মিখাইল গর্বাচেভ (১৯৩১-২০২২)
একানব্বই বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন (৩০ আগস্ট, ২০২২) পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট (১৯৮৮-৯১) মিখাইল সেরগেইভিচ গর্বাচেভ। ১৯৮৫ সালে যখন তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে আসীন হন, তখন তিনিই ছিলেন পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি ছিলেন গর্বাচেভ, চেয়েছিলেন সোভিয়েত ব্যবস্থার ‘সংস্কার’ — অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় ‘আমূল’ পরিবর্তন নিয়ে এসে ‘গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজতন্ত্র’-এর পত্তন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলতে থাকা ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির উপর তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান এবং সংস্কার-প্রক্রিয়ার অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা পরম্পরার পরিণামে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই পরিসমাপ্তি ঘটে। শুধু তাই নয়, যে-দেশটি কয়েক বছর আগেই মহাশক্তি হিসেবে সম্ভ্রম ও ভীতি আদায় করে নিচ্ছিল, সেটিই মানচিত্র থেকে মুছে যায়। প্রায় রাতারাতি বিশ্ব-রাজনীতির কাঠামোগত বদল ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক-মেরু বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হয়।
এই বিপুল পরিবর্তনের ‘নায়ক’ হিসেবে পাশ্চাত্যের ‘নয়নের মণি’ হয়ে উঠেছিলেন মিখাইল গর্বাচেভ। ১৯৯০-এ তিনি শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। অন্যদিকে, সারা বিশ্বের বিপ্লবী কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের একাংশের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন ‘খলনায়ক’। প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে, একজন ব্যক্তির উপর সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের দায় চাপিয়ে দেওয়া কি আদৌ যুক্তিসম্মত? নিশ্চয়ই নয়। এই পরিণামের জন্যে একা গর্বাচেভ দায়ী হতে পারেন না। এক জটিল ঘটনাপরম্পরা ও সোভিয়েত ব্যবস্থার কিছু গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন ‘গর্বাচেভ ফ্যাক্টর’-এর গুরুত্ব—১৯৮৫-এ তিনি না হয়ে অন্য কেউ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বভার নিলে এই পরিণাম সৃষ্টি হত কিনা সন্দেহ। স্বয়ং গর্বাচেভও পশ্চিমি মিডিয়ার কাছে এক সময় এই দম্ভোক্তি করেছিলেন যে, ‘একটি দৈত্যাকার সামরিক শক্তি, মারাত্মক পুলিশি ও নজরদারি ব্যবস্থাপনার আমি ছিলাম চালক। এ এমন এক রাষ্ট্র, যা ছিল সকলের সব কিছুর প্রভু। এই সব কিছুকে ধ্বংস করেছি আমি নিজে থেকে। … এখন রাশিয়া একটা অন্য দেশ।’ কথাটির মধ্যে অতিরঞ্জন আছে সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের পিছনে সক্রিয় গণসম্মতির অভাব ও দীর্ঘ অর্থনৈতিক স্থবিরতা সত্বেও আটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, এমনকি ১৯৮৮-তেও, এই ব্যবস্থার আশু ভাঙনের কোনও লক্ষণ ছিল না। না ছিল সেখানে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রবিরোধী গণ-আন্দোলন, না ছিল জনজাতিগুলির বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের চাপ। সমগ্র ব্যবস্থার বদল তথা ভাঙনের উদ্যোগ ও সম্ভাবনার সৃষ্টি গর্বাচেভের সংস্কার-প্রচেষ্টার অনিয়ন্ত্রিত পরিণাম থেকেই।
রাশিয়ার স্তাভরোপল শহরের সত্তর কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে ১৯৩১ সালে গর্বাচেভের জন্ম। একেবারেই গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর মা-বাবা যৌথ খামারে কাজ করতেন। বালক গর্বাচেভও। এমন প্রান্তিক স্থান ও সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি যে কমিউনিস্ট পার্টির ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হতে পেরেছিলেন, তা সোভিয়েত জমানার সামাজিক চলমানতারই ইঙ্গিত দেয়। ১৯৫৫ সালে মস্কোর স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনের স্নাতক হন এবং ওই বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তিরিশের দশকে স্তালিনের পার্জ ও কঠোর যৌথখামার নীতির ভুক্তভোগী হয়েছিল গর্বাচেভের পরিবার। তাঁর দুই দাদুই (মায়ের ও বাবার দিক থেকে) ১৯৩০-এর দশকে কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। ১৯৩২-৩৩-এর দুর্ভিক্ষে তাঁর দুই কাকা ও এক পিসি মারা যান (এই দুর্ভিক্ষের জন্যে গবেষকদের একাংশ বলপ্রয়োগে যৌথখামার নীতিকে দায়ী করেন)। এই পারিবারিক স্মৃতিই হয়তো গর্বাচেভকে পরবর্তীকালে একজন প্রত্যয়ী স্তালিন-বিরোধী করে তুলেছিল। আমরা জানি, ক্রুশ্চেভের সময়কালে (১৯৫৩-১৯৬৪) সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন-নিন্দার সূত্রপাত। তবে ক্রুশ্চেভের নিন্দা মূলত বর্ষিত হয়েছিল ব্যক্তি-স্তালিনের উপর, সোভিয়েত ব্যবস্থার কাঠামোগত বদলের প্রয়াস তিনি তেমনভাবে নেননি। ক্রুশ্চেভ-পরবর্তী ব্রেজনেভের সময়কালে (১৯৬৪-৮৪) সোভিয়েত ব্যবস্থা পুনরায় আটকা পড়েছিল গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যে। ইতিমধ্যে সোভিয়েত অর্থনীতির বিকাশে স্থবিরতার চিহ্ন স্পষ্ট হয়েছে। কৃষি ও শিল্প-উৎপাদন, পুঁজি বিনিয়োগ, শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা, প্রকৃত মাথা পিছু আয়—সর্বত্রই এই প্রবণতা প্রকট। এরিক হবসবমের ভাষায়, এই সময় বিদেশ থেকে গম আমদানি করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ টিকে থেকেছে ‘গুপ্ত অর্থনীতি’-র দৌলতে। ১৯৭০-এর দশকে বিশ্ববাজারে অগ্নিমূল্যে খনিজ তেল রপ্তানি করে কিছু দিন ‘কৃত্রিম সচ্ছলতা’-র স্বাদ পেয়েছিল সোভিয়েতের মানুষ; কিন্তু সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে অর্থনীতির ভঙ্গুরতা আরও স্পষ্ট হয়। অস্ত্রশস্ত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিন্তু প্রযুক্তি, কম্পিউটার প্রভৃতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল। কৃষি ও ভোগ্যদ্রব্যে বিপুল ঘাটতি থেকে গিয়েছিল।
এমত প্রেক্ষাপটে পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হয়ে (১৯৮৫) গর্বাচেভ সংস্কারের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। সেই সংস্কারের দুটি প্রতিশব্দ আমরা জানি—‘পেরেস্ত্রোইকা’ (অর্থনৈতিক পুনর্গঠন) এবং ‘গ্লাসনস্ত’ (খোলামেলা আলোচনার অধিকার, মুক্ত পরিবেশ)। স্তালিনীয় অতি-নিয়ন্ত্রণবাদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সমালোচক হলেও গর্বাচেভ ছিলেন লেনিনের অনুরাগী। বস্তুত, গর্বাচেভ নিজেকে লেনিনের—নেপ (NEP) পর্বের লেনিনের—‘প্রকৃত উত্তরসূরি’ হিসেবে হাজির করেছিলেন। ওই পর্বে লেনিন অর্থনীতির উপর সার্বিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এসে কৃষি ও ছোটো ব্যবসায় ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পার্টির মধ্যে খোলামেলা আলোচনার উপরও গুরুত্ব দিতেন লেনিন। সেই লেনিনীয় উত্তরাধিকার ফিরিয়ে আনার দাবি তুললেন গর্বাচেভ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর মধ্যেই আনতে চাইলেন বাজার অর্থনীতির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য। এও বললেন, সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্যে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক ভাবে তথ্যসংগ্রহ ও খোলামেলা আলোচনা ও সমালোচনার অধিকার। তাঁর আশঙ্কা ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেকার রক্ষণশীল অংশটি এই সংস্কার-প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সেই কারণে তিনি তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার পিছনে জনমত সংগঠিত করতে সচেষ্ট হলেন, যার একটি পরিণাম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সমালোচনার মুক্ত অধিকার। ‘পেরেস্ত্রোইকা’-কে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল ‘অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭)-এর ‘প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতা’ হিসেবে, যার লক্ষ্য বিদ্যমান ‘রাজনৈতিক বিচ্যুতি ও বিকৃতিকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের উজ্জীবন ও সত্যিকারের এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজতন্ত্র’-এর প্রতিষ্ঠা। ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হল সংস্কারের প্রক্রিয়া।
পেরেস্ত্রোইকার তাৎক্ষণিক ফল ভালো হল না। হবসবম লিখেছেন, সোভিয়েত অর্থনীতি তথা রাজনীতির ধরনটা ছিল মূলত সামরিক ধাঁচের। সেনাবাহিনীর গণতন্ত্রীকরণে যেমন সেনাবাহিনীর দক্ষতা বাড়ে না, তেমনই সোভিয়েত ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণেও অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দক্ষতা-বৃদ্ধি ঘটেনি। বরং ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও বাজার অর্থনীতির আংশিক প্রয়োগ শ্রেণিবৈষম্য বাড়িয়েছিল। সাধারণ মানুষের হাতে এত অর্থ ছিল না যে তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগপতিতে পরিণত হবে। ক্ষমতাবান পার্টি ও প্রশাসনিক আমলারাই এই উদ্যোগের মূল সুফলভোগী হয়েছিল। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা শোচনীয় হয়। সংস্কার-বিরোধীরা বলতে থাকল, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের মূল্যে অর্থনীতির সংস্কার সমাজতন্ত্রের মূল নীতির বিরোধী। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল ও মঙ্গলময় দিকগুলি, যেমন সব মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, ভর্তুকির সাহায্যে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা, প্রত্যেকের বিনামূল্যে শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার অধিকার ইত্যাদির কোনও নড়চড় না করেই জীবনযাত্রার সার্বিক মান বাড়াতে হবে। উগ্র সংস্কারবাদীরা আবার এগুলোকেই অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিবন্ধক বলে চিহ্নিত করল। এই উগ্র সংস্কারবাদী গোষ্ঠীরই মুখপাত্র ছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। অধিকতর গণতন্ত্রের দাবি তুলে তিনি পলিটব্যুরো থেকে পদত্যাগ করেন।
গ্লাসনস্তের কল্যাণে কমিউনিস্ট-বিরোধী শক্তির পুনরুজ্জীবন ও দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকল। গর্বাচভের প্রশ্রয়ে সোভিয়েত মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছিল স্তালিন-বিরোধী নানা সমালোচনা। কিন্তু তখনও লেনিন ছিলেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে এক নমস্য মানব। কিন্তু ক্রমে সমালোচকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন এবং লেনিনও তীব্রতম সমালোচনার অন্তর্ভুক্ত হলেন। অনতিবিলম্বে রুশ বিপ্লব-উত্তর গোটা সোভিয়েত ঐতিহ্যটাই ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর রূপে বর্জনের দাবি উঠল। এই পরিস্থিতিতে পার্টি-নেতৃত্বের একাংশ গ্লাসনস্তের রাশ টেনে ধরার প্রস্তাব দেন। কিন্তু গর্বাচেভ গ্লাসনস্তকে সংকুচিত করতে রাজি হলেন না। পার্টিকে বললেন, নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। সমস্যা হল যে এমন খোলামেলা পরিবেশে কমিউনিস্ট পার্টির বুদ্ধিজীবী ও প্রচারকদের মতাদর্শগত সংগ্রাম চালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না—পার্টি লাইনের প্রতি আনুগত্য ও শৃঙ্খলা প্রদর্শনে তারা যতটা স্বচ্ছন্দ ছিল, প্রচারক হিসেবে ততটা দক্ষ ছিল না। ফলে মতাদর্শের লড়াইটা তারা তুল্যমূল্য চালাতে পারেনি। তা ছাড়া তাদের সততার ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল। যারাই গ্লাসনস্তের অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে উদ্বেগ জানাচ্ছিল, তাদেরই ‘গণতন্ত্রবিরোধী’, ‘স্তালিনবাদী’ বলে ছাপ্পা মেরে দেওয়া হচ্ছিল। ‘পরিবর্তনপন্থী’-রাই কেবলমাত্র চিহ্নিত হচ্ছিল ‘গণতন্ত্রপ্রেমী’ হিসেবে।
বস্তুত চিনের সঙ্গে সোভিয়েতের তুলনা টেনে হবসবম লিখেছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী চিন একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে হাঁটেনি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকৃত নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি ও একদলীয় কর্তৃত্বের অবসানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এমন একটি সময়ে শুরু হল যখন দেশে চলছে চরম অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা। গড় জীবনযাত্রার মানের অধঃপতন ঘটেছে। কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের প্রতিষেধক কোনও ঐক্যমূলক শক্তি বা কাঠামো আর অবশিষ্ট নেই। এ এমন এক বিস্ফোরক পরিস্থিতি যা সোভিয়েত ব্যবস্থার ঐক্যের ভিতটাই টলিয়ে দিয়েছিল।
বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দাবি উঠল। গবেষকরা অঙ্গরাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উৎস সন্ধানে দূর অতীতে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। সংহত জাতীয় চেতনার বোধটি একান্তভাবেই আধুনিক কালের বিষয় এবং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের আধুনিকীকরণের কর্মসূচির একটি যোগ আছে। বস্তুত জাতীয় ভিত্তিতে প্রশাসনিক একক গঠন করে, স্থানীয় জাতীয় ভাষাগুলিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়ে, স্থানীয় ‘এলিট’-দের সেখানকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ করে আঞ্চলিক জাতিসত্তা নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিতই করেছিল সোভিয়েত নেতৃত্ব। গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচির সূচনার পূর্বে এদের বিচ্ছিন্নতার কোনও লক্ষণই ছিল না (যদিও রুশীকরণ নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল না তা নয়)। সংস্কারের পরিণামে কেন্দ্রীকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শৈথিল্য, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোতে ভাঙন, স্থানীয় এলিট নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পালাবদলের সূচনা করেছিল। গর্বাচেভ একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থার অবসানের লক্ষ্যে ১৯৮৯-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ-এর নির্বাচনে অন্যান্য শক্তিকেও অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার ফলে বিচ্ছিন্নতাকামী জাতীয়তবাদী শক্তিগুলি একদিকে যেমন নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছিল, তেমনই সুযোগ পেয়েছিল তাদের পক্ষে জনমত সংগঠিত করার। ঐক্যপন্থী কমিউনিস্ট প্রার্থীরা এই নির্বাচনে শোচনীয় ফল করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করব একটি কথা বলে। বামপন্থীদের একাংশ যেমন গর্বাচেভকে একজন ‘ঘৃণ্য চরিত্র’ বলে দেগে দিতে চাইছেন, আমি তাঁর সঙ্গে একমত নেই। সোভিয়েত ব্যবস্থা যে শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করেনি, রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ও পার্টি-নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপ্ত হয়ে জনগণের মুক্তির মার্কসীয় প্রকল্পটিকে স্থগিত করে দিয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই ব্যবস্থার গণতন্ত্রমুখী সংস্কার ছিল দীর্ঘ-প্রত্যাশিত এবং গর্বাচেভ সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন (হবসবম তাঁকে ‘passionate reformer’ বলে অভিহিত করেছেন)। কিন্তু সংস্কারের পথ পিচ্ছিলও বটে, বিশেষত যে-‘সমাজতন্ত্র’ তখনও আগ্রাসী পুঁজিবাদ দ্বারা পরিবৃত। গর্বাচেভ আগ্রাসী পুঁজিবাদের বিপদকে খাটো করে দেখেছিলেন, কখনও-বা তাকে ‘মিত্র’ ভেবেও বসেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে-অর্থনৈতিক সংকট চলছিল তার জন্য সোভিয়েত ব্যবস্থার অতিকেন্দ্রিক চরিত্র নিশ্চয় দায়ী ছিল, কিন্তু খুল্লামখুল্লা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি যে এর বিকল্প হতে পারে না – সে-কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব। ভ্রান্ত মোহ তৈরি হয়েছিল মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও ভোগবাদের প্রতি এবং গর্বাচেভের সীমিত সংস্কারকে যথেষ্ট মনে করেননি সোভিয়েতের উদারপন্থী চিন্তকসমাজ। নেপ পর্বের লেনিনকে গর্বাচেভ বারবার অনুসরণ করার কথা বলতেন, কিন্তু লেনিন ছিলেন আপাদমস্তক বিপ্লবী, যিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন, অবস্থান পালটাতেন। লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পড়লেই বোঝা যায় যে তিনি গণতন্ত্র-বিরোধী ছিলেন না; কিন্তু বিপ্লবকে রক্ষা করা তাঁর প্রধানতম বিবেচনা ছিল এবং সে কারণে প্রয়োজনে ‘নিষ্ঠুর’ হতে দ্বিধা করতেন না। কিন্তু গর্বাচেভ সোভিয়েত ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় কঠোরতা দেখাতে পারেননি। রাষ্ট্রীয় ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সমাজতন্ত্রকে ধরে রাখার নীতি থেকে তিনি সম্পূর্ণ সরে এসেছিলেন। এ তার ব্যক্তিগত মহত্ত্বেরই প্রকাশ—কিন্তু আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের কর্ণধাররা সচরাচর এমন মহত্ত্ব দেখান না—রাষ্ট্রবিপ্লব ও চূড়ান্ত বিদ্রোহের মুখে উদারনৈতিক ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রভুরা চুপচাপ বসে থাকেন—এও আমরা দেখিনি। কিন্তু গর্বাচেভ শত প্ররোচনার মুখেও তেমন আদর্শবাদী অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। রাশিয়ায় তখন বিরাজ করছিল এক অদ্ভুত পরিস্থিতি—পার্টির সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃবৃন্দের একাংশই হয়ে উঠেছিল তীব্রতম কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী। এর কারণও সম্ভবত নিহিত ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অতি-কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামো ও আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে, যা জনগণের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী উদ্দীপনাকে শুকিয়ে মেরেছিল। প্রভাত পট্টনায়ক যথার্থই বলেছেন, এই ব্যবস্থা শুধু জনগণকেই রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন ও রাজনৈতিক চেতনাশূন্য (depoliticize) করেনি, নেতৃত্বকেও করেছিল। গর্বাচেভের নিজের সম্পর্কে করা একটি মন্তব্য দিয়েই তাই এই আলোচনার ইতি টানা যেতে পারে: আমি ছিলাম এই ব্যবস্থার ‘প্রোডাক্ট’, আবার তার ‘অ্যান্টি প্রোডাক্টও’। বলাই বাহুল্য, কথাটি সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন কমিউনিজম-বিরোধী ‘কমিউনিস্ট নেতা’-দের অনেকের সম্পর্কেই প্রযোজ্য।
নির্বাচিত রচনা ও গ্রন্থপঞ্জি
১. Gorbachev, Mikhail, Memoirs. Translated by Georges Peronanky and Tatjana. New York: Harper Collins, 1991
২. Hobsbawm, Eric. Age of extremes The Short Twentieth Century 1914-1991, New Delhi: Viking, 1994
৩. Brown, Archie. The Gorbachev Factor, Oxford University Press, 1996
৪. Taubman, William, Gorbachev His Life and Times, London: Simon & Schuster, 2017
৫. Patnaik, Prabhat, Re-envisioning Socialism, New Delhi: Tulika, 2012
৬. চক্রবর্তী রাজকুমার, “স্তালিন-লেনিন নিন্দা, ইতিহাসের পুনর্বিচার ও সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন”, শারদীয় অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৪২১/২০১৪
৭. সেরিনা জাহান, ধূসর মস্কো, কলকাতা: একুশ শতক, ২০০৫
গর্বাচভেরা কুলাক উৎস থেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে সাম্যবাদবিরোধীতা ছিল তাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেই বিরোধীতা ছিল সুপ্ত। অনুকূল পরিবেশে বিকশিত হয়েছে মাত্র। অক্টোবর বিপ্লব ও ধারাবাহিক তীব্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে এক নতুন সমাজ বাস্তবতা। জারের আমলের বিভিন্ন জাতিগোষ্টীর কারাগার পরিণত হয়েছে মুক্ত মানুষের সহমর্মিতার সমাজব্যবস্থায়। জন্ম লগ্ন থেকেই আতুড়ঘরে নিশ্চিহ্ণ করার আপ্রাণ চেষ্টার বিরতি ঘটেনি কখনই। লেনিনের নেতৃত্বে সমস্ত অপপ্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াও বড় চাষী বা কুলাকদের অভ্যুত্থান বড় রকমের বিপদের কারণ হয়েছিল। কিন্তু লেনিনের পরে স্তালিনকে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল দৃঢ়তার সাথে। নতুন সমাজব্যবস্থার পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ অঙ্কুরেই ধ্বংস করার প্রয়াস চালু ছিল সামাজ্যবাদী দুনিয়ার পক্ষ থেকে। বাইরে থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ ও ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত- উভয়ই ব্যর্থ হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৩৮এর সংঘটিত সোভিয়েত বিরোধী অভ্যুত্থান ব্যাপকতা লাভ করে এবং সর্বশক্তি নিয়োগ করে পরাজিত করতে হয়। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় সামাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মদতে বেড়ে ওঠা কট্টর সাম্যবাদবিরোধী শক্তি হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ২ কোটি ৭০ লক্ষের বেশি দেশপ্রেমিকের আত্মবলিদানে হিটলারের পরাজয় সুনিশ্চিত হয়। ব্যাপক ধ্বংসস্তূপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুনভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। বাইরে থেকে সমাজতন্র ধ্বংস করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার প্রধান অন্য পথ অনুসরণ করে। মার্কিন সংস্থা সি আই এ ১০০-বছরের পরিকল্পনা নেয় সোভিয়েত দেশ ধ্বংস করার। ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা ৬নং ধারায় স্বীকৃত হয়। প্রশাসনের সমস্ত স্তরে নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া সুষ্ঠূভাবেপরিচালিত হতে থাকে এইভাবে। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার সবথেকে শক্তিশালী হাতিয়ার সি আই এ ভিতর থেকে বিশ্বস্ত ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অত্যন্ত সতর্কতার পার্টিতে নতুন সদস্যদের দিকে নজর দেয়। তার আগে ওই সব সদস্যদের কয়েক পুরুষের তথ্যপঞ্জি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়। এই হচ্ছে পটভূমি।//// ব্রেজনেভের মৃত্যুর পর আন্দ্রোপভ নেতৃত্বে আসে। সেই সুস্বাস্থ্যের মানুষটি ”কিডনির অকার্যকারিতার” জন্য অপ্রত্যাশিতভাবেই মারা যান। তারপর রুগ্ন চেরনেংকো অল্পদিনের মধ্যেই প্রয়াত হয়। গর্বাচভের পথ মুক্ত হয়। তার কার্যকলাপ-ের মূল লক্ষ্য সমাজে মুক্তির হাওয়া বয়িয়ে দেওয়া। গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা নামক দুটি বস্তু জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। ওদিকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার চিত্তাকর্ষক দিকগুলোকে সামনে আনা। কিন্তু ওই দুনিয়ার নিয়মিত সংকট এবং মানুষে মানুষে ধনবৈষম্য প্রচারে চাপা দেওয়া হয়। এক স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। কারণ তারা দেখেছে। জন্মের আগে থেকেই সামাজিক সুরক্ষা যে ভাবে চালু আছে তাতে নাফরিকদের কখনই ভাবতে হয়না তাদের বেড়ে উঠা শিক্ষা স্বস্থ্য কর্মসংস্থান বাসস্থান এই সব সমস্যার কথা। তখন তথাকথিত ”গণতন্ত্র” ”মুক্ত” বাজার ইত্যাদি সম্পূর্ণ অপরিচিত সর্বরোগহর দাওয়ায় তুলে ধরলো বিভ্রান্ত মানুষের মধ্যে। সমাজতন্ত্রের ”মানবিক” রূপ তুলে ধরতে সচেষ্ট হলও। রাষ্ট্রপতি প্রধান পদ্ধতির প্রবর্তন হোল। সেখানে তার হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। কিন্তু প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াল সংবিধানের ৬ নং ধারা, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকা প্রধান। তখন সেই বাধা দূর করার জন্য, প্রচার চলল যে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই আর পার্টির নেতৃত্বদানের প্রধান ভূমিকা থাকার প্রয়োজন নেই। বাতিল করা হোল ওই ধারা। পথের সব বাধা দূর হয়ে গেল। তার পর শুধু সময়ের অপেক্ষা। গর্বাচভ ও বিশ্বস্ত গোষ্ঠীর কাজ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছিল। এক একটা পদক্ষেপ নেবার পর তাকে মূল্যায়ন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যার যে কাজ নির্দিষ্ট ছিল সে সেই কাজ করেছে। গরবাচভের পরে ইয়েলতসিন তার ভূমিকা পালন করেছে। গরবাচেভএর দেশদ্রোহিতার দুটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। দুই জার্মানির একীকরণ হয়ে নতুন দেশ হোল। কিন্তু গরবাচেভ দাবী করল না যুক্ত জার্মানির নিরপেক্ষ অবস্থান। সাম্রাজ্যবাদী দাবী খুশিরসাথে মেনে নিল। অয়ারশ জোট ভেঙে দিল তাদের দাবী মত। কিন্তু কখনই দাবী করল না বা নিশ্চিত কল না যে ন্যাটো ভেঙে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্ত দাবী মেন নিয়ে ধন্য হোল গরবাচেভ। সেই জন্য সে মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের কাছে সে বিশ্বাসঘাতক ঘৃণ্য এক ব্যক্তিত্ব। সাম্রাজ্যবাদের ার এক লক্ষ্য বিশাল রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠতরাজ করা। তার জন্য দেশকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত এখনও সফল হয় নি। বর্তমান রাশিয়ার নেতৃত্ব স্বীকার করেছে– ”বিংশ শতাব্দীর সবথেকে বড় বিপর্যয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া-ভ্লাদিমির পুতিন।”