সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

দাও ফিরে সে নগর – দক্ষিণ মেক্সিকোয় আবিষ্কৃত নতুন মায়া নগরী

দাও ফিরে সে নগর – দক্ষিণ মেক্সিকোয় আবিষ্কৃত নতুন মায়া নগরী

ডিসেম্বর ৪, ২০২৪ ৪৫ 0

দোস্‌ লাগুনাস্‌ শহরের পূর্বে গভীর জঙ্গল ভেদ করে তীরের মত চলে গেছে হাইওয়ে নং ২৬৯। কাছেই বেলিজ্‌ আর গুয়াতেমালার সীমান্ত। একসময় য়ুকাতান উপদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত এই পুরো অঞ্চলটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এক ছিল। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসক, স্বাধীনতার পর ভূ-রাজনৈতিক দলাদলি ও মার্কিন হস্তক্ষেপ হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ইতিহাস অগ্রাহ্য করে কতগুলো এলোমেলো টেরাবাঁকা রেখা টেনে দিয়েছে মানচিত্রে। দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দাদের জন্য খুব চেনা ছবি।

তবুও ইতিহাস সহজে মোছা যায় না। এই অঞ্চল-ই একদা ছিল মায়া সভ্যতার আদিম লীলাভূমি। ইউরোপীয় আগমনের আগে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদি বাসিন্দারা যতগুলো সভ্যতা নির্মাণ করেছে, তার মধ্যে দর্শন, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে মায়ারা ছিল তুলনারহিত। ২০০ থেকে ৯০০ সাধারণাব্দের মধ্যে য়ুকাতান উপদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ছোট-বড় অসংখ্য নগর। পরিকল্পিত পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক কেন্দ্র, নগরের ব্যবহারের জন্য জলাধার আর বিখ্যাত ধাপ-কাটা পিরামিডের আকৃতিতে তৈরি মন্দির – সব দিক দিয়ে নগর পরিকল্পনায় মায়ারা অনেক ক্ষেত্রেই পাল্লা দিতে পারত আধুনিক বিশ্বের অনেক শহরের সময়ে। সমসাময়িক খুব কম ইউরোপীয় শহরকেই মায়াদের তৈরি নগরগুলির সমকক্ষ বলা চলে। এই ধ্রুপদী যুগে মায়া কৃষি ও সেচ, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যার মত ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিল। তাদের ভাষা ছিল অত্যন্ত উন্নত, লেখা হত এক অভিনব চিত্র-লিপি ব্যবহার করে।

মায়াদের নিয়ে ঐতিহাসিকদের প্রধান আকর্ষণ হল রহস্যে ঘিরে থাকা তাদের সভ্যতার পতন। স্প্যানিশ আগমনের বহু পূর্বেই মায়া সভ্যতার পতন হয়, পরিত্যক্ত হয় মায়া নগরগুলির অধিকাংশ। তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা স্প্যানিশ আগমনের পর পাদ্রীরা দায়িত্ব নিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। মায়া ভাষায় লেখা বহু বই তাঁরা ‘শয়তানী শিক্ষা’ আর ‘জাদুবিদ্যা’-র বই বলে পুড়িয়ে দেন। নথিভুক্ত এইরকম বইয়ের বহ্ন্যুৎসবের একটিতেই প্রায় ২৭-টি বই পড়ানো হয়েছিল বলে শোনা যায়। পরিস্থিতি এমন-ই যে মায়াদের হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে মাত্র চারটি (তার মধ্যে একটি অসম্পূর্ণ) বই আমাদের হাতে এসেছে যা মায়া সভ্যতার চিন্তা জগত-কে বোঝার জন্য আমরা ব্যবহার করতে পারি। লিখিত উপাদান ধ্বংস হয়ে গেলেও মায়াদের উত্তরপুরুষদের মধ্যে রয়ে গেছিল মৌখিক বিবরণ। তারও অনেকটা ধ্বংস হয়ে যায় ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় সিআইএ কর্তৃক গুয়াতেমালার বামপন্থী রাষ্ট্রপতি জ্যাকপো আর্বেঞ্জের উৎখাতের পর। মার্কিন সমর্থিত উগ্র-দক্ষিণপন্থী সামরিক হুন্টা ক্ষমতায় এসেই মায়া জনজাতি, যারা আর্বেঞ্জের কট্টর সমর্থক ছিল, তাদের উপর নামিয়ে আনে অত্যাচার। সেই অত্যাচার ক্রমে রূপ নেয় গণহত্যার, যাতে দেড় লক্ষের কাছে মায়া নিহত হন, স্বদেশ ছাড়া হন আরও নয় লক্ষ। ‘নিঃশব্দ গণহত্যা’ (‘Silent Holocaust’) নামে পরিচিত (কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের আগে এই বিষয়ে কেউই বিশেষ সোচ্চার হননি) এই ঘটনায় মায়া সভ্যতার মৌখিক সূত্রেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

তবুও তারপরে অত্যন্ত উদ্যমী কিছু ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভাষাবিদের কল্যাণে আমরা মায়া সভ্যতা সম্পর্কে আজ অনেকটাই জানি। মেক্সিকো, গুয়াতেমালা সহ সামগ্রিক ভাবে য়ুকাতানের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ফিরে আসার পর এঁদের প্রচেষ্টাতেই জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া একের পর এক বিশাল বিশাল নগরের আবিষ্কার ও তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ক্রমশঃ আবার রঙের সঞ্চার করছে মায়া সভ্যতার ধূসর মলিন স্মৃতিতে। এই প্রয়াসের নবতম সংযোজন দোস্‌ লাগুনাস্‌ শহরের পূর্বে হাইওয়ে নং ২৬৯-এর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এক নতুন মায়া নগরীর আবিষ্কার।

তুলানে ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্বের ডক্টোরাল গবেষক লুক অল্ড-টমাস হাইওয়ে নং ২৬৯ দিয়ে আগেও গিয়েছেন অনেকবার। কিন্তু প্রায় হাতের কাছেই যে জঙ্গলের মধ্যে এত বড় একটা শহর লুকিয়ে ছিল, তা তিনি কখনও টের পাননি। তবে য়ুকাতানের দুর্ভেদ্য অরণ্যে যে বহু অনাবিষ্কৃত মায়া নগরী লুকিয়ে আছে, তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন লুক। এই নগরগুলি পায়ে হেঁটে অভিযান করে খোঁজার চেষ্টা অবশ্য পন্ডশ্রম বলে মনে করতেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, বহু জায়গায় জঙ্গল এত ঘন যে কয়েক ফুট দূরের ধ্বংসাবশেষও চোখে পড়বে না কোনও অভিযাত্রীর, অথবা যে টিলার উপর দাঁড়িয়ে তিনি হারানো শহর খুঁজবেন সেটাই হয়তো মাটি চাপা পিরামিড। বিকল্প হিসেবে লুক প্রস্তাব দিয়েছিলেন একটি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা। এই প্রযুক্তির নাম ‘লিডার’ (Lidar)। এটি এমন একটি রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি যার মধ্যমে লেসার ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠে দূরত্ব মাপা হয়। এছাড়াও এর নানা ব্যবহার রয়েছে, যেমন পরিবেশবিদরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন জঙ্গলের ঘনত্ব পরিমাপ করতে। প্রত্নতত্ত্বে অবশ্য এতদিন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। মূলতঃ পরিবেশবিদ্যা, অরণ্যবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব-এর মত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা-ই ‘লিডার’ ব্যবহার করতেন। লুকের প্রস্তাব কিন্তু গৃহীত হয়নি। ‘খরচ সাপেক্ষ’-এই বলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল। হতোদ্যম না হয়ে লুক তখন খুঁজতে শুরু করেন ইতিমধ্যেই য়ুকাতানের কোনও ‘লিডার’ সার্ভে হয়েছে কি না। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন। লুক পেয়ে গেলেন ২০১৩ সালে মেক্সিকোর নেচার কন্‌জারভেন্সির করা একটা একটা ‘লিডার’ সার্ভে যা জঙ্গলের ভূ-তলে কার্বনের পরিমাপ করার সময় করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই সার্ভের যে তথ্য পাবলিক ডোমেইনে ছিল, প্রায় পাঁচ বছর ধরে তার প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন লুক ও তাঁর সহকর্মীরা। দুর্ভেদ্য জঙ্গল শত শত বছর যে রহস্য লুকিয়ে রেখেছিল, তার চাবিকাঠি মিলে যায় সেই বিশ্লেষণের মধ্যেই। প্রায় ছয় হাজার ছ’শোটি মায়া নির্মাণ এবং একটি আস্ত শহর খুঁজে পেলেন তাঁরা। এই গবেষণা তাঁরা প্রকাশ করেছেন এক মাস আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার ‘অ্যান্টিকুইটি’ জার্নালে।

নতুন আবিষ্কৃত এই এই শহরের নাম লুক ও তাঁর সহকর্মীরা দিয়েছেন ভালেরিয়ানা (Valeriana), কাছেই অবস্থিত একটি অগভীর হ্রদের নামে। প্রাথমিক অনুমানে মনে করা হচ্ছে আনুমানিক ১৫০ সাধারণাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত এই শহরটিতে ৭৫০ থেকে ৮৫০ সাধারণাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের রমরমার দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের বাস ছিল। মায়া শহরের মুল বৈশিষ্ট্যগুলি সবই উপস্থিত। ধাপকাটা পিরামিড আকৃতির মন্দির, প্রাসাদ, নাগরিক জমায়েতের উন্মুক্ত ক্ষেত্র, জলাধার, চওড়া রাজপথ – ভালেরিয়ানায় আছে সব-ই। ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ক্যাথরিন রিজ-টেলর এই আবিষ্কার সম্পর্কে বলেছেন আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি মাপের শহরে যে নগর পরিকল্পনা দেখা যায়, মায়া শহরটির নগর পরিকল্পনা প্রায় একই রকম। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক নৃতত্ত্বের অধ্যাপক সাইমন মার্টিন এই আবিষ্কার প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘এর ভিত্তিতে আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি এই অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র বিপুল সংখ্যায় মানুষ বাস করতেন।’ সাইমনের এই মন্তব্য সাম্প্রতিক মায়া গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রমশ জনপ্রিয় হওয়া একটি মতবাদের প্রেক্ষিতে। এই মতবাদের অনুসারীদের মতে কতগুলি বড় শহর ছাড়া য়ুকাতানে তেমন নগরায়ন হয়নি এবং মায়া জনসংখ্যা আগে যা মনে করা হত তার থাকে অনেক কম ছিল। ভালেরিয়ানা এবং তার আগেও পর পর অনেকগুলি মাঝারি মাপের মায়া নগরের আবিষ্কার এই মতামতকে জোরালো ধাক্কা দিচ্ছে। এই নগর ও নগরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আধা-নগর আধা-গ্রাম অঞ্চলগুলি বরং ইঙ্গিত দিচ্ছে উল্টো দিকে, যে আগে যা মনে করা হত তার থেকেও য়ুকাতানের মায়া সভ্যতা অধিক জনবহুল ও নগরকেন্দ্রিক ছিল। মার্টিন এই সূত্র ধরেই মন্তব্য করেছেন যে এতে রহস্য না কমে বরং আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ধ্রুপদী মায়া সভ্যতা এত উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা নির্মাণ করেও কীভাবে প্রায় মিলিয়ে গেল এবং স্প্যানিশ আগমনের আগেই মায়াদের সংখ্যা এত কমে গেল কীভাবে এর সন্তোষজনক উত্তর অধরাই থেকে যাচ্ছে।

লুক অল্ড-টমাস বলেছেন প্রত্নক্ষেত্রে হাতে কলমে পুরোদমে কাজ শুরু হওয়ার এখনও বিলম্ব রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই কিছু শৈল্পিক নিদর্শনের যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা খুবই আশাপ্রদ। তিনি বলেছেন, যে রাস্তায় তিনি একদা গাড়ি চালিয়ে গেছিলেন তার পাশের জঙ্গলেই একশো মিটার দূরত্বে এইরকম নগরের অবস্থান প্রমাণ করছে আগের মত পায়ে হেঁটে এই জঙ্গলের মধ্যে শহর খোঁজা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মত। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সাহায্য লাগবে। প্রয়োজন প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, ইতিহাস ও পরিবেশবিদ্যার মত বিষয়ের পারস্পরিক সহযোগিতাও। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ‘লিডার’ দিয়ে করা সার্ভের যে তথ্য দেখেছেন, সেই একই ডাটা পরিবেশবিদরাও দেখেছেন, কিন্তু তাঁরা মাপছিলেন জঙ্গলের মধ্যে কার্বনের মাত্রা, তাই একটা আস্ত শহর তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে তাঁরা যদি সার্ভের তথ্য জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে না দিতেন, তাহলে এই শহর আবিষ্কৃত হত না। এই প্রেক্ষিতেই লুক উন্মুক্ত তথ্যের সপক্ষেও সওয়াল করেছেন। প্রথম যখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে জঙ্গলে লুকনো শহর খোঁজার সওয়াল করেছিলেন লুক, তখন তার জন্য অর্থ মঞ্জুর হয়নি। এইবার যখন এর কার্যকারিতা প্রমাণিত, তখন তা অবশ্যই হবে। য়ুকাতান উপদ্বীপের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বহু মায়া শহর আগামী কয়েক বছরে আবিষ্কৃত হবে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। প্রশ্ন থেকে যায় এক জায়গাতেই, এই পুরো আলোচনায় এইবারও বাদ থেকে গেলেন মায়ারা। তাঁরা বিলুপ্ত জনজাতি নন, ঐ অঞ্চলে এখনও তাঁদের বাস। লুক নিজেই তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, নিঃসন্দেহে স্থানীয় মায়ারা জানতেন কাছেই ঐরকম একটি শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, কিন্তু তাঁরা কখনও কাউকে সে কথা বলেননি। এই ঐতিহ্য তো শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই। বহিরাগতদের সম্পর্কে ইতিহাসের শিক্ষা নিয়েই তাঁরা সন্দিহান থেকে তা গোপন রেখেছিলেন। তাই তাঁদের মতামত এড়িয়ে কী উৎখনন নৈতিক হবে ? এই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।      

খবরটি দিয়েছেন অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত।

নিচের লিংকে গিয়ে পুরো খবরটি পড়তে পারেন–

https://www.nytimes.com/2024/11/02/world/americas/maya-city-mexico.html

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: ‘লিডারে’ ধরা দেওয়া ভালেরিয়ানা শহর (সৌজন্যে –  লুক অল্ড-টমাস ও অন্যান্য/কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস)

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।