জলদস্যু হেনরি এভেরি’র হদিশ
যখন খুব ছোট ছিলাম, ঠাকুমা-দিদিমার কাছে আরাকানের মগদের ঘুমপাড়ানি গল্প শুনতাম। একটু বড় হওয়ার পর, কৈশোরে যখন পা দিচ্ছি, এই মগদের ওপরে লেখা বেশ কয়েকটা গল্পের বইও পড়েছিলাম। ভয়ঙ্কর জলদস্যু ছিলেন এই মগেরা। তাঁদের ভয়ে তঠস্থ হয়ে থাকতো বঙ্গোপসাগর পারাপারকারী জাহাজের লোকজন আর সমুদ্রকুলবর্তী বসতির বাসিন্দারা – সাধারণ অব্দের ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে।
তবে জলদস্যু যে শুধু বঙ্গোপসাগরে ছিল – তা নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই ছিল। এখনও আছে। খবরের কাগজের পাতায় বা টিভি নিউজ চ্যানেল’এ মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে সোমালি জলদস্যুদের কথা। এইসব জলদস্যুদের মধ্যে কয়েকজন আবার হয়ে গিয়েছেন ‘লেজেন্ড’। এইরকমই এক স্মরণীয় কিংবদন্তি হলেন হেনরি এভেরি। জলদস্যুদের ‘হল অফ ফেম’এ যাঁর স্থান চিরকালের জন্য পাকা। কারণ? বিশেষ কিছু নয়। তিনি লুঠ করেছিলেন প্রবলপরাক্রমশালী মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব’এর জাহাজ – ‘গঞ্জ-ই-সওয়াই’। ১৬৯৫ সাধারণ অব্দে। সাথে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাদশাহের পৌত্রীকেও।
এভেরি’র জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ড’এর প্লেমাউথ’এ। প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটেন’এর রাজকীয় নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। অধস্তন আধিকারিক হিসেবে। কিছুদিন পর সেই চাকরি ছেড়ে দি দেন। বেছে নেন বেসরকারি নৌঅভিযাত্রীদলের পথপ্রদর্শকের পেশা।
১৬৯৩ সাধারণ অব্দে তিনি ৪৬’টা কামানওয়ালা এক ফরাসি জাহাজের সর্বাধিনায়ক হিসাবে নিযুক্ত হন (সে যুগে জলদস্যুদের ভয় থাকায় অসামরিক জাহাজেও কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকতো)। গন্তব্য ছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু গোল বাধলো জাহাজের মালিক সময় মত মাইনে দেওয়া বন্ধ করায়। এভেরি’র নেতৃত্বে জাহাজের নাবিকরা করলেন বিদ্রোহ। দখল করে নিলেন জাহাজের কর্তৃত্ব। জাহাজের নতুন নাম রাখলেন ‘ফ্যান্সি’। শুরু হয়ে গেল নৌডাকাতি।
প্রথম কিছুদিন লুঠতরাজ চললো অতলান্তিক মহাসাগর অঞ্চলে। তারপর নজর ঘুরলো ভারত মহাসাগরের দিকে। ফ্যান্সি রওনা দিল স্বল্পবসতির ম্যাডাগাস্কার’এর উদ্দেশ্যে। ততদিনে ফ্যান্সি ‘ লোকবল বেড়েছে। প্রথমদিকের শুধু ইংরেজ নাবিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ফরাসী এবং ড্যানিশ নাবিকও। ম্যাডাগাস্কার’এ আসার উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে ভারতের সুরাট এবং ইয়েমেন’এর মোচা’র (কফি রপ্তানির জন্য বিখ্যাত) মধ্যেকার ব্যস্ত জলপথে লুঠতরাজ চালানো।
এইখানে ফ্যান্সি’র প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল বাব-এল-মান্দেব। সেখানে ফ্যান্সি’র মোলাকাত হয় ব্রিটেন’এর পতাকা লাগানো কিছু ডিঙ্গি নৌকোর সাথে। এই ডিঙ্গি নৌকোগুলোর মাঝিমাল্লারাও ছিল সমুদ্র অভিযাত্রীদের পথপ্রদর্শক। কিন্তু ফ্যান্সি’র নাবিকদের সাথে সাক্ষাতের পর এই মাঝিমাল্লারা হয়ে ওঠেন অনুপ্রাণিত। মনস্থ করেন জলদস্যু হবার। হাত মেলান ফ্যান্সি’র নাবিকদের সাথে। গড়ে ওঠে জলদস্যুদের এক বড় দল।
এঁদের প্রথম বড় শিকার ছিল ‘ফথ মাহমামদি’ – সুরাটের বড় ব্যবসায়ী আব্দুল গফুরের জাহাজ। গায়েগতরে ফথ মাহমামদি ছিল ফ্যান্সি’র থেকে বেশ বড়। কিন্তু সঙ্গে কামান ছিল মাত্র ৬’টি। ফলে এভেরি আর তাঁর দলবল খুব সহজেই লুঠ করেন ফথ মাহমামদি । হস্তগত করেন ৫০-৬০ হাজার পাউন্ড মূল্যের (মনে রাখবেন তখনকার মূল্যে, আজকের নয়) সোনা এবং রুপা।
এর ঠিক ২ দিন পরেই, ৭ই সেপ্টেম্বর, লুঠ হয় বাদশাহ আওরঙ্গজেব’এর– ‘গঞ্জ-ই-সওয়াই’। মুঘল রণতরী হওয়ার সুবাদে গঞ্জ-ই-সওয়াই ‘এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট সুদৃঢ়। কিন্তু কপাল খারাপ – ‘গঞ্জ-ই-সওয়াই’এর একটা কামানের গোলা নিজেদের জাহাজেই গেল ফেটে। বেশ কয়েকজন মুঘল সৈন্য হন নিহত। তা হতচকিত করে দেয় বাকি মুঘল সৈন্যদের। ঝোপ বুঝে কোপ মারে ফ্যান্সি। ‘গঞ্জ-ই-সওয়াই’এর পাশের দিক থেকে শুরু করে গোলাবর্ষণ। কামানের গোলায় উড়ে যায় গঞ্জ-ই-সওয়াই ‘এর প্রধান মাস্তুল। মুঘল সৈন্যরা তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা। এই সুযোগে এভেরি আর তাঁর দলবল উঠে পড়েন গঞ্জ-ই-সওয়াই ‘এর পাটাতনে। শুরু হয় লুঠতরাজ। আনুমানিক ১৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের সোনা, রুপা, হাতির দাঁত এবং রত্নসামগ্রী লুঠ করেন এভেরি আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা।
শুধু লুঠতরাজ করেই ক্ষান্ত হননি এভেরি আর তাঁর দলবল। এই জাহাজে ছিলেন মক্কা থেকে তীর্থ করে ফেরা প্রচুর মুসলিম তীর্থযাত্রী। আর ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব’এর পৌত্রী এবং তাঁর সহচরীরা। এঁদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন এভেরি আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা। মেয়েদের হয় সম্মানহানি। সন্মান বাঁচানোর জন্য অনেক মহিলা জাহাজের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন, অনেকে ঝাঁপ দেন জলে। সম্রাটের পৌত্রীর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা অবশ্য সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। অনেকে বলেন যে এভেরি নিজের সাথে নিয়ে চলে যান সম্রাটের পৌত্রীকে এবং বিয়ে করে নেন তাঁকে।
এভেরি’র এই নৌডাকাতি এবং পাশবিক অত্যাচারের কথা যথাসময়ে পৌঁছয় ভারতে এবং ব্রিটেন’এ। প্রাচ্যের অসভ্যদের সাথে ইওরোপের সভ্য সমাজের এক প্রতিনিধির এহেন ‘অসভ্য’ আচরণে মাথা হেঁট হয়ে যায় স্বঘোষিত সভ্যদের, অন্তত সরকারিভাবে। হেঁট মাথা সোজা করার জন্য ব্রিটেনের তদানীন্তন রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ঘোষণা করেন এক বড় পুরষ্কারমূল্যের, এভেরি’কে ধরার জন্য। এদিকে ভারতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ও প্রতিশ্রুতি দেয় “এক ভারি রকম কি, এভেরি’কো পাকড়নে কে লিয়ে”।
শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। ধরা পড়লেন এভেরি’র অনেক সঙ্গিসাথী। কিন্তু এভেরি’কো পাকড়না সির্ফ মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন থা। কর্পূরের মত উবে গেলেন এভেরি। শুধু রয়ে গেল তাঁর (কু)কীর্তির স্মৃতি যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের বেশ কিছু দিকপাল জলদস্যু যেমন ক্যাপ্টেন কিড, ব্ল্যাকবেয়ার্ড ইত্যাদি। এভেরি’র জীবন নিয়ে লেখা হয়েছিল বেশ কিছু নাটকও।
সম্প্রতি জানা গিয়েছে কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলেন এভেরি। এবং কিভাবে। তবে এসব নিয়ে আমি আর কিছু বলবো না। আপনি যদি জানতে চান তাহলে আপনাকে পড়তে হবে “দ্য গার্ডিয়ান” পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া একটি খবর যার লিংক দেয়া হল নিচে।
– শান্তনু ভৌমিক।
এটা কিন্তু ঠিক হল না। চরম অবিচার। গল্পের খেই ধরিয়ে কেটে পড়া দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া উচিত। খুব ভালো লাগলো।
Bhalo laaglo … Sundarban anchal er pirates niye lekh … Gota europe thake sob pirates ekhane ese jutechilo kano ?
সেপ্টেম্বর ১৬৯৫ সালে ইংরেজ জলদস্যু হেনরি এভরি সুরাট বন্দরের কাছে একটি মুঘল নৌবহরকে লুট করে। নৌঘটি হজব্রত পালনের পড়ে মক্কা থেকে ভারতে ফিরছিল। ক্ষুব্ধ আওরঙ্গজেব তৎক্ষণাৎ বোম্বাইতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত একটি শহর আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা ক্ষতিপূরণ বাবদ ছয় লক্ষ পাউন্ড পরিশোধ করার পর তিনি সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। [১০৯] ইতোমধ্যেই আওরঙ্গজেব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চারটি কারখানা বন্ধ এবং কারখানার সকল কর্মচারী ও ক্যাপ্টেনকে বন্দি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন (উন্মত্ত জনতার প্রহারে মৃতপ্রায় অবস্থায়)। এভেরি ধরা না পড়া পর্যন্ত ভারতে সকল ব্রিটিশ কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।[১০৯] প্রিভি কাউন্সিল এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এভেরি কে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এটাই ছিল ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিশ্বব্যাপী হুলিয়া জারির ঘটনা
একের পর এক পর্তুগীজ ঘাঁটি ধ্বংস হল। হার্মাদরা এবার সরে আসে চন্দনগরে। ব্রিটিশ আমলেও কলকাতা নগরীতে হার্মাদ ও মগের আতঙ্ক চোখে পড়ত। ১৭৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার হাওড়ার শিবপুরে গঙ্গায় বাঁধ টানেন। তাতেই মগ ও হার্মাদদের আসা যাওয়ার পথ বন্ধ হল। বাংলা চিরতরে মুক্তি পেল জলদস্যুদের হাত থেকে। ইতিহাসেও ঘটল এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি।
আখ্যানটা সুন্দর লাগলো। দুইটা প্রশ্ন জাগছে –
১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কি ভারতের পশ্চিম উপকুলে ১৬৯০-এর দশকে কারবার ছিল? না থাকলে এভেরির সাথে তাদের সংঘাত কোথায়।
২) “রক বড়ি রকম কি…” কথাটার মানে কি?
আরেকটা ছোট জিনিস বলতে চাইছি, রয়াল নেভি-র অনুবাদ কিন্তু “রাজকীয়’ নৌবাহিনী হয় না। “রাজার পরিচালিত” জ্ঞাপন করতে “রাজ-” উপসর্গটা ব্যাবহার করা যায়। “রাজকীয়” সাধারণত জাকজমকের দ্যোতনা বহন করে।