বড়ো কথা এই – লোকের মনে জড়তা আছে। সেটা আমাদের দোষ, বড়োরকমের দুঃখ-বিপদের মূল কারণ সেখানে। ওঁরা এ কাজ হাতে নিয়েছেন, সেজন্য ওঁদের কাজ সবচেয়ে বড়ো বলে মনে করি। গোপালবাবু উপকার করবেন বলে কোমর বেঁধে আসেন নি।” [‘ম্যালেরিয়া’, অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটিতে কথিত, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪]
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে (জন-)স্বাস্থ্য চিন্তার আসল উপাদান এই নয় যে ঠিক কতটা উপকার করে দিতে পারা গেল। আসল কথা হল, সেটা সমাজের নিজস্ব বস্তু হয়ে উঠল কিনা, সমাজ সত্যি সেই শিক্ষাটা নিতে পারল কিনা। এবং শিক্ষা গ্রহণের পরে সেটা নিজেই নিজের কাজে লাগাবার জন্য সমাজ কতটা তৈরি হয়ে উঠল।
পর্ব ২
জনস্বাস্থ্যের ধারণার বিকাশ, ব্রিটিশ ভারত ও রবীন্দ্রনাথ
জনস্বাস্থ্যের ধারণাটি চিরকালীন নয়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটেছে। সিন্ধুসভ্যতায় নগর-পরিকল্পনা ও পয়ঃপ্রণালীর নিদর্শন আছে। সুতরাং জনসাধারণের স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা অতি প্রাচীন। কিন্তু আধুনিক জনস্বাস্থ্যের ধারণা তার চাইতে অনেক দূরে। সম্রাট অশোক, শের শাহ বা আকবর জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবুও বলতে হবে, জীবন যাপনের সামগ্রিক ধারণা হিসেবে, আধুনিক অর্থে জনস্বাস্থ্যের জন্ম তার চাইতে অনেক পরে।
আমাদের দেশে আধুনিক অর্থে জনস্বাস্থ্য প্রথম রূপ পেতে শুরু করেছিল আক্রমণকারী ইউরোপীয় সেনা ও উপনিবেশ স্থাপনকারী বিদেশি প্রভুদের নিরাপত্তার তাগিদে। এদেশে মানুষের স্বাস্থ্য তথা জীবনের জন্য ইংরেজ শাসককুল যে ব্যবস্থা করেছিল সেটি কতটা কার্যকরী বা কতটা ভাল ছিল সে-ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া কঠিন, হয়তো নিরপেক্ষ অবস্থানের ধারণাটিও অবাস্তব। সেসময়ে এদেশের জনস্বাস্থ্যের প্রধান শত্রু ছিল ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা করে স্যার রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর অবদান ছাড়া ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই দিশাহীন হয়ে যেত। তাঁর অবস্থান বিচার করলে বোঝা যাবে, প্রায় একই সময়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছিল, রস-এর তা নজরে আসেনি।
ব্রিটিশ শাসন যে এদেশে প্রায় স্বর্গরাজ্য এনে দিয়েছে, রসের কাছে সেটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল। তাঁর ভাষায়, ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে এনেছে “সততা, আইন, ন্যায়বিচার, রাস্তা, ডাকব্যবস্থা, রেলপথ, সেচ, হাসপাতাল … এবং সভ্যতার জন্য যেটা একান্ত দরকার সেই চূড়ান্ত ওপরতলার কর্তৃত্ব।” (রস, ১৯২৩) কথাটা রস-এর কাছে মোটেও মিথ্যে ছিল না। রস-এর উক্তির কিছুদিন পরে ভারতীয় মার্কসবাদী রজনী পাম দত্ত বললেন, “… শহরে ও গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য সাধারণ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গণ-পরিচ্ছন্নব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য এত কম যে তাকে নেই-ই বলা যায়।” (দত্ত, ১৯২৩) কিছু ভুল বলেন নি রজনী পামও। “কাদের স্বাস্থ্য?” এই প্রশ্নে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক ছিল। কাদের কেন্দ্রে রেখে, কাদের জন্য, কাদের দ্বারা (জন) স্বাস্থ্যব্যবস্থা? বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জীবনের পুরোটা জুড়ে, জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থা কীভাবে ও কতটা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছিল? জনমানসে তার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার আলোচনায় এটি অতি প্রাসঙ্গিক।
ব্রিটিশ শাসনেই প্রথম আধুনিক অর্থে জনস্বাস্থ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। কিন্তু সত্যিকারের ‘জন’-কে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রেখে সেই ‘জন-স্বাস্থ্য’ গড়ে তোলা হয়। ভারতের নাগরিক তখনও কেউ ছিল না, ছিল মহারাণীর অভাজন প্রজা। এই ‘জনস্বাস্থ্যে’ তারা ছিল বহিরাগত। তাদের যার শেষ রক্তবিন্দু শুষে নিয়ে সমগ্র সভ্যতার ইমারত তৈরি হয়েছিল। ‘জনস্বাস্থ্যের’ ইমারত তার ব্যতিক্রম ছিল না। সে ইমারতে ‘জন’-এর প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।
কিন্তু সেই ইমারত ছিল স্যার রোনাল্ড রস সাহেবের কাছের লোকেদের একান্ত নিজস্ব। ডেভিড আর্নল্ড বলেছেন, ডাক্তারি ও গণ-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা পেত কেবল ইউরোপীয় বসতিগুলো। বাকিদের জন্য ছিল একেবারে নিঃস্ব ও অনভিজ্ঞ স্থানীয় পুরবিভাগ ইত্যাদি অকেজো সংস্থা। ‘কলোনিয়াল মেডিসিন’ বা ‘ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান’ এখন যথেষ্ট বিকশিত ইতিহাস ও বিজ্ঞান চর্চার এক ক্ষেত্র। তার পণ্ডিতেরা একবাক্যে বলেন, সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্বাস্থ্যনীতির একটা ধাঁচা উপনিবেশগুলিতে আসত। কিন্তু হাবভাব এমন করা হত যেন উপনিবেশের সমস্ত মানুষের জন্য স্বর্গ তৈরি করা হচ্ছে, বা রস-এর ভাষায় “সভ্যতার জন্য যেটা একান্ত দরকার” তার সবই পাওয়া গেছে। কিন্তু আসলে কলোনিয়াল স্বাস্থ্যনীতি ইংরেজ আর তার সেনাবাহিনীর জন্যই কেবল তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে নিতান্ত প্রয়োজনীয় ফাউ হিসেবে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার ও স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত এদেশীয় কিছু মানুষের কাজে লেগেছিল।
একথার অনুসিদ্ধান্ত কিন্তু এই নয় যে, সেই সময়ে জনসাধারনের স্বাস্থ্য যতটা খারাপ ছিল তার পুরোটার জন্যই দায়ি হল ব্রিটিশ। আপাত-স্ববিরোধী ব্যাপার হল, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গণ-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রচেষ্টায় নিজস্ব উদ্যোগ ভারতীয়দের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত ছিল। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের সামান্য ইতিবাচক প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করা হত না, বা বহু ক্ষেত্রে সক্রিয় বিরোধিতা করা হত। রবীন্দ্রনাথ এটাতে অত্যন্ত পীড়িত বোধ করেছিলেন। অবশ্য সরকারের ইতিবাচক প্রচেষ্টায় সহযোগিতা না করার একটা কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ভালই জানতেন। সরকার প্রায়ই জোর করে সহযোগিতা আদায় করার চেষ্টা করত। ব্রিটিশরা দেশীয় রীতিনীতি সম্পর্কে ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের মনোভাব পোষণ করত, আর সেই মনোভাব লুকানোর চেষ্টাও তেমন করত না। ফলে তারা দেশীয় রীতিনীতি ও প্রথার ওপর আঘাত করত, আর ভারতীয়রা স্বভাবতই তাদের ভাল কাজগুলোও সৎ উদেশ্য-প্রণোদিত বলে ভাবতে পারত না। অন্যদিকে, ব্রিটিশ এদেশে আসার আগে পুণ্য-অর্জন বা সামাজিকতার খাতিরে যে যৎসামান্য ‘সামাজিক ব্যয়’ এদেশের রাজারাজড়া, জমিদার-জায়গীরদার, শ্রেষ্ঠিরা করতেন -তা জনস্বাস্থ্যের কাজে লাগত। সেই ব্যয় রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে ক্রমশ কমে আসছিল। এই ‘সামাজিক ব্যয়’-এর প্রেক্ষিতটি আমরা পরে আবার ফিরে দেখব
জনস্বাস্থ্যে পেশিশক্তি ও রবীন্দ্রনাথ
ইংরেজদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ ছিল, তাদের গায়ের জোরটা বড্ড বেশি, সব কিছুই তারা গায়ের জোরে করতে চায়। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্য এদেশের লোকের ভাল করা। সেখানেও সরকারি পেশিশক্তির প্রদর্শনটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। অবশ্য সেনাবাহিনীকে মডেল করে দেশে জনস্বাস্থ্যের শুরু হওয়ার জন্য হয়তো তার ধাঁচাটাই পেশিশক্তি নির্ভর হয়ে গিয়েছিল।
প্রদীপ বসু লিখেছেন—“অবশ্য এদেশে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তার সূত্রপাত হয় সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে। … ১৮৬৪ সালের সংক্রামক ব্যধি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সৈন্যদের কথা মনে রেখেই। কলকাতায় তখন বেশ বড় সৈন্যশিবির ছিল, এবং আইনের বলে পঞ্জিকৃত বারবনিতাদের কাছেই শুধু সৈন্যদের যাবার অনুমতি ছিল। লক হাসপাতালে এই বারবনিতাদের পরীক্ষা এবং পঞ্জিকরণ হত এবং পুলিশ যে নিয়মিত ধরপাকড় করে এদের নিয়ে আসত …।”“১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে কোম্পানির অধীন ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশের যুদ্ধবিগ্রহে মৃত্যু হয়, বাকিদের গ্রাস করে ম্যালেরিয়া জাতীয় অসুখ, রক্ত-আমাশা, উদরাময়, যকৃতের অসুখ ও কলেরা … ফলে … জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে। হিন্দুদের তীর্থ, মেলা, উৎসব উপলক্ষ্যে জনসমাগম যে সংক্রামক রোগজীবাণুর ঘাঁটি এবং বহু মহামারীর উৎপত্তিস্থল এ-ব্যাপারে ইংরেজরা মোটামুটি নিঃসংশয় ছিলেন।”
কুম্ভমেলা আর পুরীর রথযাত্রাকে কলেরার বড় উৎস ভাবতেন ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিরা। তাই ১৯১৪ সাল নাগাদ কলেরার টিকা নিয়ে যখন জোর জবরদদস্তি শুরু হল তখন এই দুটো অনুষ্ঠানের ওপর হাত পড়ল। ১৯৩০-এর এলাহাবাদ কুম্ভমেলা থেকে কলেরা রোগী ও টিকাবিহীনদের আলাদা করে সরিয়ে রাখার জন্য জোর জবরদস্তি শুরু হল। আবার গুটিবসন্তের ক্ষেত্রেও দেশীয় মানুষের সঙ্গে সরকারের সংঘাত বাধে। সরকার জেনার প্রবর্তিত টিকা দেবার আগে দেশীয়রা, বিশেষ করে হিন্দুরা, একরকম দেশীয় টিকা দিতেন। টিকাদারেরা মানুষের গুটিবসন্তের রস ও মামড়ি শুকিয়ে সেটাকেই টিকা হিসেবে ব্যবহার করতেন। অনেক সময় শীতলাপূজো বা অন্যরকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করে দেশীয় টিকা দেওয়া হত। জেনারের টিকার সঙ্গে এই পুরনো টিকার সংঘাত বাঁধল। এসবই ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে।
প্লেগের ব্যাপারেই সরকারি দমননীতির সব থেকে উগ্র প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। ১৮৯৭ সালে সরকার সারা ভারতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক ভয়ঙ্কর আইন জারী করে। রবীন্দ্রনাথ তখন মধ্য-তিরিশে। রোগ সন্দেহে পৃথকীকরণ, রোগে দূষিত সম্পত্তি নষ্ট করা, সন্দেহ হলেই সড়ক, রেল, এমনকি বাড়ি গিয়ে খানাতল্লাসি করা, এমনকি বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা— সরকারি কর্মচারীদের এসব অধিকার দেওয়া হয়। স্বভাবতই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে। কলকাতা শহরেও মেথর, মজুর ও ভিস্তিওয়ালারা ধর্মঘট করে। শহর নরক হয়ে ওঠে, দলে দলে লোক পালাতে থাকে। প্লেগের চাইতে সরকারি ‘পিলেগ-গাড়ি’র শব্দ মানুষের মনে বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করতে থাকে।
পাশ্চাত্য মেডিসিনে দেহকে রোগ ও চিকিৎসা—এই দুয়ের মুখোমুখি সংঘর্ষের এক নিস্ক্রিয় পশ্চাৎপট হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা ছিল। তা রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্য মেডিসিনের প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল। পাশ্চাত্য মেডিসিন একদিকে জোর করে (নিষ্ক্রিয়) সমাজদেহ থেকে প্লেগ ইত্যাদি মহামারী দূর করতে চাইছে, অন্যদিকে (নিস্ক্রিয়) মানবদেহ থেকে ওষুধ-অপারেশনের জোরে রোগজীবাণু দূর করতে চাইছে। পাশ্চাত্য মেডিসিন তথা অ্যালোপ্যাথির তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেহকে বা সমাজদেহকে এক নিস্ক্রিয় পশ্চাৎভূমির চাইতে বেশি গুরুত্ব পেত না। এ-দুটো ঘটনা রবীন্দ্রনাথের কাছে খুব সম্ভবত পরস্পর সম্পর্কিত হয়েই প্রতিভাত হয়েছিল। এবং সত্যি সত্যিই এই সমাপতন পাশ্চাত্য মেডিসিনের দর্শনে নেহাত আকস্মিক নয়।এর বিপরীতে, যখন রবীন্দ্রনাথ জনস্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন বা জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রকল্প হাতে নেন, তাঁর কথায়-কাজে বারবার সমাজদেহকে সক্রিয় অংশীদার করার প্রচেষ্টা ফুটে ওঠে।
“এখানে বলবার কথা এই, তোমরা দুঃখ পাচ্ছ, সে দুঃখ যতদিন নিজের চেষ্টায় দূর না করতে পারবে ততক্ষণ যদি কোনো বন্ধু বাহির থেকে বন্ধুতা করতে আসে তাকে শত্রু বলে জেনো। কারণ তোমার মধ্যে যে অভাব সে তাকে চিরন্তন করে দেয়, বাহিরের অভাব দূর করবার চেষ্টা দ্বারা। … যাকে পল্লীসেবা বলা হয়েছে, তার অর্থ তোমরা একত্র সমবেত হয়ে তোমাদের নিজের চেষ্টায় তোমাদের দুঃখ দূর করো।” [‘ম্যালেরিয়া’, অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটিতে কথিত, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪]
গায়ের জোরে আইন করে বাইরে থেকে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করার প্রক্রিয়া এখন পাশ্চাত্য মেডিসিনের মূল স্রোত নয়। আজকের স্বীকৃত ঝোঁক হল সমাজের মধ্য থেকে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে, সামাজিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো। আধুনিক জনস্বাস্থ্যের স্বীকৃত রূপ এরকম হলেও সর্বত্র কাজে পরিণত করা হচ্ছে না। যেমন আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য আলোচনা এখন ভোটের তরজায় কে কাকে কতটা ‘পাইয়ে দিচ্ছে’ সেই বিতর্কে এসে ঠেকছে। কেন এমন হচ্ছে সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের কাছে কাজের কথা হল, জনস্বাস্থ্য নিয়ে সমাজদেহকে সক্রিয় অংশীদার করার রাবীন্দ্রিক প্রয়াসটি আজ তাত্ত্বিকভাবে পাশ্চাত্য মেডিসিনের তথা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বীকৃত অংশ।
পর্ব ৩
জনস্বাস্থ্যের সামাজিক প্রেক্ষিত ও রবীন্দ্রনাথ
সমাজের উন্নতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা সম্পর্কে দুটি সাধারণীকরণ করা যায়।
প্রথমতঃ, শিক্ষাই প্রাথমিক উপায়।
দ্বিতীয়তঃ, বাইরে থেকে ভাল করার শেষ নেই। তা দাতাকে তৃপ্তি দেয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে উপকৃতের সত্যিকারের ভাল হয় না, বরং তার সর্বনাশ স্থায়ী রূপ পায়। দরকার হল শিক্ষা দিয়ে গ্রহীতাকে স্বাবলম্বী করে তোলা।
স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের কাজ ও চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ‘শিক্ষা’। জনস্বাস্থ্য নিয়েও তাঁর চিন্তার মূল জায়গাটা ছিল জন-এর শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা মানুষকে স্থায়ীভাবে পরনির্ভর করে না, যা তাকে স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজটুকু অন্তত নিজে করে নিতে শক্তি যোগায়। নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে নিতে সক্ষম করার মত শিক্ষা।
কিন্তু এটাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তার একমাত্র দিক নয়। তাঁর চিন্তায় আরেকটি দিক ছিল যাকে এর প্রায় বিপরীতমুখী বলে মনে হয়। সেই দিকটি হল, প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে ধর্ম ও সামাজিক সংগঠন বড়মানুষের ওপর কিছু উপকার করার দায় চাপিয়েছিল। ব্রিটিশের দ্বারা ওপর থেকে করে দেওয়া জনহিতকে রবীন্দ্রনাথ সুনজরে না দেখলেও, এদেশীয় বড়মানুষের দায় পালনকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন বলা যায়।
ব্রিটিশ এদেশে আসার আগে পুণ্য-অর্জন বা সামাজিকতার খাতিরে যে যৎসামান্য ‘সামাজিক ব্যয়’ এদেশের রাজা-রাজড়া, জমিদার-জায়গীরদার, শ্রেষ্ঠিরা করতেন; তাঁর জন্মের আগে থেকেই সে ব্যয় ক্রমশ কমে আসছিল। বড়লোকেরা তাদের পারলৌকিক সুবিধের আশাতে অর্থব্যয় করছেন, এটা তিনি মেনে নিতেন। তারপরেও তিনি বলতেন, তাতেই সামাজিক হিতসাধন হচ্ছে, আর এতদিন এভাবেই ভারতবর্ষ বেঁচে বর্তে ছিল। ব্রিটিশ আগমনে বড়োলোকের ‘সামাজিক ব্যয়’ কমে গেল, নিজের আর্থিক উন্নতি মুখ্য, এমনকি একমাত্র হয়ে দাঁড়াল। ধর্মের নামে তার এতদিনকার চলে আসা খরচাটা নিছক বাজে খরচ মনে করে সে তা বন্ধ করে দিল।
“যারা সেকালে কীর্তি অর্জন করতে উৎসুক ছিল, যাঁরা উচ্চপদস্থ ছিলেন, তাঁদের উপর দেশের লোক দাবি করেছে। তাঁরা মহাশয় ব্যক্তি – তাঁদের জল দেবার … আরো অন্যান্য অভাব মোচন করে দেবার দাবি করেছি – তাঁদের পুরস্কার ছিল ইহকালে কীর্তি ও পরকালে সদগতি।” [‘ম্যালেরিয়া’, অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটিতে কথিত, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪]
“বেশিদিনের কথা নয়, নবাবি আমলে দেখা গেছে, তখনকার বড়ো বড়ো আমলা যাঁরা রাজদরবারে রাজধানীতে পুষ্ট … অর্জন করেছেন শহরে, ব্যয় করেছেন গ্রামে। মাটি থেকে জল একবার আকাশে গিয়ে আবার মাটিতেই ফিরে এসেছে, নইলে মাটি বন্ধ্যা মরু হয়ে যেত। আজকালকার দিনে গ্রামের থেকে যে প্রাণের ধারা শহরে চলে যাচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে তার দেনাপাওনার যোগ আর থাকছে না।” [‘পল্লীপ্রকৃতি’, ফেব্রুয়ারী ১৯২৮]
লক্ষ করার যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সঙ্গে ‘সামাজিক ব্যয়’-এর একটা সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন। বিষয়টা যে গণ-অধিকারের বিষয়, একে যে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে, সেটা তিনি মনে করছেন না। তাঁর কাছে এ ক্ষেত্রে রাজনীতি অতি সংকীর্ণ, রাষ্ট্রনীতি মাত্র। কিন্তু রাজনীতি তো শুধুমাত্র রাষ্ট্রনীতি নয়, রাজনীতি হল ক্ষমতা বজায় রাখার প্রকরণ। কেবল গায়ের জোরে তক্ত দখল করলেই চলে না, নিঃস্ব মানুষের ওপর রাষ্ট্রের বিবিধ ভার চাপাতে হয়। তাদের যথাসম্ভব কম দিয়ে যথেষ্ট দেবার ঠাট বজায় রাখলে রাষ্ট্রযন্ত্র মসৃণভাবে চলে। সভ্যতার পিলসুজ যারা বইছে তারা মাথা চাড়া দিলে ওপরতলার সবার সমস্যা। তাই নীচে থাকা মানুষদের ভুলিয়ে রাখতে হয় ধর্মের বেশে। কেননা ধর্মের মার আরামের মার, সে শুধু মারে না, সে ভোলায়ও। রবীন্দ্রনাথ সেটা অন্য কারো চাইতে কম জানতেন না। কিন্তু তবু তিনি ভেবেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসনের প্রত্যক্ষ ফল যে শাসকের কৃপাদৃষ্টি, তার দান, সেটার ওপরেই ভরসা করে একদা পল্লী বেঁচে ছিল। ব্রিটিশ-বণিকতন্ত্রে বড়মানুষ সেই কৃপার দান করে না বলেই দুর্গতি জন্মেছে। বড়মানুষ গ্রামে বাস করলেই গ্রামে খানিকটা স্বচ্ছলতা স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুণ্যার্জনের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি আর জনস্বাস্থ্যকে সরাসরি জুড়ে দিলেন। ভাবলে কিঞ্চিৎ আশ্চর্যই লাগে। মনে হয় নিজে বড়মানুষ হিসেবে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা তিক্ত ছিল বলেই তিনি বড়লোকের দান দিয়ে দরিদ্রকে ভোলানোর স্বরূপটি দেখতে পাননি, বা দেখতে চাননি।
“আমাদের দেশে পুণ্যের লোভ দেখিয়ে জলদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতএব যে লোক জলাশয় দেয় গরজ একমাত্র তারই। এইজন্য যখন গ্রামের লোক বললে, ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ তখন তারা এই কথাটাই জানত যে, এ ক্ষেত্রে যে মাছটা ভাজা হবার প্রস্তাব হচ্ছে সেটা আমারই পারত্রিক ভোজের, অতএব এটার তেল যদি তারা জোগায় তবে তাদের ঠকা হল। এই কারণেই বছরে বছরে তাদের ঘর জ্বলে যাচ্ছে, তাদের মেয়েরা প্রতিদিন তিন বেলা দু-তিন মাইল দূর থেকে জল বয়ে আনছে, কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত বসে আছে যার পুণ্যের গরজ সে এসে তাদের জল দিয়ে যাবে।” [‘পল্লীর উন্নতি’, মার্চ ১৯১৫]
কিন্তু সমাজনীতি ধর্মপালন এসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো আকাশকুসুম তো নয়। পুকুর কেটে জলদানের পুণ্য অর্জন করে যে জমিদার, ব্যক্তিগতভাবে তার মনে যাই থাকুক না কেন, যে সব ধর্মপ্রণেতারা ‘জলদান অতি পুণ্যকর্ম’ এমন অনুজ্ঞা চালু করেছিলেন তাঁরা জ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা জানতেন, যাদের শ্রম আত্মসাৎ করে রাজাগজারা তক্তে বসে আছেন, তাদের ভুলিয়ে রাখতে হবে। ভোলানোর যে ক’টি কায়দা আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে বোধ করি ধর্ম সবচেয়ে পুরনো হয়েও এখনও ভারী কার্যকর। ধর্ম তো শুধু পুরুত-পাণ্ডা-মোল্লার বেশে ভোলায় না, তা ভোলায় জমিদারের পুকুর কাটার পুণ্যকর্মের মধ্যে দিয়ে, পুজো-আচ্চার পরে দরিদ্র-নারায়ণের জন্য মহাভোজের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম’ [তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১।১১৩]। কিন্তু শ্রদ্ধায় হোক বা অশ্রদ্ধায়, ন্যায্য পাওনা না দিয়ে মাঝে মধ্যে ‘দরিদ্র নারায়ণ’ বলে শ্রদ্ধাপ্রকাশ আসলে দরিদ্রকে ভোলানো। আপন কর্মের অধিকারী হিসেবে তাদের দাবি রয়েছে জমিদারের কাটানো পুকুরে, কাঙালভোজন বা দরিদ্র-নারায়ণ সেবায়। তাদের দাবি রয়েছে সমস্ত সামাজিক সম্পদে। রাজাগজা দাতাবেশীরা পরান্নভোজী পরজীবী মাত্র। যারা ধনীর সম্পদ সৃষ্টি করে তারাই দাতা-ধনীর দান গ্রহণের ফলে ভিক্ষুকে পরিণত হয়।
অথচ এইটাই একমাত্র রবীন্দ্রনাথ নন। আরেকজন রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি স্বচ্ছদৃষ্টিতে দেখতে পান সংগঠিত ধর্ম আর দয়াধর্ম হল একই রাজনীতির এপিঠ ওপিঠ। তার কোনও একটির বশবর্তী হলে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। রাশিয়ার চিঠিতে তিনি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় সে কথা লিখছেন।
“ঠিক আমাদেরই দেশের জন-মজুরদের মতোই নিরক্ষর নিঃসহায় নিরন্ন … তাদেরই মত অন্ধসংস্কার এবং মূঢ় ধার্মিকতা। দুঃখে বিপদে এরা দেবতার দ্বারে মাথা খুঁড়েছে; পরলোকের ভয়ে পান্ডাপুরুতের হাতে এদের বুদ্ধি ছিল বাঁধা … যারা এদের জুতোপেটা করত তাদের সেই জুতো সাফ করা এদের কাজ ছিল।” [‘রাশিয়ার চিঠি’]
রাজনীতিকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রনীতি বলে ভাবলে, তাকে এড়িয়ে গিয়ে, সমাজের মধ্যে দরিদ্র মানুষের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেবার সমস্যা আছে। কেননা অর্থ-ক্ষমতা-সমাজ-শিক্ষা-ধর্ম-রাষ্ট্র সবই যে জটিল রসায়নে সম্পর্কিত তারই চলতি নাম হল রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাকে খানিকটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর অপরিসীম মনীষা ও সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে সাময়িক কিছু সফলতা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতা ও নেশন স্টেটের গড়ন ও আদর্শ তাঁর শিক্ষা ও সামাজিক আদর্শকে আত্মসাৎ করে ফেলল। ফলে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে যে আত্মনির্ভর পল্লী-উন্নয়নের আদর্শ কিছুটা রূপায়িত হয়েছিল সেটা ভারতের ‘রোল মডেল’ হবার বাস্তবতা তৈরিই হল না। দান-ধ্যানের ঘাড়ে চেপে সে মহাযজ্ঞ হবার কথাও নয় বোধ হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় কিন্তু কোনোরকম ফাঁকি ছিল না। তিনি নিজে টাকা ধার করে, তাঁর প্রবল কর্মশক্তি ব্যয় করে, তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে যেটুকু করতে পেরেছিলেন সেটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। গড়পড়তা লোকে এ কাজ পরে আর করে উঠতে পারেনি, এমনকি চালিয়ে যেতেও পারেনি। পারার কথাও নয়।
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে তাঁরই চিন্তার প্রতিধ্বনি তুলল যেন। পরের পর্বে আসব সে কথায়।
পর্ব ৪
জনস্বাস্থ্যের আধুনিক ধারণা ও রবীন্দ্রনাথ
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে আলমা-আটা শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছিল ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ আনা হবে। রাষ্ট্রসংঘের এক শাখা সংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার সেদিনের ঘোষণাপত্রের ভাষা অতীব সাহসী ছিল বলা যায়। কিছু মানুষের সন্দেহ তাতে ঘোচেনি। কিন্তু মোটের ওপর সারা পৃথিবী জুড়ে এই (অধুনা নিহত!) উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি অনেক আশা আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। আজ তার তেতাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। কেউ কথা রাখেনি। তবু ওই অধিবেশনের ঘোষণাটি জনস্বাস্থ্য বলতে আধুনিক কালে কী বোঝায় তার মাপকাঠি দিয়েছে। এ-ঘোষণাকে এযুগের মানুষের ন্যায়বোধের এক ধারণার প্রকাশ হিসেবে ধরা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অর্জনের জন্য ঠিক কী কী করতে হবে, এবং কারা সেটা করবে, তার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট দিশা ঘোষণাপত্রে পাওয়া যায়।
আলমা-আটা অধিবেশন
সকলের জন্য স্বাস্থ্য – ঘোষণাপত্র
“স্বাস্থ্য কেবলমাত্র অসুখ বা বিকলাঙ্গতার অনুপস্থিতি নয়, বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।’’
“জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।’’
“একটা গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা…পাওয়া যেতে পারে…পৃথিবীর সম্পদের পূর্ণতর ও মহত্তর ব্যবহারের দ্বারা…যার বৃহৎ অংশ এখন অস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে…”
আলমা-আটা শহরে ঐ অধিবেশনে বলা হয়েছিল যে, “স্বাস্থ্য কেবলমাত্র অসুখ বা বিকলাঙ্গতার অনুপস্থিতি নয়, বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।’’ [অনুবাদ লেখকের]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থায় বিরাট পার্থক্য আছে। এমনকি একই রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন মানুষের স্বাস্থ্য পাবার ব্যবস্থায় পার্থক্য কিছু কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এতদূর পর্যন্ত বলেছিল যে, মানুষের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনেই স্বাস্থ্যের নিজস্ব ক্ষেত্র ছাড়াও সমাজ ও অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে।
কথাটা কিঞ্চিৎ বিশদে বলার দরকার রয়েছে। এই ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের, অন্যদিকে এ-কথাও বলা হয়েছিল, “জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।’’ এ যেন রবীন্দ্রনাথের চাইতেও এককাঠি বাড়া। তিনি বলেছিলেন, ভিক্ষার ওপরে শুধু জনসাধারণের কল্যাণ নির্ভর করবে না।
“আজ এই কথা পল্লীকে বুঝতেই হবে যে, তোমাদের অন্নদান জলদান বিদ্যাদান স্বাস্থ্যদান কেউ করবে না। ভিক্ষার উপরে তোমাদের কল্যাণ নির্ভর করবে এতবড়ো অভিশাপ তোমাদের উপর যেন না থাকে।” [রবীন্দ্রনাথ, ‘পল্লীর উন্নতি’, মার্চ, ১৯১৫]
আর আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, ভিক্ষার ওপর জনস্বাস্থ্য নির্ভর করবে না। শুধু তাই নয়, (জন) স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনসাধারণের হকের কড়ি, আর সে কড়ি কীভাবে খরচা করা হবে সেটা দেখভাল করবার মধ্যে দিয়ে জনগণ নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলবে, আপনার সবচেয়ে ভাল হয় কিসে সেটা আপনি ঠিক করবেন।
রবীন্দ্র-জনস্বাস্থ্য ভাবনার আধুনিক রূপায়ণ
প্রশ্ন আসে আজকে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ – এনিয়ে কথা তুলছি কেন? আমার প্রবন্ধ তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তাঁর চিন্তা তাঁর কর্মকে নিয়ে, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কিভেবেছিলেন আর করেছিলেন তাই নিয়ে। আজ থেকে আশি বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন যে কবি ও কর্মী, তাঁর মানস তাঁর কর্ম নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাঁর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ আলাদা পরিস্থিতিতে এক আন্তর্জাতিক সংগঠন কী বলেছিল তার কোন প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে?
আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাত্ত্বিক দিক থেকে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথের “… যাকে পল্লীসেবা বলা হয়েছে, তার অর্থ তোমরা একত্র সমবেত হয়ে তোমাদের নিজের চেষ্টায় তোমাদের দুঃখ দূর করো…” এই বক্তব্যের কাছাকাছি আসছে। তার সঙ্গে যেটা যোগ হয়েছে সেটা হল, দুঃখ দূর করাটা কোনো দয়ার দান নয়। পৃথিবীর সম্পদ সৃষ্টি করছে সাধারণ মানুষ, তাই তার ন্যায্য অধিকার হল স্বাস্থ্য। এ স্বাস্থ্য কেবল অসুখ থেকে মুক্তি নয়, বরং তা হল শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা, ইহজাগতিক দুঃখ থেকে যতটা সম্ভব ততটাই মুক্ত থাকা। এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাকে স্মরণ করার একটা চলতি ধরণ হল স্রেফ রবি ঠাকুরকে জানার জন্যেই তাঁর চিন্তার হদিশ নেওয়া। এ এক ধরণের নিষ্ক্রিয় ইতিহাস-চর্চা। ব্যক্তিগত কারণে, সামাজিক অবস্থানের জন্য এবং যুগের সীমাবদ্ধতার ফলে রবীন্দ্রনাথের মত অনন্যসাধারণ মানুষও আটকা পড়েছিলেন। আবার এই মানুষটিই সত্যিকারের ভবিষ্যৎদ্রষ্টার চোখ দিয়ে ভবিষ্যৎকে দেখেছিলেন, তাকে বরণও করেছিলেন। আজকে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করতে গেলে তাঁর ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে চলে আসা চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে একটা প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে হয়, আর বর্তমান পৃথিবীতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে যে ভাবনা ও কাজ চলছে তার সঙ্গে তাঁর ভাবনাকে মিলিয়ে দেখতে হয়। তিনি তাঁর যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ভাবতে পেরেছিলেন। জনগণের দ্বারাই কেবল জন-স্বাস্থ্যের প্রকৃত কাজ হওয়া সম্ভব, সে-সত্য রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় সেই সময়েই আসতে পেরেছিল।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর চিন্তার মূল জায়গাটাই ছিল ‘জন’-এর শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা মানুষকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে, নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে নিতে। এটুকু করা বড় সহজ ব্যপার নয়। এটি অধুনা চালু ‘এন জি ও’ মডেলের জনস্বাস্থ্যের, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের মুনফাবাজীর, বিশ্ব-ব্যাঙ্কের আদেশে ‘কাঠামোগত সংস্কার’ করে জনস্বাস্থ্যের গঙ্গাযাত্রা-ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত একটি চিন্তাপ্রক্রিয়া।
সত্যিই যদি ‘জন’-র হাতে চিন্তা করার ভার দেওয়া হয়, সত্যিই যদি তাদের জানতে দেওয়া হয় তাদের স্বাস্থ্য, যা তাদের জীবিকা তাদের পরিবেশের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত, সেসব নিয়ে কী কী হচ্ছে, সত্যি যদি “জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব’’, যেমনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, তা দেওয়া যায়, তা হলে জনগণের বহু প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় এসে যায়, তাদের বহু অধিকার কেবল কথায় গ্রাহ্য নয়, বাস্তবেও মেনে নিতে হয়।
তথ্যসূত্র
১) Ray PP, Biswas BC, Sen BK. Knowledge Communication in Tagore’s Model for Rural Reconstruction: An Overview. Annals of Library and Informational Study; 52, 3; 2005; 94-102
২) David Arnold. Colonizing the Body. University of California Press. 1993
৩) প্রদীপ বসু। মুখবন্ধ। সাময়িকী – পুরোনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৯৮। সম্পাদনা- প্রদীপ বসু। পৃ ৩২-৩৩
লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনার সূত্র উল্লেখ করা আছে।
চমতকার হয়েছে এ লেখা। খুব সুন্দর বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই আলোচনার মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্যটি পরিষ্ফুট হয়েছে ভালোই। অজস্র ধন্যবাদ লেখককে।
সমৃদ্ধ হলাম। এইধরনের বেসিক লেখার খুব প্রয়োজন।এঁনার মতো বিষয়ে সম্পূর্ণ অধিকারী মানুষের লেখা পড়ার পর আমার মতো সাধারণের অনেক ধোঁয়াশা কাটে।আর তখনই ‘জন’ উপকৃত হয়।স্বাস্থকে সামগ্রিকতায় দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তো আন্দোলন এবং সেটা সমাজে এই চিকিৎসকেরা দেখিয়ে চলেছেন।এই লেখা জনমানসকে প্রভাবিত করুক এমন আশা রাখলাম।