সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রবীন্দ্রনাথ ও নাইটহুড; প্রাপ্তি – পরিত্যাগ – প্রতিক্রিয়া

রবীন্দ্রনাথ ও নাইটহুড; প্রাপ্তি – পরিত্যাগ – প্রতিক্রিয়া

অত্রি গোলুই

সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১ ১৬৭০ 1

পর্ব ১: প্রাপ্তি

১৯১৫ সালের জুন মাস থেকে ১৯১৯ এর মে পর্যন্ত একটি খেতাব কে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ এর জীবনে প্রাপ্তি প্রতিবাদ ও পরিত্যাগের যে আবর্ত সৃষ্টি হয় তার ইতিহাস বিচিত্র ও জটিল। এই একটি প্রতিবাদ পত্রে মিশে গেছে কবির আন্তর্জাতিক চেতনা, স্বাদেশীকতাবোধ, মডারেট রাজনীতির দৈন্যতার প্রতি তাঁর নীরব ধিক্কার।

১৯১০ সালে নভেম্বর মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসেন। লর্ড এবং লেডি হার্ডিঞ্জ দুজনেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যের অনুরাগী ছিলেন। অবশ্য ভাইসরয় এবং তার পত্নীর সাথে রবীন্দ্রকাব্যের যোগসূত্রটি ছিলেন চার্লস অ্যান্ড্রুজ। অ্যান্ড্রুজ যেমনটা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর মধ্যে, তেমনি হার্ডিঞ্জ এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমটি ছিলেন অ্যান্ড্রুজ। ১৯১২ সালে ২৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় চাঁদনি চকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। আহত হন হার্ডিঞ্জ। রবীন্দ্রনাথ তখন আমেরিকায়। সেখান থেকে তিনি এই আক্রমণের খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনে জগদানন্দ রায়কে ১৫ ডিসেম্বর একটি চিঠিতে লেখেন “কাল হঠাৎ সকালে খবরের কাগজে পড়া গেল লর্ড হার্ডিঞ্জ এর উপর একজন বোমা ছুঁড়ে মেরেছে। পড়ে আমার মনটা অত্যন্ত পীড়িত মনে হচ্ছে। আমরা মনে করি পাপকে আমাদের কাজে লাগাতে। কাজতো গোল্লায় যায়, তারপরে সেই পাপটাকে সামলায় কে?”

এই চিঠির বক্তব্যে লর্ড হার্ডিঞ্জ এর সঙ্গে কবির বন্ধুতা জনিত পরিচয় যতটা না আছে তারচেয়ে অবশ্য ঢের বেশি আছে সন্ত্রাসবাদী জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বীতরাগ। মনে রাখতে হবে ১৯০১ থেকে ১৯১২ বা ১৩ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনায় একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে। সন্ত্রাস এর পথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে দেশের মঙ্গল সাধন করতে পারে না এ বিষয়ে এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ সচেতন ছিলেন আমৃত্যু। ১৯০৮ সালে লেখা “পথ ও পাথেয়” প্রবন্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপ সম্বন্ধে তিনি লেখেন “এই প্রকার দুশ্চেষ্টা অনিবার্য পরাভবের মধ্যে লইয়া যাইবেই। …মঙ্গলকে সৃষ্টি করিতে হয় তপস্যার দ্বারা। ক্রোধের আবেগ তপস্যা কে বিশ্বাসই করে না।”

যাই হোক, এই বোমা আক্রমণের ঘটনায় হার্ডিঞ্জ এবং অ‌্যান্ড্রুজ এরমধ্যে একটা ব্যক্তিগত সখ্যতা গড়ে ওঠে। দিল্লিতে আহত হার্ডিঞ্জের এর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অ্যান্ড্রুজ। তাঁরি মধ্যস্থতায় হার্ডিঞ্জ ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে আসেন। এইসময় কবি বিদেশে। অ্যান্ড্রুজের তাগিদ ছিল তার স্বদেশবাসীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাজকর্মের প্রত্যক্ষ পরিচয় করিয়ে দেবার। এই উদ্দেশ্যে সিমলার রাজভবনে হার্ডিঞ্জের অনুরোধে অ্যান্ড্রুজ “বাংলার নবজাগরণ ও রবীন্দ্রনাথ” নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ওই সভাতেই হার্ডিঞ্জ তার ভাষণে বলেন “the sovereignty of rabindranath Tagore had already passed far beyond the bounds of Bengal and had reached to Western as well as Eastern shores. He might be named, without fear of any rival claim, as the poet laureate of Asia.”

বিদেশ থেকে ফেরার পর, কবির নোবেল প্রাপ্তি উপলক্ষে, ২৬ ডিসেম্বর ১৯১৩, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে এই অনুষ্ঠানেও হার্ডিঞ্জ কবির প্রশংসা করে বলেন, “upon the modest brow of the last of these the Nobel prize has but lately set the the laurels of a world wide recognition and I can only hope that the the retiring disposition of our Bengali poet will forgive us for dragging him into publicity once more and recognise with due resignation that he must endure the penalties of greatness.”

রবীন্দ্র প্রতিভায় আপ্লুত এই হার্ডিঞ্জই ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করার জন্য ইংল্যান্ডে সরকারের কাছে আবেদন করেন। অবশ্য এই আবেদনের আগে ভাইসরয়ের অফিস থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অ্যান্ড্রুজের কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি আসে। সেই চিঠিতে নাইট উপাধির প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে জানানো হয় “The Viceroy would be very happy indeed to make a recommendation in the sense, if he thought that Rabindranath would appreciate the owner but he hesitates to do so because he has just a shade of doubt weather Rabindranath would do so.”

ভাইসরয়ের এই দ্বিধার সংগত কারণ ছিল। বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও হার্ডিঞ্জের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বিদেশি শাসকের হাত থেকে খেতাব নেবেন কিনা সে বিষয়ে হার্ডিঞ্জ নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের আত্মসম্মান জ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্টই অবহিত ছিলেন। আবার হার্ডিঞ্জ হয়তো এটাও জানতেন যে রবীন্দ্রনাথের মত আত্মসচেতন মানুষের মনের সুর সরাসরি প্রত্যাখ্যানের বিরোধী ছিল। বস্তুতপক্ষে হার্ডিঞ্জ এবং অ‌্যান্ড্রুজ এদের দুজনের উপরোধ রবীন্দ্রনাথ ফেরাতে পারেননি। ফলত, ১৯১৫ সালের তেসরা জুন, পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে ‘birthday honours’ এ Knighthood-এর তালিকায় ‘Dr. Rabindranath Tagore of bolpur, Bengal’ এর স্থান হয়।

সম্মানপত্রে লেখা ছিল-

George the Fifth by the grace of God of the United Kingdom of Great Britain and Ireland and of the British Dominion beyond the seas King defender of the faith do all to whome these present shall come Greeting Know ye that We of Our especial grace certain Knowledge and mere notion Have given and granted and by these presents Do give and grant unto our trustee and well beloved Rabindranath Tagore, Esquare of Bengal, the degree title honour and dignity of a Knight Bachelor together with all rights precedences privileges and advantages to the same degree title honour and dignity belonging or appertaining In Witness where of We have caused these our letters to be made patent Witness ourself at Westminster the 18th day of June in the sixth year of Our reign.

By Warrant Under Kings Sign Manual

                                  Muir Mackenzie.

একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, সমগ্র মানপত্রটিতে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার ন্যূনতম উল্লেখটুকুও নেই। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যে কবি, সে কথাও এই মানপত্রে কোথাও বলা নেই।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ইংল্যান্ডের দরবার থেকে এই সম্মান স্বহস্তে গ্রহণ করেননি। কারণ ৮ ডিসেম্বর ১৯১৫, স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত সে বছরের সরকারি খেতাব প্রদানের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে খেতাবপ্রাপ্তদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতে রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল না। তবে সম্মান পাওয়ার পর দেশ এবং বিদেশ থেকে বহু অপরিচিত শুভানুধ্যায়ী চিঠি তার কাছে আসতে থাকে। সেসব চিঠির জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত কবি শেষে পিয়ারসনকে এক চিঠিতে বলেই ফেললেন “letters letters everywhere never a moment to think..” তবে এত শুভেচ্ছার মধ্যে কিছু বক্র উক্তিও ছিল যেমন ৫ জুন তারিখে অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়-

“we mast, however, confess that the old familiar names Dr. Rashbehari and Robi Babu sound sweeter in our ears than Sir Rashbehari and Sir Rabindranath”

এই পর্বটিতে দেখা যাচ্ছে নাইটহুড খেতাব রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছুটা ব্যক্তিগত সখ্যতার সূত্র ধরেই এসেছিল। অযাচিত দান প্রত্যাখ্যান না করার স্বভাবসুলভ ভদ্রতা ও সংবেদনশীল মনের পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তীকালে খ্যাতির বিড়ম্বনায় বিপর্যস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু কোনভাবেই এই খেতাবকে রবীন্দ্রনাথের সাথে ব্রিটিশ সরকারের কোনরকম সখ্যের সূচক বলে ভাবা ঠিক হবে না। ব্যক্তিগতভাবে খেতাবের প্রতি কবির কোন আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। বরং এই পর্বেই বিভিন্ন প্রবন্ধগুলিতে, বলাকার কবিতাগুলিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ইউরোপীয় দেশগুলির জাতি প্রেমের বিরুদ্ধে তার লেখনী শানিয়ে উঠেছে।

পর্ব ২: পরিত্যাগ

ইতিমধ্যে সারাবিশ্বে এবং সেই সূত্র ধরে ভারতবর্ষে দ্রুত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছে। ১৯১৪ সালের জুন মাসে সারাজেভো হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া ঘনিয়ে আসে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ২৮ জুলাই সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। রাশিয়া, সার্বিয়াকে সমর্থন জানায়। এতে জার্মানি আগস্ট মাসে রাশিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের খবর পেয়ে ৫ আগস্ট শান্তিনিকেতন মন্দিরের উপাসনায় ইউরোপ জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী উন্মত্ত হিংসার থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা জানান। “মা মা হীংসি’ নামে সেই প্রার্থনা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় ছাপা হয়। সে দিক দিয়ে দেখলে “মা মা হীংসি” বক্তৃতাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত কবির প্রথম কোন রচনা, যা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে রচিত। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং তার সাথে জড়িত উগ্র জাতীয়তাবাদের দুর্লক্ষণগুলো নিয়ে শতাব্দীর জন্মলগ্ন থেকেই রবীন্দ্রনাথ সচেতন এবং মুখর ছিলেন। ১৮৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর লেখা নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ৬৪ নম্বর কবিতাটির কথা মনে করা যায়-

“শতাব্দীর সূর্য আজি রক্ত মেঘ মাঝে

অস্ত গেল-হিংসার উৎসবে আজি বাজে

অস্ত্র অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী

ভয়ংকরী।…..

স্বার্থে স্বার্থে বেঁধেছে সংঘাত; লোভে লোভে

ঘটেছে সংগ্রাম; প্রলয় মন্থন ক্ষোভে

ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি

পঙ্ক শয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি

জাতি প্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়

ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।”

একইরকমভাবে ১৯০১ সালে ‘বিরোধ মূলক আদর্শ’ প্রবন্ধে জাতিপ্রেম সম্বন্ধে কবি লিখলেন “মিথ্যার দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক নিজেদের কাছে নিজেকে বড় করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজমের প্রধান অবলম্বন। গায়ের জোর, ঠেলাঠেলি, অন্যায় ও সর্বপ্রকার মিথ্যাচারের হাত হইতে নেশন-তন্ত্রকে উপরে তুলিতে পারে এমন সভ্যতার নিদর্শন তো আমরা এখনও য়ুরোপে দেখিতে পাই না।”

দুটি লেখা থেকেই স্পষ্ট যে জাতিপ্রেম বা ন্যাশনালিজম জাত হিংসা ও তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি- বলপ্রয়োগের নীতি ইউরোপীয় দেশগুলিকে যে দুর্বলের প্রতি অত্যাচারে প্রলুব্ধ করছে এবিষয়ে কবির কোন দ্বিধা নেই। এই চিন্তা সূত্রটি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরবর্তীকালে ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হিংসাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন।

প্রাক যুদ্ধকালীন এই সমস্ত রচনাপর্বের একটি পরিণত রূপ দেখা যায় ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’তে প্রকাশিত ‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধটিতে। এখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন “য়ুরোপের সেই প্রভুত্বের ক্ষেত্র এশিয়া ও আফ্রিকা। এখন মুশকিল হয়েছে জার্মানির। তাহার ঘুম ভাঙিতে বিলম্ব হইয়াছিল। সে ভোজের শেষ বেলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত। ক্ষুধা যথেষ্ট, মাছেরও গন্ধ পাইতেছে অথচ কাঁটা ছাড়া আর বড় কিছু বাকি নাই। এখন রাগে তার শরীর গমগম করিতেছে। সে বলিতেছে আমার জন্য যদি পাতা পাড়া না হইয়া থাকে আমি নিমন্ত্রণ পত্রের অপেক্ষা করিব না আমি গায়ের জোরে যার পাই তার পাত কাড়িয়া খাইব।”

 রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন জার্মানির যুদ্ধ প্রবৃত্তির পিছনে রয়েছে বৈশ্যের স্বার্থবুদ্ধি। যে স্বার্থবুদ্ধি তাকে সাময়িকভাবে বৈশ্য থেকে ক্ষত্রিয়ে পরিণত করেছে। কিন্তু জার্মানির এই যুদ্ধোন্মাদনা কি কেবল জার্মানির একার? রবীন্দ্রনাথ তাকেও বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রবন্ধে – “আজ ক্ষুধিত জার্মানির বুলি এই যে প্রভু এবং দাস দুই জাতের মানুষ আছে। প্রভু সমস্ত আপনার জন্য লইবে, দাস সমস্তই প্রভুর জন্য জোগাইবে … য়ুরোপের বাহিরে যখন এই নীতির প্রচার হয় তখন য়ুরোপ ইহার কটুত্ব বুঝিতে পারে নাই, আজ তাহা নিজের গায়ে বাজিতেছে”।

স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের কাছে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের ব্যাপারে জার্মানে ব্রিটিশে খুব একটা ভেদাভেদ নেই। এই প্রবন্ধের একেবারে শেষেরদিকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন – “কিন্তু জার্মান পন্ডিত

যে তত্ত্ব আজ প্রচার করিতেছে এবং যে তত্ত্ব আজ মদের মতো জার্মানীকে অন্যায় যুদ্ধে মাতাল করিয়া তুলিল সে তত্ত্বের উৎপত্তি তো জার্মান পণ্ডিত এর মগজের মধ্যে নহে, বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যে।”

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথা বলছেন তখন দেশে জাতীয় আন্দোলনের মডারেট নেতৃবৃন্দ প্রায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশদের সহায়তায় তৎপর। আবার অন্যদিকে চরমপন্থী আন্দোলনের নেতারা ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ – এই নীতি অবলম্বন করে জার্মানির সাহায্য প্রাপ্তির আশা করছেন, এমনকি পশ্চিমী দেশগুলিতে রাসেল মোরেল বা রোমাঁ রলাঁর মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া বাকি সকল প্যাসিফিস্ট চিন্তাবিদরা ‘my country first’ পন্থা অবলম্বন করে, আন্তর্জাতিকতা শিকেয় তুলে, নিজ নিজ সরকারের লেজুড়-এ পরিণত।

এই প্রসঙ্গে দেশের মধ্যে ঘটে চলা বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত বিশ্লেষণ করাটা জরুরী। যুদ্ধ চলার সময়েই রবীন্দ্রনাথ জাপান আমেরিকা ঘুরে আসেন। এই দুই দেশে দেওয়া ন্যাশনালিজম সংক্রান্ত বক্তৃতাগুলি এদেশের সংবাদপত্রে আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ওই বক্তৃতাগুলির বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন, এমনকি স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাশ পর্যন্ত প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভামঞ্চ থেকে কবির বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। ইতিমধ্যে ১৯১৬-র লখনৌ অধিবেশনে কংগ্রেসের মডারেট ও চরমপন্থীরা পুনরায় মিলিত হলেন, একই সাথে মুসলিম লীগও যৌথভাবে এই অধিবেশন থেকেই Congress League Scheme of Reforms পাস করে। যাতে করে কিছুটা মৃদুস্বরে হলেও Self Governance- এর দাবি তোলা হলো। ১৯১৭ সালে ১৬ জুন অ্যানি বেসান্ত কারারুদ্ধ হলে, রবীন্দ্রনাথ সংবাদপত্রে তার প্রতিবাদ করলেন। এর কয়েকদিন বাদেই (আগস্ট, ১৯১৭) ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টই ভারতের জাতীয় আত্মকর্তৃত্বের দাবি তোলেন।

“মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় কথাটাই এই যে কর্তৃত্বের অধিকারই মনুষ্যত্বের অধিকার।”…অতএব ভুলচুক এর সমস্ত আশঙ্কা মানিয়া লইয়াও আমরা আত্মকর্তৃত্ব চাই। আমরা পড়িতে পড়িতে চলিব, দোহাই তোমার, আমাদের এই পড়ার দিকে তাকাইয়া আমাদের চলার দিকে বাধা দিও না।…মানুষ আগে সম্পূর্ণ যোগ্য হইবে তারপর সুযোগ পাইবে এই কথাটাই যদি সত্য হয় তবে পৃথিবীতে কোন জাতিই আজ স্বাধীনতার যোগ্য হয় নাই । ডিমক্রেসির দেমাক করিতেছ! কিন্তু য়ুরোপের জনসাধারণের মধ্যে আজও প্রচুর বীভৎসতা আছে -সেসব কুৎসার কথা ঘাঁটিতে ইচ্ছা করে না। যদি কোন কর্ণধার বলিত এই সমস্ত যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ডিমক্রেসি তার কোনো অধিকার পাইবে না,  তবে বীভৎসতা তো থাকিতই, আবার সেই পাপের স্বাভাবিক প্রতিকারের উপায়ও চলিয়া যাইত” 

এত স্পষ্ট ভাষায় আত্ম কর্তৃত্বের কথা রবীন্দ্রনাথ কখনো উচ্চারণ করেননি এর আগে। সম্ভবত আমেরিকায় ন্যাশনালিজম বক্তৃতাগুলির পর্বে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কোন সদর্থক দিক তার চোখে পড়েনি, যা দেশে ফিরে জাতীয় প্রেক্ষাপট দেখে তার মনে হতে শুরু হয়।

১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে মোটামুটিভাবে সকলেই মন্টেগুর ভারত সফরে আশা ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী – “this Congress speaking on behalf of the United people of India begs respectfully to convey to His Majesty the King Emperor their deep loyalty and profound attachment to the throne, their unswerving allegiance to the British connection, and their firm resolve to stand by the empire at all hazards and at all costs.”  অথচ এই সময়েই “স্বাধীকার প্রমত্ত” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট বললেন “… মন্টেগুর ডাক খুব বড় ডাক আজ এই কথা বলিয়া ভারতের সভা হইতে সভায়, সংবাদপত্র হইতে সংবাদপত্রে, ঘোষণা চলিতেছে। কিন্তু এই ভিক্ষার ডাকে আমরা মানুষ হইব না”।

এর কিছুদিন বাদেই (এপ্রিল ১৯১৮) দিল্লিতে war conference আহ্বান করে ভারতবাসীকে সর্বতোভাবে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডকে সহায়তা করার জন্য ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আবেদন জানান। সেই সভায় উপস্থিত গান্ধীজী কেবলমাত্র একটি হিন্দি বাক্যে যুদ্ধ প্রস্তাব সমর্থন করলেন। এবং এর কিছুদিন পরেই ভাইসরয় চেমসফোর্ডকে এক চিঠিতে গান্ধীজী সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দান করেন – “…I would make them withdraw all Congress resolutions and not Whisper ‘Home Rule’ or ‘Responsible Government’ during the pendency of the war.I would make India offer all her able-bodied sons as a sacrifice to the empire at its critical moment.”

তার কথা ও কাজের মধ্যে কোন ফাঁক যাতে না থাকে তার জন্য কেবল বিবৃতি দিয়েই গান্ধীজি ক্ষান্ত হননি, সশরীরে গুজরাটের খেদা জেলায় তিনি সৈন্য সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন। এমনকি এই কাজে অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য অচিরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শুধু গান্ধীজী নয়, তিলকের মত চরমপন্থী নেতাও তখন সৈন্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। অবশ্য গান্ধীজীর কাছে এই কাজ ছিল তার কূটনীতির একটি আবশ্যিক পন্থা মাত্র। কারণ এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি স্বীকার করলেন,  “I did all these in the belief that acts such as mine must gain for my country and equal status in the empire.” অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মেলাতে তিনি দ্বিধা করলেন না, যদিও গান্ধীজীর রাজনীতিতে চিরকালই লক্ষ্যের তুলনায় লক্ষ্যে পৌঁছানোর পন্থাই বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি “means justify the ends”-এর সহজ রাস্তাতে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এর ক্ষেত্রে এমন স্ববিরোধিতার জায়গা এক্ষেত্রে কোথাও ছিল না।

এদিকে এই কালান্তক যুদ্ধও একদিন শেষ হয়ে এল। তবে তার আগেই ১৯১৮ সালের জুন মাসে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং এর অল্পদিন পরেই ৮ জুলাই রাওলাট কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পেশ হয়। এই প্রতিবেদনে ভারতের গণ-আন্দোলন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে দমন করার সুপারিশ ছিল। ফলে রিপোর্ট প্রকাশের সাথে সাথেই ইংরেজদের গূঢ় উদ্দেশ্যটি প্রকাশ হয়ে পড়লো। কংগ্রেসের মডারেটপন্থীরা মোটামুটিভাবে মন্ট-ফোর্ড পরিকল্পনা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার ছাড়া অন্য কিছুতেই সন্তুষ্ট হবেন না বলে দাবি করলেন। গান্ধীজী অবশ্য এই দুই দলের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি বললেন “the scheme deserves sympathetic handling rather than summary rejection”

এরই মধ্যে ১৯১৮-র ১১ নভেম্বর সকাল ৫-টায় জার্মানি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলো এবং এর ৬ ঘন্টা পর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হল। যুদ্ধোত্তর পর্বে দেশে নানা কারণে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই এর কারণে শ্রমিক অসন্তোষ, তুরস্কের ভবিষ্যৎ ও খিলাফত সমস্যায় এদেশীয় মুসলিমদের বিক্ষোভ দেশকে প্রায় বারুদের স্তূপের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। দেশব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলনের ইঙ্গিত পেয়ে ইংরেজ সরকার রাওলাট বিল পাস করানোর উদ্যোগ নিল। ৬ ফেব্রুয়ারি স্যার উইলিয়াম ভিন্সেন্ট কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় বিলটি উত্থাপন করেন। সভার ভারতীয় সদস্যগণের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ২১ মার্চ বিলের প্রথম খসড়াটি পাস হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় গান্ধীজী এই আইনের প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সত্যাগ্রহের প্রতিজ্ঞাপত্রে তিনি ঘোষণা করলেন, “We further affirm that in this struggle we will faithfully follow truth and refrain from violence to life person or property.” কিন্তু সারা দেশ যখন আন্দোলনের উত্তেজনায় প্রায় উন্মাদ তখন এই অহিংসার বাণী ক্ষিপ্ত জনতার মধ্যে কতদূর প্রভাব বিস্তার করেছিল তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন থেকে যায়। গান্ধীজী প্রস্তাব করেছিলেন রাওলাট আইনের প্রতিবাদে একদিন সারা দেশের লোক কর্মবিরতি পালন ও আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে উপবাস ও প্রার্থনা করবে। প্রথমে এই দিনটি ঠিক হয় ৩০ এপ্রিল। কিন্তু পরে হঠাৎ করে দিন পরিবর্তন হয় ও ৬ এপ্রিল হরতালের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু এই খবর দেশের সর্বত্র পৌঁছায়নি, ফলে পূর্ব ঘোষিত দিনেই জনতা শোভাযাত্রা ও মিছিল করে বেরিয়ে পড়ে। সারাদেশে হরতালে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। দিল্লিতে শোভাযাত্রাকারি জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। কলকাতা অমৃতসর, বোম্বাই, আমেদাবাদে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। দিল্লি ও পাঞ্জাবের অবস্থা শান্ত করার উদ্দেশ্যে গান্ধীজি ৭ এপ্রিল বোম্বাই থেকে দিল্লি হয়ে অমৃতসরের দিকে রওনা হন কিন্তু পথিমধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং বোম্বাইতে ফিরিয়ে আনে। গান্ধীজীর গ্রেপ্তারে ক্রোধে ক্ষিপ্ত জনতা আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। অমৃতসরে ১০ এপ্রিল ড. কিচলু ও ড. সত্যপালকে পুলিশ অমৃতসরের জেলাশাসকের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে এবং অজানা জায়গায় অন্তরীণ করে রাখে। এই ঘটনায় অমৃতসর, কাসুর ও গুজরানওয়ালায় পুলিশের সাথে জনতার তীব্র সংঘাত শুরু হয়। পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ার কঠোর হাতে এই আন্দোলনকে দমন করতে উদ্যোগী হন। ১০ এপ্রিলেই পাঞ্জাবে মার্শাল ল’ জারি করা হয়।

পাঞ্জাব তখন কার্যত অবরুদ্ধ। দিল্লি, বোম্বাইতে আন্দোলন তুঙ্গে, এই সময় গান্ধী তার আদর্শ নীতির কথা ভেবে সংগ্রাম স্থগিত রাখার চিন্তা করছেন। তিনি বললেন “I think the occasion has arrived when I should offer Satyagraha against ourselves for the violence that has occurred” রবীন্দ্রনাথ সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনকে দূর থেকে, প্রায় একটি birds eye view থেকে লক্ষ্য করছিলেন। যখন দেখা গেল আন্দোলন সুশৃঙ্খল নেতৃত্বাধীন পথ ছেড়ে সহজাত বিপ্লবী প্রতিক্রিয়ার পথে চলতে শুরু করল তখন রবীন্দ্রনাথ ১২ এপ্রিল গান্ধীজিকে এক খোলা চিঠি লিখলেন। ১৬ এপ্রিল ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ পত্রিকায় ওই চিঠি প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত মূল্যবান এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –

“Dear Mahatma ji,

     Power in in all its forms is irrational,-it is like the horse that drags the carriage blindfolded . The moral element in it is only represented in the man who drives the horse. Passive resistance is a force which is not necessarily moral in itself, it can be used against truth as well as for it. The danger inherent in all force grows stronger when it is likely to gain success, for then it becomes temptation.”

“I know your teaching is to fight against evil by the help of the good. But such a fight is for heroes and not for men led by impulses of the moment. Evil on one side naturally begets evil on the other, injustice leading to violence and insult to vengefulness. Unfortunately, such a force has already been started, and either through panic or through wrath, our authorities have shown us their claws whose sure effect is to drive some of us into the secret path of recentment and others into utter demoralization.”

কবি আশঙ্কা করছেন অসংগঠিত গণসংগ্রামকে অশিক্ষিত জনতার হাতে ছেড়ে দিলে গণসংগ্রাম হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে শাসক তার নখ দন্ত বের করলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। তার এই আশঙ্কাই জালিয়ানওয়ালাবাগে চরম বাস্তব রূপ নেয়। আসলে রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি দুজনেই আন্দোলনকে আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যতটা বিচার করছিলেন ক্রিয়া কৌশলগত দিক থেকে হয়তো ততটা বিচার করছিলেন না। এই দুই বিরাট মাপের চিন্তাবিদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের যে স্তরগুলি রয়েছে, সাংগঠনিক প্রস্তুতিপর্ব কতদূর, স্বতঃস্ফূর্ত গণসংগ্রাম ইতিহাস নির্ধারিত স্বাভাবিক গতিপথে যখন বেগবান হবে তখন কিভাবে তাকে একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে ইত্যাদি কৌশলগত বিষয়ে ততটা চিন্তিত ছিলেন কি, যতটা আন্দোলনের নীতি আদর্শ নিয়ে তারা পরস্পরের মতবিনিময় করছিলেন?

যাই হোক আন্দোলন যখন নেতৃত্বের হাত থেকে জনতার হাতে চলে গেল তখনই ১৩ এপ্রিল ১৯১৯,  ঘটে গেল সেই বীভৎস জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড।

 সেদিন প্রায় কুড়ি হাজার জনতার উপর জেনারেল ডায়ার অবিশ্রাম গুলি বর্ষণ করে। সরকারি হিসাবেই ৪০০ র কাছাকাছি নিহত ও ১২০০ জন আহত। বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা প্রায় চার গুণ। বলা বাহুল্য, এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর ভারতবর্ষের সর্বত্র সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েনি- অল্প অল্প করে একটু একটু খবর আসছিল।

রবীন্দ্রনাথ ও অ্যান্ড্রুজ তখন শান্তিনিকেতনে। যেটুকু খবর পাওয়া যাচ্ছিল তাতেই তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। ১৭ এপ্রিল, রবীন্দ্রনাথের সাথে পরামর্শ করে অ্যান্ড্রুজ দিল্লি চলে যান। ২০ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ এন্ড্রুজকে পত্র লিখলেন। এই চিঠিটি পড়লে বোঝা যায় যে তখন পর্যন্ত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তেমন কিছু জানতেন না। ২২ মে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো চলে আসেন। এই সময় একটি চিঠিতে তিনি রানু অধিকারীকে লেখেন, “আকাশের এই প্রতাপ আমি একরকম সইতে পারি কিন্তু মর্ত্যের প্রতাপ আর সহ্য হয় না, তোমরা ত পাঞ্জাবে আছো, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধহয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।”

কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রনাথ পাঞ্জাবের খবর আরো বেশী করে পেতে থাকলেন। এতে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার নীলরতন সরকার তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। এদিকে ভারত রক্ষা আইন এর কবলে পড়ে দেশ নেতারা প্রায় সকলেই চুপচাপ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ স্মৃতিচারণে জানাচ্ছেন- “.. পাঞ্জাবে যে কাণ্ড ঘটেছে তা নিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে একজন লোকও প্রতিবাদ করবে না এটা কবির পক্ষে অসহ্য। অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে মহাত্মাজীর কাছে পাঠালেন এক প্রস্তাব নিয়ে। তখন বাইরে থেকে পাঞ্জাবে লোক প্রবেশ করা নিষেধ হয়েছে। কবির ইচ্ছা যে মহাত্মাজী যদি রাজি থাকেন তবে মহাত্মাজী আর কবি দুজনে দিল্লিতে গিয়ে মিলবেন। সেখান থেকে দুজনে একসাথে পাঞ্জাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন। ওদের দুজনকেই তাহলে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই হবে ওদের প্রতিবাদ। অ্যান্ড্রুজ সাহেব গান্ধীজীর কাছে চলে গেলেন।”

এরপরের ঘটনাও জানতে পারি প্রশান্তচন্দ্রের স্মৃতিচারণ থেকে, “সকালবেলা পুরানো বাড়ির দোতলায় পশ্চিমদিকের বারান্দায় কবি বসে আছেন। অ্যান্ড্রুজ সাহেব আসতেই অন্য সব কথা ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি হলো? কবে যাবেন?’ অ্যান্ড্রুজ সাহেব একটু আস্তে আস্তে বললেন ‘বলছি সব’ – গুরুদেব কেমন আছেন, এইসব কথা পাড়ছেন কবি আবার বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে কি হলো? তখন অ্যান্ড্রুজ সাহেব বললেন যে গান্ধীজি এখন পাঞ্জাবে যেতে রাজি নন- “I do not want to embarrass the government now” – শুনে কবি একেবারে চুপ হয়ে গেলেন এ সম্বন্ধে আর কোন কথা বললেন না।”

এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। প্রশান্তচন্দ্র লিখছেন, “… রাতে ভালো ঘুম হলো না। ভোর হয়নি হয়তো চারটে হবে উঠে স্নান করে বেরিয়ে পড়লুম। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে দেখি দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। গরমের দিন দারোয়ানরা বাইরে খাটিয়াতে শুয়ে। তাদের জাগিয়ে দরজা খুলিয়ে উপরে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সিঁড়ির উপরের জানলা দিয়ে দেখলুম বসবার ঘরের উত্তর-পূর্বের দরজার সামনে টেবিলে বসে কবি লিখছেন। পূব দিকে মুখ করে বসে আছেন। পাশে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আকাশ একটু ফর্সা হয়েছে কিন্তু ঘর তখনো অন্ধকার। আমি ঘরে যেতেই মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী এসেছ? এই বলে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন। দু তিন মিনিট। তারপরেই একখানা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন পড়ো। বড়লাটকে লেখা নাইটহুড পরিত্যাগ করার চিঠি। আমি পড়লুম।

কবি তখন বললেন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বাস্ এখন চুকল। আমার যা করবার তা হয়ে গিয়েছে। মহাত্মাজি রাজি হলেন না পাঞ্জাবে যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জন এর কাছে। বললুম যে এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদ সভা ডাকো, আমি নিজেই বলছি যে আমি সভাপতি হব। চিত্ত একটু ভেবে বললে,বেশ। আর কে বক্তৃতা দেবে? আমি বললুম সে তোমরা ঠিক করো। চিত্ত আর একটু ভাবলে,বললে, আপনি যদি সভাপতি হন তবে তার পরে আর কারুর বক্তৃতা দেওয়ার দরকার হয় না। আপনি একা বললেই যথেষ্ট। আমি বললুম, তাই হবে। এবার তবে সভা ডাকো। তখন চিত্ত বললে, আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সবচেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা ডাকা। বুঝলুম ওদের দিয়ে হবে না। তখন বললুম আচ্ছা আমি ভেবে দেখি। এই বলে চলে এলুম। অথচ আমার বুকে এটা বিঁধে রয়েছে। কিছু করতে পারবো না, এ অসহ্য। আর আমি একাই যদি কিছু করি তবে লোক জড়ো করার দরকার কি? আমার নিজের কথা নিজের মত করে বলাই ভালো। এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেবার উপলক্ষ করে আমার কথাটা বলার সুযোগ পেলুম।”

প্রশান্তচন্দ্রের এই স্মৃতিচারণ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত সেদিন এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ করতে জাতীয় স্তরের কোন নেতাই রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়াননি। দ্বিতীয়ত চিরকালের খেতাব বিমুখ রবীন্দ্রনাথ ইংরাজের দেওয়া এই খেতাব টিকে ব্যবহার করলেন তার নিজের কথাগুলি জোর দিয়ে বলার জন্য। খেতাবটা একটা উপলক্ষ মাত্র। ওটা আগেও তার কোনো কাজে আসেনি, বরং এখন নিজের কথাগুলো শোনানোর কাজে এসে যাওয়ায় কবি যেন খেতাবের একটা সার্থক ব্যবহার দেখতে পেলেন।

খেতাব ত্যাগের পত্রটি সারা পৃথিবীর প্রতিবাদের ইতিহাসে একটা উজ্জ্বল মাইলফলক। নেপাল মজুমদার অপূর্ব মরমী ভাষায় সেই চিঠির মর্মবাণী বিশ্লেষণ করেছেন – “সেদিনের সেই ঘোর দুর্যোগের অন্ধকারে দেশবাসীর সমস্ত অপমান ও লাঞ্ছনার কালিমা সবটুকুই কবি যেন একাই দুই হাতে সর্বাঙ্গে মাখিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিবাদ পত্র সেদিন সারা দেশের মানুষের বুকে যে কি আশা-ভরসা ও সাহসের সঞ্চার করিয়াছে – যে কি বিপুল স্বজাত্যবোধ ও আবেগের সৃষ্টি করিয়াছে তা বলিয়া প্রকাশ করা যায়না। এই একটিমাত্র প্রতিবাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতি যেন বিশ্বের দরবারে বিচার ও প্রতিকার মাগিয়াছে।”

পর্ব ৩: প্রতিক্রিয়া

রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রতিবাদপত্রটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। দেশের তৎকালীন মডারেট রাজনীতির যে দৈন্যতা, হীনতা- তাকে রবীন্দ্রনাথ কোনদিনই সহ্য করতে পারেননি। আবার এক্সট্রিমিস্ট রাজনীতিকেও তিনি কখনো সমর্থন করেননি। স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয় আন্দোলনের যে স্বভাবজাত নৈরাজ্য সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছেন, আবার সহজাত কবিমন রবীন্দ্রনাথকে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছন থেকে টেনে রেখেছে। এইসব টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে তিনি যখন দীর্ণ হচ্ছেন তখন এই প্রতিবাদপত্রটি যেন সমস্ত দ্বন্দ্বের জাল ছিন্ন করে তাকে এক মুক্তির আশ্বাস এনে দিল। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই লড়াইয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একা। দীর্ঘকাল ধরে পাঞ্জাবের সেই বীভৎস ঘটনার কোন প্রতিবাদ ভারতবর্ষের আর কোথাও হলো না। গান্ধীজীর নীরবতাও বড় অদ্ভুত। একুশে জুলাই আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গান্ধীজী যে খোলা চিঠি লেখেন তাতে তিনি জানালেন,  “The government of India has given me….. a grave warning that the resumption of civil disobedience is likely to be attended with serious consequences to public security…. I have after deep consideration decided not to resume civil resistance for the time being….a civil resister never seeks to embarrass the government”

আবার ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে যখন নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলন হলো গান্ধীজী সেই সম্মেলনের অভিভাষণে খিলাফত দাবিতে অবিচারের প্রশ্নে ভারত সরকারের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয় উৎসব বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু তার সাথে এটা স্পষ্ট করে দিলেন পাঞ্জাবের ঘটনাকে যেন এই বয়কট ব্যাপারে টেনে আনা না হয়, “It has been contended that the Punjab grievance too is a good reason for refraining from peace celebration. I differ from that view. The Punjab grievance does not arise out of the peace terms and as does the khilafat question”

অর্থাৎ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং ইংরেজির দমননীতি কেবলই দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনামাত্র, বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে গান্ধীজী এই ঘটনার কোন যোগাযোগই স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। ইংরাজের এই দমননীতি যে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের একটি বিশেষ ফলশ্রুতি তা গান্ধীজী মানতে চাইলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা এর ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে দেখি। খিলাফত সন্মেলনের কয়েক মাস বাদে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের স্মরণ দিবস উপলক্ষে কবি জিন্না সাহেবকে যে লিখিত ভাষণটি পাঠান তাতে তিনি লেখেন – “আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে পাঞ্জাবে এক মহা পাপাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত পাপের এইরকম ভীষণ আকস্মিক প্রকাশ তাদের পশ্চাতে রেখে যায় – আদর্শের ভগ্নস্তূপের ও ভস্মাবশেষের আবর্জনা। চার বছর ধরে যে দানবীয় সংগ্রাম বিধাতার সৃষ্টিজগতকে আগুনে দগ্ধ ও বিষে জর্জরিত করেছে তারই আসুরিক ঔরস্য হলো এই জালিয়ানওয়ালাবাগ। …গত যুদ্ধে মানুষ সত্য ও সম্ভ্রমবোধকে যেভাবে পদদলিত করে আপন স্বভাবের মহত্বের প্রকাশকে নিয়তি লাঞ্ছিত করেছে তাতেই সম্ভব হয়েছে এই কাপুরুষতা।”

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাকে ভারতের আর কোন নেতৃবৃন্দই রবীন্দ্রনাথের মত এই বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন কিনা সন্দেহ। গান্ধীজী যেখানে ঘটনাটিকে কেবলমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আখ্যা দিয়েছেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ এই নিষ্ঠুর বীভৎসতাকে দেখছেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির লোভ-লালসা ও আগ্রাসনের এক অবশ্যম্ভাবী ক্রমপরিণতি হিসাবে। গান্ধীজীর জীবন দর্শন অনুযায়ী অত্যাচারীর সমালোচনা করা তার হিসাবে আদর্শবহির্ভূত ছিল। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের জন্য শাসক তথা সমগ্র সাম্রাজ্যবাদীশক্তিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। অথচ উভয়েই কোন প্রকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নীতিতে ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু গান্ধীজী যেখানে বলছেন অত্যাচারকে নির্বিকার চিত্তে সহ্য করায় বীরত্ব, সেখানে কবির মত হলো অত্যাচারকে সহ্য করা আর মেনে নেওয়াতেই আত্মার পরাভব। বোধ হয় এই মূলগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের জন্য কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ কবির প্রতিবাদ সম্পর্কে আশ্চর্য নীরব। ১৯১৯-এর অমৃতসর কংগ্রেসে ইংরেজির অত্যাচার ও বর্বরতার বিরুদ্ধে সভা কাঁপানো অনেক বক্তৃতা হয়েছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপাধি ত্যাগ এবং সেই ঐতিহাসিক প্রতিবাদপত্রটি সম্পর্কে একটি বাক্য কাউকে বলতে শোনা যায়নি। অমল হোম এই বিষয়ে একটি ধন্যবাদ সূচক প্রস্তাব গ্রহণ করানোর জন্য কি চেষ্টা করেছিলেন এবং তার কি পরিণতি ঘটেছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় তার পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের ‘অমৃতসর কংগ্রেস ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশটি এখানে উল্লেখ করলে রাজনৈতিক মহলের ঔদাসীন্যের ছবিটা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

“অমৃতসরে যখন দেখলাম কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যেসব রেজোলিউশন সাবজেক্ট কমিটির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে,তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ এর নাম গন্ধ কোথাও নেই তখন আমি আমার কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শের পর সেই রকম একটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে প্রেসিডেন্ট মতিলালজীর কাছে কথা পাড়তেই তিনি বলিলেন “you move it in the subjects committee”….”আমি সকলের আগে ধরলাম জিতেন বাঁড়ুজ্জ্যে মশাইকে, তিনি প্রথমে খুব উৎসাহ প্রকাশ করে পরে- ঠিক আধ ঘন্টা পরেই, কেন জানিনা পিছিয়ে গেলেন। তখন আমি চিত্তরঞ্জন দাস মশাই এর শরণাপন্ন হলাম। তিনি বলিলেন ‘দেখো আমার মনে হয় বেঙ্গল ডেলিগেট কেউ এরকম প্রস্তাব না এনে পাঞ্জাবের কাউকে দিয়ে এটা আনলে ভাল হয়। আমি তখন ধরলাম লালা মনোহর লাল কে…. তিনি আমাকে বললেন you must have a passionate speaker to sponsor a motion like this. I don’t feel equal to it!…শেষে ইন্দুভূষণ সেন মশায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সৈয়দ হোসেন সাহেবকে বলা মাত্রই তিনি সম্মত হলেন। বললেন it will be an honour. ঠিক হলো যে সৈয়দ হোসেন প্রস্তাবটি পেশ করার পর রঙ্গ আয়ার সেটি সমর্থন করবেন।

প্রস্তাবের খসড়া যথারীতি মতিলালজীর সামনে নিয়ে ধরলাম। তখন subject’s কমিটির মিটিং চলছে। তিনি কাগজখানা আড় চোখে একবার দেখে তাঁর চশমার খাপটা চাপা দিয়ে সেটি রেখে দিলেন একপাশে। ভাবলাম যথা সময়ে সৈয়দ হোসেনের ডাক পড়বে। কিন্তু ডাক আর পড়লো না।- দু দু বার স্মারক স্লিপ পাঠানো সত্বেও। শেষে জওহরলাল এর খোঁজ করলাম। তিনি গিয়ে ‘পাপা’র কানে কানে দু একটা কথা কি বলতেই লক্ষ্য করলাম পন্ডিতজীর ভুরুটা কুঁচকে উঠলো। ব্যাপার বুঝলাম না কিছুই। অনেক রাত্রিতে সাবজেক্ট কমিটির মিটিং যখন ভাঙ্গলো ছুটে গেলাম পণ্ডিতজীর কাছে। তিনি শুধু বললেন wait।

ভাবলাম কাল হয়তো প্রস্তাবটা উপস্থিত করবেন কমিটিতে। কিন্তু সে ‘ কাল’ আর এলো না। … অমৃতসরে বেঙ্গল ডেলিগেটদের ক্যাম্পেও এনিয়ে কোনো চাঞ্চল্য দেখিনি। রবীন্দ্রনাথ যে একটা মস্ত কাজ করেছেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া এ ধারণার কোনো পরিচয় সেদিন পেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। বাংলার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, বিপিনচন্দ্র পাল, কামিনী কুমার চন্দ, অখিল চন্দ্র দত্ত কাউকেই বলতে বাকি রাখিনি। তাদের মধ্যে যে কেউ একজন সাবজেক্ট কমিটি তে উঠে দাঁড়ালেই হয়ে যেত।” কংগ্রেসের এই নিস্পৃহতা আর গান্ধীজীর এ বিষয়ে উদাসীনতা প্রায় একই সূত্রে গ্রথিত।

শ্রীনিবাস শাস্ত্রী কে লেখা ৬ জুন-এর একটা চিঠিতে গান্ধীজী জানাচ্ছেন “The Punjab horrors have produced a burning letter from the poet. I personally think it is premature. But he cannot be blamed for it.” এর কিছুদিন পর ৩ নভেম্বর, ১৯১৯ punjub letter লেখায় গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের নামের আগে স্যার ব্যবহার করেন এবং এর ৬ বছর পর, ৫ নভেম্বর ১৯২৫, ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘The Poet and the Charka’ প্রবন্ধে ওই একই কাজ করেন। স্পষ্টত বোঝা যায় প্রথম উল্লেখটি অভ্যাসবশত হলেও হতে পারে। কিন্তু ওই ঘটনার এত বছর পরও দ্বিতীয়বার একই সম্বোধনে মনে হয়, ‘নিষ্ক্রিয়তাই অহিংসা’ এমন কোনো আদর্শবোধের দৃষ্টি থেকে হয়তো গান্ধীজী কবির এই দীপ্ত প্রতিবাদকে মেনে নিতে পারেননি।

বিদেশেও এই নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। সেখানের পত্রপত্রিকায় অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ডেইলি হেরাল্ড লেখে ‘কবি প্রো-জার্মান বা অ্যান্টি-ব্রিটিশ নন। ভারতীয় নেতারা যে উপাধির খাতিরে তাদের জন্মগত অধিকার ত্যাগ করবে না, রবীন্দ্রনাথ এর চিঠিপত্র থেকে তা স্পষ্ট হচ্ছে।’ ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান লিখলো ‘কবি যে সব কথা বলেছেন সে সম্পর্কে অবিলম্বে ভারত সরকারের তদন্ত করা প্রয়োজন।’ আবার Englishman পত্রিকা ব্যাঙ্গের সুরে লিখল, “It will not make a ha’porth worth of difference. As if it mattered a brass farthing whether Sir Rabindranath Tagore approved of the Government’s policy or not! As if it mattered to the reputation the honour and the security of British rule and justice whether this Bengali poet remained a knight or a plain Bengali Babu”

তবে এই ঘটনায় ইংল্যান্ডে কবির কিছু বন্ধুবিচ্ছেদও হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীকে লিখেছিলেন, “ওদের ওটা খুব অপমান লেগেছিল। তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে দেখলাম ওরা সে কথা ভুলতে পারছে না। ইংরেজ রাজভক্ত জাত। রাজাকে প্রত্যাখ্যান তাই আঘাত দিয়েছিলো ওদের।”

রবীন্দ্রনাথ উপাধি ত্যাগ করলেও ব্রিটিশরা সরকারি ভাবে উপাধি ফেরত নেয়নি কোনো দিন। কারণ তারা বুঝেছিল ফেরত নেওয়া হলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে মান্যতা দেওয়া হবে। চতুর চেমসফোর্ড সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। ১১ জুন ১৯১৯, একটি ‘ প্রাইভেট’ টেলিগ্রাম এ তিনি ভারত সচিব মন্টেগুকে জানান, “A letter dated 31st May, has been addressed to me by Rabindranath Tagore announcing his desire to resign Knighthood, Which was conferred on him in June 1915, as a protest against by policy followed by Government in dealing with the recent troubles in the Punjab….. I propose to reply, in view of the advertisement that would be given to Tagore and of the fact that grant of his request might be interpreted as admission of mistaken policy in the Punjab, that I am unable myself to relieve him of his title and in the circumstances, do not propose to make any recommendation to His Majesty on the subject.” 

Macmillan কোম্পানি উপাধি ত্যাগ এর বেশ কিছু বছর পরেও তাদের প্রকাশিত বইতে কবির নামের আগে স্যার উপাধি বসাতে থাকে। এই সব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাঝে উজ্জ্বল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ঘটনাটি। উপাধি ত্যাগের পরে পরেই, রামেন্দ্রসুন্দর তখন মৃত্যুশয্যায়, রবীন্দ্রনাথতকে তিনি জানালেন ‘আমি উত্থানশক্তিরহিত, আপনার পায়ের ধুলা চাই।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন ও তাঁর অনুরোধে প্রতিবাদপত্রটি পড়ে শোনান। 

রামেন্দ্রসুন্দর কবির পায়ের ধুলা মাথায় নিয়ে তন্দ্রায় নিমগ্ন হলেন। তার সেই তন্দ্রা আর ভাঙ্গেনি। উপাধি আছে না নেই এই বিতর্ক যখন মাঝে মাঝেই কবিকে বিব্রত করে চলেছে, তখন ১৯২৬ এর ফেব্রুয়ারি মাসের মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে এই বিতর্কে যবনিকা টেনে দেন। সেই চিঠিতে তিনি জানালেন, “Being aware that if discussion has been raised in regard to my Knighthood. I feel it right to put clearly my own view of it before the public. It is obvious that it was solely to give utmost emphasis to the expression of my indignation at the Jaliwanwalabag massacre and other deeds of inhumanity that followed it that I asked lord Chelmsford to take it back from me…… I was driven to it when I hoplessly failed to persuade our political leaders to launch an adequate protest against what was happening at that time in the Punjab.”

এই বিতর্কে তার এই শেষ চিঠি। এখানেও তিনি দ্ব্যর্থহীন। প্রতিবাদে ও প্রত্যাখ্যানে একাকী কিন্তু একক।

তথ্যসূত্র:

১। ভারতে জাতীয় আন্দোলন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

২। ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ। নেপাল মজুমদার।

৩। রবিজীবনী, প্রশান্ত কুমার পাল

৪। পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ, অমল কুমার হোম

৫। মংপু তে রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী

৬। রবীন্দ্রনাথ ও কয়েকজন রাজপুরুষ, সনতকুমার বাগচী

৭। রবীন্দ্রনাথ এর আন্তর্জাতিক চিন্তা (প্রবন্ধ), চিন্ময় সোহানবিশ।

৮। ‘মর্তের প্রতাপ আর সহ্য হয় না’ অভীক কুমার দে, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৫.

লেখক পেশায় শিক্ষক। ইতিহাসের প্রতি বিশেষ আগ্রহী, প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “রবীন্দ্রনাথ ও নাইটহুড; প্রাপ্তি – পরিত্যাগ – প্রতিক্রিয়া”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।