নবগ্রামের কার্তিকেয় মূর্তি: একটি ক্ষেত্রসমীক্ষা
কার্তিক বা কার্তিকেয় দেবতা দেবসেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা, মহাযোগী, বিদ্যার পৃষ্ঠপোষক, তস্করের উপাস্য, বন্ধ্যানারীদের সন্তান উৎপাদনের দেবতা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে হিন্দুধর্মে পূজিত হন। তবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ঋগ্বেদে (আনু. রচনাকাল: ১২০০ – ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ‘কার্তিকেয়’ নামে কোনো দেবতার উল্লেখ নেই। পরবর্তী বৈদিক যুগের (আনু. ১০০০ – ৬০০ খ্রি. পূ.) ছান্দোগ্য উপনিষদ ও সামবিধান গ্রন্থে ‘স্কন্দ’ নামে এক দেবতার উল্লেখ রয়েছে।
ঋগ্বেদোত্তর কালের বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য, মহাকাব্যদ্বয় ও পুরাণসমূহ বিশ্লেষণ করে প্রথিতযশা পণ্ডিত জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এইমর্মে দেখিয়েছেন যে, স্কন্দ, বিশাখ, কুমার, মহাসেন, ব্রহ্মণ্যদেব প্রভৃতি কতকগুলি সমশ্রেণির দেবতার একত্রীভবনের ফলে ‘স্কন্দ-কার্তিকেয়’ নামে একটি দেবতার ধারণা গঠিত হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, গুপ্তযুগে (আনু. ৩০০ – ৬০০ খ্রি.) রচিত শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কে কার্তিকেয়কে তস্করগণের দেবতারূপে চিত্রিত করা হয়েছে। মহাভারতের বনপর্বে এবং কালিকাপুরাণ, বরাহপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বামনপুরাণ ইত্যাদি পৌরাণিক সাহিত্যে এই দেবতার বৈচিত্র্যময় জন্মবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘স্কন্দ – কার্তিকেয়’কে একজন লৌকিক দেবতারূপে চিহ্নিত করেছেন, যিনি কালক্রমে শিব ও পার্বতীর পুত্র হিসাবে ব্রাহ্মণ্য – ধর্মব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন এবং এই দেবতার জন্মের কাহিনীকে ভিত্তি করেই খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে অর্থাৎ গুপ্তযুগে রচিত হয়েছিল মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ নামক একটি ধ্রুপদী কাব্য।
খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকে গুপ্তযুগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গাণিতিক বরাহমিহির (৫০৫ – ৫৮৭ খ্রি.) তাঁর ‘বৃহৎ সংহিতা’ গ্রন্থে কার্তিকেয় দেবতার দ্বিভুজ মূর্তির বিবরণ দিয়েছেন। এই ধ্রুপদী গ্রন্থের ‘প্রতিমালক্ষণ অধ্যায়’-এর ৪১তম শ্লোকে রয়েছে যে, স্কন্দ হবেন বালক বয়সী। তিনি শক্তি (বর্শা) আয়ূধ ধারণ করবেন এবং তিনি ময়ূরবাহন। কিন্তু মৎস্যপুরাণ ও অগ্নিপুরাণে দ্বিভুজ, চতুর্ভুজ ও দ্বাদশভুজ কার্তিকেয় দেবতার রূপকল্প বিদ্যমান। অগ্নিপুরাণে তিনি ষড়ানন অর্থাৎ ছয়টি মস্তকবিশিষ্ট। আবার কাশ্মীরে রচিত আদি মধ্যযুগের বিষ্ণুধর্মোত্তর নামক একটি উপপুরাণে ছয়মুণ্ডু কার্তিকেয় মূর্তির কল্পনা করা হয়েছে। এখানে তিনি ময়ূরবাহন ও রক্তবস্ত্রধারী। তাঁর হাতে কুক্কুট, ঘণ্টা, বৈজয়ন্ত পতাকা ও শক্তি আয়ুধ দৃশ্যমান। এমনকি বৌদ্ধতন্ত্রেও ষড়ানন ও ষড়ভুজ ময়ূরারূঢ় কার্তিকেয়র চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
কুষাণ বংশীয় নৃপতি হুবিষ্কের ( আনু. ১০৬ – ১৩৮ খ্রি.) কয়েকটি মুদ্রায় সর্বপ্রথম স্কন্দ-কার্তিকেয় দেবতার মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে প্রজাতান্ত্রিক যৌধেয় গণরাজ্যের মুদ্রায় কুক্কুটধারী কার্তিকেয় মূর্তি বিদ্যমান। আবার গুপ্তবংশীয় নৃপতি প্রথম কুমারগুপ্তের (আনু. ৪১৫ – ৪৫৬ খ্রি.) স্বর্ণমুদ্রায়ও কতিপয় ময়ূরবাহন কার্তিক উৎকীর্ণ রয়েছে। দাক্ষিণাত্যে এই দেবতা ‘সুব্রাহ্মণ্য’ এবং তামিলভাষায় তিনি ‘মুরুগণ’ নামে সুপ্রসিদ্ধ।
চিত্র ~ ১ নবগ্রামের কার্তিকেয় মূর্তি
মুর্শিদাবাদ জেলার পাঁচটি মহকুমার মধ্যে একমাত্র কার্তিকেয় মূর্তিটির সন্ধান মিলেছে কান্দি মহকুমায়। এই মহকুমার কান্দি থানার অন্তর্গত নবগ্রামেই কার্তিকেয় দেবতার বিগ্রহটির নিদর্শন মিলেছে (১ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)। দুর্ভাগ্যবশত স্থানীয় গ্রামবাসীরা এই দেববিগ্রহটিকে ‘ব্রহ্মাণী’ রূপে আরাধনা করেন। সবচেয়ে বড় কথা হল, এটা যে কোনো দেবীপ্রতিমা নয়, সেটা বিগ্রহের শারীরিক কাঠামোয় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা যায় যে, বহু বছর আগে নবগ্রামের অনতিদূরে হাটপাড়া গ্রামের একটি পুষ্করিণী সংস্কারের সময়ে দুটি মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল মহিষমর্দিনী মূর্তি এবং অপরটি কার্তিকেয় মূর্তি।
এবার কার্তিকেয় মূর্তিটিকে একবার দৃষ্টিপাত করা যাক। এটি ১.৫ ফুট ভূমি এবং ৩.৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মূর্তিটি ব্যাসাল্ট পাথরে নির্মিত একটি অনিন্দ্যসুন্দর বিগ্রহ। এখানে কার্তিকেয় ‘মহারাজালীলাসন’ ভঙ্গিতে ময়ূরপৃষ্ঠে উপবিষ্ট। তিনি চতুর্ভুজ। তাঁর মস্তকে কিরীটমুকুট, কর্ণে কুন্ডল এবং বক্ষে যজ্ঞোপবীতসহ বিভিন্ন অলংকার দেদীপ্যমান। তাঁর বাহন ময়ূর এখানে পদ্মপীঠের উপরে সমপদস্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। ময়ূর হল অমরত্বের প্রতীক।
কার্তিকেয় বিগ্রহের ঊর্ধ্ব ও অধঃ দক্ষিণহস্তে যথাক্রমে শক্তি ও পদ্মকলিকা বিদ্যমান। অন্যদিকে দেবতার ঊর্ধ্ব বামহস্তের আয়ুধটি হল পাশ (ফাঁস)। কিন্তু নিম্নের বামহস্তের আয়ুধটি এখানে অস্পষ্ট। বিগ্রহের নিম্নভাগে অর্থাৎ ময়ূরের উভয় পার্শ্বে দুটি অপরূপা নারীমূর্তি বিরাজমান। সম্ভবত তাঁরা কার্তিকেয়র দুই সহচরী, যাদের মধ্যে দক্ষিণে দেবসেনা এবং বামে বল্লী – উভয়ে অপূর্ব লীলালাস্যে ও ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। প্রতিমার উপরের দিকে মালা হাতে উড্ডীন দুই বিদ্যাধর, যাদের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ A L Basam ‘স্বর্গের জাদুকর’ আখ্যা দিয়েছেন। স্বর্গীয় সৌন্দর্যের জন্যই মূলত তাঁদের সৃষ্টি।
চিত্র ~ ২ ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে রক্ষিত কার্তিকেয় মূর্তি
বিগ্রহের একেবারে ঊর্ধ্বে গর্জনরত সিংহের মুখাকৃতি উৎকীর্ণ, যা মূর্তিতত্ত্বে ‘কীর্তিমুখ’ বা ‘The face of glory’ নামে প্রসিদ্ধ। সাধারণত গর্জনরত সিংহ শক্তির প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই অলোকসামান্য ভাস্কর্যটি শুধু মুর্শিদাবাদ জেলা নয়; সমগ্র দেশের একটি বিরলতম শিল্পকর্মের অভিনব দৃষ্টান্ত। আমাদের অনুমান মোটামুটি একাদশ-দ্বাদশ শতকে অর্থাৎ পাল নৃপতিদের রাজত্বকালে এই অনবদ্য ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছিল। যদিও বিগ্রহটির সময়কাল নির্ণয় করার জন্য কোনো বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার কথা জানা যায়নি।
কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত একটি চমৎকার কার্তিকেয় মূর্তি বিদ্যমান (২ নম্বর চিত্র)। ক্লোরাইড পাথরে নির্মিত মূর্তিটি দ্বাদশ শতকের। পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পরীতির অলোকসামান্য প্রতিরূপ এটি। অন্যদিকে দিল্লির জাতীয় মিউজিয়ামে রক্ষিত কার্তিকেয়র মূর্তিটি তিনমুন্ডু ও দ্বাদশভুজ বিশিষ্ট। দ্বাদশ শতকের এই ভাস্কর্যটি দক্ষিণ ভারতের চোল শিল্পরীতির অনন্য দৃষ্টান্ত (৩ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)।
চিত্র ~ ৩ দিল্লির জাতীয় মিউজিয়ামে দাক্ষিণাত্যের কার্তিকেয় মূর্তি
তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকার:
১) পণ্ডিতবর শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন, (সম্পা.) বৃহৎ সংহিতা, কলকাতা, ১৮১৫ শকাব্দ।
২) হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ (২য় পর্ব), ফার্মা কে. এল. এম., ২০১৫।
৩) কল্যাণ কুমার দাশগুপ্ত, প্রতিমা শিল্পে হিন্দুদের দেবদেবী, প. ব. বাংলা আকাদেমি, ২০১৬।
৪) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, জেনারেল, ২০০০।
৫) অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, পৌরাণিকা (প্রথম খণ্ড), ফার্মা কে. এল. এম. ১৯৭৮।
৬) T. A. Gopinatha Rao, Elements of Hindu Iconography (Vol. 2, Part -2), New Delhi, 2017.
৭) Enamul Haque, Bengal Sculptures : Hindu Iconography upto C. 1250 A. D., Dhaka, 1992.
৮) J. N. Banerjea, Development of Hindu Iconography, New Delhi, 2016.
৯) A. L. Basam, The Wonder that was India, London, 2004.
ভালো লাগলো।
ষাণ্মাতুর [ ষষ্+ মাতৃ + অণ্] > কার্ত্তিক
কার্ত্তিকের ছ জন মা?
সুত্র– A Trilingual Dictionary
Publisher– Sanskrit College, Calcutta
হুঁ। কার্তিকেয় দেবের ছয় মা। অগ্নি, বায়ু, গঙ্গা, শরবন, কৃত্তিকা ও পার্বতী। এঁদের মধ্যে অগ্নি, বায়ু ও শরবন পুরুষ অথচ কার্তিকেয় মাতা রূপে বিবেচিত। মতান্তরে, কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ যাতে কি না সপ্তর্ষির ছয় ঋষির ঋষিপত্নিরা অবস্থান করেন, তাঁরা হলেন কার্তিকেয়র ছয় মাতা, এমনকি কার্তিকেয় নামটাও ‘কৃত্তিকার জাত’ থেকে এসেছে।
কার্তিক কি অনার্য দেবতা? সঙ্গম সাহিত্য থেকে জানা যায় যে ৩০০-৪০০ সাধারণ পূর্ব অব্দ বা তারও আগে থেকেই তামিল দেশে মূড়ূগাণ-এর পূজা হত| অন্ধ্রের ঈক্ষাকূরা ছিলেন স্কন্দ কার্তিকেয়র উপাসক|
স্কন্দ, কুমার কিংবা কার্তিকেয় নামগুলি যে যে পুরাণে উঠে এসেছে সেই পুরাণগুলির রচনা কয়েক শতাব্দী আগে থেকে তামিল-ভূমে মুরুগ বা তাঁদের ভাষায় মুরুগন নামে এক যুদ্ধ-দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়, যিনি আবার কালীর ন্যায় দেবী কোড়বৈ-এর পুত্র। আর্য সংস্কৃতি সেখানে যাওয়ার পরে এই মুরুগ দেবতা, সুব্রহ্মণ্য নামে পরিচিত হতে থাকেন।
চমৎকার তথ্যনির্ভর লেখা।
খুবই তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, আর নানান তথ্যসূত্র থেকে নেওয়া। এই পরিশ্রমের প্রতি যথাযত সম্মান রেখেই বলতে চাই – যে এই আখ্যানে মানব ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক কিছু দেখাতে পারলে আরো তৃপ্তি পেতাম। সেটা ছাড়া শুধুমাত্র ধর্মীয় ইতিহাসের আখ্যান হচ্ছে, মানুষের লৌকিক বা রাজনৈতিক জীবনের সাথে সংযুক্তি ছাড়া। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর তার থেকে উদ্ভুত হিন্দু ধর্ম এই উপমহাদেশের রাজনীতি আর নৃতত্ত্বের একটা জীবন্ত দলিল, শুধু ধর্মীয় ব্যাখ্যান পেতেই যে এর অধ্যয়ণ করতে হবে তা কিন্তু নয়।