ময়ূরশর্মা
কথায় বলে ‘ভাগ্যের লিখন খণ্ডাবে কে?’। ঠিক তাই হয়েছিল ময়ূরশর্মার সঙ্গে। অবশ্য এই নিয়ে পরবর্তী জীবনে, সম্ভবত ওনার কোনও আক্ষেপ ছিল না। ওনার বংশধরদের তো নয়ই। আপনার কোনও পূর্বপুরুষ যদি ময়ূরশর্মার মত কাজ করে বসতেন, তা নিয়ে আপনি যে একফোঁটা অভিযোগও করতেন না, সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। উল্টে হয়তো বলতেন, “ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যেই করেন।”
আপনারা বোধহয় ময়ূরশর্মাকে চেনেন না। মানে, আমি যে ময়ূরশর্মার কথা বলছি। একই নামে তো অনেক লোক হয়। এই যেমন আমি আগে যেখানে চাকরি করতাম, সেখানে আমার এক সহকর্মী ছিল ‘ময়ূর শর্মা’ বলে। ম্যাঙ্গালোরের ছেলে। কিন্তু আমার সেই সহকর্মী ময়ূর শর্মা আর এই গল্পের ময়ূরশর্মা তো এক নয়। এই ময়ূরশর্মা ছিলেন পুরোনো দিনের লোক। পুরোনো মানে বেশ পুরোনো। প্রায় সতেরো’শ বছর আগের। তাও আবার দক্ষিণের। সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বতমালা পেরিয়ে যেখানে আমাদের নজর পৌঁছোয় না। তাই আপনারা এই ময়ূরশর্মার নাম হয়তো শোনেননি।
ময়ূরশর্মা খুব সম্ভব ছিলেন আজকের কর্ণাটক রাজ্যের শিমোগা জেলার তালাগুণ্ডা অঞ্চলের লোক। জাতে ব্রাহ্মণ। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নামজাদা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হবেন। সেই স্বপ্নপূরণের আশায় পৌঁছে গিয়েছিলেন কাঞ্চিপুরমে। মহাশক্তিধর পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চিপুরম। সেই সময়কার দক্ষিণ ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র। ভর্তি হয়েছিলেন ‘ঘটিকায়’, সে যুগের মহাবিদ্যালয়।
সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু একদিন, হঠাৎ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন পল্লব রাজাদের এক রক্ষীর সঙ্গে। ঠিক কি নিয়ে যে ঝামেলা হয়েছিল তা জানা যায়নি। কোথায় ঝামেলা হয়েছিল তা নিয়েও দ্বিমত আছে। কেউ বলেন রাস্তায়, ঘোড়ায় চড়া রক্ষীর সাথে। আবার কেউ বলেন পল্লব রাজাদের যজ্ঞে, যেখানে ময়ূরশর্মা গিয়েছিলেন প্রধান পুরোহিতের সহকারী হয়ে। ঝামেলা অবশ্য হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়নি। কিন্তু হাতাহাতি হলে বা রক্ষীর হাতে দু-চার ঘা খেলে বোধহয় ময়ূরশর্মা ততটা অপমানিত বোধ করতেন না, যতটা অপমানিত বোধ করেছিলেন রাজার রক্ষী ওনার সাথে হাতাহাতি করতে ‘অসম্মত’ হওয়ায়! ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চায়নি রাজার রক্ষী। বিদ্রুপ করেছিল ময়ূরশর্মার ‘ক্ষাত্রতেজ’-এর অভাব নিয়ে। পাতি বাংলায় যাকে বলে ‘হ্যাটা’ করেছিল। “ওহে বামুনের পো, ‘অউকাত মে রহো’; পড়াশোনা, যাগযজ্ঞ করা তোমার কাজ, তাই নিয়ে থাক। লড়াই-দাঙ্গা করতে এস না, ওইসব করার মত মুরোদ তোমার নেই” – এইরকমই কিছু একটা বলেছিল রাজার রক্ষী। আমার অনুমান।
বিদ্রূপটা ময়ূরশর্মা ‘দিল পে’ নিয়ে নিয়েছিলেন। মনে মনে বলেছিলেন, “কারারা জবাব মিলেগা।” ঘটনাটা যদি আরও পাঁচ’শ বা হাজার বছর আগে ঘটতো, তাহলে সম্ভবত ব্রহ্মতেজ দেখিয়ে উনি রাজার রক্ষীকে ভস্মই করে দিতেন। কিন্তু যে সময়ে এই ঘটনাটা ঘটেছিল তখন ‘ব্রহ্মতেজ’-এ ভস্ম করে দেওয়ার কালচার ‘অবসলিট’ হয়ে গিয়েছিল। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ময়ূরশর্মা ঠিক করেছিলেন যে এই অপমানের জবাব তিনি দেবেন ক্ষাত্রতেজের মাধ্যমে – স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
যথা ইচ্ছা তথা কাজ। বইপত্র বন্ধ করে তিনি পাড়ি দিলেন পশ্চিম দিকে। এসে পৌঁছোলেন পল্লব রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম দিকের প্রান্তিক এলাকা শ্রীপর্বত অঞ্চলে। সেখানকার উপজাতিদের নিয়ে গড়ে তুললেন নিজের একটা দল। শুরু হল পল্লবদের সাথে ‘পাঙ্গা’ নেওয়া। পল্লব প্রতিনিধিদের পরাজিত করে রাজস্ব আদায় শুরু করলেন বৃদ্ধবন এবং পল্লবদের অন্যান্য সামন্তদের কাছ থেকে। নড়েচড়ে বসলেন পল্লবরা। ময়ূরশর্মাকে শায়েস্তা করতে সৈন্য পাঠালেন।
কিন্তু ময়ূরশর্মাকে বাগে আনা গেল না। আজকের দিনে হলে হয়তো আনা যেত। কিন্তু ঘটনাটাতো আজ থেকে প্রায় সতেরো’শ বছর আগের। মানুষ তখনও পৃথিবীকে ন্যাড়া করে ফেলতে পারেনি। এই প্রাকৃতিক সুবিধার ফায়দা ওঠাতেন ময়ূরশর্মা। পল্লব সেনারা আক্রমণ করলেই, তিনি নিজের দল নিয়ে লুকিয়ে পড়তেন শ্রীপর্বতের গভীর জঙ্গলে। শুধু জঙ্গলে লুকিয়েই ক্ষান্তি দেননি ময়ূরশর্মা। পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন পল্লব বাহিনীকে। তবে সামনাসামনি আক্রমণ নয়। বুদ্ধিমান ময়ূরশর্মা জানতেন যে পল্লব বাহিনীর সাথে সামনাসামনি লড়াইয়ে তাঁর দল এঁটে উঠতে পারবে না। চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু করলেন। ‘অ্যাট এ টাইম অ্যান্ড প্লেস অফ হিজ চয়েস’। শুরু হল এক ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
পল্লবরা এই খেলাটা বেশিদিন খেলতে পারলেন না। অল্প দিনের মধ্যেই মেনে নিলেন ‘পশ্চিম সাগর থেকে প্রেহরা’র (সম্ভবত তুঙ্গভদ্রা অথবা মালপ্রভা নদী) মধ্যবর্তী অঞ্চলের উপর ময়ূরশর্মার সার্বভৌমত্ব। ৩৪৫ সাধারণ অব্দে শুরু হল ময়ূরশর্মার স্বাধীন রাজ্যপাট। প্রতিষ্ঠা হল নতুন রাজবংশের। কদম্ব রাজবংশ। ঐতিহাসিক কালের প্রথম কন্নড় রাজবংশ। রাজধানী বৈজয়ন্তীকে (বর্তমানে কর্ণাটকের ‘উত্তর কন্নড়’ জেলার বনবাসী), আজকের কর্ণাটকের উত্তর-পশ্চিমে অংশে এবং কোঙ্কন উপকূলে, যে অঞ্চলটাকে তখন বলা হত ‘কুন্তলা’, প্রায় দু’শ বছর ধরে চলেছিল এই কদম্বদের শাসন। কদম্ব শাসনের যবনিকা পতন হয়েছিল ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (৫৬৫ সাধারণ অব্দ) বাদামির চালুক্যদের হাতে, যাঁরা একসময় ছিলেন কদম্বদের সামন্ত রাজা।
ময়ূরশর্মার রাজ্যস্থাপনের এই কিসসা পড়ার পর আপনি নিশ্চই মানবেন যে ‘ভগবান যা করেছিলেন, তা ময়ূরশর্মা এবং তাঁর বংশধরদের ভালোর জন্যেই করেছিলেন’। সবকিছু ‘অ্যাজ পার প্ল্যান’ চললে বুদ্ধিজীবী হতেন ময়ূরশর্মা। হয়তো কয়েকটা ‘ডক্টরাল থিসিস’ লিখতেন। কিছু পেপারও হয়তো ‘পাবলিশ’ করতেন ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে’। পল্লব রাজাদের রক্ষীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল বলেই তো ময়ূরশর্মা মসি ছেড়ে অসি ধরেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মণ রাজবংশের। ভাগ্যের লিখন কি খণ্ডানো যায়?
ময়ূরশর্মার এই ‘হ্যাপিওয়ালা এন্ডিং’ গল্পে কিন্তু একটা খটকা আছে। বড় সহজেই যেন স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে ফেলেছিলেন ময়ূরশর্মা। অনেকটা “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম” ভঙ্গিমায়। এত তাড়াতাড়ি কেন হাল ছেড়ে দিলেন পল্লবরা? লড়াইটা তো আদতে ছিল একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসংগঠিত পেশাদার সৈন্যবাহিনীর সাথে কিছু অপেশাদার যোদ্ধার মিলিজুলি দলের। ময়ূরশর্মা ছোটবেলা থেকে হাতে পুথি ধরেছেন, অস্ত্র নয়। তাঁর দল তৈরি হয়েছিল উপজাতিদের নিয়ে, যাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা ছিলেন না। উল্টোদিকে, পল্লব সৈন্যবাহিনী ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার বাহিনী। তাও ময়ূরশর্মাকে দমন করতে কেন পারলেন না পল্লবরা? ময়ূরশর্মা দলবল নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়তেন তো কি হয়েছিল? জঙ্গল কিছুদিন ধরে ঘেরাও করে রাখলেই তো হত। সেইরকম রসদ তো ছিল পল্লবদের। তাও কেন রণে ভঙ্গ দিলেন পল্লবরা? এর পিছনে কি অন্য কোন কারণ ছিল?
হ্যাঁ, ছিল! আসলে, এই গল্পে ময়ূরশর্মা এবং পল্লবরা ছাড়াও আর একজন কুশীলব ছিলেন যার কথা এখনও বলা হয়নি। বলা হয়নি কারণ তাঁর ‘রোল’ ছিল খুব ছোট। অনেকটা সিনেমার অতিথি শিল্পীর মত। কিন্তু এমন অনেক সিনেমা আছে যেখানে অতিথি শিল্পীই সিনেমার অভিমুখটা বদলে দেন, সিনেমাটাকে নিয়ে চলে যান অন্য মাত্রায়। এই গল্পেও ঠিক তাই হয়েছিল। কে ছিলেন এই গল্পের অতিথি শিল্পী? সমুদ্রগুপ্ত। গুপ্ত বংশের প্রবল পরাক্রমশালী সমুদ্রগুপ্ত।
হয়েছিল কি, ময়ূরশর্মার সঙ্গে যখন পল্লবদের ঝুটঝামেলা চলছিল, তখন সুদূর মগধ থেকে পল্লব রাজ্যে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। না, না, ময়ূরশর্মাকে সাহায্য করতে নয়। খুব সম্ভব, আপনার আমার মত উনিও ময়ূরশর্মার নাম জানতেন না। উনি পল্লব রাজ্যে গিয়েছিলেন নিজের কাজে। তবে সেই কাজটা হাওয়াবদল বা চড়ুইভাতি গোছের কিছু ছিলনা। উনি ছিলেন কাজের মানুষ। ওনার কাজটা ছিল নিজের দিগ্বিজয় সম্পন্ন করা।
সেই সময় কাঞ্চিপুরমের সিংহাসনে আসীন ছিলেন বিষ্ণুগোপ। বিষ্ণুগোপ তাই করেছিলেন যা একজন রাজার কাছে প্রত্যাশিত – সমদ্রগুপ্তকে আটকানোর জন্য যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলাফলটাও হয়েছিল প্রত্যাশামতই। যুদ্ধে হেরে গিয়ে সমুদ্রগুপ্তের হাতে বন্দি হয়েছিলেন বিষ্ণুগোপ।
সমুদ্রগুপ্ত কাঞ্চিপুরম গিয়েছিলে দিগ্বিজয় করতে। পল্লব রাজ্য পাকাপাকিভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসার কোন অভিপ্রায় ওনার ছিলনা। তাই, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তি দেন বিষ্ণুগোপকে। ফিরিয়ে দেন পল্লবদের রাজত্ব। তারপর ফিরে যান নিজের দেশের বাড়িতে। কিন্তু রাজত্ব ফিরে পেলে কি হবে? সামরিকভাবে পল্লবরা হয়ে পড়েছিলেন দুর্বল। সমুদ্রগুপ্তর সাথে যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল পল্লবদের। আর সেই সুযোগটাই নিয়েছিলেন ময়ূরশর্মা। সমুদ্রগুপ্তের হাতে দুরমুশ হওয়া পল্লবদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি সামলানো। অতএব ময়ূরশর্মাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলনা পল্লবদের। তাই যশ চোপড়ার নির্দেশ ব্যতিরেকেই পল্লবরা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন “যা ময়ূর যা, লে যা কুন্তলা আউর জি লে আপনি জিন্দেগী”।
গল্পটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এবার তাহলে চুটুদের কথা বলে ফেলি। চুটুদের কথা না বলে গল্পটা যে শেষ করা যাবে না। কারণ চুটুরা ছিলেন এই গল্পের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।
পল্লব রাজ্যের উত্তরপশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে ছিল চুটুদের রাজ্য। সাতবাহনদের জ্ঞাতি। তাঁদেরও রাজধানী ছিল বনবাসী। দিন-কাল ভালোই কাটছিল। চুটিয়ে করছিলেন রাজত্ব। শুরু করেছিলেন সাতবাহনদের সামন্ত রাজা হিসাবে। সাতবাহনদের পতনের পর হয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীন। এই ঘটনার কয়েক দশক আগেই, তাঁরা খুব ধুমধাম করে পালন করেছিলেন নিজেদের স্বাধীন রাজত্বের শতবর্ষপূর্তি। আচমকা বিনা মেঘে বাজ পড়ার মত, ‘দ্য এন্ড’ হয়ে গেল তাঁদের রাজ্যপাটের। কারণ, ক্ষাত্রতেজ দেখিয়ে নিজ রাজ্য স্থাপনের চক্করে, চুটুদের ছুটি করে দিয়েছিলেন ময়ূরশর্মা! আইয়ো!
পুরো গল্পটাতে চুটুদের কোন ভূমিকা নেই। না তাঁরা করেছিলেন ময়ূরশর্মাকে ‘হ্যাটা’, না তাঁরা দিয়েছিলেন ময়ূরশর্মার ‘বাড়া ভাতে ছাই’। তাও গল্পশেষে, ঘটি-বাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন তো তাঁরাই। ভিটেমাটি চাটি হয়ে গেল তাঁদের। ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’-এর একদম ‘খাপে খাপ’ উদাহরণ। নেহাত সেই যুগে মিডিয়া ছিলনা, তাই ব্যাপারটা নিয়ে হইচই হয়নি।
ব্যাস, এইটাই ছিল ময়ূরশর্মার গল্প। আপনাদের অনেকটা মূল্যবান সময় নিয়ে ফেললাম, গল্পটা বলার জন্য। আর সময় নষ্ট করব না। টাইপ করে করে, তাও আবার বাংলায়, আমিও ক্লান্ত। তাই গল্পে এবার টানি দাঁড়ি। শুধু একটা কথাই বলব শেষ করার আগে। ভবিষ্যতে কাউকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার আগে একটু ভাববেন। কার কি প্রতিভা আছে; সেই প্রতিভা কবে, কোথায়, কি ভাবে ফুঁড়ে বেরোবে কে জানে। আর সেই চক্করে যদি চুটুদের মত আরেকটা কেস হয়ে যায়, দোষের ভাগী হবেন আপনি। কি দরকার?
পাদটীকা
- সাধারণ অব্দের দ্বিতীয় শতকের প্রথম ভাগ থেকে সাধারণ অব্দের চতুর্থ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত কুন্তলা অঞ্চলের (দক্ষিণ-পশ্চিম মহারাষ্ট্র এবং উত্তর-পশ্চিম কর্ণাটক), শাসক ছিলেন চুটুরা – প্রথমে সাতবাহনদের করদ রাজা হিসাবে এবং সাধারণ অব্দের তৃতীয় শতকের প্রথম দিকে সাতবাহনদের পতন হলে, স্বাধীন রাজা হিসেবে। এঁদের রাজধানী ছিল বর্তমান কর্ণাটকের ‘উত্তর কন্নড়’ জেলার বনবাসী। তখন বনবাসীর নাম ছিল বৈজয়ন্তী। চুটুদের সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য খুবই অপ্রতুল। বনবাসী এবং মালাভাল্লিতে প্রাপ্ত লিপিতে প্রাপ্ত চুটু রাজাদের নামে ‘সাতকর্ণী’ উল্লিখিত আছে। এর থেকে অনেকে মনে করেন যে চুটুরা সাতবাহনদের জ্ঞাতি ছিল। চুটুদের নিজস্ব মুদ্রা ছিল এবং সেই মুদ্রার নকশা দেখে মনে হয় যে চুটুরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ৩৪৫ সাধারণ অব্দে ময়ূরশর্মার হাতে চুটুদের পতন হয়।
- ৩৪৫ সাধারণ অব্দে চুটুদের প্রতিস্থাপিত করে কদম্ব রাজবংশের সূচনা করেন ময়ূরশর্মা। এঁদের রাজধানী ছিল বৈজয়ন্তী (অধুনা বনবাসী)। পরিবর্ত/ বিকল্প রাজধানী ছিল পালাসিকা (অধুনা হালসি)। কদম্বরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। রাজা হওয়ার আগে এঁদের কাজ ছিল মূলত বেদ চর্চা এবং বৈদিক যজ্ঞ পরিচালনা করা। কদম্ব রাজবংশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজা ছিলেন কাকূস্থবর্মন (৪২৫-৪৫০ সাধারণ অব্দ)। একটা সময় এই রাজবংশ কিছুদিনের জন্য দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এঁদের রাজত্বকালের পুরো সময় জুড়েই লেগে ছিল পল্লব আর পশ্চিমি গঙ্গা-দের সাথে যুদ্ধবিগ্রহ। তবে এঁদের পতন হয়েছিল বাদামি চালুক্যদের হাতে। বাদামি চালুক্যরা যখন সাধারণ অব্দের পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময় আইহোলে থেকে রাজত্ব শুরু করেন তখন তাঁরা ছিলেন কদম্বদের করদ রাজা। ৫৪৩ সাধারণ অব্দে সাধারণ অব্দে বাদামি চালুক্য রাজা প্রথম পুলকেশী কদম্বদের অধীনতা অস্বীকার নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান বাদামীতে। ৫৬৫ সাধারণ অব্দে প্রথম পুলকেশীর পুত্র কীর্তিবর্মন-এর হাতে শেষ কদম্ব রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণবর্মন (মতান্তরে, তাঁর পুত্র অজয়বর্মন) পরাজিত হলে স্বাধীন কদম্ব রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে এবং বনবাসী হয়ে যায় বাদামি চালুক্য রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এর পরে কদম্বরা কয়েকটি শাখায় ভেঙে যায় এবং বাদামি চালুক্য, রাষ্ট্রকূট এবং কল্যাণী চালুক্যদের করদ রাজা হিসাবে পরবর্তী প্রায় পাঁচ’শ বছর রাজত্ব চালান। ওই শাখাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাখাগুলি হল গোয়ার কদম্ব, হালসির কদম্ব এবং হাঙ্গালের কদম্ব।
- ময়ূরশর্মা সম্পর্কিত উপরোক্ত গল্পের ভিত্তি হল ৪৫০ সাধারণ অব্দে লিখিত তালাগুণ্ডা লিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য। এছাড়াও ময়ূরশর্মা সম্পর্কে আরও কয়েকটি কাহিনি/ কিংবদন্তি রয়েছে। তবে ঐতিহাসিকরা সাধারণ ভাবে তালাগুণ্ডা লিপিকেই সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য করেন।
- পল্লবদের সম্পর্কে পাদটীকায় কিছু লিখলে পল্লবদের অপমান করা হবে। পল্লবদের সম্পর্কে লিখতে গেলে, এক বা একাধিক স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা লিখতে হয়।
- সমুদ্রগুপ্ত ঠিক কবে পল্লবদের আক্রমণ করেছিলেন এই নিয়ে কোন সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়না। বস্তুত সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল নিয়েই ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । এলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ) স্তম্ভলিপি অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্ত কাঞ্চিপুরমের রাজা বিষ্ণুগোপকে পরাজিত করেছিলেন। আবার পল্লব বংশলতিকায় বিষ্ণুগোপের নাম পাওয়া যায় না। খুব সম্ভবত বিষ্ণুগোপ কোন নাবালক পল্লব রাজার হয়ে রাজ্যশাসন করছিলেন সমুদ্রগুপ্তের আক্রমণের সময়।
তথ্যসূত্র
- K.A. Nilakanta Sastri, ‘The Illustrated History of South India, From Prehistoric Times to the Fall of Vijayanagar’; Oxford University Press, 2009.
- Noboru Karashima edited, ‘A concise history of South India – Issues & Interpretation’; Oxford University Press, 2014.
- https://en.wikipedia.org/wiki/Chutu_dynasty.
উপাদেয় স্টাইল।
পাদটীকা একটু পল্লবিত হলে তেমন ক্ষতি ছিল না। বিশেষ করে পল্লবকথা ইতিহাস সিলেবাসে তেমন নেই যেখানে।
শুধু পাতা দিয়েই পাতা ভরানোর চেষ্টা করব একবার
খুব ভাল লাগল। নতুন অনেক কিছু জানলাম। পল্লবদের নিয়ে পাদটীকা থাকলে আরও ভালো লাগত। ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ| পল্লবদের নিয়ে একতা স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা লিখব ফেসবুকে|