সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পরিবেশের ক্রমাবনতি — মানুষই কি দায়ী?

পরিবেশের ক্রমাবনতি — মানুষই কি দায়ী?

প্রদীপ কুমার সেন

আগস্ট ১১, ২০২০ ১০৫৫ 1

(১)

পৃথিবীর পরিবেশ যে এক গভীর সংকটের সম্মুখীন, এবং এর জন্য মানবজাতি যে প্রধানত দায়ী, এবিষয়ে সন্দেহ নেই। তথাকথিত সভ্যতার প্রয়োজন মেটাতে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় করে চলেছি, দূষণের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে চলেছি, জীববৈচিত্র্যের ক্রমাবনতি ঘটিয়ে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে পদে পদে বিঘ্নিত করে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চিত করে তুলছি।

কিন্তু এটা কি শুধু একটা সাম্প্রতিক ঘটনা? আসলে মানবসভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে এসেছে। অবশ্য, শুরুতে তার ঊদ্দেশ্য ছিল প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল করা। কিন্তু এই প্রচেষ্টার ফলে, ইচ্ছাকৃতভাবে না হলেও, সে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আজকের মূল্যায়নে সেই পরিবর্তন প্রায়শই অশুভ।

এখানে আমরা মূলত জীববৈচিত্র্যের দিকটিই আলোচনা করব। অবশ্যই এর উপর পরিবেশের অন্যান্য দিকগুলিও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

এক সময় পৃথিবীতে ছিল অতিকায় ডাইনোসরদের রাজত্ব। প্রায় ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে তারা হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। উত্তরসূরী হিসেবে রেখে যায় নানা প্রজাতির পাখি। ডাইনোসরদের সঙ্গে আরও অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতিও পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে চিন্তা করছেন। এখনও ঐকমত্যে পৌঁছনো সম্ভব না হলেও একটি গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সঙ্ঘাতের ঘটনা অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে আসছে। কারণ যা-ই হোক, মানুষের এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকা নেই — কারণ, মানুষের আবির্ভাব তখনও সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে।

এই গোষ্ঠীতে আদি মানুষের আবির্ভাব ও ক্রমবিকাশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। সংক্ষেপে, দু’লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় হোমো সাপিয়েন্সের উদ্ভব হয়। সত্তর হাজার বছর আগে তারা ইউরেশীয় ভূখণ্ডে পদার্পণ করে এবং সম্মুখীন হয় মানুষের অন্য প্রজাতি নিয়নডার্থালদের, যাদের উদ্ভব পাঁচ লক্ষ বছর আগে। কারিগরী কুশলতায় উন্নততর হওয়ায় হোমো সাপিয়েন্সরাই প্রাধান্য লাভ করে। ঠিক কী ঘটেছিল জানা না, থাকলেও অন্তিম পরিণতি হল এই যে নিয়নডার্থালদের পৃথক অস্তিত্ব রইল না, এবং আজ দুই গোলার্ধে ছয় মহাদেপে হোমো সাপিয়েন্সই মানুষের একমাত্র প্রজাতি। যদিও জিনগত কারণে তাদের বিস্তর বৈচিত্র্য বর্তমান।

এজন্য আমরা এরপর ‘মানুষ’ বলতে হোমো সাপিয়েন্সকেই বোঝাব।

আফ্রিকা তথা এশিয়া ও ইউরোপের দক্ষিণাংশে ছড়িয়ে পড়ার সময় মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশে তেমন পরিবর্তন ঘটায় নি, বরং চেষ্টা করেছে নিজেকে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। এজন্য সে চেষ্টা চালিয়ে গেছে নিজের প্রকৌশলকে উন্নততর করতে। প্রকৃতি ও পরিবেশও শিখেছে এই নবতম অতিথিটির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে। দু’টি ঘটনা এই ধারায় পরিবর্তন আনে। প্রথম, মানুষের সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পদার্পণ। দ্বিতীয়, সাইবেরিয়া থেকে তৎকালীন যোজক বেয়ে মানুষের আলাস্কায় প্রবেশ।

(২)

ভূপৃষ্ঠের ৭১ শতাংশ আবৃত করে রেখেছে জলভাগ। এর ৯৬.৫ শতাংশ মহাসাগরগুলির দখলে। ফলতঃ পুর্ব গোলার্ধে এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকার সম্মিলিত ভূখণ্ড, আমেরিকার ভূখণ্ড আর অস্ট্রেলিয়া পরস্পর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়াও আছে মাদাগাস্কারের মত নানা দ্বীপ। এই বিচ্ছিন্নতা এই সব ভূখণ্ডে আলাদা আলাদা পরিবেশের বিকাশ ঘটিয়েছিল। এর ফলে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণীজগতের পৃথক পৃথক রূপ এখনও চোখে পড়ে। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা মাদাগাস্কারে পদার্পণকারী প্রথম ইউরোপীয়দের প্রথমেই অবাক করেছিল এই ‘আজব’ প্রাণী ও উদ্ভিদের দল।

উদ্ভিদের এবং প্রাণীর, বিশেষত স্থলচর প্রাণীর পক্ষে এই দুস্তর ব্যবধান অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। এমনকি জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষ বছর লেগেছে। এক্ষেত্রে তাদের একমাত্র ভরসা ছিল অভিযোজন, যা বিবর্তনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর ফলে কারো সামনের পা পরিবর্তিত হয়েছে সাঁতার কাটার জন্য (সীল) , আবার কারো শ্বাসরন্ধ্র মুখের সামনে থেকে চলে এসেছে উপরে (তিমি)। তাদের শরীরের কাঠামো হয়ে উঠেছে অনায়াসে জল কেটে এগোনোর জন্য উপযুক্ত।

মানুষ কিন্তু দীর্ঘ জলযাত্রার ক্ষমতা অর্জন করেছে অনেক কম সময়ে, এবং তার প্রধান সহায় ছিল কারিগরী কুশলতা। এই ঘটনার সূত্রপাত ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলির অধিবাসীদের মধ্যে। প্রথমে তারা জোড়াতালি দেওয়া ভেলা জাতীয় যানে অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ জলভাগ অতিক্রম করতে শেখে। অল্প সময়ের মধ্যে তারা উন্নততর জলযান নির্মাণ ও চালনায় দক্ষ হয়ে ওঠে। এরপর তারা নিয়মিতভাবে মাছ ধরা ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে গভীর সমুদ্রে যাতায়াত শুরু করে। এর ফলশ্রুতি হিসাবে আজ থেকে প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে মানুয অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে এসে ওঠে। তখন উত্তরে নিউগিনি ও দক্ষিণপূর্বে তাসমানিয়া দ্বীপ অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

প্রথমেই তারা সম্মুখীন হল এক প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশের। মনে রাখতে হবে তখনো মানুষ ছিল শিকারী-সংগ্রাহক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে তারা প্রায় রাতারাতি নিজেদের খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করল। এর আগেও তারা প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু কখনোই তারা পরিবেশে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় নি। প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করতে তারা বরং নিজেদের কারিগরী ও জীবনচর্যাকে পরিবর্তিত করেছে। কিন্তু মানুষের পদার্পণ অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটাল।

(৩)

অস্ট্রেলিয়ায় তখন মারসুপিয়াল বা অঙ্কগর্ভ প্রাণীদের রাজত্ব। এরা সামান্য সময় গর্ভধারণ করে অপুষ্ট ভ্রুণ প্রসব করে। শাবকগুলি মায়ের পেটে ঝোলানো থলিতে থেকে স্তন্যপান করে অবশেষে পরিণত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। ক্যাঙ্গারু ও ওপোসাম এই গোত্রের প্রাণী। এছাড়া আছে প্লাটিপাসের মতো মনোট্রিম বা স্তন্যপায়ী অণ্ডজ প্রাণীরা। এইসব অপরিচিত প্রাণী শুধু বিস্ময়কর নয়, সে সময় ছিল বিপজ্জনকও। কারণ সেদিন তাদের আকারও ছিল বিশাল। ছিল দু’মিটার উঁচু দু’শো কিলোগ্রাম ওজনের ক্যাঙ্গারু, আজকের বাঘের মাপে ভয়ঙ্কর অঙ্কগর্ভ সিংহ, উটপাখির চেয়ে বড় উড়ানহীন পাখি আর পাঁচ মিটার লম্বা ড্রাগন-হেন সরীসৃপ ও নানা সাপ। ডাইপ্রোটোডন ছিল বৃহত্তম অঙ্কগর্ভ, আকারে জলহস্তী সমতুল্য — দৈর্ঘ্যে তিন মিটার, উচ্চতায় দু’ মিটার আর ওজনে ২,৭৯০ কিলোগ্রাম।

আশ্চর্যের বিষয় হল, মানুষের সংস্পর্শে আসার দু-তিন হাজার বছরের মধ্যে এসব অতিকায় প্রাণী কর্পূরের মত ঊবে গেল। আজ তাদের অস্তিত্বের প্রমাণরূপে রয়ে গেছে শুধু কিছু জীবাশ্ম। এমনটা কিন্তু এশিয়া বা আফ্রিকায় ঘটেনি। এর কারণ কী?

অনেক গবেষকের বক্তব্য, এব্যাপারে মানুষের তেমন ভূমিকা নেই। প্রধান কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু মানুষকে বেকসুর খালাস দেওয়া যায় কি? মানুষের বিপক্ষে তিনটি প্রমাণ উল্লেখযোগ্য।

প্রথমতঃ, ৪৫,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় তেমন জোরালো কোনো প্রাকৃতিক টালমাটাল ঘটেনি যার ফল এত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী হতে পারে। আবহাওয়া বিপর্যয়ের মধ্যে আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল হিমযুগ, যা মোটামুটি একলক্ষ বছর অন্তর আসে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। মজার কথা হল, ডাইপ্রোটোডন পনের লক্ষ বছর, ডজনের ওপর হিমযুগ টিঁকে থেকেও অকস্মাৎ শেষ হিমযুগটা সামলে উঠতে পারল না, যেটা ছিল তুলনায় যথেষ্টই কমজোরি।

দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে স্থলচর ও জলচর দু’ধরণের প্রাণীর বিলুপ্তির সম্ভাবনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার স্থলচর প্রাণীদের ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটলেও সমীপবর্তী সামুদ্রিক জীবেরা বিপন্ন হয়নি। আর মানুষ যেহেতু মূলত স্থলচর, তার আগমন স্থলচর জীবদের প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক।

তৃতীয়তঃ, অস্ট্রেলিয়ার এই ঘটানাক্রম মোটেই তুলনারহিত নয়। বরং, মানুষের কোন নতুন অঞ্চলে প্রথম পদার্পণ, এবং তার অব্যবহিত পরই সেই অঞ্চলের প্রাণীকুলের বিরাট অংশের বিলুপ্তি — এই ঘটনাক্রমের বিভিন্ন স্থান ও কালে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এতবার ঘটেছে যে তাকে আর সমাপতন বলা চলে না। যেমন, নিউজিল্যান্ডের অতিকায় প্রাণীরা ৪৫,০০০ বছর আগেকার ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ কাটিয়ে দিব্যি টিঁকে ছিল। মাত্র ৮০০ বছর আগে মাওরিদের পদার্পণ ঘটল, আর তার শ’দুয়েক বছরের মধ্যে সবাই নিশ্চিহ্ন, মায় অর্ধেকের বেশি পক্ষীপ্রজাতি!

আরেকটি তুলনীয় ঘটনা সুমেরু সহাসাগরে র‌্যাঙ্গেল দ্বীপের ম্যামথ বা অতিগজদের অবলুপ্তি। দশ হাজার বছর আগে আর সব জায়গায় নিশ্চিহ্ন হয়েও এই দ্বীপে তারা দিব্যি দাপিয়ে বেড়াত। কাল হল চার হাজার বছর আগে দ্বীপে মানুষের অবতরণ। চোখের নিমেষে নিশ্চিহ্ন হল অতিগজেরা।

দু’টি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ঘটনায় মানুষ হাতেনাতে দোষী প্রমাণিত। দুটি ক্ষেত্রেই বিলুপ্ত প্রাণীটি পক্ষীগোত্রীয়।

মাদাগাস্কারের অধিবাসী গজপক্ষী বা এলিফ্যান্ট বার্ড ছিল উটপাখি, এমু বা কিউইর মত র‌্যাটাইট শ্রেণীর উড়ানহীন পাখি। সর্বকালের বৃহত্তম পাখি — উচ্চতা তিন মিটারের বেশি, ওজন ৭৩০ কিলোগ্রাম। মরিশাসের ডোডো পাখি তো আজ প্রবাদপ্রতিম। এই দু’টি পাখিই মানুষ শিকার করে শেষ করেছে ৩০০-৩৫০ বছর আগে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে আমেরিকা ভূখণ্ডে মানুষের পদার্পণ প্রসঙ্গে।

(৪)

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আশা করি একথা স্পষ্ট হয়েছে যে অস্ট্রেলিয়া ভূখণ্ডে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য মানুষকে দোষী ভাবার যথেষ্ট কারণ বর্তমান। এই বিপর্যয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছিল এবং ফলত খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু এই বিরাট বিপর্যয় ঘটল কীভাবে। নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও তিনটি সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে, যার একটি, দুটি বা হয়ত তিনটিই বাস্তবে ঘটেছিল।

অতিকায় জীবপ্রজাতিগুলির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল নিম্ন প্রজননহার, দীর্ঘ গর্ভধারণকাল ও প্রসবপ্রতি ন্যূনতম শাবকসংখ্যা। এর ফলে একটিমাত্র পশুর — বিশেষত স্ত্রী-পশুর মৃত্যু পুরো প্রজাতির জনসংখ্যার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদি কয়েক মাস অন্তর একটি করেও পশু মারা যায়, অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুহার জন্মহারকে ছাপিয়ে যাবে — জনসংখ্যাতত্ত্বের নিয়মে যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি— প্রজাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি।

পরের প্রশ্ন, প্রস্তরযুগের প্রকৌশল নিয়ে ক্ষীণবল মানুষ কীভাবে এই দৈত্যাকার প্রাণীদের হত্যা করতে সক্ষম হত? আসলে তার প্রধান অস্ত্র ছিল চমক। কুড়ি লক্ষ বছর ধরে এশিয়া ও আফ্রিকায় আদি মানুষ, অর্থাৎ হোমো সাপিয়েন্স এর পূর্বপুরুষেরা বিশাল জন্তুদের শিকার করে এসেছে। সময়ের সঙ্গে শিকারীর কৌশল যেমন উন্নত হয়েছে, তেমনই শিকারও শিখেছে পলায়নের কৌশল।

অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু দৈত্যাকার পশুরা প্রথম সাক্ষাতে মানুষকে বিপজ্জনক বলে বুঝতেই পারে নি। যখন বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, মানুষ ইতিমধ্যে আগুনকে পোষ মানিয়েছে। আগুন যেমন পশুদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখতে সাহায্য করেছে তেমনি সাহায্য করেছে বৃক্ষাকীর্ণ অরণ্যকে পুড়িয়ে উন্মুক্ত তৃণভূমিতে পরিণত করতে। এভাবে পশুরা তাদের স্বাভাবিক বাসভূমি ও খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে খাদ্যশৃঙ্খল। অন্য অনেক গাছ নিশ্চিহ্ন হলেও ইউক্যালিপটাস গাছের ব্যাপক বিস্তার ঘটে, কারণ এই গাছ বিশেষভাবে অগ্নিসহ। আবার কোআলা, যাদের একমাত্র খাদ্য ইউক্যালিপটাস পাতা, তারা বেঁচে গেল।

তবে আবহাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। বরং মনে হয় মানুষের অভিযান যাদের খাদের কিনারায় এনে ফেলেছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদের শেষ ধাক্কাটা দেয়।

হয়ত সবগুলি কারণ সমান্তরালভাবে সক্রিয় ছিল। যাই হোক, এমনটা কিন্তু আফ্রিকা ও এশিয়ায় ঘটেনি। মূল পার্থক্য – আকস্মিকতা।

এবার আলোচনা করব আমেরিকা ভূখণ্ডে মানুষের পদার্পণ এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর তার চিরস্থায়ী প্রভাব।

(৫)

স্কুলে পড়েছি, ইতালীয় পর্যটক ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের রানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার করেন। আসলে তিনি পৌঁছেছিলেন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। পরবর্তী দু’টি অভিযানে তিনি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে অবতরণ করেন।

আসলে, তাঁরও প্রায় ৫০০ বছর আগে ১০০০ সালে নরওয়ের ভাইকিং নাবিক লেইফ এরিকসন ক্যানাডার পূর্ব উপকূলে নিউফাউন্ডল্যান্ডে নোঙর ফেলেন। অল্পদিন থেকেই তাঁকে ফিরে আসতে হয়, কারণ স্থানীয় অধিবাসীদের বৈরিতা।

কলম্বাসও স্থানীয় অধিবাসীদের দেখা পেয়েছিলেন। নতুন আবিস্কৃত ভুখণ্ডকে ভারতের অংশ ভেবে তিনি এদের ‘ভারতীয়’ আখ্যা দেন। আজও সাধারণ মার্কিনীরা আমেরিকার যে কোনও আদিবাসীকেই ‘ইন্ডিয়ান’ নামে চিহ্নিত করেন।

কলম্বাস প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাবিকেরা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে নতুন দেশে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য বসতি স্থাপন ও সাম্রাজ্য বিস্তার। ক্রমে স্পষ্ট হয় দেশটা ভারত নয়, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক নতুন দেশ। সর্বত্রই তাঁরা সম্মুখীন হন স্থানীয় মানুষদের। তারা কেউ পড়ে আছে প্রস্তরযুগে, আবার কেউ গড়ে তুলেছে কৃষি ও নগরনির্মাণ সমৃদ্ধ উন্নত সভ্যতা। উন্নততর অস্ত্র ও নিষ্ঠুরতা ও শঠতার সহায়তায় নবাগতরা কিছুদিনের মধ্যে এই ‘অসভ্য’ মানুষদের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী পদানত ‘সভ্য’ মানুষে পরিণত করে। আপাতত সেই লজ্জাজনক ইতিহাস এখানে আমাদের আলোচ্য নয়।

কেবল একটি প্রশ্ন। এই আদিবাসী মানুষেরা কারা? কোথা থেকে, কেন আর কীভাবে তারা এল এখানে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে সহজ, যদিও তার যাথার্থ্য প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন যে হাতিয়ার, অর্থাৎ জিনপ্রযুক্তি, তার উপযুক্ত বিকাশের জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় এই আদিবাসীরা আদি অকৃত্রিম হোমো সাপিয়েন্স।

কোথা থেকে এল? এল উত্তর এশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তারা কেন এসেছিল সেই পাণ্ডববর্জিত হিমশীতল সাইবেরিয়ায়?

অপেক্ষাকৃত শীতসহিষ্ণু হয়েও নিয়ানডার্থালরা যেখানে নিজেদের নাতিশীতোষ্ণ বলয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছিল, সেখানে আদিতে আফ্রিকার উষ্ণ সাভানা অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েও সাপিয়েন্সরা কেন শীতবলয়ে পাড়ি দিল?

হতে পারে, যুদ্ধে হেরে দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুদের তাড়া খেয়ে তারা আরো উত্তরে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। হতে পারে জনসংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় শিকার ও সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট প্রাকৃতিক রসদের অভাব হয়েছিল। আবার এ-ও হতে পারে সাইবেরিয়ায় ম্যামথ, বল্গাহরিণ ইত্যাদি পশুর প্রাচুর্য তাদের মনে সুস্বাদু প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্যের লোভ জাগিয়েছিল। শিকারের মাংসবহুল দেহ এবং সেই মাংস দীর্ঘদিন টাটকা রাখার সহায়ক শৈত্য — সবই সম্ভবত তাদের আকর্ষণ করেছিল।

অল্পদিনের মধ্যেই শিকারের লোমশ চামড়ার সদ্ব্যবহার করে তারা বরফে চলার উপযুক্ত পাদুকা এবং পোষাক উদ্ভাবন ও তার ব্যাপক উন্নতিসাধন করল। এই মানবগোষ্ঠীই কালক্রমে আমেরিকা ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন করে — আজ থেকে ১৬,০০০ বছর আগে।

এখন সাইবেরিয়া পূর্বপ্রান্ত আর আমেরিকার উত্তরসীমাস্থ আলাস্কার পশ্চিমপ্রান্তকে আলাদা করে রেখেছে বেরিং প্রণালী। এর ন্যূনতম প্রস্থ ৮৫ কিমি এবং গভীরতা ৩০-৫০ মিটার। কিন্তু আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন এই অঞ্চলে জলের গভীরতা অনেক কম ছিল, এমনকি দু’টি ভূখণ্ড এক প্রাকৃতিক সেতু দ্বারা যুক্ত ছিল। এই সেতু পদব্রজে অতিক্রম করে মানুষ প্রথম পা রাখে আলাস্কার মাটিতে (বরং বলা ভাল বরফে)। হাজার কয়েক বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে তিয়েরা দেল ফুয়েগো দ্বীপ পর্যন্ত বসতি স্থাপন করল, ছড়িয়ে পড়ল উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম থেকে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত — এমনকি আটলান্টিক মহাসাগরের কিউবা, হাইতি ও অন্যান্য ক্যারিবীয় দ্বীপসমুহে।

এখানকার অপরিচিত পরিবেশের মোকাবিলা তারা কীভাবে করল, কীভাবে সফল হল, তা-ই পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনার বিষয়বস্তু।

(৬)

১৬,০০০ বছর আগে মানুষ উত্তরপূর্ব সাইবেরিয়া থেকে বরফসেতু পেরিয়ে আলাস্কায় প্রবেশ করে। কথাটা শুনতে যত সহজ, মোটেই তত সহজ ছিল না। বরং মনে হয় জলপথে অস্ট্রেলিয়া অভিযানের চেয়ে কঠিন ছিল এই যাত্রা। ম্যামথ, তার বড়দাদা মাস্টোডন, বল্গা হরিণ ও গণ্ডারদের অনুসরণ করতে করতে একদল মানুষ অজান্তেই এসে পড়ে নতুন জগতে। তারা হয়ত ভেবেছিল এ-ও তাদের পরিচিত সাইবেরিয়ারই বর্ধিত অংশ, যেমনটা ছিল ম্যামথদের কাছে। কিন্তু আপাতত তারা দক্ষিণদিকে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না। বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশাল সব হিমবাহ।

হাজার দুই বছর ধরে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলশ্রুতি হিসাবে হিমবাহের বরফ গলে একটি পথ উন্মুক্ত হয়। দলে দলে মানুষ সেই পথ ধরে দক্ষিণ দিকে রওনা হয়। সেই যাত্রা শেষ হয় তিয়েরা দেল ফুয়েগো পৌঁছে। এর মধ্যে নানা দল ছড়িয়ে পড়েছে দিগ্বিদিকে। পূর্ব আমেরিকার অরণ্যভূমি থেকে মিসিসিপি সঙ্গমের জলাভূমি, আন্দিজের পাহাড়ি উপত্যকা থেকে মধ্য আমেরিকার গহন বন, মেক্সিকোর মরুভূমি থেকে আর্জেন্টিনার পাম্পাস তৃণভূমি — নানা বিচিত্র পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তারা বসতি স্থাপন করেছে। আর এটা ঘটেছে মাত্র এক থেকে দু’হাজার বছরের মধ্যে।

পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রামে মানুষের এই বিজয় একেবারেই রক্তপাতহীন ছিল না। আজকের তুলনায় ১৪,০০০ বছর আগেকার আমেরিকা ভূখণ্ডের প্রাণীজগৎ ছিল অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ তখন এই অঞ্চলে দেখা যেত, যারা আজ সবাই অদৃশ্য। ম্যামথ আর ম্যাস্টোডন তো ছিলই, আরও ছিল ঘোড়া ও উটের পাল, প্রকাণ্ড সিংহ, এ রকম নানা অচেনা প্রাণী। ছিল অসিদন্ত বিড়াল আর দৈত্যাকৃতি ভূচর স্লথ মাইলোডন — ছ’মিটার উঁচু আর ওজনে আট টন। দক্ষিণ আমেরিকায় ছিল আরও বহু বিচিত্র স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও পাখি। সারা আমেরিকা ভূখণ্ড জুড়ে যেন ছিল বিবর্তন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার এক সুবিশাল গবেষণাগার, যেখানে এশিয়া বা আফ্রিকায় অজ্ঞাত বিচিত্র গাছ ও পশুপাখি উদ্ভূত ও বর্ধিত হত।

কিন্তু মানুষের আগমনের মাত্র দু’হাজার বছরের মধ্যে অতিকায় প্রাণীরা সবাই তো বিদায় নিলই, এমনকি ছোট পশু, পাখি, পতঙ্গ ও পরজীবীদের বহু প্রজাতিও পার পেল না। ম্যামথ, অসিদন্ত বিড়াল, স্থানীয় ঘোড়া ও উটেদের সাথে বিলুপ্ত হল মাইলোডন ও অন্যান্য অতিপ্রাণীরা।

এই বিলুপ্তির কারণ খুঁজতে গবেষকেরা পাহাড়-জঙ্গল চষে ফেলেছেন এসব প্রাণীর জীবাশ্মীভূত হাড় ও পুরীষপিণ্ডের সন্ধানে। সামান্য যা নমুনা মিলেছে সবই ১২,০০০ থেকে ৯,০০০ বর্তমানপূর্বাব্দ – এই সময়সীমার মধ্যেকার। আর এই সময়কালেই মানুষ আমেরিকা ভূখণ্ডের দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। আবার, কিউবা ও হিসপানিওলায় এজাতীয় সাম্প্রতিকতম নিদর্শনের সময়কাল নির্ধারিত হয়েছে ৫,০০০ বর্তমানপূর্বাব্দ, আর মোটামুটি এই সময়েই মানুষ ক্যারিবীয় সাগর পার হয়ে এই দ্বীপ দু’টিতে বসতি স্থাপন করে। জ্যামিতিক প্রমাণের অনুকরণে বলতে হয় ‘ইহাই উপপাদ্য বিষয়।’ কিংবা ওকালতি জবানে ‘I rest my case.’

অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় মানুষের প্রথম পদার্পণ প্রকৃতি ও পরিবেশে যে বিপর্যয় ঘটিয়েছিল তা এজাতীয় একমাত্র ঘটনা নয়। পরবর্তী কালে এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। তারা ব্যাপ্তি ও অভিঘাতের বিচারে প্রথম দু’টির তুলনীয় না হলেও ইতিহাসের সেই প্রবাদ কথিত পুনরাবৃত্তি।

তথ্যসূত্র:

. Sapiens: A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari

. Quest for the origins of the first Americans by James E. Dixon.

. The Prehistory of Australia by D. J. Mulvaney

. World Prehistory: A Brief Introduction by Brian M. Fagan and Nadia Durrani.

৫. সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাল উৎস।

মন্তব্য তালিকা - “পরিবেশের ক্রমাবনতি — মানুষই কি দায়ী?”

  1. খুবই ভালো লাগলো আমি জীব-বিদ্যার ছাত্র
    ধন্যবাদ আপনাকে, “পৃথিবী কিশুধু মানুষের জন্য ”
    পড়েছি ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।