পাণিনি ও বৈদিক ঐতিহ্য
পাণিনি – কাল ও বাসভূমি
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ব্যাকরণ গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ীর রচয়িতা পাণিনি সম্পর্কে আমরা আজও বিশেষ কিছু জানি না। পঞ্চদশ শতক সাধারণাব্দের শেষার্ধে ওড়িশার গজপতি শাসক পুরুষোত্তমদেব রচিত ত্রিকাণ্ডশেষ শিরোনামের একটি সংস্কৃত অভিধান গ্রন্থে (২.৭.২৪) পাণিনির ৬টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়— পাণিনি, আহিক, দাক্ষীপুত্র, শালঙ্কি, পাণিন ও শালাতুরীয়।১ অন্ত-মধ্যযুগে সংগৃহীত এই নামগুলি নিঃসন্দেহে পাণিনির সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘ ঐতিহ্যের স্মারক।
আনুমানিক দ্বিতীয় শতক সাধারণপূর্বাব্দে পতঞ্জলি, তাঁর মহাভাষ্য (চূর্ণি নামেও পরিচিত) গ্রন্থে অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের একটি সূত্রের (১.১.২০) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে একটি কারিকা উদ্ধৃত করেছেন। ঐ কারিকায় পাণিনিকে দাক্ষীপুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পাণিনি ও দাক্ষী উভয়ই ব্যক্তিনাম না গোত্রনাম সে বিষয়ে যথেষ্ট মতদ্বৈধ আছে। দশম শতক সাধারণাব্দে সোমদেব সূরির যশস্তিলক চম্পূ গ্রন্থের দ্বিতীয় আশ্বাসে পাণিনিকে পণিপুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।২ সপ্তদশ শতক সাধারণাব্দে রামভদ্র দীক্ষিত, তাঁর পতঞ্জলিচরিত গ্রন্থে (১.৪৭) পাণিনির পিতার নাম পণী ও মাতার নাম দাক্ষী বলে উল্লেখ করেছেন।৩
অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের একটি সূত্রে (২.১.৭০) বলা হয়েছে, “কুমারঃ শ্রমণাদিভিঃ”। এই সূত্রে শ্রমণা অর্থাৎ নারী শ্রমণদের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় বৌদ্ধ ধর্ম বা অন্ততপক্ষে জৈন ধর্মের প্রবর্তনের পর গ্রন্থটি রচিত। অধিকাংশ আধুনিক বিদ্বানরা পাণিনির কাল নির্ণয়ের জন্য দুটি সম্ভাব্য উপায় অবলম্বন করেছেন। প্রথম উপায় অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের নিরিখে তাঁর কাল নির্ণয় ও দ্বিতীয় উপায় পাণিনির দুই উত্তরসূরি, বার্তিককার কাত্যায়ন ও মহাভাষ্য রচয়িতা পতঞ্জলির কাল নির্ণয় করে, তার ভিত্তিতে পাণিনির কাল সম্পর্কে অনুমান। এই দুই পদ্ধতি অবলম্বন করেই অধিকাংশ আধুনিক বিদ্বানরা মোটামুটিভাবে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন – পাণিনির আনুমানিক কাল সাধারণপূর্বাব্দের চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধ।৪ এখানে উল্লেখ্য, অষ্টাধ্যায়ী ছাড়া পাণিনির রচনা বলে জ্ঞাত পাণিনীয় শিক্ষা, দ্বিরূপকোশ এবং জাম্ববতীবিজয় বা পাতালবিজয় কাব্য আদৌ পাণিনির রচিত নয়, পরবর্তীকালের রচনা।
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থ থেকে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না, শুধু বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সংযোগের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত পাণিনির শিব বা অবলোকিতেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করে ব্যাকরণ রচনার কাহিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল শৈব ও বৌদ্ধ বিদ্বানদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন।৫
পাণিনির বাসভূমি শলাতুর সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। পাণিনি তাঁর গ্রন্থের একটি সূত্রে (৪.৩.৯৪) শলাতুর নিবাসী অর্থে শালাতুরীয় শব্দের উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন শলাতুর নগর কাবুল নদী ও সিন্ধু নদের সঙ্গমস্থলে, বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সোয়াবি জেলার ছোটা লাহোর নামে পরিচিত একটি শহরের কাছে অবস্থিত ছিল বলে আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান। আনুমানিক সপ্তম শতক সাধারণাব্দের কাশ্মীরের বিদ্বান ভামহ তাঁর কাব্যালংকার গ্রন্থে (৬.৬২) পাণিনির মতকে সালাতুরীয় মত বলে উল্লেখ করেছেন।৬ বলভীর মৈত্রক বংশীয় শাসক সপ্তম শীলাদিত্যের ৭৬৬ বা ৭৬৭ সাধারণাব্দে উত্কীর্ণ অলিণা তাম্রশাসনে পাণিনির ব্যাকরণকে শালাতুরীয় তন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৭ দ্বাদশ শতক সাধারণাব্দে বর্ধমান তাঁর ‘গণরত্নমহোদধি’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকে পাণিনিকে শালাতুরীয় বলে উল্লেখ করেছেন। ঐ শ্লোকের স্বকৃত বৃত্তিতে বর্ধমান শলাতুর গ্রামকে পাণিনির অভিজন (অর্থাৎ পুরুষানুক্রমিক বাসস্থল) বলে উল্লেখ করেছেন।৮
সপ্তম শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে জুয়ান জাং শলাতুর শহরে এসেছিলেন। জুয়ান জাং তাঁর বিবরণে জানিয়েছেন, তিনি উড়খণ্ড (পরবর্তীকালের ওয়াহিন্দ, বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত) থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করে শলাতুর নগরে উপস্থিত হন। তিনি পাণিনিকে শব্দশাস্ত্র বিদ্যার রচয়িতা ঋষি বলে বর্ণনা করেছেন। জুয়ান জাং তাঁর বিবরণে লিখেছেন, কল্পের প্রারম্ভে মানুষের ভাষা বিপুল শব্দভাণ্ডারে সমৃদ্ধ ছিল। পরে তা লুপ্ত হলে দীর্ঘায়ু দেবতারা মানুষের কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হন। ব্রহ্মা ও ইন্দ্র শব্দশাস্ত্র (বা ব্যাকরণ) রচনা করেন। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই শাস্ত্র চর্চা প্রচলিত থাকলেও ক্রমশ শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই শাস্ত্র আয়ত্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। পাণিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন, মানুষের আয়ু কমে মাত্র একশো বছর হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে তাদের জ্ঞানের গভীরতার অভাব দেখে পাণিনি ব্যথিত হন। তিনি মহেশ্বর দেবের কাছ থেকে সহায়তার আশীর্বাদ প্রাপ্তির পর লিখিত ও কথ্য ভাষার অধ্যয়ন করে এক সহস্র ৩২ অক্ষরের শ্লোকে ‘শেং-মিং-লুন’ (শব্দবিদ্যা) শাস্ত্রের গ্রন্থ রচনা করেন। জুয়ান জাং আরও জানিয়েছেন, গ্রন্থ রচনার পর পাণিনি রাজাকে এই গ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপি প্রদান করেছিলেন এবং রাজা যে সম্পূর্ণ গ্রন্থটি স্মৃতি থেকে বলতে পারবে তাকে এক সহস্র স্বর্ণখণ্ড দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। জুয়ান জাং লিখেছেন, তাঁর আগমনের সময় পর্যন্ত শলাতুর শহরে গুরু শিষ্য পরম্পরায় এই গ্রন্থের চর্চা অব্যাহত ছিল। তিনি এখানে এসে শুনেছিলেন, পাণিনির শিষ্যরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত শলাতুর শহরে তাঁর একটি প্রতিমা স্থাপন করেছিলেন এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পাঁচশো বছর পরেও এই প্রতিমাটি বিদ্যমান ছিল।৯
পাণিনির জীবনকথা
পাণিনির সম্পর্কে মহাযান বৌদ্ধ শাস্ত্রে সম্ভবত প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে সদ্ধর্মলঙ্কাবতারসূত্রের সগাথক শীর্ষক দশম অধ্যায়ের ৮১৩ সংখ্যক শ্লোকে।১০ পাণিনির জীবনকাহিনি প্রথম পাওয়া যায় মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প বা মঞ্জুশ্রীমূলকল্প (মঞ্জুশ্রীমূলতন্ত্র নামেও পরিচিত) আনুমানিক ষষ্ঠ শতক থেকে অষ্টম শতক সাধারণাব্দের মধ্যবর্তী কোনও সময় সংস্কৃত ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ মহাযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ। মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থের ৫৩তম পটলবিসর অর্থাৎ অধ্যায়ে, বুদ্ধ কর্তৃক ভবিষ্যৎবাণীর রূপে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস বিবৃত। এই অধ্যায়টি ‘রাজব্যাকরণ’ নামে পরিচিত। এই অধ্যায়ে প্রাচীন মগধের শাসকদের বিবরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (৫৩.৩৮২-৪০৫) বিশোকের ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যু হলে শূরসেন সিংহাসনে বসেন। তিনি ১৭ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পর নন্দ পুষ্পনগরের (কুসুমপুর, অর্থাৎ পাটলিপুত্র) সিংহাসনে আসীন হন। তাঁর এক বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। বলা হয়েছে, নন্দ এক পিশাচের মন্ত্র সাধনা করে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তাঁকে সর্বত্র নীচমুখ্য বলে অভিহিত করা হত। নন্দ প্রথমে মন্ত্রী হয়ে প্রভূত ধন সংগ্রহ করে তারপর নিজেই রাজা হয়ে যান। মগধের রাজধানীতে সেই সময় অনেক ব্রাহ্মণ তার্কিক বাস করতেন, রাজা নন্দ তাঁদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকতেন। নন্দ নিজে ধর্মশীল (অর্থাৎ বৌদ্ধ) ছিলেন, বুদ্ধধাতুর পূজা করতেন এবং অনেকগুলি বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই ব্রাহ্মণদেরও যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য করতেন। নন্দের মন্ত্রীমুখ্য ছিলেন বররুচি নামে এক অতিপ্রাজ্ঞ পাটলিপুত্রবাসী ব্রাহ্মণ। নন্দ তাঁর কাজের জন্য মন্ত্রীদের বিরাগভাজন হলেও পূর্ণশক্তিতে রাজত্ব করে ৬৬ বছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন। রাজা নন্দের সখা ছিলেন পাণিনি নামের এক তরুণ ব্রাহ্মণ। পাণিনি লোকীশের (অবলোকিতেশ্বর) মন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।১১ এখানে উল্লিখিত নন্দকে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল মহাপদ্মনন্দ বলে চিহ্নিত করেছেন। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের এই বিবরণ অনুযায়ী পাণিনি মহাপদ্মনন্দের কনিষ্ঠ সমসাময়িক হলে, তিনি চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষার্ধে বিদ্যমান ছিলেন।
পাণিনির জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে আদি-মধ্যযুগে রচিত তিনটি গ্রন্থে কিছু উল্লেখ রয়েছে। দশম শতক সাধারণাব্দের গোড়ার দিকে রাজশেখর রচিত কাব্যমীমাংসা গ্রন্থে (১.১০) লেখা হয়েছে, পাটলিপুত্র শহরে প্রাচীন কালে শাস্ত্রকারদের পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। বর্ষ, উপবর্ষ, পিঙ্গল, ব্যাড়ি, বররুচি ও পতঞ্জলির মতো অন্যান্য শাস্ত্র রচয়িতাদের মতো পাণিনিও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।১২ একাদশ শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে ক্ষেমেন্দ্র রচিত বৃহৎকথামঞ্জরী ও একই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সোমদেব রচিত কথাসরিৎসাগর, উভয় গ্রন্থই বর্তমানে লুপ্ত গুণাঢ্য রচিত বৃহৎকথা গ্রন্থের ভিত্তিতে লেখা। কথাসরিৎসাগরে (১.৪.২০-২৫) বলা হয়েছে, রাজা নন্দের আমলে তাঁর রাজধানী পাটলিপুত্রে ব্যাকরণের আচার্য বর্ষ বাস করতেন। বররুচি বা কাত্যায়ন ও ব্যাড়ি তাঁর শিষ্য ছিলেন। পাণিনিও বর্ষের শিষ্য ছিলেন, কিন্তু ক্ষীণবুদ্ধি ছিলেন। পরে তিনি হিমালয়ে গিয়ে কঠিন তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে, শিবের কাছ থেকে সর্ববিদ্যার উত্সস্বরূপ এক নতুন ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন। তারপর, পাণিনি বররুচির সঙ্গে বিতর্ক শুরু করে অষ্টম দিনে শিবের প্রভাবে তাঁকে পরাস্ত করেন। ঐন্দ্র ব্যাকরণের চর্চার ধারা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়।১৩ বৃহৎকথামঞ্জরীতেও (১.২.৭১-৭৪) প্রায় এই একই কাহিনির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ আছে।১৪ দ্বাদশ (বা ত্রয়োদশ) শতক সাধারণাব্দের কাশ্মীরি শৈব বিদ্বান রাজানক জয়রথ (বা জয়দ্রথ) রচিত হরচরিতচিন্তামণি গ্রন্থের ২৭তম প্রকাশেও প্রায় একই কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে। এখানে পাণিনিকে শিবের রূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।১৫ কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথামঞ্জরী ও হরচরিতচিন্তামণি গ্রন্থের বিবরণের উত্স বৃহৎকথা। আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দী সাধারণাব্দে শৈব মতাবলম্বী গুণাঢ্যের রচিত বৃহৎকথা গ্রন্থে১৬ বর্ণিত এই কাহিনি সম্ভবত তাঁর নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত, এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
জুয়ান জাং-এর বিবরণ থেকে শুরু করে হরচরিতচিন্তামণি পর্যন্ত বর্ণিত কাহিনিগুলি থেকে ব্যাকরণ চর্চার উত্পত্তি ও পাণিনিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রচলিত পুরাকথার সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করা যায়। তবে, প্রচলিত পুরাকথায় ঐন্দ্র ব্যাকরণ নামে দেবরাজ ইন্দ্র রচিত যে প্রাক-পাণিনীয় ব্যাকরণের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনও বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।১৭ ব্যাকরণ চর্চার উত্পত্তির সঙ্গে ইন্দ্রের সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত পুরাকথাটির উত্স কিন্তু বেশ প্রাচীন। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬.৪.৭.৩) ইন্দ্রের দ্বারা ব্যাকরণের (ব্যুত্পত্তিগত অর্থ, প্রত্যেক ধ্বনির পৃথক স্পষ্ট উচ্চারণ) সূত্রপাত সংক্রান্ত একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে, পতঞ্জলি মহাভাষ্যের প্রথম পস্পশাহ্নিকে বলেছেন, শোনা যায়, বৃহস্পতি এক সহস্র দিব্য বর্ষ (অর্থাৎ ৩৬৫,০০০ বছর) ধরে ইন্দ্রকে শব্দপারায়ণ (অর্থাৎ, সব শব্দের পৃথকভাবে জ্ঞান) শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়েছিলেন, কিন্তু সব শব্দ শেষ করতে পারেননি। এখনকার মানুষেরা তো খুব বেশি হলে একশো বছর বাঁচেন, শিক্ষাগ্রহণ করতে করতেই তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। অতএব এই ভাবে প্রত্যেক শব্দের পৃথক জ্ঞান সম্ভব নয়।১৮ লক্ষণীয়, মানুষের আয়ু কমে একশো বছর হয়ে যাওয়ার কথা জুয়ান জাং-এর বিবরণেও আছে।
১৩২২ সাধারণাব্দে তিব্বতি বিদ্বান বুতোন-রিনছেন-ডুব (১২৯০-১৩৬৪ সাধারণাব্দ) রচিত ‘ভারত ও তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে ভারতের ব্যাকরণ চর্চার ইতিবৃত্ত প্রসঙ্গে পাণিনির জীবনকথা উল্লিখিত হয়েছে। বুতোন লিখেছেন, লঙ্কাবতারসূত্রে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে পাণিনি ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করবেন (সদ্ধর্মলঙ্কাবতারসূত্রের সগাথক শীর্ষক দশম অধ্যায়ের ৮১৩ সংখ্যক শ্লোকে এ কথা বলা হয়েছে) এবং মঞ্জুশ্রীমূলতন্ত্র গ্রন্থে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে পাণিনি বোধিলাভ করবেন। সৃষ্টির শুরুতে সর্বজ্ঞ নামে দেবতা ৩৩ সংখ্যক দেবতাদের স্বর্গে ব্যাকরণের এক বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। দেবতারা এই গ্রন্থ ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ফলে জম্বুদ্বীপে আবির্ভূত হতে পারেনি। এরপর দেবরাজ শক্র (ইন্দ্র) ইন্দ্রব্যাকরণ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ঋষি বৃহস্পতি এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে দেবশিশুদের শিক্ষা দেন। তিনি দেবগুরু ও ব্যাকরণের আচার্য বলে জ্ঞাত হন। তিনি, আমি ছাড়া আর কারও ব্যাকরণের জ্ঞান নেই এই ভেবে বিপুল অহংকারে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। তখন দেবরাজ সমুদ্র থেকে এক কলস জল সংগ্রহ করে, সেই কলস থেকে কুশাগ্রে এক ফোঁটা জল নিয়ে বৃহস্পতিকে বলেন, ব্যাকরণের জ্ঞান সমুদ্রতুল্য, আমার জ্ঞান এই কলসের জলের সমান আর আপনার জ্ঞান এই এক ফোঁটা জলের সমান। ইন্দ্রের কথা শুনে বৃহস্পতি হতাশ হয়ে ব্যাকরণের শিক্ষাদান ত্যাগ করার কথা ভাবেন। ইন্দ্র বৃহস্পতিকে যতটা তিনি জানেন, ততটা পড়াতে নির্দেশ দেন। বৃহস্পতি ইন্দ্রের নির্দেশে ব্যাকরণের শিক্ষা দান শুরু করেন এবং এইভাবে জম্বুদ্বীপে ইন্দ্রব্যাকরণের আগমন ও প্রসার হয়। ইন্দ্রব্যাকরণের বিলুপ্তির পর ব্রাহ্মণ পাণিনির আবির্ভাব হয়। ব্যাকরণ শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে তিনি এক হস্তরেখাবিদের কাছে হাত দেখান, সে বলে পাণিনি কখনওই ব্যাকরণের জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন না। পাণিনি একটি ধারালো ছুরি দিয়ে করতলে ঐ রেখাটি সৃষ্টি করে আচার্যের সন্ধানে যাত্রা করেন, কিন্তু তিনি কোনও আচার্যের সন্ধান পেলেন না। তখন তিনি মহাদেবের তপস্যা শুরু করেন। মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে পাণিনির কাছে তাঁর বাসনা জানতে চাইলে, পাণিনি তাঁর কাছে ব্যাকরণ শিক্ষা করতে চান। মহাদেব পাণিনিকে আশীর্বাদ করে ‘অ’, ‘ই’, ‘উ’ একসাথে উচ্চারণ করেন এবং পাণিনি সমগ্র ব্যাকরণ শাস্ত্র বুঝতে পারেন। বুতোনের মতে এটি একটি কিংবদন্তি মাত্র। তাঁর মতে, বাস্তবে পাণিনি অবলোকিতকে সন্তুষ্ট করে ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন, এবং একথাই শাস্ত্র সম্মত, কারণ মঞ্জুশ্রীমূলতন্ত্র গ্রন্থের ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ সন্তান পাণিনি শ্রাবক বোধি লাভ করবেন এবং লোকেশ্বরের মন্ত্রে সিদ্ধি লাভ করবেন। পাণিনির রচিত পাণিনীয় ব্যাকরণে ২০০০টি নিয়ম আছে এবং নাগরাজ (শেষনাগ অর্থাৎ পতঞ্জলি) এক লক্ষ শ্লোকে মহাভাষ্য নামে এর একটি বহুল প্রচারিত ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন।১৯ বুতোন পাণিনিকে নিয়ে প্রায় সব শৈব ও বৌদ্ধ পুরাকথাই উল্লেখ করেছেন।
তিব্বতি বিদ্বান তারনাথ তিনটি বর্তমানে বিলুপ্ত সংস্কৃত গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে ১৬০৮ সাধারণাব্দে তাঁর তিব্বতি ভাষায় লেখা ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তারনাথ লিখেছেন, ব্রাহ্মণ পাণিনি রাজা নন্দের মিত্র ছিলেন। তিনি পশ্চিমের ভিরুক বনে জন্মগ্রহণ করেন। পাণিনি এক হস্তরেখাবিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি ব্যাকরণের আচার্য হতে পারবেন কিনা। সেই হস্তরেখাবিদ বলেন, তা সম্ভব নয়। পাণিনি তখন একটি ধারালো ছুরি দিয়ে করতলের রেখা পরিবর্তন করেন। তারপর, বিশ্বের সব বৈয়াকরণের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে ও প্রভূত পরিশ্রম করে ব্যাকরণে ব্যুত্পত্তি লাভ করেন। কিন্তু, তিনি সন্তুষ্ট না হয়ে ইষ্টদেবতার আরাধনা শুরু করেন। কঠিন সাধনার পর ইষ্টদেবতা তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন, ‘অ’, ‘ই’, ‘উ’। পাণিনি তিন লোকের সমস্ত শব্দজ্ঞান লাভ করেন। বাইরের লোকেরা (তীর্থিক বা অবৌদ্ধ) তাঁকে ঈশ্বর (মহেশ্বর) বলে মনে করে, কিন্তু এর কোন ভিত্তি নেই। ভিতরের লোকেরা (বৌদ্ধরা) তাঁকে অবলোকিতেশ্বর বলেই জানে। কারণ মঞ্জুশ্রীমূলতন্ত্র গ্রন্থে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ পাণিনি শ্রাবক-বোধি লাভ করবেন, এবং তিনি মহান লোকেশ্বর হবেন। পাণিনি পণি ব্যাকরণ নামে এক সহস্র শ্লোকে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন এবং এক সহস্র শ্লোকে নিজের গ্রন্থের একটি ভাষ্যও রচনা করেন। তাঁর পূর্ববর্তী কোনও ব্যাকরণ গ্রন্থ বিদ্যমান নেই। তাঁর গ্রন্থ রচনার পূর্বে বৈয়াকরণরা ব্যাকরণের বিভিন্ন ক্ষুদ্র গ্রন্থ থেকে নিয়মাবলি সংগ্রহ করে ব্যাকরণ শিখতেন। তিব্বতে বিশ্বাস করা হয় ইন্দ্র ব্যাকরণ পাণিনির ব্যাকরণের চেয়ে প্রাচীন। তা সত্য হলে, এই গ্রন্থ কোনও দেবতার রচনা। তবে, ভারতের ইন্দ্র ব্যাকরণ নিশ্চিতভাবে পাণিনির পূর্ববর্তী রচনা নয়। তিব্বতে অনূদিত চন্দ্র ব্যাকরণ পণি ব্যাকরণের সম-মতাবলম্বী। কলাপ ব্যাকরণ ইন্দ্র ব্যাকরণের সম-মতাবলম্বী।২০ লামা তারনাথের বিবরণে পাণিনি সম্পর্কে কেবল বৌদ্ধ পুরাকথাই সমাবিষ্ট হয়েছে।
অষ্টাধ্যায়ী – বিষয় ও ভাষা
পাণিনির রচিত গ্রন্থটি ৮টি অধ্যায়ে বিভাজিত, সূত্রাকারে রচিত ব্যাকরণের নিয়মাবলি। প্রচলিত ঐতিহ্য অনুযায়ী, এই গ্রন্থে সংজ্ঞা, পরিভাষা, বিধি, নিয়ম, অতিদেশ ও অধিকার, এই ৬ প্রকারের ব্যাকরণের নিয়ম বর্ণিত হয়েছে২১ (প্রতিষেধ নামের সপ্তম প্রকারেরও উল্লেখ পাওয়া যায়)। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায় ৪টি পাদে বিভক্ত। এই গ্রন্থে একটি পূর্বপরিকল্পিত ক্রম অনুসারে সূত্রগুলিকে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। দ্বিতীয় শতক সাধারণপূর্বাব্দের পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে পাণিনির ১৭১৩টি সূত্র বিশ্লেষিত হয়েছে এবং আরও অনেক সূত্র উল্লিখিত হয়েছে। সাধারণাব্দের সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর সর্বাধিক জনপ্রিয় কাশিকা নামের বৃত্তি (ব্যাখ্যামূলক) গ্রন্থ রচনা করেন জয়াদিত্য ও বামন (কাশিকা বৃত্তির কোন অংশ কার রচনা, আজও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি)। কাশিকা বৃত্তিতে পাণিনির ৩৯৮৩টি সূত্র উদ্ধৃত করা হয়েছে। কাশিকা বৃত্তিতে উদ্ধৃত প্রথম সূত্র ‘অথ শব্দানুশাসনম্’ পাণিনির নয় বলেই অধিকাংশ প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্বানদের মত। আধুনিক সংস্কৃত বিদ্বান ফ্রাঞ্জ কিলহর্নের মতে, কাশিকা বৃত্তিতে পাণিনির কিছু সূত্রকে পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থের রূপ থেকে পরিবর্তিত রূপে উদ্ধৃত করা হয়েছে; কাত্যায়নের বার্তিকা ও মহাভাষ্য থেকে সংগৃহীত কিছু মন্তব্যকে পাণিনির সূত্র বা সূত্রের অংশ হিসাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং মূল গ্রন্থের কিছু সূত্রকে বিভক্ত করে একাধিক সূত্র হিসাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কাশিকা বৃত্তিতে অষ্টাধ্যায়ীর পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থের রূপের থেকে ২০টি অতিরিক্ত সূত্র উদ্ধৃত হয়েছে।২২ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে পাণিনির একটি সূত্রের (৬.৩.১০৯) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সম্ভবত ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত বলে গ্রন্থটিকে অষ্টাধ্যায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাণিনির রচনা প্রাচীন কাল থেকেই শব্দানুশাসন নামেও পরিচিত। এই গ্রন্থটি অষ্টক নামেও পরিচিত।
অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থটির প্রারম্ভে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ধ্বনিমালার অক্ষরসমাম্নায় বা বর্ণসমাম্নায় (অর্থাৎ ধ্বনিগুলিকে ব্যাকরণের নিয়ম রচনার জন্য বর্গীকরণ) বিষয়ক ১৪টি প্রত্যাহারসূত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছে। প্রত্যাহারসূত্রের ১৪টি সূত্রে ধ্বনিমালাকে উচ্চারণ অনুযায়ী ৪টি স্বরধ্বনি ও ১০টি ব্যঞ্জনধ্বনির বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে। স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির এই বর্গগুলিকে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত করে ৪১টি (বা ৪২টি) প্রত্যাহার২৩ (অর্থাৎ সংক্ষেপিত রূপ) নির্মাণ করে বিভিন্ন সূত্রে ব্যাকরণের নিয়ম বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে। পতঞ্জলির মহাভাষ্যের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রত্যাহারসূত্রগুলি পাণিনিরই রচনা। আধুনিক বিদ্বানরাও একই মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে প্রত্যাহারসূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণ গ্রন্থের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে নিঃসন্দেহে ধ্বনিমালার বর্গীকরণ করার কাজ পাণিনির পূর্বেই শুরু হয়েছিল এবং পাণিনি এই রকম একাধিক বর্গীকরণ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।২৪
প্রত্যাহার সূত্রগুলি পরবর্তী কালে শিবসূত্র বা মাহেশ্বরসূত্র নামেও পরিচিত হয়। সম্ভবত এর সঙ্গে একটি প্রচলিত পুরাকথা জড়িত। বুতোন ও তারনাথের বিবরণে মহাদেব কর্তৃক পাণিনিকে প্রথম প্রত্যাহারসূত্র (অইউণ্) প্রদানের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আদি-মধ্যযুগের কোনও সময় রচিত নন্দিকেশ্বরকাশিকা (বা নন্দিকেশ্বরকারিকা) নামের একটি শৈব গ্রন্থের প্রথম শ্লোকে উল্লিখিত পুরাকথা অনুযায়ী নটরাজ শিব নটরাজ শিব তাঁর নৃত্য সমাপ্তির পর ১৪ বার ঢক্কা নিনাদ করেন। তার ফলে ১৪টি শিবসূত্রের উদ্ভব হয়।২৫ বর্তমানে বিদ্যমান পাণিনীয় শিক্ষা গ্রন্থের একটি শ্লোকে (৫৭) বলা হয়েছে, যিনি মহাদেবের কাছ থেকে অক্ষরসমাম্নায় লাভ করে সমগ্র ব্যাকরণ রচনা করেছেন, সেই পাণিনিকে প্রণাম। এই শ্লোকটির সম্ভবত প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, একাদশ শতক সাধারণাব্দে হরদত্ত রচিত কাশিকা বৃত্তির ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ পদমঞ্জরী গ্রন্থে। কিন্তু হরদত্ত শ্লোকটিকে কোনও গ্রন্থ নয়, প্রচলিত ঐতিহ্য থেকে সংগৃহীত বলে উল্লেখ করেছেন।২৬ এরপর একই শতকে রচিত ধর্মকীর্তির রূপাবতার গ্রন্থের মঙ্গলাচরণের প্রথম শ্লোক হিসাবে এই শ্লোকটি দেখতে পাওয়া যায়। ধর্মকীর্তিও শ্লোকটি কোনও গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত বলে উল্লেখ করেননি। বর্তমানে বিদ্যমান অগ্নিপুরাণে (৩৩৫.১-২১) সংকলিত পাণিনীয় শিক্ষাতেও এই শ্লোকটি পাওয়া যায় না। নবম শতক সাধারণাব্দে বর্তমান অগ্নিপুরাণের রচনার সূত্রপাত বলে আধুনিক বিদ্বানদের অভিমত। সম্ভবত, শ্লোকটি বিগত সহস্রাব্দের মাঝামাঝি কোনও সময় পাণিনীয় শিক্ষা গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে।২৭
পঞ্চাঙ্গ বা পঞ্চাবয়ব ব্যাকরণের ঐতিহ্য অনুযায়ী পাণিনির রচিত মূল গ্রন্থের সঙ্গে আরও ৪টি খিল (অর্থাৎ পরিশিষ্ট) গ্রন্থকে যুক্ত করা হয় – ধাতুপাঠ, গণপাঠ, উণাদিসূত্র ও লিঙ্গানুশাসন। এই খিল গ্রন্থগুলির অস্তিত্বের কারণে মূল গ্রন্থটিকে সূত্রপাঠ বলেও অভিহিত করা হয়। ৪টি খিল গ্রন্থের রচনাকাল ও রচয়িতা সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে। অষ্টম শতক সাধারণাব্দের গোড়ার দিকে জিনেন্দ্রবুদ্ধি কাশিকা বৃত্তি গ্রন্থের কাশিকাবিবরণপঞ্জিকা বা ন্যাস শিরোনামের একটি ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। জিনেন্দ্রবুদ্ধি, তাঁর ন্যাস গ্রন্থে ধাতুপাঠ ও গণপাঠ পাণিনির রচনা নয় বলে যুক্তি দিয়ে প্রতিপাদিত করেছেন। তিনি গণপাঠের কিছু অংশ কাত্যায়নের বার্তিকের চেয়েও আধুনিক বলে উল্লেখ করেছেন।২৮ অন্যদিকে, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেরই মতে ধাতুপাঠ এবং গণপাঠ পাণিনিরই রচনা। কিন্তু, ধাতুপাঠ ও গণপাঠের বর্তমান রূপে মূল অংশের সঙ্গে পরবর্তীকালের প্রক্ষেপের চিহ্ন বিদ্যমান। বর্তমানে যে উণাদিসূত্র ও লিঙ্গানুশাসনের রূপ পাওয়া যায়, তা পতঞ্জলির মহাভাষ্যেরও পরবর্তীকালের রচনা বলে আধুনিক বিদ্বানদের ধারণা।২৯ ধাতুপাঠ প্রায় ২০০০টি ধাতুর (অর্থাৎ ক্রিয়ার বিভক্তিবিহীন মূল অংশের) ১০টি গণে বর্গীকৃত সংকলন, মূল গ্রন্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। গণপাঠ প্রাতিপদিকের (অর্থাৎ, বিভক্তিবিহীন অর্থযুক্ত নামশব্দের) বর্গীকৃত সংকলন। উণাদিসূত্র ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যোগের নিয়ম নিয়ে রচিত, এর শুরু উণ্ বিভক্তি দিয়ে, সেই কারণে এই নাম। লিঙ্গানুশাসন শব্দের অর্থ ও গঠন অনুযায়ী লিঙ্গ নির্ধারণের নিয়ম নিয়ে রচিত।
সূত্রাকারে রচিত অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থ সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম রচনা, যা কোনও বৈদিক শাখার সঙ্গে যুক্ত নয়, বা বেদাঙ্গ গ্রন্থ বলে পরিগণিত নয়। অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের অধিভাষাও পাণিনির নিজস্ব সৃষ্টি বলেই মনে হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনি পূর্ববর্তী আচার্যদের রচনা থেকে কিছু পারিভাষিক শব্দ গ্রহণ করেছেন। পাণিনি ঠিক কোন ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছেন এই বিষয় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে দু’টি পৃথক ভাষার উল্লেখ রয়েছে – ভাষা (৩.২.১০৮ ও অন্যত্র) এবং ছন্দস (১.২.৩৬ ও অন্যত্র)। ভাষা অর্থে সম্ভবত পাণিনি তৎকালীন গান্ধারের স্থানীয় মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার কথা বুঝিয়েছেন আর ছন্দস তাঁর জ্ঞাত বৈদিক সাহিত্যের ভাষা। তবে তিনি ঠিক কোন বৈদিক গ্রন্থসমূহের ভাষা সম্পর্কে ছন্দস কথাটির প্রয়োগ করেছিলেন, তা আজ যথাযথভাবে নির্ণয় করা দুষ্কর। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, পাণিনি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের তৎকালীন প্রচলিত মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির সম্পর্কেও যথেষ্ট পরিমাণে অবহিত ছিলেন। তিনি একটি সূত্রে (৪.২.৭৪) বিপাশা (বর্তমাণ বিয়াস) নদীর উত্তর ও দক্ষিণে উচ্চারণের পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যতদূর বোঝা যায়, পাণিনি বৈদিক ভাষা, সমসাময়িক কথোপকথনের ভাষা এবং সম্ভবত সমসাময়িক প্রাচীন শ্রৌতসূত্রগুলির ভাষার শব্দভাণ্ডারের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সমস্ত শব্দসমূহের ব্যাকরণগত কাঠামো গঠনের নিয়মাবলি উল্লেখ করেছেন। তিনি কোনও ভাষায় সম্পূর্ণ বাক্য গঠনের পরিবর্তে বীজগাণিতিক রূপে সংক্ষেপিত সূত্রের আকারে রচনা করেছেন। সেই কারণে, পাণিনির প্রায় কোনও সূত্রেরই, ঐ সম্পর্কিত অন্য সূত্রগুলি না জানলে অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কার্যত এই সূত্রগুলির মাধ্যমে তিনি এক কঠোর নিয়মবদ্ধ সাহিত্যিক ভাষার ব্যাকরণের সৃষ্টি করেছেন। এই সাহিত্যিক ভাষাই পরবর্তীকালে সংস্কৃত (আধুনিক বিদ্বানদের রচনায় ধ্রুপদী সংস্কৃত) নামে পরিচিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, পাণিনির গ্রন্থের কোথাও সংস্কৃত শব্দটিকে ভাষা অর্থে প্রয়োগ করা হয়নি; বাল্মীকি রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডে (সমীক্ষাত্মক সংস্করণ, ২৮.১৮) প্রথম সংস্কৃত শব্দটি বাক্ অর্থাৎ ভাষা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নিঃসন্দেহে সূত্রাকারে ব্যাকরণের নিয়মগুলিকে গ্রন্থিত করার প্রয়াস পাণিনির বেশ কিছু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, পাণিনির রচনায় তা সম্পূর্ণতা লাভ করে। তবে, পাণিনির সূত্রগুলি বৈদিক সাহিত্য ও তৎকালীন প্রচলিত ভাষার ব্যাকরণের নিয়মগুলি সম্পর্কে তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ না ভাষাশিক্ষার জন্য শিষ্যদের প্রতি ব্যাকরণের নির্দিষ্ট নিয়মাবলির উপদেশ এ নিয়ে আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে সংশয় আছে। প্রাচীন বৈদিক ভাষা প্রস্বরিত ভাষা। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে বিশ্লেষিত ভাষার রূপটির সঙ্গে রামায়ণ ও মহাভারতের ভাষা বা পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার মিল থাকলেও, সেই ভাষায় স্বরধ্বনির তিনটি রূপ— উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত বিদ্যমান (১.২.২৯-৩১)। কোনও কোনও আধুনিক বিদ্বান অবশ্য মনে করেন, পাণিনি কেবল গান্ধারে তৎকালীন প্রচলিত মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা শিক্ষার জন্য ব্যাকরণের নিয়মগুলি সূত্রাকারে রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে, সাধারণপূর্বাব্দের তৃতীয় শতকে কাত্যায়ন ও দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি পাণিনির সূত্রগুলিকে বিশ্লেষণের সময় নিয়মগুলিকে সংশোধন, সংযোজন বা পরিবর্তন করে পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংস্কৃতের ব্যাকরণের নিয়মে পরিণত করেন। এখানে বলা দরকার, আমাদের জ্ঞাত কোনও মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা কিন্তু পাণিনির ব্যাকরণে বিশ্লেষিত ভাষার মতো প্রস্বরিত ভাষা নয়।
পাণিনির ভাষাচর্চা ও বৈদিক ঐতিহ্য
বৈদিক ভাষার চর্চা সম্ভবত প্রথম গুরুত্ব লাভ করে চারটি বেদসংহিতার, বিশেষত ঋগ্বেদসংহিতার পদপাঠ রচনার মাধ্যমে। পদপাঠ গ্রন্থগুলিতে বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ চর্চার প্রারম্ভিক রূপের নিদর্শনও দেখা যায়। প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেকে বৈদিক ভাষা চর্চার তিনটি ধারা, শিক্ষা এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী শিক্ষা ধারার সঙ্গে যুক্ত পার্ষদ বা প্রাতিশাখ্য, নিরুক্ত ও ব্যাকরণকে ষড় বেদাঙ্গ অর্থাৎ ৬টি বেদাঙ্গের মধ্যে ৩টি বেদাঙ্গ বলে অভিহিত করা শুরু হয়। প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দে বৈদিক ভাষার ক্রমপরিবর্তনশীল উচ্চারণ ও মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা অর্থাৎ ধ্বনিবিদ্যার চর্চার গুরুত্ব ছিল খুবই বেশি। সময়ের সাথে সাথে প্রাচীন বৈদিক ভাষার শব্দভাণ্ডারের বৃদ্ধি ও অর্থের পরিবর্তনের কারণে নিরুক্ত অর্থাৎ ব্যুত্পত্তিতত্ত্বের চর্চারও সমান গুরুত্বও ছিল। শিক্ষা ও নিরুক্ত চর্চার সঙ্গে ব্যাকরণের চর্চার ওতপ্রোত যোগ ছিল। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণ রচনার সময় শিক্ষা ও নিরুক্ত বিষয়ক চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তী আচার্যদের প্রাসঙ্গিক চিন্তনকে বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করেছেন। অন্তত দু’টি প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ, শৌনক রচিত বলে জ্ঞাত ঋগ্বেদপ্রাতিশাখ্য ও অজ্ঞাত লেখকের তৈত্তিরীয়প্রাতিশাখ্য পাণিনির পূর্ববর্তী রচনা বলে আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান।৩০ যাস্ক রচিত নিরুক্ত পাণিনির পূর্ববর্তী না পরবর্তী রচনা এ বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। বাজসনেয়ী প্রাতিশাখ্য গ্রন্থের রচয়িতা কাত্যায়ন ও অষ্টাধ্যায়ীর বার্তিককার কাত্যায়ন একই ব্যক্তি বলে আধুনিক বিদ্বানদের মত।৩১
ব্যাকরণ বেদাঙ্গ বলে বৈদিক ঐতিহ্যে স্বীকৃত হলেও কোনও বৈদিক শাখার ব্যাকরণ গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায় না। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে পূর্ববর্তী দশ আচার্যের নাম ও তাঁদের মতের কথা উল্লেখ করেছেন। অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে উল্লিখিত এই আচার্যরা হলেন আপিশলি (৬.১.৯২), কাশ্যপ (১.২.২৫), গার্গ্য (৭.৩.৯৯, ৮.৩.২০ ও ৮.৭.৬৭), গালব (৬.৩.৬১, ৭.১.৭৪, ৭.৩.৯৯ ও ৮.৪.৬৭), চাক্রবর্মণ (৬.১.১৩০), ভারদ্বাজ (৭.২.৬৩), শাকটায়ন (৩.৪.১১১, ৮.৩.১৮ ও ৮.৪.৫০), শাকল্য (১.১.১৬, ৬.১.১২৭, ৮.৩.১৯ ও ৮.৪.৫১), সেনক (৫.৪.১১২) এবং স্ফোটায়ন (৬.১.১২৩)। পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে অষ্টাধ্যায়ীর একটি সূত্রের (৩.২.১০৮) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘উপসেদিবান্ কৌৎসঃ পাণিনিম্’। এর ভিত্তিতে জনৈক কৌৎস পাণিনির শিষ্য ছিলেন বলে অনুমান করা যায়, কিন্তু ইনিই যাস্কের নিরুক্ত গ্রন্থে (১.১৫) উল্লিখিত কৌৎস কিনা বলা সম্ভব নয়। এই উল্লেখগুলি থেকে পাণিনির আগে ও পরে ভাষাচর্চা যে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় অব্যাহত ছিল তা বোঝা যায়।
পাণিনির বাসভূমি গান্ধার অঞ্চল ষষ্ঠ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষার্ধে পারসিক আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আকিমিনীয় সম্রাট দারিয়াসের (রাজত্বকাল ৫২২-৪৮৬ সাধারণপূর্বাব্দ) ত্রৈভাষিক বিসিতুন (বেহিস্তুন) শিলালেখ (আনুমানিক ৫২০-৫১৮ সাধারণপূর্বাব্দ) থেকে বোঝা যায়, দারিয়াস যখন আকিমিনীয় সিংহাসন দখল করেন তখন গন্দার (অর্থাৎ গান্ধার) আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্ভবত তাঁর পূর্ববর্তী আকিমিনীয় সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৫৯-৫৩০ সাধারণপূর্বাব্দ) গান্ধার জয় করেছিলেন।৩২ আকিমিনীয় সম্রাট তৃতীয় আর্তাজারেক্সেসের রাজত্বকালের (আনুমানিক ৩৫৮-৩৩৮ সাধারণপূর্বাব্দ) শেষ পর্যন্ত যে গান্ধার আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার প্রমাণ তাঁর সমাধির শিলালেখ থেকে বোঝা যায়।৩৩ পাণিনির সময়ও গান্ধার আকিমিনীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল, তবে সম্ভবত প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল না। আকিমিনীয় আমলে সরকারি নথিগুলি আরামীয় ভাষায় লেখা হতো। অনুমান করা যায়, গান্ধার জয়ের পর এই অঞ্চলেও আরামীয় ভাষায় সরকারি নথি লেখা শুরু হয়। প্রাচীন গান্ধার (পূর্ব আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশ) অঞ্চল থেকে এখনও কোনও আরামীয় ভাষায় লেখা আকিমিনীয় সরকারি নথি না পাওয়া গেলেও পার্শ্ববর্তী প্রাচীন ব্যাকট্রিয়া (উত্তর আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান) অঞ্চলে চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের আরামীয় সরকারি নথি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আরামীয় লিপি থেকেই খরোষ্ঠী লিপি উদ্ভূত হয়। প্রাচীন গান্ধার অঞ্চলে খরোষ্ঠী লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তৃতীয় শতক সাধারণপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের (রাজত্বকাল ২৬৮-২৩২ সাধারণপূর্বাব্দ) শাহবাজ গরহি ও মানসেহরা শিলালেখে। সম্রাট অশোকের কান্দাহার শিলালেখে আরামীয় লিপিরও নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তবে, অশোকের লেখগুলিতে খরোষ্ঠী বা আরামীয় লিপির যে রূপ পাওয়া যায়, সেই লিপিতে গান্ধারী বা মাগধী প্রাকৃতের মতো ভাষার ধ্বনিমালা লেখা সম্ভব, প্রত্যাহারসূত্রে যে ভাষার ধ্বনিমালার উল্লেখ রয়েছে, সেই ভাষা নয়।
পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে (৩.২.২১) লিপি ও লিবি উভয় শব্দেরই উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন পারসিক ভাষায় ডিপি বা দিপি শব্দ থেকে প্রাচীন পূর্ব ইরানীয় ভাষায় লিপি ও লিবি শব্দদ্বয় উদ্ভূত হয়েছিল। পাণিনি সম্ভবত প্রাচীন পূর্ব ইরানীয় ভাষা থেকে এই শব্দ দু’টি গ্রহণ করেছিলেন। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে (৬.৩.৭৯) লিখিত পুথি অর্থে গ্রন্থ শব্দের ব্যাবহার করেছেন। ভূর্জপত্র বা তালপত্রের পৃষ্ঠার মধ্যে ছেদ করে সুতো দিয়ে বেঁধে পাণ্ডুলিপি তৈরির রীতি থেকে গ্রন্থ শব্দটি উদ্ভূত। অতএব এই ধরনের পুথির কথাও তিনি জানতেন। পাণিনি অষ্টাধ্যায়ীর একটি সূত্রে (৪.১.৪৯) যবন থেকে যবনানী শব্দটির ব্যুত্পত্তির উল্লেখ করেছেন, কাত্যায়ন তাঁর বার্তিক গ্রন্থে এই সূত্রের ব্যাখ্যায় যবনানী শব্দটির অর্থ যবন ভাষার লিপি বলে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে কেউ কেউ এই যবন ভাষা গ্রিক বলে মনে করলেও, বাকিরা যবনানীর অর্থ প্রাচীন পারসিক ভাষার লিখিত রূপ, অর্থাৎ প্রাচীন পারসিক কিউনিফর্ম লিপি বলে মনে করেন। ভাষার লিখিত রূপ ও লিখিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও পাণিনি তাঁর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বসমন্বিত সূত্রগুলিকে মৌখিক রূপে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়েই রচনা করেছিলেন তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়।৩৪ বৈদিক মৌখিক ঐতিহ্য প্রসঙ্গে মহাভারতের অনুশাসনপর্বের একটি শ্লোকে (সমীক্ষাত্মক সংস্করণ, ২৪.৭০) বলা হয়েছে, “বেদবিক্রয়িণশ্চৈব বেদানাং চৈব দূষকাঃ।/ বেদানাং লেখকাশ্চৈব তে বৈ নিরয়গামিনঃ॥” অর্থাৎ, ‘যারা বেদ বিক্রয় করে, বেদের নিন্দা করে এবং যারা বেদ লেখে তারা নরকে যায়’ (হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্যের অনুবাদ অনুসরণে)। গান্ধারের ব্রাহ্মণ পাণিনি বৈদিক মৌখিক ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই তাঁর ভাষাচর্চার ফসলকে সূত্রের রূপ দিয়েছিলেন। পাণিনি কয়েকটি ধাতুকে যে ভাবে সূত্রে উল্লেখ করেছেন, লিখিত রূপে তার কোনও প্রয়োজন ছিল না।৩৫
টীকা
- C.A. Seelakkhanda Maha Thera edited, ‘The Trikandaçesha, A Collection of Sanskrit Nouns by Sri Purushottama Deva King of Kalinga, India’; Bombay: Khemaraja Shrikrishnadâsa, (1916):60.
- Mahāmahopādhyāya Paṇḍit Śivadatta and Vāsudeva Laxmaṇ Śāstrī Paṇaśīkar edited, ‘The Yaśastilaka of Somadeva Sûri with the Commentary of Śrutdeva Sûri, Part I’; Bombay: Nirṇaya-Sāgar Press, (1916):236.
- Mahāmahopādhyāya Paṇḍit Śivadatta, Kāśīnāth Pāṇḍurang Parab and Wāsudev Laxmaṇ Śāstrī Paṇśīkar edited, ‘The Patañjali Charita of Ramabhadra Dikshit’; Bombay: Nirṇaya-Sāgar Press, (1934):5.
- George Cardona, ‘Pāṇini: A Survey of Research’, p 260-268.
- Madhav M. Deshpande, “Who Inspired Pāṇini? Reconstructing the Hindu and Buddhist Counter-Claims” in ‘Journal of the American Oriental Society, Jul.-Sep., 1997, Vol. 117, No. 3’; American Oriental Society, p. 444-465.
- C. Sankara Rama Sastri, ‘Kāvyālaṅkāra of Bhāmaha, Paricchedas 1 to 6 with English Translation and Notes on Paricchedas 1 to 3’; Madras: Sri Balamanorama Press, (1956): 184.
- John Faithful Fleet, “Alina Copper-Plate Inscription of Siladitya VII. The Year 447.” in ‘Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III’; Calcutta: The Superintendent of Government Printing, India, (1988):175.
- Julius Eggeling, ‘Vardhamāna’s Ganaratnamahodadhi with the Author’s Commentary’; Delhi: Motilal Banarsidass, (1963):2.
- Samuel Beal, ‘Si-Yu-Ki, Buddhist Record of The Western World: Translated from The Chinese of Hiuen Tsiang (A.D. 629), Vol. I’; London: Trübner & Co., (1840):114-118. See also, Li Rongxi, ‘The Great Tang Dynasty Record of The Western Regions (Taishō Volume 51, Number 2087)’; Moraga, California: BDK America, (1996):68-70.
- “পাণিনিং শব্দনেতারমক্ষপাদো বৃহস্পতিঃ।/ লোকায়তপ্রণেতারো ব্রহ্মা গর্ভো ভবিষ্যতি॥”
- P.L. Vaidya edited, ‘Mahāyānasūtrasaṁgraha, Part II’; Darbhanga: The Mithila Institute of Post-Graduate Studies and Research in Sanskrit Learning, (1964):477-478. See also, K.P. Jayaswal, ‘An Imperial History of India in a Sanskrit Text (c. 700 B.C.- c. 770 A.D.)’; Lahore: Motilal Banarsidass, (1934):14-16.
- C.D. Dalal and R.A. Sastry edited, ‘Kāvyamimāmsā of Rājaśekhara’; Baroda, Oriental Institute, third edition, (1934):55.
- Paṇdit Durgâprasâd and Kâśīnāth Pâṇḍurang Parab edited, ‘The Kathâsaritsâgara of Somadevabhatta’; Bombay: Nirṇaya-Sâgara Press, (1889):9.
- Mahâmahopâdhyâya Paṇḍit Śivadatta and Kâśīnâth Pâṇḍurang Parab edited, ‘The Bṛihatkathâmañjari of Kshemendra’; Bombay: Nirṇaya-Sâgara Press, 1901):12-13.
- Mahâmahopâdhyâya Paṇḍit Śivadatta and Kâśīnâth Pâṇḍurang Parab edited, ‘The Haracharitachintâmaṇi of Râjânaka Jayaratha’; Bombay: Nirṇaya-Sâgara Press, (1897):223-236.
- S.N. Dasgupta and S.K. Dey edited, ‘A History of Sanskrit Literature: Classical Period, Vol. I’; Calcutta: University of Calcutta, second edition (reprint), (1977):92-93.
- George Cardona, ‘Pāṇini: A Survey of Research’; The Hague: Mouton, (1976):150-151.
- Bhargava Sastri Bikaji Joshi edited, ‘The Vyākaraṇamahābhāṣya of Patañjali with the Commentary Bhāṣyapradīpa of Kaiyaṭa Upādhyāya and the Supercommentary Bhāṣyapradīpoddata of Nāgeśa Bhaṭṭa, Vol. I: Navāhnika (on the Aṣṭādhyāyī, Chapter I, Quarter I)’; Delhi: Chaukhamba Sanskrit Pratishthan, (1987):54.
- E. Obermiller translated, ‘History of Buddhism (Chos-ḥbyung) by Bu-Ston, II. Part: The History of Buddhism in India and Tibet’; Heidelberg: Institut für Buddhismus-Kunde, (1932):166-167.
- Lama Chimpa and Alaka Chattopadhyaya translated, ‘Tāranātha’s History of Buddhism in India’; Delhi: Motilal Banarsidass, (1990):83-84.
- “সংজ্ঞা চ পরিভাষা বিধির্নিয়ম এব চ।/ অতিদেশোঽধিকারশ্চ ষড়বিধং সূত্রমুচ্যতে॥”
- F. Kielhorn, “Notes on the Mahabhashya, 6. The text of Panini’s Sutras, as given in the Kasika-Vritti, compared with the text known to Katyayana and Patanjali” in John Faithful Fleet and Richard Carnac Temple edited, ‘The Indian Antiquary, A Journal of Oriental Research, Vol. XVI’; Bombay: Education Society’s Press, (1887):178-184.
- Swami Dwarika Das Shastri and Kalika Prasad Shukla edited, ‘Nyāsa or Pañcikā Commentary of Ācārya Jinendrabuddhipada and Padamañjari of Haradatta Miśra on The Kāśikāvṛtti (Commentary on the Aṣṭādhyāyī of Pāṇini) of Vāmana-Jayāditya, Part I (Chapter First)’; Varanasi: Prachya Bharati Prakashan, (1965):59-60.
- Paul Kiparsky, “Economy and Construction of the Śivasūtras” in ‘Madhav M. Deshpande and Saroja Bhate edited, ‘Pāṇinian Studies, Professor S.D. Joshi Felicitation Volume’; Ann Arbor: Center for South and Southeast Asian Studies, The University of Michigan, (1991):239-261.
- “নৃত্তাবসানে নটরাজরাজো ননাদ ঢক্কাং নবপঞ্চবারম্।/ উদ্ধর্তুকামঃ সনকাদিসিদ্ধানেতদ্বিমর্শে শিবসূত্রজালম্॥” K.S. Balasubramanian and T.V. Vasudeva edited, ‘Śrīnandikeśakāśikā Upamanyukṛtatattvavimarśinīsahitā with Roman transliteration and English translation’; Chennai: The Kuppuswami Sastri Research Institute, (2009):3.
- “যেনাক্ষরসমাম্নায়মধিগম্য মহেশ্বরাৎ।/ কৃত্স্নং ব্যাকরণং প্রোক্তং তস্মৈ পাণিনয়ে নমঃ॥” Swami Dwarika Das Shastri and Kalika Prasad Shukla edited, ‘Nyāsa or Pañcikā Commentary of Ācārya Jinendrabuddhipada and Padamañjari of Haradatta Miśra on The Kāśikāvṛtti (Commentary on the Aṣṭādhyāyī of Pāṇini) of Vāmana-Jayāditya, Part I (Chapter First)’, p. 9.
- Madhav M. Deshpande, “Who Inspired Pāṇini? Reconstructing the Hindu and Buddhist Counter-Claims”, p 444-465.
- যুধিষ্ঠির মীমাংসক, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ-শাস্ত্র কা ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ’; বহালগড়: যুধিষ্ঠির মীমাংসক, (১৯৮৪):৪৪-৪৫, ১৫২-১৫৩।
- Hartmut Scharfe, ‘Grammatical Literature, A History of Indian Literature, Vol. V, Fasc. 2’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, (1977):105.
- George Cardona, “Sanskrit” in George Cardona and Dhanesh Jain edited, ‘The Indo-Aryan Languages’; Abingdon, Oxon: Routledge, (2014):117
- Hartmut Scharfe, ‘Grammatical Literature, A History of Indian Literature, Vol. V, Fasc. 2’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, (1977): 129.
- T. Cuyler Young Jr, “The early history of the Medes and the Persians and the Achaemenid empire to the death of Cambyses” in edited, John Boardman, N.G.L. Hammond, D. M. Lewis and M. Ostwald edited, ‘The Cambridge Ancient History, Vol. 4, Persia, Greece and the western Mediterranean, c. 525 to 479 B.C.’; Cambridge: Cambridge University Press, 2nd edition, (1988):36
- Cameron A. Petrie and Peter Magee, “The Achaemenid Expansion to the Indus and Alexander’s Invasion of North-West South Asia” in ‘Iranian Journal of Archaeological Studies, Volume 2, Issue 1’; Zahedan: Archaeological Sciences Research Centre, University of Sistan and Baluchestan, (2012):8.
- Michael Witzel, “Gandhara and the formation of the Vedic and Zoroastrian canons” in ‘Proceedings of the International Symposium., The Book, Romania, Europa, Etudes euro- et afroasiatiques’; Bucharest: Biblioteca ucurestilor, (2011):490-532.
- ibid.
আকর গ্রন্থপঞ্জি
- George Cardona, ‘Pāṇini: A Survey of Research’; The Hague: Mouton, (1976).
- George Cardona, ‘Pāṇini: His Works and its Traditions, Volume One, Background and Introduction’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2nd edition, (1997).
- George Cardona, ‘Recent Research in Pāṇinian Studies’; Delhi: Motilal Banarsidass, (1999).
- Hartmut Scharfe, ‘Grammatical Literature, A History of Indian Literature, Vol. V, Fasc. 2’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, (1977):88-116.
- Joseph Naveh and Shaul Shaked edited, ‘The Khalili Collection: Ancient Aramaic Documents from Bactria (Fourth Century B.C.E.), Corpus Inscriptionum Iranicarum, Part I, Volume V, Texts II’; London: The Khalili Family Trust, (2006).
- Rama Nath Sharma, ‘The Aṣṭādhyāyī of Pāṇini, Vol. I: Introduction to the Aṣṭādhyāyī as a Grammatical Device’; New Delhi: Munshiram Manoharlal, second edition, (2002).
- রামেশ্বর শ’, ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’; কলকাতা: পুস্তক বিপণি, (২০১২)।
- Saroja Bhate, ‘Makers of Indian Literature: Panini’; New Delhi: Sahitya Akademi, (2002).
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’; কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, (১৯৬০)।
- সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘ভাষাকোশ’; কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, (২০১৪)।
- V.S. Agrawala, ‘India as Known to Pāṇini (A Study of the Cultural Material in the Ashṭādhyāyī)’; Varanasi: Prithvi Prakashan, 2nd edition, (1963).
- Wiesiek Mical translated, ‘The Root Manual of the Rites of Mañjuśrī, Mañjuśrīmūlakalpa’; Dharmachakra Translation Committee, 84000: Translating the Words of the Buddha, (2020) [https://read.84000.co/translation/UT22084-088-038.html].
- যুধিষ্ঠির মীমাংসক, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ-শাস্ত্র কা ইতিহাস, প্রথম ভাগ’; বহালগড়: যুধিষ্ঠির মীমাংসক, (১৯৮৪)।
- যুধিষ্ঠির মীমাংসক, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ-শাস্ত্র কা ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ’; বহালগড়: যুধিষ্ঠির মীমাংসক, (১৯৮৪)।