কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগঃ প্রাক স্বাধীনতা যুগ
(এই প্রবন্ধের সহলেখক হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় । অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায়ের গবেষণার বিষয় নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা। তিনি বর্তমানে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দুটি ছোট জীবনী, নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারীদের অবদান নিয়ে লেখা ‘তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ’ এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন ‘বিজ্ঞানীর বিবেক’।)
প্রথম পর্ব
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের দেশে এসেছে পশ্চিমি দুনিয়া থেকে, আজও দেশের মাটিতে তার শিকড় খুব দৃঢ় নয়। তাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তার ইতিহাস সাধারণত কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন ও কাজ এবং বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। জগদীশচন্দ্র বসু, সি ভি রামন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, হোমি ভাবার মতো শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের উপর লিখিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। আধুনিক যুগে বিস্মৃতপ্রায় হলেও নিজেদের সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপরিচিত বিজ্ঞানীদের নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে, এঁদের মধ্যে পড়বেন কে এস কৃষ্ণন, দেবেন্দ্রমোহন বসু, শিশিরকুমার মিত্র, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ডি ডি কোসাম্বি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতো বিজ্ঞানীরা। এঁরা সবাই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অনেকেই আবার নিজের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।
এই নিবন্ধে ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে সুপরিচিত এক প্রতিষ্ঠানকে একটু অন্য দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ স্বাধীনতাপূর্ব যুগে যে উচ্চতা ছুঁয়েছিল, সমকালে ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তার তুলনীয় কোনো উদাহরণ নেই। তার একটা কারণ নিশ্চয় সি ভি রামন বা মেঘনাদ সাহার মতো ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি; কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতিরও একটা ভূমিকা আছে। আমরা কেউই ঐতিহাসিক নই; ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ আমাদের ক্ষমতার অতীত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে কাজ করার সুবাদে সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, একই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে সেই বিষয়ে গবেষণার জন্য কী ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন হয় সে বিষয়েও আমাদের কিছুটা ধারণা আছে। বিজ্ঞান আলোচনা নয়, এই লেখাতে আমরা সেই যুগে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান প্রশাসন, অর্থের উৎস, পাঠক্রম, বিদেশি বা দেশীয় বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ, সরকারের মনোভাব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তিন দশকে পদার্থবিদ্যা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেক মানুষ, সকলেই সমান পরিচিত নন না বা সাফল্যলাভও করেননি, কিন্তু তাদের পরিশ্রমের উপরে বিভাগ অনেকাংশে নির্ভর করত। তাঁদের অনেকের কথাই এই লেখাতে আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা
১৮৫৭ সাল ভারতের ইতিহাসে এক দিকচিহ্ন। সেই বছর মহাবিদ্রোহের ফলে শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে ভারতের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। বিদ্রোহের আগে সেই বছরই কলকাতা, বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) ও মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) এই তিন নগরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। কলকাতাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ২৪ জানুয়ারি, এটিই আধুনিক ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য হয়েছিলেন স্যার উইলিয়াম কোলভিল।
ভারতীয়দের জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল না; তাদের লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের কাজে সহায়তাকারী একদল করণিক ও সহকারী সৃষ্টি। তাই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তারা শুধুমাত্র পরীক্ষা নিয়ে ডিগ্রি দিতে পারত। মাদ্রাজ ও বম্বে প্রেসিডেন্সির বাইরে ভারত, বর্মা ও শ্রীলঙ্কার স্কুল ও কলেজগুলি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। স্কুলের শেষে এনট্রান্স (এবং পরবর্তীকালে ম্যাট্রিক, বর্তমান মাধ্যমিক বা দশম শ্রেণির সমতুল্য) পরীক্ষা নিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর দু’ বছরের ইন্টারমিডিয়েট ও দু’ বছরের স্নাতক কোর্স পড়ানো হত কলেজে। স্নাতক কোর্স অনার্স ও পাস এই দুই শাখাতে বিভক্ত ছিল। ১৮৮৪ সালে বিজ্ঞানে স্নাতকোতর পড়ানো শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেখানে জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্রের মতো শিক্ষকরা ছিলেন। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় একই নিয়ম অনুযায়ী চলত না। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে পাকিস্তানে) প্রথম তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে তৈরি হয়েছিল, সেখানে কিন্তু প্রথম থেকেই পড়ানো হত। আবার তারও পরে প্রতিষ্ঠিত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ছিল পুরানো তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। ১৯০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বলবৎ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অধ্যাপক নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়। তার দু’বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। প্রথম দফায় ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ মোট আট বছর তিনি উপাচার্য ছিলেন, ১৯০৪ সালের আইনের সুযোগে তাঁর চেষ্টাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
পরবর্তী আলোচনার সুবিধার জন্য সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পরিচালিত হত দেখে নেওয়া যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সমিতি ছিল সেনেট। ভাইসরয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আইন ও নিয়মাবলী প্রণয়নের অধিকার ছিল সেনেটের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে ছিল সিন্ডিকেট, সিন্ডিকেটে আলোচনা ছাড়া সেনেটে কোনো বিষয় উত্থাপিত হত না। পদাধিকারবলে ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় হতেন চ্যান্সেলর বা আচার্য, অর্থাৎ সেনেটের সভাপতি। বাংলার গভর্নর জেনারেল পদাধিকারবলে হতেন সেনেটের রেক্টর। এচাড়া সেনেটের সদস্য হতেন ভাইস চ্যান্সেলর, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোরা। ফেলো আবার দুই ধরনের; ১৮৯০ সাল থেকে সেনেট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ ফেলো নির্বাচিত হত, এছাড়া ছিলেন সরকার নিযুক্ত ফেলোরা। সরকার ভাইস চ্যান্সেলরকে নিযুক্ত করত, তাঁর কার্যকাল ছিল দু’বছর। তিনি সিন্ডিকেটকে পরিচালনা করতেন। পদাধিকারবলে বাংলার ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন সিন্ডিকেটের সদস্য হতেন। সেনেট ও বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি বা অনুষদ থেকে কয়েকজন সদস্য সিন্ডিকেটে নির্বাচিত হতেন। রেজিস্ট্রার ছিলেন সিন্ডিকেটের সেক্রেটারি।
আশ্চর্য মনে হলেও এটা সত্যি যে পরাধীন ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন পরিচালনাতে সরকারি হস্তক্ষেপ ছিল বর্তমান যুগের থেকে অনেক কম। একজন ছাড়া সিন্ডিকেটের সমস্ত সাধারণ সদস্যই নির্বাচিত হতেন। এই প্রসঙ্গে ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের আলোচনা প্রসঙ্গে আশুতোষের বক্তৃতা স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন যে উচ্চশিক্ষা অবশ্যই রাষ্ট্রের এক প্রধান কর্তব্য, কিন্তু তা বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারি বিভাগে পরিণত করা কোনো মতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
পালিত ও ঘোষের দান
১৯১২ সালের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, পালি, ইংরাজি, অর্থনীতি ও গণিত বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ শুরু হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের থেকে পাওয়া যায়নি, স্যার আশুতোষ তখন দেশীয় দাতাদের কাছে আবেদন রাখেন। সেই আবেদনে দুজন সাড়া দিয়েছিলেন, দুজনেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী, তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষ। উপাচার্য হিসাবে তাঁর কার্যকাল শেষ হওয়ার তিনদিন আগে ১৯১৪ সালের ২৭ মার্চ রাজাবাজারে ৯২ আপার সার্কুলার রোডে (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স বা বিজ্ঞান কলেজের শিলান্যাস করেছিলেন আশুতোষ। এটিই বর্তমানে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ নামে পরিচিত, কেতাবি নাম রাসবিহারী শিক্ষাপ্রাঙ্গণ।
রাসবিহারী ঘোষ
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার ফলে স্বদেশি শিক্ষাতে জোর পড়েছিল। ভারতীয়দের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির পাশাপাশি দেশীয় শিল্প ও আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সম্পর্ক নিয়েও জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পুরোধারা সচেতন ছিলেন। জাতীয় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৯০৬ সালে তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন। প্রথমেই অবশ্য মৌলিক না ব্যবহারিক, কোন ধরনের বিজ্ঞান শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা নিয়ে বিতর্কের ফলে এক দল সদস্য বেরিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সোসাইটি ফর প্রমোশন অফ টেকনিকাল এডুকেশন; এঁদের মধ্যে ছিলেন রাসবিহারী ঘোষ ও তারকনাথ পালিত। এই সোসাইটি তৈরি করে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট যা আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরী। চার বছর পরে ন্যাশনাল কাউন্সিলের ভাঙন জোড়া লাগে। রাসবিহারী ঘোষ শিক্ষার প্রসারের জন্য কাউন্সিলকে ১৩ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। আশুতোষ নিজে ছিলেন আইনজীবী ও পরে বিচারক, সেই সূত্রেও দুই ব্যারিস্টার তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
তারকনাথ পালিত
রাজাবাজারে বিজ্ঞান কলেজের ক্যাম্পাসেই পদার্থবিদ্যা বিভাগ অবস্থিত। এটি ছিল পালিতের বাগানবাড়ি। বালিগঞ্জে বিজ্ঞান কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসটি তারকনাথ পালিতের নাম বহন করে, সেখানে ছিল তাঁর বসতবাটি। পালিত ১৯১২ ও ১৯১৩ সালে দুই কিস্তিতে যে অর্থ ও সম্পত্তি দান করেছিলেন, সেই সময় তার অর্থমূল্য ছিল ১৪ লক্ষ টাকা। এই টাকাতে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিভাগে দুটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া এই অর্থ থেকে গবেষক, সহ-অধ্যাপক ইত্যাদিকে বৃত্তি দেওয়া হত। সহ-অধ্যাপক পদ সেই সময় পাকা চাকরি ছিল না, তাদের আধুনিক যুগের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো বা সিনিয়র রিসার্চ ফেলোদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এছাড়াও অধ্যাপকের সহকারী নিয়োগ করা হয়েছিল। বিজ্ঞান কলেজের সূচনাপর্বে এই সব বিভিন্ন পদকে সবসময় আলাদা করা যায় না।
রাসবিহারী প্রথম দফাতে ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছিলেন দশ লক্ষ টাকা, এই অর্থে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ফলিত গণিত ও উদ্ভিদবিদ্যাতে চারটি পূর্ণ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রতিটি অধ্যাপক পদের সঙ্গে দুই গবেষককে বৃত্তি প্রদানের সুযোগ ছিল। বৃত্তির পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৯০০ টাকা। পরে রাসবিহারী আরো ১১ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন যে অর্থে ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ফলিত রসায়ন বিভাগে দুটি পূর্ণ অধ্যাপক পদের সৃষ্টি করা হয়।
বিজ্ঞান কলেজে সরকারের থেকে সাহায্যের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। পালিত ও ঘোষের বিপুল পরিমাণ দানের পরে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ৪ অক্টোবর ১৯১৩ সালে এক চিঠিতে ১,৯০,০০০ টাকা অতিরিক্ত বার্ষিক অনুদানের জন্য সরকারের কাছ আবেদন জানায়। সেই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের থেকে বার্ষিক অনুদান পেত ১,১৫,০০০ টাকা। এই অতিরিক্ত অনুদানের মধ্যে ৩৬,০০০ টাকা চাওয়া হয়েছিল পালিত ল্যাবরেটরির জন্য। সরকার উত্তর দেয় যে যদি সরকারের পক্ষে কখনো অনুদান সম্ভব হয়, তাহলে অন্যান্য আবেদনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনও বিবেচিত হবে।
ঘোষ ও পালিতের দানের পরিমাণ অনুমানের জন্য একটা সহজ হিসাব দেখা যাক। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন এক টাকার মুদ্রা চালু করেছিল, তাতে রুপোর পরিমাণ ছিল ১১.৬৬ গ্রাম। সেই পরিমাণ রুপোর বর্তমান বাজারদর আটশো টাকার বেশি। এই হিসাবটা খুব সঠিক না হলেও এ কথা বুঝতে অসুবিধা নেই যে পালিত ও ঘোষের মোট দানের পরিমাণ আজকের বিচারে কয়েকশো কোটি টাকার কম নয়।
বিজ্ঞান কলেজের আয় ব্যয়ের হিসাব থেকে পালিত ও ঘোষের দানের গুরুত্ব বোঝা যায়। যেমন ১৯১৭-১৮ সালে বিজ্ঞান কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খরচ করেছিল ২,৩৯,৪৭৩ টাকা, এর মধ্যে সরকারি সাহায্য ছিল মাত্র ১২,০০০ টাকা। পক্ষান্তরে ঘোষ ও পালিতের দান থেকে সুদ বাবদ এসেছিল ১,৩৬,২৫৬ টাকা। এই অর্থ থেকে পালিত ও ঘোষ অধ্যাপক বা তাঁদের গবেষক ছাত্রদের বেতন দেওয়া হত। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিভাগের সহ-অধ্যাপকদের মাইনেও পালিত তহবিল থেকে আসত। সেই বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালিয়ের সাধারণ তহবিল থেকে তাঁরা বেতন পেতে শুরু করেছিলেন।
পালিত ও ঘোষের শর্ত ছিল তাঁদের দানের টাকায় সৃষ্ট অধ্যাপক পদে একমাত্র ভারতীয়রাই নিযুক্ত হবেন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপকই ছিলেন ব্রিটিশ, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপের অন্য দেশের লোক। মাত্র কয়েক বছর আগে জামসেদজী টাটার উৎসাহে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। কিন্তু প্রথম দিকে সেখানে ব্রিটেন থেকে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির বিজ্ঞানীরাই মূলত চাকরি পেয়েছিলেন, তার ফলে সেখানে গবেষণার মান ছিল খুবই নিচু।
কয়েকজন দাতা বিদেশে গবেষণার জন্য বৃত্তি বা বিজ্ঞান সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন। বিজ্ঞান কলেজের অনেক গবেষকই তার সদ্ব্যবহার করেছিলেন। দেশে বিজ্ঞান গবেষণার পরিকাঠামো সেই মুহূর্তে সবে সৃষ্টি হচ্ছে, তাই তরুণ গবেষকদের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা ও তাঁদের গবেষণাগারে কাজের এই সুযোগ যে উপকারে লেগেছিল তা বলা বাহুল্য। কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য গুরুপ্রসন্ন ঘোষ ছাত্রবৃত্তি আগে থেকেই ছিল। বিদেশে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য পালিত তহবিলে এক লক্ষ টাকা রাখা হয়েছিল। রাসবিহারী ঘোষ উইল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন, এই টাকা থেকে বিদেশে গবেষণার জন্য তিনটি বৃত্তি দেওয়া হত, তার মধ্যে অন্তত দুটি ছিল বিজ্ঞানের জন্য নির্দিষ্ট। পদার্থবিদ্যা বিভাগের অনেকেই এই সমস্ত বৃত্তির সুযোগ নিয়েছিলেন।
অধ্যাপক পদ
১৯১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে দু’টি পালিত অধ্যাপক ও দু’টি ঘোষ অধ্যাপক পদের জন্য এবং উদ্ভিদবিদ্যা ও ফলিত গণিতে আরো দুটি ঘোষ অধ্যাপক পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারির সিদ্ধান্ত নেয়। পালিত ও ঘোষ অধ্যাপকদের বেতন ছিল বছরে যথাক্রমে দশ হাজার ও ছ’হাজার টাকা। প্রকৃত বেতনের পরিমাণে অবশ্য সামান্য পার্থক্য হয়েছিল। ভারতবর্ষে সেই সময়ে বিশেষ করে পালিত অধ্যাপকের বেতন নিঃসন্দেহে বেশ উল্লেখযোগ্যই ছিল।
আবেদনপত্র গ্রহণের শেষ তারিখ ছিল ১৪ জানুয়ারি, ১৯১৪। অধ্যাপক নিয়োগের জন্য তারকনাথ পালিত দান তহবিলের গভর্নিং বডি (এখন থেকে গভর্নিং বডি) এবং রাসবিহারি ঘোষ দান তহবিলের ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের (এখন থেকে ম্যানেজমেন্ট বোর্ড) সভা হয় দশ দিন পরে ২৪ জানুয়ারি; সেই দিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এক সভায় দুই সমিতির সিদ্ধান্তে সম্মতি দেয়। বর্তমানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দ্রুততা অকল্পনীয়।
দুই সমিতিই প্রায় একই ভাষায় অধ্যাপকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। অধ্যাপকরা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের প্রসার ঘটাবেন, বিজ্ঞান কলেজের অগ্রবর্তী ছাত্রদের গাইড করবেন, এবং স্নাতকোত্তর ছাত্রদের পাঠ ও উচ্চতর স্তরে গবেষণাতে সাহায্য করবেন। ছুটি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের অফিসারদের নিয়ম অনুসরণ করা হবে। বিজ্ঞান কলেজে ল্যাবরেটরি তৈরি করা ছিল পালিত অধ্যাপকদের দায়িত্ব।
গভর্নিং বডির সভাতে সভাপতি ছিলেন পদাধিকারবলে উপাচার্য সার আশুতোষ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজে রসায়নের অধ্যাপক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রেভারেন্ড জে ওয়াট, জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী নিবন্ধক পল ইওহানেস ব্রুল, বাংলার অ্যাডভোকেট-জেনারেল সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, বিচারপতি বি কে মল্লিক ও ডাক্তার নীলরতন সরকার। আবেদনপত্রগুলির সংক্ষিপ্তসার আগেই সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়েছিল; কারা আবেদন করেছিলেন সেই তথ্য পাওয়া যায় না। গভর্নিং বডি ঠিক করে যে পালিত অধ্যাপকের বেতন হবে ৮০০-৫০-১০০০ এই স্কেলে। তুলনাতে বলতে পারি যে তখন একজন সহ-অধ্যাপক বা লেকচারারের মাইনে ছিল ২০০ টাকা। রসায়নে পালিত অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক।
পদার্থবিদ্যা বিভাগে পালিত অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তে তাঁর কৃতিত্বের কথা বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। লেখা আছে যে ১৯০৬ সালে ব্রিটেনের ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে রামনের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি তখন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ইন্ডিয়ান ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে উচ্চপদে কর্মরত, একই সঙ্গে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে গবেষণা করেন। ইতিমধ্যে তাঁর বাইশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে সাতটি ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে, তিনটি ফিজিক্যাল রিভিউতে ও ছ’টি নেচার পত্রিকাতে। ১৯১৩ সালে গবেষণার জন্য মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মহারাজা অফ ত্রিবান্দ্রম কার্জন পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সভাতে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, ব্রুল, জ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জি, মহেন্দ্রনাথ রায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ। উল্লেখ্য যে শেষ তিনজন এবং নীলরতন সরকার ছিলেন সে সময় সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য। চারটি পদের মধ্যে ফলিত গণিতের অধ্যাপকের বেতন নির্ধারিত হয়েছিল মাসিক ছশো টাকা, বাকিগুলির পাঁচশো টাকা। ফলিত গণিত ও রসায়নের অধ্যাপকদের স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যার ক্ষেত্রে তা করা হয় সাত বছরের জন্য। শর্ত ছিল যে এর মধ্যে দু’বছর সেনেটের অনুমোদনক্রমে ব্রিটিশ ভারতের বাইরে অন্যত্র, যেমন ইউরোপ মহাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে হবে।
ফলিত গণিত বিভাগে বেনারসের কুইন্স কলেজের অধ্যাপক গণেশ প্রসাদকে নিযুক্ত করা হয়। রসায়নে ঘোষ অধ্যাপক পদে মনোনীত হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই লেকচারার প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র। উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক পদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সেই মিটিঙে নেওয়া হয়নি, পরে শঙ্কর পুরুষোত্তম আগরকারকে সেই পদে নিয়োগ করা হয়। কলকাতার সিটি কলেজের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসুকে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ঘোষ অধ্যাপক পদে মনোনীত করা হয়। তিনি ডি এম বোস নামে বেশি পরিচিত। বোর্ডের বিবরণীতে উল্লেখ করা হয় যে তিনি ১৯০৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পরীক্ষাতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর তিনি কেম্ব্রিজে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের অধীনে তিন বছর কাজ করেছিলেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি অনার্স পরীক্ষাতে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
ডি. এম. বোস
সিন্ডিকেটের অনুমোদনের পর সেনেটে সেই বিষয় আলোচনা হয় ৩০ জানুয়ারি। আশুতোষ সেনেটের সভাতে উল্লেখ করেন যে এই সমস্ত পদের জন্য সারা ভারত থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। রামনের আবেদনে গভর্নিং বডির সদস্যরা কিছুটা বিস্মিতই হয়েছিলেন, কারণ ফিনান্স সার্ভিসে রামনের মাইনে কালক্রমে দু’হাজার টাকায় পৌঁছত। সেনেটে কয়েকজন ইউরোপীয় সদস্য নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে আশুতোষ আলোচনার সুযোগ না দিয়ে জোর করে অধ্যাপক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে নিতে চাইছেন। ফলে দু’বার ভোটাভুটি হয়, দু’বারই আপত্তি অগ্রাহ্য হয়।
রামন ও ডি এম বোস একই দিনে মনোনীত হলেও সরকারি চাকরিতে থাকার জন্য রামনের পক্ষে অনুমোদন ছাড়া যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। ১৭ জুলাই ১৯১৪ লেখা এক চিঠিতে সেই অনুমোদন আসে। রামন অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ১৯১৭ সালের ২ জুলাই। পালিত অধ্যাপকরাই বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। দেবেন্দ্রমোহন অবিলম্বেই চাকরিতে যোগ দেন। নিয়োগের শর্ত হিসাবে দেবেন্দ্রমোহনকে দু বছর বিদেশে কাটাতে হত, সেনেটের অনুমোদনক্রমে তিনি জার্মানিতে যান। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে তিনি ১৯১৯ সালের আগে ফিরতে পারেননি। এমএসসি ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯১৬ সালে, তখন বিভাগে কোনো প্রফেসর উপস্থিত ছিলেন না। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে যোগেশচন্দ্র মুখার্জি ও ফণীন্দ্রনাথ ঘোষকে ২০০-২৫-৫০০ স্কেলে লেকচারার পদে নিয়োগ করা হয়েছিল।
আশুতোষের চেষ্টাতে ১৯২১ সালে খয়রার মহারাজা গুরুপ্রসাদ সিংহের দানে পাঁচটি অধ্যাপক পদের সৃষ্টি হয়েছিল। দানের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১১,১০,০০০ টাকা। এর মধ্যে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ধ্বনিতত্ত্ব এবং কৃষিবিজ্ঞানের পদগুলিকে বলা হত খয়রা অধ্যাপক, ভারতীয় চারুশিল্পের পদটির নাম ছিল মহারানি বাগেশ্বরী অধ্যাপক। দানের শর্ত অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখার্জি, নীলরতন সরকার ও জগদীশচন্দ্র বসু খয়রা বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবর্ত সদস্যদের মনোনয়নের অধিকারও তাঁদের ছিল। পদার্থবিজ্ঞানে মেঘনাদ সাহা, রসায়নে জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, ধ্বনিতত্ত্বে সুনীতিকুমার চ্যাটার্জি ও ভারতীয় চারুশিল্পে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অধ্যাপক নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীকালে নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকে কৃষিবিজ্ঞানে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়।
পালিত ও ঘোষ অধ্যাপক পদ একসঙ্গে শুরু হলেও প্রথমটি সবসসময়েই ছিল বেশি আকর্ষণীয়। পালিত অধ্যাপক হতেন বিভাগের প্রধান, তাঁর মাইনে দাঁড়াত এক হাজার টাকা। অপর দুই অধ্যাপক পদের বেতন ছিল পাঁচশো টাকা। পালিত অধ্যাপকদের ল্যাবরেটরির জন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল, সেখান থেকে তাঁরা গবেষকদের বৃত্তি দিতে পারতেন, এমনকি সহকারী অধ্যাপকও নিয়োগ করতে পারতেন। ফলে পালিত-ঘোষ-খয়রা অধ্যাপক পদের এই অনুক্রম বহুদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। রামনের পরে দেবেন্দ্রমোহন হন পালিত অধ্যাপক, তাঁর পরে সেই পদে বসেন মেঘনাদ সাহা। ঘোষ অধ্যাপকরা পরবর্তীকালে আড়াইশো টাকা গৃহভাতা পেতেন। রামন একসময় পাঁচশো টাকা পর্যন্ত গৃহভাতা পেতেন, কিন্তু তাঁর পরের পালিত অধ্যাপক ডি এম বোস গৃহভাতা পেতেন না।
১৯৩৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপকদের মূল বেতনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমনকি ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তীব্র মূল্যবৃদ্ধির সময়েও পালিত অধ্যাপক পদের বেতন ছিল ১৩০০ টাকা। পক্ষান্তরে ঘোষ অধ্যাপক পেতেন ১০০০ টাকা। সেই বছরই খয়রা অধ্যাপকের বেতন ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১৩০০ টাকা। অন্য বিভাগে পালিত বা খয়রা অধ্যাপকরা কিন্তু এর থেকে কম বেতন পেতেন। তার কারণটা সহজবোধ্য, পদার্থবিভাগে পালিত অধ্যাপক ছিলেন মেঘনাদ সাহা, অন্যদিকে সেই বছরই ঢাকা থেকে এসে সত্যেন্দ্রনাথ বসু খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন। পালিত অধ্যাপকের পুরো বেতনটাই পালিত তহবিল থেকে আসত। বাকি দুই অধ্যাপক পদের ক্ষেত্রে কিন্তু দানের তহবিল থেকে বার্ষিক ছ’হাজার টাকার বেশি পাওয়া যেত না, বাকি অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে আসত।
১৯১৬ সালের ১ জুলাই বিভাগে পড়ানো শুরু হয়েছিল, সেই বছর মোট আটজন অধ্যাপক বা অধ্যাপকের সহকারী (অর্থাৎ গবেষক) ক্লাস নিয়েছিলেন। গবেষকদের ক্লাস নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, এবং সেই অনুযায়ী তাদের মাইনেও বাড়ানো হয়েছিল। পালিত অধ্যাপকের সহকারী হিসাবে ছিলেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তাঁদের বৃত্তি ১২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২০০ টাকা। রামন কিন্তু পালিত অধ্যাপকের পদে যোগ দেবেন পরের বছর। ১৯১৭ সাল থেকে যে সমস্ত গবেষক বা সহকারী ক্লাস নিতেন, তাঁদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারিত হয় ২০০ টাকা। নিচের তালিকাতে ১৯১৬ সালে বিভাগের প্রথম শিক্ষকদের নাম ও বেতন পাওয়া যাবে।
নাম | পদ | বেতন (টাকাতে) |
দেবেন্দ্রমোহন বসু | ঘোষ অধ্যাপক | ৫০০ |
যোগেশচন্দ্র মুখার্জি | লেকচারার | ২০০ |
ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ | লেকচারার | ২০০ |
সত্যেন্দ্রনাথ বসু | পালিত অধ্যাপকের সহকারী | ২০০ |
মেঘনাদ সাহা | পালিত অধ্যাপকের সহকারী | ২০০ |
সুশীলকুমার আচার্য | ঘোষ গবেষক | ১২৫ |
শিশিরকুমার মিত্র | ঘোষ গবেষক | ১২৫ |
অবিনাশচন্দ্র সাহা | পালিত গবেষক | ১২৫ |
গবেষকদের টাকা দেওয়া হত বিভিন্ন দানের তহবিল থেকে। শুরুতে তাঁদের বৃত্তি ছিল ৫০ টাকা, পরে সেটা বাড়িয়ে করা হয় ৭৫ টাকা। তাঁদের পদকে আজকের জুনিয়র রিসার্চ ফেলোর সমতুল বলা যেতে পারে। এর পর তাঁরা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও আরো পরে সহকারী অধ্যাপক হতে পারতেন। সহকারী অধ্যাপকদের চাকরি ছিল স্বল্পমেয়াদি, কিন্তু তাদের স্কেলে বেতন দেওয়া হত। পদের বিভাগগুলো সবসময় খুব পরিষ্কার ছিল না, তাদের পরিবর্তনও হত।
বিজ্ঞান কলেজ প্রশাসন
তারকনাথ পালিত তহবিল গভর্নিং বডি ও রাসবিহারী ঘোষ তহবিল ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সভা প্রায়ই এক সঙ্গে হত, এখন থেকে আমরা তাকে জয়েন্ট বোর্ড বলব। শুরুতে তারাই বিজ্ঞান কলেজের প্রশাসন পরিচালনা করত। এই বিষয়ে সুপারিশের জন্য এক উপসমিতি তৈরি হয়, তার সদস্য ছিলেন আশুতোষ, ব্রুল, মহেন্দ্রনাথ রায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র। উপসমিতি সুপারিশ করে যে রসায়নের জন্য একটি ও পদার্থবিদ্যা ও সাইকো-ফিজিক্সের (পরে মনোবিদ্যা) জন্য একটি স্থায়ী কমিটি তৈরি হোক। জয়েন্ট বোর্ড ও সিন্ডিকেট সেই সুপারিশ গ্রহণ করলেও তা কার্যকরী হয়নি। ১৯১৮ সালে আবার একটি কমিটি তৈরি হয়, তার সদস্য ছিলেন আশুতোষ, রামন, ব্রুল, সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র। কমিটির রিপোর্টে ভিত্তিতে জয়েন্ট বোর্ড বিজ্ঞান কলেজের প্রশাসনিক পরিচালনার জন্য এক গভর্নিং বডি তৈরির সুপারিশ করে, এর সদস্য হবেন জয়েন্ট বোর্ডের সমস্ত সদস্য, বিজ্ঞানের সমস্ত পূর্ণ-অধ্যাপক, এবং লেকচারার ও গবেষকদের থেকে নির্বাচিত কয়েকজন। উপাচার্য হবেন পদাধিকারবলে সেই বোর্ডের সভাপতি। সিন্ডিকেট ও সেনেটের অনুমোদনের পরে ১৯১৯ সালে বিজ্ঞান কলেজের গভর্নিং বডি তৈরি হয়।
পাশাপাশি ১৯১৭ সালে তৈরি হয়েছিল স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক কাউন্সিল, তার দায়িত্ব ছিল বিজ্ঞান শিক্ষা পরিচালনা। স্নাতকোত্তর শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক এর সদস্য হতেন, তাছাড়া সেনেট চারজন সদস্যকে মনোনীত করত, বিজ্ঞান অনুষদ ও যে সমস্ত কলেজে স্নাতক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হত, তাদের অধ্যক্ষরা মিলে দুজন সদস্যকে নির্বাচিত করতেন। এই কাউন্সিলের এক কার্যকরী সমিতি ছিল। প্রতিটি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে থেকে দুজনকে কার্যকরী সমিতিতে নির্বাচিত করতেন। সেনেট ও বিজ্ঞান অনুষদ যথাক্রমে দু’জন ও এক জন সদস্যকে সমিতিতে মনোনীত করতেন। কার্যকরী সমিতির সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি নির্বাচিত করতেন, তিনিই হতেন কাউন্সিলের সভাপতি। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান কলেজের গভর্নিং বডি ও কাউন্সিলের কার্যকরী সমিতি পাশাপাশি কাজ করেছিল। তার পর থেকে গভর্নিং বডি বিলুপ্ত হয়, তার সমস্ত দায়িত্ব নেয় কার্যকরী সমিতি।
দ্বিতীয় পর্ব
আগের পর্বে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠার কথা আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা বিভাগের কথা আলোচনা করব। প্রথম পর্বে জয়েন্ট বোর্ডের কথা বলা হয়েছে, ১৯১৬ সালের ১৬ই মে জয়েন্ট বোর্ডের মিটিংএর কার্যবিবরণী তিনদিন পর সিন্ডিকেটের সভায় পেশ হয়। তারও পাঁচদিন আগে, ১১ তারিখ, জয়েন্ট বোর্ড একটি সাবকমিটি তৈরি করে যাদের কাজ ছিল আগামী দু বছরের জন্যে বিজ্ঞান কলেজের কর্মপদ্ধতির রূপরেখা প্রণয়ন করা। এই সাবকমিটিতে ছিলেন স্বয়ং সার আশুতোষ, মহেন্দ্রনাথ রায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র এবং পল ইওহানেস ব্রুল, এঁদের সবার কথাই আমরা আগের পর্বে পেয়েছি। পদার্থবিদ্যা পঠনপাঠন সম্বন্ধে এই সাবকমিটির পরামর্শ ছিল – সর্বাধিক বারোজন ছাত্র নিয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শুরু করা হোক, চারজন করে তিনটি বিষয়ে ভাগ করে, পদার্থের ধর্ম ও স্বনবিদ্যা, আলোক, এবং তাপ। এই ভাগগুলো এখনকার দিনের অ্যাডভান্সড বা ঐচ্ছিক পত্রের পূর্বসূরী। বলা বাহুল্য, ঐচ্ছিক পত্রের বাইরে আবশ্যিক পত্রও পাঠক্রমে ছিল।
ইংরেজিতে স্টুডেন্ট বলা হয়েছে, আমরা সচেতনভাবেই বাংলায় ছাত্র বলছি, কারণ পদার্থবিদ্যার ক্লাসে মেয়েদের দেখা পেতে আরো পনেরো বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞান সে যুগের ইউরোপেও পুরুষপ্রধান বিষয় ছিল, এমি নোয়থার বা লিজে মাইটনারকে স্বীকৃতির জন্যে অনেক লড়াই করতে হয়েছে, এদেশের কথা সহজেই অনুমেয়। ১৯৩৩ সালে চামেলি দত্ত (পরে বসু) প্রথম ছাত্রী হিসেবে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পাশ করেন। ইনি বেথুন কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপিকা ছিলেন, এবং বৃদ্ধ বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে এক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। চামেলি ভারতের প্রথম বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছাত্রী। পরের বছর আরো একজন ছাত্রীর দেখা পাই, কাকতালীয়ভাবে এঁর নামও চামেলি দত্ত, ইনি ভারত সরকারের চাকরি করেছেন। তার পরের বছর এমএসসি পাশ করেন বিভা চৌধুরী, দেবেন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে পরে তিনি যে গবেষণা করেছিলেন তা প্রায় নোবেল পুরস্কারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৪৩ সালে ইভা মিত্র প্রথম নারী গবেষক হিসেবে বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ করে পূর্ণিমা সিংহ পিএইচডি পান, ইনি পদার্থবিদ্যায় ভারতের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম মহিলা ডক্টরেট। পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম মহিলা অধ্যাপক পারঙ্গমা সেন, তিনি যোগ দেন ২০০০ সালে।
আবার সেই সময়ে ফিরে যাওয়া যাক। এই নতুন পাঠক্রমের জন্যে কিন্তু কোনো টেক্সট বই উল্লেখ করা হল না; সেটা যারা পড়াবেন তাঁদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হল। এই স্বাধীনতা দেবার ফলে গতানুগতিক বিষয়ের বাইরে গিয়ে একেবারে আধুনিক বিষয়েও শিক্ষকেরা পড়াতে শুরু করলেন। আমরা পরে দেখব, বিজ্ঞানের যে সব আবিষ্কার ইউরোপে দু-তিন বছর আগে হয়েছে, তাও স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে পড়ানো হয়েছে, অনেক সময় টেক্সট বইএর অভাবে মূল গবেষণাপ্রবন্ধ থেকেই (আজকাল এ সব ভাবতেও কেমন অবাক লাগে)। ১৯১৬ সালে যোগেশচন্দ্র মুখার্জি ও ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন, স্নাতকোত্তরে পঠনপাঠন শুরু হল। এই বিভাগের প্রথম শিক্ষক হবার সম্মান দেবেন্দ্রমোহন বসুর প্রাপ্য, কিন্তু প্রথম পড়ানো শুরু করেছিলেন যোগেশচন্দ্র ও ফণীন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রমোহন ১৯১৪ সালে নিযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তখন তিনি ইউরোপে। মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে পৃথিবীর প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানী, এরিখ রেগেনারের কাছে পিএইচডি করে জার্মানিতেই আটকে পড়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্যে, ১৯১৯ সালে তাঁকে আমরা বিজ্ঞান কলেজে দেখতে পাব।
যোগেশচন্দ্র ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তরে প্রথম স্থান অধিকার করেন, তারপর বঙ্গবাসী কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, সেখান থেকে আসেন বিজ্ঞান কলেজে। ১৯৪৮ সালে বাষট্টি বছর বয়সে তিনি অবসর নেন। তিনি একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন, সঙ্গে শিল্পকলা ও সঙ্গীতের রসবোদ্ধা। অবশ্য গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ কোনো অবদান ছিল বলে আমরা খুঁজে পাইনি। তাঁর এক ছেলে পূর্ণচন্দ্র পদার্থবিদ্যা বিভাগেই পালিত গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, পরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। আরেক পুত্র মুরারিমোহন ছিলেন বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক।
যোগেশচন্দ্রের পরের বছর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা স্নাতকোত্তরে প্রথম স্থান পান ফণীন্দ্রনাথ, তিনিও ১৯১০ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত বঙ্গবাসী কলেজে পড়িয়েছেন, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। গবেষক হিসেবে ফণীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব আছে, যদিও তাঁর গবেষক জীবনের শুরু হয় একটু দেরি করেই, ৩২ বছর বয়সে, সি ভি রামন পালিত অধ্যাপক পদে যোগ দেবার পর, এবং হয়তো তাঁর অনুপ্রেরণাতেই। রামনের সঙ্গে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ১৯১৮ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, অভ্রের রং ও আলোকধর্মের ওপরে। ১৯২০ সালে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার ঘোষ অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন ফণীন্দ্রনাথ, যদিও বিভাগটি পুরোপুরি চালু হতে আরো কিছু সময় লেগেছিল। ভারতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে ফণীন্দ্রনাথ বা পি এন ঘোষ একটি উজ্জ্বল নাম।
এখানে আরেকজন লোকের কথাও বলা উচিত যিনি আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত। অথচ ইনি না থাকলে পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর ল্যাবরেটরি হয়তো চালুই হত না। ইনি এক বর্ণাঢ্য চরিত্র শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। একাধারে পদার্থবিদ্যার উজ্জ্বল ছাত্র এবং বিপ্লবী এই মানুষটিকে সার আশুতোষ নিজের হাতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরীক্ষাগার গড়ে তোলার। কিন্তু ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে তাঁকে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালাতে হয়। এনার কথা পরে কখনো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
সেই সময়ে, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে, ছাত্রদের মাসিক বেতন ছিল দশ টাকা, বোঝাই যাচ্ছে সে যুগের তুলনায় যথেষ্টই বেশি। আগে যে তিনটি ঐচ্ছিক ভাগের কথা বলেছি, তা ছাড়াও ১৯১৯ সালে আরো একটি নতুন ভাগ চালু হয় – গবেষণা পত্র বা থিসিস পেপার, অনেকটা আজকের দিনের প্রোজেক্ট পেপারের মত। যদিও এই ভাগটি ছাত্ররা গোড়ায় নেবার সাহস দেখায়নি; আমরা দেখতে পাই প্রথম ১৯২৭ সালে তিনজন ছাত্র এই পত্রটি নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন, বি এন শ্রীনিবাসন, সি নাঞ্জুনদায়া, এবং সুবোধচন্দ্র ঘোষ। (সেই সময়ে এই বিভাগে প্রচুর অবাঙালী ছাত্রের নাম পাওয়া যায়; সেটা স্বাভাবিক, তৎকালীন ভারতের পদার্থবিদ্যা শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।) ১৯২৯ সালে প্রথম তিনটি ভাগ জুড়ে দিয়ে একটি সাধারণ পত্র তৈরি হয়, আর গবেষণা বা থিসিস পত্রটিও বহাল থাকে। অর্থাৎ, কেউ কেউ স্নাতকোত্তরে প্রোজেক্ট করবেন, আর অনেকেই প্রোজেক্ট না করে সম্মিলিত ঐচ্ছিক পত্রটি পড়বেন। ১৯২৯ সালে পিভি কৃষ্ণমূর্তি রামন বর্ণালীর ওপরে তাঁর প্রোজেক্ট করেন, তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
স্নাতকোত্তর পদার্থবিদ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষা হয় ১৯১৮ সালে। আটজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, উত্তীর্ণ হন চারজন – তাপ বিভাগে সুধাকর চক্রবর্তী ও নারায়ণদাস বসু, আর আলোক বিভাগে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জ্যোতির্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৯ সালে এই সংখ্যাটা বেড়ে হয় আট; পদার্থের ধর্ম ও স্বনবিদ্যা বিভাগে জে সি কামেশ্বর রাও ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আলোকে সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধাকর বিশ্বাস ও ভূপেন্দ্রকিশোর বসু, আর তাপ বিভাগে সত্যেন্দ্রকুমার ঘোষ, মাখনলাল চক্রবর্তী, ও বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। পরের বছর কামেশ্বর রাও পালিত গবেষক হিসেবে রামনের কাছে কাজ শুরু করেন ও ১৯২৪ সালে ডক্টরেট পান। সত্যেন্দ্রকুমারও ১৯২০ সালে ঘোষ গবেষক হিসেবে যোগ দেন, তবে পিএইচডির কাজ সম্পূর্ণ করেননি। বাকিদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না, কেউ জানালে উপকৃত হব।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ মিলিয়েই পঠনপাঠন হত, যে প্রথা বহুকাল পর্যন্ত চলে এসেছিল। প্রেসিডেন্সিতে পড়ানো হত তড়িৎবিদ্যা, চৌম্বকবিদ্যা, ও আলোকবিদ্যার ঐচ্ছিকপত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরে পড়ানো হত এক্সরশ্মি, তেজস্ক্রিয়তা, আপেক্ষিক তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব (পুরনো কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা বলছি, নতুন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তখনো জন্মায়নি), ইলেকট্রন তত্ত্ব, এবং ইথার তত্ত্বের ইতিহাস। ১৯১৭ সালে মোট তেরো জন শিক্ষকের নাম পাই; প্রেসিডেন্সি কলেজের থেকে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, ডি বি মীক, এবং দ্বিজেন্দ্রকুমার মজুমদার, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সি ভি রামন, যোগেশচন্দ্র মুখার্জি, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, সুশীলকুমার আচার্য, সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি, শিশিরকুমার মিত্র ও অবিনাশচন্দ্র সাহা। শৈলেন ঘোষ কখনো শিক্ষক হিসেবে যোগ দেননি; ততদিনে তিনি আমেরিকায়। এই শিক্ষকদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ, মেঘনাদ, শিশিরকুমার, সুশীলকুমার ও অবিনাশচন্দ্র ছিলেন গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, ১৯১৬ সালের কার্যবিবরণীতে তাঁদের পালিত অধ্যাপকের সহকারী বা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুধাংশুকুমারও রামনের ল্যাবে কাজ করতেন, কিন্তু আসলে ছিলেন ব্যবহারিক গণিতের সহকারী অধ্যাপক। তেমনি সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক হয়েও ব্যবহারিক গণিতের ক্লাস নিতেন।
মেঘনাদের কথা যখন উঠল, তখন বলে রাখা ভালো, তাঁর সঙ্গে রামনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি বহুচর্চিত বিষয়। সংঘাতের শুরু কবে বা কোথা থেকে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত, কিন্তু যেটা সকলেই স্বীকার করেন, এই সংঘাত একসময় অত্যন্ত তিক্তরূপ নিয়েছিল। স্বয়ং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র এতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রামন বা মেঘনাদ, কেউই নিজের পদমর্যাদাসুলভ আচরণ করেননি। কিন্তু এ প্রসঙ্গ নিয়ে পরে কখনো আলোচনা করা যাবে।
১৯১৮ সালে তড়িৎবিদ্যা, আলোকবিদ্যা, ও স্বনবিদ্যার বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কিনে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মশালায় তৈরি করে স্নাতকোত্তর ল্যাবরেটরি পুরোদমে চালু হয়। তখন শৈলেন্দ্রনাথ আর এদেশে নেই, স্বয়ং রামন দাঁড়িয়ে থেকে কর্মশালার কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। ল্যাবরেটরির দায়িত্ব বিভিন্ন শিক্ষকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত – তড়িৎবিদ্যায় অবিনাশচন্দ্র, আলোকবিদ্যায় ফণীন্দ্রনাথ ও শিশিরকুমার, তাপ ও তাপগতিতত্ত্বে সুশীলকুমার ও মেঘনাদ, এবং পদার্থের ধর্ম বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ও রামনের গবেষণাগারে কর্মরত টি কে চিন্ময়ানন্দম। বিভাগের বার্ষিক রিপোর্টে রামন নিজেই বলছেন, এটা একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা, যতদিন না চিন্ময়ানন্দম স্থায়ী শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন, কিন্তু সে নিয়োগের আগেই চিন্ময়ানন্দম চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯১৭ সালের রিপোর্টে রামন এঁকে প্রোফেসর চিন্ময়ানন্দম বলে উল্লেখ করছেন, মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথকে মিস্টার বলে, তার থেকে মনে হতে পারে চিন্ময়ানন্দম বিভাগের পূর্ণ সময়ের শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিতে সেরকম কোনো উল্লেখ আমরা পাইনি।
রামনই তখন একমাত্র অধ্যাপক যিনি তাঁর চারদিকে গবেষকদের গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন, কিছু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিছু কালটিভেশন অফ সায়েন্সে। এই গবেষকরা অনেকেই স্থায়ী চাকরির জন্যে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। এমনকি সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদও আরো ভালো বেতন ও সুযোগসুবিধের জন্যে কলকাতা ছেড়ে যথাক্রমে ঢাকা ও এলাহাবাদে চলে যাবেন এর কিছুদিনের মধ্যেই, যদিও অনেক পরে দুজনেই আবার ফিরে আসবেন। তার আগে রামন নিজেই চলে যাবেন বাঙ্গালোরে, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হয়ে। কিন্তু সে আরো পরের গল্প।
এই বিভাগের প্রথম দিকের শিক্ষকদের নাম ও যোগদানের বছর
দেবেন্দ্রমোহন বসু, ১৯১৪ (ঘোষ অধ্যাপক, ১৯১৯ সালে বিভাগে ফিরে আসেন)
যোগেশচন্দ্র মুখার্জি ও ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, ১৯১৬ (পূর্ণ সময়ের শিক্ষক)
সুশীলকুমার আচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশিরকুমার মিত্র, অবিনাশচন্দ্র সাহা, ১৯১৬ (গবেষক ও শিক্ষক)
চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন, ১৯১৭ (১৯১৪ সালে পালিত অধ্যাপক পদে নির্বাচিত)
ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ১৯১৯
বিধুভূষণ রায়, ১৯২১
দুর্গাদাস ব্যানার্জি, ১৯২২
হৃষীকেশ রক্ষিত, ১৯৩৫
সুকুমারচন্দ্র সরকার, ১৯৪৪
বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরী, ১৯৪৬ (সুর রিডার পদে)
রামনের সঙ্গে মেঘনাদের সংঘাতের কথা একটু আগে বলেছি। এই সংঘাতের একটা কারণ ছিল বিভাগের জন্যে বরাদ্দ অর্থ পালিত অধ্যাপকের গবেষণাগারে কতটা যাবে, তা নিয়ে টানাপড়েন। বরাদ্দ অর্থ অন্য শিক্ষকরাও খরচ করছেন, বা সেই টাকায় স্নাতকোত্তর ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে, ফলে পালিত গবেষণাগারে টাকার টান পড়ছে, এ নিয়ে রামন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আজকাল এটা একটু অদ্ভুত শুনতে লাগবে, কিন্তু বিভাগের অর্থে সব শিক্ষকেরই সমান অধিকার, এ কথা তখনো স্বীকৃত হতে বহু দেরি। রামনের পক্ষে যুক্তি ছিল যে টাকার বড় অংশের যোগান আসে পালিতের দান থেকে, আর পালিত অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সে টাকা কীভাবে খরচ হবে সে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তাঁর থাকা উচিত। ১৯৩৩ সালে রামন কলকাতা ছেড়ে গেলে পালিত অধ্যাপক হন দেবেন্দ্রমোহন (ঘোষ থেকে পালিত অধ্যাপক, বা খয়রা থেকে ঘোষ, পদোন্নতি হিসেবে ধরা হত, আগেই বলেছি), ঘোষ অধ্যাপক হন তৎকালীন খয়রা অধ্যাপক শিশির মিত্র, খয়রা অধ্যাপকের পদে যোগ দেন বিধুভূষণ রায়। তিনি অবশ্য বেশিদিন বাঁচেননি। ১৯৪৪ সালে তাঁর অকালমৃত্যুর পর খয়রা অধ্যাপকের শূন্যপদে ঢাকা থেকে ফিরে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ।
বিধুভূষণ রায়
দেবেন্দ্রমোহন ১৯৩৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা হন। পরের বছর পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন মেঘনাদ সাহা, এলাহাবাদ থেকে ফিরে এসে। এই পর্বে সাহার মূল কাজ হল ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তৈরি করা, তাঁর মৃত্যুর পরে যার নাম হয় সাহা ইন্সটিটিউট। এটি পদার্থবিদ্যা বিভাগের অংশ হলেও আধা-স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান ছিল। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাইক্লোট্রন নামে এক কণাত্বারক যন্ত্র, যার কথা পরে আলোচনা করা হবে। এটি গোটা এশিয়া মহাদেশের প্রথম সাইক্লোট্রন, এর মূল অংশটি এখনো বিজ্ঞান কলেজে আছে। সাইক্লোট্রনের জন্যে মেঘনাদ আলাদা অর্থের বরাদ্দ করেছিলেন। সেই অর্থ থেকে কিছু গবেষককে বৃত্তি দেওয়া হত, যেমন ধীরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু বা পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, তাঁদেরও আমরা এই বিভাগের গবেষক বলেই গণ্য করব। এই ইন্সটিটিউটে একটি জীবপদার্থবিদ্যা বিভাগও ছিল, সেখানে ১৯৪৪ সালে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন নীরজনাথ দাসগুপ্ত, ইনি লন্ডন থেকে পিএইচডি করেছিলেন।
গবেষক ও গবেষণা
শুধু ভালো পড়ালেই কোনো স্নাতকোত্তর বিভাগের সুখ্যাতি হয় না। পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে কলকাতায় সে ঐতিহ্যের অভাব হয়নি, প্রথম থেকেই শিক্ষক ও গবেষক ছাত্রেরা পৃথিবীর একেবারে প্রথম সারির পত্রিকায় নিয়মিত তাঁদের প্রবন্ধ ছাপিয়েছেন, যেমন নেচার, ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন, ফিজিক্যাল রিভিউ। এর বেশির ভাগ প্রবন্ধই আসত রামনের গবেষকগোষ্ঠী থেকে, কিন্তু অন্যান্যদেরও অবদান ছিল। এই বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবন্ধটি লিখেছিলেন মেঘনাদ সাহা, তাপ আয়নন তত্ত্বের ওপরে, যার থেকে আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার সূত্রপাত বলা যেতে পারে।
প্রথম থেকেই পদার্থবিদ্যা বিভাগের গবেষণার মান উঁচু তারে বাঁধা ছিল। একেবারে প্রথম সারির আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় বেশির ভাগ প্রবন্ধ ছাপা হত। প্রবন্ধের অধিকাংশই আসত রামনের গবেষণাগার থেকে, বিভাগে ফিরে আসার পর দেবেন্দ্রমোহন বসুও নিয়মিত প্রবন্ধ ছাপাতেন, আর কিছু তাত্ত্বিক গবেষণার প্রবন্ধ লিখেছিলেন মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ — যার মধ্যে সবার ওপরে থাকবে ১৯২০ সালে মেঘনাদের তাপ আয়নন তত্ত্বের প্রবন্ধগুলি। যে কাজের জন্যে রামন বিখ্যাত, সেই রামন এফেক্টের গবেষণার কাজ হয়েছিল কালটিভেশন অফ সায়েন্সে, আর সত্যেন্দ্রনাথের কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ওপর বৈপ্লবিক কাজটি হয়েছিল ঢাকা থেকে।
বিভাগের গবেষণার মান কেমন ছিল, তার জন্যে উদাহরণস্বরূপ ১৯১৮ সালে রামনের পাঠানো রিপোর্ট দেখা যাক। সেই বছর সাতাশটি প্রবন্ধ হয় প্রকাশিত হয়েছিল, বা প্রকাশনার জন্যে মনোনীত হয়েছিল। এর মধ্যে নেচার পত্রিকায় দুটি, ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে দশটি, লন্ডনের রয়াল সোসাইটির কার্যবিবরণীতে একটি, ফিজিক্যাল রিভিউতে তিনটি, এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে একটি। আটটি প্রবন্ধ ছিল রামনের লেখা (তার মধ্যে একটি ফণীন্দ্রনাথের সঙ্গে, আরেকটি সুধাংশু ব্যানার্জির সঙ্গে), সুধাংশু নিজে আরো তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, শিশির মিত্র তিনটি, চিন্ময়ানন্দম চারটি, এবং মেঘনাদ পাঁচটি (তার মধ্যে একটি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে, গ্যাসের অবস্থা সমীকরণ বিষয়ে)। এর বাইরে আরো কয়েকটি প্রবন্ধ ছিল, কিন্তু লেখকরা রামনের গবেষণাগারে কাজ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত গবেষক ছিলেন না, যেমন এন এম বসু বা চণ্ডী প্রসাদ। এঁরাও কিন্তু আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন।
প্রথম দিকের অনেক গবেষক রামনের ল্যাবে নথিভুক্ত ছিলেন কিন্তু স্বাধীনভাবেই কাজ করতেন, এবং পরে তাঁদের কাজের জন্যে ডিএসসি ডিগ্রি পেয়েছিলেন। এই স্বাধীনতা দেবার কথা এখনকার দিনেও অনেক অধ্যাপক ভাবতে পারবেন না। রামনের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে পিএইচডি পান একমাত্র ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ (১৯১৯) ও লক্ষ্মীনারায়ণপুরম অনন্তকৃষ্ণায়ার রামদাস (১৯২৭), বাকি সকলেই ডিএসসি — সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি (১৯১৮), শিশিরকুমার মিত্র (১৯২০), ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২২), বিধুভূষণ রায় (১৯২৩), জে সি কামেশ্বর রাও (১৯২৪), পঞ্চানন দাস (১৯২৯), কেদারেশ্বর ব্যানার্জি (১৯৩০), সুকুমারচন্দ্র সরকার (১৯৩৩)। এর পরেই রামন কলকাতা ছেড়ে চলে যান। এছাড়া স্বাধীন গবেষণা করে প্রাকস্বাধীনতা যুগে আর যারা ডিএসসি পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন – মেঘনাদ সাহা (১৯১৯), শশিভূষণ মালি (১৯২৫), কুলেশচন্দ্র কর (১৯২৬), দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, হৃষীকেশ রক্ষিত, ও ক্ষেত্রমোহন বসু (সকলেই ১৯৩৪), পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল (১৯৩৬), বি এস মাধব রাও (১৯৩৮), মোহিনীমোহন ঘোষ (১৯৪১), সুবোধকুমার চক্রবর্তী (১৯৪৪), শ্যামাদাস চ্যাটার্জি, অজিতকুমার সাহা, সুবোধনাথ বাগচি, মৃগাঙ্কশেখর সিংহ, সুবোধনাথ দত্ত (সকলেই ১৯৪৫)। পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট পাবার কৃতিত্ব মেঘনাদের। অনেক গবেষক রামনের কাছে কালটিভেশন অফ সায়েন্সে গবেষণা করতেন, তাঁদের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না, একমাত্র পিএইচডি বা ডিএসসি দেওয়া ছাড়া, তাঁদের নাম এখানে বলা হয়নি। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হলেন কারিয়ামানিক্কম শ্রীনিবাস, বা কে এস, কৃষ্ণন। প্রাকস্বাধীনতা যুগে এই বিভাগের অন্যান্য খ্যাতনামা গবেষকদের মধ্যে আছেন অবিনাশচন্দ্র সাহা, সত্যেন্দ্রকুমার ঘোষ, দুর্গাপ্রসন্ন আচার্য, সুশোভন দত্ত, যতীন্দ্রনাথ ভড়, পূর্ণচন্দ্র মুখার্জি, হৃষীকেশ রক্ষিত, পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, দেবীদাস বসু, পরেশকিশোর সেনচৌধুরী, কমলাক্ষ দাসগুপ্ত, ইভা মিত্র, শিবব্রত ভট্টাচার্য, ধীরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু। এঁদের মধ্যে অবিনাশচন্দ্র, শ্যামাদাস চ্যাটার্জি, যতীন্দ্রনাথ, হৃষীকেশ, পরেশচন্দ্র, কমলাক্ষ ও শিবব্রত পরে এই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। শ্যামাদাস ভারতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। অবিনাশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রকুমার, দুর্গাপ্রসন্ন, সুশোভন, পূর্ণচন্দ্র ও পরেশকিশোর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। দেবীদাস বসু এই বিভাগে গবেষণা শুরু করলেও পরে ডাবলিন থেকে ডক্টরেট পান, এবং পরে কালটিভেশন অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হন। অজিতকুমার (মেঘনাদ সাহার পুত্র) ও ধীরেন্দ্রনাথ পরবর্তী জীবনে সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ইভা মিত্র বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া একটি নাম; ইনি এই বিভাগের প্রথম মহিলা গবেষক, ১৯৪৩ থেকে ৪৫ তিন বছর ঘোষ অধ্যাপকের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেন, যদিও পিএইচডি শেষ করেননি। সেটা খুব অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, গবেষক হিসেবে যারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশই গবেষণার কাজ শেষ না করেই সায়েন্স কলেজ ছেড়ে গেছেন, সম্ভবত শিক্ষকতা বা অন্য কোনো চাকরি নিয়ে।
এই গবেষকরা প্রায় সকলেই পালিত, ঘোষ, বা খয়রা অধ্যাপকের (১৯২২ সালের পর থেকে) গবেষণাগারে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো গবেষণা বৃত্তি ছিল না, শুধু মাসে ৭৫ টাকা করে কিছুদিনের জন্যে কাউকে সাহায্য করা হত। এরকম বৃত্তি পেয়েছিলেন হৃষীকেশ রক্ষিত (১৯২৯-৩১) এবং যোগেশচন্দ্রের পুত্র পূর্ণচন্দ্র মুখার্জি (১৯৩৬)। পরে সাইক্লোট্রনের সঙ্গে যুক্ত গবেষকদের বৃত্তি তার জন্যে বরাদ্দ আলাদা তহবিল থেকে আসত।
গবেষক হিসেবে যারা নির্বাচিত হতেন, সবাই যোগ দিতেন না, যেমন ১৯১৪ সালে ঘোষ গবেষক হিসেবে নির্বাচিত সুশীলকুমার আচার্য। বিভাগে গবেষক হিসেবে প্রথম যোগ দেন শিশিরকুমার মিত্র ও কুমারনাথ ব্যানার্জি।
যতীন্দ্রনাথ শেঠ একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ইনি পালিত অধ্যাপকের সহকারী ছিলেন। ১৪ই জুলাই ১৯১৬ তারিখে তিনি ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। সিন্ডিকেট অবশ্য জুলাই মাসের ১৪ দিনের বেতন তাঁকে মঞ্জুর করেছিল। যতীন্দ্রনাথ কখনো এই বিভাগে শিক্ষকতা করেননি।
বিদেশযাত্রার জন্যে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যেত, গবেষকরা পেতেন, এমনকি অধ্যাপকরাও। (আজকাল পেতে গেলে যে কত মাথা খুঁড়তে হয় সে ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।) মূলত তিন জায়গা থেকে এঁরা সাহায্য পেতেন। প্রথম, গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি, ২০০০ টাকা, পেয়েছিলেন মেঘনাদ (১৯১৯) ও শিশিরকুমার (১৯২০)। তিন বছর ধরে মোট ১০০০০ টাকা পাওয়া যেত তারকনাথ পালিত স্কলারশিপ (বিদেশ) থেকে, পেয়েছিলেন বিধুভূষণ রায় (১৯২৩) ও দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (১৯৩১)। রাসবিহারী ঘোষের দান থেকে ছিল ঘোষ ট্র্যাভেলিং ফেলোশিপ, এর জন্যে উইলে আড়াই লাখ টাকা ব্যবস্থা রাখা ছিল। ৩০০০ টাকার এই বৃত্তিটি পেয়েছিলেন শিশিরকুমার (১৯২২, ১৯৩৫), রামন (১৯২৩), দেবেন্দ্রমোহন (১৯২৭), কেদারেশ্বর ব্যানার্জি (১৯৩১), বিধুভূষণ (১৯৩৩), হৃষীকেশ রক্ষিত (১৯৩৮-৩৯), নীরজনাথ দাসগুপ্ত, ধীরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু, পূর্ণচন্দ্র মোহান্তি (সকলেই ১৯৪৫), দেবীদাস বসু (১৯৪৬)। কেউ কেউ অবশ্য প্রত্যাখ্যাতও হতেন। যেমন ১৯২২ ও ১৯২৩ সালে পালিত স্কলারশিপের জন্যে আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সতীশরঞ্জন খাস্তগির, পরে ইনি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই বিভাগের অন্যতম খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালে বাঙ্গালোরে বিজ্ঞান কংগ্রেসে যাবার জন্যে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন, পাননি।
প্রশ্নপত্র
সে যুগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেমন হত দেখা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই প্রশ্নপত্রগুলি পাওয়া যায়, বেশির ভাগ পত্রেই প্রশ্নকর্তার নামও দেওয়া থাকে (সুতরাং অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে সেই পত্রগুলো তাঁরাই পড়াতেন)। প্রশ্ন থেকে পড়ানোর ধাঁচ সম্বন্ধেও ধারণা করা যায়; কখনো দেখব, একেবারে আধুনিক গবেষণার ওপর প্রশ্ন আসছে, হয়ত দু-তিন বছর আগে সেই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, পাঠ্যবইতে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই, একেবারে মূল প্রবন্ধ থেকেই পড়াতে হবে। কোনো কোনো পত্র আবার অত্যন্ত গতানুগতিক, যেরকম প্রশ্ন এখনো দুর্লভ নয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে দুরকম ধারাই আছে, কিছু গৎবাঁধা, কিছু অতি-আধুনিক। কখনো দেখি, রামন এবং মেঘনাদ একসঙ্গে প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন, ততদিনে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা বহুদূর গড়িয়েছে, একের সম্বন্ধে অন্যের মনে তীব্র বিরাগ। এখানে বলে রাখা ভালো, রামন, মেঘনাদ, ও সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্র গণিতের প্রশ্নপত্রও তৈরি করতেন।
এই বিভাগের স্নাতকোত্তর ছাত্ররা প্রথম পরীক্ষা দেয় ১৯১৮ সালে; সে বছর থেকেই দেখি, প্রায় প্রতিটি প্রশ্নপত্রে দুজন প্রশ্নকর্তা, একজন সায়েন্স কলেজের, একজন প্রেসিডেন্সির। তড়িৎ ও চৌম্বকবিদ্যার ওপর দুটো আবশ্যিক তাত্ত্বিক পত্র ছিল। প্রথম পত্রে প্রশ্ন করেছিলেন সুশীল আচার্য ও প্রেসিডেন্সির ডি বি মীক। দ্বিতীয় পত্রে প্রেসিডেন্সির ডবলু এ জেঙ্কিন্স ও অবিনাশ সাহা। এই পত্রে তেজস্ক্রিয়তা এবং এক্স-রশ্মির ওপরে প্রশ্ন ছিল। এমনকি নিকেলের নিজস্ব এক্স-রশ্মি রেখার ওপরে প্রশ্ন দেখতে পাই; তার মাত্র পাঁচ বছর আগে এই বিষয়ে মোজলের সাড়া জাগানো কাজ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটিশ পদার্থবিদ হেনরি মোজলে ১৯১৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্যালিপোলির রণাঙ্গনে নিহত হন, নইলে নোবেল প্রায় অবশ্যম্ভাবী ছিল।
তৃতীয় ও চতুর্থ পত্র, আগেই বলেছি, ছিল ঐচ্ছিক। তিনটে গ্রুপ ছিল। প্রথম গ্রুপে ছিল পদার্থের ধর্ম (প্রশ্নকর্তা — সুধাংশু ব্যানার্জি ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু; যতদূর জানা যায় এটিই সত্যেন্দ্রনাথের করা প্রথম প্রশ্নপত্র) ও স্বনবিদ্যা (যোগেশ মুখার্জি ও প্রেসিডেন্সির চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য)। সনাতনী বলবিদ্যা পদার্থের ধর্মের আওতায় পড়ত। দ্বিতীয় গ্রুপ ছিল আলোকবিদ্যার ওপর (তৃতীয় পত্রে ফণীন্দ্রনাথ ও প্রেসিডেন্সি থেকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, চতুর্থ পত্রে শিশির মিত্র ও প্রেসিডেন্সির দ্বিজেন মজুমদার)। চতুর্থ পত্রে ছিল বর্ণালীবিজ্ঞান বা স্পেকট্রোস্কোপি এবং আপেক্ষিক তত্ত্ব (বিশেষ, কারণ তখনো সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ওপর ইংরেজিতে কোনো বই ছিল না)। এখানে যেমন সূর্যের বর্ণালী থেকে কীভাবে সূর্যের উষ্ণতা মাপা যায়, তার ওপর প্রশ্ন আছে, তেমনি আছে আপেক্ষিকতাবাদের ওপর রচনা লিখতে দেবার মত গৎবাঁধা প্রশ্ন।
তৃতীয় গ্রুপে ছিল তাপ ও তাপগতিবিদ্যা। তৃতীয় পত্রের প্রশ্নকর্তা ছিলেন রামন এবং প্রেসিডেন্সির সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, আর চতুর্থ পত্রে মেঘনাদ ও প্রেসিডেন্সির গণিত বিভাগের দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক।
১৯২১ থেকে ধাঁচ একটু পালটাল। কয়েকটি পত্রে দেখি মাত্র একজনই প্রশ্নকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বা কখনো প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। রাদারফোর্ডের বিখ্যাত আলফা-কণা পরীক্ষা থেকে প্রশ্ন এসেছে; গাইগার ও মার্সডেনের পরীক্ষা এবং রাদারফোর্ডের বিশ্লেষণ, যার থেকে আধুনিক পরমাণু মডেলের সূত্রপাত, তার বয়স তখন মাত্র দশ বছর।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তখনো জন্ম হয়নি, পুরনো কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগ সেটা, যার ভিত্তিস্তম্ভস্বরূপ চারটি প্রবন্ধের তিনটি ইতিমধ্যেই প্রকাশিত (ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন, ও নিলস বোরের কলমে), চতুর্থটি কিছুদিন বাদে লিখবেন সত্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু মহাকর্ষের আধুনিক তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ জন্ম নিয়েছে, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী সার আর্থার এডিংটন পরীক্ষা করে তার সত্যতা প্রমাণ করেছেন। পরের বছর কলকাতার দুই তরুণ, মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন ও হেরমান মিনকভস্কির লেখা আপেক্ষিকতাবাদের মূল কয়েকটি প্রবন্ধ জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বই হিসেবে প্রকাশ করলেন। এর সঙ্গে আইনস্টাইনের সংক্ষিপ্ত একটি জীবনীও লিখেছিলেন মেঘনাদ, বইয়ের ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় (সম্প্রতি আরেকবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, উৎসাহীরা চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন)। আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত প্রবন্ধের এই প্রথম ইংরেজি অনুবাদ, বইটি সব অর্থেই ঐতিহাসিক। পাঠ্যবই হিসেবে এটি অনুসরণ করা শুরু হয় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই। (এখানে একটি স্বল্পজ্ঞাত তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে — ১৯১০ সালে গণেশ প্রসাদ ক্যালকাটা ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটির বুলেটিনে “স্পেস অ্যান্ড টাইম” নামে মিনকভস্কির একটি জার্মান প্রবন্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।) ১৯২১ সালে প্রশান্তচন্দ্র সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ওপর প্রশ্ন দিয়েছেন দেখতে পাই, এমনকি তার পরীক্ষামূলক প্রমাণও, যা হয়েছে মাত্র দু বছর আগে। আজকাল হয়তো এ জিনিস ভাবাও কষ্টসাধ্য। আমাদের এই পূর্বসূরীরা নতুন পথ কেটেছিলেন, তাঁদের সাহসের অভাব ছিল না।
তিনটে গ্রুপ তখনো ছিল, সত্যেন্দ্রনাথ পদার্থের ধর্ম ও স্বনবিদ্যা বিষয়ে প্রশ্ন করতেন, যদিও সেখানে প্রায় সবই উনিশ শতকের বিজ্ঞান। আলোকবিদ্যা বিভাগে প্রশ্নকর্তা হিসেবে এলেন বিধুভূষণ রায়, দেবেন্দ্রমোহন প্রশ্ন রাখছেন বোরের পরমাণু মডেলের ওপর, ব্রজেন্দ্রনাথ জানতে চাইছেন জীম্যান ক্রিয়া এবং জ্যোতির্বিদ্যায় তার প্রয়োগ নিয়ে। তাপগতিতত্ত্বে সত্যেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করছেন কঠিনের আপেক্ষিক তাপের আইনস্টাইন ও ডিবাই মডেল থেকে; ডিবাই মডেলের বয়েস তখনো দশ বছরও হয়নি। অনুমান করা অন্যায় নয় যে এখান থেকেই সত্যেন্দ্রনাথের মাথায় প্লাঙ্কের কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের সূত্রকে অন্যভাবে দেখার ভাবনা অঙ্কুরিত হয়। এক্স-রশ্মি সেই সময়ের হট টপিক, তার থেকে প্রচুর প্রশ্ন আসত। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও পুরনো কোয়ান্টাম তত্ত্বও একইরকম গুরুত্ব পেত। নতুন ধারণা ও তার পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পর্কে নিয়মিত পড়ানো হত, সে যুগের ইউরোপের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে খুব একটা তফাৎ ছিল না। অবশ্য যারা পড়তেন, তাঁরা কতটা নিতে পারতেন, সে প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ বেশির ভাগই গবেষণার জগতে খুব একটা কৃতবিদ্য হননি।
এর পরে খুব বিশদে গিয়ে আর লাভ নেই, মূল কথাটা আপনারা বুঝতে পেরেছেন, পড়ানো বা গবেষণার দিক থেকে সদ্যগঠিত বিভাগটি প্রথম বিশ্বের থেকে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। প্রথম পর্বে “The Dazzling Dawn” বলে যে বইটির কথা বলেছি, তাতে প্রশ্নপত্রের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যাবে, আমরা এখানে আর অল্প কিছু কথা বলেই এই পর্বের ইতি টানব।
১৯২৪ থেকে আলোকবিদ্যার ঐচ্ছিক পত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্যে একটা আলাদা ভাগ থাকত। আবশ্যক পত্রে ইলেকট্রন থিওরি বলে একটা ভাগের দেখা পাই, এখানে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া পর্যন্ত আধুনিক পদার্থবিদ্যার অনেক জিনিস থেকেই প্রশ্ন আসত। ১৯২৬ সালে প্রথম সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের থেকে একটি গাণিতিক প্রশ্নের দেখা মেলে — শোয়ার্ৎসশিল্ট জ্যামিতিতে আলোর গতিপথের বিচ্যুতি বের করার।
১৯২৭ সালে প্রথম ফলিত পদার্থবিদ্যার জন্যে আলাদা প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাগটি চালু হয় ১৯৩০ সালে। তখন থেকে পদার্থবিদ্যা নাম পাল্টে হয়ে যায় বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা বা পিওর ফিজিক্স, দীর্ঘকাল এই নাম চলেছিল।
মাঝে কিছুদিন প্রশ্নকর্তাদের নাম দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ১৯২৯ থেকে আবার এই প্রথা ফিরে আসে। ১৯৩০ সালে দেখি, আপেক্ষিকতাবাদ অংশের প্রশ্ন করছেন সত্যেন্দ্রনাথ ও প্রশান্ত মহলানবিশ। সত্যেন্দ্রনাথ তখন ঢাকায়, সুতরাং অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে প্রশান্তচন্দ্র একাই আপেক্ষিকতাবাদ পড়িয়েছিলেন, প্রেসিডেন্সি ও বিজ্ঞান কলেজের ছাত্রদের একসঙ্গে। এখানে দেখি পাঁচ মাত্রার দেশকাল বা কালুজা-ক্লাইন তত্ত্বের থেকে প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে, যা আজও ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান স্নাতকোত্তরে দেবার সাহস দেখাবে না। তখন এই তত্ত্বের বয়েস মাত্র চার বছর (এবং পাঠ্যবইতে জায়গা পাবার প্রশ্নই নেই), কিন্তু আইনস্টাইনের একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্বের প্রথম ধাপ হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পরে অবশ্য তত্ত্বটিতে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে, আইনস্টাইনের স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৩১ সালে মেঘনাদের তাপীয় আয়নন তত্ত্ব প্রশ্নপত্রে জায়গা পেল, আবিষ্কারের এগারো বছর পরে। সেই বছরেই উইলসনের মেঘকক্ষ নিয়ে প্রশ্ন রাখলেন এক্সটার্নাল পরীক্ষক কে এস কৃষ্ণন। বর্ণালীবিদ্যা অংশে রামন বিক্ষেপের ওপর প্রশ্ন এলো। আপেক্ষিকতাবাদী কোয়ান্টাম বলবিদ্যাও প্রথম দেখা দিল। কিন্তু আসল চমক ইলেকট্রন থিওরির প্রশ্নপত্রে — প্রশ্নকর্তা সার সি ভি রামন, নাইট, এম এ, ডিএসসি, পিএইচডি, এফ আর এস, নোবেল লরিয়েট, এবং মেঘনাথ সাহা (বিশ্ববিদ্যালয় এই বানানই ব্যবহার করেছিল, মেঘনাদ নিজে তা ত্যাগ করা সত্ত্বেও), ডিএসসি, এফ আর এস। এঁদের বিরোধিতা তখন প্রবাদে পর্যবসিত, কিন্তু পেশাগত জায়গায় সেই বিরোধকে এঁরা টেনে আনেননি। সে বছরেই বেরোয় তাপ ও তাপগতিতত্ত্বের ওপর লেখা মেঘনাদ ও তাঁর ছাত্র শ্রীবাস্তবের বিখ্যাত বই “এ ট্রিটিজ অন হিট”, বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন রামন।
১৯৩২ সালে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ওপর প্রশ্ন এলো, বসু-আইনস্টাইন ও ফের্মি-ডিরাক। রামন এফেক্ট নাম ব্যবহার করে প্রশ্ন করলেন রামন, শিশির মিত্র ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। দেখা মিলল পাউলি অপবর্জন নীতির। সত্যেন্দ্রনাথ ও প্রশান্তচন্দ্র লেমাৎরের প্রসারণশীল মহাবিশ্বের কথা জানতে চাইলেন। মনে রাখতে হবে, লেমাৎরের তত্ত্বের বয়স তখন পাঁচ বছর, এবং মূল প্রবন্ধগুলি ফরাসিতে লেখা।
এখানেই শেষ করা যাক, কারণ এরপর আস্তে আস্তে পাঠ্যবই চলে এলো, পঠনপাঠন ও প্রশ্নও পাঠ্যবইভিত্তিক ও গতানুগতিক হতে শুরু করল। যে উৎসাহ, সাহস, ও স্বপ্ন নিয়ে একদল তরুণ যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাও স্তিমিত হয়ে এলো। গবেষণার ক্ষেত্রেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের ব্যবধানটাও দিনের পর দিন বেড়েই চলল। কিন্তু সে গল্পের স্থান এটা নয়।
সহায়ক গ্রন্থঃ
The Dazzling Dawn: Physics Department of Calcutta University (1916-1936), Gautam Gangopadhyay, Anirban Kundu and Rajinder Singh, Shaker Verlag (2021) – এখানে অবশ্য শুধু প্রথম কুড়ি বছরের কথা পাওয়া যাবে।
এছাড়া যে সমস্ত বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে Hundred Years of the University of Calcutta, University of Calcutta (1957) উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে বিশেষ করে নীহাররঞ্জন রায় ও প্রমথনাথ ব্যানার্জির প্রবন্ধ দুটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
খুব তথ্য সমৃদ্ধ আর্টিকেল। পড়ে আনন্দ পেলাম।
সংগ্রহে রাখার মত সুন্দর একটি প্রবন্ধ ।
ইতিহাস বিষয়ক লেখায় হয়তো একজন লেখক থাকাই প্রথা। একাধিক থাকলে একজন প্রধান, বাকিরা সহযোগী। ঠিক জানি না কেন দুজন লেখকের নামই একসঙ্গে দেওয়া যায়নি। তবে এই লেখাটির জন্যে গবেষণা ও পরিশ্রমের সিংহভাগই অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায়ের, একথা স্বীকার না করলে অনৃতকথন হয়।
অনেক কিছু জানলাম, ভাল লেখা।
অভিনন্দন অনির্বাণ, গৌতম। বিপুল পরিশ্রমসাধ্য এবং তথ্যনিষ্ঠ এই লেখাটি সংগ্রহে রাখার মত।
প্রচুর তথ্য সহ সুন্দর গবেষণামূলক একটি লেখা, সাধুবাদ জানাই এই প্রচেষ্টার জন্য!
গৌতম ও অনির্বাণ কে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্ স্বাধীনতা পর্বের স্মরণীয় শিক্ষক ও বিজ্ঞানীদের অসামান্য অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য। আমার একটি ই অনুরোধ – এই ধরনের তথ্য সমৃদ্ধ ও সুললিত গদ্যে রচিত প্রবন্ধটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সীমাবদ্ধ না রেখে পুস্তিকাকারে ছাপানো হোক্ যাতে বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি মাত্রেই তা পাঠ করতে পারে।
অসাধারণ একটি লেখা। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। অনেক ধন্যবাদ প্রফেসর অনির্বাণ কুণ্ডু ও প্রফেসর গৌতম গাঙ্গুলীকে যাঁরা আমার গবেষণাকালে আদর্শস্থানীয় ছিলেন। বছর কয়েক আগে CU Physics 100 শীর্ষক এক আলোচনাসভায় এই বিষয়ে কিছু ধারণা হয়েছিল কিন্তু পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম দিকের উত্তরণের ইতিহাস এই সকল আঙ্গিক থেকে – এমন লিখিত বিস্তারিত বিবরণ আগে পড়ি নি। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
লেখকদের দারুণ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। বুঝতে পারছি এই লেখার রসদ জোগাড় করতে ওনাদের কতটা সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করতে হয়েছে। আমাদের সম্রিদ্ধ করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সমৃদ্ধ করার জন্য
আমি অধ্যাপক চিনির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সেই বইটিতে সেসময়ে প্রকাশিত কিছু পেপার আর কয়েকটি প্রশ্নপত্র থাকলে খুবই ভাল হবে।
বহুদিন পর এরকম লেখা পড়লাম। অনির্বাণ আর গৌতমকে অনেক ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানাই। আমরা যখন স্নাতকোত্তর ছাত্র তখন আবার তিন কিংবদন্তী পদার্থবিদের কাছে শিক্ষালাভের অশেষ সৌভাগ্য হয়েছিল। তাঁরা হলেন অমলকুমার রায়চৌধুরী, বিনায়ক দত্তরায় এবং চঞ্চলকুমার মজুমদার। এঁদের স্মৃতিবিজড়িত একটি লেখার ইচ্ছা আছে।
খুবই তথ্যসমৃদ্ধ সাবলীল লেখা।অত্যন্ত পরিশ্রম ও যত্ন নিয়ে যে লেখা,সে কথা বলাই বাহুল্য।রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে গর্ব অনুভব করছি। এই লেখা সংগ্রহে রাখার মতো।লেখকদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন,ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।
অনেক কিছু জানলাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর পদার্থবিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযূগ নিয়ে।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের প্রাক্তনী হওয়ার অনুভূতি সত্যিই বিশেষভাবে আলাদা। অনেক ধন্যবাদ প্রণম্য লেখকদের এই ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
খুব ভালো, প্রয়োজনীয় লেখা
অসাধারণ ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। সামগ্রিক ভাবে লেখাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের এক গভীর বিশ্লেষণ। সত্যি কথা বলতে কি, এতটা জানতাম না। ঋদ্ধ হলাম। লেখাটি পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে যেন আরও বেশি গর্বিত বোধ করছি। লেখাটি এককথায় অনবদ্য। অনির্বাণ ও গৌতমকে সাধুবাদ জানাই এত সুন্দর একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করার জন্য।