সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

নালন্দার শেষ অধ্যায় – বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা

নালন্দার শেষ অধ্যায় – বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০ ৩৬৬৮ 4

বর্তমান বিহারের নালন্দা জেলায় অবস্থিত, প্রাচীন মগধের দুই প্রধান নগর রাজগৃহ ও পাটলিপুত্রকে সংযোগকারী রাজপথের ধারে অবস্থিত নালন্দার বৌদ্ধ মহাবিহারের গৌরবের ইতিহাস বিগত কয়েক দশক যাবৎ ভারতের প্রায় সব বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত। কিভাবে পঞ্চম শতকের শুরুতে গুপ্ত বংশের সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত পূর্ব ভারতের বৌদ্ধশাস্ত্রের, বিশেষতঃ মহাযান ধর্মশাস্ত্র ও বৌদ্ধ মূর্তিনির্মাণশাস্ত্র চর্চার এই মহান বিদ্যাপীঠের পঠন-পাঠনের সমাপ্তি ঘটল, এই প্রশ্নের উত্তরে, বোধহয় প্রায় সবাই বলবেন, ‘নালন্দা মুসলিম আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেছিল।‘ এই বিশ্বাস জনমানসে অত্যন্ত ব্যাপক, এবং এর কারণ সম্ভবতঃ বিংশ শতক থেকে বহু আধুনিক বিদ্বানদের রচনায় এই বিশ্বাসের অভিব্যক্তি। এই বিদ্বানদের অনেকেই আবার নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ১১৯৩, ১১৯৭, ১১৯৮, ১২০০ ১২০২, ১২০৫ বা ১২০৬ সাধারণাব্দের মধ্যে কোন একটি বর্ষকে এই ‘ঘটনা’র সম্ভাব্য তারিখ বলে চয়ন করেছেন।[১]

এই আধুনিক বিশ্বাসের সাম্প্রতিক স্বরূপ ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্রের রচনা থেকে উদ্ধৃত করা যাক, “A Khalji officer, Bakhtiyar Khalji, whose uncle had fought the battle of Tarain, had been appointed in charge of some of the areas beyond Banaras. He had taken advantage of this to make frequent raids into Bihar, which was at that time in the nature of a no-man’s land. During these raids, he had attacked and destroyed some of the famous Buddhist monasteries o Bihar, Nalanda and Vikramasila, which had no protector left.”[২]

সতীশ চন্দ্র বর্ণিত এই আধুনিক বিশ্বাস কি বাস্তব ইতিহাস না কল্পিত অতীতের নির্মাণ? তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেই কেবল সত্য জানা সম্ভব।

এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত যে, আনুমানিক ১১৯৮-১১৯৯ সাধারণাব্দে আফগান সেনাপতি ইখতিয়ার-উদ-দীন মুহম্মদ (বখতিয়ার খলজি রূপে পরিচিত) এবং তার সৈন্যরা মগধ অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ বিহারের কোন একটি বৌদ্ধ বিহারকে দুর্গ ভেবে ধ্বংস করেছিল। এই ঘটনার অর্ধ শতকেরও পর, ১২৫৯ সাধারণাব্দে, মিনহাজ-ই-সিরাজ জুর্জানি, তাঁর ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থের বিংশতিতম খণ্ডে এই ধ্বংসলীলার বর্ণনা দিয়েছেন। বখতিয়ার খলজির এই আক্রমণে নিজাম-উদ-দীন ও সমসাম-উদ-দীন নামে দুই ভাই অংশগ্রহণ করেছিল। মিনহাজের এই বর্ণনার উৎস ১২৪৩ সালে তাঁর লখনৌতি (লক্ষ্মণাবতী) শহরে অবস্থানকালে সমসাম-উদ-দীনের কাছ থেকে শোনা বিবরণ: “It is said by the credible persons that he went to the gate of the fort of Behār with only two hundred horses, and began the war by taking the enemy unawares… Muhammad Bakhtiyār with great vigour and audacity rushed in at the gate of the fort and gained possession of the place. Most of the inhabitants of the place were Brāhmans with shaven heads. They were put to death. Large numbers of books were found there and when the Muhammadans saw them, they called for some persons to explain their contents, but all the men had been killed. It was discovered that the whole fort and city was a place of study (madrasa). In the Hindī language the word Behār (vihār) means a college.”[৩] 

মিনহাজের এই বর্ণনা থেকে অবশ্য ঠিক কোন বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করা হয়েছিল তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয় (যদিও মিনহাজ তাঁর গ্রন্থের ঠিক পূর্ববর্তী খণ্ডে ‘ঔদন্দ’ জয়ের কথা উল্লেখ করেছেন)। ১৬০৮ সাধারণাব্দে লামা তারনাথ, তাঁর ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ (‘rGya-gar-chos-‘byuṅ’) রচনা করেন। তিনটি (বর্তমানে লুপ্ত) প্রাচীনতর সংস্কৃত গ্রন্থের ভিত্তিতে রচিত এই গ্রন্থে, তারনাথ পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন এই বৌদ্ধ বিহার হল ওদন্তপুরী (বর্তমান বিহার শরীফ): “Then came the Turuṣka king called the Moon to the region of Antarvedi in-between the Gaṅgā and the Yamunā. Some of the monks acted as the messengers for this king. As a result, the petty Turuṣka rulers of Bhaṃgala and other places united, ran over whole of Magadha and massacred many ordained monks in Odantapurī. They destroyed this and also Vikramaśīla. The Persians at last built a fort on the ruins of the Odanta vihāra.”[৪]

তারনাথের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথমে ওদন্তপুরী ও তারপর বিক্রমশীল মহাবিহার ধ্বংস করা হয়। নালন্দার কোন উল্লেখই তারনাথ করেন নি। এত স্পষ্ট তথ্য থাকা সত্ত্বেও কিন্তু আধুনিক বিদ্বানদের অনেকের সংশয় দূরীভূত হয় নি।

সতীশ চন্দ্রের পূর্বে ঐতিহাসিক হাসমুখ ধীরজলাল সাঙ্কলিয়াও বিশ্বাস করেছেন বখতিয়ার খলজির নালন্দা ধ্বংস করার কাহিনী। ১৯৩৪ সালে লেখা ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা’ গ্রন্থে, সাঙ্কলিয়া অবশ্য মিনহাজের বর্ণিত ১১৯৯ সাধারণাব্দে বখতিয়ার খলজির দ্বারা ধ্বংস করা বৌদ্ধ বিহারকে তারনাথের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ওদন্তপুরী বলে মেনে নিয়েছেন। তিনি এও স্বীকার করে নিয়েছেন বখতিয়ার খলজির ১১৯৯ সাধারণাব্দে নালন্দা ধ্বংস করার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও, তিনি প্রথমে অনুমান ও তারপর সরাসরি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, বখতিয়ার খলজিই ১২০৫ সাধারণাব্দে নালন্দাও ধ্বংস করেছিল। যেহেতু, সাঙ্কলিয়ার বিশ্বাস ছিল নালন্দার সমাপ্তি মুসলিম আক্রমণের পরিণাম, তাই সম্ভবতঃ তিনি কোন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, “Needless to say, the description of the so called fort of Bihar refers to the capture and destruction of a Buddhist monastery. Now this has been identified with the monastery of Odanatapuri, founded by Rāmapāla, on the strength of remarks of Taranath…It would thus appear that there is no direct evidence to Nālandā was destroyed by the Mohammedans in the year A.D. 1199. We, however, think that the description of the loot and ravage of the monastery referred to by the Moslem chronicler as well apply to Nālandā. The reasons for this suggestion are as under: 1. Nālandā like Vikramaśilā and Odanatapuri, had, as we learn from Hiuen Tsiang, a big surrounding wall, which would give it the appearance of a fortress. 2. It had also a rich library containing countless books. 3. Moreover, its antiquity and huge establishment were sufficient reasons for the invader to regard it as very prosperous and therefore a good bait for attack. Likewise, we would suggest the year A.D. 1205-1206, as the probable date of the Vihāra’s destruction…Kutubuddin thus seems to have had the Sultanate in or about 1205 A.D.; and as Bakhtiyar Khilji was honoured by Kutubuddin as A Sultan, the invasion, therefore, of Bihar approximately took place in or about 1205 or 1206 A.D. Hence, Nālandā was destroyed by the Mohammedans in or about 1205 A.D…The Moslem invasion therefore appears to be the immediate cause of the destruction of Nālandā.”[৫]

সাঙ্কলিয়ারও পূর্বে আরেক ঐতিহাসিক যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার, তাঁর ‘দ্য গ্লোরিস অফ মগধ’ (১৯২৪) এই ভাবেই কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই লিখেছিলেন, “…the date of the conquest falls in 1199. That was the year of the destruction of all the Buddhist places of learning in Bihar, Nālandā, Vikramaśīla and Odantapura.”[৬]     

আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে ব্যতিক্রমী কালিকা রঞ্জন কানুনগোর অবশ্য বখতিয়ার খলজি কোন বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেছে এই বিষয়ে কোন সংশয় ছিল না। তিনি লিখেছেন, “The fortified monastery which Bakhtyār captured probably in 1199 A.D. was known as Audand-Bihār or Odaṇḍapura-Vihāra.”[৭]   

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও প্রায় একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন, “Within a short time Bakhtiyār amassed enough fortune from his plunders to build up a large force. Finding these districts are utterly prostrate and incapable of any resistance, he was emboldened to push as far as the Vihāra of Odantapurī (Bihār) and, obtaining permission from Aibak, made a final attack upon that town. There were no soldiers to defend it. But some feeble resistance was offered by the helpless shaven headed Śramaṇas (Buddhist monks), who were taken by Bakhtiyār to be Brahmin priests and slaughtered.”[৮]

কালিকা রঞ্জন কানুনগো এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো, যাঁরা তারনাথের ঐতিহাসিক সাক্ষ্যকে স্বীকার করবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে সংশয়মুক্ত যে, বখতিয়ার খলজির সেনারা নালন্দা ধ্বংস করে নি, ধবংস করেছিল ওদন্তপুরী। কেন প্রথমে ওদন্তপুরী ও তারপর বিক্রমশীল মহাবিহার আক্রান্ত হয়েছিল, তার সূত্রও সম্ভবতঃ পেতে পারি তারনাথের রচনায়: “To protect Odantapurī and Vikramaśīla, the king even converted these partially into fortresses and stationed some soldiers there.”[৯]

তারনাথের রচনা থেকে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, দুর্গপ্রাকার ও সৈন্যের উপস্থিতির খবর শুনে বখতিয়ার খলজি ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীল মহাবিহারকে দুর্গ শহর বলে অনুমান করে আক্রমণ করেছিল। সাধারণাব্দের ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভে, যখন আফগান সেনারা সমস্ত মগধ (বর্তমান দক্ষিণ বিহার) জুড়ে ইতস্তত লুঠতরাজ চালাচ্ছিল, তখন, নালন্দার মহাবিহারের ঠিক কি পরিস্থিতি ছিল, তা জানার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান অবশ্যই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। সংযোগবশতঃ, ১২৩৪ থেকে ১২৩৬ সাধারণাব্দ পর্যন্ত মগধে উপস্থিত ছিলেন তিব্বতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও অনুবাদক ছোইজে পাল (Chos-rje-dpal, ধর্মস্বামী বা ধর্মশ্রী) (১১৯৭-১২৬৪ সাধারণাব্দ)। ধর্মস্বামীর ‘নাম-থর’ (rnam-thar) এবং অষ্টাদশ শতকের তিব্বতি গ্রন্থ ‘পাগ সাম জোন জাং’ (Dpag bsam ljon bzaṅ) আমাদের এই পর্বের প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধানে সাহায্য করে।   

তিব্বতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও চাগ লোচাবা (chag lo-tsā-ba, চাগ বংশীয় অনুবাদক) ছোইজে পাল (ধর্মস্বামী) শেষ জীবনে নিজের ‘নাম-থর’ (rnam-thar, জীবনকথা) বর্ণনা করেছিলেন তাঁর এক শিষ্য ছোই পাল দারপ্যাং (Chos-dpal-dar-dpyaṅ)-কে। মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৩৬ সালে তিব্বত ভ্রমণকালে ছোই পাল দার প্যাং (Chos-dpal-dar-dpyaṅ)-এর লিপিবদ্ধ করা ধর্মস্বামীর জীবনকাহিনীর একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান এবং এর একটি প্রতিলিপি ভারতে নিয়ে আসেন। এই প্রতিলিপিটি বর্তমানে পাটনার বিহার রিসার্চ সোসাইটিতে সংরক্ষিত রয়েছে।[১০]  এই গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম ‘চাগ বংশীয় অনুবাদক গুরু ধর্মস্বামীর জীবনী’ (Bla ma Chos-rje-dpal chag lo-tsā-ba’i rnam-thar)। ছোইজে পালের (ধর্মস্বামীর) জীবনকথার পাণ্ডুলিপিতে উল্লিখিত বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, তিনি ১২৩৪ সাধারণাব্দের এপ্রিল মাসে মিথিলা (বর্তমান উত্তর বিহার) থেকে গঙ্গা নদী পার হয়ে মগধে (বর্তমান দক্ষিণ বিহারে) পৌঁছান। বোধগয়ায় পৌঁছে, ১২৩৪ সাধারণাব্দের জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ১২৩৪ সাধারণাব্দের শীতকালে মগধের বিভিন্ন তৎকালীন বৌদ্ধ তীর্থ দর্শন করে, ১২৩৫ সাধারণাব্দের জানুয়ারীতে রাজগৃহে পৌঁছান এবং ঐ বছরেরই এপ্রিল মাসে রাজগৃহ থেকে নালন্দায় যান। ১২৩৬ সাধারণাব্দের মার্চে নালন্দার শিক্ষা সম্পূর্ণ করে, মে বা জুন মাসে গঙ্গা পার হয়ে, মিথিলায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ঠিক ২ বছর মগধে অতিবাহিত করেছিলেন।[১১]    

ছোইজে পাল (ধর্মস্বামী) যখন নেপাল থেকে ভারতে আসেন, তখন মিথিলা (বর্তমান উত্তর বিহার) বা তিরহুতের রাজা ছিলেন কর্ণাট বংশীয় রামসিংহ (রাজত্বকাল ১২২৭-১২৮৫ সাধারণাব্দ) এবং মগধের (বর্তমান দক্ষিণ বিহারের) রাজা ছিলেন বুদ্ধসেন (রাজত্বকাল ১২৩০-১২৬০ সাধারণাব্দ)। কিন্তু, এঁদের সামরিক ও প্রশাসনিক প্রভাব ছিল খুবই সামান্য (তারনাথের বর্ণনা অনুযায়ী, বুদ্ধসেন আফগানদের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন), আফগান সেনারা সমস্ত অঞ্চল জুড়ে ব্যাপকভাবে লুঠ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিহার শরীফে (অর্থাৎ ওদন্তপুরীতে) আফগানরা একটা সেনাশিবির স্থাপন করেছিল।[১২] ধর্মস্বামীর ভারতে আগমনের পূর্বেই তুরুষ্ক (অর্থাৎ, আফগান) সৈন্যরা বিক্রমশীল মহাবিহারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিল।[১৩]

ছোইজে পালের (ধর্মস্বামীর) জীবনকাহিনীর দশম অধ্যায়ে তাঁর নালন্দার অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। ধর্মস্বামী যখন নালন্দায় পৌঁছান, তখন, নালন্দার ৭টি চৈত্য এবং ১৪টি বৃহৎ বিহারের (প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে কেবল ৫টি চৈত্য ও ১১টি বৃহৎ বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে) মধ্যে অধিকাংশই নিয়মিত দানের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায়, ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় ছিল না। এদের মধ্যে কয়েকটি আফগান সেনাদের হাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কেবল ২টি মাত্র বৃহৎ বিহার ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় ছিল। অবশ্য ৮৪টি ক্ষুদ্র বিহার (যার অধিকাংশই একজনমাত্র ভিক্ষু থাকার মত ঘর) মোটামুটি অক্ষত ছিল। চারটি দেবমূর্তি তখনও নিয়মিত পূজিত হত – খসর্পণ লোকেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, জ্ঞাননাথ (বা মহাকাল, বৌদ্ধ তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী ইনি নালন্দার রক্ষক দেবতা) ও তারা। নালন্দায় সেই সময় ৯০ বছর বয়সী আচার্য রাহুলশ্রীভদ্রের কাছে ৭০ জন ভিক্ষু শিক্ষালাভ করছিলেন। মগধের রাজা বুদ্ধসেন তাঁর গুরু রাহুলশ্রীভদ্রকে একটি মশারিসমেত রত্নখচিত বিছানা, একটি হাতপাখা আর একটি মশা তাড়ানোর ধূপদানী দান করেছিলেন। নালন্দার মহাবিহারের ভিক্ষুদের দৈনন্দিন ভোজনের জন্য আর্থিক সাহায্য করতেন ওদন্তপুরীর (বিহার শরীফের) রাহুলশ্রীভদ্রের শিষ্য এক বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ, জয়দেব। ধর্মস্বামী নালন্দায় থাকাকালীন, একবার আফগান সেনারা জয়দেব ও তাঁর এক আত্মীয়কে (খুব সম্ভব, নালন্দার গোপন ধনভাণ্ডারের সন্ধান নিতে) ওদন্তপুরীতে বন্দী করে। জয়দেব তখন দূত পাঠিয়ে তাঁর গুরু রাহুলশ্রীভদ্রকে সম্ভাব্য নালন্দা আক্রমণ সম্বন্ধে সতর্ক করেন। সমস্ত ভিক্ষুরা ভয়ে পালিয়ে গেলে, একা ধর্মস্বামী তাঁর গুরু রাহুলশ্রীভদ্রকে নিয়ে নিকটবর্তী জ্ঞাননাথ (বা মহাকাল) মন্দিরে আশ্রয় নেন। আফগান সেনারা নালন্দায় এসে লুঠ করার মত কিছু না পেয়ে ফিরে চলে যায়। জয়দেবও কয়েকদিন বাদে কারামুক্ত হন।[১৪] ধর্মস্বামীর বিবরণ থেকে দুটি বিষয় পরিস্কার, প্রথমতঃ তৎকালীন নালন্দার ভগ্নদশার মূল কারণ ছিল নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, এবং, দ্বিতীয়তঃ নালন্দায় পঠনপাঠন ধর্মস্বামীর সময়েও একেবারে বন্ধ হয় নি। নালন্দার গ্রন্থাগারগুলির কি অবস্থা ছিল তা অবশ্য ধর্মস্বামীর জীবনী থেকে জানা যায় নি।

১৭৪৮ সাধারণাব্দে লেখা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসগ্রন্থ ‘পাগ সাম জোন জাং’ (Dpag bsam ljon bzaṅ অর্থাৎ কল্পদ্রুম)-এর লেখক মঙ্গোলীয় বিদ্বান সুমপা খনপো ইয়েশে পালজোর (Sum-pa Mkhan-po Ye-śes-dpal-’byor) (১৭০৪-১৭৮৮ সাধারণাব্দ)। নালন্দার গ্রন্থাগার কিভাবে ধ্বংস হল, সে সম্বন্ধে অতিলৌকিকতার স্পর্শমিশ্রিত একটি বিবরণ এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই বিবরণ অনুযায়ী নালন্দা মহাবিহারের যে অংশে গ্রন্থাগারটি অবস্থান করত, ঐ অংশ ধর্মগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। ধর্মগঞ্জে, তিনটি বহুতল ভবন – ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নোদধি’ ও ‘রত্নরঞ্জক’ নিয়ে ছিল এই গ্রন্থাগারের ব্যাপ্তি।[১৫] তুরুষ্ক (অর্থাৎ, আফগান) সেনার আক্রমণে নালন্দার চৈত্য ও বিহারগুলির যে ক্ষতি হয়েছিল, তা মুদিতভদ্র নামের এক ভিক্ষু মেরামত করে দেন। এর কিছুদিন বাদে, মগধের রাজার মন্ত্রী কুক্কুটসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। ঐ মন্দিরের উদঘাটন চলাকালীন দুজন অতি দুঃস্থ তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুক সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকজন দুরন্তপ্রকৃতির তরুণ ‘শ্রমণেব’ (শিক্ষানবিশ ভিক্ষু) তাঁদের গায়ে নোংরা জল ছিটিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ঐ দুই ভিক্ষুক অত্যন্ত রুষ্ট হন। সূর্যদেবকে প্রসন্ন করার জন্য তাঁদের মধ্যে একজন বারো বছর ধরে তপস্যা করেন এবং শেষে তাঁরা দুজনে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞশেষে তাঁরা জ্বলন্ত সমিধ ও ভষ্ম নালন্দার বিহারগুলির ওপর ছুঁড়তে শুরু করলে প্রায় সমস্ত বিহারেই আগুন লেগে যায়। ধর্মগঞ্জের গ্রন্থাগারের তিনটি ভবনেই আগুন লাগে। ‘রত্নোদধি’ ভবনটি ছিল নয়টি তলবিশিষ্ট। এর নবম তলে সংরক্ষিত ছিল মহাযান শাখার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র ও বজ্রযান শাখার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুহ্যসমাজতন্ত্রের পুঁথি। এই সময় রত্নোদধির নবম তলের এই পবিত্র পুঁথিগুলি থেকে অলৌকিকভাবে জলধারা নির্গত হয়ে বহু পুঁথিকে রক্ষা করে। রাজার ভয়ে দুই ভিক্ষুক পালাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু নিজেদের প্রজ্বলিত আগুনে পুড়ে মারা যান।[১৬] এই বিবরণে নালন্দার গ্রন্থাগারের ভষ্মীভূত হবার কারণ হিসাবে স্থানীয় সূর্য উপাসক ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিরোধের প্রতি যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার সত্যতা অস্বীকার করা কঠিন। বিহার শরীফের নিকটবর্তী শাহপুর থেকে প্রাপ্ত একটি সূর্যমূর্তির পাদপীঠে খোদিত লেখে ঐ সূর্যমূর্তিটি মগধের শাসক আদিত্যসেনের বলাধিকৃত (সেনাপতি) সালপক্ষ ৬৭২-৬৭৩ সাধারণাব্দে নালন্দায় স্থাপন করেছিলেন বলে উল্লিখিত হয়েছে।[১৭] এই লেখযুক্ত সূর্যমূর্তি ও মহাবিহারের অবশেষের অতি নিকটে অবস্থিত ‘সূর্য পোখর’ পুষ্করিণী ও তার তীরবর্তী বড়গাঁও গ্রামের সূর্য মন্দিরে প্রাপ্ত প্রাচীন সূর্যমূর্তি[১৮] নিঃসন্দেহে সপ্তম শতক থেকে নালন্দায় সূর্য উপাসকদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। 

তারনাথের গ্রন্থেও আচার্য রাহুলশ্রীভদ্র ও তাঁর ৭০ জন শিষ্যের উল্লেখ রয়েছে। তারনাথের বিবরণ অনুযায়ী, রাহুলশ্রীভদ্রের পর নালন্দার আচার্য হন ভূমিশ্রীভদ্র এবং তাঁর উত্তরসুরী ছিলেন উপায়শ্রীভদ্র। আরও দুজন সমকালীন বিদ্বান, করুণাশ্রীভদ্র ও মুনীন্দ্রশ্রীভদ্রের নামও তারনাথ উল্লেখ করেছেন। তারনাথ আরও উল্লেখ করেছেন, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে বঙ্গলের চিঙ্গলরাজা নালন্দার জন্য প্রভূত দান করেন, কিন্তু তিনি কোন নতুন নির্মাণ করেন নি।[১৯]                 

ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যানভদ্র ১৩২৮ সালে বেইজিং-এ মঙ্গোল রাজার সঙ্গে দেখা করেছিলেন ধর্মোপদেশ দিতে। ১৩৬৩ সালে কোরিয়ায় তাঁর জীবনাবসান হয়। কোরিয়ার মন্দিরে তাঁর সমাধিস্তুপে ১৩৭৮ সালে লেখা এক লিপি থেকে জানা যায়, তিনি নালন্দায় বিনয়ভদ্রের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন।[২০]    

চতুর্দশ শতাব্দীর পর নালন্দার পঠন-পাঠনের বিষয়ে আর কোন তথ্য জানা যায় নি। কিন্তু ত্রয়োদশ -চতুর্দশ শতাব্দীর যেটুকু তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছেছে, তা থেকে বোঝা যায় নালন্দার চূড়ান্ত অবলুপ্তির মূল কারণ, এই কালপর্বে বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখার পূর্ব ভারতে গৃহী উপাসকদের ক্রমিক বিলুপ্তির পরিণামে নিয়মিত দানের অভাবে সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কট। 

নালন্দার অবসানের কাল ও কারণ নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ ডি.আর. পাটিল, তাঁর ‘দ্য অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইনস ইন বিহার’ গ্রন্থে যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত: “There is, therefore, reason to believe that Nalanda had met its final end some time in the 11th century i.e. more than hundred years before Bakhtiyar Khilji invaded Bihar in 1197 A.D. It is known that Odantapurī or modern Bihar-Sharif had a similar and rival institution functioning under the royal patronage of the Pālas and, being a capital town, it must have inevitably snatched away the fortunes of Nalanda. The Muhammedan chronicles apparently refer to this latter place and do not even mention the name of Nalanda. Presumably Nalanda was then a desolate place and already fallen to ruins.” [২১]  

বখতিয়ার খলজির সেনাদের একটি (বা দুটি) বৌদ্ধ মহাবিহার ধ্বংসের বর্ণনার ভিত্তিতে বিংশ শতক থেকে বিশিষ্ট আধুনিক বিদ্বানরা মুসলিম আক্রমণকারীদের দ্বারা নালন্দা তথা পূর্ব ভারতের সমস্ত বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের যে কাহিনী নির্মাণ করেছেন, তা অবশ্যই অতিরঞ্জিত এবং কোন ঐতিহাসিক তথ্যদ্বারা সমর্থিত নয়। পাল রাজবংশের শাসনকালে পূর্ব ভারতে নালন্দা ছাড়া আরও চারটি বিখ্যাত বৌদ্ধ মহাবিহার ছিল – ওদন্তপুরী, বিক্রমশীল, সোমপুর ও জগদ্দল। তারনাথ ও ‘পাগ সাম জোন জাং’ গ্রন্থের সাক্ষ্য অনুযায়ী কাশ্মিরী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শাক্যশ্রীভদ্র (১১২৭-১২২৫ সাধারণাব্দ) মগধে এসে ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীল মহাবিহারকে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখে বরেন্দ্রভূমির জগদ্দল মহাবিহারে চলে আসেন এবং এখানে শুভাকরগুপ্তের কাছে তিন বছর শিক্ষাগ্রহণ করার পর তিব্বতে চলে যান।[২২] নালন্দা মহাবিহারের উৎখননে প্রাপ্ত আনুমানিক দ্বাদশ শতকের প্রথম দিকে লিখিত তারিখবিহীন বিপুলশ্রীমিত্রের সংস্কৃত শিলালেখ থেকে জানা যায়, বঙ্গাল দেশের (বর্মণবংশীয়) রাজার সেনারা বরেন্দ্রভূমিতে তাঁর গুরুর গুরুর গুরু করুণাশ্রীমিত্রের সোমপুর মহাবিহারের (পাহাড়পুর) আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ করে এবং করুণাশ্রীমিত্রের মৃত্যু ঘটে।[২৩] বর্মণবংশীয় রাজাদের ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতার তথ্য সুবিদিত। মুসলিম আক্রমণকারীদের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ধ্বংসের বিংশ শতক থেকে আরেকটি নির্মিত কাহিনী প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়, চতুর্দশ শতকের শেষেও চীনের মিং বংশীয় সম্রাটের নির্দেশে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সুং লে (Tsung Le)  ভারতে এসে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন।[২৪]  

এই কারণেই, আধুনিক বিদ্বানদের বৌদ্ধ বিহারগুলিতে মুসলিম আক্রমণ নিয়ে আধুনিক বিশ্বাস প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মার্শাল হজসনের বক্তব্য মনে হয় পূর্ণতঃ সত্য: “The record of the massacre of one monastery in Bengal, combined with the inherited Christian conception of Muslims as devotees of the sword, has yielded the widely repeated statement that the Muslims violently ‘destroyed’ Buddhism in India. Muslims were not friendly to it, but there is no evidence that they simply killed off all the Buddhists, or even all the Buddhist monks. It will take much active revision before such assessments of the role of Islam, based largely on unexamined preconceptions, are eliminated even from educated mentalities.”[২৫]     

তথ্যসূত্র:

১. Trusche, A. (2018). “The Power of the Islamic Sword in Narrating the Death of Indian Buddhism,” in History of Religions 57, no. 4 (May 2018). Chicago: University of Chicago Press, pp.406-435.

২. Chandra, S. (2007). History of Medieval India (800-1700). New Delhi: Orient Blackswan. pp.71-72.  

৩.  Elliot, H.M. (1869) (tr.). The History of India, As Told by Its Own Historians. Vol. II. London: Trübner & Co. p.306.

৪. Chimpa, L. and A. Chattopadhyaya (1990)[1970](tr.). Tāranātha’s History of Buddhism in India. Delhi: Motilal Banarsidass. p.319.

৫. Sankalia, H.D. (1934). The University of Nālandā. Madras: B.G. Paul & Co. pp. 212-214.

৬. Samaddar, J.N. (1924). The Glories of Magadha. Patna: Patna University. p.132.

৭. Qanungo, K.R. (2003)[1943]. “The Muslim Conquest of Bengal” in J.N. Sarkar ed. The History of Bengal. Vol. 2. Delhi: B.R. Publishing. p.3.

৮. Majumdar R.C. (2001)[1957]. “The Turkish Conquest of Northern India” in R.C. Majumdar, A.D. Pusalkar and A.K. Majumdar ed. The Struggle for Empire. Mumbai: Bharatiya Vidya Bhavan. p.123.

৯. Chimpa, L. and A. Chattopadhyaya (1990)[1970](tr.). Tāranātha’s History of Buddhism in India. Delhi: Motilal Banarsidass. p.318.

১০. Roerich, G. (1959) (tr.). Biography of Dharmasvāmin. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. p.xxxix.

১১. Roerich, G. (1959) (tr.). Biography of Dharmasvāmin. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. pp.v-vii.

১২. Roerich, G. (1959) (tr.). Biography of Dharmasvāmin. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. pp.xiii-xviii.

১৩. Roerich, G. (1959) (tr.). Biography of Dharmasvāmin. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. p.64.

১৪. Roerich, G. (1959) (tr.). Biography of Dharmasvāmin. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. pp.90-97.

১৫. Vidyabhusana, S.C. (1921). A History of Logic (Ancient, Mediæval and Modern Schools). Calcutta: University of Calcutta. p.516.

১৬. Dutt, S. (1962). Buddhist Monks and Monasteries of India. London: George Allen and Unwin. p.343.

১৭. Sastri, H. (1942). Nalanda and its Epigraphic Material. Delhi: Manager of Publications. p.82-83.

১৮. Kulshreahtha, S. (2019). “Removable Heritage: Nalanda beyond the Mahavihara” in H.P. Ray ed. Decolonising Heritage in South Asia: the Global, the National and the transnational. New York: Routledge. pp.129-155.

১৯. Chimpa, L. and A. Chattopadhyaya (1990)[1970](tr.). Tāranātha’s History of Buddhism in India. Delhi: Motilal Banarsidass. pp.320-321. 

২০. Waley, Arthur (1931-1932). “New Light on Buddhism in Medieval India” in Mélanges chinois et bouddhiques,1. pp.355-376.

২১. Patil, D.R. (1963). The Antiquarian Remains in Bihar. Patna: K.P. Jayaswal Research Institute. pp.325-326.

২২. Dutt, S. (1962). Buddhist Monks and Monasteries of India. London: George Allen and Unwin. p.378-379.

২৩. Majumdar, N.G. (1932). “Nalanda Inscription of Vipulasrimitra” in Epigraphia Indica, Vol. XXI, 1931-32. Delhi: Manager of Publications. pp. 97-101.

২৪. Enoki, K. (1972). “Tsung-Le’s Mission to the Western Regions in 1378-1382” in Oriens Extremus, 19, 1-2. Wiesbaden: O. Harrasowitz. pp.47-53.

২৫. Hodgson, M.G.S. (1977). The Expansion of Islam in the Middle Periods. The Venture of Islam, Vol. 2. Chicago: University of Chicago Press. p.557.

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

মন্তব্য তালিকা - “নালন্দার শেষ অধ্যায় – বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা”

  1. যাকে আমরা মিথ ব্লাস্টার বলি, সেই পথেই এগোতে চেয়েছে লেখাটি। কিন্তু নালন্দার পতন কীভাবে হল, বাইরে থেকে সেনা আক্রমণের কোনও ভূমিকা এই পতনের পেছনে ছিল কিনা, সেই নিয়ে কথাবার্তায় বখতিয়ার ও তুরষ্ক আক্রমণই কি একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ?

    নালন্দার পতন সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে, যা এখানে আলোচিত।
    ১) নালন্দা আগেই তার অতীত গরিমা হারিয়ে ফেলেছিল। ওদন্তপুরী হয়ে উঠেছিল বিদ্যাচর্চার প্রধান পীঠস্থান।
    ২) নালন্দা বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণে ধ্বংস হয়।
    ৩) বখতিয়ারের সময়পর্বের অনেক পরেও নালন্দা ও সেখানকার বিদ্যাচর্চা টিঁকে ছিল।
    এই লেখায় দ্বিতীয় মতটিকে নস্যাৎ করা হয়েছে। লেখার অধিকাংশটা জুড়েই রয়েছে তৃতীয় মতটির পক্ষে যুক্তি ও তথ্য সমাবেশ। নালন্দায় যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও বিদ্যাচর্চা চলত চাগ লোচাবা ধর্মস্বামীর জীবনী এর অন্যতম প্রমাণ। এই মতটিকে মেনে নিলে দ্বিতীয় মতটিকে গ্রহণ করার উপায় থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হল প্রথম মত, যা লেখার শেষে বলা হয়েছে – ডি আর পাটিলকে উদ্ধৃত করে – “নালন্দা হ্যাড মেট ইটস ফাইনাল এন্ড সাম টাইম ইন দ্য ইলেভেন সেঞ্চুরি এডি” – এই ফাইনাল এন্ড কে গ্রহণ করার যুক্তিই বা কতটা ?
    দ্বিতীয় মত – নালন্দা বখতিয়ারের দ্বারা ধ্বংস হয় নি এটা প্রমাণের জন্য দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মতের সমাবেশ লেখাটিতে ঘটেছে – ক) নালন্দা একাদশ শতকেই তার শেষ দশা প্রত্যক্ষ করেছিল এবং খ) নালন্দায় ত্রয়োদশ শতকের মাঝে বিদ্যাচর্চা চলত তো বটেই, চতুর্দশ শতকেও যে চলত তার উল্লেখ আছে। লেখাটি এই প্রবহমানতার পক্ষে তথ্য সমাবেশ করে কেন একাদশ শতাব্দীতেই শেষ দশা প্রত্যক্ষ করেছিল এই মত উদ্ধৃত করে শেষ হল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেল। প্রাবন্ধিক আসলে কোন মতের পক্ষে ? চতুর্দশ শতাব্দী অবধি বিদ্যাচর্চা না একাদশ শতাব্দীতে বিলয় ? না এরকম একটা বক্তব্য রাখা হল যে, এই দুটি (পরস্পর বিপরীত) মতের যেটা খুশি পাঠক বেছে নিন, কেবল বখতিয়ারের আক্রমণে নালন্দা যে ধ্বংস হয়েছিল – সেই “মিথ ও মিথ্যা”র যেন আবসান হয় ?

    এবারে আসা যাক অন্য একটি প্রসঙ্গে। নালন্দার পতন কীভাবে হয়েছিল ? বাইরে থেকে কোনও আক্রমণ কি আদৌ হয়েছিল নালন্দার ওপর ? তুরষ্ক আক্রমণে নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল কিনা, সেটা নয়। প্রশ্ন বাইরে থেকে কোনও আক্রমণ আদৌ হয়েছিল কিনা সেটা নিয়ে। প্রাবন্ধিক কি মত পোষণ করছেন এই ব্যাপারে ? তারানাথের সাক্ষ্য মানলে বলতে হয় যে দুটি বিহারের ওপর তুরষ্ক আক্রমণ হয়েছিল, সেই দুটি হল ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা। আর চাগ লোচাবা ধর্মস্বামীর জীবনীর সূত্র দেখলে দেখা যায় ১৪ টি বৃহৎ বিহারের মধ্যে মাত্র ২ টি ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় ছিল। বাকী ১২ টি বিহারের পতন প্রসঙ্গে দুটি কথা রয়েছে। ক) দানের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া খ) আফগান সেনাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা “পাগ সাম জোন জাং” তৃতীয় একটি সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে। প্রাবন্ধিক যাকে ‘অতিলৌকিকতার স্পর্শমিশ্রিত’ বলেছেন, তার অতিলৌকিক খোলসটি বাদ দিলে পাওয়া যাবে এই তৃতীয় সম্ভাবনাটি – গ) ব্রাহ্মণদের বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতি বিদ্বেষ। নালন্দার কেন পতন হয়েছিল তাই নিয়ে ভাবতে গেলে এই তিনটি সম্ভাবনার সমন্বয়ের কথাই কি ভাববো আমরা ? বৌদ্ধ রাজাদের সমর্থন ও দান হারিয়ে ফেলা এবং বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের ক্ষোভের অভ্যন্তরীণ দুটি কারণের পাশাপাশি বাইরে থেকে আসা আফগান সেনাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথাও ? নালন্দার পতনের ক্ষেত্রে বাইরের আক্রমণের ভূমিকা প্রসঙ্গে তুর্কিদের বদলে আফগানদের কথাই কি চাগ লোচাবা ধর্মস্বামীর জীবনী সূত্রে ভাবতে হবে আমাদের ?

  2. একাদশ শতাব্দিতেই বেশীরভাগ বৌদ্ধ বিহার গুলি দানের অভাবে শুকিয়ে যাওয়ার বিশেষ কারণগুলো জানাও এক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন। দান না পাওয়া মানে বৌদ্ধধর্ম প্রচার অবহেলিত বা অসমর্থিত‌ও হ‌ওয়া‌ও অসম্ভব নয়।
    লখনাবতীর সেন রাজাদের বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকর্ষণ এর ব্যাপারে কিছু বলা নেই এখানে। তবে বৃদ্ধসেন নামক রাজার নাম আছে, কিন্তু তার পরিচয় আমরা জানিনা। তবে অনেক আগে থেকে নালন্দায় সূর্য উপাসনার বিষয়টি উল্লিখিত।
    চতুর্দশ শতকের কিছু পরেই বাঙ্গালায় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য দেবের আগমন ঘটে এবং বৈষ্ণব ধর্মান্তকরনের ব্যাপক প্রভাব ঘটে।
    সুতরাং নালন্দা বিহারের অবক্ষয় কি বৌদ্ধধর্ম আর হিন্দুধর্মের (গুপ্ত রাজাদের পর) দীর্ঘদিন‌এর সংঘাতের কারন কিনা, জানার ইচ্ছা র‌ইলো।

  3. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুলিখিত সমৃদ্ধ হবার মতো প্রতিবেদন। নালান্দার তিনটি গ্রন্থাগারের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সেগুলির উল্লেখ থাকলে আরো ভালো হতো। তবে নালান্দার গ্রন্থাগারগুলিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সংশয় থাকে। আগুন দীর্ঘদিন ধরে জ্বলেছিল। সেই সময় বহু বিদেশি ছাত্র বহু পুথি সরিয়ে নিয়েছিলেন বলে অনুমান করেছেন অনেকে। তার‌ই কিছু তিব্বত থেকে পরবর্তীকালে কয়েকজন উদ্ধার করে আনেন। তাদের মধ্যে রাহুলজী অন্যতম। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার কিছু বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। অনেকে হয়তো আরো আলোকপাত করতে পারেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।