সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কম্বোডিয়ায় একদিন

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কম্বোডিয়ায় একদিন

সুদীপ্ত পাল

আগস্ট ২৬, ২০২৩ ৫০৩ 3

কম্বোডিয়া – অতীতের নাম কম্বুজ। ভারতের বাইরে আরেকটা ভারত। আঙ্কোরওয়াট বিষ্ণুমন্দিরের বিশালতা আমাদের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। কিন্তু আরও আশ্চর্য করল আঙ্কোর-পূর্ববর্তী যুগের শিল্পকৃতি। আঙ্কোর যুগ হল নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক যখন আঙ্কোর ছিল খ্মেরদের রাজধানী। তার আগে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক ছিল চেনলা কিংডমের যুগ। এই যুগের মন্দির অল্প কিছু অবশিষ্ট আছে, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাব নেই, নম পেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কম্বোডিয়ায় গেলে দেখা যায়। আঙ্কোর-পূর্ব, আঙ্কোর ও আঙ্কোর-পরবর্তী তিন যুগেরই সংগ্ৰহ এই মিউজিয়ামে আছে।

মিউজিয়ামে ঢুকলে সবার প্রথমে ব্রোঞ্জের সংগ্ৰহ – ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু। তার মধ্যে সবার প্রথমে বৌদ্ধ সংগ্ৰহ। তিনরকম বুদ্ধের রূপ এদেশের মূর্তিশিল্পে প্রচলিত। লোকেশ্বর, মৈত্রেয়, আর বুদ্ধ স্বয়ং। ভারতে যাকে অবলোকিতেশ্বর বলা হয়, কম্বোডিয়ায় তিনি লোকেশ্বর। সাধারণতঃ লোকেশ্বর মহাযানের সঙ্গে যুক্ত আর মৈত্রেয় থেরবাদের সঙ্গে। পরে মহাযান ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকলে লোকেশ্বরও থেরবাদের সঙ্গে যুক্ত হন। লোকেশ্বরের সাধারণতঃ দুটো হাত হয়, ক্ষেত্রবিশষে চারটে। মৈত্রেয় বুদ্ধের আটটা, ক্ষেত্রবিশষে চারটে। এছাড়া আছেন বুদ্ধ নিজে, সপ্তমস্তক মুচলিন্দ নাগ তাঁর ছত্রধর। সিংহভাগ সময়ে এদেশে তাঁকে পিঠে সাপ নিয়ে দেখা যায়। সাতমাথা এই সাপের নাম মুচলিন্দ। আরেকটা মূর্তিরূপ এখানে জনপ্রিয় ছিল – লোকেশ্বর, বুদ্ধ ও প্রজ্ঞাপারমিতার ত্রয়ীমূর্তি।

আঙ্কোর শহর জুড়ে দেখেছি চারিদিকে সাপ – বাসুকি আর মুচলিন্দ এই দুই পৌরাণিক নাগ যেন শহরটা দখল করে রেখেছে। প্রত্যেকটা মন্দিরের সামনের রেলিং হল বাসুকি, প্রত্যেকটা প্রাচীন সেতুর রেলিংও বাসুকি। তাকে ধরে টানছে অসুররা – এই সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য সারা শহরকে তার রূপ দিয়েছে। মুচলিন্দর মতো বাসুকিরও সাতখানা মাথা। নম পেন শহরের মন্দিরগুলোও এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে।

বাসুকি আর মুচলিন্দ। একটা সাপ বিষ্ণুর, অন্যটা বুদ্ধের। ভারতে মুচলিন্দ-বুদ্ধ এতটা জনপ্রিয় কখনোই হয়নি। তৃতীয় একটি নাগও আছে – শেষনাগ। মুচলিন্দ-বুদ্ধমূর্তি আর শেষশায়ী বিষ্ণুমূর্তি দেখলে মনে হবে যেন কোথাও একটা বুদ্ধ আর বিষ্ণুকে একীকরণ করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

মিউজিয়ামের বৌদ্ধ সংগ্ৰহে ব্রোঞ্জের কাজ প্রচুর দেখা যায়। রয়েছে পাথরের মূর্তিও। ব্রোঞ্জ সংগ্ৰহ শেষ হলে দেখা যায় একটা শিলালেখ। এই শিলালেখটিতে আছে একটা বিশেষ সংখ্যা- শূন্য। পৃথিবীতে প্রাপ্ত এখনও অবধি প্রাচীনতম শূন্যের নিদর্শন। ৬০৪ শকাব্দ বোঝাতে শূন্য ব্যবহার হয়েছিল এই সপ্তম শতকের লিপিতে।

বৌদ্ধ ত্রয়ী- লোকেশ্বর, বুদ্ধ, প্রজ্ঞাপারমিতা

শিলালিপিতে শূন্যের নিদর্শন

এরপর শুরু হয় পাথরের সংগ্ৰহ- প্রথমদিকটায় এর সিংহভাগ হিন্দু- যার বেশিরভাগ বৈষ্ণব, কিছু শৈব। শাক্ত ধর্ম প্রায় অনুপস্থিত।

ষষ্ঠ শতাব্দীর মূর্তিগুলো বেশ বড় আকারের। বিষ্ণুর এবং তাঁর অবতারদেরই প্রাধান্য, সঙ্গে বুদ্ধ, হরিহর ও শিবও ছিলেন। এগুলো দুটো কারণে আমার চোখে বিস্ময় জাগালো। এক, এত আগে যখন ভারতের সমুদ্রবাণিজ্যের প্রচুর ঐতিহাসিক নথি নেই, সেইযুগে ওদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির এতখানি বিস্তার হয়েছে। আর দুই, তাদের আকার। বিস্ময়টা ঠিক সাইজের জন্য নয়, অন্য কারণে। মূর্তিগুলো দেখতে দেখতে বারবার ভাবছিলাম ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতে কি এত বিশাল মূর্তি কোথাও দেখেছি? ষষ্ঠ শতাব্দীতে ছিল বাদামি গুহার মূর্তিগুলো- একই রকম বড় বড়, কিন্তু সেগুলো তো গুহামূর্তি- অর্থাৎ পাথরকে যথাস্থানে কেটে করা। পঞ্চম শতাব্দীর অজন্তা আর উদয়গিরিও তাইই। মোট কথা গুপ্ত বা চালুক্য যুগে এরকম মূর্তি ভারতে ছিল না। বরং তার আগে কুষাণ যুগের মথুরা আর মৌর্যযুগে ছিল এরকম মূর্তি – এরকমই আকার, এরকমই বাস্তবানুগতা।

এবার আসি প্রথম বিস্ময়ের জায়গাটাতে। কবে কিভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি ওখানে এসে পৌঁছল? এ ব্যাপারে স্থানীয় অভিলেখ বা ভারতীয় সাহিত্য অতোটা তথ্য দিতে পারে না। বরং চীনা লেখকদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম শতাব্দী থেকেই ওখানে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত ফুনান কিংডমের অস্তিত্ব ছিল। তারপরে ষষ্ঠ শতাব্দীতে আসে চেনলা কিংডম। কিন্তু কিভাবে শুরু হয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার? চীনা রেকর্ডেও প্রচুর তথ্য নেই – তাই নানা তথ্য জুড়ে অনুমান করতে হয়। চৈনিক কাহিনী অনুযায়ী এক ভারতীয় ব্রাহ্মণ আর স্থানীয় নারীর মিলন থেকে ফুনান রাজ্যের সূচনা। এছাড়াও পঞ্চম শতাব্দীর চৈনিক নথি অনুযায়ী তুন-সুন রাজ্যে সহস্রাধিক ব্রাহ্মণের বাস ছিল। তুন-সুন রাজ্যের স্থানীয় অধিবাসীরা ব্রাহ্মণদের কন্যাদান করত। দুটো কাহিনী একটাই বিষয়ের ইঙ্গিত দেয় – ভারতীয় বহিরাগত ব্রাহ্মণ পুরুষ আর মূলনিবাসী নারীদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠত। এর বাইরেও ক্ষত্রিয়করণের একটা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা যায়। কম্বোডিয়াতে নয়, জাভাতে উদাহরণ আছে ব্রাত্যস্তোম ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রাত্যজনকে ক্ষত্রিয় বানানোর।

এই ব্রাহ্মণরা ভারতের কোন প্রান্ত থেকে এসেছিল? স্পষ্ট জানা নেই। ওড়িশা, উত্তর ভারত, দাক্ষিণাত্যের পল্লব রাজ্য – নানা রকম তত্ত্ব আছে। লিপির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের পল্লব লিপির মিল পাওয়া গেছে – কিন্তু সেগুলো চতুর্থ শতকের আগে নয়। ভারতীয়করণ শুরু হয়েছিল প্রথম শতাব্দীতে। লিপি পরে আলাদা ভাবে এসে থাকতে পারে। আবার ফুনানের তৃতীয় শতাব্দীর লিপির সঙ্গে কুষাণ লিপির মিল পাওয়া গেছে। মন্দিরের গঠন উত্তর ভারতের সঙ্গে বেশি মেলে। আঙ্কোর-পূর্ব যুগের মন্দিরগুলোর সঙ্গে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিতরগাঁও মন্দিরের মিল পাওয়া যায়। আমার নিজের ওই মিউজিয়ামের ষষ্ঠ শতকের মূর্তিগুলো দেখে গুপ্ত বা কুষাণ প্রভাব বলে মনে হয়েছিল। তবে মূর্তিগুলোও অনেক পরের- ষষ্ঠ শতাব্দীর। মোটকথা ফুনানের হিন্দু রাজ্যের প্রাথমিক ইতিহাসের পুনর্গঠন বেশ মুশকিল ব্যাপার।

কিন্তু শুধুই কি ব্রাহ্মণ পুরুষদের পরিযান হয়েছিল? বণিকদের হওয়াটা তো বেশি স্বাভাবিক? বৌদ্ধ বণিকদের আনাগোনাও ছিল সম্ভবতঃ। কারণ ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধের বিভিন্ন রূপ – লোকেশ্বর, মৈত্রেয় – এদের মূর্তি প্রচুর পাওয়া গেছে। বুদ্ধ উপাসনা গত দেড় হাজার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে হয়ে এসেছে। তবে এটা ঠিক যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে বৌদ্ধ ধর্মের থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরই দাপট সেখানে বেশি ছিল- বিশেষ করে বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ্য ধর্মের।

মিউজিয়ামের হিন্দু অংশে রয়েছে বিষ্ণুর বিভিন্ন রূপ, আর তাঁর বিভিন্ন অবতার। আছেন গোবর্ধন উত্তোলনকারী কৃষ্ণ। যেভাবে দুই পায়ের মধ্যে ভারবিন্যাস দেখানো হয়েছে, শিল্পীর প্রশংসা করতেই হয়। আছেন পুঁথি হাতে পরশুরাম, লাঙল হাতে হলধর বলরাম। এগুলো সবই ষষ্ঠ শতকের। এগুলো “নম দা” শৈলি হিসেবে পরিচিত। নম দা হল কম্বোডিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে একটি গ্ৰাম, যা ষষ্ঠ শতাব্দীর মন্দির, মূর্তি আর শিলালিপির জন্য পরিচিত। রাজা রুদ্রবর্মণের সময়ে এগুলো তৈরি।

এই অংশেই আছেন ধনুর্ধর রাম। রামের এতো পুরোনো ভাস্কর্য পৃথিবীতে আর দু-একটাই আছে। ভারতের দেওগড় দশাবতার মন্দির- কিন্তু সেটা ঠিক রামের মূর্তি নয় – প্যানেল। আর হরিয়ানায় পেহোয়াতেও গুপ্তযুগের এরকম কিছু প্যানেল পাওয়া গেছে।

কিছু মূর্তি অভাবনীয় রকমের বিশাল। হিন্দু সংগ্রহের শুরুতেই ব্রোঞ্জের শায়িত বিষ্ণুর মাথা। সম্ভবতঃ অনুভূমিক ভাবে শায়িত মূর্তি বলেই এত বড় আকার দিতে পেরেছিল। বালি-সুগ্ৰীবের লড়াই- পাথরের মূর্তি – সেও বিশাল।

ব্রোঞ্জের শায়িত বিষ্ণুর মাথা

গোবর্ধন গিরিধারী

সুবিশাল বিষ্ণুমূর্তি

মূর্তিগুলোর বিশালতার পাশাপাশি আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। মূর্তিগুলোর একটা বড় অংশ শুধু সামনে থেকে নয়, পিছন থেকে দেখলেও তারা সম্পূর্ণ। এর পিছনে একটা কারণ অনুমেয়। কম্বোডিয়া ও ভারতের হিন্দু মন্দিরশৈলীর কিছু পার্থক্য আছে। গর্ভগৃহের ধারণা ওদেশে নেই। মন্দিরের কেন্দ্রীয় মূর্তিগুলোকে চারদিক থেকে দেখা সম্ভব। ভারতীয় হিন্দু মন্দিরে মূল মূর্তিগুলোকে এক দিক থেকেই দেখার নিয়ম, সামনের দিক থেকে দেখার জন্যই তারা নির্মিত। এটা বিশাল একটা পার্থক্য। এটা আঙ্কোরের মন্দিরগুলো দেখার সময়ই লক্ষ করেছিলাম, পরে আরো পূর্ববর্তী যুগের মূর্তিগুলো যখন দেখলাম নম পেন মিউজিয়ামে এসে, তখন ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হল। মূর্তিগুলো চারদিক থেকেই সম্পূর্ণ।

ভারতীয় মূর্তিশিল্পের প্রথম স্তর ছিল মৌর্যযুগে – এবং সেযুগের অনেক মূর্তিই চারিদিক থেকে সম্পূর্ণ। কারণ তখনও পঞ্চায়তন রীতির মন্দির, গুহামন্দির কোনোটাই আসেনি। সম্ভবতঃ কাঠের মন্দির হত। আধুনিক ভারতীয় মূর্তিশিল্পের সূচনা পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীর অজন্তা, উদয়গিরি, বাদামির গুহামন্দিরগুলো থেকে। সেখানে গুহার দেয়াল কেটে মূর্তি হত। তাই মূর্তির পিছন দিকটাকে সুচারুভাবে তৈরির কোনো কারণ নেই। কম্বোডিয়ায় গুহা মন্দির বিশেষ ছিল না। এটাও পার্থক্যের কারণ।

ভারতীয় মন্দিরশিল্প যখন গুহা থেকে পঞ্চায়তনশৈলীর দিকে গেল তখনও দেবমূর্তির সামনের দিকটাই গুরুত্ব পেত। কারণ, ভারতীয় মন্দিরে গর্ভগৃহটাকে প্রদক্ষিণ করা হয় (একমাত্র ব্যতিক্রম শিবলিঙ্গ), বিগ্ৰহটিকে নয়। ওদেশের মন্দিরে মূল মূর্তিগুলোকে প্রদক্ষিণ করা সম্ভব, তাই মূর্তিগুলো সব দিক থেকে দর্শনীয়।

প্রশ্ন জাগে, এই গর্ভগৃহের অনুপস্থিতি কি ওদেশে তুলনামূলকভাবে কম কঠোর জাতিপ্রথার ইঙ্গিত দেয়? ভারতীয় মন্দিরের যত গভীরে যাওয়া যায় স্থানাভাব তত বেশি, ফলে প্রবেশাধিকার তত বেশি জাতিভিত্তিক।

কম্বোডিয়ায় পুরুষ দেবতার বাহুল্য, মিউজিয়ামেও তাই। দেবীমূর্তি সংখ্যায় নগণ্য- দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী এদের একটা দুটো করে মূর্তি দেখলাম- মাঝারি আকারের। বিষ্ণু, শিব আর বুদ্ধ এরাই সর্বত্র। ভারতেও সপ্তম শতাব্দীর আগে দেবীরা গৌণ ছিল। আর ওদেশে মোটামুটি গুপ্তযুগের ভারতীয় ধর্ম ও শিল্পই বেশি করে প্রসার হয়েছিল সেটা আমরা আগেই দেখেছি। ফলে সপ্তম শতক থেকে যে মহিষাসুরমর্দিনী, সপ্তমাতৃকা, উমা-মহেশ্বর আর চৌষঠ যোগিনীর উপাসনা ভারতে ব্যাপকভাবে দেখা যায়, সেটা কম্বোডিয়ায় নগণ্য।

এখানে লিঙ্গমূর্তির প্রচলন ছিল। যোনিও দেখলাম, তবে সেটাকে স্নানদ্রোণী বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে ময়ূরবাহিত কার্তিক, যম, গণেশ আছে।

মূর্তির পাশাপাশি আরেকটা দারুন সংগ্রহ আছে। তোরণের। পাথরের দরজার উপরের অংশ (সরদল বা লিন্টেল)। বিভিন্ন রকম পৌরাণিক চিত্রণ সেখানে আছে। উড়ন্ত গরুড়ের কাঁধে বিষ্ণু, কিংবা উমা-মহেশ্বর সহ কৈলাশ তুলছেন রাবণ।

আঙ্কোর-পূর্ব যুগের পর আঙ্কোর যুগের সংগ্ৰহ। কিছু শৈল্পিক পার্থক্য স্পষ্ট চোখে পড়ে। এই যুগের একটা বিশেষত্ব হল অনেক মূর্তিতে পালিশ দেখা যায়। এটা এইযুগের উদ্ভাবন।

তারপর আছে আঙ্কোর যুগের শেষ দিকের সংগ্রহ। দ্বাদশ শতকের শেষভাগ ও ত্রয়োদশ শতকের। এগুলো বায়ন শৈলী হিসেবে পরিচিত। বায়ন মন্দিরের নামে। এখানে বিষ্ণুর উপস্থিতি কম। বুদ্ধের উপস্থিতি বেশি। মিউজিয়াম শুরু হয় বুদ্ধ দিয়ে, তারপর তাঁর উপস্থিতি কমতে থাকে। কিন্তু এই অংশে আবার তিনি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। কারণ এই সময়ে বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মকে পিছনে ফেলে বৌদ্ধ ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হয়ে উঠতে থাকে।

একদম শেষে সাম্প্রতিক কালের সংগ্রহ। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর। এই অংশে প্রচুর বুদ্ধমূর্তি। আর আছে রামায়ণ পেইন্টিং। সমুদ্রে দুই ভূখণ্ডের মাঝে সেতুরূপী হনুমানের ছবি দেখে মনে হল- এটা কি রামায়ণের হনুমান নাকি বৌদ্ধ জাতকের মহাকপি বোধিসত্ত্ব? যদিও হনুমান, কিন্তু মনে হল যেন দুই গল্পের ক্রসওভার। বানর মহাকপি তার গোষ্ঠীকে রাজার আক্রমণ থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল গঙ্গার এপাড় থেকে ওপাড় দুটি গাছের মধ্যে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়ে। গোষ্ঠীর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল।

পালিশ করা বাজীমুখের মূর্তি

হনুমানের সমুদ্র পার হবার চিত্রণ

এই মিউজিয়ামটা ঘুরলে কম্বোডিয়ার দেড় হাজার বছরের সংস্কৃতির একটা ঝলক পাওয়া যায়। একদিকে দেখা যায় ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতির আত্তীকরণ, অন্যদিকে তার মধ্যে নিজস্ব উদ্ভাবন যা ভারতীয় শিল্পরীতির থেকে স্বতন্ত্র। কোনো কোনো সময়কালে হিন্দু মূর্তির অতিরিক্ত উপস্থিতি আর কোনো সময়কালে বৌদ্ধ মূর্তির- এটা একটা সংঘাতের চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু পাশাপাশি দুই ধর্মের শিল্পগত সাদৃশ্য একটা শৈল্পিক ধারাবাহিকতার ছবিও তুলে ধরে।

তথ্যসূত্র:

The Indianized States of Southeast Asia, by George Cœdès

Materials from Cambodian National Museum

মন্তব্য তালিকা - “ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কম্বোডিয়ায় একদিন”

  1. জানা গেল না ভারতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঠিক কি ভাবে হলো। আমাদের দেশের গর্ভগৃহের মুর্তী ও কাম্বোডিয়ার মূর্তির রকম ফের কেন এই সুন্দর বিশ্লেষণ আগে কোথাও পাই নি। সমুদ্র বানিজ্য ছিল তার কিছু ইতিহাস জানলে আরও পূর্ণতা পেত। ভাষা বর্ণনা বিশ্লেষণ লেখকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।