ভূস্বর্গ শাসিকা: কাশ্মীরের রানিদের সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান
জন্মেজয় বৈশম্পায়নকে শুধালেন:
“দেশস্য গৌরবং চক্রে কিমর্থং দ্বিজসত্তম।
বাসুদেবো মহাত্মা যদভ্যষিঞ্চত্ স্বয়ং স্ত্রিয়ম্॥”
অর্থাৎ, “হে দ্বিজ বলুন, মহাত্মা বাসুদেব সেই সম্মানিত দেশটির শীর্ষে কেন এক নারীকে অভিষিক্ত করেছিলেন?”
উত্তরে কৃষ্ণের সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করে নীলমতপুরাণে বৈশম্পায়ন শুরু করলেন তাঁর উত্তর,
“যৈব দেবী উমা সৈব কশ্মীরা নৃপসত্তম।
আসীত্ সরঃ পূর্ণজলং সুরম্যং সুমনোহরম্॥”
অর্থাৎ, “হে নৃপতিশ্রেষ্ঠ জেনে রাখুন, এই পুণ্যবারিময় সুরম্য হ্রদের কাশ্মীর এবং দেবী উমা এক ও অভিন্ন সত্তা।”
দেবী উমার দৈবী সত্তার পার্থিব প্রকাশ রূপে কাশ্মীরের উৎপত্তির সঙ্গে জন্মেজয়ের প্রশ্নে নিহিত সেই নারীর রাজপদে আরোহণকে একই সূত্রে বেঁধে আরেকটু বিশদে বহু শতক পরের রাজতরঙ্গিণীতে প্রথমবার যশোবতীর নাম নিলেন কল্হণ। কৃষ্ণের ভাষ্যে তিনি লিখলেন রাজার অনুপস্থিতিতে কাশ্মীরের রানির ঐশ্বরিক উত্তরাধিকারের অমোঘ ঘোষণা:
“কশ্মীরাঃ পার্বতী তত্র রাজা জ্ঞেয়ঃ শিবাংশজঃ।
নাঽবজ্ঞেয়ঃ স দুষ্টোঽপি বিদুষা ভূতিমিচ্ছতা॥
পুংসাং নির্গৌরবা ভোজ্য ইব যাঃ স্ত্রীজনে দৃশঃ।
প্রজানাং মাতরং তাস্তামপশ্যন্দেবতামিব॥”
অর্থাৎ,
“কাশ্মীরের ভূমি স্বয়ং পার্বতী। কাশ্মীর রাজ হলেন শিবের অংশ। রাজকর্তৃত্ব মন্দ হলেও মঙ্গলকামী জ্ঞানী মানুষের তাঁকে অবজ্ঞা করা অনুচিত। পুরুষের যে চোখগুলি নারীকে সুখভোগ্য পণ্য মনে করে তাঁর দিকে অসম্মানের দৃষ্টিপাত করত, তারাই তাঁকে প্রজাদের দেবীস্বরূপা মাতা হিসেবে গ্রহণ করল।”
আসুন, এই লেখায় আমরা “পূর্ণজলং সুরম্যং সুমনোহরম্” কাশ্মীরের মহাপরাক্রমশালিনী শাসিকাদের কাহিনি পাঠ করে দেখি।
রানি যশোবতী (সম্ভাব্য সময়কাল: মহাকাব্যের যুগ)
সেই কোন সুদূর মহাভারতের কাল। কাশ্মীরের মহাশক্তিধর রাজা প্রথম গোনদ (৩২৩৮-৩১৮৮ সাধারণ পূর্বাব্দ) তাঁর আত্মীয় মগধরাজ জরাসন্ধের আহ্বানে গেলেন যদুবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। কিন্তু কালিন্দী (বর্তমান যমুনা) নদীর তীরে প্রবল যুদ্ধে বলরামের কাছে পরাজিত ও নিহত হলেন তিনি। গোনদের পর কাশ্মীরের রাজসিংহাসনে বসলেও তাঁর পিতৃভক্ত পুত্র প্রথম দামোদরের মনে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত যে শান্তি নেই একফোঁটাও! সিন্ধু নদীর তীরে শ্রীকৃষ্ণ সহ যদু বংশের অন্যান্য বীরকে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করলেন রাজা দামোদর। কিন্তু কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে প্রাণ হারাতে হল তাঁকেও!
রাজা দামোদরের রানি যশোবতী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা। রাজার অন্য কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় ক্ষমতালিপ্সু মন্ত্রীরা কাশ্মীরের রাজপদ দখলের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন। কাশ্মীরের এই দুঃসময়ে কৃষ্ণ সিংহাসনে মনোনীত করেন স্বয়ং রানি যশোবতীকে। একে নারী, তায় অন্তঃস্বত্ত্বা! যশোবতীর বিরুদ্ধে ঘনিয়ে ওঠে পুরুষতন্ত্রের তীব্র অসন্তোষ। কল্হণ লিখেছেন, এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ সর্বসমক্ষে প্রাচীন নীলমতপুরাণের একটি শ্লোককে উদ্ধৃত করে কাশ্মীরের রাজপদে রানি যশোবতীর ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৈশম্পায়নের প্রতি জন্মেজয়ের উপরোক্ত জিজ্ঞাসাটি যেন, কাশ্মীরের যশোবতী বিরোধী পুরুষ গোষ্ঠীর সম্মিলিত কন্ঠস্বর। অপরপক্ষে কাশ্মীররাজকে স্বয়ং শিব এবং কাশ্মীর রাজ্যকে দেবী পার্বতীর সঙ্গে তুলনা করে নীলমতপুরাণ এবং রাজতরঙ্গিণী উভয় গ্রন্থে প্রদত্ত কৃষ্ণের উপরোক্ত দীর্ঘ উত্তর রেখে গেছিল কাশ্মীরের রাজনীতি ও প্রশাসনে নারী কর্তৃত্বের জোরালো উপস্থিতির চিরচিহ্ন।
ক্রমে যশোবতীর কোলে এল এক শিশুপুত্র। নাম তার রাখা হল বালগোনদ বা দ্বিতীয় গোনদ। এবার যশোবতী আর সার্বভৌম শাসিকা নন, বরং বালগোনদের অভিভাবিকা রূপে কাশ্মীরের প্রশাসন চালাতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় গোনদের নাবালকত্ব বাদেও সম্ভবত তাঁর অভিভাবিকা এক নারী ছিলেন বলে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষের সকল তাবড় রাজা যুদ্ধে যোগ দিলেও কুরু ও পান্ডব কোন শিবিরই প্রভাবশালী কাশ্মীর রাজ্যকে আপন পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি।
নীলমতপুরাণে এরপর আলাদা করে যশোবতীর উল্লেখ না পাওয়া গেলেও কাশ্মীর রাজ্যের সর্বব্যাপ্ত সমৃদ্ধির যে বর্ণন এর পরের শ্লোকগুলিতে পাওয়া যায়, তা থেকে পরোক্ষে হলেও প্রশাসক হিসেবে রানি যশোবতীর দক্ষতাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নীলমতপুরাণ ও রাজতরঙ্গিণী, দুটি গ্রন্থেই সার্বভৌম শাসক বা রাজ অভিভাবিকা হিসেবে যশোবতীর নির্দিষ্ট শাসনকালের উল্লেখ নেই। রাজতরঙ্গিণীতে কল্হণ মাত্র পাঁচটি স্তবক (স্তবক ৭০-৭৪) যশোবতীর জন্য ব্যয় করেছেন। তবে তাঁর কাশ্মীর রাজদের সারণি থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় গোনদ ও তাঁর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ রাজা লবের মধ্যে কাশ্মীরে রাজত্ব করেছিলেন আরও পঁয়ত্রিশ জন রাজা। দামোদরের মৃত্যু থেকে দ্বিতীয় গোনদের নাবালকত্বের বড়ো সময়কালটিতে যশোবতী তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে কাশ্মীরের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সফল হয়েছিলেন বলেই গোনদ রাজবংশ সুদীর্ঘ কাল স্থায়ী হয়েছিল।
নীলমতপুরাণে উল্লিখিত প্রতিটি চরিত্রই বাস্তব ও মাইথোলজির মিশ্রণে সৃষ্ট। রানি যশোবতীকে তাই কল্হণ থেকে অরেলস্টাইন পর্যন্ত অধিকাংশ কাশ্মীর ইতিহাসবেত্তা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও যে কাশ্মীরের প্রথমতমা মহিলা শাসক ছিলেন; সে সত্যকেও উপেক্ষা করতে পারেননি এঁরা কেউ। কারণ স্বয়ং কৃষ্ণের ভাষ্যে উল্লিখিত হয়েছে তাঁর সার্বভৌমত্ব। বিরোধী পুরুষ শিবিরকে প্রতিরোধ করে এক যোগ্য নারীর সিংহাসনের অধিকারকে সমর্থন জানিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের এক প্রধান পৌরাণিক দেবতা কর্তৃক এ হেন কূটনৈতিক উচ্চারণ কাশ্মীরের ইতিহাস ও রাজনীতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এক আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর দাঁড়িয়ে রানির সিংহাসন গ্রহণের পক্ষে কৃষ্ণের খোলাখুলি সম্মতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও চিরকালের মতো কাশ্মীরের নারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বদান, এমনকি রাজসিংহাসন গ্রহণকে ন্যায়সঙ্গত করে দিয়েছিল।
যশোবতীর পরে কাশ্মীরের সিংহাসনে বসেছিলেন রানি সুগন্ধা, রানি দিদ্দা, রানি কোটা এবং নাবালক রাজার অভিভাবিকা হিসেবে স্বাধীনভাবে রাজ্যচালনাও করেছিলেন আরও অনেক হিন্দু এমনকি মুসলমান নারীও। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃতি সত্ত্বেও বিতস্তা তীরের জটিল রাজনীতিতে নারীদের এগোনোর পথ সুগম হয়নি কোনদিন। তবু তাঁরা দৃপ্তপদে এগিয়েছেন আর সকল প্রতিস্পর্ধার মুখোমুখি নির্ভীক দাঁড়িয়ে বুঝে নিয়েছেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার। যশোবতীর বহু শতাব্দী পরেকার হলেও, উৎপল বংশের রানি সুগন্ধার কাহিনি বলে যায় সেই একই কথা…।
মহারানি সুগন্ধা (৯০৪ – ৯০৬ সাধারণ অব্দ)
ভূস্বর্গের প্রথম ঐতিহাসিক শাসিকা ছিলেন মহারানি সুগন্ধা। উৎপল বংশের রাজা শঙ্করবর্মণের (৮৮৫ – ৯০২ সাধারণ অব্দ) অন্যতমা রানি সুগন্ধা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাজকীয় সামরিক অভিযানগুলিতেও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতেন। ৯০২ সাধারণ অব্দে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয় করে ফেরার পথে উরুশ (বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা অঞ্চল) নামক স্থানে তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাজা শঙ্করবর্মণ। এই অভিযানটিতেও রানি সুগন্ধা রাজার সঙ্গে ছিলেন। রাজার বাকি দুই রানি এবং কিছু সেবিকা রাজার চিতায় সহমৃতা হলেও তেজস্বিনী সুগন্ধা সতীদাহে জীবন শেষ করতে চাননি।
চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসা সহমরণের প্রবল চাপ সামলে সুগন্ধা শঙ্করবর্মণের ও তাঁর বড়ো ছেলে নাবালক গোপালবর্মণকে সিংহাসনে বসান এবং নিজে রাজমাতা হিসেবে রাজ্যের সকল ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক। তাঁর জনকল্যাণমুখী কার্যাদি তাঁকে কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। দেশকাল নির্বিশেষে ইতিহাসের এমন দৃঢ়চেতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সফল নারীদের দিকে পুরুষ ঐতিহাসিকরা যে বারবার নিন্দার দশ আঙুল তুলেছেন তা বলাই বাহুল্য সুগন্ধাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না! অর্থমন্ত্রী প্রভাকরদেবের সঙ্গে সুগন্ধার ঘনিষ্ঠতাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন কল্হণ সমেত আগামীর প্রায় সকল ঐতিহাসিক। তবে প্ৰভাকরদেব ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ। রানির সঙ্গে সম্পর্কের সুযোগে রাজকীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ তিনি আত্মস্যাৎ করতে শুরু করেন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজা গোপালবর্মণ রুখে দাঁড়ালে প্রভাকরদেব তাঁকে হত্যা করার জন্য রামদেব নামক এক ব্যক্তিকে কাজে লাগান। ৯০৪ সাধারণ অব্দে গোপালবর্মণ প্রয়াত হন। রাজহত্যার ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ায় আত্মহত্যা করেন রামদেবও। রাজমাতা সুগন্ধা এবার তাঁর ছোটো ছেলে সঙ্কটকে রাজপদ দান করেন। কিন্তু রহস্যময়ভাবে মাত্র দশদিনের মধ্যে মারা যান নতুন রাজাও।
কাশ্মীরের দুই নবীন রাজার মৃত্যু এবং শঙ্করবর্মণের অন্য কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীরের রাজনীতিতে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এই সঙ্কটের সময় সামরিক অভিজাত গোষ্ঠী অর্থাৎ তন্ত্রিন, রাজকীয় দেহরক্ষী দল অর্থাৎ একনাগ এবং আঞ্চলিক শূদ্র সামন্তপ্রভুরা অর্থাৎ ডামর শিবির একযোগে রানি সুগন্ধাকে কাশ্মীরের পরবর্তী সার্বভৌম শাসিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেন (৯০৪ – ৯০৬ সাধারণ অব্দ)। মহারানি হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করে সুগন্ধা তাঁর পূর্বতন সুশাসনের ধারাই বজায় রেখেছিলেন।
সমকালীন কাশ্মীরে সুগন্ধার প্রভাব প্রতিপত্তির অন্যতম পরিচায়ক হল তাঁর নিজের নামে প্রচলিত মুদ্রাগুলি। এই মুদ্রাগুলির একদিকে রয়েছে সমকালীন শারদা লিপিতে উৎকীর্ণ সুগন্ধা নামক নারী নামটির বাঁকে রাজকীয় পৌরুষের উচ্চারণ মাখা ‘শ্রী সুগন্ধা দেব’ উপাধি এবং অন্য পিঠে খোদিত ললিতাসনে উপবিষ্টা ‘অর্দোক্ষ’ বা দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রভাবশালী রাজা রানিদের সহজাত বৈশিষ্ট্য মতোই সুগন্ধা তাঁর উদ্যোগে নির্মিত স্থাপত্যগুলির মধ্য দিয়ে নিজের নামকে চিরস্থায়ী করে যেতে চেয়েছিলেন। স্বামী শঙ্করবর্মণ সুগন্ধার উৎসাহে শঙ্করপুরা নামক নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। এই শহরে তাঁরা যুগ্মভাবে নির্মাণ করিয়েছিলেন শঙ্করা গৌরেশ এবং সুগন্ধেশ্বর নামক দুটি শিব মন্দির। আধুনিক পট্টনে আজও এই মন্দির দুটি ছাড়াও অক্ষত রয়েছে তাঁর দ্বারা নির্মিত সুগন্ধেশা মন্দিরটি। এই মন্দির ছাড়া একক উদ্যোগে সুগন্ধা নির্মাণ করান সুগন্ধাপুরা এবং গোপালপুরা নামের নতুন দুটি শহর, গোপালকেশব নামে একটি বিষ্ণুমন্দির এবং গোপালমঠ নামক এক মঠ নির্মাণ করেছিলেন। প্রখর বুদ্ধিমতী সুগন্ধা তাঁর রাজ্যের আপামর জনগন, অভিজাত সম্প্রদায় এবং সামরিক বাহিনীর কাছে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ছিলেন। তাঁর প্রশাসন পরিচালনা বছরগুলিতে রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শান্ত পরিবেশ এবং স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের প্রশংসনীয় উন্নতির কারণে ঐতিহাসিকরা মহারানি সুগন্ধার অভিভাবকত্ব তথা রাজত্বের সময়কালকে কাশ্মীরের ইতিহাসের ‘স্বর্ণযুগ’ বলেও অভিহিত করে থাকেন।
তবে সুগন্ধার শান্তির দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি গোপালবর্মণের স্ত্রী জয়লক্ষ্মীর অনাগত সন্তানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু জয়লক্ষ্মী একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেওয়ায় তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উৎপল বংশের রক্তসম্পর্কের ভিতর কাউকে রাজসিংহাসন দেওয়ার জন্য তিনি নির্জিতবর্মণ ‘পঙ্গু’ নামে পূর্বতন রাজা সূর্যবর্মণের এক নাতিকে বেছে নেন। কিন্তু শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী নির্জিতবর্মণকে পরবর্তী রাজা হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না রাজ্যের মন্ত্রী পরিষদ এবং তন্ত্রিন সামরিক গোষ্ঠী। কিন্তু রানি সুগন্ধা নিজ মনোনয়নে অনড় থাকলে এই দুই অভিজাত গোষ্ঠী ৯০৬ সাধারণ অব্দে রানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং নির্জিতবর্মণের বালক পুত্র পার্থকে কাশ্মীরের সিংহাসনে বসান।
সিংহাসন হারানো নির্বাসিত রানি সুগন্ধা হুষ্কপুরা অঞ্চলে (বর্তমান বারামুলার উস্কার বা উসকুর অঞ্চল) পরবর্তী আট বছর বসবাস করেছিলেন। কিন্তু এই সময়কালেও তিনি বারবার তাঁর হৃত প্রভাব প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে গেছিলেন। একনাগ ও ডামর গোষ্ঠীর সহায়তায় পর্যাপ্ত শক্তি সংগ্রহের পর ৯১৪ সাধারণ অব্দে শ্রীনগরের কাছে রানি রাজা পার্থ ও তন্ত্রিনদের চূড়ান্ত যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে রানি সুগন্ধা পরাজিত হন এবং তাঁকে নিষ্পালক বিহার নামক এক বৌদ্ধ মঠে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। কাশ্মীরের রাজনীতির তিনটি দশক জুড়ে সর্বময় ক্ষমতাশালিনী রানি সুগন্ধার এই দুঃখজনক পরিণতিতে কল্হণ লিখেছিলেন, “আশ্চর্য এই ভাগ্যের পথখানি; সতত উত্থান পতনে পরিবৃত..।”
তবে রানি সুগন্ধার করুণ পরিণতির প্রতি কল্হণ যতখানি সহানুভূতিশীল, তার ছিটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে দেখা যায় না, কাশ্মীরের পরবর্তী মহাশক্তিশালিনী শাসিকা দিদ্দার কাহিনি বিবৃত করার সময়…।
মহারানি দিদ্দা (৯৫৮ – ১০০৩ সাধারণ অব্দ)
পীরপঞ্জালের বুকে বসা লোহরিন উপত্যকার রাজা সিংহরাজের সঙ্গে কাবুলের অন্যতম দোর্দন্ডপ্রতাপ হিন্দু শাহী উদ্ভান্ড রাজ্যের রাজা ভীমদেবের কন্যার বিবাহের পরিণতিতে জন্ম নিয়েছিল এক রাজকন্যা। নাম তার দিদ্দা। পরমা সুন্দরী হলেও পায়ের ত্রুটির জন্য তিনি তেমন হাঁটতে পারেন না যদিও (রাজতরঙ্গিণীতে কল্হণ দিদ্দাকে ‘চরণহীনা’ বলেছেন)। তীক্ষ্ণ মেধাবী কিন্তু নিঃসঙ্গ রাজকন্যা তাঁর কৈশোর, যৌবন জুড়ে মন দিয়ে শুধু শিখে চলেন প্রশাসন ও কূটনীতির জটিল বিদ্যা। আশৈশব বাবা মায়ের উদাসীনতার পাশে এহেন দিদ্দার একমাত্র সঙ্গী বলজা বা বলগা নামের এক সহায়িকা, যাঁর পিঠে চেপে তিনি যাতায়াত করেন সর্বত্র।
২৬ বছর বয়সকালে নিজের কাশ্মীর রাজ্যের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য ‘চরণহীনা’ দিদ্দাকে বিবাহ করলেন কাশ্মীররাজ ক্ষেমগুপ্ত (৯৫০ – ৯৫৮ সাধারণ অব্দ)। কাশ্মীরে এসে দিদ্দা যে দিকে তাকান, দেখেন তিনি কেবলই শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত, দেখেন অত্যাচারী, দুশ্চরিত্র ক্ষেমগুপ্তের বকলমে রাজপাট চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী তথা ক্ষেমগুপ্তের অন্যতমা রানি চিত্রলেখার পিতা ফাল্গুন। কিন্তু প্রবল বুদ্ধিমত্তার জোরে দ্রুত বাকি সকলকে সরিয়ে ক্ষেমগুপ্তের ওপর নিজের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করলেন দিদ্দা। ফাল্গুন রাজ্যত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন দিদ্দায় মন্ত্রমুগ্ধ রাজা অচিরেই পরিচিত হয়ে উঠলেন ‘দিদ্দাক্ষেম’ নামে, এমনকি যুগ্মনামে প্রচলন করলেন ‘দিক্ষেমগুপ্তদেব’ নামক এক বিশেষ মুদ্রাও।
কিন্তু দিদ্দার সহজ সময় থাকল না বেশিদিন। মৃগয়া করতে গিয়ে এক অজানা জ্বরে মৃত্যু হল ক্ষেমগুপ্তের। তাঁদের সন্তান অভিমন্যু তখন নিতান্তই শিশু। মৃত রাজার মন্ত্রী সান্ত্রী, আত্মীয় পরিজনেরা ক্ষেমগুপ্তের চিতায় সহমরণে বাধ্য করে দিদ্দা নামক শক্তিটিকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু শত্রুদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিদ্দা বেঁচে রইলেন তাঁর শিশুসন্তানের রক্ষাকবচ হয়ে। কঠোর হাতে সমস্ত শত্রুকে দমন করে শিশু অভিমন্যুকে সিংহাসনে বসালেন দিদ্দা। রাজার অভিভাবিকা হিসেবে কাশ্মীরে শুরু হল দিদ্দার প্রত্যক্ষ শাসনকাল (৯৫৮ – ৯৮০ সাধারণ অব্দ)।
শুরু থেকেই তাঁর বা অভিমন্যুর সর্বময় কর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিদ্দা বিনা বাক্যব্যয়ে নাশ করতে শুরু করেছিলেন। ক্ষেমগুপ্তের দুই মন্ত্রী মহিমন ও পাতালার মাথা তিনি স্বহস্তে কেটেছিলেন যেমন, তেমন প্রভূত ধনরত্ন দিয়ে সমর্থন জুটিয়েছিলেন ললিতপুরার প্রভাবশালী ব্রাহ্মণদের। দিদ্দা তাঁর সফল সেনাপতি যশোধরের নেতৃত্বে সেনা বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। অন্যদিকে বিশ্বস্ত মন্ত্রী নরবাহন ও রক্ক তাঁর আদেশে আশপাশের রাজ্যগুলিতে অভিযান চালিয়ে সকল দিদ্দা-বিরোধী শক্তিকে হত্যা করছিল। এই উত্তাল রক্তক্ষয়ী দিনগুলিতে রানি দিদ্দার সম্পর্কে জনমনে ছড়িয়ে পড়ছিল নানা গুজব। দিদ্দার ঘোর বিরোধী কল্হণ রাজতরঙ্গিণীর ষষ্ঠ তরঙ্গে বড়ো গুছিয়ে লিখে রেখেছেন মন্ত্রতন্ত্র – বশীকরণে পারঙ্গমা, রাতের অন্ধকারে দেওয়াল বেয়ে হেঁটে সরীসৃপের মতো হেঁটে বেড়ানো পিশাচসিদ্ধা রানি দিদ্দার নানা ‘কুকীর্তি’। এবার মারা গেল দিদ্দার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুচর তথা মন্ত্রী নরবাহন। কল্হণ বলেছেন, রানির নেকনজর সরে যাওয়াতেই নাকি বিষাদে আত্মহত্যা করেছিল সে। কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হল রক্করও। অহংকারী, ব্যাভিচারিনী রানিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লক্ষ্যে এসময় শক্তিশালী ডামর সামন্তগোষ্ঠীর প্রবল বিদ্রোহে কেঁপে উঠেছিল কাশ্মীর উপত্যকা। বিপদের দিনে দিদ্দা ফিরিয়ে আনলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ফাল্গুনকে। দেহরক্ষী একনাগ গোষ্ঠী এবং ফাল্গুনের সাহায্যে নির্মমভাবে ডামর বিদ্রোহ দমন করলেন তিনি।
৯৭২ সাধারণ অব্দ। রহস্যজনকভাবে প্রয়াত হলেন দিদ্দার একমাত্র পুত্র অভিমন্যু। দিদ্দা বিদ্বেষীরা বলল, ‘ডাইনি রানি’ নাকি এবার পুত্রঘাতিনীও! দিদ্দার অপার অপশক্তি সম্পর্কে অজস্র কল্পকাহিনি পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল কাশ্মীরময়। কিন্তু সমাজের কোন কুকথাকে কোনকালেই কী পরোয়া করেছেন তিনি! পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে নাবালক নাতি নন্দীগুপ্তকে (৯৭২ – ৯৭৩ সাধারণ অব্দ) সিংহাসনে বসিয়ে রাজনীতি থেকে সাময়িক অবসর নিলেন পুত্রশোকাতুরা মা। মন্দির, মঠ, বিহার স্থাপনের জন্য গোটা রাজ্যে ভ্রমণও করলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠল দিদ্দাস্বামী মন্দির, দিদ্দাপুরা জনপদ, সহায়িকা বলগার সম্মানে বলগা মঠও। কিন্তু বছর ঘুরতেই হঠাৎ মারা গেলেন নন্দীগুপ্ত। পরবর্তী বালক রাজা ত্রিভুবনগুপ্তও (৯৭৩ – ৯৭৫ সাধারণ অব্দ) বছর দুয়েকের মধ্যে প্রয়াত হলে অভিমন্যুর শেষ জীবিত পুত্র ভীমগুপ্তকে সিংহাসনে বসালেন রাজপিতামহী দিদ্দা। ইতিমধ্যে মারা গেছেন অশীতিপর ফাল্গুনও। কাশ্মীরের বাতাসে আবারও প্রবলতর হয়ে উঠল দিদ্দা কর্তৃক ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বজনহত্যার সেই পুরোনো তত্ত্বই।
দিদ্দার জীবনের শেষ তিন দশকে তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তুঙ্গ নামক এক যুবক মেষপালক। তুঙ্গের সঙ্গে পিতামহীর ঘনিষ্ঠতায় ক্রুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করলেন কিশোর রাজা ভীমগুপ্ত। কিন্তু দিদ্দার অঙ্গুলিহেলনে নির্মম মৃত্যুদণ্ড পেলেন তিনি। শ্লেষভরে কল্হণ লিখেছেন, “সকল বিদ্রোহীকে সমূলে উৎপাটিত করেছেন এই পঙ্গু নারী। মনে হয়েছিল যাঁর গোষ্পদসম ধরণীতেও চলার ক্ষমতা নেই, তিনি আজ হনুমান যেভাবে একটি লাফে সাগর পার করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই অবলীলায় শত্রুদের জয় করেছেন।” ভীমগুপ্তের পরে কাশ্মীরের সিংহাসনের অধিকারী রক্তসম্পর্কের অন্য কোন পুরুষ আর জীবিত না থাকায় এবার প্রৌঢ়া দিদ্দা স্বয়ং নিজের মাথাতেই তুলে নিয়েছিলেন কাশ্মীরের রাজমুকুট এবং পরবর্তী ২৩ বছর (৯৮০ – ১০০৩ সাধারণ অব্দ) তুঙ্গের সহায়তায় একচ্ছত্র রাজত্ব করেছিলেন কাশ্মীর জুড়ে।
তাঁর রাজত্বের এই শেষপর্বও কিন্তু রক্তপাতহীন হয়নি। রানির প্রশ্রয়ে তুঙ্গ ও তাঁর ভাইরা একদিকে যেমন প্রশাসনে একাধিপত্য কায়েম করেছিলেন, তেমনই জনগণের ওপর শুরু করেছিলেন প্রবল অত্যাচার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লোহারা রাজ বিগ্রহরাজের নেতৃত্বে রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রীরা এবং ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী রানি ও তুঙ্গের বিরুদ্ধে তুমুল বিদ্রোহ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিক্ষুব্ধ আমজনতা, ডামর অভিজাতরা, এমনকি পার্শ্ববর্তী রাজাপুরীর (বর্তমান রাজৌরি) শাসক পৃথ্বীপালও। কিন্তু কখনও কূটনীতি, কখনও বা চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে তুঙ্গ এই প্রতিটি বিদ্রোহকে দমন করেছিলেন। তুঙ্গের বিশ্বস্ততার পুরস্কার স্বরূপ রানি দিদ্দা তাঁকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির যুগ্মপদ দান করেছিলেন। বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি তুঙ্গের সহায়তায় রানি দিদ্দা কাশ্মীরের সামরিক তথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। আবার অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সত্তরটির মতো অধুনাবিলুপ্ত মন্দির, মঠ ও বিহারও।
প্রায় আশি বছর বয়সে আবার একবার আপন উত্তরাধিকারীর খোঁজ শুরু করেন মহারানি দিদ্দা। ভাই উদয়রাজার পুত্র তথা লোহারা বংশের যোগ্যতম রাজনীতিক সংগ্রামরাজাকে কাশ্মীরের পরবর্তী রাজন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে সংগ্রামরাজার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী তুঙ্গও দিদ্দার কাছে নতুন রাজাকে সাহায্য করার শপথ করেছিলেন। অবশেষে সুদীর্ঘ চারটি দশকের নিরবচ্ছিন্ন নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে ১০০৩ সাধারণ অব্দে কাশ্মীরকে একাধারে এক মহাশক্তিধর রাজ্যে পরিণত করে এবং রাজপদকে এক নিরাপদতম হাতে দান করে নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছিলেন কাশ্মীর তথা ভারতীয় ইতিহাসের এক অনন্য নারীচরিত্র মহা ক্ষত্রাণী মহারানি দিদ্দা।
দিদ্দার শাসনকালের তিন শতক পর দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশের রানি কোটা কাশ্মীরের হাল ধরেছিলেন রাজ্যের এক সঙ্কটময় সময়ে। তাঁর নির্ভীক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিত্ব এবং কূটনৈতিক কৌশলগুলির মধ্যে যেন অনেকসময় ধরা পড়ে মহারানি দিদ্দার অস্পষ্ট ছায়া…।
কোটা রানি (১৩৩৮ – ১৩৩৯ সাধারণ অব্দ)
কাশ্মীরের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ শাসিকা কোটা রানি সম্পর্কে বিশদ তথ্য জানা যায়, কালপঞ্জীকার জোনরাজের দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থ থেকে। মহাশক্তিধর দিল্লি সুলতানির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মুখে ধ্বস্ত হতে থাকা এক কঠিন সময়ে কোটা রানি কাশ্মীরের সিংহাসনে বসেছিলেন। তাঁর শাসনকাল (১৩৩৮ – ১৩৩৯ সাধারণ অব্দ) সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁকে আধুনিক ইতিহাস মূলত মনে রেখেছে কাশ্মীরের শেষ হিন্দু শাসক হিসেবে।
প্রথম লোহারা রাজবংশের শেষ রাজা হর্ষকে (১০৮৯ – ১১০১ সাধারণ অব্দ) পরাজিত করে রাজা উচ্চল (১১০১ – ১১১১ সাধারণ অব্দ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশ। লোহারা রাজারা তাঁদের সুদক্ষ প্রধানমন্ত্রী ও আমলাদের সহায়তায় কাশ্মীর উপত্যকা থেকে উত্তর আফগানিস্তান পর্যন্ত এক সুবিশাল অঞ্চলে দীর্ঘ দুই শতক জুড়ে রাজত্ব করে আসছিলেন। লোহারা রাজা সূহদেবের (১৩০০ – ১৩১৯/২০ সাধারণ অব্দ) এমনই এক প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্রের কন্যা ছিলেন কোটা। কৈশোর থেকেই রাজনীতি ও প্রশাসনের কাজে আগ্রহী কোটা রামচন্দ্রকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাজা সূহদেবের আমলে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল। মধ্য এশিয়ার ত্রাস তাতার নেতা দুলচার আক্রমণও ঘটেছিল তাঁর সময়কালেই। কথিত আছে, এই দুঃসময়ে রাজা সূহদেব কিস্তওয়ারে আত্মগোপন করলে কন্যা কোটার কূটনৈতিক বুদ্ধির বলে বিদেশি আক্রমণ রুখে কাশ্মীরকে রক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র। কাশ্মীর রক্ষার কাজে এসময় কোটা ছাড়াও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কাশ্মীরে আশ্রিত পশ্চিম তিব্বতের (মতান্তরে লাদাখের) পলাতক রাজপুত্র রিঞ্চেন এবং লোহারা প্রশাসনের উচ্চপদে কর্মরত শাহ মীর নামক এক ভাগ্যান্বেষী পর্যটক। রিঞ্চেন এবং শাহ মীরের সহায়তায় এরপর রাজা সূহদেবকে হত্যা করে রামচন্দ্র কাশ্মীরের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই রামচন্দ্রকে হত্যা করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতান সদর-উদ-দিন নামে কাশ্মীরের রাজসিংহাসনে বসেন রিঞ্চেন। রামচন্দ্রের কন্যা কোটাকে তিনি বিবাহও করেন। নতুন রাজার সঙ্গে বিবাহের সূত্রে মন্ত্রী কন্যা কোটা হয়ে ওঠেন কাশ্মীরের রানি। তবে মাত্র তিন বছরের মধ্যে খুন হয়ে গেছিলেন দক্ষ শাসক রিঞ্চেনও। এরপর থেকেই কাশ্মীরের প্রধান শাসিকা হিসেবে কোটা রানির মূল উত্থান শুরু হয়েছিল।
রিঞ্চেন ও তাঁর শিশু সন্তান হায়দারের অভিভাবিকা হিসেবে তিনি দক্ষতার সঙ্গে সুবৃহৎ কাশ্মীর রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনা করতে শুরু করলেও শান্তি স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। পুরোনো রাজা সূহদেবের ভাই উদয়নদেব কাশ্মীর আক্রমণ করলেন। যুগপৎ রাজ্যের নিরাপত্তা এবং নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য শাহ মীরের পরামর্শে তিনি উদয়নদেবকে বিবাহ করেন। তবে উদয়নদেবের রাজত্বকালের (১৩২৩ – ১৩৩৮ সাধারণ অব্দ) আগাগোড়া রাজ্যের প্রধান প্রশাসিকার দায়িত্বভার সামলেছিলেন কোটা রানিই, কারণ উদয়নদেবও তাঁর বড়ো ভাইয়ের মতো অযোগ্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহ থেকে জাত কোটার দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল জট্ট (মতান্তরে বোলরতন)। এসময় অচল নামে এক দুর্ধর্ষ তুর্ক-মোঙ্গল নেতা কাশ্মীর আক্রমণ করে। প্রত্যাশিতভাবেই উদয়নদেব প্রাণভয়ে পালিয়ে যান দুর্গম তিব্বতে। জোনরাজ লিখেছেন, রাজ্যের এই দুঃসময়ে কোটা রানি কাশ্মীরের জনগণ তথা প্রতিবেশী রাজ্যগুলির রাজাদেরকে কয়েকবছর আগেকার মোঙ্গল আক্রমনের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ও সর্বশক্তি দিয়ে মোঙ্গল বিরোধী সম্মিলিত সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রানির নেতৃত্বে কাশ্মীরি জনতার জীবনপণ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পরাজিত হয়েছিল অচল। কোটা রানি পরাজিত অচলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এদিকে ১৩৩৮-এ মারা গেলেন উদয়নদেবও। এবার আর বড়ো ছেলে অনভিজ্ঞ হায়দারকে সিংহাসনে বসার সুযোগ না দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য কাশ্মীরের একচ্ছত্র কর্ত্রী হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলেন কোটা রানি স্বয়ং। তবে রানির দ্বিতীয় পর্বের রাজত্বকালটি একেবারেই নির্বিঘ্ন হয়নি। একদিকে তিনি কাশ্মীরি জনতার সমর্থন যেমন হারাচ্ছিলেন, পাশাপাশি তেমনই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠছিলেন নিজের দীর্ঘদিনের পরামর্শদাতা তথা হায়দারের অভিভাবক শাহ মীরের জনপ্রিয়তাতেও। সমকালীন কাশ্মীরি রাজনীতিতে তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শাহ মীরের মর্যাদাকে খাটো করার উদ্দেশ্যে এবার রানি তিনটি পদক্ষেপ নিলেন। প্রথমত, ভট্ট ভীক্ষণ নামক এক ব্যক্তিকে তাঁর যুগপৎ তাঁর প্রধানমন্ত্রী আর দ্বিতীয় পুত্র জট্টর অভিভাবক রূপে নিযুক্ত করলেন। দ্বিতীয়ত, শাহ মীরের অভিভাবকত্বে বড়ো হয়ে ওঠা হায়দারকে সকল উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা জনসমক্ষে ঘোষণা করলেন। তৃতীয়ত, প্রশাসনের অন্যান্য মন্ত্রীদের উৎকোচ দিয়ে তো বটেই, জনতার মধ্যেও বিপুল অর্থ ছড়িয়ে নিজের হারানো প্রতিপত্তি ফেরত পেতে চাইছিলেন কোটা রানি। কিন্তু শাহ মীর অচিরেই তাঁর অপমানের বদলা নিলেন। কৌশলে ভট্ট ভীক্ষণকে হত্যা করার পর তিনি কোটা রানিকেও বলপূর্বক ক্ষমতা চ্যুত করলেন এবং ১৩৩৯ সাধারণ অব্দে সুলতান শামস-উদ-দিন উপাধি গ্রহণ করে কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসলেন শাহ মীর (১৩৩৯ – ১৩৪২ সাধারণ অব্দ)। কোটা রানির শেষ পরিণতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও নানা মত প্ৰচলিত রয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত সমসাময়িক দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিণীতে জোনরাজ লিখেছেন, রানি তাঁর হৃত ক্ষমতা ফেরত পাওয়া তথা নিজের দুই সন্তানকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টায় শাহ মীরকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরের সকালেই তাঁকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করা হয়েছিল। কারাগারে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন এবং নিজের ক্ষতবিক্ষত অন্ত্র শাহ মীরকে তাঁদের বিবাহের উপহার হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। রানির মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্রকেও শাহ মীর দ্রুত হত্যা করেন।
জোনরাজ থেকে শুরু করে পি.এন.কে বামজাই পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ধ্রুপদী কাশ্মীরি ঐতিহাসিক যশোবতী, সুগন্ধা, দিদ্দার মতো কোটা রানিকেও নিষ্ঠুর, ক্ষমতালোভী, নীতিহীন এক নারী হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। মুসলমান রিঞ্চেন এবং শাহ মীরকে বিবাহ করে কাশ্মীরে হিন্দু রাজশাহির বিলোপ ঘটানোর জন্যও কিছু ঐতিহাসিক কোটা রানিকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু এই ধারাবাহিক নেতিবাচক পরিচায়নগুলির বাইরে অস্পষ্ট হয়ে থেকে যায়, কাশ্মীরি রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিচক্ষণতার বাকি সকল উজ্জ্বল দিকগুলি। পর পর দুবার কোটা রানির কূটনীতিতেই কাশ্মীর মোঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। কোটা রানি রাজধানী শ্রীনগরকে ঝিলাম নদীর বিধ্বংসী বন্যা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি একটি খাল খনন করিয়েছিলেন, যেটি আজও ‘কুটে কোল’ নামে পরিচিত। ক্ষমতাবৃত্তে থাকার জন্য তিনি নির্দ্বিধায় তিনবার প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। স্পষ্টতই, কোটা রানি ছিলেন আদ্যোপান্ত এমন এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিক নারী, যাঁর কাছে প্রতিপক্ষের ধর্মীয় পরিচয় বা মাতৃত্বের আবেগে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপেক্ষা জটিল রাজনীতির ময়দানে নিজ সর্বময় প্রভাব অক্ষুন্ন রেখে নিজ রাজ্যের মর্যাদা বৃদ্ধির মূল লক্ষ্যটি ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কেবল উপরোক্ত চার অবিস্মরণীয় মহারাজ্ঞীই নন, বিতস্তার পাড়ের রাজনীতিতে পুরাণের সময়কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বারবার আপন কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন আরও কত তেজস্বিনী প্রশাসিকা! রানি সুগন্ধা, দিদ্দা বা কোটার প্রশ্নাতীত ঔজ্জ্বল্যের সামনে কিছুটা আবছা হয়ে থাকা সেই সকল সফল নারীদের কাহিনিও সংক্ষেপে ধরা রইল এই লেখাটির মধ্যে…।
বিতস্তার তীরের আরও তেজস্বিনী
নীলমতপুরাণে পাওয়া যায় রাজা জলৌকের রানি ঈশানদেবী এবং রাজা তুঞ্জিনের রানি বাকপুষ্ট-র উল্লেখ। রাজ প্রশাসনে সহায়তা করার পাশাপাশি কাশ্মীরের বন্যা ও খরা নিয়ন্ত্রণে এবং জনকল্যাণে এঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
অনঙ্গলেখা: কারকোটা রাজবংশের (৬২৫ – ৮৫৫ সাধারণ অব্দ) প্রতিষ্ঠাতা দুর্লভক প্রতাপাদিত্যের মা অনঙ্গলেখা প্রশাসন ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালিনী ছিলেন।
শ্রীলেখা: লোহারা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সংগ্রামরাজের (১০০৩ – ১০২৮ সাধারণ অব্দ) মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র হরিরাজ মাত্র ২২ দিনের জন্য সিংহাসনে বসেন। কিন্তু সংগ্রামরাজের রানি ও হরিরাজের মা শ্রীলেখা নিজেই ছেলেকে সরিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু একনাগ নামক রাজকীয় দেহরক্ষী একনাগ গোষ্ঠী এবং সেনার অসহযোগিতার কারনে তাঁকে রাজপদ দিয়ে দিতে হয় তাঁর নাবালক পুত্র অনন্তকে। পরবর্তীকালে তিনি অনন্তর সাবালকত্ব পর্যন্ত তাঁর অভিভাবিকা হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেছিলেন।
সূর্যমতী: সূর্যমতী ছিলেন রাজা অনন্তদেবের (১০২৮ – ১০৬৮ সাধারণ অব্দ) প্রধানা মহিষী। সূর্যমতীর পরামর্শে রাজা অনন্তদেব কাশ্মীরের প্রথম বেতনভোগী স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের নেশা এবং ভোগ বিলাসের খরচ মেটানোর জন্য কাশ্মীরি প্রজাদের ওপর বিপুল হারে কর বসিয়েছিলেন। রানি সূর্যমতী তাঁর প্রখর বুদ্ধিবলে তাঁর রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি করে তোলেন এবং প্রজাদের অভাব অভিযোগ দূর করে রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। শিবের উপাসিকা রানি সূর্যমতীর পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরে বহু মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু স্বামী অনন্তদেব ও অযোগ্য পুত্র কলশের মধ্যে নিয়ত দ্বন্দ্বের কারণে রানির ব্যক্তিগত জীবন ছিল চরম অশান্তিময়। ১০৬৮-তে রাজা অনন্তদেব আত্মহত্যা করলে রানি সূর্যমতী সহমরণে গমন করেন।
জয়মতী: কাশ্মীরের মহারানির পদে এক অনাম্নী নর্তকীর কন্যা জয়মতীর উত্থান ছিল সত্যি অর্থেই গল্পের মতো। নৃত্য ও সংগীতে পারঙ্গমা জয়মতী প্রথম জীবনে ছিলেন কাশ্মীরের চরম অত্যাচারী শাসক হর্ষের সভাসদ মন্ডলেশ নামক এক মন্ত্রীর রক্ষিতা। ১১০১ সাধারণ অব্দে রাজা হর্ষকে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উৎখাত করেন অতীতের উৎপল রাজবংশের প্রতিনিধি তথা দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশের স্থপতি বচ্ছল (১১০১ – ১১১১ সাধারণ অব্দ)। এরপর জয়মতী বচ্ছলকে বিবাহ করেন এবং রাজা বচ্ছলের এক দশকব্যাপী সুশাসনের প্রধান সহায়িকা হয়ে ওঠেন। হর্ষের নিপীড়নে বিধ্বস্ত কাশ্মীরে শান্তি ফিরে এসেছিল জয়মতীর দিশানির্দেশে। তাঁর পরামর্শেই বচ্ছল প্রজাদের ওপর থেকে হর্ষের আমলের অতিরিক্ত করের বোঝা সরিয়ে নেওয়া, দরিদ্র জনতার জন্য হাসপাতাল স্থাপন, দুর্নীতি দূর করে প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করে তোলা তথা রাজ্যব্যাপী সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করার মতো মানবিক পদক্ষেপগুলি নিয়েছিলেন। দিদ্দার সমালোচনায় নির্মম হলেও জয়মতী একক যোগ্যতায় যেভাবে এক অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে এসে কাশ্মীরের জনকল্যাণকামী মহারানির সর্বোচ্চ পদে আরোহণ করেছিলেন, সেই কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কল্হণ স্বয়ং।
রাদ্দাদেবী: দ্বিতীয় লোহারা বংশের রাজা জয়সিংহের (১১২৭ – ১১৫৪ সাধারণ অব্দ) প্রধানা মহিষী রাদ্দাদেবী ছিলেন এক আদ্যন্ত ধর্মপ্রাণ চরিত্র। জয়সিংহ তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর শিশুপুত্র গুলহনের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন। শ্রীনগরে রাদ্দাদেবীর একক অভিভাবকত্বে এই অভিষেক নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছিল। রানির নিখুঁত কূটনীতি এবং রাজকীয় ব্যক্তিত্বের কাছে সমস্ত বিরোধী জোট নতি শিকার করতে বাধ্য হয়েছিল। রানি রাদ্দা তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীর কারনে কল্হণের রাজতরঙ্গিণীতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।
কলহনিকা: কলহনিকা জয়সিংহের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রানি হলেও সমকালীন কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যাগুলি সমাধানের ক্ষেত্রে রাজার প্রধানতম সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। সুভাষিনী ও সুরুচিসম্পন্না এই রানি ছিলেন যেমন তুখড় কূটনীতিক ছিলেন, তেমনই ছিলেন কুশল যোদ্ধাও। ধর্ম ও আর্থসামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল প্রজাকে কঠোর ন্যায়বিচার দানের জন্য কলহনিকা তাঁর সমকালে অত্যন্ত সম্মানিতা ছিলেন।
বিবি হাউরা: কোটারানির মৃত্যুর পর কাশ্মীরে শাহ মীরের অধীনে ইসলামী শাসন শুরু হয়েছিল। এই সময়কালে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সুলতানী পরিবারের নারীদের স্বাধীনতা বহুলাংশে ক্ষুন্ন হলেও সুলতান কুতুব-উদ-দিনের (১৩৭৩ – ১৩৭৯ সাধারণ অব্দ) স্ত্রী বিবি হাউরা ছিলেন সর্বতোভাবে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। পুত্র সিকন্দরের মাত্র আট বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পর তিনি বালক সুলতান সিকন্দরের অভিভাবিকা হিসেবে দীর্ঘ এক দশক (১৩৭৯ – ১৩৮৯ সাধারণ অব্দ) কাশ্মীরের শান্তি শৃঙ্খলা ও সুশাসন বজায় রেখেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, ন্যায়বোধসম্পন্ন এবং দানশীল ব্যক্তিত্ব হলেও পুত্র সিকন্দরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি দুই প্রভাবশালী অভিজাত, এমনকি নিজের কন্যা ও জামাতাকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং বাকি সকল প্রতিদ্বন্দ্বীর আঘাত থেকে পুত্রকে রক্ষা করেছিলেন। পরে যদিও বিবি হাউরা তাঁর অত্যাচারী পুত্র সিকন্দরের দ্বারাই নির্মমভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন।
গুল খাতুন: কাশ্মীরের শ্রেষ্ঠ সুলতান জয়নুল আবেদিনের পুত্র সুলতান হায়দার শাহ (১৪৭০ – ১৪৭২ সাধারণ অব্দ) চরম দুশ্চরিত্র ও অযোগ্য শাসক ছিলেন। ফলে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাশ্মীরে শাহ মীর বংশের নিশান রক্ষা করতে হয়েছিল তাঁর স্ত্রী তথা সুদক্ষ প্রশাসিকা গুল খাতুনকেই। রাজ্য শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি গুল কাশ্মীরময় বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা,খানকা ইত্যাদির স্থাপনা সহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়ত নিয়োজিত থাকতেন। গুল খাতুনকে এই কারনে ঐতিহাসিক শ্রীবর হিন্দু রানি দিদ্দার মুসলিম সমকক্ষ বলে অভিহিত করেছিলেন। কাশ্মীরের নিজস্ব সংস্কৃতির এক উৎসাহী সমর্থক গুল খাতুন সমন্বয়বাদী সুফি এবং ভক্তি আন্দোলননের প্রতিও গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা কালীন গুল খাতুনের অকালমৃত্যু কাশ্মীরি শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সেই কোন মহাকাব্যিক কল্পকথার যুগে কৃষ্ণের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল কাশ্মীরের রাজপদে নারীর ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নাতীত সমর্থন। তবে কৃষ্ণের বকলমে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুমোদনের শক্তিতে কেবল নয়, আদতে কাশ্মীরের একান্ত নিজস্ব দর্শন ও সংস্কৃতির মুক্তধারায় পুষ্ট হয়ে উঠেছিল কাশ্মীরি নারীর সামাজিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সমানাধিকার লাভের বিষয় দুটি। কিন্তু চিরকাল কাশ্মীরে নারী প্ৰশাসকদের নেতৃত্বদানের পরাক্রমী ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের দৃপ্ত ব্যক্তিত্বকে রাজনীতির তথাকথিত পুরুষালি আঙিনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেওয়া পুরুষতন্ত্রের পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। তাই তো প্রায় সমকালীন কল্হণ বা জোনরাজ হোন বা একালের অরেলস্টাইন থেকে পৃথ্বীনাথ বামজাই; অধিকাংশ পুরুষ ইতিহাসবেত্তার কলমে কুৎসিতভাবে নিন্দিত কিংবা অন্যায়ভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন
মহাকাব্যিক যশোবতী থেকে আদিমধ্য যুগের তিন অসামান্যা রাজ্ঞী সুগন্ধা, দিদ্দা বা কোটা রানি হয়ে কয়েক শতক পরের গুল খাতুন কিংবা বিবি হাউরা পর্যন্ত এই লেখায় উল্লিখিত রানিদের প্রায় প্রত্যেকেই। তবুও আপন যোগ্যতায় এঁরা ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন, জয় করেছেন তাঁদের সমকালকে আর অনপনেয় হয়ে রয়ে গেছেন পুণ্যবারি বিতস্তার, সুরম্য হ্রদসমূহের, তুষারশুভ্র হিমাদ্রির, দীর্ঘদেহী বৃক্ষরাজির, অনিবার উপত্যকার, উর্বর কৃষিক্ষেত্রের, অপরূপ পুষ্পপত্রের ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বহুবর্ণময় কালপ্রবাহের প্রায় সবখানে।
চিত্রঋণ
শীর্ষক চিত্রটির শিল্পী: Sumairha Mumtaz, চিত্র সূত্র: Scroll. In।
রানি সুগন্ধা এবং রানি দিদ্দার নামাঙ্কিত মুদ্রাগুলির ছবি ইন্টারনেটে সহজলভ্য।
তথ্যসূত্র:
১. ড. বেদকুমারী অনূদিত, ‘নীলমতপুরাণম্’।
২. কল্হণ, ‘রাজতরঙ্গিণী’।
৩. জোনরাজ, ‘দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিণী’।
৪. Asif Raina, ‘Yoshovati: The Neglected Queen’; 2020
[https://www.researchgate.net/publication/339295642_Yasovati_the_neglected_queen].
৫. Khawar Khan Azkhwai, ‘Queen Didda: Between Facts and Fantasy’
[https://freepresskashmir.news/2021/01/18/queen-didda-between-facts-and-fantasy/].
৬. Ajay Vaid and Samta Sharma, ‘Queens of Kashmir, A Glimpse of Kashmir’s Women Rulers’.
চমৎকার লেখা| কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে লেখা খুব একটা পাওয়া যায় না| সেই অভাব কিছুটা হলেও পুড়ন হল|
পড়ার জন্য ধন্যবাদ শান্তনুদা।