প্রাচীন ভারতে বিবাহের ধারণার ক্রমবিবর্তন
ক্রমবিবর্তনের রূপরেখা
ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক জনগোষ্ঠীদের বিবাহের ধারণা সম্পর্কে প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে ঋগ্বেদের বিবাহ সূক্তে (১০.৮৫)। সাধারণপূর্বাব্দের প্রথম সহস্রাব্দ জুড়ে রচিত বৈদিক সাহিত্য থেকে তৎকালীন বৈদিক জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্কিত ধারণার ক্রমিক বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকে রচিত কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার সংহিতায় (৬.১.৬.৬) উল্লেখ করা হয়েছে পিতা তাঁর কন্যাকে অন্য একটি পরিবারকে দান করেন (অর্থাৎ, কোন ব্যক্তিকে নয়)। এর বেশ কয়েক শতাব্দী পর, এই প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায় এই তৈত্তিরীয় শাখারই আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে (২.১০.২৭.৩), যেখানে বলা হয়েছে, নারীদের অন্য একটি কুলে দান করা হয় (কোন ব্যক্তিকে নয়)। আদি মধ্যযুগে লেখা স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থে অধুনালুপ্ত বৃহস্পতির ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত শ্লোকেও এই রীতির উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে উল্লিখিত দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডব ভ্রাতাদের বিবাহও এই প্রাচীন প্রথার স্মারক। সংস্কৃতে ‘দেবর’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থও এই প্রাচীন বিবাহ প্রথারই ইঙ্গিতবাহক।
আলোচ্য সহস্রাব্দের প্রথম কয়েক শতকের মধ্যে, ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে, বিশেষত উত্তর ভারতে, কৃষির বীজ ও প্রযুক্তির উন্নতি ও বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে সমাজের উচ্চবর্গের মানুষদের ভূমি ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর ফলে, ব্যক্তিগত সম্পদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনে উচ্চবর্গের মানুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। ক্রমশ বিবাহ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত হয়। মহাভারতের আদিপর্বে (পুণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের ১১৩ অধ্যায়) পাণ্ডু ও কুন্তীর মধ্যে কথোপকথনে উল্লিখিত পুরাকালে ঋষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু কর্তৃক স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণের বর্ণনায় বিবাহের সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে উদ্ভব সংক্রান্ত তৎকালীন প্রচলিত পুরাকথার সন্ধান পাওয়া যায়। এই কালপর্বে, একদিকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিভিন্ন যৌন সম্পর্কগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা ও অন্যদিকে তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পতি ও পত্নী চয়নের পদ্ধতির বিভিন্নতাকে একটি সাধারণ ধারণার অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রয়াস বৈদিক শাস্ত্রকাররা শুরু করেছিলেন, তার নিদর্শন প্রথমে গৃহ্যসূত্র ও পরে ধর্মসূত্র পর্যায়ের গ্রন্থগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রয়াস চূড়ান্ত রূপগ্রহণ করে ছয় বা আট প্রকারের প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের ধারণায়।
ঋগ্বেদসংহিতার একাধিক সূক্তে (১.১২৪.৮, ৭.২.৫, ১০.৮৬.১০ ও ১০.১৬৮.২) বর্ণিত ‘সমন’ উৎসবে অনূঢ়া যুবতিরা পতিলাভের উদ্দেশ্যে সুসজ্জিতা হয়ে অবিবাহিত যুবকদের সঙ্গে মিলিত হতেন। রামায়ণ, মহাভারত এবং পৌরাণিক সাহিত্যে বারংবার স্বয়ংবর বিবাহ রীতির উল্লেখ করা হয়েছে। পালি জাতক গ্রন্থের অন্তর্গত কুলাবক জাতক ও কুণাল জাতকেও স্বয়ংবর বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত প্রাচীন বৈদিক জনগোষ্ঠীদের মধ্যে নারীদের পতি চয়নের রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু, প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মধ্যভাগ থেকে শাস্ত্রকারদের বিবাহরীতির ধারণায় কেবল পুরুষদেরই পত্নী চয়নের পদ্ধতির স্থান রয়েছে; নারীদের স্বয়ংবর বা অন্য কোনভাবে পতি চয়নের কোন পদ্ধতি এই ধারণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। গৃহ্যসূত্র বা ধর্মসূত্র গ্রন্থসমূহে ‘স্বয়ংবর’ শব্দের উল্লেখমাত্র নেই। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যে দেখা যায়, বিদর্ভরাজকন্যা ইন্দুমতী স্বয়ংবরসভায় রাজকুমার অজকে মাল্যদান করার (৬.৮৩) পরও আবার তাঁদের শাস্ত্রীয় বিধি (অর্থাৎ ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি) অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় (৭.১৮-২৯)। সম্ভবত আলোচ্য কালপর্বে এইভাবেই স্বয়ংবর বিবাহকে ধর্মসম্মত রূপ দেওয়ার ধারণা প্রচলিত ছিল।
মনুস্মৃতিতে বিবাহের প্রকার
মানবধর্মশাস্ত্র বা মনুস্মৃতি আনুমানিক সাধারণাব্দের দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের রচনা বলে বর্তমানে আধুনিক বিদ্বানরা মনে করেন। মানবধর্মশাস্ত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয় বিবাহ। এই অধ্যায়ের ২০-৩৪ সংখ্যক শ্লোকে এই আট প্রকারের বিবাহ নিয়ে যে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে, তা খুব সম্ভবত প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের ধারণার পরিচায়ক। মানবধর্মশাস্ত্রের মতে বিবাহের আটটি প্রকার হল – ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। এর মধ্যে পৈশাচ সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এই আট প্রকার বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্মণদের জন্য প্রথম ৬ প্রকার, অর্থাৎ, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর ও গান্ধর্ব; ক্ষত্রিয়দের জন্য শেষ ৪ প্রকার, অর্থাৎ, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ এবং বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য কেবল আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ ধর্মসম্মত, অর্থাৎ আইনসঙ্গত বলে মানবধর্মশাস্ত্রের বিধান। মানবধর্মশাস্ত্র উল্লেখ করেছে যে, বিদ্বানরা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রথম ৪ প্রকার, অর্থাৎ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ ও প্রাজাপত্য; ক্ষত্রিয়দের জন্য কেবলমাত্র রাক্ষস এবং বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য কেবলমাত্র আসুর বিবাহকে অনুমোদন করেছেন। কিন্তু, মানবধর্মশাস্ত্র অনুসৃত ঐতিহ্য অনুযায়ী আসুর ও পৈশাচ বিবাহ কোন মতেই কর্তব্য নয় (অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য ও গান্ধর্ব, ক্ষত্রিয়দের গান্ধর্ব ও রাক্ষস এবং বৈশ্য ও শূদ্রদের কেবল গান্ধর্ব বিবাহ কর্তব্য)। ক্ষত্রিয়দের জন্য মিশ্র গান্ধর্ব ও রাক্ষস বিবাহকেও মানবধর্মশাস্ত্রে স্বীকার করা হয়েছে।
মানবধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যখন কোন চরিত্রবান ও শীলসম্পন্ন ব্যক্তিকে স্বয়ং আহ্বান করে নিজের কন্যাকে বস্ত্রালঙ্কারে আচ্ছাদিত করে অর্চনাপূর্বক তাঁকে দান করেন, ঐ বিবাহ ব্রাহ্ম বিবাহ নামে জ্ঞাত (৩.২৭)। কোন ব্যক্তি যখন কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠান চলাকালীন, ঐ যজ্ঞের ঋত্বিককে নিজের কন্যাকে অলঙ্কৃত করে দান করেন, সেই বিবাহকে দৈব বিবাহ নামে পরিচিত (৩.২৮)। কোন ব্যক্তি যখন ধর্মসম্মতভাবে বরের কাছ থেকে একটি বা দুটি গোমিথুন (একটি গরু ও একটি ষাঁড়) গ্রহণ করে নিজের কন্যাকে বিধি অনুযায়ী প্রদান করেন, ঐ বিবাহকে আর্ষ বিবাহ বলা হয় (৩.২৯)। কোন ব্যক্তি যখন তাঁর কন্যা ও জামাতাকে ‘তোমরা একত্রে ধর্মাচরণ কর’ বলে অর্চনাপূর্বক কন্যা দান করেন, সেই বিবাহ বিধি প্রাজাপত্য (৩.৩০)। স্বেচ্ছায় কন্যার জ্ঞাতিদের এবং কন্যাকে যথাশক্তি ধনদান করার পর যখন কোন ব্যক্তিকে কন্যা প্রদান করা হয়, তখন সেই বিবাহকে আসুর বিবাহ বলে (৩.৩১)। যখন, বর ও কন্যা স্বেচ্ছায় একে অপরের সঙ্গে মিলিত হন, কামনা থেকে উৎপন্ন সেই মৈথুনকর্ম গান্ধর্ব বিবাহ নামে জ্ঞাত (৩.৩২)। হনন, অঙ্গচ্ছেদন ও প্রাকারাদি ভেদ করে, যখন, কেউ, তীক্ষ্ণ চীৎকার ও ক্রন্দনরত কন্যাকে বলপূর্বক অপহরণ করে তাকে রাক্ষস বিবাহ বিধি বলা হয় (৩.৩৩)। নিদ্রিতা, নেশাগ্রস্তা বা মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে যখন কেউ গোপনে ধর্ষণ করে, সেই পাপকর্ম, অষ্টম পৈশাচ, সর্বাপেক্ষা অধম বিবাহ রীতি (৩.৩৪)।
মানবধর্মশাস্ত্র (৩.৩৯-৪০) অনুযায়ী, প্রথম চার প্রকারের, অর্থাৎ, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ ও প্রাজাপত্য বিবাহের পর দম্পতিদের বেদজ্ঞানসম্পন্ন ও শিষ্টজনের কাছে সম্মানপ্রাপ্ত পুত্রসন্তান প্রাপ্তি হয়। ঐ সন্তান রূপবান, সদ্গুণসম্পন্ন, ধনবান, যশস্বী হয়ে, পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্পদ ভোগ ও ধর্মনিষ্ঠা পালন করে একশত বছর জীবিত থাকে। মানবধর্মশাস্ত্রে যেভাবে বিবাহের প্রকারের সঙ্গে সুসন্তান লাভকে যুক্ত করা হয়েছে, সেই ধারণারও সূচনা হয়েছিল পূর্ববর্তী সহস্রাব্দে।
গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্রে বিবাহের প্রকার
মানবধর্মশাস্ত্রের আট প্রকারের বিবাহের ধারণা সম্ভবত সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কয়েক শতক ধরে শাস্ত্রীয় পরিমণ্ডলে প্রচলিত ছিল। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী পঞ্চম-চতুর্থ শতকের রচনা বলে অনুমান করা হয়। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের ষষ্ঠ কণ্ডিকায় আট প্রকারের বিবাহের বর্ণনা করা হয়েছে। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের বিবাহ রীতিগুলির ক্রম অবশ্য মানবধর্মশাস্ত্র থেকে পৃথক – ব্রাহ্ম, দৈব, প্রাজাপত্য, আর্ষ, গান্ধর্ব, আসুর, পৈশাচ ও রাক্ষস। এই বিবাহ রীতিগুলি নিয়ে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের বর্ণনার সঙ্গে মানবধর্মশাস্ত্রের বর্ণনারও কিছু পার্থক্য আছে। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের মতে নিদ্রিতা বা মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে অপহরণ পৈশাচ বিবাহ, এবং আর্ষ বিবাহে একটি গোমিথুনের কথা বলা হয়েছে। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী প্রথম চার প্রকারের বিবাহের পর দম্পতিদের পুত্র সন্তান, যথাক্রমে দ্বাদশ, দশ, আট ও সাত ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন পুরুষকে পবিত্রতা প্রদান করে। অপহৃতা বা ধর্ষিতা নারী গর্ভবতী হলে তাঁর সন্তানের আইনগত স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে উদ্ভাবিত পৈশাচ বিবাহের ধারণার সূত্রপাত এই কালপর্বে শুরু হয়। এই গ্রন্থের সংযোজন হিসাবে আদি মধ্যযুগে রচিত আশ্বলায়ন গৃহ্যপরিশিষ্টে (৬.২) গান্ধর্ব, আসুর, পৈশাচ ও রাক্ষস বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহের পর আইনসম্মত করার উদ্দেশ্যে হোমের অনুষ্ঠান করার যে উল্লেখ রয়েছে, সেই ঐতিহ্যের সূত্রপাতও সম্ভবত সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কোন শতকে।
কৃষ্ণযজুর্বেদের মৈত্রায়ণীয় শাখার অন্তর্গত মানব ও বারাহ শাখার দুটি গৃহ্যসূত্র নিঃসন্দেহে সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ের রচনা। মানব গৃহ্যসূত্রের প্রথম পুরুষের সপ্তম খণ্ডে (১১-১২) ও বারাহ গৃহ্যসূত্রের দশম খণ্ডে (১১-১২) কেবলমাত্র দুই প্রকারের বিবাহের উল্লেখ রয়েছে, ব্রাহ্ম ও শৌল্ক। এই ধারণা অবশ্যই অতি প্রাচীন, খুব সম্ভবত বরপণ ও কন্যাপণ, দুটি পরিবারের মধ্যে সম্পদ বিনিময়ের প্রাচীন প্রথার জ্ঞাপক। এই দুই গৃহ্যসূত্রে কন্যাশুল্ক হিসাবে একশত রথ বা একটি গোমিথুন নির্ণীত হয়েছে। কৃষ্ণযজুর্বেদের কাঠক শাখার গৃহ্যসূত্রেও কেবল দুই প্রকার বিবাহ বিধি বর্ণিত হয়েছে, ‘ব্রহ্মদেয়’ (১৫.১) ও ‘শুল্কদেয়’ (১৬.১)। কাঠক গৃহ্যসূত্রে (১৬.২) কন্যাশুল্ক হিসাবে সুবর্ণ দিতে বলা হয়েছে।
অথর্ববেদের শৌনক শাখার গৃহ্যসূত্র বলে পরিচিত কৌশিকসূত্রও প্রাচীন, অবশ্যই প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মধ্যবর্তীকালের রচনা। কৌশিকসূত্রের দশম অধ্যায়ের পাঁচটি কণ্ডিকায় (৭৫-৭৯) বিবাহের বর্ণনা রয়েছে। এই বিবাহের বর্ণনায় কন্যাশুল্কের উল্লেখ রয়েছে (৭৯.১৭-১৯)। কৌশিকসূত্র অনুযায়ী এই বিবাহ রীতি সৌর্য বিবাহ (৭৯.৩১)। কৌশিকসূত্রের মতে (৭৯.৩২-৩৩) অন্য দুটি বিবাহ রীতি ‘ব্রাহ্ম্য’ ও ‘প্রাজাপত্য’; এই দুই বিবাহের মধ্যে মূল পার্থক্য, ব্রাহ্ম্য বিবাহে মন্ত্র উচ্চারিত হয় কিন্তু প্রাজাপত্য বিবাহে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় না।
আপস্তম্ব ধর্মসূত্র একটি প্রাচীনতর ধর্মসূত্র, আধুনিক বিদ্বানদের মতে আনুমানিক সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী চতুর্থ-তৃতীয় শতকে রচিত। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে (১.৫.১১.১৭-২০, ১.৫.১২.১-৩) কেবল ছয় প্রকার বিবাহের উল্লেখ আছে – ব্রাহ্ম, আর্ষ, দৈব, গান্ধর্ব, আসুর ও রাক্ষস। সম্ভবত এই ধারণাটি কোন প্রাচীনতর ঐতিহ্যের পরিচায়ক। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের মতে ব্রাহ্ম, আর্ষ ও দৈব বিপরীত অনুক্রমে উত্তরোত্তর শ্রেয়্কর। বসিষ্ঠ ধর্মসূত্র তুলনামূলকভাবে অনেক নবীন, সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী দ্বিতীয় শতাব্দীর রচনা বলে আধুনিক বিদ্বানরা অনুমান করেন। বসিষ্ঠ ধর্মসূত্রও (১.২৮-৩৫) আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের মতই ছয় প্রকার বিবাহের উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে চার প্রকার বিবাহের নাম আমাদের পরিচিত – ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ ও গান্ধর্ব; এবং দুটি অপরিচিত – ক্ষাত্র ও মানুষ। বসিষ্ঠ ধর্মসূত্রের বর্ণনা থেকে চিহ্নিত করা যায়, ক্ষাত্র ও মানুষ বিবাহের রীতি যথাক্রমে অন্য শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত রাক্ষস ও আসুর বিবাহের সঙ্গে এক। সাধারণাব্দের দ্বাদশ শতকে ভট্ট লক্ষ্মীধরের লেখা স্মৃতিনিবন্ধ গ্রন্থ ‘কৃত্যকল্পতরু’র গৃহস্থকাণ্ডে উদ্ধৃত অধুনালুপ্ত হারীত ধর্মসূত্রে উল্লিখিত আট প্রকারের বিবাহ রীতি – ব্রাহ্ম, দৈব, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস, পৈশাচ, মানুষ ও ক্ষাত্র। এখানে মানুষ ও ক্ষাত্র বিবাহ বলতে ঠিক কি বোঝান হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়।
গৌতম ধর্মসূত্র আধুনিক বিদ্বানদের মতে আনুমানিক সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকের রচনা। গৌতমধর্মসূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ে (৬-১৫) আট প্রকারের বিবাহের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এখানে উল্লিখিত বিবাহের ক্রম আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ও মানবধর্মশাস্ত্র উভয়ের থেকেই পৃথক – ব্রাহ্ম, প্রাজাপত্য, আর্ষ, দৈব, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ। গৌতম ধর্মসূত্রের মতে, কেবলমাত্র প্রথম চার প্রকারের বিবাহ ‘ধর্ম্য’ (আইনসম্মত), অবশ্য, প্রথম ছয় প্রকারের বিবাহকেই ‘ধর্ম্য’ (আইনসম্মত) বলে কেউ কেউ মনে করেন সেকথাও গৌতম ধর্মসূত্র জানিয়েছে।
কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার বৌধায়ন ধর্মসূত্র আধুনিক বিদ্বানরা আনুমানিক সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী দ্বিতীয় শতকের রচনা বলে মনে করেন। বৌধায়ন ধর্মসূত্রেও (১.১১.২০.১-১৬) আট প্রকার বিবাহের কথা বলা হয়েছে এবং গৌতমধর্মসূত্রের ক্রম অনুসৃত হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্র অনুযায়ী, ব্রাহ্মণদের জন্য ব্রাহ্ম, প্রাজাপত্য, আর্ষ ও দৈব বিবাহ বিপরীত অনুক্রমে শ্রেয়তর, এবং আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ বিবাহ উত্তরোত্তর পাপজনক। ক্ষত্রধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে আসুর ও রাক্ষস বিবাহ ক্ষত্রিয়দের জন্য প্রশস্ত। বৌধায়ন ধর্মসূত্র মনে করত কৃষক ও সেবকের কাজ করে বলে বৈশ্য ও শূদ্রদের পত্নীদের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল, আর তাই, তাঁদের জন্য গান্ধর্ব ও পৈশাচ বিবাহ প্রশস্ত। বৌধায়ন ধর্মসূত্র এও জানিয়েছে, প্রেম থেকে উৎসারিত বলে কেউ কেউ সমস্ত বর্ণের জন্য গান্ধর্ব বিবাহ সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় বলে করেন।
অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার পৈঠীনসি গৃহ্যসূত্র বর্তমানে লুপ্ত। সম্ভবত এই গৃহ্যসূত্র সাধারণাব্দের প্রথম কয়েক শতকের কোন সময় রচিত হয়েছিল। ‘কৃত্যকল্পতরু’র গৃহস্থকাণ্ডে উদ্ধৃত পৈঠীনসি গৃহ্যসূত্রেও আট প্রকারের বিবাহের উল্লেখ আছে। এই গৃহ্যসূত্রে ব্রাহ্মণদের জন্য ব্রাহ্ম, প্রাজাপত্য, আর্ষ ও দৈব, ক্ষত্রিয়দের জন্য গান্ধর্ব ও আসুর, বৈশ্যদের জন্য রাক্ষস ও শূদ্রদের জন্য পৈশাচ বিবাহ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আর্ষ বিবাহকে সমস্ত বিবাহ রীতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা মান্য বলে উল্লিখিত হয়েছে। তবে, আর্ষ শব্দের অর্থ এখানে ‘বেদবাক্য’।
অর্থশাস্ত্রে বিবাহের প্রকার
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্ভবত মৌর্য সাম্রাজ্যের অবসানের অব্যবহিত পরবতী কালের রচনা। সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী সহস্রাব্দের অন্তিম পর্বে রচিত এই গ্রন্থেও আট প্রকারের বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় অধিকরণের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম প্রকরণে উল্লিখিত বিবাহের ক্রম গৌতম ধর্মসূত্রের সঙ্গে এক। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, প্রথম চার প্রকারের বিবাহের ক্ষেত্রে কেবল কন্যার পিতা স্বীকার করলেই সেই বিবাহ ‘ধর্ম্য’ (আইনসম্মত) হবে। শেষ চার প্রকারের বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার পিতা ও মাতা উভয়ে স্বীকার করলে, তবে ঐ বিবাহ ‘ধর্ম্য’ হবে। অর্থশাস্ত্রের মতে, (আসুর বিবাহে) কন্যাশুল্ক (কন্যাপণ) কন্যার পিতা ও মাতা উভয়কেই দিতে হবে; কেবলমাত্র একজনের অবর্তমানে অন্যজন সম্পূর্ণ পরিমাণ শুল্ক পাবেন। কোন কন্যার দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কন্যাশুল্ক তিনি একা পাবেন।
উপসংহার
প্রাচীন ভারতের শাস্ত্র নির্দেশিত বিবাহ রীতির অন্তর্ভুক্ত না হলেও নারীদের পতি চয়নের অধিকার সম্বন্ধে শাস্ত্রকাররা সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন একথা বলা যায় না। বসিষ্ঠ ধর্মসূত্রে (১৭.৬৭-৬৮) নারীদের ঋতুমতী হবার পর তিন বর্ষের মধ্যে পিতা বিবাহ না দিতে পারলে, নিজেই সমতুল্য পতি চয়ন করে বিবাহের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। একই মত পরবর্তীকালে মানবধর্মশাস্ত্রে (৯.৯০-৯১) প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে (৪.১.১৪) ঋতুমতী হবার পর চতুর্থ বর্ষে পিতা বিবাহ না দিতে পারলে এবং সমতুল্য পতি না খুঁজে পেলে তুলনামূলকভাবে গুণহীন পতি চয়নেরও অধিকার দেওয়া হয়েছে। গৌতম ধর্মসূত্রে (১৮.২০) নারীদের পিতার কাছ থেকে পাওয়া কোন অলঙ্কার না নিলে, ঋতুমতী হবার পর তিন মাস বাদেই পতি চয়ন করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। মানবধর্মশাস্ত্রেও (৯.৯২) নিজে পতি চয়ন করে বিবাহ করলে পিতা, মাতা বা ভ্রাতার কাছ থেকে পাওয়া কোন অলঙ্কার সঙ্গে না নিয়ে যেতে নির্দেশ দেওয়া আছে।
মানবধর্মশাস্ত্রের পরবতীকালে সাধারণাব্দের প্রথম সহস্রাব্দে রচিত প্রায় অধিকাংশ ধর্মসূত্র (যেমন, বিষ্ণু ধর্মসূত্র ২৪.১৭-৩৭), ধর্মশাস্ত্র (যেমন, নারদস্মৃতি দ্বাদশ বিবাদপদ, ৩৮-৪৩, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি ১.৫৮-৬১) ও পৌরাণিক সাহিত্যে (যেমন, বিষ্ণুপুরাণ ৩.১০.২৪) আট প্রকার বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত মানবধর্মশাস্ত্রের প্রভাব এই কালপর্বের শাস্ত্রীয় পরিমণ্ডলে অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। কিন্তু, কার্যত, এই সহস্রাব্দে, ভারতের উচ্চবর্গীয় সমাজে সম্ভবত একমাত্র ব্রাহ্ম বিবাহই শাস্ত্রীয় বলে স্বীকৃত হত। অবশ্য, সাধারণাব্দের তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় অর্ধে রচিত মল্লনাগ বাৎস্যায়নের ব্যতিক্রমী ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে (৩.৫.২৮-৩০) ব্রাহ্ম বিবাহের শাস্ত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেও পরস্পর অনুরাগবশত কৃত গান্ধর্ব বিবাহকেই সর্বোৎকৃষ্ট বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আনুমানিক সাধারণাব্দের পঞ্চম শতকে রচিত, বর্তমানে বিলুপ্ত ‘আদিত্যপুরাণ’ গ্রন্থের কবিকঙ্কণ গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ গ্রন্থে উদ্ধৃত অংশে গান্ধর্ব বিবাহের প্রশংসা করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. K.V.R. Aiyangar ed., “Kṛtyalkalpataru of Bhaṭṭa Lakṣmīdhara, Vol. II, Gṛhasthakāṇḍa,” Baroda: Oriental Institute, 1944, pp. 71, 76.
২. W. Caland, “The Kāṭhakagṛyhasūtra,” Lahore: The Research Department, D.A.V. College, 1925, pp. 57, 61.
৩. P.V. Kane, “History of Dharmaśāstra. Vol.II, Part I,” Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute, 1941, pp. 516-526.
৪. A.B. Keith tr., “The Veda of the Black Yajus School entitled Taittiriya Sanhita. Part II: Kāṇḍas IV-VII,” Cambridge, Massachusetts: The Harvard University Press, 1914, p. 493.
৫. P. Olivelle ed. and tr., “Dharmasūtras: The Law Codes of Āpastamba, Gautama, Baudhāyana and Vasiṣṭha,” Delhi: Motilal Banrasidass, 2000.
৬. P. Olivelle ed. and tr., “Manu’s Code of Law: A Critical Edition and Translation of the Mānava-Dharmaśāstra,” New York: Oxford University Press, 2005.
৭. R. Pandey, “Hindu Saṃskāras,” Delhi: Motilal Banarsidass, 1969, pp. 158-171.
৮. Raghu Vira ed., “Vārāha-Gṛhyasūtra with short extracts from the Padhatis of Gangādhara and Vasistha,” New Delhi: Panini, [1982] 1932, p. 29.
৯. পুরুষোত্তমশাস্ত্রী গোবিন্দ রানডে সম্পাদিত, “আশ্বলায়নগৃহ্যসূত্রম্. আনন্দাশ্রমসংস্কৃতগ্রন্থাবলী গ্রন্থাঙ্ক ১০৫,” পুণাখ্যপত্তন: আনন্দাশ্রম মুদ্রণালয়, ১৯৩৬, পৃ. ১৪.
১০. R.H. Sastri, “Mānavagṛhyasūtra of the Maitrāyaṇīya Śākhā with the commentary of Aṣṭāvakra,” Baroda: Central Library, 1926, p.44.
১১. T.G. Śāstrī ed., “The Arthaśāstra of Kauṭalya, Part II,” Trivundrum: Superintendent, Government Press, 1924, pp. 12-13.
১২. D. Shastri ed., “The Kāmasūtra by Srī Vātsyāyana Muni with the Commentary Jayamangala of Yashodhara, The Kāshi Sanskrit Series, No. 29,” Benares: The Chowkhamba Sanskrit Office, 1929, pp. 198-199.
১৩. K. Shastri, “Samana (Samana Festrival)” in S.M. Katre and P.K. Gode ed. “New Indian Antiquary, Vol. II, 1939-40,” Bombay: Karnatak Publishing House, 1940, pp. 156-162.
১৪. L. Srinivasacharya, “Smritichandrika by Devana-Bhatta, 1. Samskara Kanda,” Mysore: Government Branch Press, 1914, p. 26.
১৫. অতুল সুর, “ভারতের বিবাহের ইতিহাস,” কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৭, পৃ.২২, ২৮-৩২.
খুব সুন্দর গবেষণাধর্মী রচনা। তবে ব্রাহ্মণ্য সমাজের বাইরের অর্থাৎ বৌদ্ধ জৈন ইত্যাদি ধর্মানুলম্বী মানুষেরাও কি এইসব বিবাহরীতি মেনে চলতেন?
খুব ভালো। সমৃদ্ধ হলাম।❤️
খুব সুন্দর।
খুবই সুন্দর ভাবে বলা হয়েছে।
গৌতম ও কৌটিল্যের বর্ণিত শেষ চার প্রকার বিবাহ (গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস, পৈশাচ) সমাজের সেইসব অংশে প্রচলিত ছিল যেখানে নারী নিজে উপার্জন করত, তাই তার ভবিষ্যৎ আয়ের তুল্যমূল্য তার পিতামাতা বরের কাছ থেকে পেত ক্ষতিপূরণ হিসেবে। যেহেতু এই সমাজে নারীর নিজের উপার্জন ছিল অতএব পণের টাকা মেয়ের মাও পেতেন। এটা আমার অনুমান।