প্রাক স্বাধীনতা যুগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগ — শেষের কথা
(এই প্রবন্ধের সহলেখক হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়। অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায়ের গবেষণার বিষয় নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিপদার্থবিদ্যা। অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমানে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী।তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দুটি ছোট জীবনী, নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারীদের অবদান নিয়ে লেখা ‘তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ’ এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন ‘বিজ্ঞানীর বিবেক’)
(১)
বিভাগের ইতিহাসে আরো কিছু ব্যক্তিত্ব
স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইতিহাসে আরো অনেক ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনকে আমরা ভুলে গেছি, কয়েকজনকে হয়তো মনে রেখেছি। তাঁরা সবাই কিন্তু ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ নন। এ কথা অনস্বীকার্য যে রামন, মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথের মতো মৌলিক অবদান তাঁরা বিজ্ঞানে রাখেননি; কিন্তু আজকে দেশের প্রায় যে কোনো বিজ্ঞানীর থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচিতি মোটেই কম ছিল না। সব থেকে বড় কথা হল এঁদের প্রত্যেককেই নিজেদের গবেষণাগার একেবারে গোড়া থেকে তৈরি করতে হয়েছিল, দেশে তাঁদের পথ দেখানোর মতো বিজ্ঞানী বিশেষ কেউ ছিলেন না। আমাদের লেখাতে আগে বিভাগের এই সমস্ত ব্যক্তিত্বের নাম এসেছে, এই পর্বে আমরা তাঁদের কাজের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় রাখব। তবে শুরু করব এমন একজনের কথা দিয়ে যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো পড়ানোর সুযোগ পাননি।
শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী, তিনি পদার্থবিদ্যার ছাত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীনই তিনি প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। এমএসসিতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন, আশুতোষ তাঁর মারফতই মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথকে ডেকে বিজ্ঞান কলেজে ক্লাস নিতে বলেছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথের উপরে পড়েছিল গবেষণাগার তৈরির ভার। আশুতোষের উৎসাহেই শৈলেনকে তিন বছরের জন্য আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পালিত ফরেন ফেলোশিপ দেওয়ার কথা স্থির হয়। কিন্তু যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে এক পুলিশ অফিসার এসে শৈলেনের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে দেশ না ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শৈলেন্দ্রনাথ গোপনে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি ছিলেন বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। তিনি বুঝলেন পুলিস সেটা জানতে পেরেছে। কলকাতায় তাঁর পুরানো বাসাতে তল্লাশি চালানো হয় ও পুলিশের সঙ্গে দেখা করার কথা বলা হয়। বিজ্ঞান কলেজেও তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিস আসে। আশুতোষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তিনি চলছিলেন, তাই পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে তিনি উপদেশের জন্য আবার আশুতোষের কাছে যান। আশুতোষ তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করেন। শৈলেন পালিয়ে বিপ্লবীদের দলে যোগ দেন। কয়েকমাস পরে তিনি গোপনে আশুতোষের সঙ্গে আবার দেখা করে জানতে পারেন পুলিস তাঁকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তিনি তখন নাম ভাঁড়িয়ে জাহাজের খালাসির চাকরি নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এর পর আর তাঁর যোগাযোগ হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো থেকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোগিতা করেছিলেন, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, কয়েকবছর কারাবাসও করেছিলেন। এর পর শৈলেন্দ্রনাথের সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তিনি সাধারণ ক্ষমা বা জেনারেল পার্ডনের সুযোগ নিয়ে ১৯৩৫-৩৬ নাগাদ দেশে ফিরে আসেন। প্রথমে কলকাতা কর্পোরেশনের শিক্ষা অফিসার নিযুক্ত হন, পরে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা। তারপর চার বছর ঢাকা জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি হয়েছিলেন। সেখানেই ১৯৪৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়।
দেবেন্দ্রমোহন বসু বা ডি এম বোসের কথাও আমাদের লেখাতে কয়েকবার এসেছে। আমরা দেখেছি যে তিনিই প্রথম অধ্যাপক হিসাবে বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু গবেষণার কাজে জার্মানিতে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য আটকে যান। ১৯১৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন, সঙ্গে করে এনেছিলেন জার্মান ভাষাতে লেখা আধুনিক কয়েকটি বই। বিশেষ করে সত্যেন্দ্রনাথ এ থেকে উপকৃত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের তাপগতিতত্ত্ব বইটি তিনি ডি এম বোসের কাছে পেয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণা করেছেন যে তিনি একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যা ও জার্মান ভাষা শেখার জন্য বইটি অনুবাদ করে ডি এম বোসকে শোনাতেন। পরে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গবেষণার মূল এই বইতেই নিহিত আছে।
দেবেন্দ্রমোহনের সেটাই প্রথম বিদেশযাত্রা ছিল না, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এমএসসি করার পরে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন এবং সেখানে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসন ও ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষের আবিষ্কর্তা সি টি আর উইলসনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। এই দু’জনেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছিলেন। জার্মানিতেও তিনি মেঘকক্ষ ব্যবহার করে মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৯২৩ সালে দেবেন্দ্রমোহন এদেশে বসে প্রথম মেঘকক্ষ তৈরি করেন। প্রথমদিকে মেঘকক্ষ দিয়ে দেবেন্দ্রমোহন আলফা কণার গতিপথ দেখতেন। কিছুদিন বাদে একটা অদ্ভুত রকম পথের ছবি তুলে তিনি আর্নেস্ট রাদারফোর্ডকে পাঠান। দেবেন্দ্রমোহনের মত ছিল, এটা আলফা কণার আঘাতে বাতাসের নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন অণুর দুটি পরমাণুতে টুকরো হয়ে যাবার ছবি, রাদারফোর্ডও এই মত সমর্থন করেছিলেন। ঘোষ অধ্যাপকের গবেষণাগারে দেবেন্দ্রমোহন পদার্থের চৌম্বকধর্ম ও অন্যান্য ধর্ম নিয়ে অত্যন্ত উচ্চশ্রেণীর গবেষণা করেছিলেন, এখনকার দিনে যাকে আমরা সলিড স্টেট ফিজিক্স বলে থাকি। বিশেষ করে চৌম্বকধর্ম বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ, এ বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা রামনও লিখে গেছেন। দেবেন্দ্রমোহন কোনো কোনো পদার্থের চৌম্বক ধর্মের সঙ্গে তার পরমাণুদের ইলেকট্রন বিন্যাসের একটি সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে আমেরিকান বৈজ্ঞানিক লার্স ওয়েলোও এই সম্পর্ক আবিষ্কার করেন, তাই এটি ওয়েলো-বোস নিয়ম নামে পরিচিতি পেয়েছিল। আজকাল অবশ্য আমরা আর এভাবে চৌম্বকধর্ম বের করি না, কিন্তু তখন সারা পৃথিবীতেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হত।
দেবেন্দ্রমোহন ছিলেন জগদীশচন্দ্রের ভাগনে, মামার মৃত্যুর পরে ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেন। যদিও এই লেখা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর, কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজটি (এবং তাঁর শেষ উল্লেখযোগ্য কাজ) বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বসেই করা, সে কাজের কথা অন্তত উল্লেখ না করলে তাঁকে নিয়ে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিভা চৌধুরীর নাম আগে আপনারা পেয়েছেন, পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় ছাত্রী হিসেবে। তিনি দেবেন্দ্রমোহনের সঙ্গে গবেষণা শুরু করেন। তাঁরা দুজনে মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে পাই মেসন কণা আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াতে তাঁরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাননি, ফলে তাঁদের গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যুদ্ধের পরে ব্রিস্টলে সিসিল পাওয়েল মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে পাই মেসনকে নিশ্চিত করে সনাক্ত করেন ও নোবেল পুরস্কার পান।
আমরা দেখেছি যে একদম প্রথম শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনি রামনের কাছে গবেষণা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছিলেন; সেই সময়েই তাঁর গবেষণা উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল। রাসবিহারী ঘোষ ১৯২০ সালে ফলিত রসায়ন ও ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে দুটি অধ্যাপক পদ তৈরির জন্য আরো এগারো লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। ডক্টরেট লাভের পর ফণীন্দ্রনাথ ফলিত পদার্থবিদ্যা বা অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স বিভাগের সেই অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি দু বছরের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন পরীক্ষাগারে কাজ করেছিলেন, ফিরে এসে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। সেই সময় থেকেই অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স বিভাগ শুরু হয়েছিল ধরে নেওয়া যায়, অবশ্য কাগজে কলমে তাকে পৃথক বিভাগ হিসাবে স্বীকার করা হয় ১৯৩০ সালে। সেই বছর থেকে পুরানো বিভাগটিকে পিওর ফিজিক্স নামে অভিহিত করা হয়; সেই নাম বহুদিন চালু ছিল। ফণীন্দ্রনাথ মলিকিউলার স্পেকট্রোস্কোপি বা অণুর বর্ণালীবীক্ষণ বিষয়ে গবেষণা করতেন, সেই সময়ে এশিয়াতে এই বিষয়ে তাঁর ল্যাবরেটরির কোনো সমকক্ষ ছিল না।
রামন, মেঘনাদ এবং সত্যেন্দ্রনাথ ছাড়া বিভাগের আরো একজন অধ্যাপক রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হয়েছিলেন, তিনি শিশিরকুমার মিত্র। তিনি প্রথমে পালিত ও পরে ঘোষ গবেষণাবৃত্তি পেয়েছিলেন এবং বিভাগে ক্লাস শুরু হলে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। রামনের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে তিনি ১৯১৯ সালে ডিএসসি ডিগ্রি পেয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে মেঘনাদ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে শিশিরকুমারকে খয়রা অধ্যাপকের শূন্য পদে নিয়োগ করা হয়, এর পর ১৯৩৪ সালে তিনি হয়েছিলেন ঘোষ অধ্যাপক। ১৯২০ সালে তিনি ফ্রান্সে যান; সেখানে তিনি মাদাম কুরির ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছিলেন। ফ্রান্সে থাকাকালীন তিনি বেতার বা রেডিও বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, আমাদের দেশে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বায়ুমণ্ডলের উচ্চস্তর, বিশেষ করে আয়নমণ্ডল বিষয়ে গবেষণাতে তিনি পথিকৃৎ। তাঁর ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরি থেকে পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগটি তৈরি হয়, সেই সম্পর্কে দু-একটি কথা পরে আসবে। তিনি এবং তাঁর ছাত্র, পরে বিভাগের শিক্ষক, হৃষিকেশ রক্ষিত কলকাতার প্রথম রেডিও ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। এছাড়া বায়ুমণ্ডলের অ্যাকটিভ নাইট্রোজেন বিষয়ে গবেষণাতে তিনি পৃথিবীতে পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম। শিশিরকুমারের চেষ্টাতে স্বাধীনতার ঠিক আগে তৈরি হয়েছিল রেডিও রিসার্চ বোর্ড, তিনি হয়েছিলেন তার প্রধান। এই সুবাদে সরকারী সাহায্যে রেডিওফিজিক্স ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের নতুন বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। শিশিরকুমার ১৯৫৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হয়েছিলেন, চাঁদের বুকে মিত্র গহ্বরটির নাম তাঁর নামেই দেওয়া হয়েছে।
শিশিরকুমার সাধারণের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত হলেও বিজ্ঞানীমহলে যথেষ্টই বিখ্যাত। এই পর্যায়ের শেষে যে অধ্যাপকের কথা বলব, সেই বিধুভূষণ রায় এখন বিজ্ঞানীদের মধ্যেও প্রায় বিস্মৃত। কিন্তু এই অন্ধকার একেবারেই তাঁর প্রাপ্য নয়। সেই কারণেই তাঁর সম্পর্কে একটু বিস্তৃত আকারে আলোচনা করা যাক।
বিধুভূষণের গবেষণাজীবন যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল, এবং এ দেশে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণের চর্চা তাঁর হাতেই শুরু হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়, সেই সময়ে তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের খয়রা অধ্যাপক ছিলেন, এবং এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণ বিষয়ে ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। ১৯১৮ সালে রামনের গবেষণাগারে ছাত্র হিসাবে যোগ দেন বিধুভূষণ। প্রথমে পেতেন মাসিক ৫০ টাকা। কিন্তু তাঁর কাজে রামন এতই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে এক বছরের মধ্যেই রামনের সুপারিশের ফলে তাঁর মাসিক বেতন ১০০ টাকা হয়। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হল “অপটিকাল অ্যানালগ অফ হুইস্পারিং গ্যালারি”। আগে একবার এই কাজটির উল্লেখ করা হয়েছে, রামনের বার্ষিক রিপোর্ট প্রসঙ্গে। হুইস্পারিং গ্যালারি কী, সেটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্থপতি সার ক্রিস্টোফার রেনের হাতে তৈরি হয়েছিল লন্ডনের অন্যতম প্রতীক নতুন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। পুরনো ক্যাথিড্রালটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যাবার পর সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে নতুন ক্যাথিড্রালের কাজ শুরু হয়। ক্যাথিড্রালের মূল কক্ষটি উপবৃত্তাকার, মাথায় গম্বুজ। এখানে দেওয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বললে ঘরের অন্যপ্রান্তে শোনা যায়। শব্দতরঙ্গ দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছে যায় অন্য প্রান্তের দেওয়ালে, তাই এর নাম হুইস্পারিং গ্যালারি। কিন্তু হুইস্পারিং গ্যালারির উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে, আর তার বয়েসও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের চেয়ে কিছু বেশি। এটি বানিয়েছিলেন বিজাপুরের সুলতান মহম্মদ আদিল শাহ, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। স্থাপত্যটির নাম গোল গম্বুজ, আদিল শাহ এখানেই শায়িত আছেন। গোল গম্বুজের ভেতরেও দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শব্দ প্রতিফলিত হয়, দেওয়াল অবতল আয়নার কাজ করে। আর হুইস্পারিং গ্যালারির সন্ধানে অতদূর যদি আপনার যেতে ইচ্ছে না করে, কলকাতা ময়দানে তুলনায় অনেক অর্বাচীন ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি তো আছেই।
বিধুভূষণ দেখতে চেয়েছিলেন, শব্দের ক্ষেত্রে যেরকম, আলোর ক্ষেত্রেও তা ঘটে কি না। তিনি দেখলেন, আলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই জিনিস ঘটছে। পরে রামন স্বয়ং এ বিষয়ে আরো অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। যে কারণে এই গবেষণাটি উল্লেখযোগ্য, তা হল এখান থেকেই রামনের আলোকবিজ্ঞানে উৎসাহের শুরু। স্বনবিদ্যা থেকে তিনি আস্তে আস্তে আলোকবিজ্ঞানের দিকে সরে এলেন, তাঁর ছাত্ররাও এলো। বিধুভূষণ রামনের গবেষণাগারে কাজ করেই ডিএসসি পান।
ডিএসসি করার পর ১৯২৩ সালে বিধুভূষণ প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ গবেষক বৃত্তি পেলেন। তাছাড়াও পালিত ফান্ড থেকে বিদেশযাত্রার জন্যে বৃত্তি পেলেন, বার্ষিক ৫০০০ টাকা হিসেবে দু বছরের জন্য। কিন্তু পালিত ট্রাস্টের নিয়মানুযায়ী তাঁকে দশ হাজার টাকার বন্ড দিতে হত। সাধারণ ঘরের একজন ছাত্রের পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব, তাই বিধুভূষণ এই শর্তে রাজি হলেন যে ফিরে এসে তিনি অন্তত পাঁচ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবেন। আমরা এক্ষুনি দেখব যে এই শর্তটা বিধুভূষণের ক্ষেত্রে উপকারী হয়নি।
রামন পরামর্শ দিয়েছিলেন নিলস বোরের কাছে যেতে। বিধুভূষণ বোরকে তাঁর প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধের কপি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে বোর আমেরিকায়, তিনি বিধুভূষণকে বললেন পরের বছর আসতে। বিধুভূষণ তাই প্রথমে গেলেন সুইডেনের উপসালায়, সেখানে এক বছর মানে সিগবানের সঙ্গে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণ নিয়ে কাজ করলেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ কাটালেন বোরের সঙ্গে, কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইন্সটিটিউট অফ থিওরেটিকাল ফিজিক্সে। এক্স-রশ্মি বিষয়ে বিধুভূষণের আগ্রহ ও গবেষণার শুরু উপসালা ও কোপেনহাগেনে।
১৯২৬ সালে বিধুভূষণ কলকাতায় ফিরলেন, সঙ্গে স্বয়ং বোরের জোরালো সুপারিশপত্র। বোর লিখেছেন এক্স-রশ্মি বিষয়ে এই ভারতীয় তরুণটির পাণ্ডিত্যের কথা। একখানা নয়, বোর তিন তিনখানা চিঠি লিখেছিলেন, বিধুভুষণের প্রশংসা করে। ভাবলে অবাক হতে হয়, নিলস বোরের মত বিজ্ঞানীর সুপারিশপত্র থাকা সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধুভূষণ নিজের ল্যাবরেটরি বানাবার জায়গা পেলেন না। চেয়ার অধ্যাপক ছাড়া আর কারো নিজস্ব গবেষণাগার থাকতে পারে, এই ধারণাটাই তখন ছিল না। হয়তো এই সময় থেকেই রামনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তাঁর স্বাস্থ্যও এই সময় থেকেই ভাঙতে শুরু করে।
পরের বছর বিধুভূষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডারের পদে মনোনীত হন। মাসিক বেতন ৬০০ টাকা, কলকাতায় পেতেন ৩৭৫। স্বভাবতই বিধুভূষণ চলে যেতে চাইলেন, কলকাতায় দু বছর বিনা বেতনে ছুটি চাইলেন। কিন্তু সেই যে বিদেশ যাবার সময়ে বন্ড দিয়েছিলেন, তার ফলে কলকাতা ছাড়া আটকে গেল। ঢাকায় চলে গেলে বিধুভূষণ শুধু যে মাইনে বেশি পেতেন তাইই নয়, কাজও হয়তো অনেক ভালো করতে পারতেন। তখন সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন, সদ্য ইউরোপ থেকে ফিরেছেন, এক্স-রশ্মি নিয়ে তাঁরও আগ্রহ ছিল। তাছাড়া, কলকাতায় পদে পদে যে সব বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তার থেকেও মুক্তি পেতেন। অনেক দর কষাকষির পর কলকাতা বিধুভূষণের মাইনে ৫০ টাকা বাড়াতে রাজি হল, তাও ফলিত গণিত বিভাগে একটা পদ খালি ছিল, সেই বাবদ যে টাকা বেঁচে যাচ্ছিল, তার সুবাদে।
এক্স-রশ্মি দিয়ে রামন বিক্ষেপ দেখার কথা আগে বলছিলাম। বিধুভূষণ ১৯৩০ সালে এই বিক্ষেপ দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, তিনি এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সামান্য বেড়ে যাওয়া (অর্থাৎ ফোটনের শক্তি সামান্য কমে যাওয়া) ধরতে পেরেছেন। ইউরোপ বা আমেরিকার বিজ্ঞানীরা কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন না, তাঁরা বললেন যে সেরকম কোনো চিহ্ন তাঁরা দেখতে পাননি। বিধুভূষণ তাঁর কাজের ফলাফল নিলস বোরকেও পাঠিয়েছিলেন, তবে যতদূর জানা যায়, বোরের থেকে কোনো জবাব আসেনি। শেষে সমারফেল্ড এই বিতর্কের ইতি টানেন। তিনি দেখান যে বিধুভূষণ সত্যিই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন দেখেছেন, তাঁর পরীক্ষায় ভুল নেই, কিন্তু তার প্রকৃত রূপটা চিনতে ভুল করেছেন। আসলে যেটা দেখেছিলেন সেটা, কৃষ্ণনেরই মতো, কম্পটন বিক্ষেপের অংশ, রামন বিক্ষেপ নয়। তবে বিজ্ঞানে এ রকম হয়েই থাকে, তাতে করে বিধুভূষণের কৃতিত্ব খাটো হয় না। ভারতে এক্স-রশ্মি বর্ণালীবীক্ষণের পথিকৃৎ যে বিধুভূষণ, তাতে কোনো দ্বিমত নেই।
এই সময়ে বিধুভূষণের দুটি তাত্ত্বিক কাজও আছে – তার একটি মেঘনাদ সাহার সঙ্গে – তার কারণ পরীক্ষামূলক কাজের জন্যে যথেষ্ট সাহায্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাচ্ছিলেন না, আর্থিক সহায়তার আবেদন নামঞ্জুর হয়েছিল। বাধ্য হয়েই তাঁকে তাত্ত্বিক কাজের দিকে মন দিতে হয়। ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার ইউরোপ থেকে ফেরার পর পরিস্থিতি কিছুটা পালটাল। ১৯৩৫ সালে শিশির মিত্র ঘোষ অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেন, ফলে খয়রা অধ্যাপক পদটি ফাঁকা হল। বিধুভূষণ সেই পদে নিযুক্ত হলেন। মাসিক বেতন বেড়ে হল ৭৫০ টাকা। এবার তিনি নিজের গবেষণাগার বানাবার দিকে মন দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০০০ টাকা অনুদানও পেলেন।সে যুগের তুলনায় তাঁর গবেষণাগারটিও ছিল অত্যন্ত আধুনিক।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিধুভূষণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। ১৯৪৪ সালে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে বিধুভূষণের জীবনাবসান হয়। বিধুভূষণ তাঁর অনেক সহকর্মীর মত অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বিষয়ে তিনি এ দেশে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে সম্মানটুকু তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য, ভুলে যাওয়ার মত ব্যক্তিত্ব তিনি নন। তাঁর মৃত্যুর পর খয়রা অধ্যাপক হিসেবে ফিরে এসে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর গবেষণাগারটি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন। কমলাক্ষ দাসগুপ্তের যে কাজের কথা আগে বলেছিলাম, বিধুভূষণের সাজানো গবেষণাগার না পেলে তা হয়তো সম্ভব হত না। কিন্তু ইতিহাস যে পার্শ্বচরিত্রদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন। সম্প্রতি রাজিন্দর সিং তাঁর বেশ কয়েকটি বইতে এই চরিত্রদের সম্পর্কে আলোকপাত করছেন।
(২)
স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
এর আগের পর্বগুলিতে আমরা দেখেছি এক নতুন বিভাগ কিভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাতে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে শুরু করেছিল। প্রথম দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই এই আশা জেগেছিল যে বিভাগে গবেষণার যে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে, তার দৃঢ় ভূমির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে নতুন সৌধ। কিছু কিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই সুযোগও এসেছিল, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা ও তার পরবর্তীকালে বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ে স্বাধীন দেশের নীতি সেই পথে অনতিক্রম্য বাধা সৃষ্টি করেছিল। বিজ্ঞান গবেষণা প্রায় বন্ধ হয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগ মূলত এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আরো দীর্ঘদিন দেশে পদার্থবিদ্যা শিক্ষাতে বিভাগ এক প্রধান স্থান অধিকার করে থাকবে। ঐতিহাসিক রবার্ট অ্যান্ডারসন তাঁর Nucleus and Nation বইতে লিখেছেন, ‘… at the end of the twenteith century, there was a consensus in India that more than half the best physics students applying for positions in India and abroad still continued to come from Science College in the University of Calcutta, and numerous people across India have asked me, “How is it still possible, under those conditions?”’ আমরা এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনাতে যাব না, কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট যে প্রথম যুগের তুলনাতে সায়েন্স কলেজে conditions নিঃসন্দেহে খারাপ হয়েছিল। এই পর্বের লেখাতে আমরা তার কিছু কারণ খুঁজে পাব।
স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা তথা পূর্ব ভারত। কলকাতাতে ১৮৭৬ সালে মহেন্দ্রলাল সরকার তৈরি করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। ১৯১৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট। এই দুই প্রতিষ্ঠানই ছিল মূলত দেশীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত, পরিচালনার ভার ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয়দের হাতে। বিজ্ঞান কলেজেও ব্রিটিশ সাহায্যের পরিমাণ ছিল নিতান্তই যৎসামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের সুবাদে বিজ্ঞান কলেজের পরিচালনাতে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না বললেই হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে সারা ভারতে এই রকম আর একটিই প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যায়, তা হল বাঙ্গালোরের টাটা ইন্সটিটিউট, পরবর্তীকালের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। টাটাদের অর্থানুকূল্যে এবং মহিশূরের মহারাজার দেওয়া জমির উপরে তৈরি হলেও ব্যাবসায়ী পরিবার টাটারা কোনোভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের চটাতে চায়নি। তাই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা নিয়োগে সরকারের নির্ণায়ক ভূমিকা ছিল। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯৩৩ সালে রমনের নিয়োগের আগে ইন্সটিটিউটে কোনো ভারতীয় অধিকর্তা নিযুক্ত হননি। ফলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ব্রিটিশ বিজ্ঞানীতে প্রতিষ্ঠান ভরে উঠেছিল।
ভারতের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবশ্য এরা কেউ পড়বে না, পলাশির যুদ্ধের দশ বছর পরেই তৈরি হওয়া সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকেই আমরা সেই স্বীকৃতি দিতে পারি। এর পরে নাম করা যায় শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন (১৭৮৬), মাদ্রাজ মানমন্দির (১৭৯২), গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে (১৮০২), জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৮৫১), বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৮৯১) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের। কিন্তু এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্পদের উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব স্থাপন, তাই ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিক্ষা বা গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে এদের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
আগে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলি এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ই পরাধীন ভারতে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণাতে নেতৃত্ব দিত। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কলকাতাতে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী; ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় পর্যন্ত তো বটেই, তার পরেও অনেকদিন শিক্ষাসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সে একটা মূল স্থান অধিকার করে রেখেছিল। রামন কলকাতায় এসেছিলেন সরকারি চাকরির সুবাদে, তারপর পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণা শুরু করেছিলেন। রাজধানী শহর না হলে তাঁর কলকাতাতে আদৌ আসার সম্ভাবনা ছিল কিনা, বা একাধিকবার বদলির পরেও আবার ফিরে আসা সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। ইংরাজি তথা আধুনিক শিক্ষাও কলকাতাতে সব থেকে আগে শুরু হয়েছিল। এই সমস্ত কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশকে কলকাতা ছিল ভারতে বিজ্ঞান চর্চার মূল কেন্দ্র। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম দশক থেকে, ভারতের বিজ্ঞান প্রশাসনের ইতিহাসের সঙ্গে সেই কাহিনি জড়িয়ে আছে।
কলকাতায় মেঘনাদের প্রত্যাবর্তন
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বিজ্ঞান কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের ঘটনাক্রমের কেন্দ্রে আছেন মেঘনাদ সাহা। দীর্ঘ দেড় দশক এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটালেও কলকাতার সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র কখনোই ছিন্ন হয়নি। রামনের প্রস্থানের পরে তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের একটি কারণ অন্তর্হিত হয়। এলাহাবাদে ল্যাবরেটরি তৈরির সুযোগ তিনি বিশেষ পাননি, তাছাড়া এলাহাবাদ ছিল ভারতের বিজ্ঞান জগতের কেন্দ্র থেকে বহু দূরে। তাই সুযোগ পেলে যে তিনি ফিরে আসবেন তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। তবে স্বাভাবিক ভাবেই বিভাগের প্রধান অর্থাৎ পালিত অধ্যাপকের পদ ছাড়া অন্য কোনো পদে ফিরতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। সেই পদে তখন আসীন ডি এম বোস।
জগদীশচন্দ্রের মৃত্যু ঘটে ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর, আগে থেকেই জানা ছিল যে তাঁর পরে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তার দায়িত্ব নেবেন তাঁর ভাগনে ডি এম বোস। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন পরের বছর ৩১ মার্চ। সেই বছর ২১ জানুয়ারি এক চিঠিতে তিনি এক বছরের বিনা বেতনে ছুটির দরখাস্ত করেন। একই সঙ্গে লেখেন যে তিনি কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা (১৯৩৪ সালে আবিষ্কৃত) ও মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণার জন্য যে সমস্ত যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন, তৈরির খরচ দিয়ে তিনি সেগুলি বোস ইন্সটিটিউটে নিয়ে যেতে চান। ছুটি মঞ্জুর হয়, তাঁকে যন্ত্রপাতির তালিকা ও তার খরচের হিসাব জমা দিতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত ৭৫০২ টাকা দিয়ে কিছু যন্ত্র তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে নিয়ে যান।
এক বছরের ছুটিতে গেলেও বোঝা গিয়েছিল যে ডি এম বোস খুব সম্ভব ফিরবেন না, তাই সেই পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তির খোঁজ শুরু হয়। সেই মুহূর্তে দুজনের নাম আসে, মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ। উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সত্যেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ ২৮ জানুয়ারি, ১৯৩৮ তার উত্তরে যে চিঠি লেখেন তাতে এটা পরিষ্কার যে তিনি ঢাকা ছাড়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। ১২ মার্চ পালিত গভর্নিং বডির সভা সিদ্ধান্ত নেয় যে ১৯৩৮ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯৩৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ের জন্য ১৩০০ টাকা মাসিক বেতনে মেঘনাদ সাহাকে পালিত অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হবে। সেনেটে আলোচনার সময় নীলরতন সরকার ও শ্যামাপ্রসাদ দুজনেই বলেন যে ডি এম বোসের ফেরার সম্ভাবনা কম, তাই আপাতত সাময়িক নিয়োগ হলেও মেঘনাদ খুব সম্ভব স্থায়ীভাবেই থাকবেন। মেঘনাদ যোগ দেন ১৯ জুলাই। দেবেন্দ্রমোহন পরের বছর মার্চ মাসে চিঠি লিখে পদত্যাগ করেন, পালিত গভর্নিং বডি ৯ মার্চ পালিত অধ্যাপক পদের নির্বাচনের জন্য এক কমিটি তৈরি করেন। তার সদস্য ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি ও ওয়ালি মহম্মদ। বোঝাই যায় যে কমিটির সিদ্ধান্ত কী হবে তা আগেই জানা ছিল, সেইদিনই সার্কুলেশনের মাধ্যমে মিটিং করে কমিটি মেঘনাদকে নিয়োগের সুপারিশ করে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগ না থাকলেও এই সময়ে মেঘনাদের কর্মকাণ্ডে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল যা বিভাগকে প্রভাবিত করেছিল। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে মেঘনাদের উৎসাহেই তৈরি হয় ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি, যা স্বাধীন ভারতের প্ল্যানিং কমিশনের পূর্বসূরী। মেঘনাদই কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য জহরলাল নেহরুকে অনুরোধ করেছিলেন। ১৩ অক্টোবর ১৯২৮ এক টেলিগ্রামে সুভাষচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্ল্যানিং কমিটিতে মেঘনাদকে নিযুক্ত করার অনুমতি চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দেয়। সাহা চিরকালই বিজ্ঞানের পাশাপাশি দেশ ও দেশের মানুষের উন্নতিকল্পে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। রাজনীতি ছাড়া তা সম্ভব নয়, তাই তিনি ছিলেন বিজ্ঞানীর রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের উৎসাহী সমর্থক। জহরলালের সঙ্গে এলাহাবাদে বাসের সময় মেঘনাদের অবশ্যই যোগাযোগ হয়েছিল, কিন্তু প্ল্যানিং কমিটির সুত্রেই তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
পালিত অধ্যাপক পদে স্থায়ী হওয়া বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই মেঘনাদ বিভাগের আধুনিকীকরণের দিকে মন দেন। পালিত গভর্নিং বডির কাছে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা, মহাজাগতিক রশ্মি, বর্ণালীবীক্ষণ ও আয়নীভবন বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি এক প্রকল্প জমা দিয়ে ৩০০০০ টাকা বিশেষ অনুদান চেয়েছিলেন। গভর্নিং বডি প্রকল্পটি অনুমোদন করে এবং বিভিন্ন খাত মিলিয়ে টাকারও সংস্থান করে। এই সময়েই পদার্থবিদ্যার এমএসসি সিলেবাস নতুন করে তৈরি করা হয়। আমরা দেখি যে স্পেশাল পেপারের মধ্যে আছে বৈদ্যুতিক ও রেডিও যোগাযোগব্যবস্থা, এক্স রশ্মি ও পদার্থের গঠন, আলোকবিদ্যা, স্বনবিদ্যা, ভূপদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা। এর মধ্যে প্রথমটি শিশিরকুমার মিত্রের ও শেষ দুটি বিষয় মেঘনাদের গবেষণার সঙ্গে সংযুক্ত।
দুটি যন্ত্রঃ সাইক্লোট্রন ও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ
এর পরেই মেঘনাদ খুবই উচ্চাভিলাষী দুটি প্রকল্পে হাত দেন যা সেই সময় থেকে ১৯৫৬ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কর্মকাণ্ডের এক বিরাট অংশ অধিকার করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে দুটি যন্ত্র, সাইক্লোট্রন ও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, বানানোর সিদ্ধান্ত তিনি নেন। এশিয়াতে এই দুই যন্ত্র আগে তৈরি হয় নি। তার মধ্যে প্রধান ছিল সাইক্লোট্রন।
মেঘনাদ যখন কলকাতাতে ফিরে আসেন, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান গবেষণাতে সেই সময় নিউক্লিয় বিজ্ঞান একটা বড় স্থান অধিকার করেছে। ১৯৩৮ সালে আবিষ্কার হল নিউক্লিয় ফিশন বিক্রিয়া; এক দশকের মধ্যে সারা পৃথিবীতে শক্তির নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাতে সেই আবিষ্কারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহা নিজে নিউক্লিয় বিজ্ঞানে কিছু গবেষণা করলেও তা তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল না, কিন্তু তিনি তখনই নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শুরু করলেন নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের পাঠক্রম। আগেই বলেছি তাঁর লক্ষ্য ছিল পদার্থবিদ্যাবিভাগের আধুনিকীকরণ, কিন্তু সে কাজে প্রধান অন্তরায় হল যন্ত্রপাতির অভাব। পদার্থবিজ্ঞানের মূল কথা হল পরীক্ষানিরীক্ষা, কিন্তু যন্ত্র না থাকলে তা সম্ভব নয়। মেঘনাদ বুঝলেন নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণার চাবিকাঠি হল কণাত্বরক। সেই সময় সবচেয়ে আধুনিক কণাত্বরক হল সাইক্লোট্রন।
সাইক্লোট্রন বিষয়ে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। সংক্ষেপে বলা যায় আধুনিক নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে যেটা প্রথমেই দরকার তা হল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরক। দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো শক্ত কারণ নিউক্লিয়াসের আধান ধনাত্মক, তাই এক নিউক্লিয়াস অন্য নিউক্লিয়াসকে বিকর্ষণ করে। সেই বিকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে বিক্রিয়া তখনই হতে পারে যখন সংঘর্ষরত দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে অন্তত একটার গতিশক্তি খুব বেশি। নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি বাড়াতে পারে সাইক্লোট্রন বা অন্য কোনো কণাত্বরক। সাইক্লোট্রন দিয়ে প্রোটন কণা বা কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি বাড়িয়ে অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসের উপর আঘাত করা হয়। এর ফলে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটে। এভাবে অনেক নতুন পরমাণুর আইসোটোপ তৈরি করা সম্ভব যা বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি চিকিৎসা বা শিল্প ইত্যাদিতে কাজে লাগানো হয়। যেমন ক্যান্সারের চিকিৎসায় বা বিভিন্ন রকমের ডায়াগনসিসে যে রেডিওআইসোটোপ ব্যবহার করা হয়, তা সাইক্লোট্রনে তৈরি। সাইক্লোট্রন উদ্ভাবন করেছিলেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্স। ১৯২৯ সালে তিনি এই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরি হয় ১৯৩২ সালে। এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনা করেন মেঘনাদ সাহা।
কিন্তু আমাদের দেশে সেই মুহূর্তে সাইক্লোট্রন বানানো ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। তার কারণ আমাদের শিল্পপ্রযুক্তি অত্যাধুনিক যন্ত্র বানানোর মতো প্রকৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি । মেঘনাদ বুঝলেন যে বিদেশ থেকে সাইক্লোট্রন আনা ছাড়া উপায় নেই। সাইক্লোট্রন কিন্তু এমন কোনো যন্ত্র নয় যা সহজে কিনতে পারা যাবে। সারা পৃথিবীতে সেই যন্ত্রের সংখ্যা তখন হাতে গোনা, সেগুলি সবই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে। তাদের কেউ হয়তো তাঁকে বিক্রি করতে রাজি হতে পারে, কারণ তারা আরো বড় সাইক্লোট্রন তৈরি করেছে। কিন্তু যন্ত্রাংশ খুলে তাকে আনার পরে আবার জুড়ে দাঁড় করানোর জন্যও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। তাছাড়া কিছু যন্ত্র অবশ্যই হাতে বানাতে হবে।
আর্নেস্ট লরেন্সের সঙ্গে সাহার বার্লিনে আলাপ হয়েছিল ১৯২৬ সালে, ১৯৩৬ সালে বার্কলেতে আবার তাঁদের দেখা হয় এবং বার্কলের সাইক্লোট্রন সাহাকে মুগ্ধ করে। সাহা তার পরেই এক চিঠিতে লরেন্সকে লেখেন যে যদি তিনি সাইক্লোট্রনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করতে পারেন, তাহলে লরেন্সকে তিনি সাহায্যের অনুরোধ জানাবেন। এর পরে তিনি প্রিন্সটনের সাইক্লোট্রনটিও দেখেন। এই সময়েই তিনি সাইক্লোট্রন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্পর্কের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, অর্থ জোগাড় করতে এই যুক্তিকেই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। লরেন্স ১৯৩৯ সালে তাঁর উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাও তাঁর সমর্থনে আসে। সাহা স্থির করেন যে বার্কলে থেকেই তিনি কলকাতার সাইক্লোট্রন জোগাড় করবেন।
সাইক্লোট্রনের জন্য ঠিক কত টাকা প্রয়োজন ছিল? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সাইক্লোট্রন বিষয়ে এক কমিটি তৈরি করেছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তিনি সেনেটে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে দেখতে পাই সাইক্লোট্রন যন্ত্রটির জন্য লাগবে আশি হাজার টাকা। এছাড়া তার জন্য বাড়ি তৈরি, যন্ত্র স্থাপন, ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক, গবেষক ফেলো ইত্যাদির মাইনের জন্য দু’বছরে লাগবে আরো সাতান্ন হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি বছর চার হাজার চারশো টাকা খরচ হবে। সেই সময় পালিত ল্যাবরেটরির বাৎসরিক বরাদ্দ ছিল পাঁচ হাজার টাকা, এছাড়া বিভাগীয় প্রধান হিসাবে সাহার পক্ষে অন্য যন্ত্রপাতি কেনা ইত্যাদি খাত থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব ছিল। তুলনায় সাইক্লোট্রন বসানোর খরচ অনেকগুণ বেশি সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই মুহূর্তে টাকাটা মেঘনাদের কাছে বড় একটা সমস্যা হয় নি, কারণ প্ল্যানিং কমিটির সূত্রে তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ।
অর্থ জোগাড়ের কাজে সাহার প্রধান সহায় হয়েছিলেন জহরলাল নেহরু। মেঘনাদ স্যার দোরাবজি টাটা চ্যারিটিজ ট্রাস্টের কাছে সাইক্লোট্রন বসানোর জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। নেহরু ট্রাস্টকে লিখেছিলেন যে সাইক্লোট্রন ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। টাটা ট্রাস্ট বম্বেতে ক্যান্সার চিকিৎসার এক কেন্দ্র তৈরি করছিলেন, তাঁরা ১৯৪০ সালে সাইক্লোট্রনের জন্য মঞ্জুর করেন ষাট হাজার টাকা। ১৯৪০ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের মিটিঙে টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার আর্দেশির দালালের এক টেলিগ্রাম আলোচনার জন্য পেশ হয়েছিল। মেঘনাদ সাহাকে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয় যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লোট্রনের জন্য প্রয়োজনীয় বাকি ষাট হাজার টাকা দিতে সম্মত হয় তাহলে ট্রাস্ট ষাট হাজার টাকা দিতে রাজি আছে। মেঘনাদ টাকার জন্য আবেদন করেছিলেন ৫ জুন, ১৯৪০। মূল আবেদনটি পাওয়া যায়নি, তবে টাটা ট্রাস্টের বার্তা থেকে অনুমান করি যে মেঘনাদ এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা চেয়েছিলেন। সিন্ডিকেট ধন্যবাদ জানিয়ে বলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স কমিটি প্রস্তাবটি বিবেচনা করার পর তাঁদের উত্তর দেওয়া হবে।
ফিনান্স কমিটির সভা বসেছিল ৫ ডিসেম্বর ১৯৪০। কমিটি বলে যে সাইক্লোট্রনের দামের আশি হাজার টাকার মধ্যে টাটা ট্রাস্টের ষাটহাজার টাকার বাইরের কুড়ি হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে। বাড়ি বানানো ও যন্ত্র স্থাপন করতে যা খরচ হবে, তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট খরচ ষাট হাজার টাকা পেরিয়ে যাবে। মেঘনাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্প রচনার জন্য এক কমিটি তৈরি হয়, তার কথা আগেই বলেছি। সিন্ডিকেট পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় সেনেটের কাছে টাটা ট্রাস্টের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সুপারিশ করে। সেনেটের ১৪ ডিসেম্বরের সভাতে বিধানচন্দ্র প্রস্তাবকে জোরালো সমর্থন করেন। এত টাকা খরচ নিয়ে মৃদু আপত্তি এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক জেনকিন্সের পক্ষ থেকে, কিন্তু সেদিনের সভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাকে উড়িয়ে দেন। অনুমান করি বিধানচন্দ্রের সমর্থনের পিছনে ছিলেন জহরলাল এবং মেঘনাদ আশুতোষের ছেলে শ্যামাপ্রসাদকে রাজি করিয়েছিলেন।
পৃথিবীর প্রথমদিকের প্রায় সব কটি সাইক্লোট্রন তৈরিতেই বার্কলের ল্যাবরেটরির সহায়তা লেগেছিল। মেঘনাদ প্রথম থেকেই সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তিনি তাঁর ছাত্র বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরিকে লরেন্সের কাছে ট্রেনিঙের জন্য পাঠান। লরেন্স তাঁকে ছাত্র হিসাবে নিয়েছিলেন এবং আমেরিকাতে তাঁর থাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে সাহায্য করেছিলেন। মেঘনাদের পরিকল্পনাতে বাসন্তীদুলাল এক কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে ছিলেন, টাটা ট্রাস্টের কাছে আবেদনপত্রে তিনি লিখেছিলেন যে কলকাতাতে সাইক্লোট্রন তৈরিতে মূল দায়িত্ব নেবেন বাসন্তীদুলাল।
এ কথা বলতেই হবে এ মেঘনাদের পরিকল্পনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির পক্ষে বড় মাপের হলেও আন্তর্জাতিক মাপে তা ছিল ক্ষুদ্র। মেঘনাদের পক্ষে খুব বেশি টাকা জোগাড় করা হয়তো সম্ভব ছিল না, তাই তাঁর উচ্চাশাকে সীমিত রাখতে হয়েছিল। যে নেহেরু সাইক্লোট্রনের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনিই আট বছর পরে মেঘনাদের প্রচেষ্টাকে আখ্যা দেবেন স্থানীয় (local) ও ক্ষুদ্র (petty)। কয়েক বছর আগের ইউরোপ বা আমেরিকা ভ্রমণের সময় সাহা যে সমস্ত সাইক্লোট্রন দেখেছিলেন, কলকাতার প্রস্তাবিত যন্ত্রটি ছিল তারই মতো বড়। সাহা অবশ্য জানতেন যে আমেরিকাতে তার মধ্যেই আরো বড় যন্ত্র তৈরি হতে চলেছে। কিন্তু সাহা বা অন্য কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমার প্রয়োগের পরে মিত্র শক্তির দেশগুলি সেই গবেষণাতে অর্থ বিনিয়োগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। তার ফলে ৩৭’’ মাপের সাইক্লোট্রন দিয়ে কোনো ভাবেই গবেষণার প্রথম সারিতে থাকা সম্ভব নয়। (এই মাপটা হল সাইক্লোট্রনে ব্যবহৃত চুম্বকের মেরুর ব্যাস।) ১৯৪০ সালে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দেয়নি, তবে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন যে তা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ১৯৩৮ সালে বার্কলেতে অনেক বড় সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনা সুরু হয়ে গিয়েছিল। মেঘনাদের অনুরোধে লরেন্স ও তাঁর সহযোগী ডোনাল্ড কুকসে তাঁদের ৩৭” সাইক্লোট্রনটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে সম্মত হন এবং তা পাঠানোর জন্য খুলতে শুরু করেন।
বাসন্তীদুলালের ডক্টরেট সম্পূর্ণ হয় ১৯৪০ সালে, সাহা তাঁকে আমেরিকাতে আরো কিছুদিন থেকে সাইক্লোট্রন পাঠানোর সমস্ত ব্যাবস্থা করে আসতে বলেন। বাসন্তীদুলালের ফেলোশিপ শেষ হয়ে গেছে, কুকসে তাঁকে বলেন যে অন্য কোনো ব্যবস্থা না করতে পারলে দু’মাস তাঁর খরচ কুকসেই বহন করবেন। ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু তা ভবিষ্যতের অর্থসঙ্কটের পূর্বাভাস দেয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৪০ টেলিগ্রাম করে মেঘনাদ তাঁকে কী কী কিনতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেন, কিন্তু টাকা না পৌছানো পর্যন্ত অর্ডার দিতে বারণ করেন। বোঝাই যাচ্ছে যে মেঘনাদ তখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিশ্চিত নন। সাইক্লোট্রনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লরেন্সকে দেড়হাজার ডলার পাঠায় যার মধ্যে স্পেশাল রিসার্চ স্কলারের জন্য মাসিক দেড়শো টাকা হিসাবে বাসন্তীদুলালের ছ’মাসের মাইনে ধরা ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাসন্তীদুলালকে ১১,৩০০ ডলার পর্যন্ত খরচের অনুমতি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করে যে ১৫ গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জমি আছে, সেখানে সাইক্লোট্রন বসানো হবে। এটি ৯২ আপার সার্কুলার রোডে সায়েন্স কলেজের ক্যাম্পাসের লাগোয়া, ১৯৫০ সাল থেকে তার ঠিকানা বদল করে সায়েন্স কলেজের সঙ্গে এক করা হয়।
কোনো সন্দেহ নেই যে প্রথম থেকেই মেঘনাদ সাইক্লোট্রনের দাম অনেক কম দেখিয়েছিলেন। তাছাড়া যুদ্ধের জন্য খরচ বেড়ে চলেছিল। যেমন ১৯৪২-৪৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর করেছিল ১০,৩০০ টাকা, ৩১ জুলাই এক চিঠি দিয়ে মেঘনাদ অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছিলেন ২৯,০০০ টাকা। ২০ আগস্ট এক চিঠিতে মেঘনাদ লেখেন বিশ্ববিদ্যালয় তখনো পর্যন্ত মোট ১,২৮,৭৯৫ টাকা বরাদ্দ করেছে, এর মধ্যে টাটা ট্রাস্টের অনুদানও আছে। আরো ৩৪,৪৭৩ টাকা পেলে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব। এর মধ্যে বাসন্তীদুলালের মাইনেও ধরা ছিল, সিন্ডিকেট সেই অংশটি বাদ দিয়ে বাকি খরচ অনুমোদন করে।
মেঘনাদ বুঝেছিলেন যে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে না, অন্য দাতা সন্ধানও জরুরি। ১৯৪৩ সালের ২৬ জুন সেনেটে সভায় বাজেট বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরে থেকে দান সংগ্রহের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় যারা প্রাক্তনীদের থেকে দান সংগ্রহের উপরে জোর দেয়। এছাড়া ভারতেও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত দানের জন্য আবেদন করে। সরকারেরও এগিয়ে আসা উচিত, সংযুক্ত প্রদেশ সরকারও বাংলা সরকারের থেকে শিক্ষা খাতে বেশি খরচ করে।
মেঘনাদ শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। দোরাবজী ট্রাস্টের দানের কথা আগে বলেছি। ঘনশ্যাম দাস বিড়লার কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্ট থেকে পাঁচ বছরের জন্য মোট ষাট হাজার টাকা অনুদান পাওয়া যায়। শ্যামাপ্রসাদের অনুরোধে দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট পাঁচ বছরের জন্য আরো তিরিশ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা মেঘনাদের চেষ্টাতে পালিত ল্যাবরেটরিতে এক গ্রাম রেডিয়াম কেনার জন্য পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দান করেন। শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সাইক্লোট্রন বা তার অনুসঙ্গের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে মোট চার লক্ষ বারো হাজার টাকা পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিল দু’লক্ষ বাষট্টি হাজার টাকা, কেন্দ্রীয় সরকার তিন লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার টাকা। বাড়ি তৈরির খরচ এর মধ্যে ধরা নেই।
এই টাকার মধ্যে আছে কলকাতার ধনাঢ্য লাহা পরিবারের সদস্য ও পালি ভাষার পণ্ডিত বিমলাচরণ লাহার দান সতের হাজার পাঁচশ টাকা যার একটা অংশ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরিতে ব্যবহার হয়েছিল। মেঘনাদ শুধুমাত্র নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানেই বিভাগকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, তাঁর দূরদর্শিতাতে তিনি বুঝেছিলেন যে জীবপদার্থবিদ্যা বা বায়োফিজিক্স ভবিষ্যতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে ডক্টরেট করা নীরজনাথ দাশগুপ্তকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ বিষয়ে শেখার জন্য পাঠায়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার হয়েছে তার দশ বছর আগে। নীরজনাথ এর আগে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিভাগে রিসার্চ ফেলো হিসাবে কাজ করেছিলেন, ১৯৪৩ সালে তাঁকে পালিত অধ্যাপক অর্থাৎ মেঘনাদের সহকারী নিয়োগ করা হয়েছিল। ১ নভেম্বর, ১৯৪৪ তিনি বায়োফিজিক্সে লেকচারার হিসাবে যোগ দেন, তাঁর মাইনে আসত বিড়লাদের কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্টের দান থেকে। নীরজনাথ দাশগুপ্তের নেতৃত্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে এশিয়ার প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি দেখাচ্ছে যে অর্থের সমস্যা অতিক্রম করার জন্য মেঘনাদ সবসময় নানা রকম পরিকল্পনা করতেন। বিমলাচরণ লাহা ১৯ অক্টোবর, ১৯৪৪ বিশ্ববিদ্যালয়কে এক চিঠিতে জানান যে মেঘনাদের অনুরোধে তিনি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ৭০০০ টাকা দিচ্ছেন। মাইক্রোস্কোপের দাম ছিল ১৪,৪৬৮ টাকা, বাকি টাকাটা কৃষ্ণার্পণ ট্রাস্ট দিলেও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনার টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় অক্ষমতা জানায়। মেঘনাদ তখন আমেরিকাতে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানান যে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনার প্রয়োজন নেই, নীরজনাথ দাশগুপ্ত তিন হাজার টাকার মধ্যে তা বিভাগেই বানিয়ে ফেলতে পারবেন। তিনি কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্টের অনুমোদিত অর্থ সাইক্লোট্রনের যন্ত্রাংশ কেনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি জোগাড় করেন। এটা ছিল ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। মেঘনাদ নিশ্চয় জানতেন যে তিন হাজার টাকাতে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের যন্ত্রাংশ কেনা অসম্ভব; তিনি সেই মুহূর্তে সাইক্লোট্রনের উপর জোর দিচ্ছিলেন। এর পর জুন মাসে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানান যে বিমলাচরণ লাহা আরো ১০,৫০০ টাকা তাঁকে দিয়েছেন, তার মধ্যে ৮,২৫০ টাকা লাগবে মাইক্রোস্কোপের যন্ত্রাংশ কিনতে। তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো টাকা দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত কাস্টমস ডিউটি ধরে মাইক্রোস্কোপের জন্য খরচ হয় প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। মাইক্রোস্কোপ তৈরি শেষ হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৫০ সালে সেটি নতুন ভবনে অর্থাৎ পরবর্তীকালের ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে স্থানান্তরিত হয়।
ফিরে আসি সাইক্লোট্রনের কথায়। বাসন্তীদুলাল সাইক্লোট্রন পাঠানোর সমস্ত ব্যাবস্থা করে দেশে ফেরেন ১৯৪১ সালে। তখন জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে যোগ দিয়েছে। কাজেই সেই সময় সমুদ্রযাত্রা করতে তিনি যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তিনি বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেন সে বছর ১৫ আগস্ট। পঞ্চাশ টন ওজনের তড়িৎচুম্বকটি এবং অন্য যন্ত্রাংশ পরের বছর এসে পৌছায়, কিন্তু হাই ভ্যাকুয়াম পাম্প ও ভাল্ভ যে জাহাজে আসছিল তা জাপানি টর্পেডোর আঘাতে প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবে যায়। এই ধাক্কা সামলে ওঠা কঠিন হয়েছিল, কারণ সেই রকম সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ তৈরির মতো কোনো ওয়ার্কশপ ভারতে ছিল না।
কলকাতায় ফিরে বাসন্তীদুলাল স্পেশাল সাইক্লোট্রন অফিসার হিসাবে পাচ্ছিলেন মাসিক ২০০ টাকা, তা বেড়ে সাড়ে তিনশো টাকায় পৌঁছেছিল। যুদ্ধের সময় সেই টাকা দিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চাকরির সুযোগ ছিল না। তাছাড়া তাঁর চাকরি ছিল অস্থায়ী। অথচ তাঁকে ছাড়া সাইক্লোট্রন বসানো অসম্ভব। মেঘনাদ এবার গেলেন শূর এনামেল এন্ড স্ট্যাম্পিং ওয়ার্ক্স কোম্পানির কাছে। শূর পরিবারের এক সদস্য তাঁর কাছে গবেষণা করে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএসসি হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে তাঁদের থেকে দু’লক্ষ টাকা দানের সুদে বাসন্তীদুলালের জন্য ৫০০ টাকা মাইনের তারিণীচরণ শূর রিডার পদ তৈরি হল। ধীরেন্দ্রনাথ কুন্ডু সাইক্লোট্রনে গবেষক ছাত্র হিসাবে কাজ করছিলেন। মেঘনাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাইক্লোট্রনের ব্যবহার শেখার উদ্দেশ্যে তাঁর জন্য ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থা করেন ও দেড় হাজার ডলার স্কলারশিপ জোগাড় করেন।
ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার ভারতে গবেষণাতে টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল; তৈরি হয়েছিল বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বা বিএসআইআর, যা আজকের কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের পূর্বসূরী। তার অধিকর্তা হয়েছেন মেঘনাদের পুরানো বন্ধু শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। ১৯৪৩ সালে জাহাজডুবির পরে পাম্প তৈরির জন্য ভাটনগর পনের হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপে সে কাজ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৫ সালে মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণার জন্য বিএসআইআর মেঘনাদকে দেয় পাঁচ হাজার টাকা। ১৯৪৬ সালে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবরেটরির জন্য বিএসআইআর থেকে পাওয়া গেল এক লক্ষ দশ হাজার টাকা। সরকারি টাকা নেওয়ার সমস্যা মেঘনাদ অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবেন। ২৮ মার্চ ১৯৪৬ পদার্থবিদ্যা বিভাগের তিন অধ্যাপক মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথ ও শিশিরকুমার মিত্র একযোগে এক চিঠিতে ১৫ নম্বর গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নতুন ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চার লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সায়েন্স কলেজের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবরেটরির বাড়ি তৈরির জন্য ছ’লক্ষ সত্তর হাজার টাকা জোগাড়ে সক্ষম হয়েছিলেন। এর দু’লক্ষ টাকা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়, বাকিটা সরকার।
বিদেশে প্রায় সর্বত্রই মৌলিক বিজ্ঞানে গবেষণাগার কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সাহা চিরকালই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে মৌলিক গবেষণার সমর্থক, পরাধীন ভারতে সমস্ত মৌলিক গবেষণাই হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। এই প্রসঙ্গে ১৯৪৪ সালের ২৬ জুন সেনেটের বাজেট অধিবেশনে আঁর বক্তৃতার কথা স্মরণ করি। বিজ্ঞান কলেজের আর্থিক ও স্থান সংকুলানের সমস্যার কথা আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজ্ঞান কলেজের দায়িত্ব আরো বাড়বে। কলকাতাতে আরো কিছু জাতীয় গবেষণাগার তৈরি হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা বাংলারই উন্নতি হবে। অবিলম্বে বিজ্ঞান কলেজকে বৃহৎ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্তরে উন্নীত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।
শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না মেঘনাদ, তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মধ্যেই এক আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন। বিএসআইআর-এর অনুদানটি আসার পরেই ১৯৪৬ সালের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় মেঘনাদের প্রস্তাবমতো নিউক্লিয় ও জীব-পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটরিকে পুনর্গঠন করার জন্য এক কমিটি গঠন করেছিল, বস্তুত এই ছিল বিভাগের মধ্যে ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তৈরির প্রথম ধাপ। মেঘনাদের প্রস্তাবটা ছিল সংক্ষেপে এইরকম- আড়াইলক্ষ টাকা ব্যয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবরেটরির আলাদা বাড়ি তৈরি হবে। সেখানে বায়োফিজিক্সের জন্য একটি নতুন রিডার পদ সৃষ্টি করা হবে। এছাড়াও কিছু নতুন নিয়োগ করতে হবে। সেই কমিটি ইন্সটিটিউটের জন্য প্রতি তলে ন’হাজার বর্গফুটের একটি দ্বিতল বাড়ি ও বেশ কিছু নতুন পদ সৃষ্টির কথা বলে। নতুন নিয়োগের জন্য বার্ষিক খরচ হবে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। অবিলম্বেই বেশ কিছু পদে নিয়োগ শুরু হয়েহিল, নীরজনাথ দাশগুপ্তকে বায়োফিজিক্সের রিডার পদে নিযুক্ত করা হয়। এই তহবিল থেকে যে সমস্ত গবেষককে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে পড়বেন সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল, সুকুমার বিশ্বাস, দ্বিজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় চ্যাটার্জি, অরুণকুমার চৌধুরি প্রমুখ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একসঙ্গে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। মেঘনাদের চেষ্টাতে শূর পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁদের অনুদানের দু’লক্ষ টাকা বাড়ি বানানোর জন্য ধার নেওয়ার অনুমতি দেয়। সাইক্লোট্রন বিল্ডিঙের সঙ্গে যুক্তভাবে বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। ১৫ গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনের অবশিষ্ট জমিতে পরে রেডিওফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের বাড়ি তৈরি হয়। ১৯৪৬ সালে রেডিওফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স পদার্থবিদ্যা থেকে আলাদাভাবে পড়ানো শুরু হয়।
মেঘনাদ যে পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন, সেটা লক্ষণীয়। তিনি জানেন যে সাইক্লোট্রন বানানো সহ আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করতে যে বিশাল পরিমাণ টাকা লাগবে, তা একবারে চাইলে দাতারা হাত গুটিয়ে নেবেন। তাই তিনি সাইক্লোট্রন দিয়ে শুরু করেছেন এবং তাঁর পরিকল্পনাকে ভেঙে ভেঙে দেখাচ্ছেন। এতে করে টাকা পাওয়া যাচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দাতারা তাঁর বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অন্ধকারে আছেন এবং অবিলম্বে ফল দেখতে ইচ্ছুক। জহরলাল যেহেতু এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছেও অভিযোগ গিয়েছিল। জহরলালের অনুযোগের উত্তরে মেঘনাদ লিখেছিলেন যে বিদেশেও সাইক্লোট্রন বসাতে তিন বছর সময় লাগে, তাঁরা দু’বছর সময় নেবেন। বাস্তবে অবশ্য এর অনেক গুণ বেশি সময় লেগেছিল। পরবর্তীকালে মেঘনাদ এর জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। নেহরু বিজ্ঞান গবেষণা দপ্তরের মন্ত্রী কে ডি মালব্য, যিনি আবার মেঘনাদের ছাত্রও ছিলেন, তাঁকে লিখেছিলেন যে অনেকেই মেঘনাদের ইন্সটিটিউটের সাফল্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান।
আরো একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। মেঘনাদ জানেন যে কলকাতা থেকে বিজ্ঞানের ভারকেন্দ্র সরে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নতুন বাড়ির জন্য অর্থ চেয়ে ১৯ মে ১৯৪৬ এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে বম্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং এখনি ব্যবস্থা না নিলে অনতিবিলম্বে কলকাতাকে পিছনে ফেলে দেবে। তার ঠিক চারদিন আগে অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ কমিটির সভা হয়েছিল, মেঘনাদও কমিটির সভ্য। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারতের মতো দেশের পক্ষে একাধিক জায়গায় নিউক্লিয় গবেষণা চালানো সম্ভব নয়, সুতরাং এখন থেকে এ বিষয়ে সমস্ত বড় প্রকল্প দেশের একটি কেন্দ্রেই হবে। সেই কেন্দ্র হল বম্বের নব প্রতিষ্ঠিত টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, সংক্ষেপে টিআইএফআর। কলকাতাতে সাহার ল্যাবরেটরিতে নতুন প্রকল্পের জন্য নয়, তবে চালু প্রকল্পের জন্য বাৎসরিক অনুদান দেওয়া হবে। মেঘনাদ কলকাতার গুরুত্ব কমানোতে আপত্তি জানিয়েছিলেন, তবে তাতে কাজ হয়নি।
অন্তর্বর্তী ও স্বাধীন সরকারের বিজ্ঞান নীতি এবং ইন্সটিটিউটের স্বশাসন
হোমি জাহাঙ্গির ভাবা কাজ করছিলেন কেমব্রিজে, মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে তাঁর কাজ বিজ্ঞানী মহলে সাড়া জাগিয়েছে। তিনি ১৯৩৯ সালে ছুটিতে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের জন্য আর ফিরতে না পেরে বাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে কাজ শুরু করলেন। তাঁর মনে হয়েছে দেশে থেকেই বিদেশের তুলনীয় গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলাটাও বিজ্ঞানীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। দেশে যদি এক ভালো বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তিনি আর বিদেশে যাবেন কেন? ১৯৪৫ সালে টাটাদের কাছে তিনি বম্বেতে এক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠালেন, তাঁরাও উৎসাহী। প্রয়োজন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও বম্বে সরকারের সহায়তা। ভাবার পক্ষে তা জোগাড় করা খুব সহজ। নেহরুর সঙ্গে তাঁর পরিবারসূত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা হল টিআইএফআর। সেই ভাবাই অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ কমিটির প্রধান।
মেঘনাদের প্রতিবাদে কোন কাজ হল না। হয়তো জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব হ্রাস পাওয়াও ছিল সাহার মতকে উপেক্ষার আরও এক কারণ। অন্যদিকে সাইক্লোট্রন কাজ করছে না। সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন, কাজেই সাহার উপর চাপ বাড়তে লাগল। ভাবার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়া সত্ত্বেও সাহাকে তাঁর কাছেই আবেদন করতে হচ্ছে, বা সাইক্লোট্রন কেন চলছে না তার ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য বাসন্তীদুলাল আবার বার্কলে গেলেন ছ’মাসের জন্য। কিন্তু সুবিধা হল না। ভাবা সাইক্লোট্রনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন। সাহা পুরোপুরি একমত হলেন না, তাঁর কাছে মূল সমস্যাটা হল দেশে যন্ত্রাংশ বানানোর মতো কোম্পানির ও লোকের অভাব, এবং একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আমদানির সমস্যা। অনেক বছর পরে ১৯৫৪ সালে সাইক্লোট্রন থেকে প্রোটন কণার স্রোত পাওয়া যায়। অবশ্য যন্ত্র পুরোপুরি কাজ করতে লেগে গিয়েছিল আরো বারো বছর, ততদিনে তার থেকে মৌলিক গবেষণার সুযোগ প্রায় অন্তর্হিত।
সন্দেহ নেই যে মেঘনাদ সাইক্লোট্রন বসানোতে কত সমস্যা হতে পারে তা বুঝতে পারেননি। এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। নিউক্লিয় বিজ্ঞানের গোড়ার দিকে প্রায় সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানীই তার প্রাযুক্তিক দিকটাকে অতটা গুরুত্ব দেননি। পরমাণু শক্তি বিল নিয়ে সংবিধান সভাতে যে বক্তৃতাতে নেহরু মেঘনাদের সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনাকে ক্ষুদ্র ও স্থানীয় বলেছিলেন, সেই বিলে ১৯৬৫ সালের মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুতের লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। বাস্তবে ১৯৬৬ সালে বিমান দুর্ঘটনাতে ভাবার মৃত্যু পর্যন্ত এক মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয়নি। পরমাণু অস্ত্রে ব্যবহার হতে পারে এই আশঙ্কায় উন্নত দেশগুলি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরে অনেক নিয়ম নিষেধ চাপে। তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সাইক্লোট্রন প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। জাপানি আক্রমণে পাম্প বা ভাল্ভবাহী জাহাজের সলিলসমাধির কথা আগে বলেছি। যুদ্ধের জন্য এমনকি ভালো মানের তামা বা স্টিলেরও দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পরে মেঘনাদ একাধিকবার বিদেশে গিয়ে সাইক্লোট্রনের জন্য কেনাকাটার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উন্নত মানের যন্ত্রাংশ বাজার থেকে সরাসরি কেনা আর সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতার আগের দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা এবং দেশভাগ ও স্বাধীনতার পরের উদ্বাস্তু সমস্যাও সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ফি থেকে বেশ বড় অর্থ রোজগার করত, গবেষণার অনেকটা খরচই সেখান থেকে আসত। দেশভাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি হ্রাস পাওয়ার ফলে ফি ফান্ড অনেকটাই সংকুচিত হয়।
১৯৪৮ সালে তৈরি হল পরমাণু শক্তি আয়োগ, ভাবা সভাপতি। নেহরুর অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন মেঘনাদ, তিনি এর সদস্য হতে অস্বীকার করলেন। টিআইএফআরের থেকে পৃথক করে জাতীয় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হবে, ভাবাই হবেন কর্ণধার। সেটা বম্বেতে স্থাপনের কারণ হিসাবে বলা হল ভারতের কোথাও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা পড়ানো হয় না, সুতরাং বম্বেতে করলে আলাদা কোনো অসুবিধা নেই। ক্ষোভে ফেটে পড়ে নেহরুকে চিঠি লিখলেন মেঘনাদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাটা সুবিধামতো ভুলে যাওয়া হয়েছে।
১৯৪৮ সালে ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের নতুন বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুরোধ গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে, তিনি সময়াভাবে আসেননি। তাঁর জায়গা নিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সেই বছর ৪ সেপ্টেম্বর পরমাণু শক্তি আয়োগের সচিব শান্তিস্বরূপ ভাটনগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক চিঠিতে জানান যে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা পড়ানো সংগঠিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সঙ্গে ছিল উপাচার্যকে লেখা এক গোপনীয় চিঠি। প্রকাশ্য চিঠিতে কোথাও মেঘনাদের উল্লেখ না থাকলেও সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয় যে সাহা ও বোস দুজনকেই বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের কাজের অনুমতি দেবে, কিন্তু কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মেঘনাদ তার আগেই আয়োগের সদস্য হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কাজেই সেই চিঠিতে কী ছিল তা অনুমানের বিষয়। মেঘনাদ সিন্ডিকেট সদস্য, সেই সভাতেও উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টা একটু আশ্চর্য, কারণ সেই সময় সেই সময় দেশের মধ্যে একমাত্র কলকাতাতেই নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ভালোভাবে পড়ানো হত, এবং তার পিছনে ছিল সাহার প্রচেষ্টা।
মেঘনাদের শত চেষ্টাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাধীন ল্যাবরেটরি তৈরি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে পরিস্থিতির অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। সারা পৃথিবীতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বিজ্ঞান গবেষণাতে বিশেষ সরকারি সাহায্য পাওয়া যেত না, সর্বত্রই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও ব্যক্তিগত দানের উপরে অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। সাহা সেই পরিমণ্ডলেরই ফসল। কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধ যখন বিজ্ঞানের গুরুত্ব দেখিয়ে দেয়, গবেষণাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ে। সেখানেই উন্নত দেশগুলির তুলনায় পরাধীন বা নবস্বাধীন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা পিছিয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে স্বাধীন ভারতে নেহরু-ভাবা যে মডেল অনুসরণ করছেন তা হল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন কতগুলি কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেখানে গবেষণাকে আর্থিক সাহায্য অনেক বেশি দেওয়া সম্ভব। নেহরু-ভাবা মডেলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিজ্ঞান গবেষণার জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করেন যে বিজ্ঞানে আমাদের দেশের অপেক্ষাকৃত ধীরগতির পিছনে আছে এই মডেল। তার সমর্থনে এ কথা বলা যায় যে সেই সময় সদ্য স্বাধীন এবং দ্বিধাবিভক্ত দেশের পক্ষে গবেষণার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব ছিল না। শিক্ষা বিস্তারের জন্য নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতেই হবে, তাদের সবাইকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করতে হলে কেউই বিশেষ কিছু পাবে না। তার থেকে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখাই হয়তো সেই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শম্ভুনাথ ব্যানার্জিকে লিখেছিলেন যে আমাদের সম্পদ সীমিত, যদিও তা নিশ্চয় বাড়বে। সেই সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার করতে হলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেজন্য ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে সর্বভারতীয় চরিত্র দেওয়া প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হল স্বাধীনতার সাত দশক পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, সম্পদও অনেকটাই বেড়েছে, কিন্তু নীতি একই রয়ে গেছে। এর ফলেই আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ক্রমশই গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই দশা হয়েছিল।
সাহা এই মডেলের সমর্থক না হলেও বাস্তবের মাটিতেই পা দিয়ে চলেন। তিনি বুঝলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ার তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আওতার বাইরে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে রূপ নিল। সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একেবারে ছাড়তে চাইছিলেন না; তাই পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন ইন্সটিটিউটের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে কোনো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সেনেটের অনেকের আপত্তি ছিল, আবারও শ্যামাপ্রসাদের হস্তক্ষেপে জট কাটল। ১৯৫১ সালের ১২ মে সেনেটের সভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অনুমোদন দিয়েছিল। তার আগেই ১৯৫০ সালে ১১ জানুয়ারি নতুন ইন্সটিটিউটের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জোলিও-কুরি, নেহরু আবারও লক্ষণীয়ভাবেই অনুপস্থিত। কিন্তু নতুন ইন্সটিটিউট তৈরির পরে মূল বিভাগে আধুনিক গবেষণার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত হয়ে গেল, বিভাগ মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। সাহা আকস্মিকভাবে মারা যান ১৯৫৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ইন্সটিটিউটের নাম হল সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। মেঘনাদ জীবিত থাকতেই সাহা ইন্সটিটিউটের কার্যকরী অধিকর্তা দায়িত্ব নিয়েছিলেন বাসন্তীদুলাল, ১৯৫৬ থেকে তিনিই হলেন পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা।
মেঘনাদ বিশ্বাস করতেন যে সঠিক সমালোচনা করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, এবং তা তাঁর যুক্তিসঙ্গত দাবির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাই ভাবাকে যে চিঠিতে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন, সেই চিঠিতেই তাঁর নিজের দাবি পেশ করেছেন, এমন উদাহরণ বিরল নয়। সাহা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথম লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং লোকসভাতে প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সমালোচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এর ফলে তাঁদের দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হবে না, কিন্তু ঠিক তাই হয়েছিল।
গবেষণা, বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বা রেডিওফিজিক্স গবেষণা, যেভাবে বাজেটের অধিকাংশ অধিকার করে নিচ্ছিল তা বিভাগের সকলের মনোমত ছিল না। ১৯৫০ সালের ২৯ জুন সেনেটের বাজেট অধিবেশনে পদার্থবিদ্যা বিভাগের সেই সময়ের প্রধান সত্যেন্দ্রনাথ এমএসসি পড়ানোতে টাকার অভাব নিয়ে তীব্র খেদ জানিয়ে প্রস্তাব করেন যে রেডিওফিজিক্স ও নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বাজেট থেকে কিছু টাকা পড়ানোর কাজে খরচ করা হোক। সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা পরে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। একই ভাবে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স এবং রেডিওফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পৃথক বিভাগে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে পদার্থবিদ্যা বিভাগ বাস্তবে সংকুচিত হয়ে পরেছিল। যে সমস্ত ছাত্র নিউক্লিয়ার ফিজিক্স স্পেশাল পেপার পড়ত, তারা দীর্ঘদিন ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গিয়ে প্র্যাকটিকাল করত। স্বাধীনতার আগে ও অব্যবহিত পরে সরকারি সাহায্যও মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক গবেষণাগারে অর্থাৎ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, বায়োফিজিক্স ও রেডিওফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে গিয়েছিল, বাকিরা পিছিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার পরে যখন পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে এই সব আধুনিক পরীক্ষাগারগুলি পৃথক হয়ে নতুন ইন্সটিটিউটে চলে যায়, তখন গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ছাত্ররা জানত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে গবেষণার সুযোগ বিশেষ নেই, তারাও বিভাগে গবেষণাতে আগ্রহী হত না। ছাত্রের অভাবে স্বাভাবিকভাবেই গবেষণা পিছিয়ে পড়েছিল।
এই সমস্ত কারণে স্বাধীনতার পরের দশ বছরের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ মূলত এক শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছিল। গবেষণাতে আবার প্রাণ ফিরে আসতে লেগে যায় কয়েক দশক। তবে আগের সেই সুউচ্চ অবস্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি, হয়তো সরকারি নীতি, পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান গবেষণার পদ্ধতিতে পরিবর্তনের ফলে তার সুযোগও ছিল না। সাহা ইন্সটিটিউট এখন সল্ট লেকে নতুন ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইন্সটিটিউটের যে দুটি বাড়ি বানানো হয়েছিল তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। সাইক্লোট্রনটিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, এক কোণে অন্ধকারে পড়ে আছে ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন। কলকাতায় অবস্থিত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলি আন্তর্জাতিক মানে গবেষণা করে চলেছে, কিন্তু মেঘনাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে বিজ্ঞানের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কলকাতা থেকে চলে গেছে বললে বোধহয় ভুল হবে না।
খুবই তথ্য পূর্ণ লেখা । অনেক কিছু জানার সুযোগ হোলো এবং ধারণা স্বচ্ছ হোলো ।