সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পরমেশ্বর হে— দ্বিতীয় পর্ব

পরমেশ্বর হে— দ্বিতীয় পর্ব

অতীন দাস

আগস্ট ৩১, ২০২৪ ২১৩ 1

পরমেশ্বর হে— প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি রাজার উপাধি হিসেবে পরমেশ্বর, ত্রিভুবন, এমনকী রাজার পদধূলি ইত্যাদি প্রথাগত হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতি শব্দগুচ্ছ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইসলামিক দেশগুলিতে আজও প্রচলিত। এই পর্বে আমরা বুঝতে চাই কেন ভারতীয় সভ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য গৃহীত হয়েছিল।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের ব্যাপক প্রসারের পরেও হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব টিকে আছে। ইসলামের জন্মের বহু পূর্বে এই অঞ্চলে ভারত থেকে হিন্দুদের সঙ্গে এসেছিল হিন্দু ধর্ম, পৌরাণিক কাহিনী মায় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য৷ প্রসারের মাত্রা ও গভীরতায় পার্থক্য থাকলেও ভারতীয় হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্ম কেন সাধারণ মানুষের মধ্যে গৃহীত হল সেটা আমরা এই আলোচনায় বুঝতে চাই। বিভিন্ন গবেষক-পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরা হবে, তবে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার— তা হল গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। ঘটনাকে অনেকে নিজের মতো করে গেঁথেছেন এবং একটি সত্য ‘আবিষ্কার’-এর ছলে উপস্থাপন করেছেন।  

আলোচনায় দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব

ক) অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখিত গ্রন্থটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বর্ণনায় সবিশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার ফল— এটি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্লেষণের সময় কিছু মন্তব্য প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন তিনি লিখেছেন (পৃ ১৪৪-৫) প্রাচীন চম্পা রাজ্য (অধুনালুপ্ত, ভিয়েতনামের অংশ নিয়ে গঠিত হিন্দু রাজ্য) প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটি নতুন জাগরণ ছিল যার মূলে ছিল ভারতীয় উপনিবেশকারীরা। রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দে আনামাইটদের হাতে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত চামরা (চম্পার অধিবাসী) কোনো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অংশ নেয়নি। তাঁরা সম্পূর্ণ রূপে বিদেশি ভারতীয়দের হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং তাঁদের রীতিনীতি, ভাষা, ধর্ম সমস্তই এই বিদেশিদের অনুরূপ হয়ে পড়েছিল। কালক্রমে রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সঙ্গে এদের মিলন হয়েছিল, আবার সংস্কৃতির দিক দিয়েও এই দুই জাতি সম্পূর্ণ এক হয়েছিল।

প্রশ্ন জাগে, তিন হাজার মাইল দূরের দুই জাতির ‘সম্পূর্ণ এক’ হয়ে যাওয়া কতটা বাস্তব?  

খ) গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব পরিস্ফুট হয় যখন জাভা বিষয়ে বিখ্যাত গ্রন্থে ‘জাভা, সুমাত্রা এন্ড আদার আইল্যান্ডস অফ ডাচ ইস্ট ইন্ডিস (১৯১৪)’ গবেষক ক্যাবাটন জাভার ইতিহাস প্রসঙ্গে একযোগে হিন্দু, মুসলমান ধর্মকে আক্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন, (জাভায়) গণতান্ত্রিক ধারণার আশা করা অথবা স্বাধীনতার জন্য আকুল ভালোবাসা খুব কমই সম্ভব; এটি এমন একটি জাতি যেটি তৈরি হয়েছে প্রথমত হিন্দু এবং তাদের অত্যাচারী বর্ণভেদ প্রথা দ্বারা এবং তারপর ইসলাম ও তাঁর নিয়তিবাদ (যাতে সবকিছুই ঈশ্বর নির্ধারিত) দ্বারা। একটি এমন জাতি যা কুড়ি শতক ধরে শাসিত হয়েছে লোভী, স্বৈরাচারী বা অসম্মানজনক প্রভুদের দ্বারা। (ক্যাবাটন, পৃ ১৩৪, ১৯১৪)

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বুঝতে পারি হিন্দুত্ব তাঁদের দিয়েছে বর্ণভেদ প্রথা, যে ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী বংশজাতদের জন্য এবং যারা বর্ণ শুদ্ধতা রক্ষা করতে নির্মম। কোনো ব্রাহ্মণের মেয়ের নিম্নবর্ণের প্রেমিক হলে কন্যাকে হত্যা করা হত এবং প্রেমিককে একটি বস্তার মধ্যে ভরে সেলাই করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হত।

ক্যাবাটন ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রশংসা করে লিখেছেন—

ডাচরা, যেখানেই তাদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পৌঁছেছে, সেখানে এই নিষ্ঠুর প্রথা নিষিদ্ধ করেছে।

গ) ১৯২২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একদল প্রাচ্য বিশারদ, আচার্য সিলভা লেভির নেতৃত্বে অ্যাংকর পরিদর্শন করেন যার সদস্য বিশ্বভারতীরর প্রাক্তন উপাচার্য গবেষক শ্রী প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর বিবরণ ‘ভারত ও ইন্দোচীন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন (বাগচী, ১৯৫০)। প্রাচ্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বাগচী বহুভাষী হওয়ায় বেশ কয়েকটি প্রচলিত খমের শব্দের সংস্কৃত উৎস খুঁজে পেয়েছেন। এগুলি খমের ইতিহাস বুঝতে খুব সাহায্য করে, বিশেষত তার পুস্তকটি একশত বছর আগে বাংলায় লেখা এই জাতীয় একমাত্র পুস্তক।

এহেন অধ্যাপক বাগচী তাঁর বইতে কাম্বোডিয়াকে নির্দ্বিধায় কেবল ভারতের উপনিবেশ বলে ক্ষান্ত হননি, বিখ্যাত সব মন্দিরকে ঔপনিবেশিকদের কীর্তি বলে বাহবা নিয়েছেন। এমনকী যে রাজা এই কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেছেন তাঁর ‘বিশেষ পরাক্রম’-এর সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন, ‘সমুদ্রপারের বর্বরজাতিকে তাঁরা কার্যদক্ষ করেছিলেন’ (বাগচী, পৃ ৬০-৬১, ১৯৫০)। সত্য হল, কাম্বোডিয়া সেই অর্থে ভারতের উপনিবেশ ছিল না যে অর্থে ভারত ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। আর সেই পরাক্রমশালী রাজা ভারতীয় ছিলেন না। তাঁদের রাজত্বে এমন রাজাও ছিলেন যারা মন্দির নির্মাণ করছেন কিন্তু হিন্দুও ছিলেন না। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি কাল্পনিক পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে দেখা যেতে পারে যেমন কলকাতায় ১৮৪৭ সালে নির্মিত অপূর্ব সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল নির্মাণ সম্পর্কে কোনো ইংরেজ পণ্ডিত যদি উপনিবেশ ও ইংরাজ রাজার সম্পর্কে প্রশংসা এবং ‘বর্বর’ ভারতীয়দের সম্পর্কে একই বিলাপে মাতেন। 

ঘ) রবীন্দ্রনাথ জাভা সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু স্থানে ভ্রমণ করেন (১৯২৭ সাল), ইতিহাস গবেষণা করেননি। কিন্তু তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে সঠিক ভাবে ধরা পরেছিল, এদেরকে বললেন সমুদ্রপারের আত্মীয়। ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ গ্রন্থে বরং হিন্দু ধর্মের সংকীর্ণতাকে দুষে তিনি লিখেছেন, হিন্দু আপন গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে কষে বাঁধলে, ঘরের বাইরে তার যে এক প্রশস্ত আঙিনা ছিল এ কথা সে ভুললে। কিন্তু, সমুদ্রপারের আত্মীয়-বাড়িতে তার অনেক বাণী, অনেক মূর্তি, অনেক চিহ্ন, অনেক উপকরণ পড়ে আছে বলে সেই আত্মীয় তাকে সম্পূর্ণ ভুলতে পারলে না। (রবীন্দ্রনাথ, পৃ ৫৩-৫৪, ১৯২৯)

ভারতী সভ্যতা কীভাবে প্রসার লাভ করেছিল

ধরা যাক (আজকের) ইন্দোনেশিয়ার কথা। প্রায় এক হাজার বছর পরে আসা ইসলামি সংস্কৃতির বিপরীতে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারত বর্ণভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাসে বিভক্ত ছিল। ফলে তুলনামূলকভাবে নিম্ন-বর্ণের বণিক এবং নাবিকদের কাছে ভারতীয় প্রথাগত আচার অধরা ছিল, সেগুলি উচ্চস্তরের হিন্দুদের কুক্ষিগত ছিল। ইতিহাসবিদরা যুক্তি দিয়েছেন যে ভারতীয়করণের প্রধান অনুঘটক ছিলেন পুরোহিতরা যাদের দেশীয় শাসকরা তাদের ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে রেখে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভূমিকা ছিল মূলত, যদিও শুধুমাত্র নয়, আদর্শগত। হিন্দু ও বৌদ্ধ চিন্তাধারায়, শাসক ঈশ্বরের অবতার বা বোধিসত্ত্ব (ভবিষ্যৎ বুদ্ধ) হিসাবে একটি উচ্চ অবস্থান দখল করেছিলেন। এই চিন্তাধারার একেবারে বিপরীত ছিল তাঁদের স্থানীয় আদিবাসী প্রধানদের ‘সমানদের মধ্যে প্রথম’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। বিভিন্ন সংস্কৃত লেখা রাজদরবারে সাক্ষরতা নিয়ে আসে এবং এর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সাহিত্যও পোঁছায়।

কিছু গবেষক পুরোহিতদের ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান কারণ উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের পালনীয় বিধিতে ‘কালাপানি’ অতিক্রম করে দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কেউ কেউ নিশ্চয়ই গিয়েছেন, সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাজদরবারের আমন্ত্রণে। বিপরীত দিকে থেকে বৌদ্ধধর্ম, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রচারমূলক। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, ব্রিটিশরা তাদের উচ্চ বর্ণের ভারতীয় সৈন্যদের বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিল যারা বার্মায় যুদ্ধের জন্য জাহাজে উঠতে অস্বীকার করেছিল। সম্ভবত পূর্ববর্তী সময়ে এই ধরনের বিধিনিষেধ কম কঠোর ছিল, অথবা সাংস্কৃতিক প্রসারে প্রধান ভূমিকা বৌদ্ধরা পালন করেছিল, যাদের এই ধরনের বাধা ছিল না। (ফ্রেডরিক এবং ওয়ার্ডেন, ১৯৯৩)

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবেশের সম্ভাব্য কারণ— বর্ণভিত্তিক ব্যাখ্যা

মুনোজ (২০১৬) তাঁর গ্রন্থে লিখছেন যে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন ভারতের এই সাংস্কৃতিক স্থানীয় অনুপ্রবেশ তিনটি রূপে ঘটতে পারে। এই তিনটি রূপের সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ।

ক) বৈশ্য তত্ত্ব— প্রথম ক্ষেত্রে, একজন ভারতীয় অভিযাত্রী বা ব্যবসায়ী সাধারণত একজন স্থানীয় প্রধানের কন্যাকে বিবাহ করে স্থানীয় পণ্যের সন্ধানে একটি অস্ট্রোনেশীয় বসতির ওপর কিছু প্রভাব বিস্তার করতে সফল হন। এটিকে বলা হয় বৈশ্য তত্ত্ব। এরপর তিনি সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদির মতো কিছু ভারতীয় সাংস্কৃতিক উপাদান সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের জীবনকে উন্নত করার চেষ্টা করেন।

অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই তত্ত্বটি প্রশংসনীয়, কিন্তু এটি সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিল না কারণ ভারতীয় অভিবাসন কখনই ব্যাপক সংখ্যায় ছিল না। এটাও সন্দেহজনক যে ব্যবসায়ীরা সংস্কৃত বা রাজ দরবারের সংস্কৃতি প্রচার করবে, কারণ তারা সাধারণত এই সব আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণী থেকে আসে না। এই ক্ষেত্রে, ভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ব্যাখ্যা করার জন্য বৈশ্য তত্ত্ব অপর্যাপ্ত।

খ) ক্ষত্রিয় তত্ত্ব— দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, ক্ষমতা ও সম্পদের সন্ধানে অভিজাত যোদ্ধা বা যোদ্ধাদের একটি দল স্থানীয় সর্দার বা শাসকের কাছে তাদের পরিষেবা প্রদান করে এবং প্রথম ক্ষেত্রের মতোই সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে সফল হয়। এটিকে ক্ষত্রিয় তত্ত্ব বলা হয়। এটা অবশ্যই লক্ষ্য করা উচিত, এই ধরনের তত্ত্ব কখনও প্রমাণিত তথ্য দ্বারা সমর্থিত হয়নি এবং এই ক্ষেত্রে, এমনকী যদি এই ধরনের অনেক ক্ষত্রিয় তাঁদের অনুসন্ধানে সফল হন, তবে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব, বৈশ্য তত্ত্বের মতোই সম্ভাব্য নয়।

গ) ব্রাহ্মণ তত্ত্ব—তৃতীয় ক্ষেত্রে, যার পক্ষে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ আছেন, একজন স্থানীয় শাসক যিনি ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে পরিচিত এবং নাবিক বা ব্যবসায়ীদের গল্পের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান রাখেন, তিনি এই সংস্কৃতি প্রদত্ত কিছু সুবিধার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং এর কিছু কিছু গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। জীবন ও ধর্ম সম্পর্কে হিন্দু ধারণাগুলি অস্ট্রোনেশীয় নেতাদের কাছে আগ্রহের বিষয় ছিল কারণ এটি ছিল তাদের ক্ষমতাসীন থাকা বৈধ করার পক্ষে। তাঁদের ‘নির্বাচিত প্রধান’-এর পদের, যা নিয়মিত তাদের যোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে, পরিবর্তে ‘দৈব রাজা’-য় পরিবর্তন করা একটি চমৎকার উপায়।

‘দৈব রাজা’ ভারতীয় ব্যবস্থায় একজন রাজাকে ধর্মীয় এবং ঐশ্বরিক উভয় মর্যাদার অধিকার দেয় এবং এই ঐশ্বরিক মর্যাদার মাধ্যমে তিনি দাবি করতে সক্ষম তার মহত্তম পূর্বসূরিদের বংশাধিকার, তাদের যে কাউকে তার পূর্বপুরুষ হিসাবে বিবেচনা করে তার রাজত্বকে বৈধতা প্রদান করা সম্ভব। এই ধরনের শনাক্তকরণ অনেক রাজনৈতিক সুবিধা প্রদান করে, যেমন সাবেক রাজার বংশজাতদের শান্তিপূর্ণভাবে তার পক্ষে নিয়ে আসার সম্ভাবনা। এটি প্রতিবেশিদের বশ্যতা স্বীকার করাতে এবং তাদের উপ-করদ রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে বৃহত্তর অঞ্চলে নিজের আধিপত্যকে বৈধ করতেও সাহায্য করে। এই ধরনের সম্পর্ক স্থাপন এবং পদমর্যাদা অধিকার করা সমতাবাদী অস্ট্রোনেশীয় ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না।

রাজার মর্যাদা পরিবর্তন করার জন্য, সর্দাররা প্রথমেই খোঁজ করতেন, নাবিক এবং ব্যবসায়ীদের দ্বারা রাজার জন্য ‘অবশ্য’ প্রয়োজন হিসেবে বর্ণিত একজন ধর্মগুরু, বা অন্য কথায়, একজন ব্রাহ্মণকে, যাকে হয় চুক্তিভুক্ত নতুবা বন্দী করা হত। একটি সম্প্রদায়ে তার বসতি স্থাপনের পর, ব্রাহ্মণের প্রথম কাজটি ছিল বংশের মধ্যে একজন হিন্দু দেবতার অবতার চিহ্নিত করা এবং সেই থেকে, বংশের নেতাদের কাছে একটি মর্যাদাপূর্ণ বংশতালিকা আবিষ্কার করা বা তৈরি করা। একবার এটি হয়ে গেলে, এই পূর্বপুরুষদের জন্য একটি উপাসনালয় তৈরি করা হত সর্দারের (‘কাদাতুয়ান বা ক্রাটন’) বাসস্থানের নিকটবর্তী একটি পাহাড় বা পর্বতে। যেখানে কোনো টিলা বা  প্রাকৃতিক পাহাড় পাওয়া যেত না, সেখানে একটি কৃত্রিম টিলা তৈরি করা হত। মন্দিরটি যুক্ত হত বিশেষ অনুষ্ঠানের  মাধ্যমে, যা দিয়ে শাসকের মনোনীত দেবত্বের মাধ্যমে নতুন রাজ্যের ভিত্তি চিহ্নিত করা হত। সামাজিক অবস্থান এবং তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, ব্রাহ্মণ রাজার আত্মীয়দের হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান এবং পবিত্র গ্রন্থে নির্দেশ দিতেন। বিনিময়ে ব্রাহ্মণ বড় ধরনের পুরস্কার পেতেন, কখনও কখনও একজন সম্ভ্রান্ত বা রাজার কন্যাকে তার স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতেন।

সবমিলে ধর্ম আঞ্চলিক প্রধানদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিল, সংস্কৃত সাহিত্য এনে দিল অর্থশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র সহ নানা বিধান, অনুশাসন, প্রধানরা রাজা, মহারাজা হতে শুরু করলেন।

যদিও এই তিনটির কোনো একটি বা সম্মিলিত ভাবে তিনটি মিলে ভারতের সংস্কৃতির প্রবেশের পুরো ব্যাখ্যা করতে পারে না, কারণ অত্যন্ত জটিল ছিল এই প্রক্রিয়া— কিন্তু এটি কোনো বিজয়ীর হাত ধরে আসেনি। (মুনোজ, পৃ ৫৬-৫৭, ২০১৬)

সেদেস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে (১৯৭৫) রাজার ব্রাহ্মণকে ব্যবহারের উদাহরণ দিয়েছে শিলালিপি পাঠোদ্ধার করে। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় দ্বিতীয় জয়বর্মন তাঁর পুরোহিত শিবকৈবল্য কে নিয়ে নতুন শহর স্থাপন করেন, ‘তারপর রাজা রাজত্ব করতে গেলেন মহেন্দ্রপর্বতে, রাজগুরু শিবকৈবল্য তাকে অনুসরণ করেছিলেন পূর্বের মতো, রাজার সেবা করার জন্য এই রাজধানীতে ঘাঁটি গাড়লেন। তারপর হিরণ্যদাম নামে জাদুবিদ্যা পারদর্শী এক ব্রাহ্মণ জনপদ থেকে এলেন রাজার আমন্ত্রণে— কম্বুজদের দেশ জাভার ওপর আর নির্ভরশীল হবে না এবং একাধিক রাজা আর থাকবে না— একজনই হবেন চক্রবর্তী (সর্বজনীন রাজা)— এটা নিশ্চিত করার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে। (সেদেস, পৃ ৯৮-৯৯, ১৯৭৫)

ভারতীয় সভ্যতার প্রসারে বণিক ও ব্রাহ্মণদের ভূমিকা

পল হুইটলি ১৯৬১ সালে তাঁর ‘দ্য গোল্ডেন খেরসোনিজ’ (মালয় উপদ্বীপকে গ্রিক ঐতিহাসিকরা এই নামে উল্লেখ করতেন) গ্রন্থে অধ্যায় বারো-তে, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ একই ধরনের ভূমিকা পালনের উল্লেখ করেছেন। আগে ভারতীয় সভ্যতার প্রসার যে আগত বণিকদের দ্বারা সম্ভব হয়নি, তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে দুই ধরনের ছিলেন। প্রথম ধরণ হলেন অভিজাত বণিক, যাদের ভূমিকা ছিল বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসা-সন্ধানী। সত্য যে এরা মাঝে মাঝে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তবে তারা সংখ্যায় কম ছিলেন এবং তাদের পরিশ্রুত এবং নির্জন জীবন আশেপাশের জনসংখ্যাকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করেছিল। (হুইটলি, ১৯৬১, পৃ ১৮৬) প্রকৃতপক্ষে আর এক দল ছিলেন ফেরিওয়ালা—ভারতীয় সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষ, যারা সমগ্র ভারত মহাসাগরে ভ্রমণ করেছিল। দরিদ্র এবং অশিক্ষিত এই মানুষেরা ভারতীয় আচার এবং নান্দনিক সংবেদনশীলতার মতো সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রসারের মাধ্যম হতে পারে না। অধিকন্তু, দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার না থাকায়, তারা বন্দর এলাকায় বিশেষ ঘিঞ্জি দরিদ্র মহল্লায় সীমাবদ্ধ ছিলেন, যেখানে তাদের মালপত্র বেচাকেনার সময় ছাড়া স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মেলামেশার বেশি সুযোগ ছিল না।

তাহলে কীভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূমিতে সঞ্চারিত হয়েছিল? উত্তরটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বিশেষজ্ঞরা প্রাচীন কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জনগণের দ্বারা অর্জিত তুলনামূলকভাবে উন্নত সাংস্কৃতিক স্তরের প্রশংসা করেছিলেন। এরা বর্বর ছিলেন না বরং ছিলেন যথেষ্ট প্রাচীন একটি আর্থ-সামাজিক সংগঠনের উত্তরাধিকারী। দক্ষিণ-ভারতীয় বন্দরগুলির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের মাধ্যমে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শাসকরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের বৈধতা দেওয়ার এবং সম্ভবত, তাদের প্রজাদের নানা স্তরে বিন্যস্ত করার উপায় হিসাবে ভারতীয় চিন্তাধারার মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা তাদের দরবারে নিয়মকানুন এবং আচার-অনুষ্ঠানে দক্ষ ব্রাহ্মণদের ডেকে পাঠায়। এই তুলনামূলকভাবে ছোট কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠীটিই হিন্দু ধর্মীয় সূত্র, শাসক পরিবারের পৌরাণিক বংশতালিকা প্রস্তুত করে রাজার দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করে মোহ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেয়। ভারতীয় মূর্তি, মহাকাব্যিক চরিত্র ও কাহিনি, এবং ভারতীয় রাজ দরবারের জটিল আনুষ্ঠানিকতা এরাই প্রচলন করেন। তারাই উন্নততর ভারতীয় সভ্যতার দিকগুলি প্রচার ও প্রসার  করতে সক্ষম একমাত্র দল ছিলেন। এই ধর্মীয় এবং বৌদ্ধিক উপাদানের পাশাপাশি সামরিক এবং বাণিজ্য গোষ্ঠীও ছিলেন। ভারতীয় দলিল এই বিষয়ে নীরব কিন্তু চিনা ইতিহাসে এর সামান্য প্রমাণ আছে। ‘লিয়াং রাজবংশের ইতিহাস’, উদাহরণস্বরূপ, একটি কম্বোডিয় ঐতিহ্য উল্লেখ করে, এক অভিযাত্রী পৌরাণিক ব্রাহ্মণ কৌন্ডিন্য নাম ধারণ করেছিলেন, সেই দেশের একজন রাণীর সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে ফু-নানের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। (হুইটলি, পৃ ১৮৬, ১৯৬১)

প্রভাব অর্জনের এই ধরনের সুযোগগুলি দুঃসাহসিকদের পাশাপাশি পুরোহিত এবং বণিকদেরও আকৃষ্ট করবে তা অপ্রত্যাশিত নয়, তবে আমাদের সেই পরিপূরক প্রক্রিয়াটিকে উপেক্ষা করা উচিত নয় যার মাধ্যমে একজন স্থানীয় সর্দার ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন ক্ষত্রিয় পদের জন্য। এর আপাত উদাহরণগুলি দুর্লভ নয় যদি আমরা কিছু শিলালিপি মনোযোগ সহকারে পড়ি। মুলাবর্মন এবং তার পিতা অশ্ববর্মন উভয়েরই বিশুদ্ধ সংস্কৃতের নাম ছিল, কিন্তু পিতামহ কুন্দুগা নামে পরিচিত ছিলেন, সম্ভবত তামিল বা ইন্দোনেশীয় নাম। (হুইটলি, পৃ ১৮৭, ১৯৬১)

ভারতীয় সভ্যতার প্রসার কেবল হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার নয়

আমরা প্রসঙ্গান্তরে আলোচনা করেছি, ইসলাম নবীনতর ধর্ম (মোহাম্মদের জন্ম আরবে, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) হওয়ায় প্রথম সহস্রাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জনসমষ্টিতে ইসলাম দৃশ্যমান ভাবে উপস্থিত হয়নি— কিছু বিচ্ছিন্ন বিদেশি বণিক মুসলমান বসতি ছিল। পুরো এক হাজার বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে ভারতীয় সভ্যতা বা সংস্কৃতি বলতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম নির্ভর সভ্যতাই বোঝাত।

দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়াতেই ইসলামের প্রসার অতি দ্রুত হতে থাকে— হিন্দু ধর্মও সংকুচিত হতে শুরু করে। বর্তমানে দেখার বিষয়— কীভাবে ইসলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রসার লাভ করল। 

প্রায় ১৪০০ সাল নাগাদ মলাক্কা-মালয় উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরপরই এটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এর ওপর নির্ভরশীল রাজ্যগুলির মাধ্যমে এটি মালয় সুলতানেট প্রতিষ্ঠা করেছিল, মালয় উপদ্বীপ ও অপরদিকে সুমাত্রার পূর্ব উপকূলে এটি দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে মুসলিম প্রভাবের বাহক হিসেবে কাজ করেছিল। পার্শ্ববর্তী দ্বীপের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এর নিয়ন্ত্রণাধীন বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হয়, বাংলা, ভারত এবং আরও দূরের কিছু মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সুযোগ খুঁজে পায় তার বাণিজ্য সহযোগী রূপে বা তার নির্ভরশীল রাজ্যে এবং এটি আকৃষ্ট করে বিদেশি ‘উলেমা’ (ধর্মীয় পণ্ডিত)-দের, প্রধানত ভারতের থেকে, যদিও তাদের অনেকেরই ছিল আরব রক্ত এবং নিজেদের সুবিধার জন্য এই আরব বংশোদ্ভূত হওয়াটা তাঁরা ব্যবহার করত। (কিটাগাওয়া, পৃ ৪৩৬, ২০২২)

মেহডেন (১৯৯৫) প্রমুখ গবেষকের মতে ইন্দোনেশিয়াতে ইসলামের প্রবেশের সঠিক সময় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও মোটামুটি ত্রয়োদশ শতকে ইসলামের প্রবেশ হিসেবে ধরা যায়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে দ্রুত প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যে জাভা এবং সুমাত্রার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম এসেছিল তার প্রচারকদের মাধ্যমে— পশ্চিম ভারতের গুজরাট, মালাবার, আরবের হাদ্রামাউত থেকে। সাধারণভাবে শান্তিপূর্ণ পথেই ধর্মান্তকরণ ঘটেছিল। প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আসা ধর্ম বিষয়ের পণ্ডিতদের মাধ্যমে ইসলাম প্রবেশ করে, সাহায্য করে অভিজাতদের ধর্ম গ্রহণ ও রাজনৈতিক সংযোগ। হিন্দু সংস্কৃতি স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, প্রথম থেকেই দেশ এবং ইসলাম তাতে রঞ্জিত হয়েছিল। ফলে বহু ধর্মান্তরিতদের, বিশেষ করে জাভাতে, ইসলামিক চিন্তা ও অনুশীলনে আকৃষ্ট করেছিল।

দেখা গেল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয়রাই ইসলাম ধর্মের আগমনে মূল ভূমিকা নিয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ভারতীয় আগন্তুক বা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামকে সহজে গ্রহণ করেছে, অন্তত তার বিকাশের প্রথম যুগে ইসলামও স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে।

হাজুমী (২০১০) তার প্রবন্ধে ১৪০০ সালের মলাক্কায় প্রথম সুলতানেট প্রতিষ্ঠা ধরে নিয়ে সেই সময়কার সমাজকে অপ্রকৃত-বাস্তবতা (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি)-র মাধ্যমে তুলে ধরতে প্রচেষ্টা করতে গিয়ে ইসলামে প্রবেশের সঠিক কাল এবং তথ্যের অপ্রতুলতার উল্লেখ করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ কেন ইসলামকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেন— সেই বিষয়ে কিছু গবেষণা করেছেন যা নিচে তুলে ধরা হচ্ছে।

ইসলাম আসার আগে অধিবাসী মালয়রা যে ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস, জনসংখ্যার একটি অংশ গ্রহণ করেছিলেন হিন্দু/বৌদ্ধ ধর্ম। জীবন এমনভাবে গঠিত ও সজ্জিত হয়েছিল যাতে প্রভাব ছিল একাধিক ধর্মের। এটা শুধুমাত্র মালয়-এর সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি রাষ্ট্রীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং রাজকুমারদের ‘ক্ষমতা’ কাঠামোর অংশ। রাজনৈতিক পর্যায়ে রাজকীয় শাসক এবং মালয়-দুনিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধানরা ইসলামকে আলিঙ্গন করেন। মানুষ মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়েছিল কোরান এবং হাদিস-এর বিধান দ্বারা যা বলেছিল মানবজাতির মান স্থির হবে মানুষে-মানুষে সমতার ভিত্তিতে।

যাদের এতদিন নিম্ন বর্ণ বিবেচনা করা হত, তাঁদের আর ধর্মীয় জাত ব্যবস্থার ধারণায় আবদ্ধ করা হল না। ইসলামে বৈষম্য বা বিভাজন ছিল না। গাত্রবর্ণ, উপজাতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি, জাতি, জন্মভূমি এবং জন্মস্থানভিত্তিক বৈষম্য সমস্যার সৃষ্ট করে। সমান অধিকার সঠিক মানবিক সমাধান বলে মনে হয়েছিল মানুষের। (হাজুমী, ২০১০)

ভারতীয়দের ধর্ম প্রসারের একটি কল্পনাপ্রসূত অভিব্যক্তি

উইন্সটেড তাঁর প্রবন্ধে (১৯৩৫, পৃ ১৮) একটি কল্পনাপ্রসূত অভিব্যক্তি দিয়েছেন।

“একটি জাহাজ বর্ষাকালে সোনা, টিন, হাতির দাঁত, কর্পূর এবং সেইসব বিরল ওষুধ, গণ্ডার-শিং, পুঁতি এবং জাদুর তাবিজ বিনিময় করতে এসেছিল এখানে। একজন যাত্রী সেখানে যাদু প্রদর্শন করেছিল, যা প্রেম, লড়াই, রোগভোগে কার্যকরী হয়েছিল। আরেকজন যোদ্ধা হিসেবে সম্মান পেয়েছেন। কিছু যাত্রী স্থানীয় পাত্রী বিবাহ করেছিল, পুরোহিতরা এসে সংস্কৃতে একটি নতুন আচার শিখিয়েছিলেন, যেটি পরবর্তী আরবি ভাষার মতোই স্থানীয়দের কাছে দুর্বোধ্য ছিল। প্রাত্যহিক কথাবার্তার জন্য নবাগতরা, স্পষ্টতই যেহেতু তাদের ভাষা দুর্বোধ্য ছিল, মালয়েশিয়ার ভাষা গ্রহণ করেছিল এবং তাদের নিজস্ব কথ্য প্রাকৃতের খুব কম শব্দই চালু করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ইন্দোনেশীয় পরিবারে বিয়ে করে এবং হিন্দু রাজত্বের ধারণা নিয়ে আসে, ঠিক যেমন ভাবে হাজার বছরেরও বেশি সময় পরে মুসলিম তামিলরা মালাক্কার সুলতান এবং বেন্দাহারদের (মালয়ের অতি প্রভাবশালী গোষ্ঠী- মালয় রাজ্যগুলির প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি, যাদের স্থান ছিল সুলতানের পরেই) পরিবারে বিয়ে করেছিল।”

মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করা ‘ব্রামিন’

মার্ডেন-এর অনুবাদ অবলম্বনে ‘দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পলো, (দ্য ভেনিসিয়ান)’-এর থেকে উল্লেখ করব একটি বর্ণনা যা সম্ভবত হিন্দু পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ সম্পর্কে। মার্কো (জন্ম ১২৫৪) দ্বীপপুঞ্জে বিস্তারিত ভ্রমণের কথা লিখে গেছেন, অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন সহ। তিনি লিখেছেন—

ডুবুরিরা নেটের ব্যাগ গায়ে বেঁধে বারবার সাগরে ডুব দিয়ে ঝিনুক খুঁজতে থাকে। শ্বাস ধরে রাখা সম্ভব না হলে তারা উপরে উঠে আসে। এবং খানিক বিরতির পর আবারও সাগরে ডুব দেয়। বেশিরভাগ মুক্তাই এই উপসাগর থেকে আহরিত হয়, এখানকার মুক্তা গোলাকার এবং খুব দ্যুতিময়। যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি ঝিনুক তোলা হয় তার নাম বেটালা, জায়গাটা মূল ভূখণ্ডের তীরে অবস্থিত। এই উপসাগরে নানা ধরনের বড় মাছের উপদ্রব খুব বেশি, প্রায়ই এরা ডুবুরিদের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়, ব্যবসায়ীরা তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে ব্রার্মিন নামের এক গোত্রের জাদুকরদের সঙ্গে নেন। নিজেদের রহস্যজনক ক্ষমতা ব্যবহার করে এরা মাছগুলোকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে, তাতে করে এদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। কেবল দিনের বেলাতেই মুক্তা আহরিত হয় বলে সন্ধ্যা নামার পর এরা তাদের সেই জাদুকরী প্রভাব বন্ধ রাখে, যাতে অসৎলোকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাতের বেলা ঝিনুক চুরি করতে না পারে । একইভাবে এই জাদুকরেরা অন্যান্য পশু-পাখিদেরও মন্ত্রমুগ্ধ করতে সক্ষম। (পোলো, পৃ ২৩০, ২০১৫)

শীর্ষক চিত্র পরিচিতি:

রাজা পরমেশ্বর (ইস্কান্দার শাহ) – সিঙ্গাপুরা রাজ্য: ১৩৮৯-১৩৯৮, মালাক্কা সালতানাত: ১৪০২-১৪১৪

প্রথম পর্বের লিংক
https://www.itihasadda.in/parameshwar-part-i/

তথ্যসূত্র

  • রমেশ চন্দ্র মজুমদার, হিন্দু কলোনীস ইন দা ফার ইস্ট, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, (১৯৪৪); অনুবাদ- এস চৌধুরী, সুদূর প্রাচ্যে প্রাচীন হিন্দু উপনিবেশ, সম্বোধি পাবলিকেশানস প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা।
  • এ ক্যাবাটন, জাভা, সুমাত্রা এন্ড আদার আইল্যান্ডস অফ ডাচ ইস্ট ইন্ডিস, অনুবাদক বি মিয়াল, চার্লস স্ক্রাইবনারস সন্স, নিউ ইয়র্ক (১৯১৪)।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাভা-যাত্রীর পত্র, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, (১৯২৯)।
  • প্রবোধচন্দ্র বাগচী, ভারত ও ইন্দোচীন, শ্রীসরস্বতী প্রেস লিমিটেড, কলকাতা, (১৯৫০)।
  • উইলিয়াম এইচ ফ্রেডরিক এবং রবার্ট এল. ওয়র্ডেন (সম্পাদক), ইন্দোনেশিয়া এ কান্ট্রি স্টাডি, ফেডারেল রির্সাচ ডিভিশন, লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, (১৯৯৩)।
  • https://babel.hathitrust.org/cgi/pt?id=umn.31951d00276008p&seq=7   
  • পি এম মুনোজ, আর্লি কিংডমস অফ দি ইন্দোনেশিয়ান আর্কিপেলাগ এন্ড দি মালয় পেনিনসুলা, মেইন ল্যান্ড প্রেস, সিঙ্গাপুর, (২০১৬)।
  • https://archive.org/details/earlykingdomsofi0000muno/page/n1/mode/2up
  • জর্জ সেদেস, Les Etats hindouises d’lndochine et d’lndonesie, (১৯৬৪), ইংরেজি অনুবাদ সুসান ব্রাউন, “The Indianized States of Southeast Asia”, সম্পাদনা ওয়াল্টার আর ভেলা, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি, ক্যানবেরা, (১৯৭৫)।
  • জে এম কিটাগাওয়া (সম্পাদক), দি রিলিজিয়াস ট্রাডিশান অফ এশিয়া- রিলিজিয়ান,” হিস্ট্রি এন্ড কালচার, ম্যাকমিলান পাবলিশিং কোম্পানি, ইউ এস, ১৯৮৭ গ্রন্থের অধ্যায় ৭, এইচ জন, ইসলাম ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া, রুটলেজ সংস্করণ (২০২২)।
  • পল হুইটলি, দ্য গোল্ডেন খেরসোনিজ: ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগের মালয় উপদ্বীপের ঐতিহাসিক ভূগোলের অধ্যয়ন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ অধ্যায় ১২, ইউনিভার্সিটি অফ মালয়া প্রেস, কুয়ালালামপুর, (১৯৬১): ১৮৫।
  • ভি ডি মেহডেন আর ফ্রেড, ইন্দোনেশিয়া, জ এস্পোসিটো (সম্পাদক), দি অক্সফোর্ড এনসাইক্লোপেডিয়া অফ দি মডার্ন ইসলামিক ওয়ার্ল্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড, (১৯৯৫)।
পড়াশুনোর মধ্যে পড়াটা বেশি, শোনাটা কম, নিজেকে স্বশিক্ষিত বলেন। প্রথাগত শিক্ষা বিজ্ঞান শাখায় হলেও সমাজ সম্পর্কিত নানা বিষয়ে বহুদিন থেকে পড়ছেন। পেশাগত ভাবে শিক্ষকতা গ্রহণ করেছেন ত্রিশ বছর আগে।

মন্তব্য তালিকা - “পরমেশ্বর হে— দ্বিতীয় পর্ব”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।