আমাদের মেরি লিকি আর লুই লিকির অর্ধ-সমাপ্ত গল্প
মুখবন্ধ
‘আমাদের দেশে ফসিল পাওয়া যায় না কেন?’
‘কেন?’
‘কারণ আমরা জানিনা ফসিল কী করে রক্ষা করতে হয়। দেশে বেসিক এডুকেশন নেই। আমরা সভ্য না, শিক্ষিত না। ফসিল পেলে সেগুলো ফেলে দিয়ে জমি সাফ করে চাষ করে দিই। দু চারটে বিক্কিরিও হয়ে যায়।’
‘যা:, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’
‘একটুও না। তুই কি জানিস, ১৯৬০ সালে পঞ্জাব আর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে হিমাচল প্রদেশে এক লুপ্ত এপ-এর সম্পূর্ণ চোয়াল পাওয়া গিয়েছিল! এখন আমরা যদি সুযোগ পেতাম আজকের আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতাম, আরও কত কিছু পেতে পারতাম বলতো?’
‘অসুবিধা কী?’
‘পুরো জায়গাটা সাফ করে, সমান করে এখন চাষ করা হচ্ছে। যদি আরও ফসিল ভিতরে থেকে থাকে সেসব ফসিলগুঁড়ো চাষের সার হয়ে গেছে।’
‘বলিস কী?’
‘ন্যাকামি করিস না। জানিস না কোন দেশে থাকি?’
‘তুই কি সত্যি বাইরে স্কলারশিপের চেষ্টা করছিস?’
‘হুম।’
‘ওঃ, তাই এত বাতেল।’
‘ক’মাস ধরে চেষ্টা করছি, এখনও কিছু পেলাম না। ইচ্ছে ছিল জেনেটিক্স নিয়ে আমেরিকায় পিএইচডি করব। বাতেল কী দেব রে? তুইও চেষ্টা চালা। নম্বর তো ভালোই পেয়েছিস।’
‘আমি এখানেই থাকব রে। আমার এখানেই ভালো লাগে। তাছাড়া মাকে এখন একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। তুই অযোধ্যা পাহাড়ে যাবি? সেখানে কিন্তু কিছু দিন থাকতে হবে। স্যার বললেন, নতুন একটা এলাকাতে প্রস্তরযুগের মাইক্রোব্লেড পাওয়া গেছে। সেখানকার জনজাতি মানুষরা পেয়েছেন।’
সূর্য
চলে এলাম ওদের সঙ্গে। স্যার বললেন। শেখর স্যার এত যত্ন নিয়ে প্রত্যেকটি ছাত্রর সঙ্গে কাজ করেন, এত ভালো রেকো আমাকে দিয়েছেন, ওনাকে না বলা গেল না। তাছাড়া কলকাতায় বসে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থেকে উত্তরের অপেক্ষা করার চেয়ে এখানে কিছু কাজ করা ভালো।
আমরা আছি কয়েকটা তাঁবুতে। আশেপাশের লোকেরাই রান্না করে দিয়ে যায়। ব্যবস্থা মন্দ নয়। এই অঞ্চলটা পুরুলিয়া শহর থেকে অনেকটা দূরে। আমাদের মূল সাইট আবার এখান থেকে এক কিলোমিটার পাহাড়ের ওপরে। সেখানে পাহাড়টা কিছুটা চূড়ার মতো, এতজনের থাকার জায়গার অভাব হতো। পাশের লোকেরা বলছিল, ঐদিকে মাঝেসাঝে হাতি আসে।
পুরুলিয়ায় এলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় নিজের দেশে এসে গেছি। এটাই আমার জায়গা। এখানকার ভূপ্রকৃতি আদিম। আছে কোয়ার্টজাইট, গ্রানাইট শিলার পাহাড়। পাহাড়ে আছে নদী; কুমারী-শঙ্খ নদী। সেই সব জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের পাথরের ব্লেড পাওয়া গেছে। আগেও পাওয়া গেছে অনেক প্রাচীন সরঞ্জাম। মাঝে মাঝে মনে হয় এই অঞ্চলে পাহাড়ের নিচে হয়তো আছে সারা পূর্ব ভারতের ইতিহাস, প্রথম মানুষ বাসের ইতিহাস।
মৃণাল আর আর্য দুদিন ধরে খুব ঘুরছে। ওরা আমার থেকে একটু সিনিয়ার। স্যারের কাছে গবেষণা করছে। আমি আর্যকে একটু এড়িয়ে চলি। ওর সব কিছুতে একটু চিমটি কাটার স্বভাব। আলোকে ও ডাকে আলোরানী বলে। কী করে আলো ওকে সহ্য করে বুঝি না।
যে ব্লেডগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো দেখলাম। অতি প্রাচীন। হয়তো হাজার পনের বছর আগের। দুলি হেমব্রমের সঙ্গে গতকাল আলাপ হল। ইনিই ব্লেডটা উদ্ধার করেছেন। কিছুদিন আগে এই অঞ্চলে সামান্য ভূমিকম্প হয়েছে। পরে সেখান দিয়ে যাবার সময় পাথরের ব্লেডটা পায়ে লেগে তাঁর আঙ্গুল কেটে যায়। হাতে নিয়ে বোঝেন ওই পাথরে কেউ ধার দিয়েছিল। আসলে এই সব অঞ্চলে টুকটাক কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়া যায়। তাই দুলির মনে হয় এটা হয়তো দরকারি জিনিস; সেখানে আরও পাথরের সরঞ্জাম পাওয়ার সম্ভবনা আছে।
বিছানায় শুয়ে পা নাড়তে নাড়তে সেই প্রাচীন যুগের মানুষের কথা ভাবার মধ্যে যে রোম্যান্স আছে, আর কিছুতে তা আমি খুঁজে পাই না। মেখলার সঙ্গে প্রেমটাই টিকল না তার জন্য। যখন তখন ফোন করত, আবার না ধরলে সোজা বাড়ি এসে জোরে জোরে গায়ে ধাক্কা, “কিরে, আমার ফোন ধরিস না কেন?” কোনো উত্তর দেবার আগেই, বাপরে, কী সিন। থাপ্পড় দিয়ে, চুল টেনে, জীবন হেল। সেদিনই বলে দিলাম, “এসব চলবে না। আমার প্রথম ভালোবাসা আমার কাজ, প্রাগিতিহাস। থাকতে হয় থাকো, নয়তো কেটে পরো।” মা পরে শুনে বলল, “তোর কপালে বিয়ে নেই। আমার একটা মাত্র ছেলে, মনে হয় বন্ধুহীন হয়ে জীবন কাটাবে।”
তবে বাড়িতে আমাকে কিছুতে জোর করে না। বাবা-মা দুজনে ডাক্তার। আমি অঙ্কতে ভালো ছিলাম; এ ক্ষেত্রে সবাই চাপ দেয় জয়েন্টে বসবার জন্য। আমি ওপথে যাইনি। তারাও আর কিছু বলেনি।
ভাবতে ভালো লাগে সেই মানুষের জীবনকথা। কেমন জীবন তারা কাটাত? খাবারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সকাল থেকে নিশ্চই খাবারের সন্ধানে দিন কাটত। কী খেত তারা। চাষ করতে পারত না। ওই বনে শিকার করত হরিণ, খরগোশ, শুয়োর, বুনো ছাগল। হাতি শিকার করতে হয়তো জানত। অনেকে মিলে হাতিকে ভয় দেখিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিত। তারপর এই পাথরের ব্লেড দিয়ে ছাল ছাড়িয়ে, চাকলা করে মাংস কেটে আগুনে রোস্ট করে খেত। মন্দ ছিল না ব্যাপারটা।
বেশ জমে গিয়েছিল, আলোর আবির্ভাবে চিন্তাসূত্র কেটে গেল। “কালকে আমরা একসঙ্গে সাইটে যাব, স্যার থাকবেন সঙ্গে, এখান থেকে খাড়াই যেতে হবে। স্যার বলেছেন, সেখানে হয়তো আরও আর্টেফ্যাক্টস পাওয়া যাবে। সকাল ছটাতে একেবারে রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়াবি।”
সকাল বেলা বাইরে বেরিয়ে দেখি সবাই আমার অপেক্ষা করছে। এমনকি দুলি হেমব্রমও চলে এসেছে। তুষার চোখ মটকে একটু হাসল। “রাজপুত্রের ঘুম ভাঙল!” ও আমাদের পাড়ায় থাকে, বাড়ি আসে মাঝে মাঝে।
চা খেতে খেতে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের এই চড়াইয়ে গাড়ি, গরুর গাড়ি কিছু চলবে না। শুধু দুটো পা। দ্বিপদ প্রাণীর প্রথম ও শেষ ভরসা।
নাদিয়া পিছিয়ে পড়ছে। আমিও একটু পিছিয়ে গেলাম। যে কোনো জায়গায় জমিয়ে দিতে পারে নাদিয়া। আমি ওর বাড়ি গেছি। ওর মা কিন্তু ভীষণ শান্ত, খুব কম কথা বলেন।
“তুই আমাকে পাহারা দিতে এলি নাকি?”
“নারে বাবা, আড্ডা দিতে। শেষ পর্যন্ত আসতে পারলি?”
“বলে দিয়েছি, বাড়ি থেকে না যেতে দিলে, একদিন এমন ভাবে চলে যাব আর খোঁজ পাবে না। তারপরে সব একেবারে চুপ।” আমার হাসি দুদিকের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আবার আমার কানে চলে এল।
ওকে দেখলে প্রথমে সবাই বলে, বাবা, কী ফুটফুটে মেয়ে। কিছু পরে নিশ্চই বলে, কী খরখরে মেয়ে।
“কোথায় যেতিস?”
“কেন তোর বাড়িতে গেলে থাকতে দিবি না? তুই না দিলে আলোর বাড়িতে চলে যেতাম। নয়ত চলে আসতাম এখানে। দিব্বি বাচ্চাদের স্কুলে দিদিমনি হয়ে আর ফসিল খুঁজে জীবন কাটিয়ে দিতাম।”
আলো
এখানে পৌঁছোতে আট’টা বেজে গেল। দুলি দাদা সাইটটা দেখিয়ে দিল। বেশ উঁচু এই টিলাটা। একটু দূরেই একটা পুকুর। পাশে দুটো প্রকাণ্ড শাল গাছ। এদিকে শাল, হর্তুকি, আমলকি, নিম গাছ আছে। নানা রঙের গাছের পাতা ঝরে পড়ে যেন এক কার্পেট পেতে দিয়েছে।
সকাল থেকেই আমরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে গ্লাভস পরে খোঁড়াখুঁড়ি করে চলেছি। এই খোঁড়াখুঁড়ি খুব সাবধানে করতে হয়। আমাদের সাহায্য করছে দুলি দাদার গ্রামের কয়েকজন। এই কাজে যথেষ্ট পরিশ্রম হয়, আমি তো ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষন বাদে বাদে একটু উঠে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। এখন এদিকে যথেষ্ট শীত পরে গেছে। ঘাম হচ্ছে না। এদিকে থেকে গেলেই ভালো হত। অন্তত হাঁটার পরিশ্রম বাঁচত। তবে শুনলাম অনেক সময়ে হাতি আসে।
দুপুরে লাঞ্চ প্যাকেট নিতে গিয়ে দেখি নাদিয়া একটা ছোটো ব্লেড পেয়েছে। ব্লেডটা ভেঙে গেছে। সূর্য খুব চুপচাপ। কাজেও যেন মন নেই। নাদিয়া ওকে হাত মুখ নেড়ে কী বোঝাচ্ছে।
জল খেতে গিয়ে ওকে ডাকলাম, “কী রে এত গোমড়া মেরে গেলি কেন?”
“জানি না, এই জায়গাটা দেখে কেমন যেন মায়ায় পরে গেলাম। আমি এখানে থাকব রে।”
“পাগলামি করিস না, স্যার থাকতে দেবেন না।”
“আমি তোদের গ্রুপের কেউ না। স্যার আমাকে আসতে বলেছেন, তাই এসেছি। বলেই এসেছি দরকার হলে কলকাতা চলে যাব।”
সূর্য যেন দিন দিন কীরকম রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। কারোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। যেন কোনো এক চাপা উত্তেজনায় ভুগছে। আগে কিন্তু একদম অন্যরকম ছিল। ওদের বাড়িতে আমি গেছি। ওদের বাড়িতে যেহেতু অনেক জায়গা, কলেজের পরে আমরা ছয়-সাত জন মিলে গিয়ে আড্ডা দিতাম, ল্যাবের রিপোর্ট লিখতাম, আর প্রচুর খাবার খেতাম। সারাক্ষণ ও জমিয়ে রাখত। কাকিমা খুব ব্যস্ত মানুষ। একবার কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিল। উনি নামি স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমি শুনেছি তোমার কথা। তোমার মা’কে আমার সমবেদনা জানিও।”
বাবা চলে গেছে প্রায় এক বছর হতে চলল। হঠাৎ করে। এক্সিডেন্ট। রাস্তায় এক গাড়ি ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা খবর পেয়েছি বহু পরে। বাবার রক্তে গড়িয়ার রাস্তা ভিজে গিয়েছিল।
পুলিশ এখনও তাকে ধরতে পারেনি। মাঝে মাঝে যাই থানায়। এদের একটাই কথা, “যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেখানে কোনো সিসি টিভি ক্যামেরা নেই। কী করে ধরি বলুন দেখি?” যেন আমার জানার কথা এরা কীভাবে আততায়ীকে ধরবে। সূর্য একবার বলেছিল, আমার সঙ্গে থানায় যাবে। পরে আর কিছু বলল না।
এখনও রাতে মা বাচ্চা মেয়ের মত কেঁদে ওঠে। তখন গায়ে হাত দিলে লজ্জা পায়। আসলে বাবা আমাদের কিছুটা নাবালক করে রেখেছিল। মা স্কুলে পড়ায়। তবে ওই পর্যন্ত, আর কিছু খবর রাখত না। প্রায় একবছর ধরে দুজনে দৌড়াদৌড়ি করে গেলাম শুধু ব্যাঙ্ক, এল আই সি, কর্পোরেশন – এই সব ঠিক করতে।
মা খুব বাবার অভাব বোধ করে, বুঝি। আমি কি করি না? কিন্তু এবার শক্ত হতে হবে যে! এখানে আসার আগে বলে এসেছি, “কোথায় চাকরি পাব জানি না, একা থাকতে অভ্যাস করো।” একা থাকতে হবে একদিন সবাইকে।
একা থাকতে আমার কোনোদিন অসুবিধা হয়নি। ঠাম্মু চলে যাবার পরে একা একাই তো থাকি। বই, দু চারটে গাছ, আর গান – এই নিয়েই তো কেটেছে। মায়ের সঙ্গে আমার ঠিক কোনোদিন বন্ধুত্ব হল না। আমার আর মায়ের মধ্যে বাবা যেন ছিল এক সেতু। সেই সেতুটা চলে গেল। আবার চলে গিয়ে যেন দু জনকে একটু মিলিয়ে দিল!
একা থাকব, শুধু খুঁজে বেড়াব প্রাচীন ইতিহাস, প্রাগিতিহাস। কলেজে লুই লিকির বইগুলো পড়ে মনে হত, ইশ, এই জীবন যদি আমার হত। মেরি আর লুই লিকি, তাদের ছেলে রিচার্ড। সারা জীবন ধরে পুরো পরিবার আফ্রিকায় ফসিল খুঁজে বেড়িয়েছে। আমাদের কেন এমন হয় না?
সূর্য
কাল রাতে সাইটে থাকলাম। আমার সঙ্গে আছে স্থানীয় একটি ছেলে। বসন্ত। মাধ্যমিক পাশ। একটা ছোট্ট পারিবারিক দোকান আছে। সুযোগ পেলেই শখের পর্যটকদের সঙ্গে আসে এই পাহাড়গুলোতে। শুনলাম আরও একটু শীত পড়লে কলকাতা থেকে অনেকে আসবে ট্রেক করতে।
আমরা আছি একটা তাঁবুতে। ওর একটা মহৎ গুন, একটাও বাড়তি কথা বলে না। বোঝে কখন থামতে হবে।
রাতে বাইরে বেরিয়ে দেখি চারিদিক জোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর নির্জন। শাল গাছের মাথার ওপরে আলোর আভায় মনে হল এই দৃশ্য হয়তো হাজার কুড়ি বছর আগে আমার মতোই কোনো এক যুবক দাঁড়িয়ে দেখেছে। হয়তো অপর্থিবের আশঙ্কায় কেঁপে উঠে গুহায় লুকিয়েছে।
গাছের ছায়ায় যেন আলো’কে দেখলাম। “একবার তো গেলি না আমার সঙ্গে থানায়। তোদের এত চেনাশোনা, এত খাতির, আমাদের কে পাত্তা দেয় বল!” ও কি চেয়েছিল আমি ওর সঙ্গে যাই! বলেনি তো!
সকালে পুরো অঞ্চলটা ঘুরে দেখে নিলাম। এত পুরোনো অঞ্চল, সেভাবে পদ্ধতিগত গবেষণার কাজ এখানে হয়নি। হলে কিন্তু অনেক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মহাদেবেরা ও কানা, পুরুলিয়ার সাইট, চিত্র ঋণ – অনিল কুমার
যখন মানুষ শিকারি আর সংগ্রাহক ছিল, তখন এই বন-জঙ্গল ঘেরা টিলা ছিল তাদের স্বাভাবিক ঘর-বাড়ি। এখানে নিশ্চই কিছু গুহা ছিল, সেখানে তারা থাকত। জঙ্গল থেকে ফল মূল কুড়িয়ে আনত। পশু শিকার করে খেত। চকমকি বা অন্য ছোটো পাথর দিয়ে ব্লেড বানাতো। ছোটো পাথরের ধারালো ব্লেড বানানো বেশ কঠিন ব্যাপার। সেই ব্লেডকে লাঠির গায়ে জুড়ে বল্লমের মত ব্যবহার করত। তাদের সমাজে শ্রেণী বিভাগ ছিল না, তবে সেখানেও ছিল দলপতি। কিশোর ও যুবকদের মধ্যে অনেকে ছিল দারুন শিকারি, তাদের নিশ্চই আলাদা মর্যাদা ছিল। এই যেমন আজকের সমাজে আছে ধনবান বা রাজনীতির মাথাদের।
পাড়ার পুঁটে নেতারও কত হাঁকডাক।
মেয়েদের অবস্থা কেমন ছিল? ছেলেদের সমান মর্যাদা পেত? বড়ো শিকারে অংশ নিতে পারলে, পেত। নয়ত নয়। সম্মান শেষমেশে ঠিক হয়, কে বেশি উৎপাদন করতে পারছে তাই দিয়ে। রোজগার। বাবার নার্সিং হোমটা ভালো চলছে না। রাতে আজকাল মাঝে মাঝেই একটু ড্রিংক করে। মা ফেরে রাতে। সারাদিন এক গাদা জায়গায় রোগী দেখে আর অপারেশন করে যখন বাড়ি ফেরে তখন একদম ক্লান্ত। আমার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে ঘরে চলে যায়। মা ঠিক ঝগড়াঝাটি করে না, তবে একটু যেন সূক্ষ্ম অবজ্ঞা থাকে বাবার সঙ্গে ব্যবহারে। দেখ আমি সফল, সার্থক। তুমি হেরে গেছ। তোমার জেদ, অনমনীয়তা তোমার এই অবস্থার কারণ। ওই পাড়ার ছেলেগুলোকে হাতে রাখতে পারলে আজ তোমার এই অবস্থা হোত না।
বাবার চিন্তার কারণ আমি বুঝি। নার্সিং হোমটা হয়তো বেচে দিতে হবে। এতগুলো মানুষের দায়িত্ব নিয়েছিল, মাঝপথে ওদের ছেড়ে যেতে হবে।
দূর থেকে দেখি ওরা সব আসছে। নাদিয়া চেঁচাচ্ছে, “জিনপরী দেখেছিস রাতে?” আর্য বলে ওঠে, “হুম, ও দেখেছে ডামাবাণু। আরণ্যকের সেই পেত্নী।” এখানেও আর্য একটু আতলামি মারতে ছাড়ল না। দেখ, আমি আরণ্যক পড়েছি।
সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম গেল। আলোর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলাম না। ফিরে গিয়ে ওর বাবার ব্যাপারটা দেখতে হবে।
আলো
রাতে শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। সব যেন কেমন দুলছে। চারিদিকে রব। গাছের ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। মাটির তলায় ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। ভূমিকম্প। সবাই উঠে গেছে। কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “সবাই মাটিতে শুয়ে পড়।”
সূর্য। সূর্য ওপরে আছে। জোর করে থেকে গেল। কোনো কথা শুনল না। কারোর কথা শোনে না। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে। বাবার কথা মনে পরে যাচ্ছে।
শেষে এক সময় পৃথিবী স্থির হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশে জোৎস্নার আলো। কে বলবে পাঁচ মিনিট ধরে কী প্রলয় হয়ে গেল। পাশের শিমুল গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছে আমাদের রান্নার তাঁবুর মাথায়।
স্যার হাতে একটা টর্চ আর লাঠি নিয়েছেন। আমি ওদের সঙ্গে চললাম। স্যার একবারও বারন করেননি। দুলি দাদা চলেছে সকলের আগে। প্রায় অর্ধেকটা ওঠার পরে দেখি কে একজন নেমে আসছে। বসন্ত।
“সূর্য কোথায়? সূর্য?”
“ওই ওপরে আছে। পাহাড় ফাঁক হয়ে গেছে। পুকুরের জল আর মাছ বাইরে চলে এসেছে। আমরা শুয়ে পড়েছিলাম বিছানা, তাঁবু সব মাথায় দিয়ে। বেঁচে গেছি। দাদা সেই সেখানে বসে আছে। বলল সকালে নামবে।”
সকালের আকাশ গলানো সোনা রঙের আলোয় রেঙে উঠল। সূর্য ওই দূরে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখি, পাথর সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা নতুন স্তর। ও যেন ঘুম থেকে উঠল।
ফ্লেক্স, ব্লেড, চিত্র ঋণ – অনিল কুমার
“দেখ দেখ, এখানে একটা নতুন স্তর উঠে এসেছে। আছে ফ্লেক্স, ব্লেড। স্যার, এখানে পুরো এক্সকাভেশন করতে হবে। এদিকে পাথরের নীচে ফসিল পাবার সম্ভবনা আছে। এত পুরানো গ্রানাইটের স্তর। শুকনো মাটি। আজ ভোরে আমি কাস্তের মতো শুরু বাঁকানো এই ব্লেড পেয়েছি। এই জায়গা ঘিরে ফেলতে হবে।”
উত্তেজনায় ওর গলা কাঁপছে।
দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে যখন নামছি, তখন দেখি পাশে সূর্য এসেছে। “এবার ফিরে গিয়ে তোকে নিয়ে থানায় যাব। আমার ভুল হয়ে গেছে রে।”
অবশিষ্ট
নাদিয়া ফোন করেছিল সকালে। ওরা সব পরের সপ্তাহে পুরুলিয়া যাচ্ছে। এরপরে গরম পড়ে যাবে। তারপর বর্ষা। সেখানে ওই গরমে কাজ করা যাবে না। তবে যাবে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। এর থেকে বেশি সময়ের জন্য টাকা এখনও পাওয়া যায়নি। এখন জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। আমি যেতে পারব না, তাই ওর মন খারাপ।
একটা চাকরি পেয়ে গেছি। কলকাতাতেই। এই মার্চ মাসে কলকাতার গরমে রোজ অফিস যাতায়াত করতে করতে মনে হয় সেই নভেম্বরের পুরুলিয়া যেন ছিল এক মায়াময় অন্য পৃথিবী। সেই শিমুল গাছ। পাহাড়ের ওপরে পুকুর, শাল গাছ। স্তব্ধ রাত্রি, দূরের স্লেট রঙের টিলা। যেন স্বপ্ন জগতে ছিলাম। ভোরের আলোয় সূর্যের হতভম্ব হয়ে বসে থাকা মনে পড়লে এখনও বুক ধক করে ওঠে।
ওই জীবনটা আমি চেয়েছিলাম। সত্যি কি চেয়েছিলাম? তাহলে নাদিয়ার মতো সামান্য স্টাইপেন্ড নিয়ে ওদের সঙ্গে তো যেতে পারতাম। হয়তো অনিশ্চয়তাকে ভয় পেলাম। য়ুনিভার্সিটিতে একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদ বেরিয়েছে, তার জন্য লাইনে আছে অন্তত কুড়ি জন। আমার ভাগ্যে কোনোদিন যদি শিকে ছেড়েও, সে হবে এক যুগ পরে। এক্সকাভেশনের জন্য সামান্য টাকা জোগাড় করতে স্যারের হেনস্থা দেখে মনে হয়, এভাবে চলবে না।
সূর্য এখন শিকাগোতে আছে। এই তো সবে গেল। মাঝে মাঝে ফোন করে। ও ভালো আছে। খুশি। তবে খালি বলবে, “চলে আয়। এখানে পপুলেশন জেনেটিক্সে দারুন কাজ হচ্ছে। এপলাই কর।”
ভাবছি।
কলকাতা, মা, চাকরি এসব ছেড়ে যাওয়া কি সহজ? আবার মনে হয় এই গতানুগতিক জীবন কাটিয়ে কী হবে? মেরি লিকি হতে চেয়েছিলাম না একদিন?
ভেবে চলেছি।
তথ্যসূত্র
১) Bishnupriya Basak et al., “Earliest dates and implications of Microlithic industries of Late Pleistocene from Mahadebbera and Kana, Purulia district, West Bengal,” Current Science, 107(7), October (2014)
২) নীহাররঞ্জন রায়, “বাঙালীর ইতিহাস-আদি পর্ব,” পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, তৃতীয় অধ্যায়, (১৯৮০)
৩) Bishnupriya Basak et al., “Earliest dates of microlithic industries (42–25 ka) from West Bengal, Eastern India: New light on modern human occupation in the I
অসাধারণ!! অসাধারণ!!! শুধু লেখার গুণে একটানা পড়ে যেতে হয়, থামা যায় না!
লেখার মধ্যে তথ্যের ভার তেমন নেই কিন্তু প্রত্নতত্ত্বের প্রতি ভালোবাসা জাগানোর সমস্ত উপাদান উপস্থিত।
এতো ভালো গদ্য যাঁর কলমে উপস্থিত তিনি কেন শুধু Non fiction লেখেন?
দিদি, আপনাকে অনুরোধ আপনি অতি অবশ্যই কিছু fiction লিখুন।
আপনার মন্তব্যটিও খুব ভাল হয়েছে৷
থ্যাঙ্কু। আসলে গল্প লিখতে সময় পাইনা। তুমিও চেষ্টা করতে পারো।
ইতিহাস, নৃতত্ব, বিষণ্ণতা, টুকরো প্রেম সব মিলেমিশে একাকার। এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়া। খুব ভালো লাগলো।
খুব সুন্দর। আমি তো অনেক দিন ধরে fossil hunting করছি তাই দেখেছি যে মানুষ এগুলোকে কতোটা অপ্রয়োজনীয় ভাবে। আবার জনসংখ্যা, দারিদ্র্য তাদের বাধ্য করে site ভেঙ্গে চাষবাস করতে
শেষ দুপুরে পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হয়ে গেল! প্রথমে পুরো লেখাটা দেখে ভাবছিলাম বড়ো লেখা। শেষ হয়ে গেলে ভাবছি, আর একটু থাকলে হতো না!
এই ধরনের মন্তব্য কাজের প্রেরণা জোগায়। ধন্যবাদ নেবেন।
আপনার মন্তব্যটিও খুব ভাল হয়েছে৷
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে গেলাম।
আমার ধন্যবাদ নেবেন।
বরাভূম স্টেশনের একটা গল্প আছে ।পাহাড় জংগল থেকে ভালুক লোকালয় এ নেমে আসত ।একবার একটা ভালুক এসে স্টেশন মাস্টারের চেয়ারে বসেছে ।পয়েন্টসম্যান এসে বলছে বড়বাবু 137 line clear চাইছে
।
খুব ভাল লাগল। মানুষের প্রতি ভালবাসা আর প্রত্নতত্ত্বের প্রতি ভালবাসা কোথায় যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে লেখার গুণে।
অনেক ধন্যবাদ নেবেন।
আসলে সেটাই চেষ্টা করেছিলাম।
অসাধারণ লাগলো, লেখাটা। আপনার লেখা প্রাগিতিহাস, সবে পরে শেষ করলাম।
ধন্যবাদ।
প্রাগৈতিহাসিক আবিষ্কার নেশা তার উপর রহস্য গল্প বোধ হয় আমাদের সাহিত্যে প্রথম। তবে একটু ছাড়া ছাড়া লাগায় প্রবন্ধ মতো লাগছিল। বাঁধুনি আরো ভাল হলে সরস লাগতো।
একটাই কথা – দারুন ! এরকম লেখা আরো পেলে ভালো লাগবে খুবই।
ধন্যবাদ। আপনিও লিখে ফেলতে পারেন।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ নেবেন।
অভিভূত হলাম।
ধন্যবাদ নেবেন।