অবিভক্ত বাংলায় সংগঠিত প্রগতি-সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা-পর্ব
উনিশশো ত্রিশের দশকের সূচনা থেকেই অবিভক্ত বাঙলায় মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীগণ শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজমের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকে। ইতোপূর্বে বিশের দশক থেকেই প্রধানত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের প্রেরণায় কাজী নজরুল ইসলাম (যাঁর নিজস্ব মনন-সমৃদ্ধ সাম্যবাদে আস্থা বিষয়ে নতুন করে বলার নেই) নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (যিনি বাংলাভাষায় প্রথম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুবাদ করেন), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (বাংলা কথাসাহিত্যে শ্রমিক শ্রেণী যার জন্য প্রথম সম্মানজনক স্থান করে নিতে পেরেছিল) প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ সাম্যবাদ বা মার্কসবাদী মতাদর্শের মূল নির্যাসকে তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ত্রিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের সাহিত্য সৃষ্টিতেও এর প্রভাব যথেষ্টই উপলব্ধি করা গিয়েছিল — যদিও এঁরা কেউই সে অর্থে মার্কসবাদী ছিলেন না। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ বাঙলা তথা ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সমাজে সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বাড়িয়ে তোলে। ১৯৩১ – ৩২ সাল থেকে স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ ও বিপ্লবী নেতা ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (এবং অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারও) ইউরোপ থেকে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে মার্কসীয় দৃষ্টিতে শিল্প, সাহিত্য ও সমাজতত্ত্ব বিশেষণে অগ্রসর হন। ১৯৩২ – ৩৩ সালের ‘দেশ’ ও ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এর বেশ কিছু নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। ১৯৪৫-এ প্রকাশিত ‘সাহিত্যে প্রগতি’ নামক গ্রন্থে এগুলি সংকলিত হয়েছিল।১
অধ্যাপক বাসব সরকার এই প্রসঙ্গে তাঁর এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, “তিরিশের দশকেই রাজনৈতিক আন্দোলনে গান্ধী প্রদর্শিত পথ ছেড়ে ভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদ এসেছিল। …এদেশে বুদ্ধিজীবীদের মার্কসীয় তত্ত্ব চিন্তার সঙ্গে পরিচয় তখনও নিবিড় হওয়ার সুযোগ আসেনি। সোভিয়েতের সাফল্য, আর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেই একটা ভিন্নতর মাপকাঠি খোঁজার তাগিদ বুদ্ধিজীবীরা সে সময় অনুভব করেছিলেন মাত্র।” তবে অধ্যাপক সরকারের বক্তব্যে একটা পরস্পর বিরোধিতা লক্ষণীয়। নিবন্ধটিতে তিনি একবার বলেছেন, “বিশের দশকে অসহযোগ আন্দোলন তার ইঙ্গিত ফললাভ করলে মার্কসবাদের দিকে এই আকর্ষণ নিজের থেকে গড়ে উঠত কিনা বলা শক্ত। আবার তিনি মনে করেন- “ভারতে গান্ধীপর্বে গণরাজনীতির সূচনা না হলে বৌদ্ধিক প্রেরণায় মার্কসীয় বিচার বিশেষণের ধারা তৈরি হতে আরো অনেক সময় লাগতো।” এই দ্বিতীয় বক্তব্যটিতে হয়তো কিছুটা যথার্থতা আছে, কিন্তু ভারতীয় বৌদ্ধিক জগতে মার্কসীয় চিন্তাধারা বিকাশের বিষণে এই মন্তব্যে অতি সরলীকরণের ঝোক অস্বীকার করা যায় না—বিশেষত আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবি আন্দোলনের সমৃদ্ধ প্ৰেক্ষিত বিচারে।২
উনিশশো ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতার সুস্পষ্ট আভাস দেখা যায় ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় শিবরাম চক্রবর্তীর ‘আজ ও আগামীকালের’ প্রবন্ধগুলিতে। শিবরাম-এর সেই সময় রচিত ‘যখন তারা কথা বলবে’ একাঙ্ক নাটক সেসময় বেশ আলোড়ন তুলেছিল। মনীন্দ্রলাল বসু রচিত গল্পে (‘কিরণের কথা’) নায়কের মুখে এই উক্তি সেদিন আর অস্বাভাবিক মনে হয়নি, “শিল্পী কি শুধু রঙ নিয়ে খেলা, সুন্দরীর মুখ আঁকা? কুলীদের বস্তির কদর্যতা, চাষী-মজুরের কর্মজীবন, পতিতার বেদনাকে আমি মূর্ত করতে চাই।”
বস্তুত মজুর সাহিত্য সৃষ্টিতে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘কল্লোল’ পত্রিকার ভূমিকাও সেদিন ছিল উল্লেখযোগ্য — যদিও তাঁর লেখকগোষ্ঠীর ভাবনায় মার্কসবাদী তত্ত্ব-শৃঙ্খলা বোধের কোনো পরিচয় ছিল না— তথাপি অচিন্ত্য কুমার, মনীশ ঘটক, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং পরবর্তীকালে জগদীশ গুপ্ত, হেমন্তকুমার সরকার বা তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যে ও কথা সাহিত্যে মার্কসীয় সমাজ-বাস্তবতার ছোঁয়াচ লেগেছিল। আর প্রত্যক্ষভাবে মার্কসবাদে নির্যাস নিয়ে রচিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাস ‘অন্তঃশীলা’ ও ‘আবর্ত’ (১৯৩৫) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), মনোরঞ্জন হাজরার কৃষক সংগ্রাম কেন্দ্রিক কাহিনী পলিমাটির ফসল’, ‘নোঙরহীন নৌকা’ (১৯৩৭) এবং সদ্য কারামুক্ত গোপাল হালদারের সন্ত্রাসবাদ থেকে মাকর্সবাদে উত্তরণের কাহিনী ‘একদা’ (১৯৩৯-তে প্রকাশিত, কিন্তু রচিত ১৯৩৪-৩৫ সাল) বাংলা প্রগতিশীল সাহিত্যে নতুন মোড় ফিরিয়েছিল এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সংস্রব ঘটাতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।৩
উনিশশো ত্রিশের দশকের সূচনা থেকেই বাঙলায় কমিউনিস্ট চিন্তাধারা ও মাকর্সবাদের যে প্রসার ঘটেছিল তার পশ্চাতে নানাধরণের মার্কসীয় প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মার্কসীয় সাহিত্য, তাত্ত্বিক গ্রন্থাবলী এবং সংবাদপত্রগুলি অল্প সংখ্যায় হলেও এক শ্রেণীর শিথিত মানুষের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে মার্কসবাদের প্রচার চালিয়ে যেত। ১৯৩১ সালে ২২ বছরের তরুণ কমিউনিস্ট সোমনাথ লাহিড়ীর মৌলিক গ্রন্থ ‘সাম্যবাদ’ প্রকাশিত হয় — যা বেরনোমাত্র পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৩১ সাল থেকেই ৪১ নং জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট থেকে বাঙলায় মার্কসীয় প্রকাশনার একটি সংগঠিত উদ্যোগ শুরু হয়। হিন্দি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই সাপ্তাহিক, পারিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। যেমন, অভিযান (১৯৩০ সম্পা.-সোমনাথ লাহিড়ী), ‘দিনমজুর’ (১৯৩২ সম্পা.-সোমনাথ লাহিড়ী), ‘চাষী মজুর’ (১৯৩১ সম্পা.-বৈদ্যনাথ মুখার্জী), ‘জঙ্গী মজদুর’ (১৯৩২ হিন্দি সম্পা.-মঙ্গল সিং (প্রঃ সোমনাথ লাহিড়ী), ‘মাকর্সবাদী’ (১৯৩৩ সম্পা.-অবনী চৌধুরী), মাকর্সপন্থী (১৯৩৩ সম্পা.-আব্দুল হালিম), নয়া মজদুর’ (১৯৩৪, বাংলা সাময়িক পত্র), ‘গণশক্তি’ (১৯৩৪, সাপ্তাহিক) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৩ সালে ‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই উদ্যোগ বিস্তারলাভ করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বাঙলা কমিটির তৎকালীন সম্পাদক আব্দুল হালিম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “কমিউনিস্ট তত্ত্ব, মাকর্সবাদ ও রাজনৈতিক প্রচার এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে সুসংহত করিবার কাজে ৪১ নম্বর জ্যাকেরিয়া স্ট্রীটস্থ কমিউনিস্ট কেন্দ্র যে ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল তাহা চিরস্মরণীয় থাকিবে।”৪
‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউসের’ নামে প্রকাশিত অন্যতম তাত্ত্বিক পত্রিকা ছিল আব্দুল হালিম সম্পাদিত ও মুদ্রিত মাসিক ‘মাকর্সপন্থী’ (১৯৩৩)। এর চতুর্থ সংখ্যার (ফাল্গুন, ১৩৪০, ফেব্রুয়ারী-মার্চ, ১৯৩৪) শেষ প্রচ্ছদে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল ‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউসের’ নামে। এতে বলা হয়, সকল প্রকার সাম্যবাদমূলক ও মজুর আন্দোলনের বৈজ্ঞানিক সাহিত্য ও ইতিহাস এখানে পাওয়া যায়। সকল দেশের গণ আন্দোলনের পত্রিকাদি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া এই বিজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিল যে মফঃস্বলের অর্ডার যত্নের সহিত সরবরাহ করা হয়। সুতরাং এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কমিউনিজমের ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়ার একটা সংগঠিত উদ্যোগ সেসময় গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য রাষ্ট্রশক্তি ব্রিটিশ প্রশাসনের বাধা ও হস্তক্ষেপ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। গণশক্তিতে পুলিশী হামলার একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল সেসময়কার একটি ‘টেরো-কমিউনিস্ট দল’ রূপে পরিচিত ইণ্ডিয়ান প্রোলেতারিয়েত রেভলিউশনারী পার্টি’র মুখপত্র ‘গণনায়ক’ পত্রিকার ৩রা জুন, ১৯৩৩ তারিখের সংখ্যায়। সংবাদটি ছিল—
“গত ২৮শে মে সকাল ৬টায় একদল সাব-ইন্সপেক্টর কয়েকজন পুলিশ সহ গণশক্তি পাবলিশিং হাউসে ১টা পর্যন্ত খানাতল্লাসি করিয়াছে এবং ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর’ সমস্ত কপি, ‘রাষ্ট্র ও আবর্তন’ এবং কম্যুনিস্ট রিপোর্ট’ লইয়া গিয়াছে।”
অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা (১৯৩৪) করার পূর্বেই ব্রিটিশ সরকার তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে দিয়েছিল। যাহোক, গণনায়ক ছাড়াও সেইসময় বিভিন্ন মার্কসবাদী-বিপ্লবী গোষ্ঠীর (ব্রিটিশরা যাদের ‘টেরো-কমিউনিস্ট বা Terrorist Communist বলতো) পক্ষ থেকে আরো কতকগুলো সংবাদ-সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হত। যেমন—কারখানা’, লালনিশান’, সর্বহারা’, ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘জনসাধারণ’ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় তাত্ত্বিক বুলেটিন কমিউনিস্ট’ (এটি অবশ্য প্রধানত পার্টির অভ্যন্তরে প্রচারিত হত) প্রভৃতি। এছাড়া সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত ‘গণবাণী’। ১৯৩৪-এর জানুয়ারীতে প্রায় সাত বছর পরে ইউরোপ থেকে কলকাতায় ফিরে মাকর্সবাদী সৌম্যেন ঠাকুর ১৯৩৪-এর ২ আগস্ট (১৭ শ্রাবণ, ১৩৪১) তারিখে সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ প্রকাশ শুরু করেন। সি. পি. আই. এর সঙ্গে তার মতাদর্শগত বোঝাপড়া ছিল না। স্বাধীনভাবেই ‘বিপ্লবী কমিউনিস্ট (R. C. P. I.) পার্টি গঠন করে তিনি কাজ করতে থাকেন। এই সময়কালেই প্রকাশিত হয় ‘কমিউনিজম ও বুর্জোয়া সৌম্যেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি। শুধু তাই নয় ২২০ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট ঠিকানায় ‘গণবাণী পাবলিশিং হাউস’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও তিনি চালু করেন যেখান থেকে নিয়মিত মার্কসীয় সাহিত্যের প্রচার চালানো হত।
১৯৩০-এর দশকে কয়কটি পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড জোরদার হয় উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযাগ্য। এই পত্রিকার আড্ডাকে কেন্দ্র করে হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি, বিষ্ণু দে প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ ঘটত। সুধীন্দ্রনাথ দত্তর সম্পাদনায় ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রকাশ (১৯৩১) এই ধারায় একটি নতুন সংযোজন ছিল। পরিচয়কে কেন্দ্র করেই বাঙলার চিন্তা-চেতনার জগতে কিছু বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকের তৎপরতা সৃষ্টি হয়। সুধীন্দ্রনাথ নিজে কমিউনিজমের আদৌ সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও তার পত্রিকাকে তিনি প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা এমনকি মার্কসবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলেন। এই ‘বুর্জোয়া উদারতা’ তাঁর ছিল। সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা, সমাজদর্শন ও শিল্প-সাহিত্য বিশেষণে মাকর্সবাদী তত্ত্বের প্রয়োগ, লেখক-শিল্পীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে এবং সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ব্যাপক অগ্রগতি বিষয়ে ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধেই অসংখ্য লেখা ‘পরিচয়’-এর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হত। পরিচয়ের পৃষ্ঠায় যে সকল মাকর্সবাদী বুদ্ধিজীবী লিখতেন বাঙলার শিক্ষিত সমাজে তারা যথেষ্টই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুশোভনচন্দ্র সরকার, নীরেন্দ্রনাথ রায়, হিরণ কুমার সান্যাল, বিষ্ণু দে, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। মার্কসবাদী রূপেই এঁরা সুপরিচিত ছিলেন। এ ছাড়াও আরো অনেকে এঁদের সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন। পরবর্তীকালে (১৯৪৩) পরিচয়’ পত্রিকার মালিকানা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছেড়ে দেন কমিউনিস্ট পার্টির হাতে।৫ এছাড়া ছিল অগ্রণী ও অরণির (সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত) মত মার্কসবাদ প্রভাবিত পত্রিকাগুলি।
লক্ষ্ণৌ কংগ্রেস ১৯৩৬ সালে চলাকালীন সময়ে নেহরু প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সহযোগিতায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবি ও সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রথম সংগঠন ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ গড়ে ওঠে। এই সংগঠন গড়ার পটভূমিকা ছিল ১৯৩৩ সালের জার্মানীতে হিটলারের নাৎসী দলের ক্ষমতা দখল এবং ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান এবং তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী আন্দোলন। বস্তুতপক্ষে কমিণ্টার্নের সপ্তম কংগ্রেসে ‘ডিমিট্রভ থিসিস’ পেশ করা হয়েছিল ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রেক্ষাপটেই। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল। League against Imperialism গঠন তারই প্রত্যক্ষ ফল। ১৯৩৫-এর ২১ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে রোমাঁ রোলাঁ, আঁদ্রে জিদ, আঁদ্রে মালরো, ই. এম. ফস্টার আলডাস হাক্সলি, মাইকেল গোল্ড, জন স্ট্রাচি প্রমুখ বরেণ্য সাহিত্যিক ও মনীষিরা যোগ দিলেন। আহ্বান জানালেন ফ্যাসিস্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে সকল মানব-প্রেমিক শিল্পী সাহিত্যিককে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অগ্রসর হতে। এই বিশ্ব সম্মেলনে ভারতীয় লেখকদের পক্ষ থেকে মুলকরাজ আনন্দ উপস্থিত ছিলেন।
১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত AIPWA-র ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে তৈরি হয়েছিল ১৯৩২-৩৪ সালের লণ্ডনের মাটিতে। সেখানে মূলকরাজ আনন্দ, সাজ্জাদ জাহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানী ভট্টাচার্য, ইকবাল সিং, রাজা রাও মহম্মদ আসরফ প্রমুখ লণ্ডন প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের দ্বারা। এই আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৩৬-এর এপ্রিলে লক্ষ্ণৌতে মুন্সী প্রেমচন্দর সভাপতিত্বে গঠিত হল ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। প্রকৃতপক্ষে প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে ছিল মার্কসীয় বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় উদ্যোগ। সদ্য ইউরোপ-প্রত্যাগত সাজ্জাদ জাহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবি ও লেখকদের সচেতন প্রচেষ্টা ও উদার মানবিক দৃষ্টি সেদিন এই সংগঠনের মধ্যে টেনে এনেছিল বহু অমাকর্সবাদী কিন্তু জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ খ্যাতিমান লেখক ও শিল্পীকে। AIPWA-র প্রথম সভাপতি প্রেমচন্দ্র ছিলেন এঁদের অন্যতম। সাজ্জাদ জাহির হয়েছিলেন AIPWA-র সম্পাদক।৭ প্রগতি লেখক সংঘের এই ঘোষণাপত্রটি ছিল সুদীর্ঘ এবং নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্তেহারের প্রধান কয়েকটি বাক্য উল্লেখযোগ্য –
“….যা কিছু আমাদের নিশ্চেষ্টতা, অকর্মণ্যতা, যুক্তিহীনতার দিকে টানে, তাকে আমরা প্রগতিবিরোধী বলে প্রত্যাখান করি। যা কিছু আমাদের বিচার বুদ্ধিকে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরীক্ষা করে, আমাদের কর্মনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপটু ও সমাজের রূপান্তরক্ষম করে, তাকে আমরা প্রগতিশীল বলে গ্রহণ করব।”৮
সন্দেহ নেই এই ইস্তেহারে ভারতের বৌদ্ধিক জগতে দায়বদ্ধ শিল্প-সাহিত্য সৃজনের এক নতুন যুগের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল।
লক্ষ্ণৌ সম্মেলনে গৃহীত AIPWA-এর ঘোষণাপত্রকে ভিত্তি করে বাঙলার প্রগতিশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা একটি সাংগঠনিক কমিটির মাধ্যমে এই সময়কালেই শুরু করে দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নানা ধরণের সংস্কৃতিমূলক কাজ। ১৯৩৬-এ ১৮ই জুন গোর্কির মৃত্যু সংবাদ ঘোষিত হলে বাঙলার ‘প্রগতি লেখক সংঘের সাংগঠনিক কমিটি’ ১১ই জুলাই অ্যালবার্ট হলের কমিটি একটি শোকসভার আয়োজন করেন। এই সভায় আহ্বায়ক ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (সভায় তিনিই সভাপতিত্ব করেন), কাজী নজরুল ইসলাম, হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, বিবেকানন্দ মুখার্জী, ড. ধীরেন সেন (সম্পাদক, অ্যাডভান্স) ও খগেন্দ্র সেন। গোর্কির এই শোকসভা থেকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তকে সভাপতি ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে সম্পাদক করে ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।৯
বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘর উদ্যোক্তারা অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ কাছাকাছি ছিলেন একথা বলাই বাহুল্য। সি. পি. আই. যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এবং প্রাদেশিক ক্ষেত্রগুলিতে দৃঢ়ভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বৃহৎ মঞ্চ রূপেই ব্যবহার করতে চেয়েছিল তার প্রমাণ মেলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংঘ দ্বারা ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফর দি ডিফেন্স অব পীস’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং জাতীয় ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমচন্দ্র, সরোজিনী নাইডু, সুমিত্রানন্দন পন্থ, আবুরী রামকৃষ্ণ রাও, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে। ১৯৩৬-এর ১৬ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের ডাকে আশুতাষ কলেজের হলে অনুষ্ঠিত গোর্কির স্মৃতিসভায় এক বাণী পাঠিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কির প্রতি তার শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রবীন্দ্রনাথকে প্রগতি লেখক সংঘ পরেও সঙ্গে পেয়েছিল।
সূচনা পর্ব থেকেই ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রোমাঁ রোলাঁ পরিচালিত ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফর দি ডিফেন্স অফ পীস’ এবং লীগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম এ্যাণ্ড ওয়ার’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। জাতীয় ক্ষেত্রেও এই সংঘ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমচন্দ্র, প্রফুল্ল রায়, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জওহরলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ মনস্বীদের সমর্থন সহযোগিতা ও আশীর্বাদ বারংবার প্রার্থনা করেছে এবং তার সুফল লাভ করেছে।১০ তথাপি ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠিত হবার অব্যবহিত পরেই এর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এজেন্টদের প্ররোচনায় শুরু হয় ব্যাপক কুৎসাপ্রচার। এই কুৎসা প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তৎকালীন “দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকা এবং এর পশ্চাতে মূল প্ররোচক রূপে ছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব এম. জি. হ্যলেট প্রচারিত সার্কুলারটিই ছিল এই কুৎসা প্রচারের প্রধানতম উৎস। এই গোপন সার্কুলারটি প্রকাশের পূর্বেই অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহক ‘দি স্টেটম্যান’ পত্রিকার সিমলাস্থিত বিশেষ প্রতিনিধিদের প্রতিবেদনে সদ্যগঠিত ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার শুরু করে। তাদের প্রধান বক্তব্য ছিল ও প্রগতি লেখক সংঘের উদ্ভব একটি কমিউনিস্ট রণকৌশল ও ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছে কিছু তৎপর ও দক্ষ কমিউনিস্ট।১১
এই প্রসঙ্গে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র তৎকালীন প্রখ্যাত সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার-এর একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমরা স্মরণ করতে পারি। ‘স্টেটসম্যান’-এর বিশেষ সংবাদদাতার এই হীন ও কুৎসাপূর্ণ অপপ্রচার এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশ দমননীতি ও সেন্সর বিভাগের চরম কাণ্ডজ্ঞানহীনতার তীব্র সমালোচনা করে পরদিনই সত্যেন্দ্রনাথবাবু ‘আনন্দবাজার পত্রিকায় তীব্র ভাষায় একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখে এর জবাব দেন। উক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধে শ্ৰীযুক্ত মজুমদার লিখেছিলেন –
‘সম্প্রতি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা এ বিষয়ে গভর্ণমেন্টকে যথেষ্ট উস্কানি দিতেছেন। মায়ের চেয়ে যেমন মাসীর দরদ বেশী তেমনই ‘স্টেটসম্যান’ নিরন্তর সাম্যবাদ সম্পর্কে ভারতবাসীকে সজাগ করিয়া সরকারী দমননীতিকে উগ্রতর করিবার প্ররোচনা দিতেছেন। মস্কোফেরৎ কমিউনিস্টদের লাল আতঙ্ক বিস্তারের কোনো প্রমাণসিদ্ধ সন্ধান না পাইলেও এই পত্রিকার বিশেষ-অজ্ঞ সংবাদদাতাগণ প্রায়শই জুজুর ভয়ে আঁতকাইয়া উঠিতেছেন। গত ৭ই জুলাই তারিখে কাগজে তাঁহারা পুনরায় কমিউনিস্ট প্রোপাগাণ্ডা’ শীর্ষক দীর্ঘ দুই কলম ব্যাপী সংবাদ রচনা করিয়া এই দেশের অজ্ঞ জনসাধারণকে জানাইয়া দিয়াছেন যে, Progressive Writers’ Association নামে গত বৎসর ইংলণ্ডে ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকদের যে সমিতি গঠিত হইয়াছিল এবং বিগত লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে যাঁহাদের প্রথম বার্ষিক অধিবেশন হইয়াছিল, তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ভারতবর্ষকে রসাতলে লইয়া যাওয়া।……কুকুরকে বদনাম দিয়া ফাঁসিতে লটকাইবার মতো ইহা এক হীন চক্রান্ত মাত্র। দেড়শত বৎসরের ইংরাজ শাসনে যে দেশ ও জাতি মনুষ্যত্বের মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, … তাহাদের পথে নিশ্চয়ই এমন কোনো সাহিত্যের প্রয়োজন নাই, সে সাহিত্য তাহাদিগকে জীবনের বাস্তবতা হইতে দূরে রাখিয়া দাসত্বের সুখনিদ্রায় ঘুম পাড়াইয়া রাখিবে। প্রকৃতপর যাহাতে আমরা সাহিত্যের বিলাসিতা লইয়া মুগ্ধ থাকি এবং জাতীয় দৈন্য, অপমান ও বুভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিয়া প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শোষণকেই একমাত্র বরণীয় বলিয়া গ্রহণ করি, এই দেশের ধনিক রাষ্ট্র ও সমাজকর্তাগণের ইহাই হইতেছে সর্বপ্রধান লক্ষ্য।১২
সরকারী ও বেসরকারী কুৎসা প্রচার সত্ত্বেও দিল্লিতে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সম্মেলনের অল্পকাল পরেই কলকাতা, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, আলিগড়, দিল্লী, লাহোর বোম্বাই, পুণা, দেরাদুন, ওয়ায়োর প্রভৃতি দেশের প্রধান প্রধান শহরে প্রগতি লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জাহীর এর তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন। তার মর্মার্থ ছিল নিম্নরূপ-
“ …ভারতবর্ষে আন্তর্জাতিক প্রগতি লেখক সংঘের দ্রুত বিস্তৃতি দেখিয়া (ছয় মাসের মধ্যে সংঘের এগারোটি শাখা সংস্থাপিত হইয়াছে) ভারত গভর্ণমেণ্ট যে আমাদের ক্রিয়াকলাপের পশ্চাতে মস্কোর অদৃশ্য হস্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করিবেন তাহা বিস্ময়ের বিষয় নহে। …আপাতত হেতু দাঁড়াইয়াছে সোশ্যালিজম্ ও কমিউনিজম্। গত এপ্রিল মাসে লক্ষ্ণৌতে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙেঘর প্রথম অধিবেশনে গৃহীত সংঘের ইস্তেহারেই ইহার উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হইয়াছে। …প্রগতি লেখক সংঘ কোনো গুপ্ত প্রতিষ্ঠান নহে, সুতরাং যে কেহ ইচ্ছা করিলে নিজেই প্রমাণ করিতে পারিবেন যে, ‘স্টেটসম্যান’-এর প্রবন্ধে আমাদের যাহা বলা হইয়াছে, তাহার অধিকাংশই ডাহা মিথ্যা। আমাদের অধিকাংশ সদস্যই বিশিষ্ট ভারতীয় লেখক, …আমাদের ইস্তেহারে বর্ণিত উদ্দেশ্য যাঁহারা সমর্থন করেন, তাঁহারাই আমাদের সঙেঘর সদস্য হইতে পারেন। প্রগতিবাদী সমস্ত ভারতীয় মণীষীদিগকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া হইতে রক্ষা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। …স্টেটম্যান ও তার গভর্ণমেণ্ট এই ব্যাপারে যতটুকু বুদ্ধির পরিচয় দিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট আমি তাহা অপেক্ষা বেশী বুদ্ধি আশা করি না, কিন্তু ভারতের শিক্ষিত সমাজ প্রগতি লেখক সংঘের উদ্দেশ্য প্রণিধান করিয়া সংঘকে সমর্থন করিবেন, তাহা আমি নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করি।”১৩
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ‘স্টেটম্যান’ পত্রিকা পুরোপুরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান রূপেই কাজ করেছিল। স্টেটম্যান’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটির সঙ্গে সরকারী ‘হ্যালেট সার্কুলার’–এর সাদৃশ্য দেখে মনে হয় যে সংগঠিত একটি পবিকল্পনা সে সময় গ্রহণ করা হয়েছিল যাতে প্রগতি লেখক সংঘে’র বিরুদ্ধে প্রচার সংঘটিত করা যায়। সরকারী সার্কুলারটির মর্মার্থ ছিল নিম্নরূপ-
HALLET CIRCULAR (File No. 7/9/36 Home/Political 1936)
Sub: Warning conveyed to Local Governments regarding the Indian Progressive Writers’ Association.
From : The Secretary to the Govt. of India,
Home Dept,
To : The All Local Governments.
“…. The Association has already Attracted interest and some Support form persons of an intellectual type who are unlikely to have any sympathy with communism or other revolutionary theories. The association is however a typical example of the method, now being persued by communist in all countries in accordance with the current policy of the Communist International.
“This method is for a few convinced and trained Communist to establish contacts with all sorts of organisations and societies having interest in intellectual, cultural and social subjects with the object of spreading Communistic ideas and gaining converts.”১৪
এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-র প্রতিষ্ঠা ও কর্মসূচী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে কতখানি বিব্রত ও আতঙ্কিত করে তুলেছিল। মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকগণ প্রগতি-সাহিত্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন এ কথা সত্যি, কিন্তু কখনোই ঐ সংগঠনটি কোনো সঙ্কীর্ণদলের স্বার্থে পরিচালিত হয়নি। বরঞ্চ বাঙলাদেশের বিভিন্ন মতের ও পথের বুদ্ধিজীবীদের একই মঞ্চে সমবেত করার চেষ্টাই ঐ সংগঠনটির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। বস্তুতপথে ঐতিহাসিক বিচার এই যুগসন্ধিক্ষণ একটি উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ভারতের কমিউনিস্টরা কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছিলেন— তা হল সেসময় শিক্ষিতমধ্যবিত্ত তরুণ মানসে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে যে আগ্রহ ও সহানুভূতি প্রধানত ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতার সূত্রেই ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করছিল—তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে আদর্শগত সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিহত করা। জাতীয় চেতনা যাতে ফ্যাসিবাদী দর্শনের মত একটি ক্ষয়িষ্ণু ও সভ্যতা-বিরোধী ভাবনায় কলুষিত হতে না পারে তার জন্য রবীন্দ্রনাথ সহ ভারতের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা প্রগতি লেখক ও গণ-সাংস্কৃতিক আন্দোলন (পরবর্তীকালে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) কমিউনিস্ট পার্টিরই নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক সংগ্রাম পরিচালনা করে বাঙলা তথা ভারতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত করে।
বাঙলা তথা ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই পর্যায়ে গণ-সংস্কৃতির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ স্থাপিত হওয়ার পর বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ ১৯৩৯-৪০ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকার পর ক্রমশ তার গতি নানা কারণে শ্লথ হয়ে আসে। কিন্তু ১৯৪১ এর সোভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই গঠিত ‘সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি’-র মাধ্যমে পুনরায় বাঙলার বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্ৰ-মহিলা প্রভৃতি কমিউনিস্ট গণসংগঠনগুলির পাশাপাশি সাহিত্য ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগণের মধ্যে জাপানী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার গুরুত্ব অনুভূত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ (AFWAA)।
ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ (Anti-fascist Writers’ & Artists’ Association)
১৯৪২-এর ৮ মার্চ মাত্র ২১ বছর বয়সে ঢাকার তরুণ লেখক ও কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক সোমেন চন্দ রেলশ্রমিকদের একটি মিছিল নিয়ে সুত্রাপুর সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে ‘সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতির আহ্বানে একটি ফ্যাসিস্ট-বিরোধী সম্মেলনে যোগদান করতে যাওয়ার পথে কমিউনিস্ট-বিরোধী বাম-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণে নৃশংসভাবে নিহত হন। এই ঘটনার কিছু সময় পূর্বে (বঙ্কিম মুখার্জি, স্নেহাংশু আচার্য এবং জ্যোতি বসু ছিলেন সভার বক্তা) সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির যে সম্মেলন হচ্ছিল সেখানে বাম জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর (প্রধানত RSP) পক্ষ থেকে সশস্ত্র হামলা চালান হয়েছিল। পুলিস ঐ হামলা প্রতিহত করতে চাইলে আক্রমণকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং পুলিশের গুলিতে একজন বাম-জাতীয়তাবাদী কর্মী অখিল দাস নিহত হন। সম্মেলনে যোগ দিতে আসার পথে নিরীহ সোমেন চন্দ-র হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্ব ঘটনারই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। বস্তুতপক্ষে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অক্ষশক্তির সমর্থক জাতীয়তাবাদীদের ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ যে কত তীব্র ছিল তা বোঝা যায় সোমেন চন্দ-র নৃশংস ও অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ পাঠ করলে। একজন সম্ভাবনাময় তরুণ লেখক রূপে সোমেনের মৃত্যু বাঙলার প্রায় সমগ্র বুদ্ধিজীবী-লেখকশিল্পী-সাহিত্যিক মহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন গণসংগঠন এবং সমসাময়িক সংবাদপত্রগুলিও সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র শোক ও ধিক্কার জানায়। ‘নিখিল ভারত সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হীরেন মুখার্জি, ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’-এর সাধারণ সম্পাদক সুধীন্দ্র প্রামাণিক, ভারতীয় লেবার পার্টির সম্পাদক নন্দলাল বসু, ‘নিখিল ভারত কিষাণ সভা’র সম্পাদক গোপাল হালদার এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন’-এর সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য যে বিবৃতি দেন তাতে সোমেন চন্দ-র উপর এই কাপুরুষোচিত ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করা হয়। কার্যত সোমেনের মৃত্যুর পরেই বাঙলায় ফ্যাসিস্ট-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন পূর্ণ গতিবেগ লাভ করে। দীর্ঘদিন নিরব থাকার পর কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে প্রগতি লেখক সংঘ পুনরায় একটি ফ্যাসিস্ট-বিরোধী বুদ্ধিজীবী সংগঠন রূপে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা মূলত ফ্যাসিবাদের ও অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যাপক ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গঠনে উদ্যোগী হয়। অ-কমিউনিস্ট এমনকি নীতিগত ভাবে যারা কমিউনিজমের বিরোধী তারাও ছিলেন এই ‘যুক্তফ্রন্টে স্বাগত। এরই ফল স্বরূপ ১৯৪২-এর ২৩ মার্চ বাঙলার কয়েকজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সোমেন চন্দ-র হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, প্রমথ বিশী, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতির্ময় ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ রায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, বিমলপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আবদুল কাদের, কামাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হিরণকুমার সান্যাল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, সরোজ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে এবং শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী। বিবৃতিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বিবৃতির মাধ্যমে বলা হয়ছিল-
“সোমেন চন্দ একজন উদীয়মান ও বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। তিনি তাঁহার নিজের চিন্তাধারার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া অনুরূপভাবে দেশের ও দশের সেবায় যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাহাতেই তাহার প্রকৃতির উৎকর্ষ সূচিত হইতেছে। ফ্যাসিবাদের কুৎসিৎ মূর্তি দেখিয়া প্রত্যেক দেশের সাহিত্যিকের মতই ফ্যাসিবাদের প্রতি নিজেদের ঘৃণা জানাইয়াছেন। ভারতবর্ষে আমরা আমাদের সভ্যতার আভ্যন্তরীণ এই দুষ্ট ক্ষত সম্পর্কে তীব্রভাবে এবং একবাক্যে নিজেদের মনোভাব জ্ঞাপন করিয়াছি। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপেক্ষা এত তীব্রভাবে সম্ভবত আর কেহই ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেন নাই। এই দুর্দিনে দেশের মধ্যে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী দল সংগঠন করিতে সোমেন চন্দ যে অগ্রসর হইবেন ইহাতে আশ্চর্যের কিছুই থাকিতে পারে না। মাত্র এই কারণেই এবং এই অভিযোগেই গুপ্তঘাতকের হস্তে তাহাকে আত্মবলি দিতে হইয়াছে। আমাদের এক জন নির্ভীক সহকর্মীর মৃত্যুতে আমরা সন্তপ্তচিত্তে দেশের জনসাধারণের নিকটে এই রক্ত লিপ্সা এবং বিষ কলুষ মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে একবাক্যে তীব্র ঘৃণা জ্ঞাপন করিতে আবেদন জানাইতেছি।”১৫
বাঙলার প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের এই বিবৃতি ছাড়াও সোমন চন্দ-র হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া রূপে অসংখ্য রিপোর্ট, নিবন্ধ, প্রতিবাদ-পত্র, বিবৃতি, কবিতা, সাহিত্যিক রচনা ও স্মৃতি কথা বাঙলার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি প্রকাশের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল— ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অরণি’ সাপ্তাহিক পত্রিকা, ‘পরিচয়’ মাসিক পত্রিকা, প্রতিরোধ’ সাহিত্য পত্র প্রভৃতি। এছাড়া সোভিয়েত সুহৃদ্ সমিতির আহ্বানে বাঙলার বিভিন্ন জেলায় সোমেন চন্দ-র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সভা ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র-ফেডারেশনের নির্দেশক্রমে ‘ঢাকা জেলা ছাত্র ফেডারেশনের’ উদ্যোগে ১৭ই মার্চ (১৯৪২), সোমেনকে হত্যা করার সপ্তাহ কালের মধ্যেই, ঢাকায় ‘নিখিল বঙ্গ সোমেন দিবস’ পালন করা হয়।১৬
বস্তুতই সোমেন চন্দ-র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফলে বাঙলাদেশের প্রগতিশীল লেখকেরা সচকিত হয়ে ওঠেন সোমেনের আত্মদান তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিপুল প্রেরণা রূপে দেখা দেয়। বাঙলার প্রগতিশীল লেখক ও সাহিত্যিকরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করেন যে আর দেরি নয়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র মৌখিক ধিক্কার উচ্চারণই নয়, অবিলম্বে ফ্যাসিবিরোধী লেখকদের একটি সংগঠনের মধ্যে এনে সুসংহতভাবে কাজও শুরু করতে হবে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনমানসে চেতনা জাগ্রত করার জন্য বাস্তব কার্যক্রমও গ্রহণ করতে হবে। অবিভক্ত বাঙলায় জনযুদ্ধের যুগে এইভাবে সাহিত্যিক সোমেন চন্দ-র নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড বাঙলার ফ্যাসিস্ট বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক নির্দেশক ঘটনা হয়ে উঠেছিল।
এই ঘটনার প্রতিবাদে BPSF-এর উদ্যোগে ২৮ মার্চ (১৯৪২) তারিখে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি হলে’ একটি ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক সমাবেশ আহ্বান করা হয় সেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এই সমাবেশে অংশ নিয়ে কবিতা পাঠ করেন বুদ্ধদেব বসু এবং বক্তব্য রাখেন অমিয় চক্রবর্তী, নীহাররঞ্জন রায়, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, হিরণকুমার সান্যাল, গোপাল হালদার, আব্দুল কাদের ও অতুল গুপ্তের মতন বাঙলার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদগণ। এই সম্মেলন থেকেই অতুল চন্দ্র গুপ্ত, গোপাল হালদার, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও বিষ্ণু দে-কে আহ্বায়ক করে ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এর সাংগঠনিক কমিটি গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। অবশ্য হীরেন মুখার্জির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় নব গঠিত ‘ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ যা ১/১০ প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোড, কালিঘাটে অফিস করে কাজ শুরু করেছিল তার সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং যুগ্ম সম্পাদক হন কবি বিষ্ণু দে এবং ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রখ্যাত লেখক ও শিল্পীবৃন্দ যথা যামিনী রায়, অতুল গুপ্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সত্যেন মজুমদার, হিরণকুমার সান্যাল, সজনীকান্ত দাস, নরেশ সেনগুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ।১৭
ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা ইউনিভাসির্টি ইনস্টিটিউট হলে (১৯ – ২০ ডিসেম্বর ১৯৪২)। বাঙলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও লেখকরা এই সর্বভারতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। প্রখ্যাত লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মূল সভাপতি। এছাড়া আরও ৪ জন হবিবুল্লাহ বাহার, আবু সঈদ আয়ুব, বুদ্ধদেব বসু ও যুগান্তর-সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীতে। অতুলচন্দ্র গুপ্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেন এবং হিরণ কুমার সান্যাল অভ্যর্থনা সমিতির অভিভাষণ পাঠ করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এই সম্মেলনে জাতীয়স্তরের লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা বার্তা পাঠিয়েছিলেন বা যোগদান করেছিলেন। এই সম্মেলনের পরেই ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটে-এর অফিসকে কেন্দ্র করে বাঙলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য লেখক ও শিল্পীকে জাপ-আক্রমণ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিল। বিশেষত বাঙলার অবহেলিত লোকসাহিত্য ও শিল্পকলাকে তারা ব্যবহার করেছিল তাদের আদর্শগত সংগ্রামের অন্যতম মাধ্যম রূপে।১৮
এই প্রথম সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন ‘পরিচয়’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক হিরণকুমার সান্যাল এবং উদ্বোধক ছিলেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত (রাহুল সাংকৃত্যায়নের অনুপস্থিতিতে)। সভাপতির আসন থেকে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার ঐতিহাসিক ফ্যাসিস্ত-বিরোধী ভাষণে প্রকারান্তরে কমিউনিস্ট পার্টির ‘জনযুদ্ধ নীতি’কেই সমর্থন জানান। তারাশঙ্করের লিখিত অভিভাষণে অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপ-
“ভারতবর্ষের জনশক্তি, তার নেতৃবৃন্দ, তার বুদ্ধিজীবীগণ, তার সংবাদপত্র কোনোদিনই তার সত্য কর্তব্য করতে বিস্মৃত হয়নি। তার শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিবাদের উদ্ভবকাল থেকেই ওই আদর্শকে হীন বলে ঘোষণা করে এসেছে। ভারতের জাতীয় সংবাদপত্র ফ্যাসি-বিরোধী নীতি এবং আদর্শকে জনসাধারণের মধ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচার করে এসেছেন। ভারতের জনসাধারণ, তার শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান, তার সংবাদপত্র, তার সাহিত্যিক, মণীষীবর্গ কেউই চায় না ফ্যাসিবাদী জার্মানীকে, জাপানকে অথবা ইটালিকে। কিন্তু তবু আমাদের সম্মুখে এক অদ্ভুত সমস্যা। ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের দমননীতি, ভেদনীতি, কূটনীতি ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উত্তোলিত জনশক্তির উদ্যত হাত পঙ্গু করে দিয়েছে। ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান আজ বিপর্যস্ত, নেতারা বন্দী। উন্মত্ত জনসাধারণ সমগ্র দেশে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে— তার ফলে জনশক্তির ব্যর্থ অপচয় হয়ে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। … “ভারতের জনসাধারণ একটা শিকল খসাবার জন্য আর একটা শিকল চায় না এবং চাইবে না। ভারতের ইতিহাসে এই ভুলের বহু পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সে-ভুলের মাসুল দিতে দিতে আবার সেই ভুল আমরা করব না। একদল লোক মুষ্টিমেয় হলেও আছে, যারা বলে— আমরা তো গোলামী করতে আছিই, গোলামী আমরা করব। হয় এর নয় ওর। তাদের আমি বলি ক্লীব। এই ক্লীব জাতির মধ্যে হতেবিলুপ্ত হোক।”১৯
তারাশংকরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এই সংঘের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে সকল লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীকে টেনে আনতে উদ্যোক্তারা যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সেল (যার প্রথম তিনজন সদস্য ছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ, সুধী প্রধান ও বিনয় রায়) এই সংঘের অধিকাংশ কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান করতো, তবু এটা লক্ষণীয় যে, সংঘের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্যও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। মূল সভাপতি তারাশঙ্কর তো ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ কংগ্রেসকর্মী। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য ‘ফ্যাসিস্ত-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এবং ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ পরিত্যাগ করে ‘কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে’ যোগ দেন।২০
পরবর্তীকালে যাই ঘটুক না কেন, জনযুদ্ধের যুগে, অন্তত ফ্যাসিস্ত-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলাকালে কমিউনিস্ট পার্টি কোনো সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হয়নি কিংবা কেবলমাত্র কমিউনিস্ট লেখক ও শিল্পীদের নিয়েই তাদের সংঘ বা সমিতি গড়ে তোলেনি। বরঞ্চ দেখা গেছে, ফ্যাসিস্ত-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে’র যাঁরা প্রধান ব্যক্তিত্ব, তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক মতামতের দিক থেকে ছিলেন কমিউনিজম-বিরোধী। এখানেই ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির কৃতিত্ব, বিচক্ষণতা ও উদারতা। এই অভিমত অধিকাংশ ঐতিহাসিকেরই।
তথ্যসূত্র নির্দেশিকা
১. ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত, বাঙলার সংস্কৃতিতে মার্কসবাদী চেতনার ধারা, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৯৯২
২. বাসব সরকার, মাকর্সবাদী বুদ্ধিজীবীদের সমাজ-মানস বিশ্লেষণ (নিবন্ধটি ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত পূর্বোক্ত বাঙলার সংস্কৃতিতে মার্কসবাদী চেতনার ধারা গ্রন্থে সঙ্কলিত), পৃঃ ৩৭৪-৪২২।
৩. ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত, মাকর্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক, ১ম খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭৫
৪. আব্দুল হালিম, বাংলা সাহিত্য মার্কসবাদী ভাবধারার সূচনা; নবজীবনের পথ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৯৬৬
৫. শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, পরিচয়-এর আড্ডা কে. পি. বি, কলকাতা, ১৯৯০ এবং হিরণ কুমার সান্যাল, পরিচয়-এর কুড়ি বছর ও অন্যান্য স্মৃতিচিত্র, কলকাতা, ১৯৭৮
৬. হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তরী হতে তীর মণীষা, ১৯৭৪, পৃঃ ৩০১
৭. দ্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ জুন, ১৯৩৬ এবং ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত বাঙলার সংস্কৃতিতে মার্কসবাদী চেতনার ধারা, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
৮. ইংরাজী থেকে অনূদিত দ্রঃ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রগতি লেখক আন্দোলন ও অর্ধশতাব্দী মন্থিত স্মৃতি’, ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত পূর্বোক্ত।
৯. ধনঞ্জয় দাশ (সং) মাকর্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক, প্রথম খণ্ড, কলকাতা ১৯৭৫, পৃঃ এগারো, দ্রষ্টব্য আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট, ১৯৩৬।
১০. দ্রঃ ধনঞ্জয় দাশ, পূর্বোক্ত ও নেপাল মজুমদার, ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, দে’জ, কলকাতা।
১১. দ্য স্টেটসম্যান, ৭ জুলাই, ১৯৩৬।
১২. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জুলাই, ১৯৩৬।
১৩. ইংরাজী থেকে অনূদিত- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ জুলাই, ১৯৩৬।
১৪. সুধী প্রধান (সম্পাদিত ও সঙ্কলিত), মার্ক্সিস্ট কালচারাল মুভমেন্ট ইন ইণ্ডিয়া, ভল-১, কলকাতা, পৃঃ ১০৭-০৮
১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩মার্চ, ১৯৪২
১৬. সংবাদ-দাতার পত্র; আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯ মার্চ, ১৯৪২
১৭. অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৮ মার্চ, ১৯৪২ এবং Hiren Mukherjee,’Bengal Progressive Writers Getting together for the People’; Peoples War, 15Nov. 1942. এছাড়া দ্র. চিন্মাহন -সহানবীশ, সংস্কৃতি আন্দোলনের নতুন ধারা; পরিচয় ফ্যাসিস্ট-বিরোধী সংখ্যা, ১৯৭৫
১৮. চিন্মাহন সহানবীশ, ৪৬ নং: একটি সংস্কৃতিক আন্দালন প্রসঙ্গ কলকাতা, ১৯৮২
১৯. তারাশংকর বন্দ্যাপাধ্যায়, সংগ্রাম ও শিল্পী; অভিবাদন, পৗষ-মাঘ, ১৩৪৯ ২০. সুধী প্রধান, তারাশংকর কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসার জবাব, সংস্কৃতির প্রগতি; কলকাতা।
ভালো লেখা।
অনেক কিছু জানতে পারলাম এ লেখা পড়ে। তবে কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে দ্বিমতও আছে
খুব ভালো লাগলো। বেশ কিছু অজানা অধ্যায় জানতে পারলাম। এই লেখাটির কি একাধিক পর্ব হবে?
সমাজ প্রগতির যাত্রীূদের বারবার পাঠ করা দরকার। ফ্যাসিবাদ,সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লেখক শিল্পীসহ প্রগতিকামীদের আন্দোলনে অনুপ্রানিত করে।