সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পরমেশ্বর হে—তৃতীয় পর্ব

পরমেশ্বর হে—তৃতীয় পর্ব

অতীন দাস

জানুয়ারি ১৮, ২০২৫ ৭৪ 1

প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি রাজার উপাধি হিসেবে পরমেশ্বের, ত্রিভুবন, এমনকী রাজার পদধূলি ইত্যাদি প্রথাগত হিন্দু ধর্মের সংস্কৃত ভাষার শব্দগুচ্ছ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইসলামিক দেশগুলিতে আজও প্রচলিত। দ্বিতীয় পর্বে বুঝতে চেয়েছি কেন ভারতীয় সভ্যতা গৃহীত হয়েছিল। তৃতীয় ও শেষ পর্বে দেখব হিন্দু সংস্কৃতি স্থানীয় বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে পরিবর্তিত রূপে গৃহীত হয়েছিল, ফলে পরবর্তীকালে ভিন্ন ধর্মীয় মতালম্বী দেশগুলিতে (বিশেষ করে ইসলামিক ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে) ভারতীয় সংস্কৃতি আজও টিকে আছে—পরিবর্তিত রূপে।

১। হিন্দু সংস্কৃতির পরিবর্তন ও গ্রহণ

ফ্রেডরিক এবং ওয়র্ডেন সম্পাদিত ‘ইন্দোনেশিয়া এ কান্ট্রি স্টাডি’ জানাচ্ছে—

যদিও ভারতের সংস্কৃতি জলবেষ্টিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছিল মূলত সংস্কৃত ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে বিদ্যমান, সমাজের অভিজাতরা জেনেছিলেন জাতপাত এবং মহিলাদের নিকৃষ্ট মর্যাদা প্রদানের মতো ভারতীয় ধারণার প্রতীকগুলি, মনে হয়, ইন্দোনেশীয় ঐতিহ্যের উপরে সামান্য বা আদপে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। (পৃ ৮)

পরিবর্তন ছাড়া কোথাও ভারতীয় সভ্যতা গৃহীত হয়নি, বরং, আরও বিস্তারিত ভাবে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার এবং পরিভাষাগুলি আদিবাসী ধারণাগুলিকে পরিমার্জিত করতে সাহায্য করেছে। এমনকী জাভাতেও ভারতীয় সংস্কৃতির বাহ্যিক প্রকাশগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে ইন্দোনেশীয় চেহারায় রূপান্তর করা হয়েছিল। জাভায় ছায়া পুতুল ব্যবহার করে নাটকের ঐতিহ্য, ভারতীয়করণের সময়কালে জটিল হিন্দু নাটক চিত্রিত করার ক্ষেত্রে পরিশীলিত উপস্থাপনার একটি নতুন স্তরে নিয়ে আসা হয়েছিল। এমনকী পরবর্তীকালে ইসলাম, যা মানুষের সচিত্র উপস্থাপনাকে উৎসাহ দেয় না—ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে অসংখ্য পরিমার্জনের মাধ্যমে ছায়া পুতুল নাটকের ঐতিহ্যে নতুন বিকাশ এনেছিল (ফ্রেডরিক এবং ওয়ার্ডেন, ১৯৯৩)।

হিন্দু সংস্কৃতির এইভাবে পরিবর্তিত হয়ে টিকে থাকার কিছু বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছে তাঁর ‘জাভা যাত্রীর পত্রে’ বইতে। রবীন্দ্রনাথ জাভা দর্শন করে লিখেছেন—

‘সমুদ্রপারের আত্মীয়-বাড়িতে’ হিন্দু ভাবের ও রীতির সঙ্গে এদের জীবন কিরকম জড়িয়ে গেছে ক্ষণে ক্ষণে তার পরিচয় পেয়ে বিস্ময় বোধ হয়। অথচ হিন্দু-ধর্ম এখানে কোথাও অমিশ্র ভাবে নেই; এখানকার লোকের প্রকৃতির সঙ্গে মিলে গিয়ে সে একটা বিশেষ রূপ ধরেছে; তার ভঙ্গীটা হিন্দু, অঙ্গটা এদের’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাভা-যাত্রীর পত্র, পৃ ৩৫, ১৯২৯)।


ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় পুতুলের ছায়া চিত্র প্রদর্শনী।

জাভার প্রদর্শনীতে পঞ্চ পাণ্ডব—বা দিক থেকে যথাক্রমে ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব। (সূত্র: উভয় চিত্র, ওয়েয়াং পাপেট থিয়েটার, কে গুনবান, উইকিমেডিয়া, ২০০৮।)

উক্ত গ্রন্থ থেকে একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দেওয়া যাক।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

এখানে আমরা প্রকাণ্ড একটা অন্ত্যেষ্টিসৎকারের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছি। মোটের উপরে এটা কতকটা চীনেদের মতো—তারাও অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়ায় এইরকম ধুমধাম সাজসজ্জা বাজনাবাদ্য করে থাকে। কেবল মন্ত্রোচ্চারণ প্রভৃতির ভঙ্গিটা হিন্দুদের মতো। দাহক্রিয়াটা এরা হিন্দুদের কাছ থেকে নিয়েছে। কিন্তু, কেমন মনে হয়, ওটা যেন অন্তরের সঙ্গে নেয় নি। হিন্দুরা আত্মাকে দেহের অতীত করে দেখতে চায়, তাই মৃত্যুর পরেই পুড়িয়ে ফেলে দেহের মমতা থেকে একেবারে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে। এখানে মৃতদেহকে অনেক সময়েই বহু বৎসর ধরে রেখে দেয়। এই রেখে দেবার ইচ্ছেটা কবর দেবার ইচ্ছেরই সামিল। এদের রীতির মধ্যে এরা দেহটাকে রেখে দেওয়া আর দেহটাকে পোড়ানো, এই দুই উলটো প্রথার মধ্যে যেন রফানিষ্পত্তি করে নিয়েছে। মানুষের মনঃপ্রকৃতির বিভিন্নতা স্বীকার করে নিয়ে হিন্দুধর্ম রফানিষ্পত্তিসূত্রে কত বিপরীত রকম রাজিনামা লিখে দিয়েছে তার ঠিকানা নেই। ভেদ নষ্ট করে ফেলে হিন্দুধর্ম ঐক্যস্থাপনের চেষ্টা করে নি, ভেদ রক্ষা করেও সে একটা ঐক্য আনতে চেয়েছে।

কিন্তু, এমন ঐক্য সহজ নয় বলেই এর মধ্যে দৃঢ় ঐক্যের শক্তি থাকে না। বিভিন্ন বহুকে এক বলে স্বীকার করেও তার মাঝে মাঝে অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলে দিতে হয়। একে অবিচ্ছিন্ন এক বলা যায় না, একে বলতে হয় বিভক্ত এক। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ ৩৫-৩৬, ১৯২৯)

৩। ইসলামীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতি

মামুদ শাহ না মহা মোক্ষ?

চিনাদের লিখিত নানা চিনা রাজকীয় এবং তাঁদের করদ রাজ্যের বর্ণনায় বহু তথ্যের সন্ধান দেয় যদিও স্বাভাবিকভাবেই কিছু অতিকথন ও অতিরঞ্জন দোষ মুক্ত নয় সেগুলি। এই রকম একটি রেকর্ড (মিং সিন, ৩২৫ নং) অনুযায়ী ১৩৭০ সালে পো-নি (ব্রুনেই) রাজ্যের শাসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মা-হো-মো-সা। একজন ঐতিহাসিক বলেছেন এটি সেরি ‘মহারাজা’-র বিকৃত রূপ। আবার ব্রুনেই মিউজিয়ামের কিউরেটার নিকল তাঁর গবেষণাপত্রে (১৯৮০) বলেছেন—এটি হবে ‘মহা মোক্ষ’- যা একজন বৌদ্ধ শাসকের উপযুক্ত নাম (অর্থাৎ এই শাসককে তিনি মুসলিম বলেও মনে করছেন না)। (রবার্ট নিকল, পৃ ৩৫, ১৯৮০)

একই সঙ্গে মহারাজা এবং সুলতান

উত্তর বোর্নিওর ব্রুনেইতে একজন শাসকের সমাধি-পাথর পাওয়া গেছে যিনি উপাধিতে আরবি (সুলতান) এবং সংস্কৃত (মহারাজা)—উভয়ই ব্যবহার করতেন যা সেই অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতিকেই প্রতিফলিত করে। আবদুল মজিদ হাসান ইবনি মুহাম্মদ শাহ ১৪০২ সালে ব্রুনেইয়ের সিংহাসনে বসেন, তাঁর অপর নাম ছিল মহারাজা কর্ণ। পূর্ব জাভাতে কিছু বিশেষ আকর্ষণীয় সমাধি-পাথর সংরক্ষিত আছে। এইগুলি প্রাক-মজপাহিত ইসলামি রাজ্যের নিকট ট্র্যাউলান এবং ট্রালায়ার কবরস্থানে পাওয়া। যদিও এগুলো নিঃসন্দেহে মুসলমানদের কবর, কিন্তু তারা আরবি সংখ্যা ব্যবহার না করে হিন্দু শক এবং প্রাচীন জাভানীয় পদ্ধতির তারিখ ব্যবহার করেছে।

তাই ইসলামীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে এখানে সংস্কৃতির মিশ্রণের প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। এই সমাধি-ফলক পাওয়া শুরু হয় ১৩৬৮-৬৯ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই পাথর সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণ করেছেন ফরাসি পণ্ডিত লুই-চার্লস—

তাদের সজ্জা দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দেয়, এইগুলি জাভার অভিজাত সদস্যদের সমাধি, এমনকী মজপাহিত রাজপরিবারের সদস্যদেরও হতে পারে। তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠীর, জাভাবাসীদের, ধর্মান্তরের ইঙ্গিত দেয়। ধর্মান্তর সমাজের একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু হয়েছিল। স্থানীয় স্তরে ধর্মান্তকরণের কারণ প্রাসঙ্গিক—জাদু-দেখিয়ে সুফিরা হিন্দু-বৌদ্ধ জাভার অভিজাতদের ধর্মান্তরিত করছেন- অতি সাধারণ ব্যবসায়ীরা নয়—চিত্রটি এভাবে ভাবা যায়। (রিকলেফ প্রমুখ, পৃ ৭৮-৭৯, ২০১০)।

মিশ্র সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাবাটন (১৯১৪) মন্তব্য করেছিলেন—

আজকের দিনে ডাচ ইস্ট ইন্ডিসে জনসংখ্যার ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ ইসলামের বিশ্বাসের দাবি করে—কাজে না হোক নামে।

৩.১ ইসলামের প্রসারের সময়

ইসলামিকরণের এই প্রাথমিক পর্যায়ের যে চিত্রটি আমরা পেয়েছি তা অবশ্যই খণ্ডিত, সমাধি ফলকের উপর নির্ভরশীল—যা ঘটনাক্রমে টিকে গেছে এবং কখনও কোনো ভ্রমণকারীর প্রতিবেদনে জানা গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে জানতে পারি বহু তথ্য যার উৎস টম পিরেস (Tome Pires) নামে পর্তুগিজ দর্শনার্থী দ্বারা কৃত সমগ্র মালয়-ইন্দোনেশিয়ান অঞ্চলের অমূল্য জরিপ। তিনি ১৫১১ সালে পর্তুগিজদের বিজয়ের ঠিক পরে ১৫১২-১৫১৫ সালে মলাক্কাতে ছিলেন। তিনি স্বয়ং জাভা এবং সুমাত্রা পরিদর্শন করেন এবং বাকি অঞ্চল সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন।

পিরেসের মতে, সুমাত্রার অধিকাংশ শাসক তখন মুসলমান ছিলেন, কিন্তু সুমাত্রার দক্ষিণ প্রান্ত এবং পশ্চিম উপকূলের মানুষ  তা ছিলেন না। পশ্চিম জাভা তখনও হিন্দু ছিল, কিন্তু মধ্য ও পূর্ব জাভার উত্তর উপকূলে ইসলামীকরণ হয়েছিল, সেখানকার রাজ্যগুলি প্রায়শই দেশের অভ্যন্তরে তখনও বিদ্যমান হিন্দু রাজাদের সঙ্গে (যেখানে এখনও মজপাহিত রাজ্যের শেষাংশ পূর্ব জাভার কেদিরিতে টিকে ছিল) যুদ্ধে লিপ্ত হত। পিরেস জাভার উত্তর উপকূলে দুটি প্রক্রিয়া দেখেছেন- স্থানীয় জনগণের ইসলামীকরণ এবং বিদেশি মুসলমান যারা সেখানে বাস করত তাঁদের জাভানীয়করণ। এইভাবে একটি সংস্কৃতির শিকড় ছড়িয়ে পরেছিল যা ছিল একযোগে জাভানীয় এবং ইসলামী। কালিমান্তানে (বোর্নিও) ব্রুনেই একাই ইসলামীয় হয়েছিল, অন্যান্য রাজ্যগুলি প্রাক-ইসলামিক পর্বে ছিল, যেমনটা বালি থেকে পূর্বদিক বরাবর দ্বীপমালাগুলিও ছিল কিন্তু মলাক্কাতে ‘মশলা দ্বীপ’ আকর্ষণ করেছিল ইউরোপীয়দের—সেখান শাসকদের থেকে ইসলাম সমাজে নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ইসলামের প্রভাব মালয়-ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন  হয়েছিল (মালয় সহ কয়েকটি উপনিবেশ নিয়ে ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের সৃষ্টি)। জাভাতে, যেখানে ইসলামের আগমনের কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই হিন্দু-বৌদ্ধ ‘উচ্চমানের সংস্কৃতি’ ভালোভাবে স্থান করে নিয়েছিল, সেখানে সংস্কৃতির মিশ্রণের  একটি প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল ছিল,  ইসলামীয় জাভার সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে প্রাক-ইসলামীয় বৈশিষ্ট্যগুলি। অধিকাংশ মালয়-ভাষী এলাকায়, সুমাত্রা, মালয় উপদ্বীপ এবং দ্বীপপুঞ্জের উপকূলীয় অঞ্চলে, প্রারম্ভিক বছরগুলিতে ইসলাম অধিকতর প্রভাব তৈরি করেছে।

ইসলামিকরণ একটি প্রক্রিয়া—নির্দিষ্ট ঘটনা নয় এবং এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে৷ ইসলাম চায় মুসলিম সমাজে গভীর শিকড় এবং বৃহত্তর প্রভাব। আগের কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলামিকরণের এই প্রক্রিয়া জাভার সমাজে ভালোভাবে ঘটেছিল। (টি পিরেস, পৃ ৮১, ১৯৪৪)

৪। ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম

প্রায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলাম ছড়িয়ে পরে বেশির ভাগ অংশে। স্থানীয় প্রভাব মিশে যায় আগত নতুন ধর্মে—যেমনটা ঘটেছিল হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম প্রথম প্রবেশের কালে। আমরা এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করব উদার একটিইসলামিক ধারার সৃষ্টির বিষয়ে। ধর্মীয় সংস্কৃতি বা তার গ্রহণ বা বর্জনে উদার এবং রক্ষণশীল দুটি অভিমুখ থাকা স্বভাবিক যার অজস্র সাক্ষর পৃথিবীতে পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার তার ব্যতিক্রম ঘটেনি- যদিও আগন্তুক ধর্মটি অনেকটাই আলাদা ছিল এই দেশের বিদ্যমান ধর্মের থেকে।

ইন্দোনেশিয়াতে ইসলামের প্রবেশের সঠিক সময় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও মোটামুটি ত্রয়োদশ শতকে ইসলামের প্রবেশ হিসেবে ধরা যায়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে দ্রুত প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যে জাভা এবং সুমাত্রার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম এসেছিল তার প্রচারকদের মাধ্যমে পশ্চিম ভারতের গুজরাট, মালাবার, আরবের হাদ্রামাউত থেকে। সাধারণভাবে শান্তিপূর্ণ পথেই ধর্মান্তকরণ ঘটেছিল। প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আসা ধর্ম বিষয়ের পণ্ডিতদের মাধ্যমে ইসলাম প্রবেশ করে, সাহায্য করে অভিজাতদের ধর্ম গ্রহণ ও রাজনৈতিক সংযোগ।

নতুন ধর্মের দ্বারা বিলুপ্ত হওয়ার পরিবর্তে, হিন্দু এবং অন্যান্য অ-মুসলিম উপাদানগুলি ঐতিহ্যগত নিয়ম, কবিতা, নৃত্য এবং সঙ্গীদের ধারায় সংস্থাপিত হয়ে ওঠে এবং বহু ধর্মান্তরিতদের, বিশেষ করে জাভাতে, ইসলামিক চিন্তা ও অনুশীলনে আকৃষ্ট করেছিল।

প্রারম্ভিক ইসলাম সুফি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং ষোড়শ শতাব্দীতে দ্বীপপুঞ্জের অনেক বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন সুফি অনুশাসনে বিশ্বাসী। পরবর্তী বছরগুলিতে, কাদিরিয়াহ এবং নকশবন্দিয়াহ-এর মতো সুফি চিন্তাধারাগুলি অনেক ইন্দোনেশীয়কে তাঁদের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। সুফির রহস্যবাদ এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতি তার সহনশীলতা দ্বীপগুলিতে ইসলামের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে, গোঁড়া হাদ্রামউত আরব পণ্ডিতরা ইসলাম সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন, এই ভাবে ইন্দোনেশিয়ার ইসলামের উপর বাহ্যিক প্রভাব পূর্বের ভারতীয় উপমহাদেশের কেন্দ্র থেকে মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও, রহস্যবাদ ইন্দোনেশিয়ান ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থেকে গেছে। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাইরের মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ অপেক্ষাকৃতভাবে কম ছিল। স্বাধীনতা, ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত জনসংখ্যা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধর্মীয় উন্নয়নের জন্য তহবিল, এবং ইসলামি বিশ্ব জুড়ে আরও সহজে ধারণাগুলির আদান-প্রদানের ক্ষমতা ইন্দোনেশিয়াকে আরও দৃঢ়ভাবে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। (মেহডেন, ১৯৯৫)

৪.১ সমসাময়িক ইন্দোনেশিয় ইসলামের চরিত্র

যদিও সমসাময়িক ইন্দোনেশীয় ইসলাম চরিত্রায়িত হয় তার একীভূত সর্বজনগ্রাহ্য সুন্নি শিকড়গুলির স্বীকৃতির দ্বারা, আবার এটিকে বিশ্বাস ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমদের দুইভাগে বিভক্ত ধরা হয়,

‘নামমাত্র’ মুসলিম—যারা অমুসলিম ঐতিহ্যের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং আর একটি হল ‘গোঁড়া’ যারা বিশ্বাস এবং অনুশীলনের একটি বিশ্বজনীন ছাঁচ অনুসরণ করে। প্রথম ভাগটিকে সাধারণত আবাঙ্গান হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যারা হিন্দু এবং অ্যানিমিস্ট উপাদান মিশ্রিত সুফী ধারায় আবদ্ধ থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং বিশেষ করে জাভাতে উদ্ভূত আচার এবং রহস্যবাদের সৃষ্টি করেছে। এদের সংস্কৃতিতে আচার অনুষ্ঠান, আত্মায় বিশ্বাস, প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি, হিন্দু শিল্প এবং অনুষ্ঠানের পদ্ধতি মুসলিম কর্মবিধির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শেষোক্ত গোষ্ঠী, যাকে সান্ত্রি বলা হয়, তারা নিজেদেরকে একটি ‘শুদ্ধতর’ বিশ্বাসের অনুসারী বলে মনে করে, তারা প্রার্থনা এবং উপবাসের মতো আচার-অনুষ্ঠানে আরও কঠোরভাবে পালন করে, অ্যানিমিস্টিক এবং রহস্যময় বিশ্বাস দ্বারা কম দূষিত হয়। (মেহডেন, পৃ ১৯৭-২০২, ১৯৯৫)

৪.২ ইন্দনেশিয়ায় ইসলামের দুটি ধারা—অবাঙ্গান এবং সান্ত্রি

১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি সুকর্ণো রাজনৈতিক কারণে সরকারিভাবে এবং আইনগতভাবে ছয়টি স্বীকৃত ধর্মের ঘোষণা করেন- যথা ইসলাম, প্রোটেস্ট্যান্টবাদ, ক্যাথলিক, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং কনফুসিয়ানিজম। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ধর্মের সংজ্ঞার ভিত্তিতে এদের নির্বাচন করা হয়েছে। সংজ্ঞাটিতে ধর্মের ন্যূনতম চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে—একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অধিকারী, একজন নবী, এক প্রভুত্বের নীতি এবং এর অনুসারীদের জন্য একটি আইন ব্যবস্থা।

১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরে, প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল অবঙ্গান। যদিও এই হত্যালীলা সান্ত্রিদের জন্য সম্পূর্ণ বিজয় নিয়ে আসেনি। গবেষক মুল্ডার (১৯৮৩) একমত যে অবাঙ্গানরা হল মূলত দেশীয় অ্যানিমিজম এবং হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে ইসলামের সমন্বয়ের ফসল। তিনি লিখেছেন—

১৯৬৫-৬৬ সালে সন্দেহভাজন অবাঙ্গান কমিউনিস্টদের হত্যা ইসলামের উপর ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। একদিকে, ইসলাম ধর্মে নিজেদের আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে, অনেকে আবাঙ্গান সুরক্ষার সন্ধানে, প্রোটেস্ট্যান্ট বা ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল। (মুল্ডার, পৃ ৬, ১৯৮০)

এটি লক্ষণীয় যে এই দুটি পরবর্তী ধর্ম নিজেদেরকে ‘ইসলামের আবির্ভাবের এবং উপনিবেশের অপমানজনক দিনগুলির আগের মজপাহিতের গৌরবময় দিনগুলির ধর্ম ও সংস্কৃতির জীবন্ত মূর্ত প্রতীক’ হিসেবে বিবেচনা করে। মুল্ডার আরও বলেছেন—

রহস্যবাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অবাঙ্গানদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার ইঙ্গিত দেয়… এমনকী নিজেদেরকে পরিসংখ্যান তালিকায় মুসলমান হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে গণ্য করতেও অস্বীকার করে। (মুল্ডার, পৃ ৭, ১৯৮০)

সান্ত্রি এবং অবাঙ্গানদের মধ্যে উত্তেজনা অবশ্য অতিরঞ্জিত হতে পারে। এটা সত্য যে, কোরানের শিক্ষা অনুসারে, যাদের কাফের (কাফির) বলে গণ্য করা হয় তাঁদের থেকে ইসলাম খ্রিস্টানদের প্রতি বেশি সহনশীল (কারণ পবিত্র গ্রন্থে তাঁদের উল্লেখ আছে)। তবুও, সান্ত্রিরা অবাঙ্গানদের সম্পূর্ণরূপে তাদের সম্প্রদায়ের বাইরে বলে মনে করে না। তাদের কুসংস্কারকে ইসলামের সচেতন বিরোধিতা নয়, বরং ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানের অভাবের ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, অবাঙ্গানরা সাধারণভাবে সান্ত্রি ছাড়া নিজেদের অসহায় মনে করবে। রেউভেন কাহানে দেখেন যে ইন্দোনেশিয়ান সমাজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী একটি একক কঠিন সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় ‘মিশ্র কিন্তু একত্রিত নয়’। (ধর্মপুতেরা, পৃ ৮৫, ১৯৮৮)

৪.৩ উন্মুক্ত চিন্তাধারার কঠিন মূল্য

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযানে অবাঙ্গানরা, যাদের উন্মুক্ত চিন্তাধারার সঙ্গে কমিউনিস্টদের (পিকেআই) কিছু মিল থাকায় ও উভয়ের সঙ্গে সংযোগ থাকায়, আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পরে ‘নাদনাতুল উলেমা’ নামক সর্ববৃহৎ ইসলামিক সংগঠন তথা ইন্দোনেশিয়ার সৈন্যবাহিনী দ্বারা। নির্মম ভাবে তাঁদের গণহত্যা করা হয়। এই সংঘর্ষে দশ লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। অধার্মিক বা কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত থাকার অধিকার অস্বীকার করে সরকার অবাঙ্গানদের গণহত্যার পরে অবশিষ্টদের হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্মান্তরে বাধ্য করে।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: বালীতে গরুড় উইসনু কেনকানা মূর্তি, গরুড় এক জাতীয় প্রতীক এবং ইন্দোনেশিয়ার ঐক্যের প্রতিনিধি

তথ্যসূত্র

  1. উইলিয়াম এইচ ফ্রেডরিক এবং রবার্ট এল. ওয়র্ডেন (সম্পাদক), Indonesia : a country study, ফেডারেল রির্সাচ ডিভিশন, লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, ১৯৯৩।
  2. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাভা-যাত্রীর পত্র, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৯২৯।
  3. রবার্ট নিকল, Notes on Some Controversial Issues in Brunei History, আর্চিপেল ১৯, পৃ ৩৫, ১৯৮০।
  4. এম সি রিকলেফ, বি লকহার্ট, এ লাউ, পি রেয়েস, এম অং থিন, (সম্পাদনা এম সি রিকলেফ), A New History of Southeast Asia, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, নিউ ইয়র্ক, ইউ এস, ২০১০।
  5. এ ক্যাবাটন, Java, Sumatra and the other islands of the Dutch East Indies, অনুবাদক বি মিয়াল, চার্লস স্ক্রাইবনারস সন্স, নিউ ইয়র্ক ১৯১৪।
  6. টি পিরেস, The Suma oriental of Tomé Pires : an account of the East, from the Red Sea to Japan, ১৫১২-১৫১৫ সালে মালাক্কা এবং ভারতে লিখিত, হাকলুয়েট সোসাইটি, লন্ডন, ১৯৪৪। (ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি, ডিজিটাইজড সংস্করণ)
  7. ফ্রেড আর ভি ডি মেহডেন, Indonesia, পৃ ৫৫৬-৫৬৫, The Oxford Encyclopedia of the Islamic World -এর অংশ, জন এস্পোসিটো (সম্পাদক), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৯৫।
  8. এন মুল্ডার, Abangan Javanese religious thought and practice, হিউম্যানিটিস এন্ড সোশ্যাল সায়েন্স, ১৩৯, ২, ১৯৮৩।
  9. এন মুল্ডার, Mysticism and Everyday Life in Contemporary Java – Cultural Persistence and Change, পৃ ৬, সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮০। https://scholar.archive.org/work/74wgstdsnja7hfyhylnt2xcaq4/access/wayback/https://brill.com/downloadpdf/journals/bki/139/2/article-p260_4.pdf
  10. এ ধর্মপুতেরা, Pancasila and the Search for Identity and Modernity in Indonesian Society: A Cultural and Ethical Analysis, ই জে ব্রিল, ১৯৮৮।

দ্বিতীয় পর্বের জন্য লিংক-
https://www.itihasadda.in/parameshwar-part-ii/

পড়াশুনোর মধ্যে পড়াটা বেশি, শোনাটা কম, নিজেকে স্বশিক্ষিত বলেন। প্রথাগত শিক্ষা বিজ্ঞান শাখায় হলেও সমাজ সম্পর্কিত নানা বিষয়ে বহুদিন থেকে পড়ছেন। পেশাগত ভাবে শিক্ষকতা গ্রহণ করেছেন ত্রিশ বছর আগে।

মন্তব্য তালিকা - “পরমেশ্বর হে—তৃতীয় পর্ব”

  1. এই বিষয়ে আমার মত অজ্ঞান মানুষদের কাছে অনেকটা আলো নিয়ে এল এই নিবন্ধ। কিন্তু ভাষার stiffness এর কারণে পড়ার আরাম কিছু কম পাওয়া গেল। তাতে অবশ্য এর সারস্বতমূল্য কমে নি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।