সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ময়মনসিংহ, শশী লজ ও আচার্য্য পরিবার

ময়মনসিংহ, শশী লজ ও আচার্য্য পরিবার

বিজয়া গোস্বামী

মার্চ ৮, ২০২৫ ১১৮ 1

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অশান্ত পরিবেশ চলছে। শুধু ‘অশান্ত’ বললে বোধহয় খুব কম করে বলা হবে—বিধ্বংসী পরিস্থিতির শিকার দেশবাসী। এখন সেখানে নাগরিকেরা কেমন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, তা মনে করতে যন্ত্রণা হয়। এই পরিস্থিতিতে অবশ্যম্ভাবী ভাবে মনে পড়ছে ১৯৪৬-৪৭-এর সেই রক্তঝরা দিনগুলো। আর মনে পড়ছে, আমার ছোটবেলায় বাবা-পিসিদের কাছে শোনা, ‘আমগো দ্যাশের’ গল্প। মনে পড়ছে বাবাদের ‘প্যালেস’—শশী লজের স্মৃতি।

(১)

আমার বাবা স্নেহাংশুকান্ত আচার্য্য ছিলেন ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্যের কনিষ্ঠ পুত্র। খুব অল্প বয়স থেকেই বাবা স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ‘মধুদা’–সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের অনুপ্রেরণায়। পরবর্তী সময়ে বিলেতে থাকাকালীন তিনি বাম রাজনীতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সেই সব কারণে এবং তাঁর নিজের আইন ব্যবসায়ের প্রয়োজনে তিনি কলকাতাতেই বাস করতেন। তার পরে দেশভাগ হয়ে গেল, দেশে আর কখনো যাওয়া হয়নি। বাবার জন্মও হয়েছিল কলকাতায়—আমার জ্যাঠামশায়রা ও পিসিরা সবাই জন্মেছিলেন কলকাতায়। কিন্তু আজীবন তাঁদের ‘দেশের’ প্রতি নাড়ির টান ছিল। বিশেষত শশী লজ—তাঁদের ‘বাড়ি’—আর কলকাতার বাড়ি ছিল ‘বাসা’!

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই শশী লজ অধিগ্রহণ করেন, সংরক্ষিত স্মারক ফলক।

এই বাড়ির নামকরণ হয়েছিল অবশ্য আমার ঠাকুরদা শশীকান্তের নামে। এই নাম দিয়েছিলেন এবং বাড়ি তৈরি করেছিলেন আমার প্রপিতামহ মহারাজা সূর্য্যকান্ত আচার্য্য। সূর্য্যকান্তের জন্ম হয়েছিল ১৮৫১ সালে, আমার জন্মের ঠিক ১০০ বছর আগে। তবে জন্মের পর তাঁর নামকরণ হয়েছিল পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। ময়মনসিংহের কাশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেব্যা বালক পূর্ণচন্দ্রকে দত্তক নেন। আমার ঠাকুরদা ছিলেন মুক্তাগাছার ‘আট আনি’ আচার্য্য চৌধুরী পরিবারের রাজা জগৎকিশোর আচার্য্যের দ্বিতীয় পুত্র, তাঁর নাম আগে ছিল বীরেন্দ্রকিশোর। সূর্য্যকান্তের পত্নী রাজরাজেশ্বরী দেবীর অকালমৃত্যুর পর তিনি ঠাকুরদাকে দত্তক নেন। দত্তক পুত্রকে তিনি নিজের পুত্রের মতোই স্নেহ করতেন। তাঁর জন্যই এই দোতলা প্রাসাদ, শশী লজ, তৈরি করেন। এই প্রাসাদ সাজাবার জন্য ইউরোপ থেকে অনেক সুন্দর শিল্পকর্ম আনিয়েছিলেন।

(২)

এই অপূর্ব গৃহটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সময়েই সূর্য্যকান্তের স্ফটিকে গড়া প্রাসাদ, ক্রিস্টাল প্যালেস, ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। পুণ্যলতা চক্রবর্তী তাঁর বাল্যস্মৃতি ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে বলেছেন’

‘(ময়মনসিংহে) আমাদের বাড়ির সামনেই মহারাজ সূর্যকান্তের প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল। আয়নায় মোড়া ছিল তাঁর ঘরের দেয়াল, সোফা-চেয়ার-টেবিলের পায়া, সিঁড়ির রেলিং, সব সুন্দর ফুলকাটা কাঁচের তৈরী ছিল, তাই লোকে সেটাকে বলত ‘কৃস্ট্যাল প্যালেস’। ভূমিকম্পে সে স্ফটিক-প্রাসাদ গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে, পড়ে রয়েছে তার ধ্বংসস্তূপ।’ (ছেলেবেলার দিনগুলি’, পৃঃ ৬৯-৭০ )

এই ঘটনার পূর্বেই সূর্য্যকান্তের মৃত্যু হয়েছে। আমার ঠাকুরদা শশীকান্ত এই প্রাসাদের সংস্করণ করেন ১৯০৫-১৯১১ পর্যন্ত। নবরূপে প্রাসাদের এবং তার সংলগ্ন এলাকার ব্যাপ্তি নয় একরের মতো বলে জানা যায়। এর প্রবেশদ্বার একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি তোরণ। এর মধ্যে প্রবেশ করলে সামনেই একটি গোল তৃণাচ্ছন্ন বাগান। তার মাঝখানে একটি শ্বেতপাথরের ফোয়ারা এবং একটি অপূর্ব শ্বেতপাথরের নারীমূর্তি। এ দুটিই ইউরোপ থেকে আনানো হয়েছিল। প্রাসাদের মধ্যে ঢুকলে একটি প্রকাণ্ড হলঘর, যেটি ছিল নাচঘর বা বলরুম। এককালে এই প্রাসাদ শ্বেতপাথর ও স্ফটিকের নানা শিল্পকর্ম, ছবি, স্ফটিকের ঝাড়বাতি, স্ফটিকের মূর্তি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ছিল। এসব কথা আমার বাবা ও পিসিদের, এবং আমার মা’র মুখেও শুনেছি।

পারিবারিক এলবামে শশী লজ ও তার পুষ্করিণী

বাড়িতে ঢোকার মুখে দুদিকে দুটি মস্ত বড় স্ফটিকের মূর্তি ছিল। তার মধ্যে একটি ঈশপের গল্পের সেই বাঘ ও বকের মূর্তি। বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি বড় পুষ্করিণী। তার মাঝখানে একটি শ্বেতপাথরের দোতলা ঘর বা ‘ঘাটলা’। গোটা বাড়ির জানালা দরজার উপরে রঙিন কাচের কারুকার্য।

এসব প্রধানত আমার শোনা কথা। কিন্তু চোখে দেখার প্রথম সুযোগ হয়েছিল ২০১৯ সালে, প্রায় ৭০ বছর বয়সে। তখন যেরকম দেখেছিলাম তা অবশ্য আগে যা ছিল ঠিক তেমন নয়। দেশভাগের ডামাডোলে বেশির ভাগ শিল্পসামগ্রী হয় হারিয়ে গেছে নাহয় ধ্বংস হয়ে গেছে। দরজা জানালার উপরে রঙিন কাচের কারুকার্য অবশ্য অনেকটা রয়েছে। বাড়ির সামনের ফোয়ারা এবং সেই অবিস্মরণীয় নারীমূর্তি অক্ষত ছিল।

২০১৯ সালের শশী লজের ছবি

শুনেছিলাম, ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন, সংরক্ষিত স্মারক হিসাবে। গিয়েও দেখলাম, বিকেল বেলা অনেক মানুষ সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাঁচটার সময় শশী লজ বন্ধ হয়ে যায় তাই ভিতরে ঢুকে বিশেষ কিছু দেখার সুযোগ হয়নি। তখন শুনেছিলাম, বাংলাদেশ সরকার ওখানে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলবার প্রকল্প নিয়েছেন। কিন্তু তার পরের ইতিহাস বড়ই বেদনার ও লজ্জার।

(৩)

যে কোনো রাষ্ট্রীয় আলোড়নে শিল্পের ক্ষতি হয় সবার আগে। বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে জেনেছি, সেই অনবদ্য মূর্তিটি আর নেই। জানি না, শশী লজও থাকবে কিনা।

এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন হবে ভাবিনি। আজ আমার বন্ধুর অনুরোধে, ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনে এই বিবরণ লিখছি। সেই সঙ্গে ২০১৯-এ তোলা কিছু ছবি এবং আমাদের পরিবারের কিছু বহু পুরাতন দুষ্প্রাপ্য ছবি দিলাম। 

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: শশী লজ, ২০১৯

মন্তব্য তালিকা - “ময়মনসিংহ, শশী লজ ও আচার্য্য পরিবার”

  1. খুব ভালো লাগল। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম সবকিছু।
    এই পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুনে খুবই খারাপ লাগল।

    সামান্য অপ্রাসঙ্গিক কথা, তবুও বলি। আপনার এক পিসিমা কোহিনুর দেবীকে আমি ছোটবেলায় দেখেছি। আমরা যখন উত্তর কলকাতায় থাকতাম তখন তিনি আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন। আমার বাবাকে ভাই ডাকতেন। সেই সূত্রে আমরা ওঁকে পিসিমা বলতাম যদিও বয়সের হিসাবে তিনি তখন আমার দিদিমার চেয়েও বয়স্ক।
    অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন। অসাধারণ আড্ডা জমাতে পারতেন। তাঁর মুখে শোনা বেশ কিছু গল্প আমি আজও অনেককে বলি। আমার মেয়েকেও বলেছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।