স্কুলের নির্মাণ প্রকল্পে খুলে গেল অতীতের দরজা—আবিষ্কৃত লক্ষাধিক জীবাশ্ম
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের সমুদ্রের খুব কাছেই অবস্থিত ‘সান পেড্রো’ উচ্চ বিদ্যালয়। এমনিতে বিশেষত্বহীন সাদামাটা এই স্কুল-ই বিগত দুই বছর ধরে হয়ে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিক ভূ-তাত্ত্বিক ও জীবাশ্মবিদদের মক্কা।
ঘটনার শুরু ২০২২ সালে। ওই বছরই স্কুলের জমিতে নতুন নির্মাণের জন্য শুরু হয়েছিল খোঁড়াখুঁড়ি। সেই ভিত খুঁড়তে গিয়েই যথাক্রমে ৮৭ লক্ষ আর ১.২ লক্ষ বছর পর পৃথিবীর রোদের মুখ দেখেছিল একটি মিয়োসিন যুগের হাড়ের আর একটি প্লিস্টোসিন যুগের খোলসের স্তর। খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলেন এই অঞ্চলের তাবড় তাবড় জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা। এসেছিলেন ভূ-তাত্ত্বিকরাও। খুব সাবধানে, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উদ্ধার করার কাজ চলছিল জীবাশ্মগুলি। আপাতত, এই ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে সেই কাজ মোটামুটি শেষের মুখে। প্রায় ৮০% জীবাশ্ম ইতিমধ্যেই উদ্ধার করা হয়ে গেছে। এই বছরের মধ্যে বাকি কাজও সম্ভবতঃ হয়ে যাবে। এই বার শুরু হবে এগুলি নিয়ে গভীর ভাবে গবেষণা করার কাজ।
কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কার? ‘এনভাইকম’ নামক সংস্থা, যারা উদ্ধার হওয়া ফসিলের একাংশের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে (লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’ এবং ‘কাব্রিলো মেরিন অ্যাকোয়েরিয়াম’-এর পাশাপাশি), তাদের অন্যতম কর্তাব্যক্তি ওয়েন বিশফ জানিয়েছেন এত অল্প এলাকার মধ্যে এত বিশাল সংখ্যক জীবাশ্মের আবিষ্কার ক্যালিফোর্নিয়ায় আগে হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূ-তত্ত্বের অধ্যাপক রিচার্ড ভেল জানিয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসের একটা বড় সময়-ই এই অঞ্চল ছিল সমুদ্রের নিচে। তবে কিছু উঁচু এলাকা ঐ জলরাশির মাঝে জেগে ছিল দ্বীপের মতো। তাই অধিকাংশ জীবাশ্ম প্রাগৈতিহাসিক সামুদ্রিক প্রাণীর হলেও উপকূলে থাকে এমন কিছু প্রাণীর জীবাশ্মও মিলেছে। বিশফের মতে, এর থেকে অনুমান করা যায়, লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড় বা ঐ জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সমুদ্র ও দ্বীপের উপকূল থেকে নানা প্রাণী ভেসে জলের তলায় থাকা কোনো খাতের মধ্যে ঢুকে যায়। কাদা দিয়ে পরে সীল হয়ে যায় ঐ খাত। ভেতরে থেকে যাওয়া প্রাণীগুলির অবশেষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভৌগলিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পরিণত হয় জীবাশ্মে।
ভেল বলেছেন, পুরো জীবাশ্ম স্তর থেকে হাঙরদের বিশালাকৃতি পূর্বপুরুষ ‘মেগালোডন’ থেকে ‘ডায়াটম’-এর মতো অ্যালগির জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর থেকে তৎকালীন উপকূল এলাকার সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র কেমন ছিল, তা অনেকটাই পুনর্নির্মাণ করা যাবে। বিশফ এই পর্যবেক্ষণে সায় দিয়ে যোগ করেছেন, শুধু তাই নয়, উপকূলবর্তী যেসব প্রাণীর আর উদ্ভিদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, তা সাগর ও উপকূলের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে যে যোগাযোগ, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা তৈরি করার সহায়ক হবে।
এই আবিষ্কার স্বাভাবিক ভাবেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে সান পেড্রোর ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে। তাইয়া ওলসন নামে এক ছাত্রী একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইরকম ঘটনা শুধু পাঠ্যবইতেই পড়ে এসেছি। আমাদের এখানেও যে এত বড় আবিষ্কার হতে পারে, ভাবতেই পারিনি কোনোদিন।’ পুরো ফসিল উদ্ধার এবং পরে সেগুলোকে সাজানোর কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে হাত লাগিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী। তাঁদের মধ্যে একজন, মিলাদ ইস্পাহানি, জানিয়েছেন, ‘এ হল অনেকটা বালি ছেনে সোনা খোঁজার মতো কাজ।’ খুব ধৈর্য আর পরিশ্রমের এই মিলাদ ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করেছেন ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর অস্টিন হেন্ডির তত্ত্বাবধানে। ১৭ বছরের মিলাদের এখন ইচ্ছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সামুদ্রিক জীবাশ্মবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়ার। ভেল আবিষ্কৃত জীবাশ্ম নিয়ে এলাকায় নতুন করে তৈরি হওয়া এই উদ্দীপনায় আনন্দিত। তিনি বলেছেন, ‘আপাত ভাবে বহু বছর আগের ঘটনা হলেও এই প্রক্রিয়াগুলোর প্রভাব বর্তমানেও রয়েছে। এই ডায়াটোমাইটগুলির মধ্যে থাকা ডায়াটোম থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের খনিজ তেলের ভান্ডারের জন্ম। এই শহরের ইতিহাস এইসব ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার উপর দাঁড়িয়ে’। উৎসাহিত জীবাশ্মবিদ আর ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর হেন্ডিও। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ক্রমশঃ যা পাওয়া গেছে তার বিবরণ লেখা, নতুন প্রজাতিগুলিকে চিহ্নিত করা আর তালিকা বানানোর কাজ থেকে এবার সরে আসছে…এই অঞ্চলের প্রাচীন বস্তুতন্ত্র কীভাবে কাজ করত আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে তা পাল্টে গেল এগুলো আমরা এখন চেষ্টা করছি বুঝতে।’
এই বোঝার প্রচেষ্টা থেকে শেষ অবধি কোন সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে, তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন উৎসাহীরা।
নিচের লিংক-এ গিয়ে পুরো খবরটা পড়তে পারেন।
—অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতিঃ মেগালোডন, যা ৩৬ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল, যার দৈর্ঘ ছিল ৫০ ফুট। Photo Credit Alex Boersma/PNAS