বিশ্ববিশ্রুত রসায়নবিদ তবুও মনেপ্রাণে ছিলেন ইতিহাসবিদ
১৮৬১ সালে দক্ষিণবঙ্গের এক অজ গ্রাম খুলনা জেলার (তখন অবশ্য ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত) রাড়ুলি গ্রামে জন্মেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কেমন ছিল এই রাড়ুলি গ্রাম? এটা জানতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
১৮৪৯ সালে কলকাতায় প্রথম মেয়েদের স্কুল তৈরি হয়, Calcutta Female School, পরবর্তী কালে যা বেথুন স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য এর আগেই চব্বিশ পরগনার বারাসাতে কালীকৃষ্ণ মিত্রের উদ্যোগে একটি মেয়েদের স্কুল তৈরি হয়েছিল ১৮৪৭ সালে, যেটির বর্তমান নাম কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৪৮ সালে ওই জেলারই দত্তপুকুরের নিবাধুই গ্রামে আরও একটি মেয়েদের স্কুল তৈরি হয়েছিল। কলকাতা থেকে বহু দূরে অধুনা বাংলাদেশের রাড়ুলি গ্রামে প্রফুল্লচন্দ্রের পিতা হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরী ১৮৫০ সালে মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করেছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান ‘ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়’ এ’ বছর ১৭৫ তম বর্ষে পদার্পণ করল। বোঝা যায় গ্রামের জমিদার হয়েও গ্রামের শিক্ষাবিস্তারে তাঁর বিশেষ উদ্যোগ ছিল।
ছেলেবেলায় পাঠশালার পাঠ শেষ করে প্রফুল্লচন্দ্র ও তাঁর বড়দা জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্রকে নিয়ে রাড়ুলির জমিদার ১৮৭০ সালে কলকাতায় চলে আসেন ১৩২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রীটের ভাড়া বাড়িতে। তাদের ভর্তি করলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন,
‘কলিকাতা আসিবার পূর্বে আমি যখন গ্রাম্য স্কুলে পড়িতাম তখন আমার বয়স মাত্র নয় বৎসর, সেই সময়ে ইতিহাস ও ভূগোলের প্রতি আমার অনুরাগ ছিল। আমার পিতার মুখ হইতেই আমি প্রথম শিখি যে, প্রাচীন ভারতে গো-মাংস ভক্ষণ বেশ প্রচলিত ছিল এবং সংস্কৃতে অতিথির আর এক নাম হইল ‘গোঘ্ন’ (যাঁহার কল্যাণার্থে গোহত্যা করা হয়)।’
অর্থাৎ শুধু ইতিহাস চর্চা নয়, যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাস চর্চার বিষয়টিও পিতার কাছ থেকে বাল্যকালেই তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছিল।শারীরিক অসুস্থতার জন্য দু’বছর তাঁর স্কুলে পড়ার ছেদ পড়েছিল, স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ফিরে চলে যেতে হয়েছিল পল্লী গ্রাম রাড়ুলিতে। এইটি ছিল তাঁর ছাত্রজীবনের স্মরণীয় দুটি বছর। এই সময় পিতা হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরীর গ্রন্থাগারের বিপুল সংগ্রহ তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে ভর্তি হলেন অ্যালবার্ট স্কুলে, এখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন। এর পর পড়ার জন্য ভর্তি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ)। এফ.এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন ওই কলেজেই। এই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অধ্যাপক আলেকজান্ডার পেডলার-এর বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। সকলের অজ্ঞাতে নিজে নিজে প্রস্তুতি নিয়ে গিলক্রিস্ট বৃত্তি লাভ করলেন। গিলক্রিস্ট এডুকেশনাল ট্রাস্ট হল একটি ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান যা শিক্ষা অনুদান দেয়। সম্ভবত ১৮৬৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত গিলক্রিস্ট এডুকেশনাল ট্রাস্ট পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে শিক্ষা ও শিক্ষার প্রসারের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত নাম ছিল।
তিনি পাড়ি দিলেন স্কটল্যান্ডের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যয়নের বিষয় রসায়ন। রসায়নকে পড়াশুনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করলেও ইতিহাসচর্চা ছিল তাঁর স্বভাবজাত। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন ১৮৮৫ সালে সেখানকার রেক্টর স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট ছাত্রদের থেকে একটি প্রবন্ধ আহ্বান করেন। প্রবন্ধের বিষয় নির্দিষ্ট ছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা’। ঘোষণা করা হয় সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধের জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন,
‘তখন আমি ল্যাবরেটরিতে বিশেষ পরিশ্রম করিতেছিলাম এবং বি. এসসি. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। তৎসত্ত্বেও আমি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় যোগ দিলাম। আমার ইতিহাসচর্চার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পুনরায় জাগ্রত হইল এবং কিছুকালের জন্য রসায়নশাস্ত্রের স্থান অধিকার করিল।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে প্রফুল্লচন্দ্র ইতিহাস এবং পলিটিক্যাল ইকোনমি বিষয়ক বহু বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করলেন, লিখলেন প্রবন্ধ, শিরোনাম ‘India Before and After the Mutiny’. তাঁর প্রবন্ধটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। পরীক্ষকরা মন্তব্য করেছিলেন,
‘ … একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ যেটিতে মটো আছে। … ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইহা শ্লেষপূর্ণ আক্রমণে পূর্ণ।’
নিজের প্রবন্ধ সম্পর্কে প্রফুল্লচন্দ্র কি লিখেছিলেন তাঁর পরবর্তী জীবনে?
‘তৎকালে ‘ভিক্ষা নীতি’তে আমি বিশ্বাসী ছিলাম এবং শিশুসুলভ সরলতার সহিত আমি ভাবিতাম যে, ভারতের দুঃখ দুর্দশার কথা যদি ব্রিটিশ জনসাধারণের গোচর করা যায় তাহা হইলেই সেগুলির প্রতিকার হইবে। আমার এই মোহ ভঙ্গ হইতে বেশী দিন লাগে নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নাই যে, প্রভুজাতি স্বেচ্ছায় পরাধীন জাতিকে কোনো কিছু অধিকার দিয়াছে।’
এডিনবরা থেকে ডি এসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে মাসিক ২৫০ টাকা মাইনের চাকরিতে যোগদান করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। বিপ্লবী অভিধায় তিনি ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়ে গেছেন, ফলে Imperial Service এ চাকরি তাঁর জুটল না, সন্তুষ্ট থাকতে হল Provincial Service-এর শিক্ষকতায়।
১৮৮৯ সালে প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান করেন। ১৮৯৪ সাল, যোগদানের পর বছর পাঁচেক অতিক্রান্ত হয়েছে। নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে কলেজে, এ ব্যাপারে তাঁকে অকুণ্ঠ সাহায্য করেছেন চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী। এই সময়ে তিনি তাঁর কাজকে দুটি অংশে ভাগ করে নিয়েছেন, অধ্যয়ন ও ল্যাবরেটরিতে গবেষণা। অধ্যয়নের অন্যতম বিষয় ছিল রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস এবং প্রসিদ্ধ রসায়নবিদদের জীবনী। প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরি থেকে পাঠ করলেন নানা বই। জার্মান বিজ্ঞান ঐতিহাসিক Kopp-এর লেখা বই ‘Geschichte’, উদয়চাঁদ দত্তের ‘Mareria Medica of the Hindus’, মার্সেলিন বার্থেলোর L’ Alcheimistes Grecs. এতে প্রাচীন রসায়নচর্চার বিষয়ে তাঁর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। মার্সেলিন বার্থেলোকে চিঠি লিখলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রফুল্লচন্দ্র লিখলেন,
‘আপনি বোধ হয় জানেন না যে, প্রাচীন ভারতবর্ষেও অ্যালকেমি শাস্ত্রের চর্চা হ’ত এবং এ বিষয়ে সংস্কৃতে বহু বই আছে।’
বার্থেলো উত্তরে লিখলেন,
‘আপনার গবেষণার চিত্তাকর্ষক ফলাফলের সংবাদে পুলকিত হইলাম। ইউরোপ এবং আমেরিকার ন্যায় এশিয়া খণ্ডেও যে বিজ্ঞানের সার্বভৌম এবং বিশুদ্ধ রূপের সমাদর ও চর্চা চলিয়াছে তাহা জানিয়া আনন্দ হইল।’
এই উত্তর প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনে অসাধারণ প্রেরণা ও উন্মাদনার সঞ্চার করেছিল। বার্থেলোর অনুরোধে প্রাচীন রসায়নগ্রন্থ ‘রসেন্দ্রসারসংগ্রহ’-এর ভূমিকার উপর নির্ভর করে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠালেন তাঁকে। বার্থেলো সেই প্রবন্ধ পড়ে Journal des Savants পত্রিকায় এক বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখলেন। ওই মুদ্রিত প্রবন্ধের একটি কপি এবং সিরিয়া, আরব ও মধ্যযুগের রসায়ন সম্বন্ধে তিন খণ্ডে সংকলিত তাঁর বিপুল গ্রন্থ পাঠালেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। প্রফুল্লচন্দ্র সাগ্রহে পড়লেন সেই বই, সংকল্প করলেন তিনিই লিখবেন প্রাচীন ভারতের রসায়নের ইতিহাস। এটাকে তিনি মনে করেছিলেন, ‘self-imposed job’. কাজের বিপুলতার কথা ভেবেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, কিন্তু বিচলিত হননি। ভান্ডারকর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বার্নেল প্রমুখের লেখা সংস্কৃত পুঁথির বিবরণ পাঠ করে শুরু করলেন রসায়ন বিষয়ে বিভিন্ন হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহের। ভারতবর্ষের বিভিন্ন গ্রন্থাগার এবং লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসের লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত যেমন কাশী (বেনারস), কাশ্মীর, এমনকি প্রতিবেশী দেশ নেপাল থেকেও পুঁথি আনানো হয়েছিল। প্রফুল্লচন্দ্রকে সংস্কৃত পুঁথির পাঠ উদ্ধারে সাহায্য করতেন পণ্ডিত নবকান্ত কবিভূষণ। বিপুল পড়াশুনা ও গবেষণার পর ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয় ‘A History of Hindu Chemistry’-র প্রথম খণ্ড, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ১৯০৪ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেশে বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয় এই গ্রন্থ। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে।
বিখ্যাত গ্রন্থ A History of Hindu Chemistry
হিন্দু রসায়নের ইতিহাস বইয়ের প্রথম খণ্ডে একটি পরিচ্ছেদ লিখেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র যার শিরোনাম ছিল ‘Knowledge of Technical Art and Decline of Scientific Spirit’
প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন,
The arts being thus regulated to the low castes and the professions made by hereditary, a certain degree of fineness, delicacy and deftness in manipulation was no doubt secured but this was done at a terrible cost. The intellectual portion of the community being thus withdrawn from the active participation in the arts, the ‘how and why’ of phenomena — the Co-ordination of cause and effect — were lost sight of — the spirit of enquiry gradually died out among a nation naturally prone to speculation and metaphysical subtleties and India for once bade adieu to experimental and inductive sciences. Her soil was rendered morally unfit for the birth of a Boyle, a Des Cartes or a Newton and her very name was all but expunged from the map of the scientific world.’
‘এইভাবে শিল্পকলাগুলি নিম্ন বর্ণের এবং বংশানুক্রমিকভাবে তৈরি করা পেশাগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সূক্ষ্মতা, এবং কারিগরি দক্ষতা নিঃসন্দেহে সুরক্ষিত ছিল তবে এটি ভয়ঙ্কর মূল্য দিয়ে করা হয়েছিল। এইভাবে সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবী অংশটিকে শিল্পকলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে ঘটনার ‘কীভাবে এবং কেন’—কারণ এবং প্রভাবের সমন্বয় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে—অনুসন্ধানের চেতনা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেছে। এই জাতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জল্পনা-কল্পনা এবং আধিভৌতিকপ্রবণতা আছে—ভারত পরীক্ষামূলক এবং প্রবর্তক বিজ্ঞানকে বিদায় জানায়। তার মাটি বয়েল, ডেসকার্টেস বা নিউটনের জন্মের জন্য নৈতিকভাবে অনুপযুক্ত ছিল—তার নামটি বৈজ্ঞানিক বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। [অনুবাদ সম্পাদকের]
নানা শিল্পকর্ম বা কারিগরী কাজকর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিচু জাতের লোকেদের কাজ। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বংশগত পেশা। এর চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের। সমাজের চিন্তাশীল মানুষেরা হাতে কলমে কাজ করা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল। ফলে কোন জিনিস কেন হয়, কেমন করে হয়—এসব ভাবনাচিন্তা আর কাজ করেনি। পরীক্ষানির্ভর বিজ্ঞান থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়েছে ভারতবর্ষের সমাজ। এই কারণেই এদেশের মাটিতে একজন বয়েল, একজন দেকার্ট বা একজন নিউটনের জন্ম হয়নি।
Rasārṇava (রসার্ণব) গ্রন্থের প্রচ্ছদ
বেদান্ত এবং শংকরের মায়াবাদকে কখনোই মেনে নিতে পারেননি প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর মতে মায়াবাদ ভারতবর্ষের প্রাচীন বিজ্ঞানচর্চার ধারাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
‘The Vedant philosophy, as modified and expanded by Samkara, which teaches the unreality of the material world, is also to a large extent responsible for bringing the study of physical science into disrepute.’
‘বৈদান্তিক দর্শন, শঙ্করের দ্বারা পরিবর্তিত এবং সম্প্রসারিত হয়, (এই দর্শন) বস্তুজগতের অবাস্তবতা শেখায়, ভৌত বিজ্ঞানের অধ্যয়নকে অসম্মানিত করার জন্যও অনেকাংশে দায়ী।’ [অনুবাদ সম্পাদকের]
শুধুমাত্র রসায়নের ইতিহাসই নয়, সাহিত্যের ইতিহাস চর্চায় প্রফুল্লচন্দ্রকে আমরা পেয়েছি। সাময়িক পত্র বসুমতী এবং প্রবাসীতে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারা’ এবং ‘অসমীয়া গদ্যসাহিত্যের প্রাচীনত্ব’। এই দুটি লেখা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিলে প্রফুল্লচন্দ্রের ইতিহাসচেতনার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারা প্রবন্ধের শেষ অংশে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন,
‘বাঙ্গালার ধারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই, অন্ত:বিদ্রোহ, বহি:শত্রুর আক্রমণ, অত্যাচার, লুণ্ঠন প্রভৃতি প্রশমিত হইয়া দেশে শান্তি সংস্থাপিত হইলে এবং রাজা রাজকার্যে, প্রজা রাজসেবায় মনোনিবেশ করিলে দেশবাসী নি:শঙ্ক হৃদয়ে, নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে, শান্ত-সুস্থমনে জড় মস্তিষ্কের অন্ধকার কোনে প্রতিভার রোশনাই ফুটাইয়া তুলেন। সেই সময় জাতীয় বিনষ্ট লুপ্ত মানসিক শক্তি পুনরায় বিকশিত হইয়া উঠে।…বিভিন্ন মত ও তজ্জনিত রাজনীতিক উৎপীড়নে ইংল্যান্ডেও এইরূপ মানসিক শক্তির বিকাশ পরিলক্ষিত হইতেছে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের অবস্থা আমাদের মতই শোচনীয় ছিল। ধর্মমত অনুদার, সীমাবদ্ধ এবং দেশাচার ও বাহ্য আড়ম্বরে বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল। দেশবাসী ক্রীড়াপুত্তলিকাবৎ ধর্মযাজক পাদ্রীদিগের নিয়ম-ব্যবস্থা অকুণ্ঠচিত্তে মানিয়া চলিত। এইরূপে দেশের স্বাধীন চিন্তাশক্তি তিরোহিত হইলে দর্শন-পুস্তকগত কবিতা প্রাণহীন হইল। তাহার পর অষ্টম হেনরী ও তাঁহার দুহিতা রাণী এলিজাবেথের রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে যুগান্তর উপস্থিত হইল। দেশবাসীর বিনষ্ট প্রতিভা পুনরুদীপ্ত হইয়া উঠিল। … এক কথায় বলিতে গেলে মানসিক জড়তা বিদূরিত হইল।’
অসমীয়া গদ্যসাহিত্যের প্রাচীনত্ব প্রবন্ধে লিখলেন,
‘মূলকথা এই যে অসমীয়া ও বাঙ্গালা ভাষা মৈথিলী, প্রাকৃত, সংস্কৃত, মাগধী প্রভৃতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত। ইহারা ভগ্নীভাষা ও সোদরা, সুতরাং সাদৃশ্য ও নিকট সম্পর্ক থাকা একান্ত স্বাভাবিক; কেহ কাহারও উপভাষা নহে। অবশ্য বাঙ্গালা ও আসামের মধ্যে পরস্পর সংযোগ সম্বন্ধ ছিল ও ভাবের আদানপ্রদান হইয়াছে।‘
আজীবন এই ইতিহাসপ্রীতি তাঁর জীবনে বলবৎ ছিল, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় শেক্সপিয়রের সাহিত্য বিষয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখলেন ‘Shakespearean Puzzle-Endeavour after its solution.’ এখানেও চরিত্রগুলির বিশ্লেষণে সমকালীন ইতিহাসকে সঙ্গী করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের চর্চায় যুক্ত থেকেও তাঁর এই ইতিহাসপ্রীতি ও ইতিহাসচেতনা আমাদের বিস্মিত করে।
সাহায্যকারী সূত্র:
১. আত্মচরিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১১.
২. প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১২.
৩. ঐতিহ্য উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র, শ্যামল চক্রবর্তী, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৯.
৪. India Before and After the Mutiny, Prafullachandra Ray, RKBK Acharya Prafulla Chandra Sammilanee, 1991.
৫. A History of Hindu Chemistry, Prafullachandra Ray, Centenary Edition, Shaibya, 2002.
এই নিবন্ধটি পড়িয়া অনেক বিষয় জানিলাম। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিষয়ে ভাসাভাসা ধারণা ছিল। ইহা পড়িয়া অনেকটাই জানিলাম বোধ হইতেছে। কিন্তু ইহাও বুঝি, তাহা একপ্রকার প্রগলভতা। যাহাই হউক, আচার্য লিখত এ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমেস্ট্রি সংযুক্ত – ১ম ও ২য় ভ্যলিউম- বঙ্গানুবাদ কী পাওয়া যায়। পাওয়া গেলে কোথায় খোঁজ করিব জানাইলে বিশেষ উপকৃত হইবো।
A History of Hindu Chemistry দুটি খন্ডের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ হয়নি। কোথাও কোথাও কোনো বিক্ষিপ্ত অংশের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।