সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পিতামহী পৃথিবীর ইতিহাস

পিতামহী পৃথিবীর ইতিহাস

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

আগস্ট ১২, ২০২০ ১৬৭৬ 11

মাত্র সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে মানুষ (Homo sapiens) মাইগ্রেট করেছে; একদিন পৌঁছে গেছে ইউরেশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। আগে ওরা থাকত আফ্রিকাতে। এই সত্তর হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে মানুষের জয়যাত্রা চলছে। তবে মহাকালের মানদণ্ডে সত্তর হাজার বছর অতি নগণ্য সময়। পৃথিবী কবে তৈরি হল? মানুষের জয়যাত্রার সত্তর হাজার বছর আমাদের এই নীল গ্রহের ইতিহাসে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কবে এসেছে প্রথম প্রাণের স্পন্দন? তা, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর হয়ে গেল।

এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের গ্রহের পরিবেশ ও পরিস্থিতির আগাপাশতলা পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবী যখন ছিল তার শৈশবে তখন তার ভিতরের আগ্নেয়গিরি এবং লাভার কারণে তাপমাত্রা ছিল অত্যন্ত বেশী। সেই সময়ে এই গ্রহ ছিল না সবুজ ও সুন্দর। সে ছিল ভয়ঙ্কর। চারিদিকে ম্যাগমার সমুদ্র, আকাশ থেকে খসে পড়ছে বড় বড় অগ্নিপিণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল নিষ্প্রাণ।

একসময়ে নিষ্প্রাণ পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে। সম্ভবত ৪২৮ কোটি বছর আগেই এসে গেছে অতি সরল কোন প্রাণের চিহ্ন।

এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে গ্রীনল্যান্ডে এক ধরণের শিলার অভ্যন্তরে যা অন্তত ৩৭০ কোটি বছরের পুরানো বলে মনে করা হয়েছে। প্রাচীন সমুদ্রের তলদেশে পুরনো শিলার ভিতরে ছোট ছোট ছিদ্রগুলিতে পাওয়া যায় প্রাণের অন্যতম প্রাচীন জীবাশ্ম। ওই আদি প্রাণ হল এক প্রকার নীলাভ-সবুজ অলগী যাকে বলে সায়ানো ব্যাক্টেরিয়া। এটা নামে অলগী হলেও আসলে এটি বহুকোষী প্রাণী নয়, এটি একটি প্রক্যারিয়টিক ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাক্টেরিয়া সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। সায়ানো ব্যাক্টেরিয়া স্তরীভূত হয়ে তৈরি করে স্ট্রোম্যাটোলাইটস।[১] স্ট্রোমাটোলাইটসগুলি বিশেষ শিলা-জাতীয় কাঠামো। এগুলি সাধারণত অগভীর জলে গঠিত হয়।

চিত্র ১-গ্রীনল্যান্ডের ইসুয়া অঞ্চলের স্ট্রোম্যাটোলাইটসগুলি প্রাণের প্রাচীনতম জীবাশ্মের প্রমাণ হতে পারে। (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)

তারপরে এসেছে এক ধরনের মাইক্রোব যা প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিষ্কাশিত করতে পারত। অস্ট্রেলিয়াতে সেই পুরানো প্রাণের ফসিল পাওয়া গেছে।

চিত্র ২-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ান শার্ক বে-এর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ অঞ্চলে পাথরের মধ্যে পাওয়া যায় সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সালোকসংশ্লেষকারী প্রাণ। (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)

প্রাণের ক্রমবিকাশ হয়েছে এক বিশাল সময়কাল ধরে। এই দীর্ঘ সময়কালকে অনুধাবন করা সহজ নয়। তাই ওই সময়কালকে ভূতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন সেই সময়ে পাওয়া ফসিলের ভিত্তিতে।

পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ও তার বিবর্তনের রূপরেখা মোটামুটিভাবে বোঝা যায় সেই সময়কালের ফসিল থেকে। সমুদ্রের তলে, বরফের নিচে বা পাহাড়ের কোটরে রয়ে গেছে আদিম প্রাণের ফসিল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসের একেবারে আদিপর্বের প্রাথমিক অতি সরল প্রাণের ফসিল পাওয়া সহজ নয়; সেই সময়কালকে বলে প্রিক্যামব্রিয়ান কাল। ক্যামব্রিয়ান কালের আগের সময়।

মাত্র চুয়ান্ন কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে ক্যামব্রিয়ান কাল। এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময় থেকেই জটিলতর প্রাণের জীবাশ্মগুলির খোঁজ মিলেছে। প্রিক্যামব্রিয়ান কালের পর থেকে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসকে তিনটি বড় সময়কালে বিভক্ত করা হয়েছে – প্যালিওজোয়িক, মেসোজোয়িক ও সেনোজোয়িক কাল। এই কালগুলি আবার প্রতিটি বেশ কয়েকটি ছোট যুগে ভাগ করা যায়। এক একটি কালের একটি নির্দিষ্ট যুগে পাওয়া গেছে বিশেষ ধরনের প্রাণীর ফসিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মেসোজোয়িক কালের জুরাসিক যুগে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসরের ফসিল।

প্রাণ এলো, জটিলতর প্রাণ এলো। এলো অমেরুদণ্ডী প্রাণী – পোকা, স্কুইড ইত্যাদি। তারপর একসময়ে এলো মেরুদণ্ডী প্রাণী। প্রাণের পরিবর্তন হয়েছে, জটিলতর হয়েছে। একই সাথে পৃথিবীর ভূপ্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে ছিল একটাই ভূখণ্ড, পাঞ্জিয়া। কুড়ি কোটি বছর আগে পৃথিবীর টেক্টোনিক প্লেটগুলির পরিবর্তনের কারণে সেই ভূখণ্ড ভেঙে গিয়ে মহাদেশগুলি গড়ে উঠেছে। মাটি ভেদ করে উঠেছে পাহাড়, পর্বত।

কখনও আবার কক্ষপথের সামান্য পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী একটু কাত হয়ে গেছে। সেই অস্থায়ী পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধ কম সৌর-বিকিরণ পেয়েছে। তখন পৃথিবীতে এসেছে তুষার যুগ। একবার নয়, বহুবার পৃথিবীতে তুষার যুগ এসেছে। আজ থেকে এগারো হাজার ছয়শ বছর আগে শেষ তুষার যুগের অবসান হয়। আসে হলোসিন যুগ। বর্তমানে আমরা আছি হলোসিন যুগে।

জটিলতর প্রাণ এল। আবার এই বিরাট সময়কালে বেশ কয়েকবার প্রাণিকুলের গণবিলুপ্তিও ঘটেছে। প্রাণিজগতের ব্যাপক বিলোপসাধনকে বলে Mass Extinction অর্থাৎ গণবিলুপ্তি। এই বিলুপ্তি ঘটেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। অন্তত পাঁচবার পৃথিবীর প্রাণিকুল বিপন্ন হয়েছে বা বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গেছে। গণবিলুপ্তির সময়ে কখনও ৭৫% প্রাণী লুপ্ত হয়ে গেছে কখনও বা ৯৬%। তারপরেও আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে জীবজগৎ।

  • প্রথম গণবিলুপ্তি ঘটে আজ থেকে ৪৪.৪ কোটি বছর আগে, অর্ডোভিসিয়ান যুগের শেষে। তখন এসেছিল এক ভয়াবহ তুষার যুগ। সেই সময়ে সমুদ্রের স্তর ১০০ মিটার অবধি নিচে নেমে গিয়েছিল। ওই সময়ে অধিকাংশ প্রাণ ছিল সমুদ্রে। আর সমুদ্রে বসবাসকারী ৭৫% প্রাণী চিরকালের জন্য লুপ্ত হয়েছিল।
  • ডেভোনিয়ান কালের শেষ দিকে, সাড়ে সাঁইত্রিশ কোটি বছর আগে, আবহাওয়ার পরিবর্তন অগভীর সমুদ্রের জৈব বৈচিত্র্যের উপরে মারাত্মক আঘাত হানে। ওই সময়ে প্রবাল সহ জলের বিভিন্ন প্রজাতির ৭০% অবলুপ্ত হয়ে গেছে।
  • সাইবেরিয়ার বিশাল আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে পঁচিশ কোটি বছর আগে দৈত্যাকার পোকামাকড় সহ ৯৫%-এরও বেশি জৈব প্রজাতি বিনষ্ট হয়েছে। সবচাইতে ব্যাপক প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে এই সময়ে।
  • এইরকম বিপর্যয় আরও দুবার হয়েছে। কুড়ি কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক-জুরাসিক কালে তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতি হারিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত আগ্নেয়গিরির বিশাল কোন উদ্গীরণের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। এই সময় থেকে পৃথিবীতে ডাইনোসরগুলির রমরমা শুরু হয়।
  • শেষে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ভারতবর্ষে বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হয়। আর তারপরে মেক্সিকোয় একটি গ্রহাণু আঘাত করে। এই আঘাতে ডাইনোসর বংশের সব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সমস্ত প্রাণিজগতের ৭৬% লুপ্ত হয়।

এইসব প্রলয় যখন ঘটেছে, তখনও কোন মানব প্রজাতি (Homo genus) পৃথিবীতে আসে নি। এমনকি এপ-ও আসে নি ধরাধামে। ওরা এসেছে অনেক পরে। মাত্র কুড়ি কোটি বছর আগে প্রথম স্তন্যপায়ী জীবের আগমন হয়। সেই স্তন্যপায়ী থেকে অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে আসে প্রাইমেট। প্রাইমেট হল স্তন্যপায়ীদের সেই গোষ্ঠী যাদের মধ্যে আছে বানর, লেমুর এবং এপ ও বিভিন্ন মানব প্রজাতি। এদের হাত ও পায়ের পাতায় নখ আছে। তারও বহু পরে বিবর্তনের ধারায় প্রাইমেটদের থেকে এসেছে এপ। এপ হল লেজবিহীন প্রাইমেট, যাদের মধ্যে গরিলা, শিম্পাঞ্জি, গিবন, ওরাংওটাং এবং মানুষ এখনও পৃথিবীতে বেঁচে আছে। আর উনিশ লক্ষ বছর আগে অনেকটা মনুষ্যপদবাচ্য মানব হোমো ইরেক্টাস  উদ্ভূত হয়েছিল।

পৃথিবীর বয়সের অনুপাতে মানুষ (Homo sapiens) এসেছে অতি স্বল্প সময় আগে। এখনো পর্যন্ত মানুষের সর্বপ্রাচীন ফসিল পাওয়া গেছে আফ্রিকার মরক্কোতে, সে মাত্র তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর আগের। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় মানুষ আছে তার মাত্র ০.০০৭% সময়কাল জুড়ে। মানুষের আবির্ভাবের বহু আগে বসুন্ধরায় এসেছে অসংখ্য প্রাণী, তারা লক্ষ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে থেকেছে; তারপরে একদিন আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সময়ের সেতুপথে আধুনিক মানুষ অতি নগণ্য এক যাত্রী।

চিত্র ৩-পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের সময়রেখা, National Park Service, Geological Time Line, NPS Geologic Resources Inventory, 2018

সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই

সত্তর হাজার বছর আগের পৃথিবীতে সম্ভবত মানুষ ছাড়াও পাঁচ রকমের মানব (Homo genus) ঘুরে বেড়াত। এরা হল – নিয়েণ্ডারথ্যাল, ডেনিসোভান, ফ্লোরেস ম্যান অর্থাৎ বামন মানুষ, হোমো ইউজোনেনসিস ও সম্ভবত হোমো ইরেক্টাস।

সময়টা তাৎপর্যপূর্ণ। তখন সবে একদল মানুষ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এশিয়াতে পদার্পণ করেছে। নিয়েণ্ডারথ্যালরা দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াতে বাস করেছে। চলে গিয়েছে রাশিয়ার উত্তরে সাইবেরিয়াতে। ডেনিসোভানরা উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে সম্ভবত নিউ গিনি পর্যন্ত বিচরণ করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় ছিল বামন মানব ফ্লোরেস ম্যান। মাত্র আঠারো হাজার বছর আগেও ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে ওরা বাস করত। আবার অনেকটা একই ধরনের বামন মানব থাকত ফিলিপিন্সে, ওদের শারীরিক গঠন আধুনিক মানুষের থেকে ছোট, দৈর্ঘ্য ৪ ফুটের কম। ওদের বলে হোমো ইউজোনেনসিস। হোমো ইরেক্টাস-রাও সম্ভবত পঞ্চাশ হাজার বছর আগে বেঁচে ছিল ইন্দোনেশিয়ায়।[২]

মানুষের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকাতে, তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর আগে। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় সেই সময় এত সামান্য যে, এর শতকরা পরিমাপ করা কঠিন। আর তার মধ্যে মাত্র শেষ সত্তর হাজার বছর আগে সে আফ্রিকার বাইরে এসেছে, ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। কালের মানদণ্ডে এই সময় ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আর এই সামান্য সময়েই সে হয়ে উঠেছে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক।

একবার চিন্তা করা যাক অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলির কথা।

অন্ততপক্ষে উনিশ লক্ষ বছর ধরে হোমো ইরেক্টাস পৃথিবীতে থেকেছে, এই দীর্ঘ সময়ে ওরা নিজেরাও বিবর্তিত হয়েছে। ওরা আগুন ব্যবহার করেছে। আফ্রিকার বাইরে এসেছে। স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া – পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলপুঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তে ওরা বাস করেছে, শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করেছে, বংশবৃদ্ধি করেছে।

প্রায় চার লক্ষ বছর ধরে আমাদের জ্ঞাতি ভাই নিয়েণ্ডারথ্যালরা ছিল ইউরোপ থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে। ওরা স্থান থেকে স্থানান্তরে গেছে, ইউরেশিয়া জুড়ে ভ্রমণ করেছে। শিকার করে পশুর মাংস খেয়েছে, অসুস্থের যত্ন নিয়েছে। সত্তর থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে ওরা মিশ্রিত হয়েছে মানুষের সাথে। নিশ্চয়ই সেই সময়ে মানুষও ওদের যৌনমিলনের অংশীদার হবার যোগ্য মনে করেছিল। অর্থাৎ ওরা সেই সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে চিন্তায়, মেধায় খুব অপরিণত ছিল না। তবুও ওরা আজ লুপ্ত। খাদ্য, বাসস্থানের প্রতিযোগিতায় ওরা হেরে গিয়েছিল। মানুষ বাদে অন্য সব মানব ও মানুষের জ্ঞাতিভাইরা আজ ধরাধাম থেকে হারিয়ে গেছে।

এখন মানুষের নিকটতম আত্মীয় হিসাবে টিঁকে আছে একমাত্র শিম্পাঞ্জি।

আর টিঁকে আছে মানুষ।

পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষকে সাহায্য করেছে তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান। সে ভেলা তৈরি করে সমুদ্র পেরিয়ে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়াতে। অস্ট্রেলিয়ায় মানুষের আদি উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। ওই সামান্য সংখ্যক মানুষ সেখানে গিয়ে শিকার করেছে তার আকারের থেকে বহুগুণে বড় পশুদের। ওরা ৭ ফুট লম্বা ডানাহীন পাখি ও শাবকবাহী জীব (marsupial) ডিপ্রটোডন শিকার করে স্বাদু মাংস খেয়েছে।

সেই সময়ে মানুষ তৈরি করেছে সুঁই। পশুর চামড়া দিয়ে সেলাই করা পোশাক পরেছে। আর গরম চামড়ার পোশাক পরে শেষ তুষার যুগের চরম শৈত্যের সময়ে সাইবেরিয়ার বরফ থেকে বাঁচতে একদিন চলে গেছে মূল আমেরিকা ভূখণ্ডে। গড়ে তুলেছে আমেরিকার প্রথম মনুষ্য জনবসতি। শেষ তুষার যুগে ইউরোপ ও এশিয়াতে মানুষ নতুন তৈরি প্রযুক্তির সাহায্যে দূর থেকে নিঃশব্দে বল্লম ছুঁড়ে শিকার করেছে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর, মাছ। ম্যামথ, গুহা ভাল্লুক, বড় পাখি – যা পেয়েছে, খেয়েছে।

৩০ – ৩২ হাজার বছর আগে দক্ষিণ ফ্রান্সের সভেৎ গুহায় কিছু ছবি আঁকা হয়েছিল। পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনচর্যার অনন্য প্রমাণ এখানে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে চিরকালীন হয়ে আছে। প্রায় ৬৫টি ছবি এখানে পাওয়া গেছে। এই ছবিগুলির অধিকাংশ হলো শিকারের, এবং তার মধ্যে ৭৫% ছবি পশমযুক্ত গণ্ডারের (Woolly Rhinoceros)।

দশ হাজার বছর আগে এই গণ্ডার লুপ্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত মানুষ শিকারে যত করিৎকর্মা হয়েছে, তত বিভিন্ন পশু পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে।

তখন মানুষ ছিল শিকারী ও সংগ্রাহক। পশু, পাখি, মাছ শিকার করে সে তার খাদ্য সংগ্রহ করেছে। সম্ভবত মানুষের বহু প্রাণী লুপ্ত হয়ে গেছে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে। ইউরোপ থেকে লুপ্ত হয়েছে পশমযুক্ত গণ্ডার, বাইসন, পশমযুক্ত সুবৃহৎ ম্যামথ, সোজা করিদন্তযুক্ত হাতি, গুহা ভাল্লুক ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রাণিকুল মানুষের হাতেই লুপ্ত হয়েছে, এমন কথা একেবারে জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ শেষ তুষার যুগের অন্তে তাপমাত্রার ওঠা-নামাতে কিছু প্রাণী লুপ্ত হয়েছে। তবে অস্ট্রেলিয়ার ডিপ্রটোডন, আমেরিকার ম্যাস্টোডন, ইউরোপের গুহা ভাল্লুক সম্ভবত মানুষের হাতেই শেষ হয়েছে।

তবু বলা যায় সেই শিকার ছিল প্রাণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, মানুষের তখন বিকল্প খাদ্য ছিল না। সে ছিল টিঁকে থাকার যুদ্ধ।

অবশেষে মানুষ কৃষিকাজ শেখে। এগারো হাজার ছয়শ বছর আগে হলোসিন যুগ শুরু হয়। তারপরে সে প্রথম কৃষিকাজ শেখে। শেখে বনের পশুকে পোষ মানিয়ে পালন করতে। কৃষি শেখার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মানুষের নিজের হাতে অরণ্য পুড়িয়ে, গাছ কেটে, বন-জঙ্গল সাফ করে পৃথিবীকে নিষ্পাদপ করে তোলার প্রথম পদক্ষেপ।

কৃষকরা জমির জৈব বস্তুপুঞ্জকে পরিবর্তন করে দেয়। আবার কৃষিজমি প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে বন্যপ্রাণিকুল বাস্তুচ্যুত হয়ে গেল। বৃক্ষ মরে গেল। প্রাণিকুলের জনসংখ্যা কমে গেল। তার উপরে, ওরা কিছু বন্য প্রজাতির প্রাণীকে পোষ্য করে ফেলল। যেমন বুনো ঘোড়া, গাধা, গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল এগুলি মূলতঃ হয়ে গেল পালিত পশু। বন্য প্রজাতিগুলি হ্রাস পেতে শুরু করল।

এর মধ্যে মানুষ মাটি বিদীর্ণ করে ধাতু উত্তোলন করেছে। ধাতুকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্র ও অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রথমে ব্রোঞ্জ ও পরে লোহার অস্ত্র দিয়ে ক্রমাগত সে শিকার করেছে। পশুকে হত্যা করেছে।

আগে মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যেত; জীবনের একটা দীর্ঘ সময়কাল সে থাকত কম খেয়ে। শিকার করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ম্যামথ, ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে অনেকে নিহত হত। কৃষিকাজ শুরু হবার পরে দৈনন্দিন খাদ্যে সামান্য নিশ্চয়তা আসে। সে বাস করতে থাকে সমতল ভূমিতে। বনে জঙ্গলে থাকার ঝুঁকি তাকে আর নিতে হত না। সেই সময়ে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। সে ক্রমশ হয়ে উঠলো পৃথিবীর অধিপতি।

এনথ্রোপোসিনযুগ

তারপরে এল সভ্যতার চূড়ান্ত মুহূর্ত।

খুব বেশি দিন আগে থেকে নয়; শেষ একশ বছরে পৃথিবীর গাছ কেটে, জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করে মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে শুরু করে। তবে ১৯৫০ সাল থেকে হঠাৎ করে যেন প্রকৃতিতে বিশ্বব্যাপী এক অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে মানুষের প্রভাব এখন এত গভীরভাবে ব্যাপ্ত যে, ধরে নিতে হবে হলোসিন যুগ শেষ হয়ে গেছে। তাকে পথ করে দিতে হচ্ছে পারমাণবিক পরীক্ষা, প্লাস্টিকের দূষণকে। পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার জন্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে তেজস্ক্রিয় পদার্থ, এই পরীক্ষাসমূহ পৃথিবীর জৈব বস্তুপুঞ্জে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

নির্বিচারে প্রকৃতিকে ব্যবহার করার কিছু উদাহরণ দেই।

তাহিতি দ্বীপ হল প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে যেন এক বিন্দু সবুজ পান্না। কস্মিনকালে ওরা নিজেরা পারমাণবিক পরীক্ষা করে নি। ওদের পারমাণবিক বিকিরণ স্তর হল বিকিরণের সর্বাধিক স্বীকৃত স্তর থেকে ৫০০ গুণ বেশি।[৩] ষাট ও সত্তরের দশকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফরাসীরা তাদের কলোনিতে পারমাণবিক পরীক্ষা করেছে। এর তেজস্ক্রিয়তা পলিনেশিয়ার এক বিস্তৃত অঞ্চলে আজও ছড়িয়ে আছে। ফরাসীরা স্বীকার করেছে তাদের এই কৃতকর্মের কথা, তবে বলেছে অনেক কমিয়ে সমিয়ে।

১৯৬০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ফ্রান্স ২১০ টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল, ১৭ টি আলজেরিয়ান সাহারায় এবং ১৯৩ টি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফরাসী পলিনেশিয়ায়। কয়েক দশক ধরে ফ্রান্স যুক্তি দিয়েছিল যে, বিস্ফোরণগুলি নিয়ন্ত্রিত ও ক্ষতিকারক নয়।

ফরাসী পরমাণুবিদ ও রাজনীতিকদের এই ক্ষুদ্র চিন্তা দেখে আশ্চর্য লাগে। ওরা সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, পরমাণু বর্জ্য কলোনির শাসিত ও শোষিত মানুষের ক্ষতি করলেও ফরাসীদের তো করবে না। এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা।

পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরিমাণ দেখে পরিবেশবিদরা ভয় পেয়েছেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সকল পরমাণু সক্ষম দেশ তাদের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে ফেলে এসেছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে আছে পারমাণবিক শিল্প ও পারমাণবিক অস্ত্র কারখানার আবর্জনা। মায় পুরানো পারমাণবিক চুল্লী পর্যন্ত ওরা সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। মাত্র ১৯৯৩ সাল থেকে পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ সরাসরি সমুদ্রের মধ্যে ফেলা নিষিদ্ধ হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ২০১৯ সালে কেপ টাউনে আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিকরা এখনকার সময়কালকে ‘এনথ্রোপোসিন’ (Anthropocene) যুগ বলে অভিহিত করবার জন্য ‘আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিক কংগ্রেসে’র কাছে সুপারিশ করেছেন।

কেন পরিবেশবিদরা চিন্তিত? কেন আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিক কংগ্রেসে এনথ্রোপোসিন যুগ এত বড় আলোচ্য বিষয়?

বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, বিভিন্ন প্রজাতির গণবিলুপ্তি এবং বন কেটে আধুনিক বিকাশের ফলে স্থলভূমির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।[৪]

শুধু পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ নয়; এখন প্লাস্টিক, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি থেকে কার্বন নিঃসরণ মাত্রাধিক দূষণ ছড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে মানুষ ডিম খেত বেশী, মুরগীর মাংস খেত তুলনায় কম। তবে শেষ পঞ্চাশ বছরে মুরগী খাওয়া অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে। এখন প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ কোটি মুরগী খাওয়া হয়।[৫] মানুষের থেকে বহুগুণ বেশি মুরগী প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে। এই অবিশ্বাস্য সংখ্যক মুরগী তৈরি করতে পৃথিবীর জল ও আবহাওয়া ক্রমাগত নি:শেষিত ও দূষিত হচ্ছে।

জীবাশ্ম জ্বালানী দহনের প্রতিক্রিয়ায় ক্রমবর্ধমানভাবে গ্রীনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড) নিঃসৃত হচ্ছে। এই নিঃসৃত গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ঘনীভূত হচ্ছে। এর ফলে তাপ পৃথিবীতে আটকা পড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গণনা করে বলা যায় যে, ২১০০ সালে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ৩.৭° সেলসিয়াস থেকে ৪.৮° সেলসিয়াস।[৬] এই তাপমাত্রাবৃদ্ধি পৃথিবীকে তার ১.৪ কোটি বছর আগের তাপমাত্রার থেকেও বেশি উত্তপ্ত করে তুলবে।[৭] মেরুর বরফ গলে গিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে; কলকাতা সহ বহু বড় শহর বন্যায় ভেসে যাবার পরিস্থিতি হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও নিয়মিতভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে। যদি সবচেয়ে রক্ষণশীল অনুমান অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় তবুও পৃথিবীর প্রাণিজ বৈচিত্র্যের কমপক্ষে ২০-৪০% বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকবে এবং দূষণ ও শিকারের ফলে আরও কয়েক ডজন প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে যাবে।[৮]

চিত্র ৪-পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ছিল মোটের উপর স্থিতিশীল, শেষ দুইশ বছরে তা একেবারে ঊর্ধ্বমুখী। (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)

  • ষোড়শ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত ৭০০ মেরুদণ্ডী, [৯] ৬০০ উদ্ভিদ প্রজাতি লুপ্ত হয়ে গেছে।[১০] সম্ভবত আরও অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি চোখের অগোচরে বিনষ্ট হয়ে গেছে; আমরা জানতেও পারিনি।
  • ১৯৭০ সাল থেকে স্রেফ ৬০% স্থলভূমির মেরুদণ্ডী প্রাণী উবে গেছে।[১১] পশু, পাখি উদ্ভিদ, এমনকি পোকামাকড় পর্যন্ত দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। প্রাণ কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য  নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
  • ১৮ শতকে যে জলাভূমি ছিল তার মাত্র ১৫% এখন টিঁকে আছে।[১২] একবার নিজের অভিজ্ঞতাতে চারিদিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিন এই পরিসংখ্যান।
  • ১০০০ কিমির বড় নদীগুলির তিন-চতুর্থাংশ এখন আর নিজের মত করে প্রবাহিত হয় না।[১৩] গঙ্গা আর বইছে না। যমুনার গায়ে দগদগে ঘা।
  • ইতিমধ্যে পৃথিবীর ভূমিপৃষ্ঠের ৭০% এরও বেশি পরিবর্তন করেছে মানুষ।[১৪]

আমরা এই গ্রহকে সর্বতোভাবে পরিবর্তন করে ফেলেছি।

পৃথিবীতে স্থলভূমির মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে এখন ৫৯% শুধু পালিত প্রাণিসম্পদ, বাকি ৩৬% জীবিত মনুষ্যকুল। আর সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণী আছে মাত্র ৫%। এরা হল সমস্ত বন্য স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী। [১৫]

মানুষ বেঁচে আছে; মানুষের খাদ্য জোগাতে, তাকে আনন্দ দিতে বেঁচে আছে গৃহপালিত পশু। বাকি সব উধাও হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, অতি দ্রুত।

পরিবেশবিদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা আজ তাই আতঙ্কিত।

জনসংখ্যা

জৈব বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, খাদ্য ও জলের সুরক্ষা নষ্ট হচ্ছে, রোগ ও দূষণ অভূতপূর্বভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত সমস্যাগুলি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দরুন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে; গত পঞ্চাশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে ঊর্ধ্বমুখী সংখ্যা।

সত্তর হাজার বছর আগে পৃথিবীতে জনসংখ্যা ছিল সম্ভবত দশ হাজার।[১৬] কৃষি ও পশুপালন শুরুর সাথে সাথে জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। আর আজ মানুষের সংখ্যা ৭৫০ কোটি। কলকাতাতে জনঘনত্ব হল ২৪,০০০। অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৪০০০ জন মানুষ কলকাতাতে থাকেন।

এই প্রসঙ্গে জনসংখ্যার কিছু পরিসংখ্যান স্মরণ করা যেতে পারে।[১৭]

  • মাত্র ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ১ কোটির কম ছিল।
  • মাত্র ২০০ বছর আগে এই জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি।
  • আর মাত্র ১০০ বছর আগে এই জনসংখ্যা ছিল ২০০ কোটি।
  • শেষ পঞ্চাশ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। বিংশ শতাব্দী বিশ্বের জনসংখ্যার সর্বোচ্চ বৃদ্ধি দেখেছে।
  • আজকে মানুষের সংখ্যা ৭৫০ কোটিরও বেশি হয়ে গেছে।
  • আগামী দিনে, ২১০০ সালে এই সংখ্যা হবে ১১০০ কোটি।

সবুজ বিপ্লবের ফলে এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর ক্ষমতা ও দক্ষতা মানুষের হয়েছে। ফলস্বরূপ শিল্পায়ন হয়েছে অতি দ্রুত এবং কৃষিক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রকমারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই খাদ্য উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীতে ব্যবহারযোগ্য জলগুলির প্রায় ৭০% এখন খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

আমরা জানি না এই প্রকাণ্ড জনসংখ্যা নিয়ে আমরা টিঁকে থাকতে পারব কিনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সারা পৃথিবীতে সমানভাবে হয় না। আর বিজ্ঞানীরা এখনও পৃথিবীর ‘মানুষের বহন ক্ষমতা’ নির্ধারণ করতে পারেন নি।

আমাদের আগেকার সমগ্র মানব জাতি যতটা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করেছে গত পঞ্চাশ বছরে অপর তাকে ছাপিয়ে গেছি। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় – আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে জটিল ব্যবস্থাটির উপরে আমরা নির্ভর করি তার প্রতিটি উপাদানের মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। আর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এই পরিবর্তনের একটা বড় কারণ।

একশ বছর পরে কেমন হবে এই পৃথিবী

The Sixth Extinction: An Unnatural History বইটি ২০১৫ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। অতি বিষণ্ণ এই বই পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে যেন কোন এক ভুতুড়ে, অন্ধকারময় গ্রহে একজন মানুষ চলেছেন প্রাণের হদিস পেতে। দুর্গমতম স্থানে যাচ্ছেন নিজের চোখে দেখতে পাখিরা, পশুরা ভাল আছে তো?

ওরা ভাল নেই। ওরা মরে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

পৃথিবীতে পাখি বা স্তন্যপায়ীর আগে এসেছে উভচরেরা। এমন এক উভচর হল ব্যাঙ। এক দশক আগেও পানামার সোনালি ব্যাঙ ওই অঞ্চলে ছিল অগুণতি। এখন ওদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক পরীক্ষার পরে বোঝা গেল ওরা মরে যাচ্ছে, কারণ ওদের গায়ে হচ্ছে এক ধরনের ফাঙ্গাস। সেই ফাঙ্গাস কিন্তু ওই অঞ্চলে হয় না। মানুষবাহিত ফাঙ্গাসে মরে যাচ্ছে পানামার সোনালি ব্যাঙেরা।

মানুষ যখন প্রথম আইসল্যাণ্ডে বসতি করে, কিছুদিনের মধ্যে সে শেষ করে ফেলে লক্ষ লক্ষ অক পাখিদের। এরা এক জাতীয় পেঙ্গুইন; বেচারারা উড়তে পারত না। এতদিন দিব্বি ওখানে বাল-বাচ্চা নিয়ে থেকেছে। মানুষ আসার কিছুদিনের মধ্যে নধর তৈলযুক্ত অক পাখিরা শেষ হয়ে গেল।

এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে অগুণতি পশু ও পাখি। পরের কয়েক দশকে জীববৈচিত্র্যের উপর আমরা হয়ত আরও শক্তিশালী হামলা চালাব।

অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করেন যে মানুষ এক ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির (Sixth Mass Extinction) দিকে এগোচ্ছে। এই সময়কালে কমপক্ষে ৭৫% প্রজাতি এই গ্রহ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

এ কোন কল্পনা নয়।

মনে রাখতে হবে, মানুষের জয়যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। একটা দেশের উন্নয়নের হিসাব হয় তার বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপরে। মাত্র ১৮৭৯ সালে টমাস এডিসন বিদ্যুৎকে ব্যবহার করে একটা বাল্ব ৪০ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। আর ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী আমরা ব্যবহার করি ২১.৮ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা শক্তি। [১৮] মাত্র ১৩৭ বছরে বিদ্যুৎ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য আবশ্যিক হয়ে গেছে।

শেষ একশ বছরে জনসংখ্যা বাড়ছে উল্লম্বভাবে। সাথে বাড়ছে শক্তির খরচ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, আবহাওয়ায় গ্রীন হাউজ গ্যাসের ঘনীভবন, পৃথিবীর বুক থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি।

একশ বছর পরে আমাদের উত্তরসূরী কি বেঁচে থাকবে? মনুষ্য প্রজাতি কি টিঁকে থাকবে?

বিভিন্ন বিজ্ঞানী মনে করছেন, যে হারে আমরা জৈব জগৎকে ধ্বংস করছি সেই ধারা চলতে থাকলে এই সমাজ, সভ্যতা লোপ পাবে। মানবজীবন সহ সমস্ত প্রাণিকুলের ভবিষ্যতের চিত্র খুব আশাপ্রদ নয়। ওরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, মানব সভ্যতা এক খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের নিজেদের পাল্টাতে হবে। না হলে আমরা ধ্বংসের মুখোমুখি হব।

অনেকে বলবেন এ তো নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি হয়েছে। পৃথিবীর যৌবনকাল থেকে অন্ততপক্ষে পাঁচ বার প্রাণিকুলের গণবিলুপ্তি ঘটেছে। আমরা কেন দায়ী হব গণবিলুপ্তির জন্য? মানুষের গায়ে কলঙ্ক লাগানোর এই অপচেষ্টা কেন?

আগের গণবিলুপ্তিগুলি ঘটেছে প্রাকৃতিক কারণে। বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সেই ঘাটতি পুনরায় পূরণ হয়ে গেছে, নতুন প্রজাতি এসেছে। এখন একটিমাত্র প্রজাতি সারা পৃথিবীকে দখল করেছে। তার বুদ্ধি কিন্তু এখনও অতি সীমাবদ্ধ।

অথচ তার সম্ভাবনা প্রচুর। মাত্র একশ বছরে মানুষের জীবনযাপনে বিপ্লব এসেছে। যুদ্ধ, অশান্তি, নিজেদের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষ বন্ধ করে দেশগুলি যদি একত্রিতভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করতে চায়, মানুষের উন্নয়নে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে তবে তার ভবিষ্যৎ হতে পারে উজ্জ্বল। হয়ত সে তখন কলোনি করবে এই সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে, এমনকি এই ছায়াপথের বিভিন্ন গ্রহে।

কিন্তু তার আগে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে, অন্যদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

জীবনের বেঁচে থাকার অধিকার সকলের আছে। আমরা নিজেদের জন্য এন্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করে গড় আয়ু বাড়িয়েছি। আমাদের বেঁচে থেকে দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীকে ভোগ করার গোপন ইচ্ছা আছে। সেই মহাভারতের কালে শান্তনুর ছিল, আর কলি যুগে আমাদের হতে দোষ কি?

তবে আমাদের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, পাখি-পশু-সাপ-ব্যাঙ ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে। ওদের অধিকার যদি স্বীকার নাও করি, বুঝতে হবে ওদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। তাই প্রকৃতি ৪৫৪ কোটি বছর ধরে পৃথিবীকে সাজিয়েছে। আর আমরা ‘ভগবানের নির্বাচিত মানুষ’ আছি মাত্র ৩.৩ লক্ষ বছর ধরে।

আমাদের টিঁকে থাকার জন্যও ওদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতি শুধু উপভোগ করবার জন্য নয়। প্রকৃতি ছাড়া আমরা বাঁচব না।

অকারণে, মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃক্ষ ও প্রাণী সংহার করেছি। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করছি, সেই অস্ত্র একসময়ে হয়ে যাচ্ছে  অচল, সেকেলে। তখন পুরানো অস্ত্র ফেলে আবার নতুন অস্ত্র তৈরি করছি। এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিকে দূষিত করে ফেলছি।

প্রকৃতিকে আমরা আর জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ মনে করি না।

আমরা যখন আর থাকব না, তখন কে জানে, আমাদের বংশধরেরা মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত ধূসর কোন গ্রহে তাদের জীবন কাটাবে কিনা। অথবা তারা হয়ে যাবে লুপ্ত, সেই নিয়েণ্ডারথ্যাল বা গুহা ভাল্লুকের মত।

তথ্যসূত্র

১) Nutman, Allen P., et. al., ‘Rapid emergence of life shown by discovery of 3,700-million-year-old microbial structures’: Nature 537, 535–538, 2016

২) Indriati, Etty, et.al., ‘The Age of the 20 Meter Solo River Terrace, Java, Indonesia and the Survival of Homo erectus in Asia’: Plos One, June 29, 2011

৩) French nuclear tests ‘showered vast area of Polynesia with radioactivity’, The Guardian, Wed 3 Jul 2013 18.14 BSTFirst published on Wed 3 Jul 2013

৪) Waters, CN, et.al.,The Anthropocene is functionally and stratigraphically distinct from the Holocene’: Science, Vol. 351, Issue 6269, 2622, 08 Jan 2016

৫) Thronton, Alex, ‘This is how many animals we eat each year: World Economic Forum’,  08 Feb 2019

৬) Edenhofer, O., R. Pichs-Madruga, Y. Sokona, E. Farahani, S. Kadner, K. Seyboth, A. Adler, I. Baum, S. Brunner, P. Eickemeier, B. Kriemann, J. Savolainen, S. Schlömer, C. von Stechow, T. Zwickel and J.C. Minx (eds.),’Mitigation of Climate Change‘, Contribution of Working Group III to the Fifth Assessment Report of the Intergovernmental Panel on Climate Change, Cambridge University Press, Cambridge, United Kingdom and New York, NY, USA

৭) ‘Millennium Alliance for Humanity and Biosphere’, Scientific Consensus on Maintaining Humanity’s Life Support Systems in the 21st Century Information for Policy Makers. , May 2013

৮) ‘Millennium Alliance for Humanity and Biosphere‘. Scientific Consensus on Maintaining Humanity’s Life Support Systems in the 21st Century Information for Policy Makers., May 2013

৯)  Diaz et. al., ‘Pervasive human-driven decline of life on Earth points to the need for transformative change’: Science, Vol. 366, Issue 6471, 2019

১০) Humphreys, et al., ‘Global dataset shows geography and life form predict modern plant extinction and rediscovery’: Nature Ecol. Evol. 3, 1043-1047, 2019

১১) WWF. Living Planet Report 2016. (WWF, Gland, Switzerland, 2016)

১২) Davidson, ‘How much wetland has the world lost? Long-term and recent trends in global wetland area‘, Mar. Freshw. Res. 65, 934-941, 2014

১৩) Grill et al.Mapping the world’s free-flowing rivers‘, Nature 569, 215-221, 2019

১৪) Diaz et. al., ‘Pervasive human-driven decline of life on Earth points to the need for transformative change’: Science, Vol. 366, Issue 6471, 2019

১৫) Bar-On et al., ‘The biomass distribution on Earth’: Proc. Natl. Acad. Sci. USA 115, 6506, 2018

১৬) Historical Estimates of World Population, United States Census Bureau

১৭) Department of Economic and Social Affairs Population Dynamics, United Nations, World Population Prospects 2019

১৮) Statista, Global electricity consumption 1980-2016,Published by T. Wang, Jun 27, 2019

১৯) Elizabeth Kolbert, ‘The Sixth Extinction: An Unnatural History’: Bloomsbury, Paperback edition, 2015

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “পিতামহী পৃথিবীর ইতিহাস”

  1. মানব জাতির ভবিষ্যত্ প্রজন্ম কে সুরক্ষা করতে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেকোন শর্তে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সুন্দরভাবে উপস্থাপনার জন্য লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

  2. অসাধারণ লেখা দিদি , আপনার লেখা মানে মোহগ্রস্থতা , আসলেই দিদি পৃথিবীকে তো আমরাই ‘’ অতি’’ দ্বারা শেষ করে দিচ্ছি ।

  3. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা। সমৃদ্ধ হলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখার অনুলিপি পাওয়া কী সম্ভব?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।